আলেক্সিস দিয়াস পিমিয়েন্তার তিনটি কবিতা
আলেক্সিস আন্দ্রেস দিয়াস পিমিয়েন্তা
কবি, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, গবেষক, শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষক আলেক্সিস আন্দ্রেস দিয়াস পিমিয়েন্তার জন্ম ১৯৬৬ সালে কুবার হাবানা শহরে। একটি সাহিত্য ও সংস্কৃতিমনস্ক পরিবারে জন্ম-নেওয়া আলেক্সিস একেবারে শিশুকাল থেকেই মুখে মুখে কবিতা বানানোতে পারঙ্গম ছিলেন। তাঁর সেই সহজাত দক্ষতাই কালক্রমে তাঁকে শুধু কুবার নয়, সমগ্র স্প্যানিশভাষী দুনিয়ারই অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন তাৎক্ষণিক, কথ্য-কবিতা রচয়িতার সপ্রশংস স্বীকৃতি এনে দেয়। দেসিমা ও রেপেন্তা নামক এই দুই কথ্য-কবিতার আঙ্গিককে তিনি কুবায় এতটাই জনপ্রিয় করে তোলেন যে, একপর্যায়ে সেখানে এই বিষয়ে চর্চা করার জন্য দু’দুটো আন্তর্জাতিক কেন্দ্র গড়ে ওঠে এবং একে ঘিরে একাধিক সাহিত্য উৎসবও প্রচলিত হয়, মূলত আলেক্সিরই উদ্যোগে। গদ্য-পদ্য মিলিয়ে পঞ্চাশটির অধিক গ্রন্থের জনক আলেক্সিস পিমিয়েন্তা ‘আর্নেস্ট হেমিংওয়ে স্টোরি প্রাইজ’সহ দেশে-বিদেশে অসংখ্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তাঁর রচনাসমূহ ইংরেজি, ফরাসি, জার্মান, পর্তুগিজ, ইতালীয়, আরবি, ফারসি ইত্যাদি বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। ১৯৯০ সাল থেকে তিনি স্পেনে বসবাস করছেন।
সেন্সরশিপ
চিত্রসাংবাদিক সামুয়েল আরান্দার জন্য
যুদ্ধে আপনি
স্তূপাকার লাশের ছবি তুলতে পারেন
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লাশের ছবি
সৈনিকের লাশ যার কখনো কোনো প্রেমাস্পদ ছিল না
তরুণ, অতটা তরুণ নয়, এবং বৃদ্ধাদের লাশ
পিতামহ, পিতামহীর লাশ; মাতামহ, মাতামহীর লাশ
শিশুদের লাশ
প্রেমিকযুগলের লাশ
যারা আগের রাতেই সঙ্গমে মেতেছিল,
গর্ভবতী নারীদের লাশ
রোগীদের লাশ, যারা ঠিক সেই রোগে মারা যায়নি
এবং আপনি ছবি তুলতে পারেন
আহতদেরও, সবরকম অর্থেই আহতদের,
এবং চূর্ণ-বিচূর্ণ দালানকোঠার
এবং অংশত ধসে-পড়াদেরও
এবং হাসপাতাল ও স্কুলের ধ্বংসাবশেষ
এবং শহরের মাঝখানে বোমার আঘাতে সৃষ্ট গর্তসমূহের
এবং ক্ষুধার
এবং লাশের
এবং ফুটপাথে ছড়িয়ে থাকা মগজের
এবং মৃত্যু উগরে-দেওয়া বিমানসমূহের
যেনবা জীবন তাদের আঘাত করেছে
এবং জ্বলন্ত ট্যাংকের
এবং অবিস্ফোরিত বোমাদের
এবং ক্যাকটাসের মতো ছড়িয়ে থাকা মনুষ্যবিধ্বংসী মাইনসমূহের
এবং একপেয়ে মানুষদের, যারা ভুল করে ঐ ক্যাকটাসে পা দিয়ে ফেলেছিল
এবং ফুটবল খেলতে পারার মতো পা-বিহীন মানুষদের
এবং ফসিলের মতো হাড়সমূহের, যারা মাত্র কিছুদিন আগেই
সংযুক্ত ছিল নাম-পদবীঅলা মানুষের শরীরের সঙ্গে
এবং আবারও রক্ত, অনেক রক্ত, শুধু রক্তের ছবি।
যুদ্ধে তারা আপনাকে সব, সব, সবরকমের ছবিই তুলতে দেবে।
কেবল ক্রন্দনরত সৈনিকদের ছবি ছাড়া!
স্প্যানিশ ফটোগ্রাফার সামুয়েল আরান্দা আলিঙ্গন করে ফাতিমাকে
আর ফাতিমা আলিঙ্গন করে জাইদকে
বুলেট থেকে বাঁচার জন্য সামুয়েল আরান্দা যখন মসজিদে ঢোকে
মসজিদ তখন আহতের নীরবতায় এবং মরিয়া চিৎকার-করা
অপরাপর লোকজনে ভরে ছিল।
কেবল ফাতিমা ছাড়া।
ফাতিমা জাইদকে বুকে জড়িয়ে ছিল।
কালো বোরকায় চোখ ছাড়া আর সব-ঢাকা
ফাতিমা তার ছেলে জাইদকে শক্ত করে ধরে ছিল।
জাইদের জামাহীন শরীর থেকে রক্ত ঝরছিল।
ফাতিমা, বোরকার আড়ালে লুকানো, কাঁদছিল।
জাইদ প্রচণ্ড আহত, তবে তখনও শ্বাস ফেলতে পারছিল কোনোমতে।
ফাতিমা তার মাথা কোলের কাছে জোরে চেপে ধরেছিল।
জাইদ তখন আর শ্বাস নিতে পারছিল না, কেবল রক্ত ঝরে যাচ্ছিল তার।
ফাতিমাও আর শ্বাস নেওয়া নয় কেবল কাঁদতে পারছিল।
জাইদ তার ছেলে, একটু একটু করে মরে যাচ্ছিল।
জাইদ তার ছেলে এবং একটু পরেই সে মারা যাবে।
আর তখনই স্প্যানিশ ফটোগ্রাফার সামুয়েল আরান্দা তাদেরকে দেখতে পেয়ে
ক্যামেরা বার করে এবং আলোর আংরাখায় তাদেরকে ঢেকে দেয়।
জাইদকে আলিঙ্গনরত ফাতিমাকে সে আলিঙ্গন করে [আলোর আংরাখায়]।
ফাতিমাকে সে এমনভাবে আলিঙ্গন করে যেন সে তার কন্যা।
ফাতিমাকে সে আলিঙ্গন করে যেনবা আলোর আংরাখার
আলিঙ্গনে সে তার ছেলে জাইদকে বাঁচাচ্ছে।
সে তার কাছে যা কিছু আছে তার সবটুকু দিয়ে তাকে আলিঙ্গন করে,
একমাত্র সম্পদ তার : ক্যামেরা ও ক্যামেরার আলো দিয়ে।
ঘণ্টাখানেক আগে ফাতিমা তার বাড়িতে বসে
শান্তভাবে রেডিওর খবর শুনছিল।
দিনটা ছিল ১৫ই অক্টোবর, আর জাইদ তাকে বলেছিল
সেদিন সকালে সে মিছিলে যোগ দিতে যাবে।
ফাতিমা রেডিওতে গুলি আর ট্যাংক
আর মর্টারের গোলাবর্ষণের কথা শোনে।
সে তখন শহরে ছুটে যায়। এবং লাশের স্তূপের মধ্যে তাকে খোঁজে।
এবং হাসপাতালের আহতদের মাঝে তাকে খোঁজে।
এবং একসময় সে তাকে খুঁজে পায়, বারান্দায়।
তার ছেলে জাইদ তখন শ্বাস নিতে পারছিল না।
সে তখন জাইদকে কোলে তুলে নেয় পৃথিবীর সকল মায়ের মতো।
কালো বোরকা আর সাদা দস্তানা-পরা হাতে সে তাকে বুকে তুলে নেয়।
কালো কাপড় পরনে মেঝেতে বসা সে তাকে দুহাতের মধ্যে তুলে নেয়।
কালো কাপড় পরা এবং জীবিতের ভান করা।
কালো কাপড় পরা এবং সামুয়েল আরান্দার ক্যামেরার আলো না-দেখা।
সেই চোখগুলোকে দেখতে না-পাওয়া, যারা তখন গোটা জগৎকে দেখাতে উদগ্রীব
কী করে মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেকে আলিঙ্গন করতে হয়।
আগামীর যুদ্ধগুলোর জন্য শিখে নাও:
রক্ষাকারী হাতের নিখুঁত কোণ, কোলের ওপর তার সঠিক অবস্থান
এবং কী করে তার ঘাড়ের নিচে হাত রাখতে হয়
তার প্রাপ্তবয়স্ক শিশুর: জামাহীন, আহত, মৃত।
আর তারপর মসজিদের হুল্লোড়ের মধ্যে
যন্ত্রণার্ত চিৎকারসমূহ ছাপিয়ে
একটি শব্দ হয়... ক্লিক!
ফটোগ্রাফার এডি অ্যাডামস তাঁর ক্যামেরার এক ক্লিকে জেনারেল নগুয়েন নক লোনকে হত্যা করেন এবং পুলিৎজার জিতে নেন
জেনারেল তাঁর পিস্তল দিয়ে এক ভিয়েৎকংকে হত্যা করেন।
আমি তাঁকে হত্যা করি আমার ক্যামেরা দিয়ে।
এডি অ্যাডামস
যেদিন এডি অ্যাডামস তাঁর শাটার টিপলেন
জনৈক ভিয়েৎকংয়ের মুখ থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে
তার হত্যাকারী জেনারেল নক লোনের হাত থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে
তার ছাইরঙা রিভলভার থেকে কয়েক ইঞ্চি দূরে
সেদিন সেই ভিয়েৎকংয়ের পরনে ছিল ফ্লানেলের শার্ট
জেনারেলের শার্টের কলার তোলা ছিল
রিভলভারের মধ্যে একটি গুলিই ছিল [সেই একটিমাত্র প্রয়োজনীয় গুলিটি]
ভিয়েৎকংয়ের চোখজোড়া আধবোজা ছিল
জেনারেলের মুখ ছিল তির্যক ও কঠিন
ক্রোধে ও ঘৃণায় রিভলভারের ধাতু ছিল উত্তপ্ত
অনুমেয় যন্ত্রণার অনুমেয় বহিঃপ্রকাশ ছিল ভিয়েৎকংয়ের চোখেমুখে
জেনারেলের উত্তেজিত হাতের পেশীগুলো ছিল উত্তেজনায় টানটান
রিভলভারের মাপ ছিল ঠিকঠিক মৃত্যুর চাহিদা মোতাবেক
ভিয়েৎকংয়ের হাতে তখনো লেগে ছিল তারই শিকারসমূহের রক্ত
ভিয়েৎকংয়ের শিকারের রক্তের লাল লেগে ছিল জেনারেলের চোখে
এবং রিভলভারের গায়ে লেগে ছিল একটি দীর্ঘ কম্পনধ্বনি/ অনেকটা ‘আমাকে গুলি কোরো না’র মতো
কিন্তু এডি অ্যাডামস শুট করেন/ একেবারে রিভলভারের পাশ থেকেই তিনি শুট করেন
যাকে বলে ‘পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক’ শুট
এবং জেনারেল নক লোনের শরীর ঢলে পড়ে
সকল আন্তর্জাতিক সংবাদপত্রের প্রচ্ছদপটে,
ভিয়েৎকংয়ের স্বহস্তে ছড়ানো অসংখ্য লাশের ছবি দেখেনি কেউ
কেউ তার কপালের কালো গহ্বর
কিংবা রিভলভারের ধোঁয়া দেখেনি
কেবল জেনারেল নগুয়েন নক লোনের লাশ দেখেছে
যে-লাশ ফটোগ্রাফার এডি অ্যাডামস সারাজীবন তাঁর পিঠে বহন করেছেন
যতক্ষণ না, ১৯৯৮ সালের একদিন, এক বৃদ্ধ, তিনি, সত্যি সত্যি মারা যান
এবং এডি অ্যাডামস চোখে রক্তবর্ণ অশ্রু নিয়ে
তাঁর বিধবাকে একতোড়া ফুল পাঠিয়ে দেন।
ইংরেজি অনুবাদ: পেদ্রো পোয়াৎভাঁ
বাংলা অনুবাদ: আলম খোরশেদ