শব্দ তো ভদ্রলোকের সব সভ্যতা ভেঙে দেয়
পড়ুন কথোপকথনের প্রথম পর্ব ► আমাদের নাম ইতিহাসে উঠে গেছে [ভূমিকা: আনু মুহাম্মদ]
পড়ুন কথোপকথনের দ্বিতীয় পর্ব ► প্রচলিত লোকগল্প আস্তে আস্তে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে!
পড়ুন কথোপকথনের তৃতীয় পর্ব ► শব্দ তো ভদ্রলোকের সব সভ্যতা ভেঙে দেয়
ইলিয়াস: শবরদের মেলাটা কবে শুরু হয়েছিল?
দেবী: শবরদের মেলাটা হচ্ছে ৯১ সাল থেকে। কারণ, শবররা যখন এতটা জাগ্রত হয়ে একটা জায়গায় মিলিত হতে চায়, তখন মহাগড়ে প্রথম মেলা হলো। ৯১ সালের মেলাতে আমরা সংবর্ধনা জানিয়েছিলাম চুনিকোটার...কে, ও তো পরে ৯২ সালে আত্মহত্যাই করল। মেলার ব্যাপার হচ্ছে, প্রস্তুতি যে হবে, এখানে মেলা হবে, এই দিক থেকে চাল, ডাল, পুরোনো জামাকাপড়, যা ব্যবহারযোগ্য সবটুকু তৈরি করা, চাঁদার টাকা তোলা, বিশাল কাজ। একটা কলকাতায় আমার ওপর দিয়ে যায়। সেদিকে ওরা বেশি তাকিয়ে থাকে। পুরুলিয়া জেলা থেকে অল্প কিছু আসে, পুরুলিয়া এমনিতে গরিব জেলা, যদিও নর্থ পুরুলিয়াতে কিছু ধনী লোক আছে। এখন এই যে মেলাটা হয়, এই মেলার যে প্রস্তুতি, এবেলা কম করে ১০/১১ হাজার, ওবেলা ১০/১১ হাজার। ওরা কিন্তু ৩ দিন খায়। তার মানে, ৩ দিনে আমরা ৬০ হাজার লোককে খাওয়াই, কম করে হলেও। বহিরাগত অনেকে আসেন, তারা অত খানও না, আর ওদের খাওয়াটা আমি ধরছিও না। খাওয়ানো হয় শুধু খিচুড়ি তরকারি। কিন্তু এই যে লোক আসে, ওরা অনেক আগে থেকেই আশপাশে যে শুঁড়িখানার যে নির্দেশনা থাকে... মদের দোকান খুলবে না, মদ বিক্রি হবে না।
ইলিয়াস: এটা কি ওরা নিজেরাই...?
দেবী: ওরা নিজেরাই। কেননা ওরা জানে যে, ওদের মদ ছাড়া উচিত। একজন শুঁড়ি বলল, হ্যাঁ, তোরা এখন বন্ধ করে দিলি। যদি কিছু হয়েই যায়। আর শবররা ওর দিকে তাকিয়ে বলল, এখন তো সকাল, এখনই যদি কিছু হয়ে যায়, তুই ঠেকাতে পারবি? ধর, তোর দোকানটা রইল না, তুই কিছু করতে পারবি? শবরকে সবাই ভয় পায়, কিছুই করা গেল না। সে শুঁড়িরা এখন এসে খুব বাধ্য হয়ে ওখানে বসে খিচুড়ি খেয়ে চলে গেল। এবং ওরা এই তিন দিন কোনো ভাত খায়নি। আর সমস্ত জিনিসটা একটা মাটির মঞ্চ আছে, শবররাই সংগঠক। ডিএম, এসপি এ ধরনের লোকেরা সবাই আসে। তারা মাটিতে বসে। শবররা মঞ্চে বসে। শবররাই সমস্ত... সব জিনিসটাই ওরা সংগঠিত করে। রান্না ওরা করে। পরিবেশন ওরা করে। কিন্তু সব জিনিসটাই এত নীরবে আর এত সুশৃঙ্খল হয় যে যারাই দেখে, খুব অবাক হয়। তারপর অবশ্য মেলার ৩ দিন পরে ৪০/৫০ জন ছেলে থেকেও যায়। তারা বাকিটাও ওআইন্ডআপ করে, ডেকোরেটর-টেকোরেটর তুলে দিতে হবে, এটা করতে হবে, সেটা করতে হবে। তারা ভাত খাবে সেদিন। তা আমাদের বীরেন ঠাকুর যে এত দিন ধরে রান্নায় দাঁড়িয়ে বলেছে এটা ফ্যাল, ওটা দে, তদারক করেছে। সেদিন বলা হয়েছে বীরেন ঠাকুর রান্না করবে, ভাত রান্না করবে। গোপীবল্লভ সিংহ, তিনি ওই যে আমাদের...গোপী বীরেনকে বলেছে, বেলা আড়াইটার সময় ৪০ জন মোটে ছেলে ছিল। তোমার তো আজকে বেশি কষ্ট হয়নি। বীরেন বলে, হ্যাঁ! চল্লিশটা ছেলে! আমি ৬৩ কিলো চালের ভাত রাঁধলাম। ৬৩ কিলো চালের ভাত রেঁধে আমার ঘাড় দু-খা-ই হয়ে গেছে। পিঠ সব দুখাই হয়ে গেল। আমি ৩ দিন ঘুমাই নাই, আমি এখন ঘুমাব, বলে ধপাস করে পড়ে গিয়ে চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল। পরের দিন বেলা ১১/১২টায় উঠল আর ৪০টা ছেলে ৬৩ কিলো চালের ভাত খেল। তারা সন্ধ্যে থেকে অদ্ভুত বাঁশি বাজিয়ে গান করতে লাগল।
ইলিয়াস: [হাসি] ভাতেরও প্রভাব ছিল মনে হয়?
দেবী: অসম্ভব, কল্পনা করা যায় না। একবার মাশরুম ট্রেইনিং দিচ্ছি, মেয়েরা এসেছে। ৪ দিনের প্রশিক্ষণ হয়ে গেছে। আর যায় না। কেউ বাচ্চা-টাচ্চা আনেনি। কাজের সময় আর বাচ্চা কী, আমি জানি ওদের ছোট ছোট ছেলেপুলে আছে। আর তারা গানই করছে। আমাকে পাশে শুইয়ে অনেক রকম গান, ওদের বিহা গান, কেউ মরলে কী গান, ওমুক গান, তমুক গান শোনাচ্ছে। ওদের গ্রাম ২৫ মাইল দূরে। ওরা ২৫/৩০/৪০ মাইল হেঁটেই আসে। ওখানে একদম ছোট ছোট বাচ্চার বুথরাবুথরি বলে আরেকটু বড় হলে দিদরা, ফিদরা বলে। আমি একবার ভয়ে ভয়ে বললাম, তোরা যে এখানে, তোদের বুথরা, বুথরি, দিদরা, ফিদরা এগুলোকে কোথায় রেখে এলি? অত্যন্ত অলস ভঙ্গিতে বলল, বাপেরা দেখুগগা। তারপর ৭ দিনের মাথায় বাপরা প্রায় সাশ্রুনয়নে স্ত্রীদের প্রার্থনা করতে এসেছেন, কি এখন না ফিরে গেলে আমাদের রুজি রোজগার বন্ধ হবে। বাপেরা দেখুগগা... এসব সাংঘাতিক গল্প আর খুব সহজও।
পোষা শবর সে মহাদুর্বৃত্তের কাজ করেছে! সে জামশেদপুর অঞ্চলে গিয়ে নাকি দুটি নারী ধর্ষণ করেছে। রাস্তায় গোপী বলছে, দিদি আপনার শবর সন্তান, শবররা আমাকে মা বলে। যে শবর দম্পতির কথা বলা হচ্ছে, মেয়েটি চুয়ো করে চুল বাঁধে, কাঁধে একটা লতাপাতার ঝোলা তাতে মধু, পুরুষটির কাঁধে একটি খাঁচা, তাতে একটা পাখি। এদিকে তীরধনুক এসব রয়েছে, কথা বলতে বলতে আসছে, আমি বললাম... গোপী বলল, হ্যাঁ রে, পশুপতি ওর ডাকনাম, পোষাশবরের কী হবে? বলল মরাইল দিব। মানে মেরে ফেলবে।
ইলিয়াস: ঠাণ্ডা হয়ে বলল?
দেবী: হ্যাঁ। আমি বললাম, মরাইল দিবি? পশুপতির বয়স কত? হিসাব করে দেখা গেল, তা বছর ২৫/২৬। মরাইল দিবি? হ্যাঁ, তুই কাল আসবি, আমরা বসব। যে কিছু কাজ করলেই সমাজের সম্মতি নিতে হবে, সমাজ বসবে। আর আমি তো চিফ পারসন। ওদের মা, আমিও থাকব। আমরা সবই হ্যাঁ করব এবং পশুপতিকে মরাইল দেওয়া হবে। তারপর দিন গিয়ে উপরের পাথরে আমি, মে মাসের গরম, পাথর ফেটে যাচ্ছে আমি ফেটে যাচ্ছি। তারপর অবশ্য নিচে গোল হয়ে বসে অনেক করে ডিসাইড করা হলো, পশুকে একটা ভালো হবার চান্স দেওয়া হবে। তাড়াতাড়ি বিয়ে করে ফেলবে, ঠিক মতন হবে-টবে। পোষা শবর যাকে বিয়ে করতে চেয়েছিল, সেই মেয়ে ওকে বিয়ে করেনি। এ রকম ঘটনা ঘটার পরে ও স্ত্রী জাতির ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে যায়। তবে নিজের জেলায় কিছু করতে ভয় পেয়েছিল। জেলা ছেড়ে সিংভূমে গিয়ে খারাপ কাজটি করে বসেছে। ফলে সিংহভূমে ওর ঢোকা বন্ধ হয়ে গেছে। কারণ, তারাও তখন তাকে মরাইল দেবার চেষ্টা করছে। কাজেই এখন আর জেলা থেকে বেরোচ্ছে না। মরাইল দেব ওদের কথার কথা।
ইলিয়াস: আচ্ছা, দিদি, আমি আরেকটা প্রশ্ন করি, আপনি পুলিশের প্রসঙ্গে বলেছেন, কেমন? পুলিশের সঙ্গে শবরদের সব সময় একটা জেদাজেদি ধরনের সম্পর্ক আছে। সেটা এখন কী রকম সম্পর্ক? এবং এই পুলিশের কথা প্রাচীনকালের গানে কীভাবে এসেছে?
দেবী: প্রাচীনকালের গানকে ওরা রাত কাহানি বলে। একবারে একজন একটা কাহানি বলে, আর সবাই রাত জাগে। পুরোনো দিনের ওদের সৃষ্টিকথা, কী ছিল জগন্নাথ দেব? আমাদেরই ছিল, তা তখন সেই শবর দম্পতি পুজো করত তাদের এক মেয়ে ছিল। জগন্নাথকে চুরি করার জন্য এক বামন এসে সে মেয়েকে বিয়ে করল। বলল ঠিক আছে...করো, থাকো, খাটো বলল। তার এখন ইচ্ছে, কোথায় জগন্নাথ লুকানো আছে, সে মেয়ের আঁচলে সাদা সরষে গেঁথে দিল। একটা ফুটো করে দিল, সরষে পরতে পরতে গেল। সেই সরষে ফুল অনুসরণ করতে করতে ও জগন্নাথ ধরল। জগন্নাথ ধরতেই তখন ও বলল, এখন আর আমাকে পাবি না। সে গড়িয়ে গিয়ে তার ভাইবোন সবাইকে নিয়ে তার হাত-পা সব ভেতরে ঢুকিয়ে নিল। আর কিছুই নেই তার, কিছুই বোঝা গেল না। ধাড়াম ধাড়াম করে সমুদ্রের মধ্যে পড়ল, আমরা নীলাচল গাঁয়ে উঠবে, নীলাচল যখন গাঁয়ে উঠবে, তখন ওরা চলে গেল। তখন ওরা চলে গেল। পুলিশ ছাড়া তো কিছু হবার নয়। পুলিশ রাজা। সব পুলিশ-টুলিশ পাঠিয়ে দিল। জগন্নাথ তখন অনেক রকম বিধিনিষেধ আরোপ করল। এই সমস্ত পুলিশ, রাজার পুলিশরা এসে শবরদের কতই করে বলল। বলল না, আমরা যেমন ব্রাহ্মণও মানি না, পুলিশও মানব না। পুলিশরা তখন ধরাম ধরাম করে বর চেয়েছিল, মাটিতে পড়ে। এ রকমভাবে তাদের নিয়ে গিয়ে জগন্নাথের প্রথম পূজারি করা হলো।
যত রূপকথা বলেন, তখন তো রাজা তো এসে বলল, রাজকন্যাকে বিয়ে তখন দিতেই হবে। রাজা তো, তার মেয়ে হলো রাজকন্যা, ঘরে ঢুকতে পারে না। চারপাশে পুলিশ পুলিশ পুলিশ। পুলিশ সব জায়গায়। যত প্রাচীন কাহিনি সে দুর্গার কাহিনি বলুন, শিবের কাহিনি বলুন—সব জায়গায় পুলিশ। এটা খুব মজার, জীবনে যা কিছু আছে, সবটাতে পুলিশ আছে।
ইলিয়াস: [হাসি] তাহলে মহিষাসুর হয়তো নিশ্চয়ই এসপি হতো বা আইজি...।
দেবী: না, দারোগার ওপরে ওরা ভাবে না। এসপি-টেসপি না। তারপরে যখন রাবণ বলল যে, শিবকে আমি মাথায় করে নিয়ে যাব। ঠিক যেদিন নিয়ে যাচ্ছে, রাবণ কী করে যাবে? বৈদ্যনাথ থানায় গেল শিবের মায়ায়। ওর তো বহুত পেশাব লেগেছে। রাবণ বলল, এখানে একটু বসো। নামাতে গেছে যখন, তখন সেখানকার সব পুলিশ, পুলিশ শিব নামাতে দেবে না। কার হুকুমে তুমি শিব নামিয়েছ? [হাসি ইলিয়াস: পুলিশ ইজ দিয়ার] তখন রাবণের অবস্থা খুবই খারাপ। রাবণ করল কি, দশ মুণ্ডুর যে দশটা সোনার মুকুট ছিল, সব পুলিশদের দিল। [উমর: পুলিশ তখনো ঘুষ খেত?] বড় মুকুটটা দারোগাকে দিল। [সকলের হাসি] তারপর রাবণ ওয়াজ অ্যাবাউট টু ডুয়িং...কিন্তু বাই দ্যাট টাইম তো বৈদ্যনাথের মন্দির হয়ে গেছে। তখন পুলিশই আবার রাবণকে তাড়িয়ে বার করল। তখন রাবণ নিজের দেশে ফিরে গেল। পুলিশ কবে ছিল না? রাম, সীতা, রামায়ণ—ওদের যত লোককথা, সবকিছুর মধ্যে পুলিশ ছিল। সব সময় পুলিশ। নদীতে পুলিশ। মাছে মাছে লড়াই হলো, মাছের পুলিশ চলে এলো। [ইলিয়াসের অট্টহাসি] সব জায়গায় পুলিশ।
ইলিয়াস: পুলিশকে নিয়ে একটা গান আছে না? ওইটার সুরটা একটা গান না।
দেবী: [সুরে] পুলিশের কথা বলিস নারে, পুলিশ মানে অ..ন্ধ..কা..র, পুলিশের কথা বলিস নারে, পুলিশ মানে কা..রা..গা..র, পুলিশের কথা বলিস নারে, কারাগারে বড় অন্ধকার, এভাবে ওরা গান করে।
ইলিয়াস: পুলিশের অত্যাচার তো সাংঘাতিক।
নাইম: তাই বলে গল্পের মধ্যে পুলিশ, মাছের মধ্যেও পুলিশ?
দেবী: সব জায়গায় পুলিশ। সবকিছুতেই পুলিশ আছে, সবকিছুর পুলিশ আছে। আমরা বুঝতে পারি না এই যে তুমি হেঁটে যাচ্ছ, পায়ের নিচে ধানক্ষেতে কত পোকা-টোকা, তাদেরও পুলিশ আছে। সব জায়গায় পুলিশ আছে। আমরা কিন্তু জানতে পারছি না, কিন্তু পুলিশ ছাড়া কিছু হবার নয়। এই যে মেলাটা হয়েছে, তুমি ভাবছ আমরা মেলা করেছি, না। পুলিশও আছে। আমি বললাম হ্যাঁ, পুলিশ তো আসেই। কেদা থানা থেকে আসে, অমুক থানা থেকে পুলিশ আসে, তারা বলল, সে পুলিশ নয়, মেলারও পুলিশ থাকে সবকিছুতে, রাতে কোন ইয়ে হয়েছিল, মেঘ এসেছিল রান্নাবান্নার সময়ে? আসেনি, মেঘের পুলিশ সব মেঘ বন্ধ করে দিয়েছিল। কোন হাওয়া হয়েছিল ধুলাটুলা পড়েছিল কোনো কিছুতে? হাওয়ার পুলিশ সব হাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল। কাজেই পুলিশের সর্বাত্মক ভূমিকা ওরা মোটামুটি মেনে নিয়েছে। তবে প্রকৃত জীবনে যখন হরি শবরকে হত্যা করল বোরো থানার পুলিশ, তখন বোরো থানার শবররাই গিয়ে ঘিরেছিল তিন দিন ধরে। এবং শবরদের কারণে ওই জেলাতে এসপিও বদলি হয়েছে। দারোগা-টারোগার ডিমোশন-টিমোশন...এখন তারা যা-ই বলে, সেটা পুলিশ মূল্য দেয়, মেনে নেয়। এটা হচ্ছে বোরো থানার পুলিশ। এ বছরের পয়লা জুন যখন গত বছর ৯৬-এ পলিত শবরকে ‘চল তোকে কাজ দেবো, ঘাটে কাজ আছে’ বলে ডেকে নিয়ে গিয়ে ডান হাত কেটে নিল পঞ্চায়েতপ্রধান ও অন্যরা মিলে। তখন কিন্তু খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমিও খুব ক্ষেপে গিয়েছিলাম, বানজোড়া গ্রাম শবররা জ্বালিয়ে দেয়নি কেন! আর কথা নেই। যত বাস এদিকে আসছে, ওরা বাস থেকে যাত্রী সব নামিয়ে দিচ্ছে। শবররা প্রকাশ্য দিবালোকে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে...। ওদের এটা হচ্ছে সমিতি। একটা ‘হ’ শুনে যাবে। একটা ‘হ’ বলতে হবে। কেননা গঠন যখন করা হয়েছে সমিতির তো একটা সাংগঠনিক নিয়ম আছে, একটা ‘হ’ বলতে হয়। ওরা সবাই মিলে যখন বলল, তখন একটা ‘হ’ বলায় কথা উঠল। সমিতিতে যে বসে আছে জলধর শবর, সে ওদের থেকে বয়সে অনেক কম। কিন্তু সে তো সেক্রেটারি। তখন জলধর তো প্রকাশ্যে ‘হ’ বলতে পারে না। তারপরই জলধর নেচে নেচে বলল, সবাই বলেছিল। বানজোড়া গ্রামের কাছাকাছি এসব যখন অনেক করে টরে... তখনই প্রথম দেখা গেল এটা ভালো। এটা ওদের সহজে করেছে।
ইলিয়াস: এটা কি এখনো করছে?
দেবী: হ্যাঁ, এখনো। এবং তারা কান্নাকাটি করছে শবরদের কাছে। যা নেংটো করাই গিয়ে, ওরা খুব হেসে বলছে, নইলে ডান হাত ফিরিয়ে দে। কিন্তু এখানে যেটা গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো বিভিন্ন থানার শবররা এসেছিল। বরাবাজার থানার শবররাই শুধু আসেনি, আশপাশ যত থানা আছে—পুংচা, পুরুলিয়া সদর, কেঁদা—সব জায়গার শবররা এসেছিল। আজকে একটা শবরের গায়ে হাত পড়লে বিভিন্ন থানার শবররা সমবেত হয়ে সশস্ত্রভাবে লড়ছে। এটা একটা নতুন জিনিস।
ইলিয়াস: এটা আগে ছিল না। তাই না?
দেবী: They are shaking of fear like anything. পুলিশকে তো বলে, কী করবি? মরাইল দিবি? বহুত মারাইছিস। দে, মারলে তো মারবি আর তো কিছু করতে পারবি না। আমার জমি নাই, ভূমি নাই, লেংটা ফকির। মার মার। কাজেই এখন পুলিশের হাত থেকে ওই সবের থেকে বহুত লড়াই শুরু করে। আমরা তো আছি। পুরুলিয়া শহরে চারটে উকিল বসিয়ে রেখেছি।
ইলিয়াস: বাঙালি?
দেবী: হ্যাঁ, চারটি উকিল বসিয়ে রেখেছি, যারা রাত-দিন এদের কেস করে। এ না হলে না। এদের শবররাই গিয়েই ধরেছিল। এই কেস হয়ে গেল আর তুমি বলছ, তুমি এখন পায়খানায় যাবে। তোমার এখন পায়খানায় যাওয়া হবে না। এই কেস হয়ে গেল কোর্ট বসে গেল, চলো।
ইলিয়াস: এখন স্কুল করা হয়েছে, তাই না দিদি, ওদের জন্য?
দেবী: না, সেন্ট্রাল গভর্নমেন্ট একসময় আমাদের এডাল্ট লিটারেসি, অ-আনুষ্ঠানিক স্কুল, ভলান্টারি সংস্থাকে দিতে পারত, দিয়েছিল। এক বছর খুব ভালোভাবে চলে। স্টেট গভর্নমেন্ট বলল, পুরুলিয়াকে আমরা শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় আনছি। যেমন বর্ধমানে হয়েছিল। কৃষিতে বর্ধমানে যা হয়েছিল। শিল্প এলাকার বর্ধমানে ন্যাচারালি ইলিটারেট থেকে যায়। যাহোক, মোস্টলি ইলিটারেট।
ইলিয়াস: কৃষিতে বর্তমানে বোধ হয় ১০০% শিক্ষিত না?
দেবী: কাগজে তো তাই।
ইলিয়াস: কিন্তু শিল্পে কোল মাইন-টাইন যে সব জায়গায় আছে।
দেবী: কোল মাইন কেন? আসানসোল থেকে আসানসোল, চিত্তরঞ্জন, দুর্গাপুর—সব জায়গাতেই ওই তো ঠিকাদারের শ্রমিক আসে। তারপর দুই-ই করে দেয়, এই আসে এই যায়। আর পুরুলিয়ায় তো আরও। কারণ, শবররা যেখানে থাকে, মেইন গ্রাম থেকে একুশ মাইল দূরে গিয়ে টিলায় উঠে তাদের লিটারেসি দেওয়া হচ্ছে। সেটা তো হয় না। তবে আমরা ওইটা চালাতে পারলাম না। এখানে চলে এলো। এখন যেটা হয়েছে আমরা অনুদান তুলি। ইত্যাদি তুলি যা যা করেছি। কারও অনুদানে পাঁচটা স্কুল চলে। সেখানকার বাচ্চারা দুপুরবেলা টিফিন পায়। এই খায়। সকাল থেকে ১১টা অব্দি ক্লাস করে। তারপর যারা একটু ক্লাসে এসেছে, তাদেরকে মাস্টার নিয়ে যায়, নিকটতম প্রাইমারি স্কুলে নিয়ে যায়। ফিরে আসে। তারপর বিকেল থেকে মেয়েরা বসে।
উমর: আচ্ছা, আপনি কি ডেনিস ওয়াকার বলে কোনো অস্ট্রেলিয়ানকে চেনেন? যে সাউথ তেহার এবং এসব জায়গার ট্রাইবাল নিয়ে লিখছে।
দেবী: না, আমি চিনি না। বই হয়তো আছে। চিনি না, আমি যে বৃত্তে থাকি, তার বাইরে লোক খুব চিনি না।
উমর: না, আমি ভাবলাম, হয়তো আপনার সাথে দেখা-সাক্ষাৎ হয়ে থাকবে।
দেবী: না না। আর শবরদের মধ্যে আমরা বহিরাগত। ও রকম রিসার্চ আর রিসার্চের নামে সবচেয়ে বেশি ধর্ষণ হয়ে গেছে আদিবাসীরা। কাজেই ওটা আমার বা সমিতির হাতের লেখা ছাড়া কোনো আউটসাইডার গিয়ে ঢুকবে, তারা শবরদের কাছে থেকেই সব তথ্য পাবে না।
ইলিয়াস: আচ্ছা, কেন্দ্রীয় সরকার কিংবা রাজ্য সরকার—যেটাই হোক, ওদের এটা ইচ্ছা থাক না থাক, বলি কি, এদের মূলধারায় নিয়ে আসা উচিত?
দেবী: না। এরা একটা ভাষাই জানে, আমাদের ভদ্রলোকেরা সরকারি লোকেরা বলে... দেখে যে কী আনন্দ হলো! আপনারা ওদেরকে মেইনস্ট্রিমের কাছে নিয়ে এসেছেন। অথচ আমরা মেইনস্ট্রিমের থেকে যত দূরে থাকি, আমরা ততই আনন্দিত। আমি ওদের জন্য সোলার বিদ্যুৎ চাই, মেডিকেল ট্রিটমেন্ট চাই, আমি লিটারেসি চাই, আমি রাস্তা চাই, মানুষের মতো ঘর হবে, হাউজিং চাই, খাওয়ার পানি চাই। সবই চাই। মূলধারার মতো হওয়ার দুর্ভাগ্য যেন ওদের না হয়। কারণ, এই মেইনস্ট্রিম আমি যা দেখছি এই mainstream nothing to offer them. এরা খুব ডেডিকেশন নিয়ে তো কেউ যাবে না, এমন তা না যে কোনো ডাক্তার গিয়ে বসেই কাজ করবে, তা নিয়ে তো কেউ যাবে না। কাজেই মূলধারার খেলা আমার আগেই দেখা হয়েছে।
ইলিয়াস: তো এটা কি বাদ দেওয়া যাবে শেষ পর্যন্ত?
দেবী: খেড়িয়া শবররা তো সংখ্যায় খুব কম। সাঁওতালরা যেমন জাতিতে অনেক। ওরা থাকেও ওই বড় বড় গ্রামে। তাদের কবজা করলে যে সুবিধা আছে, সমস্ত শবর মিলে কজন ভোটার, এত বড় বিস্তীর্ণ এলাকায়। ভোটের ব্যাপারে ওদের দৃষ্টিভঙ্গি কী, জানো তো? ‘ভুট লিবি তো, যার নামে হয় লিয়ে নিস’। ‘ভুট দিলে কী হয় তা তো আমরা দেখলাম’। ‘ভুট দিলে কিছু হয় না।’
ইলিয়াস: [হাসি] এসব বলছে আরকি!
দেবী: আমরা যে মনে করি ওরা জানে না, গ্রামের লোকের কাছে শিখতে যাওয়া উচিত। শেখাতে যাওয়া উচিত নয়। [ইলিয়াস: এটা আমি বলি সব সময়] একটা রাস্তায় যদি মাটি পড়ে যদি ওমনি বলে, ‘হ্যাঁ, পঞ্চায়েত ভুট আসছে তো, তাহলে রাস্তায় মাটি পড়বে। এখানে এটা হবে, ওখানে ওটা হবে।’ এসব, ওরা সব বোঝে। ওরা কম পলিটিসাইজড কিন্তু খুব বোঝে।
ইলিয়াস: তো আমাদের এখানে কিন্তু, উমর ভাই, আমি যখন চাকমাদের মধ্যে যাই আর কি তখনো যারা সাহেবসুলভ! চাকমারা তো মোটামুটিভাবে একধরনের সামরিক শাসনের মধ্যে আছে, তো যারা ভদ্রলোকজন, বড় বড় অফিসার, এদেরও কথা হচ্ছে... আমরা চেষ্টা করছি এদের মূলধারায় নিয়ে আসতে। সে জন্য ওরা চাকমা ভাষা পড়াতে চায় না। চাকমা সংস্কৃতি...
দেবী: এখানেও ঠিক তাই হলো। যেখানে গিয়েছিলাম রাজশাহী থেকে ওই যে মাধবপুরে। ওরা ওখানে বলল, না, একটা মজা আছে, সাঁওতালরা যারা খানিকটা মূলধারার মতো হয়ে গেছে, তারা একমাত্র ভাষা আর সাহিত্য নিয়ে ভাবে।
ইলিয়াস: মানে ওদের ভাষা?
দেবী: হ্যাঁ, আমি হাসানকে বলেই এলাম যে সাঁওতালদের সঙ্গে যদি তোমাদের আলাপ-সালাপ থাকে, হয়, যারা রাজশাহী টাউনে থাকে, তারা চার পাতা শুধু লিখে দিক, শুধু ঠিক ঘর জানালা দরজা কপাট ইত্যাদি ইত্যাদি, বাংলা হরফে সাঁওতালি ভাষায়। বেসিক এগুলো চার পাতা দশ পাতা তোমরা এখন থেকে ছাপিয়ে দিতে পারো। কিন্তু যে যে রাষ্ট্রে থাকে তাকে সেই রাষ্ট্রের ভাষা শিখতেই হবে। সাঁওতাল সাঁওতালি ভাষা বললেই তো...কোনো কিছু হবে না। কোর্টে কাজ চলবে না, কিছু হবে না। ওরা সব সময় ভাষার সাহিত্য... সাহিত্যের কথা বলতে আমি বললাম, পশ্চিমবঙ্গে প্রচুর সাঁওতালি ম্যাগাজিন বের হয়। বই বের হয়। সংগঠন আছে। আমি বলব, তারা যদি তোমাকে পাঠিয়ে দিতে পারে তো ভালো। কোথায় পাঠাবে, না পাঠাবে আমি জানি না। কাজেই তারা খানিকটা অন্য রকম হয়ে...আমি বললাম ভাষা সাহিত্য নিয়ে ভাবুন। ওরা বলল সবচেয়ে দুঃখের হচ্ছে ভাষা সাহিত্য। আমি বললাম, না, সবচেয়ে বড় দুঃখ হচ্ছে যে, চালের খড় গলে পড়ছে... ফাঁক। সব থেকে বড় দুঃখ হলো টিউবওয়েল কম। সব থেকে বড় দুঃখ হচ্ছে এই দূষিত জল। সব থেকে দুঃখ হচ্ছে, আমি আসব বলে মাটি কোদাল দিয়ে কেটে তোমরা একটা আসার রাস্তা করেছ। সারা রাত খেটে দেড় মাইল রাস্তা। সব থেকে বড় দুঃখ হচ্ছে এইগুলো। স্কুল নেই। লেখাপড়া শিখতে পারে না। শণ ভরাবার মতো জীবিকা নেই। মাটি তো নেই-ই। যা আছে তার মধ্যে মেক্সিমাম করে-টরে... মাশরুম প্রশিক্ষণ দিলে কী হতে পারে, ভাবো। এটুকুনের মধ্যে সবজি কি চাষ করতে পারে, ভাবো, অমুক তমুক। এখানকার মাটি তো যথেষ্ট ভালো। কাজেই এগুলো বড় সমস্যা নয়, শিক্ষিত সাঁওতাল হলেই তার কাছে সমস্যা হচ্ছে ভাষা আর সাহিত্য। ভাষা সাহিত্য সংস্কৃতির বিরাট অবদান আছে। কিন্তু সাঁওতাল কেন, আদিবাসীর ক্ষেত্রে তার নিজস্ব সংস্কৃতির সবগুলোই আছে। ওরা করম পর্ব করে, সারঘুল বা বাহা পর্ব করে। ওরা সোহারা বা বাদনাও করে। এগুলো সবই কৃষি আশ্রিত জিনিস। সারঘুল বা বাহা হচ্ছে রবিশস্য ঘরে এনে নিয়ে...। তারপরে পয়লা মাঘ থেকে আবার ওদের নতুন বছর গণনা হয়।
ইলিয়াস: পয়লা মাঘ থেকে?
দেবী: তারপরে এই যে সোহরায় যেটা বা বাদনা পর্ব, সেটা হচ্ছে গরুতে গোয়াল করা, গরু জাগানো, গোয়াল পরিষ্কার করা, সকলের হয়তো গরু নেই। যার নেই তারাও সেদিন গৃহপালিত পশু যত্ন, ধর্মগান সারা রাত ধরে গান-টান ইত্যাদি করে। করম পুজা খুবই সুন্দর। এখন তো করম গাছ নেই। অন্য গাছের ডাল এনে পুঁতে। তারা করে কি, ওই সময় যে রবিশস্য হয় ছোট ছোট ডালায় বালি রেখে জল দিয়ে আগের দিন মেয়েরা সব শস্যবীজ জাইয়ে রাখে। সেইগুলো সমস্ত নিয়ে আসে ব্রতধর্ম উপকথা কথা। আর ওদের বলে ব্রতধারিণী বা বারতী, বারতীরা শস্য দাও। বারতীরা একে একে যেন সব নিবেদন করে। তারপর সমস্ত রাত্রি গান হয়। সবকিছুর পরে নাচ আর গান।
ইলিয়াস: সবাই অংশগ্রহণ করে না?
দেবী: হ্যাঁ, বাহা বা সারঘুল হচ্ছে নতুন শালপাতা, মানে ফাল্গুন মাসের নতুন পাতা, ফল-ফুল এসবের উৎসব।
নাইম: এসব উৎসব বছরে কটা?
দেবী: অনেক আছে। এখন সবগুলো বলতে পারব না। আছে। সারা বছরই আছে। তা ছাড়া আরও আছে প্রতিটি বাড়ির যেমন, ফ্যামিলির যেমন, প্রত্যেকটা মানুষেরও তেমনি নিজস্ব দেবতা আছে। কী দেবতা কেউ জানতে পারবে না। তোমার কী দেবতা, আমার কী দেবতা—কেউ কখনো জানে না। তুমি জানো নাকি তা-ও কেউ জানে না। কিন্তু সকলেরই নাকি নিজস্ব একটা দেবতা আছে। কাজেই যখন সে লোকটা মারা গেল, তাকে কবর দেওয়া হলো, তাকে সেরিমুরালি বলা হয়, তোমার দেবতাকে তুমি সঙ্গে নিয়ে গেছ। আর কোনো কারণেই তুমি অশান্ত হয়ো না, বলে মোরগ কেটে রক্তটা পুঁতে দেওয়া হয়। পুঁতে দেওয়ার পর এত দেবতা থাকে এবং অনেক নালিশ আসে। সাঁওতাল মেয়েরা নালিশ করে, আমরা এ রকম ও রকম বর্ধমানে লাঙল খাটতে গিয়েছিলাম। আমাদের তো জমিজমা নেই, তাই লাঙল খাটতে গিয়েছিলাম, দুই বোন। এসে দেখি, আমাদের ঘরের দেবতা অন্য কেউ চুরি করে নিয়ে গেছে। যে নিয়ে গেছে, সেও সাঁওতাল। ঘরের দেবতা কীভাবে চুরি হলো, আমি গিয়েও অনেক খবর-টবর করেও... ঘরের দেবতা, সেটা তো কোনো মূর্তি হবে না। সেটা যে কী, তা কিছুতেই বেরোল না।
ইলিয়াস: তো কীভাবে চুরি হলো?
দেবী: সে ওরা জানে, কী কীভাবে চুরি হয়েছে।
ইলিয়াস: আধ্যাত্মিক চুরিও বলা যায় একে?
দেবী: অসম্ভব নয়। আবার তাকে ডেকে সমাজ বসানো হলো। বসে বলল কারও ঘরের দেবতা চুরি করলে তার কী পরিণাম হয়? তখন তাদের যে প্রধান, সে তার ভয়ংকর সব বর্ণনা করল তার কী কী হবে। তার ছাগলকে সাপে কেটে নেবে। ওমুক হবে তমুক হবে। এখন তো তার বাঘে খেয়ে নেবে বলে না। ‘তোর ছেলে টাটায় কাজ করতে যাবে কিন্তু সে আর ফিরবেক নাই’। ট্রাকে চাপা পড়ে মরে যাবে। আগে বলত বাঘে খাবে, সাপে কাটবে, এখন মেশিনে খাবে। এ রকম নানা রকম শোনার পর একদিন প্রচুর ঢাকঢোল, শোনা গেল গৃহদেবতা ফিরে এসেছে। গেল কবে যে ফিরে এলো!
ইলিয়াস: তাদের গৃহদেবতা তো আবার ওই ব্যক্তি ছাড়া আর কেউ চেনে না।
দেবী: ওই দুই বুড়ি ছাড়া আর কেউ জানে না। বুড়িরা যায় লাঙল খাটতে। ওটা খুব সুন্দর। ওরা যায় মেয়েদের নিরাপত্তা দিতে, ওরা, নিজেরা কাজ করে না বুঝলেন? এরা সারা দিন যা পায়, সেই ভাতটা ওদের খাওয়ায়। ও এদের বাচ্চা-কাচ্চা সামলে-টামলে রাখে।
ইলিয়াস: আচ্ছা, একটা জিনিস লক্ষ করা যাচ্ছে যে, শবর বলেন, সাঁওতাল বলেন, মুণ্ডা [দেবী: অস্ট্রিক জাতি।] বলেন, এদের মধ্যে একধরনের শৃঙ্খলাবোধ বেশ কাজ করে।
দেবী: অসম্ভব শৃঙ্খল।
ইলিয়াস: এটা কিন্তু আমাদের যে সমাজ সেখান থেকে আলাদা, তাই না? ...আমি যে চাকমাদের মধ্যেও দেখেছি, সাংঘাতিক শৃঙ্খলা...
দেবী: হ্যাঁ। এই যে আলীপুর পুলিশ ক্যাম্পে আগে অনেক পুলিশ ছিল। মা মরে মানে মার্চ মাসে সূর্য পূজা হয়। মঙ্গল সরেন নামে একজন অত্যন্ত সুপণ্ডিত সাঁওতাল, কংগ্রেসের সময় এমএলএ হয়েছিল। একবারই হয়েছিল। তারপর সবটাই জোচ্চুরি বলে ফেলে দিয়ে চলে এসেছিল। বাবা মারা যাবার পর আমি ঝাড়গ্রামে গেছি। সেই লোকটা এলো পাহাড়ি গ্রাম থেকে। তার হাতে একটা বাটালি আর একটা ছুরি। ও কোদালের বাট তৈরি করছিল, ও বলল...মা, তুই এসেছিস, তাই আমি চলে এসেছি। বলল, মুখখানা মলিন কেন? আমি বললাম যে, বাবা মারা গেছেন। বলল না, তোর তো বাবা মারা যেতে পারে না। আজ থেকে আমি তোর বাবা। উনি চিরকাল তোমার পিতা, এই নামে আমাকে চিঠি লিখতেন। এই লোকটা সাঁওতালি ভাষার আদি জানতে নদীর উৎসে গিয়েছিল। এই লোকটা সংস্কৃত ভাষার বিভিন্ন পর্যায়ে যা বলা হতো, তার সঙ্গে পরিচিত ছিল। সুনীতিবাবু একে ডেকে পরামর্শ করত। প্রাকৃত, পালি, সংস্কৃত—সব জানতেন। মঙ্গলবাবুর নায়েকে পূজা দিতে ৩০ হাজার আদিবাসী সাঁওতাল মুণ্ডা...যারা পুলিশ হয়েছে, আশপাশ থেকেও সব এসেছে, আমি যাব শুনে। তখন পুলিশ কমিশনার বলল, দেখছেন তো আমরা আদিবাসীদের জন্য কত কিছু করে দিচ্ছি, অমুক করছি। আমি বললাম, আপনারা কিছুই করেননি। ওরা নিজেরাই...সেভাবেই এসেছে। আর এরা তো সবাই পুলিশ নয়, রেলওয়ে কর্মীও অনেক আছে। যাহোক, যেটা দেখার সেটা আপনি দেখতে পাচ্ছেন না। ৩০ হাজার লোক বসে আছে, একজন কারও হাত-পা নড়ছে না। তারা নিরস বক্তৃতাই শুনছে। নীরবে শুনছে শিশুরাও, এই যে অদ্ভুত ভেতরের শৃঙ্খলা।
ইলিয়াস: শৃঙ্খলাটা সাংঘাতিক। চাকমাদের মধ্যেও সাংঘাতিকভাবে আছে শৃঙ্খলা...
উমর: সেই, আমেরিকায় যে বঙ্গ সম্মেলন হলো, সেখানে যে সম্মেলন চলছে, বুঝেছেন তার মধ্যে ভীষণ কথাবার্তা! আমি লোকেদের জিজ্ঞাসা করলাম যে, এরা কথাবার্তা বলার জন্য ভেতরে ঢুকেছে কেন? বাইরে তো আছে।
ইলিয়াস: [হাসি] বাইরে তো জায়গা অনেক।
উমর: আপনি কি মনে করেন, এই আদিবাসী কিংবা আদিবাসী যেভাবে বলেন, তাদের মধ্যে কোনো শ্রেণিচেতনা আছে?
দেবী: পশ্চিমবঙ্গে রাজনৈতিক প্রচার যথেষ্ট হওয়ার ফলে তারা সব সময় যখন চিঠি লেখে, লেখে ‘তাহলে ভাবিয়া দেখুন বুর্জোয়া শ্রেণী কে?’ এই কথা প্রায়ই লেখে। লেখে ‘বুর্জোয়া কাহারা?’ কথা সেটা নয়, গোটা আদিবাসীর মধ্যে কিছু কিছু ব্যতিক্রম তো নিশ্চয় আছে। সেটাই তো আমি চোট্টি মুণ্ডায় লিখেছিলাম। যারা নন ট্রাইবাল, তাদের মধ্যে শোষিত যারা, তাদের সঙ্গে এক জায়গাতেই পরে, তাদের কোনো জাতি বিভেদ নেই। আর আমার অন্যান্য লেখাতেও তো আমি শোষক আর শোষিত—এই বিভাজনটা পরিষ্কার রেখেছি।
উমর: লেনিন যেমন গ্রামের গরীবদের প্রতি লেখার সময় বুর্জোয়া কথাটা ব্যবহার করে তাদেরকে বোঝানোর জন্য তলাতে লিখেছেন যে বুর্জোয়া মানে হচ্ছে ধনী লোক।
ইকবাল: ওরা কীভাবে চিহ্নিত করেছিল?
ইলিয়াস: হ্যাঁ, ওরা কীভাবে চিহ্নিত করে?
দেবী: ওরা নিজেরা পরিষ্কার বোঝে, বলে... এরা আমাদের ভাঙিয়ে বড়লোক হয়েছে। এরা, ধনীরা, চিরকাল আমাদের এই করেছে, আমাদের এই অবস্থায় ফেলে উপরে উঠেছে। ওরা শ্রেণি-ট্রেনি ব্যবহার করে না! কিন্তু ব্যাপারটা ওরা পরিষ্কার বোঝে, এটা সম্পূর্ণ বোঝে...
উমর: শ্রেণির একটা চেতনা তো ওদের তো আছে?
দেবী: পরিষ্কার আছে। শুধু আদিবাসী না, অনাদিবাসীরও আছে। ভীষণভাবে আছে। ওরা সবই জানে।
ইকবাল: গ্রামে অনেকে যেমন বড়লোকদের সাহেব বলে। আমাদের এখানেও সাহেব বলে, ঠিক ধনী বলে না। নিজেদের ক্ষেত্রে যখন চিহ্নিত করে আদিবাসী, নিশ্চয়ই ওদের ভাষায়ও কিছু ব্যবহার করে?
দেবী: শুধু আদিবাসী নয়, অনাদিবাসীও বাবু বলে।
ইকবাল: যারা ধনী হয়ে গেছে, তাদের বাবু বলে।
দেবী: যারা ধনী হয়ে গেছে বা পুরুষানুক্রমে ধনী, তাদের বাবু বলে।
উমর: আমি একবার খুলনার আবাদ অঞ্চলে কথিত নিম্ন শ্রেণির একজনকে বাবু বললাম...
দেবী: অপমানিত হলো?
উমর: না, সে বলল, আমাকে বাবু বলবেন না। অপমানিত হলো না। বলল যে, আমাকে বাবু বলবেন না। আমি তো বাবু নই আমি গরিব মানুষ।
ইলিয়াস: আচ্ছা, একটা ব্যাপার যে, ধরুন, কোথাও আদিবাসী আছে তার পাশে এমনি সাধারণ লোকালয় আছে। আদিবাসীদের শোষণ করা হচ্ছে, আবার পাশে যে বাঙালি চাষি, তাদেরও শোষণ করা হচ্ছে। আচ্ছা, এদের মধ্যে যারা শোষিত আদিবাসী এবং শোষিত বাঙালি চাষি, এদের মধ্যে কোনো রকম বিরোধ বা ঐক্য কি আছে?
দেবী: না না, কোনো বিরোধ নেই। ওরা যখন কোথাও নামাল কাটতে যায়। তখন ওরা সবাই একসঙ্গেই যাবে। গভীর ঐক্য...
ইকবাল: বিরোধ নেই বলাটা কি ঠিক? জাতিগতভাবে তো একটা পার্থক্য থাকছে?
দেবী: জাতিগতভাবে কি পার্থক্য থাকবে?
ইকবাল: বাঙালি জাতি এই যে একটা পার্থক্য।
দেবী: না না, অত দূর যায়নি, ওসব যায়নি, ওসব নেই। আদিবাসীরা নিজেদের মধ্যে তাদের নিজেদের মতো করে আছে। কিন্তু যখন তারা খেতে খাটতে যাচ্ছে, কোথাও কিছু করতে যাচ্ছে, একসঙ্গে ব্রিজ তৈরি করছে, পাথর ভাঙছে, একসঙ্গেই সমস্ত কিছু করছে। অর্থনীতি এবং ক্ষুধাই নিয়ন্ত্রণ করছে সব। আদিবাসীদের মধ্যে আবার প্রচুর আছে, যারা নানা রকম ধান্ধাবাজি করে-টরে, টাকা-পয়সা করে-টরে। তাদের আবার অন্য আদিবাসীরা কোনো রকমভাবেই স্বীকার করে না। সে আমাদের লোক নয়। কোনো ট্রাইবাল যদি মন্ত্রী হয়, যেমন শম্ভু মাণ্ডি হয়েছিল। আমাদের গভর্নমেন্টের অদ্ভুত বুদ্ধি অনুসারে কেন্দ্রীয় সরকার এবং রাজ্য সরকার সবগুলোতে একজন আদিবাসীকে আদিবাসী মন্ত্রী করে। যদিও আদিবাসী মন্ত্রী একদম ক্ষমতাহীন। দিল্লি এসটি কমিশনার যেমন ক্ষমতাহীন। তার কারণ হচ্ছে, আদিবাসীদের জন্য শিক্ষা, এর জন্য কিছু করতে হলে সেটা শিক্ষা অধিদপ্তর করবে। ভূমি চলে যাচ্ছে আদিবাসীদের হাত থেকে, সেটা ভূমি অধিদপ্তরের কাছে, স্বাস্থ্য চলে যাচ্ছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কাছে। তার হাতে বাস্তবে কোনো ক্ষমতা নেই। জিনিসটা হচ্ছে সম্মানার্থে। এই সে জমিচ্যুত হয়েছে, দেখা যাবে আমি হয়তো চিঠিটা দেব ভূমিমন্ত্রীর কাছে, কিন্তু কপি পাঠাবে আদিবাসীমন্ত্রীর বাছে, কখনো একসাথে সেটা ভূমিমন্ত্রীর কাছে যায় না।
ইলিয়াস: আদিবাসী মন্ত্রীর কোনো ক্ষমতা নেই মনে হচ্ছে!
উমর: কার্বন কপিটা আছে।
ইলিয়াস: হ্যাঁ, কার্বন কপিটা।
দেবী: আরেকটা মুশকিল হচ্ছে, ওরা যখন মন্ত্রী হয়, ওরা মন্ত্রীর সাথে মিশতেও পারে না। ওরা নিজেদের খুব বিচ্ছিন্ন মনে করে। ওরা হয় তাদের খুব কপি করে, না হয় নিজেদের মতো নিজেরা চুপ করে থাকে। চুপ করে থাকে কিংবা তাদের মতো হয়ে যায়। ফলে সে যখন ফিরে আসে, আর নিজেদের সমাজ থেকে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। কেউ গর্ব বোধ করে না।
ইকবাল: এটা যে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছে, এটাকে তারা অন্যরা কীভাবে দেখছে? মানে আদিবাসী অন্য লোকেরা।
দেবী: তারা একেবারেই বিশ্বাস করে না, কেননা তারা প্রথমেই মনে করে, ‘তুই মন্ত্রী হয়ে লাভটা কী হলো? তুই তো সেই আছিস, মাঝখানে তুই গাড়ি চেপেছিস।’
ইলিয়াস: আমাদেরও চাকমা মন্ত্রী থাকত না? তারপরও কিছু করার ছিল না। চাকমা মন্ত্রী, মারমা মন্ত্রী, এদের কিছু করার ছিল না, মাঝখান দিয়ে এরা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল।
দেবী: ওদের নিজেদের সমাজ থেকে।
ইলিয়াস: ওদের রাজাকার বলা হয়। আমরা গিয়েছিলাম, শুনেছি। লাভ হয়নি, কিছু সাময়িক সুবিধা, এই...
মুফাদ: আচ্ছা, দিদি, আদিবাসীদের মধ্যে এমন ধনী লোক কি আছে, যারা শোষণ করছে তার আদিবাসী লোকদের?
দেবী: খুবই কম। সমস্ত পশ্চিমবঙ্গে খুঁজে বা খনন করলে একজন কি দুজন বের হতে পারে, সে খুব কম। আগে অনেক বেশি ছিল ওই লুসাইটুসাই ওই সব জায়গায়। তারা ওপরের আদিবাসীরা নিচের আদিবাসীদের চুক্তিভুক্ত শ্রমিকে পরিণত করে। দিন পাল্টে গেছে, অনেক অন্য রকম হয়ে গেছে।
মুফাদ: কৈবর্তখণ্ড পড়ে যেটা আমার খুব ভালো লাগল, মনে হলো যে খুব কম তথ্য নিয়ে এই সম্পর্কে বোধ হয় সন্ধ্যাকর নন্দীর বইয়ে... [ইলিয়াস: সন্ধ্যাকর নন্দীর তথ্য খুব বিশ্বাসযোগ্য না।] হ্যাঁ, বিশ্বাসযোগ্য না, কিন্তু নীহাররঞ্জনের বইয়ের মধ্যে খুব কম আছে। কিন্তু সেটা নিয়ে যে আপনি একটা লেখা লিখলেন, পড়লে মনে হয় একটা কালের যাত্রায় গমন। খুব কম ছোট বইয়ে কিন্তু এটা খুব চমৎকারভাবে এসেছে। এটা বড় একটা বই হলে, একটা আবহাওয়া তৈরি করে নিয়ে আসা হয়তো সহজ ছিল। কিন্তু কম বইয়ের মধ্যে কাজটা দেখা যায়। এখন আমি জানতে চাচ্ছি যে, সন্ধ্যাকর নন্দী আমাদের পড়া নাই, এখানে যে উপাদান নিয়ে আপনি কাজ করেছেন যে তথ্যের ভিত্তিতে, তাতে কতটুকু ইতিহাস আছে?
দেবী: সন্ধ্যাকর নন্দীর যতটুকু আছে সবটুকুই ইতিহাস। তা ছাড়া সব জিনিসটা, এটা খুঁটিয়ে পড়লে তখনকার নগরবিন্যাস কোথায় কী রকম ছিল ইত্যাদি জানা যায়। রামপাল যা করেছিলেন, তা-ও তো জানা যায়।
ইলিয়াস: ওই বইয়ে আমরা যেটা পাচ্ছি, যে কৈবর্ত বিদ্রোহটা হয়েছিল, এখানে যেটা পাচ্ছি কৈবর্তরা দুরকম...জালিক আর হালিক। তো ওখানে বিদ্রোহ হয়েছিল দিব্যক এবং ভীমের নেতৃত্বে। একজন চাচা অন্যজন ভাইপো। সেই বিদ্রোহ রামপালের বিরুদ্ধে ছিল। রামপাল সরকার ধরনের ছিল। রামপাল বৌদ্ধ ছিলেন। সবচেয়ে বড় ব্যাপারটা কিন্তু যখন তিনি কৈবর্তদের দমন করতে গেলেন, কৈবর্তরা কিন্তু বৌদ্ধ না, কৈবর্তরা মাছ মারে, কৈবর্তরা কিন্তু রামপালকে বাঁচিয়ে রেখেছিল। কৈবর্তরা শিবকে পূজা করে, মাছ মারে, কেউ চাষ করে। তারা কিন্তু রামপালকে মারল না। মানে, মেরে ফেলল না আরকি। রামপালকে ধরে রেখে দিল। রামপাল কিন্তু বৌদ্ধ, এটা মনে রাখতে হবে। রামপাল যখন এদিক-ওদিক করে ছাড়া পেলেন। পেয়ে তিনি যে ব্যবহারটা করলেন কৈবর্তদের সঙ্গে, তাতে বুদ্ধের অহিংসার কিছুই থাকল না।
দেবী: এটা একেবারেই শ্রেণি হিংসা।
ইলিয়াস: একেবারেই শ্রেণি হিংসা। আমরা দেখেছি যে শান্তির ধর্মগুলো সে যেকোনো ধর্ম হোক, ধর্ম মানেই তো শুনি যে শান্তির ধর্ম। সেগুলো সব সময় কিন্তু সুযোগ পেলেই তলোয়ার ব্যবহার করেছে। অহিংসা ধর্ম প্রচারের জন্য পুন্ড্রবর্ধনে তিন হাজার জৈন সৈন্য হত্যা করা হয়েছিল। বলেছে ‘অহিংসা মানো?’ বলেছে ‘মানি না’! সঙ্গে সঙ্গে বলা হলো ‘মেরে ফেলো’।
দেবী: অশোক কী করেছিল?
ইলিয়াস: হ্যাঁ, অশোক কী করেছিল?
মুফাদ: কৈবর্তরা তো ওই মহীপালকে মেরেছিল।
ইলিয়াস: ওই যে যার নামে মাঠ ছিল, মাওলানা ভাসানীর কৃষক সম্মেলন হতো।
দেবী: মারা দরকার ছিল। ...ধান ভানতে মহীপালের গীত, প্রবাদ একটা।
ইলিয়াস: শীবের গীত না বলে মহীপালের গীত বলত। আমার মনে হয় মুফাদ যে বলল কৈবর্ত বিদ্রোহ ছাড়াও অন্য যে বইগুলো, মধ্যযুগের যেসব বই পাচ্ছি, সেখান থেকে কিন্তু ইতিহাসটাও আসছে। সময়টাও বেশ চমৎকারভাবে চলে আসছে।
দেবী: সেটা তার মধ্যে প্রবেশ করিয়ে পুনঃসৃষ্টি করেছি। এটা তো আমি চিরকালই করেছি।
ইলিয়াস: যেমন কবি প্রসঙ্গে আপনার বইতে দুটো জিনিস খুব ভালোভাবে এসেছে। যেমন একজন সন্ধ্যাকর নন্দী। যারা শাসকগোষ্ঠী তাদের কিন্তু কবি চাই, কবি চাই, তাই না?
দেবী: এখনো চাই।
ইলিয়াস: আমার মনে হয় এখনো উপরের শ্রেণির কবি চাই।
দেবী: হ্যাঁ হ্যাঁ, আছে।
ইলিয়াস: হ্যাঁ, আছে, না থাকলে চলে না। এখন ওই আনন্দ নামে একজন কেরালার লেখক, মহাশ্বেতা দেবী তাকে এখানে নিয়ে এসেছিলেন। তার মালয়ালাম ভাষায় লেখা একটা উপন্যাসের একটা অংশ কেরালার লোকরা, সেখানেও আছে যে কবি, রানি প্রত্যেকের চাই। রানি কিন্তু বদল হয়, বদল হতো আরকি, নতুন রাজা এলো রানি থেকে গেল। মানে রানি হলো একটা পদবির মতো। পদের মতো। ওই থেকে গেল। আবার কবিও ওই কবি রয়ে গেল। যে কবি আগের রাজাকে বন্দনা করেছে সে আবার নতুন রাজাকে বন্দনা করছে। এই একজন সন্ধ্যাকর নন্দী। আরেকজন হলেন বন্দ্যঘটি। ওঁর সম্পর্কে আপনি কিছু বলুন আমাদের। তিনি কিন্তু খাঁটি কবি।
দেবী: হ্যাঁ, কবি বন্দ্যঘটির জীবন ও মৃত্যু লেখা হয়েছিল। ওর মতো মুকুন্দরাম চক্রবর্তী আমাকে খুবই প্রভাবিত করেন। তার ওই যে কী করে আমি কবি হলাম গ্রন্থের বিবরণে আছে।...এখনো দামিনা গ্রামে মুকুন্দর নামে মেলা-টেলা হয় আর আমাকে ওরা খুব মানে। কারণ, মুকুন্দরামকে নিয়ে আমি একটা উপন্যাস লিখেছিলাম।
ইলিয়াস: কবিকে নিয়ে উপন্যাস, হ্যাঁ হ্যাঁ।
দেবী: মুকুন্দরাম বারবার ফিরে ফিরে তো আসছে। ব্যাধখণ্ডে ফিরে আসছে। কবি বন্দ্যঘটি নিয়ে সেইভাবে লিখেছিলাম যে আজকের দিনে একজন ডোম বা চণ্ডাল বা মেথর সমস্ত কর্ণাটকে, মহারাষ্ট্রে ওদের দলিত সাহিত্য আন্দোলন আছে। সে কবিতা লিখলে তাতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। কিন্তু তখন লেখাপড়া বিদ্যাচর্চা একেবারেই একটা শ্রেণির হস্তগত ছিল। ও একটা বিরাট স্বপ্ন দেখেছিল, মানে ও জন্মগত, যেটা ইয়ে সেটাকে ত্যাগ করে, দ্বিতীয় জন্মগ্রহণ করতে চেয়েছিল। ব্রাহ্মণ যেমন উপবীত নেয় তার দ্বিতীয় জন্ম হয়। মুক্তার দুটো জন্ম হয়। মুক্তা ঝিনুকের মধ্যে জন্মায় আবার বেরিয়ে এসে মুক্তার ওপর...।
ইলিয়াস: তাই নাকি?
দেবী: মুক্তোর মতো দুবার জন্ম, প্রথমে সিক্ত বস্তুরূপে, তারপর মুক্তায়। এ লোকটা নিজের একটা অর্জিত, আমরা প্রত্যেকে তাই করেছি। তবে অন্য রকম বৃত্তি অবলম্বন করেছি। তার জন্য অশ্রদ্ধেয় হই না। এটা একেবারে আধুনিক যুগের, এটা আধুনিক মানসিকতার একটা ব্যাপার, তখনকার দিনে সেটা সম্ভব ছিল না। একটা শ্রেণিরই হস্তগত ছিল এইটে করা। এবং একজন অরণ্য চুয়াড় যেখানে পরে চুয়াড় বিদ্রোহ হয়েছিল। অরণ্য চুয়াড় যে অরণ্যের পেছনে থাকত, সে এই কাজ করে। সে সেটাকে অস্বীকার করে, সে কবি হতে চেয়েছিল। যেহেতু সে সময়ের আগে জন্মেছিল, সেহেতু এই নগর তাকে বর্জন করল, মৃত্যুদণ্ড দিল। এবং অরণ্যে গিয়ে দেখে সেখানেও সে তার পথ ভুলে গেছে। সে তার নিজের ইয়েতেও ফিরে যেতে পারছে না। এটা একটা আধুনিকতা...
ইলিয়াস: হ্যাঁ, সমস্যাটা আমার মনে হয়েছিল যে, এটা একটা আধুনিক সমস্যা। এখানেও থাকতে পারল না আর। ওরা এসে পরে তাকে নিয়েই গেল আরকি জোর করে, এদিকে ওর প্রেমট্রেম হয়ে গেছে, বিয়েটিয়ে হয়ে গেছে।
দেবী: হ্যাঁ, সে প্রেমিকা যখন বলল ‘তুই চুয়াড়’, বলে মুখ ফিরিয়ে নিল। তার শরীরের মূল কৃমি, মানুষের শরীরে দুটো মূল কৃমি থাকে। মূল কৃমি তারা যেন মোচড় দিয়ে উঠল। তখন ও বুঝতে পারল এখানে তার কোনো জায়গা নেই। এই নগরীতে তার আর কোনো জায়গা নেই। প্রেমও তাকে আশ্রয় দিল না। সমাজব্যবস্থা দিল না। প্রেম দিল না। কেউ দিল না। সে অরণ্যের দিকে গেল। শেষ পর্যন্ত তাকে হত্যা করা হয়েছিল...
ইলিয়াস: এখন একটু গল্পের প্রসঙ্গে বলি কেমন? আপনার মধ্যযুগের পটভূমির যে গল্পগুলো আমাদের কাছে, আমার কাছে বিশেষভাবে আকর্ষণীয় এই জন্য যে, একই সঙ্গে বাংলার ওই সময়টাকে জানতে পারছি আবার লোকজন সম্বন্ধেও জানতে পারছি। গল্পের পরিণতিটা একটু নিষ্ঠুর হয়ে যাচ্ছে...
দেবী: যা হবার তা-ই হচ্ছে।
ইলিয়াস: হ্যাঁ, যা হবার তা-ই হচ্ছে। আমার মনে হয় এই যে, নিষ্ঠুরতা এটা আমাদের যে একটা ভুল ধারণা আছে যে, বাংলায় একসময়ে খুব ভালো লোকটোক ছিল, খুব সুজলা-সুফলা ছিল, [দেবী: কোনো দিনই ছিল না!] সে কোনো দিনই ছিল না। চর্যাপদ থেকেই তো প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে, তাই না? সেই নিষ্ঠুরতা মাঝে মাঝে একটু ইয়ে করে, অস্বস্তি দেয়। এই অস্বস্তি দেওয়ার মধ্যেই আপনার সার্থকতা! কিন্তু এগুলো যদি নিষ্ঠুর না হতো, তাহলে একটা তৃপ্তি তৃপ্তি ভাব নিয়ে...
দেবী: নিষ্ঠুর না ভেবে তুমি ‘নির্মোহ’ভাবে ভাবো।
ইলিয়াস: না দিদি, ‘নির্মোহ’-এর চেয়ে বেশি। নির্মোহ এই শব্দের ভেলায় কম হয়, [হাসি] এটাকে আমি ই করছি, না মানে, আমি বলব এটা আপনার সার্থকতা। কারণ, আমার মনে হয় লেখা কাহিনি, উপন্যাস—এগুলো মানুষকে তৃপ্তি দেবার জন্য লেখা না। মানুষকে অস্বস্তির মধ্যে ফেলাই লেখার কাজ।
দেবী: কখনোই না! কখনোই না! আমার ভালো লেখাগুলো সম্পর্কে আমি কখনোই তা বলব না।
ইলিয়াস: মানুষকে তৃপ্তি দেয়ার দরকার কী?
দেবী: অত আনন্দে রাখার কোনো দরকার নেই।
ইলিয়াস: [হাসি] অন্তত সুখে রাখার দরকার নেই, নাকি?
দেবী: একেবারেই না।
ইলিয়াস: হ্যাঁ, আমার মনে হয় এই যে কাঁটাগুলো আপনি বিঁধিয়ে দিয়েছেন, এটা ভালো।
দেবী: আমরা তো আলোচনা করে একমত হয়েছি। আমি তোমার চিলেকোঠার সেপাই সেটাই স্মরণ করেছি। শব্দ তো সশস্ত্র। শব্দ তো আঘাত করে। শব্দ তো ভদ্রলোকের সব সভ্যতা ভেঙে দেয়। মৃত্যুর পরে হাড্ডিখিজির এসে বলছে না ‘থাকেন ঘরের মধ্যে বইয়া থাকেন আর মুট্টি মারেন বইয়া বইয়া’। এর মানে তো কিছুই না। হস্তমৈথুন করার কথা বলা হয়েছে। এটাই তার ভাষা। এভাবেই সে বলতে পারে। এগুলো করতে হবে তো। না করে তো হবে না। হ্যাঁ, আমার মনে হয় এগুলোই করা উচিত।
ইলিয়াস: মধ্যযুগ নিয়ে কি আপনার আরও গল্প লেখার ইচ্ছা আছে?
দেবী: মধ্যযুগ নিয়ে তো আমি বেশ কিছু লিখেছি।
ইলিয়াস: দিদি, মধ্যযুগ কথাটা বলতে খারাপ লাগে একটু।
দেবী: মধ্যযুগ না, তুমি [ইলিয়াস: দ্বাদশ শতাব্দী] বলতে পারো এগারো শতাব্দী, বারো শতাব্দী এইভাবে। বেশ কিছু লিখেছি।
ইলিয়াস: তো আপনার মধ্যযুগের যে গল্পগুলোর পটভূমি, নাম, তার খাবারের যে বর্ণনা অনেকটা ‘মঙ্গল কাব্য’ থেকে নেওয়া, না?
দেবী: যা পড়েছি, তা থেকে নেওয়া।
ইলিয়াস: নামগুলো মিলে যাচ্ছে। ওই সব নাম এখন চলবে না।
দেবী: নাহ্।
ইলিয়াস: আপনি সাংঘাতিক খাবারের বর্ণনা দিয়েছেন। সেগুলো নিজে খেতে চান না। আরকি!
দেবী: অনেক বর্ণনা দিয়েছি। সঠিক বর্ণনা।
ইলিয়াস: তার মধ্যে আধুনিক খাবার নিশ্চয়ই নেই, তাই না?
দেবী: সে যুগে তো আর এ যুগের খাবার চলবে না।
ইলিয়াস: তারপর মেয়েদের যে কষ্ট নিয়ে আজকাল খুব কথাবার্তা চলছে না? এই যে নারীবাদী ব্যাপার-ট্যাপার যে চলছে, কিন্তু মেয়েদের কষ্ট নিয়ে গল্প মহাশ্বেতা দেবী অনেক আগেই লিখেছেন...সাধারণ মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকেই সেসব লেখা হয়েছে।
দেবী: সমগ্র শ্রেণিটাই যদি দারিদ্র্যসীমার রেখার নিচে থাকে একটা মেয়েকে আলাদা করে তুলে নিয়ে উন্নত করা কী করে যেতে পারে? তার স্বামীও তো সমান নির্যাতিত। তার পুত্রও নির্যাতিত। শুধু মেয়েটিকে কী করে আলাদা করা যাবে?
ইলিয়াস: এবার একটু অন্য প্রসঙ্গে। এটা গৌরাঙ্গ বলেছে ঠিকই। যেটা আপনার সঙ্গে আমাদের অনেক আলাপ হয়েছে একটু বলি। পশ্চিমবঙ্গের বাইরে বিহার কিংবা রাজস্থানের যে পটভূমিতে আপনি গল্প লিখেছেন, রুদালী এসব জীবন নিয়ে লিখতে গিয়ে কি ভাষার...
দেবী: রুদালীটা একেবারেই পালামৌর পটভূমিতে লেখা হয়, তাতে মোটামুটি আমি কখনোই আদিবাসী ভাষাও লিখিনি। কিন্তু আদিবাসীদের কথা বলার ধরন সেটা এনেছি। যেভাবে তারা কথা বলে, বুঝতে পেরেছ? তুমি যখন পড়ছ তখন মনে হবে তুমি ওদের ভাষায় কথা বলছ, রুদালী, নৈর্ঋতের মেঘ-এর মধ্যে আছে। পালামৌর পটভূমিতে লেখা অন্তত নৈর্ঋতে মেঘ এবং পরবর্তী অনেক বইয়ে আমি পালামৌকে রেখেছি ভারতের দর্পণ হিসেবে। সর্বত্র যা ঘটে তাই। ঠিক আয়না দিয়ে দেখা যাবে সমস্ত ভারতবর্ষে এই ঘটনা। আর সিনেমা করার সময় কল্পনা লাজমী দেখতে ভালো লাগবে বলে রাজস্থানে নিয়ে যায়। তার সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই।
ইলিয়াস: সিনেমা যে কী জিনিস...
মুফাদ: নাটকটা কেমন হয়েছিল?
দেবী: নাটকটা অনেক সঠিক হয়েছিল।
ইলিয়াস: আচ্ছা, এবার আরেকটা প্রসঙ্গে আসি। আমরা বাংলাদেশে আর কী, ভারতে যে অন্যান্য, পশ্চিম বাংলার বাইরে যে সাহিত্যচর্চা চলছে, যেমন বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতে, কেরালা, কর্ণাটকে, এসব সাহিত্য সম্পর্কে এখানে আমরা কিন্তু প্রায় অজ্ঞ, তাই না? তো পশ্চিম বাংলায় কিছু কিছু অনুবাদ হয়েছিল এমনকি মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় অনুবাদ করেছিলেন। সেগুলোও তো মনে হয় না খুব একটা সাড়া তুলতে পেরেছে পশ্চিম বাংলায়।
দেবী: না না, পশ্চিম বাংলার লেখক সমাজ অন্যান্য রাজ্যের সাহিত্য সম্পর্কে, ভাষা সম্পর্কে খুবই কম খবর রাখেন বা রাখতে চান। কিন্তু পশ্চিম বাংলার বাইরে অন্যান্য ভাষায় মহান সাহিত্য সব লেখা হয়েছে, যার খবর আমরা কিছুই রাখি না, পড়ি না। গোপিনাথ মহান্তীর অমৃতের সন্তান বা পরজা আমরা কেউ পড়িনি। পরজা ইংরেজিতে অনুবাদ আছে। পড়লে হাড় কেঁপে যাবে। তারপরে শিবশঙ্কর পিল্লাইয়ের চিংড়ি, ছবিও হয়েছিল। তারপরে শিবরাম কারান, নায়ার, বশির, রামানুজ, আনন্দ—অনেকের লেখা আমরা পড়িনি। কর্ণাটকের একটা সুবিধা হচ্ছে দ্বাদশ শতাব্দীতেই ‘বাসোবা’ নামে একজন কবি বিদ্রোহ করেন, উনি ব্রাহ্মণ অর্থোডক্সের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেন। এবং তখন থেকেই দলিত জাতি, যাদের এখন বলা হচ্ছে, তারা লিখতে আরম্ভ করে।
ইলিয়াস: তাই, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে?
দেবী: হ্যাঁ, দ্বাদশ শতাব্দী থেকে। ওখানে দলিত সাহিত্যের একটা বিশাল ইতিহাস আছে। সেটাই বাড়তে বাড়তে এসে এই সময়কালে পৌঁছেছে।
ইলিয়াস: দলিত সাহিত্য পশ্চিম বাংলাতেও বেশ বলা হচ্ছে, আরকি।
দেবী: এখন বলা যা-ই হোক না কেন, সেগুলো সাহিত্য। এগুলো দলিতও বটে, সাহিত্যও বটে। আমি বলছি, জাতিধর্মনির্বিশেষে একদম অন্য জাতির লেখা, সেটা কর্ণাটকে সবচেয়ে বেশি হয়েছে। কিন্তু অন্যান্য ভাষাতেও তারা সকলেই যে নিম্নবর্ণ তা নয়, খুব ধনী সাহিত্য আছে। চমৎকার সাহিত্য। যেমন রাজস্থানে একটা লোক আছে—বিজয়দাং, সে সমস্ত রাজস্থানের ফোকলোর সংগ্রহ করে বিরাট ২০ খণ্ড বার করেছে। আর প্রতি সন্ধ্যায় সে গ্রামের লোকজন নিয়ে বসে, চারণ কবির মতোন। খাওয়াদাওয়া শেষ করে একটা হ্যাজাক নিয়ে বসে এবং তাতে সে শুধু রাজস্থানী গাঁথা-টাথা নয়ই, রাজস্থানের প্রতিটা গাঁথার নিজের ভার্সন আছে, সেগুলো খুব মজার, যাদের বীর বলে চিত্রিত করা হয়, তাদের সম্বন্ধে অনেক কথা আছে। আবার সে লোকটা আমার অনুমতি নিয়ে...তারপরে দেখি রাজস্থান থেকে চিঠি আসছে, গ্রামের লোকেরা চিঠি লিখছে অরণ্যের অধিকার নিয়ে, নৈর্ঋতে মেঘ নিয়ে। তার মানে বিজয়দং ওটা...ওর ওই সন্ধ্যে বেলার অনুষ্ঠানে এখনো আধুনিক সাহিত্য পড়া হয়। এবং সেসব জায়গায় অন্যান্য ভাষা সাহিত্য পৌঁছে গেছে। এটা একটা অসামান্য জিনিস।
ইলিয়াস: আপনি যাদের নিয়ে এসেছিলেন এখানে, এরা কিন্তু বাংলা সাহিত্যের ভালোই খবর রাখে।
দেবী: প্রতিটা ভাষায় বাংলা গল্প-উপন্যাস অনুবাদ হয়, মালয়ালামে তো কথাই নেই, প্রাচীন দিন থেকে আজ পর্যন্ত। জসীমউদ্দীনের নকশীকাঁথার মাঠ কবেকার অনুবাদ, সোজন বাদিয়ার ঘাট... [ইলিয়াস: তাই!] হ্যাঁ, সোজন বাদিয়ার ঘাট। এগুলো বহুদিন থেকে অনুবাদ হয়ে আসছে। আমরা খবর রাখি না। সেই হিসেবে বাঙালি লেখকদের নাম বিশেষ করে ঔপন্যাসিকদের নাম পরিচিত। অন্য ভাষা থেকে বাংলায় অনুবাদ কাজটা হয়নি। তবে আমি ওদের কাছে বেশি পরিচিত বা প্রিয় এই জন্য যে, আমি সব সময় নিজেকে ভারতীয় লেখক বলে মনে করি। আমি ভারতীয় লেখক। আমি বাংলায় লিখি এবং আমি সেইভাবেই ওদের সঙ্গে মিশি, সেটা তো তুমি দেখলে। সব সময় এ দায়িত্বটা আমার ওপর এসে পড়ে।
ইলিয়াস: না, পশ্চিম বাংলার এই ধরনের লেখকদের একধরনের উন্নাসিকতা আছে আরকি, যে আমাদের বাইরে কেউ নেই।
দেবী: ভীষণভাবে।
ইলিয়াস: আমরা যে আমাদের বাইরের কেউ নেই। আমাদের লেখকেরাও তাই। আমরা লাতিন আমেরিকার খবর রাখি। না রাখলে তো একটা লজ্জার ব্যাপার, তাই না?
দেবী: এটা আমি অন্য প্রসঙ্গে খুব নিমর্মভাবে লিখেছিলাম। যখন বর্তিকায় মুসলিম সমাজ ভাবনা, তার আগে বর্তিকায় আমি সিরিয়ালি মুসলিম লেখকদের গ্রামগঞ্জ থেকে ধরে ধরে কত লেখা ছেপেছি ঠিক নেই। আরে বাপ রে বাপ! যাহোক, হাফিজুর রহমান, ভাটায় এসে দর্জির দোকানদারি পায়। তার জীবনই এমন বিচিত্র যে সে কোনো দিন বলা যায় না। অসামান্য লেখা। আমি বলেছিলাম, গল্প কবিতা চাই না। তুমি আকিকার বিষয়ে লেখো। তুমি সামাজিক বিষয়ে লেখ। বিবাহ প্রথা বিষয়ে লেখো। মুসলিম সমাজে এসবই এসেছিল এবং এটা আমি দীর্ঘদিন থেকে বলে আসছি, ঘষামাজা করে আসছি যে একজন ফরাসি বা ইংরেজদের বিয়ের সময় কী হয় না হয়, কী করে না করে, আমরা সব জানি। কিন্তু আমরা মুসলিম সমাজ সম্পর্কে কিছুই জানি না।
ইলিয়াস: না জানার কী অবস্থা!
দেবী: আকিকাতে কী হয়? বিয়েতে কী হয়? ফরজ কাকে বলে, দেনমোহর কেন? এমনকি তাদের উত্তরাধিকার আইন কী? এটা বর্তিকার মুসলিম সমাজ ভাবনাতে আছে। আমি বলেছিলাম, আগে তথ্যবাহী লেখাগুলো লিখবে, সমাজ পরিচিতি। আর আমাদের দেশে মুসলিম যাঁরা লেখেন, তাঁরা কখনোই নিজ সমাজ নিয়ে লেখেন না।
ইলিয়াস: আপনাদের ওখানে আবুল বাশার তো আছেন।
মুফাদ: বাশারের লেখাতে তথ্য যেগুলো আমাদের সমাজ-সম্পর্কিত, খুব ভালো।
ইলিয়াস: হ্যাঁ হ্যাঁ, সেটাই বলতে চেয়েছিলাম।
দেবী: বাংলাদেশে যে রকম, মুর্শিদাবাদে সে রকম হবে না। কতগুলো জিনিস তো এক হবে। উত্তরাধিকার আইনটা একরকম হবে।
ইলিয়াস: না, এটা ঠিক, উনি যেটা বলছেন, পশ্চিম বাংলার মুসলমান লেখক কেউ কেউ লিখছে, শুধু মুসলমানদের বিশেষ বিশেষ সমস্যা নিয়ে। সে সমস্যাগুলো আছে, ঠিক অত প্রকট নয়। ওরা যেভাবে দেখাচ্ছে যে এ ছাড়া, যেমন বাঙালি মুসলমানদের তালাক ছাড়া আর কিছু করার নেই। [হাসি] এমনকি বিয়ে না করলেও চলবে, কিন্তু তালাক দিতে হবে।
ইকবাল: এরা সবাই একাধিক বিয়ে করে।
ইলিয়াস: না, বিয়ে না করলেও চলবে, কিন্তু তালাক দিতে হবে।
দেবী: আমি বলেছি, যার মধ্যে বসে আছ, তা-ই নিয়ে লেখো। আরে, তিতুমীরকে নিয়ে কেউ একটা উপন্যাস লিখল না আমার আগে!
মুফাদ: তিতুমীরকে নিয়ে কোন লেখাটা দিদি?
দেবী: তিতুমীর নামেই একটা উপন্যাস।
ইলিয়াস: মুস্তফা সিরাজ কিন্তু প্রথম দিকে মুসলমানদের নিয়ে লিখতেন না, তাই না? এখন লিখছেন যথেষ্ট। বেশ ভালো।
দেবী: দুর্ভাগ্যটা হচ্ছে, নতুন লেখক সেইভাবে প্রতিনিধিত্বশীলভাবে উঠে আসছে না। আমাদের মধ্যে তরুণ কোনো মুসলিম লেখক থাকলে তার কাছে হিন্দু সমাজ নিয়ে...এখন হচ্ছে তো শিক্ষিত হিন্দু শিক্ষিত মুসলমান একসঙ্গে বিয়ে করছে, থাকছে, এই করছে, ওই করছে। কাজেই তারা তেমন সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে না। সমস্যাগুলোকে খানিকটা কাছে... আমি অনেক চেষ্টা করেছি শামসুল আলম সে ওই বস্তিতেই থাকত। সে শেষ পর্যন্ত একটা খুব রাবীন্দ্রিক ভাষায় লিখল। একজন মুসলিম মহিলা লেখককে এত দিন ধরে চর্চা করালাম... ফল হলো, তিনি একটা রান্নার বই লিখলেন। এই যে এই মেয়েটা তাহমিনা খাতুন, যে বিয়ে করল সুকুমার মিত্রকে, যাদের নিয়ে এত সমস্যা হচ্ছে, থাকার জায়গা পাচ্ছে না, এত লড়াই করছে, এত বলেছি তোমার জীবনের কথা লেখো। না, লেখেনি।
ইলিয়াস: নিজের জীবনী লিখতেও ভয় হয়।
দেবী: তার তো ভয়ের কিছু নেই। তার পেছনে সবাই দাঁড়িয়ে আছে, সবাই তাদের সমর্থন করছে।
ইলিয়াস: একেবারে আমি দেখলাম, স্বপ্নময় নামের এক ছেলে এই মুসলিম সমস্যার কিছু নিয়ে এসেছে। এই হিন্দু মুসলমানের বিয়ে-টিয়ে—এসব।
দেবী: আমি বলছি, মুসলিম সমাজকে যথেষ্ট জানব, এটা কেউ লেখেনি। সৈয়দ মুজতবা আলীর কিছু কিছু লেখায় পাই। অনেক আশা করে বাংলা একাডেমির থেকে কিছু মুসলিমদের আত্মজীবনী নিয়েছিলাম। তখন দেখি, তার মধ্যে কিছুই নেই। তারা কীভাবে পাক-সরকারে যোগ দিল, এ ছাড়া আর কিছুই নেই।
ইলিয়াস: সরাসরি রাজনীতি আছে।
দেবী: আছে। কিন্তু সমাজচিত্র নেই।
ইলিয়াস: আবুল মনসুর আহমদের সেখানে রাজনীতি আছে, কিন্তু সমাজ নেই। এ দুটো তো অবিচ্ছেদ্যভাবে আসতে পারে।
দেবী: বেগম রোকেয়াকে নিয়ে বা সুফিয়া কামালকে নিয়ে কেউ যদি উপন্যাস লিখত, কিছু তো হতো। ওই জাহানারা সেদিন মারা গেলেন—জাহানারা ইমাম, তাঁকে নিয়েও লেখা যেত। যথেষ্ট কাজ করা হয়নি।
ইলিয়াস: আমাদের দেশ তো এখনো অনাবিষ্কৃত, খালি পড়ে আছে। উর্বর ভূমি...
দেবী: না, পশ্চিমবঙ্গেও যথেষ্ট কাজ করা হয়নি। আমি খানিকটা কাজ করেছি। তাই তোমরা আমাকে নিয়ে এত জ্বালাতন করছ!
ইলিয়াস: [হাসি] কাজ করলে তো জ্বালাতন সহ্য করতেই হয়। তাই না? ...হ্যাঁ, আবু জাফর শামসুদ্দীনের লেখায় সমাজ কিছু আছে।
দেবী: সমাজ কিছু থাকার কথা বলছি না। মুসলমান সমাজ ও জীবন নিয়ে সেই উপন্যাস... বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী উপন্যাসের মধ্যে তো তখনকার গ্রাম জীবন প্রচুর উঠে আসে। গরিবের কী অবস্থা ইত্যাদি ইত্যাদি।
ইকবাল: আব্দুল ওদুদের লেখাতে কিছু কিছু আছে।
ইলিয়াস: কিন্তু সেটা আর্ট হয়নি। একটা কাজ শিল্প তো হতে হবে, তাই না।
দেবী: শিল্প তো হতে হবে...
ইলিয়াস: হ্যাঁ, শিল্প তো হতে হবে, তারপরে তো, তা ছাড়া হবে কী করে?
মুফাদ: লালসালু...
ইলিয়াস: হ্যাঁ, লালসালু প্রথম... কিন্তু শিল্প হলো বলেই তো হলো। ...একটা জিনিস দিদি সেটা বলি, মানে বাংলা উপন্যাস সম্পর্কে। উপন্যাস যখন শুরু হয়, মানে ইউরোপে আরকি, পুঁজিবাদের বিকাশের পর, কিন্তু প্রথম থেকেই কিন্তু বুর্জোয়া সমাজকে সমালোচনা করে আসছে। তাই না? সব সময়। বুর্জোয়া বা ফিউডাল সব, ডন কুইকসোট থেকে কিন্তু হয়েছে। নানা গল্পে, সেখানে কিন্তু সমাজের উপরের অংশকে আক্রমণ করা হয়েছে। এমনকি আরব্য রজনী, আরব্য উপন্যাসগুলোতেও হচ্ছে। বাংলা উপন্যাসে এসে হুতোম পেঁচার নকশা কিংবা আলালের ঘরের দুলাল... এসবে কিন্তু সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। বঙ্কিমচন্দ্র এগুলোকে সমূলে উৎপাটন করলেন। উৎপাটিত করলেন না? যেখানে অন্য জায়গায় অন্য ভাষার উপন্যাসে দেখছি যে, প্রচলিত সংস্কারগুলোকে আক্রমণ করা হচ্ছে, সেখানে বঙ্কিমচন্দ্র প্রচলিত কুসংস্কারকে মূল্যবোধ বলে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাই না? কারণ, এই যে দেবী চৌধুরাণীর মতো চমৎকার মেয়ে, যে বাইরে এল, তাকে শেষ পর্যন্ত হারামজাদা স্বামীর পায়ের উপর ফেলে দিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র তৃপ্তি পেলেন। তাই না ব্যাপারটা? এ কারণে আমি বলছি, এটা সাজানো উপন্যাস। বঙ্কিমচন্দ্র যে কাজটা করে গিয়েছিলেন, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে সেটাই ফলো করা হয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্রের শুধু ছিমছাম গল্পের দিকে ঝোঁক ছিল বেশি। আমি কোনো রকম বিভাজন করছি না। কোনো রকমই না। মুসলমানরা যখন উপন্যাস লিখতে শুরু করল, সেটা আর্ট হলো না, কিন্তু তা পীরবাদের বিরুদ্ধে গেল, যেমন আবদুল্লাহ উপন্যাস। আবদুল্লাহ মোটেই ভালো উপন্যাস নয়, কিন্তু উপন্যাসে...
দেবী: তুমি বিষাদ সিন্ধু পড়ো। এটা একটা খাঁটি লেখা। যেসব কথা লেখা আছে, অসাধারণ, একটা অসামান্য উপন্যাস। সেগুলো এখন আমরা লিখতে পারতাম না। এখন লিখলে তো মুরতাদ হতো... ‘জমীদার দর্পণ’ দেখো...
ইলিয়াস: আমার মনে হয়, বাংলাদেশের যে সমাজ আছে, হিন্দু মুসলমান সব নিয়ে যে সমাজ আছে, সেটা উঠে আসবে। সেটা উঠে আসবে, তবে সময় লাগবে। মনে হয় সেটা ভালোই হবে...
নোট
এই পর্যায়ে ইলিয়াসের আগ্রহে মহাশ্বেতা দেবী গান করতে থাকেন: ‘আমার কানতে জনম গেল রে, আমার ভাবতে জনম গেল রে; আমি কেন তারে মন রে দিলাম...’। এরপরের পর্ব আর অনুষ্ঠিত হয়নি।