দুটো দুষ্প্রাপ্য অপ্রকাশিত ও অগ্রন্থিত কবিতা


বিড়লার রাত্রি

সিকদার আমিনুল হক

ক্লিনিক্যাল ডেথ্। যার শাদা অর্থ, ভেসে আছো তুমি।
ওপরে নীলিমা আর নিচে ঘিঞ্জি, দুপুরের ভিড়। 
বিছানার চারপাশে ব্যস্ত নার্স সেবায় বিশুদ্ধ;
তাহলে নিশ্চিত নয়; কেউ নেমে আসে, আর কেউ
ভাসায় অনন্ত ভেলা!... যেন চিতাবাঘ—হরিণের
খেলা অরণ্যের চেয়ে এখানেই বেশি খাপ খায়
আপাতত জিরাফের মতো লম্বা-গলা অন্ধকারে।
দেখেছি সুদূর চোখে ঘটে গেলো কত রূপান্তর।

বিড়লার মাঝরাত্রি। শব্দ শুনি রূঢ় হাতুড়ির
কাঁচা কাঠে বসে যাচ্ছে ঝকঝকে নির্ভুল পেরেক
কফিন বানানো শেষ; ডানে-বায়ে পরিচয়হীন
সহযাত্রী সব, নানা বয়সের। তারাও এখন
চিতা আর কবরের মাঝামাঝি! অক্সিজেন মাস্ক
শোনায় ঝর্নার শব্দ, ঝিঁঝিঁ ডাক, কুকুরের হাই

সম্পাদকের নোট

বাংলা ভাষার অন্যতম আধুনিক কবি সিকদার আমিনুল হক নব্বই দশকে ভারতের বিড়লায় চিকিৎসার জন্য যান। ১৯৯২ সালে তিনি কবিতাটি লিখেছিলেন অসুস্থ অবস্থায়। বিড়লার রাত্রি কবিতায় দেখা যায়, মৃত্যুর সফেদ ইশারা দিয়েই শুরু আর শেষ হয় নৈঃশব্দ্যের দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে। তাঁর কবিতা জায়মান আধুনিক জীবনের ক্ষয় ও বিচ্ছেদি শোকের প্রতিচ্ছবি। আমাদের বিশ্বাসপাঠক কবিতাটিতে কবির নিজস্ব স্বর টের পাবেন।  

 

 

শিরোনামহীন

হুমায়ুন আজাদ

যখন আমরা দূরে সরে যাচ্ছি নিজেদের 
থেকে, সে-সময় কেউ কেউ পৌঁছে যাচ্ছি
গন্তব্যে—যেমন পৌঁছে গেছেন সিকদার আমিনুল
হক, কবি, শুধু কবি। এখানে কিছুই ধরে রাখতে 
পারে না আমাদের—প্রেম, কাম এই সব
শব্দপুঞ্জ, পুত্র, প্রেমিকা, কন্যা, বন্ধু কেউ ধ’রে
রাখতে পারে না। হৃদয়—দুরন্ত শত্রু, যৌবনে শুধুই
কাঁপে, একদিন সে-ই করে প্রতারণা। সিকদার 
ঘুমিয়ে আছেন, তাঁকে আমরা কিছুই পারি না দিতে,
এমনকি প্রেমিকারাও তাঁকে আর হৃদয় বা দেহ,
একটি কবিতার পংক্তিও পারবে না দিতে। কবি, গন্তব্যে 
পৌঁছে গেছেন, দুর্বোধ্য পুষ্পের মতো রেখে
গেছেন কোমল কবিতাগুচ্ছ, আজ থেকে শুধু তিনিই
উড়তে পারেন মেঘ, পুষ্প এবং কবিতা আমাদের দিকে।
 

সম্পাদকের নোট

সিকদার আমিনুল হককে নিবেদিত কবিতাটি লিখেছিলেন সমকালীন আরেক কিংবদন্তি লেখক বন্ধু হুমায়ুন আজাদ। ২০০৩ সালে তাঁর মৃত্যুর পর হুমায়ুন আজাদ কবিতাটি লেখেন। আর এটি প্রকাশিত হয় সিকদার আমিনুল হকের স্মরণসভার পুস্তিকায়। পুস্তিকায় প্রকাশিত কবিতার কোনো শিরোনাম ছিল না। সম্পাদকীয় তরফে শিরোনামহীন নামটি দেওয়া। তর্ক বাংলার জন্য কবিতা দুটো দিয়েছেন কবিপুত্র সালমান তারিক মিশা। সহযোগিতার জন্য আমরা উভয় কবি পরিবারের কাছে কৃতজ্ঞ।