আধুনিকতার ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে বিলীন হচ্ছে আমাদের ভাষা
ভূমিকা
সৈয়দ মহিউদ্দিনের সঙ্গে [মহিআল ভাণ্ডারী] ২০১৮ সালের ১৫ জুলাই কিছু দরকারি আলাপ সারব বলে আর তাঁর পছন্দের কিছু আলোকচিত্র সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যোগাযোগের মাধ্যমে আমরা চট্টগ্রাম শহরের কাতালগঞ্জের একটি রেস্তোরাঁয় দেখা করি বেলা সাড়ে এগারোটার দিকে। মহিআল ভাণ্ডারী কিছু তথ্য দিলেন তাঁর সংগীত জীবনের, কিছু পেপার কাটিং দেখালেন। কিছু প্রয়োজনীয় নোটও নিলাম। সবশেষে হাতে দিলেন তাঁর দুটি আলোকচিত্র। তিনি চান ও দুটো থেকে যেকোনো একটি সাক্ষাৎকার প্রকাশের সময় ব্যবহার করা হোক। তাঁর ইচ্ছের প্রতি সম্মতি জানিয়ে ওই আলোকচিত্র দুটি সাধারণ একটি কাগজের প্যাকেটে ঢুকিয়ে রেস্তোরাঁটিতে আমাদের বসার টেবিলটার একধারে রাখি। ওই সময় হোটেলবয় মেঝেতে ঝাড় দেবে বলায় আমরা ওখান থেকে সরে পাশের আরেকটি টেবিলে যাই। তখনো আরও কিছু কথা ও কাজ বাকি ছিল তাঁর সঙ্গে। ওসব কাজ সেরে সৈয়দ মহিউদ্দিনকে বিদায় জানিয়ে বাড়িতে এসে দেখি, অন্য সব কাগজপত্তর থাকলেও তাঁর সেই ফটোগ্রাফ দুটির প্যাকেটটি নেই! তাৎক্ষণিক ফোন দিয়ে জানা গেল, তাঁর সঙ্গে থাকা কাগজগুলোর ভেতরেও ওটা নেই। দ্রুত রিকশাযোগে ওই রেস্তোরাঁয় গিয়ে বয়-ওয়েটারদের জিগ্যেস করেও হদিস পাওয়া গেল না। যদিও তাঁকে আসতে হবে না বলেছিলাম, দেখি সৈয়দ মহিউদ্দিনও হন্তেদন্তে উপস্থিত। এ রকম বিহ্বল অবস্থায় এক বয়স্ক ওয়েটার ছবির ওই প্যাকেটটা নিয়ে আমাদের সামনে হাজির। বলেন, ঝাড় দেবার পর বালকটি খবর কাগজের ওই সাধারণ প্যাকেটটি বাজে কাগজের ঝুড়িতে ফেলে দেয়। সৈয়দ মহিউদ্দিন ভাইয়ের চেহারার সঙ্গে ছবি দুটির মিল দেখে আর আমাদের তল্লাশিতে আঁচ করেন, বোধ হয় এই ছবিগুলোই খোঁজা হচ্ছে। আমার মনে স্বস্তি ফিরে এলেও, দেখলাম, ভাণ্ডারী ভাই ছবি দুটি হাতে নিয়েই টুকরো-টুকরো করে ঝটপট ফেলে দিলেন মেঝেতে। শান্ত চোখে আমার দিকে চেয়ে বললেন, ‘ময়লার ঝুড়ি থেকে নেয়া এ ছবি যাবে না, হাফিজ ভাই। বাবা ভাণ্ডারী নাখোশ হবেন। আমি নতুন ছবি দেবো।’ আমার ভাবনা : দুর্ঘটনার শিকার, এখনো ভালোভাবে চলাফেরা করতে না পারা সত্তরোর্ধ্ব মানুষটার কষ্ট না হোক। ওই ছবি আবারও পরিষ্কার হয়তো করা যাবে, তাতে দৌড়ঝাঁপ যেটুক হবে, তা-ও তাঁর এ রকম অবস্থায় কম ধকলের নয়। কিন্তু সেই মুহূর্তে তাঁর মনের অবস্থা বুঝে আমি নিশ্চুপ রইলাম।
দক্ষিণ এশিয়ায় সুফি দর্শনের অন্যতম প্রভাবশালী মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতি আজীবন গভীরভাবে আস্থাশীল সৈয়দ মহিউদ্দিন। এ প্রসঙ্গে সিরীয় কবি আদোনিস বা আলী আহমাদ সায়ীদ এসরারের একটি উক্তি মনে পড়ছে। তিনি বলেছিলেন, ‘যুক্তির বলয়ের বাইরের জগৎটাকে বোঝার জন্য পশ্চিমা শিল্প ও সাহিত্য পরাবাস্তববাদ আবিষ্কার করেছিল। কিন্তু একই উদ্দেশ্যে পশ্চিমা জগতের বাইরে তারও বহু আগে সুফিবাদের আবির্ভাব ঘটে। যার দিকে আমরা তাকাইনি। আরবের দেশগুলোতে, বিশেষ করে লেবাননে পরাবাস্তববাদের গভীর প্রভাব পড়েছে। পরাবাস্তববাদের যে গভীর ধারাটি আরবের জমিতে জন্ম নিয়েছিল, আরবদের উচিত সেই সুফিকবিদের খোঁজখবর নেয়া।’ সৈয়দ মহিউদ্দিন রচিত গীতভাণ্ডার এই সুফিদর্শনকে একালের মানুষের মনে কাব্যময় সুরের রসে পরিবেশনের মাধ্যমে ব্যাপক লোকপ্রিয়তা অর্জন করেছে। সেখানে তিনি অনবদ্য ও স্বতন্ত্র। চট্টগ্রামে এই সুফি ঘরানার উদ্ভবের পেছনের ইতিহাসও চমকপ্রদ, ঐতিহাসিক তাৎপর্যমণ্ডিত।
বিগত ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর সন্ধিক্ষণের সময় ওটা। ভারতবর্ষে প্রায় দেড় শ বছরের কায়েমি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে তখন শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মুখোমুখি হচ্ছে প্রতিনিয়ত। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পাশাপাশি ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যেও চলছে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত হওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা ও প্রক্রিয়া। এ অবস্থায় ভারতের দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে ফারাক সৃষ্টির মাধ্যমে ভারতবর্ষে ব্রিটিশ শাসন প্রলম্বিত করার উদ্দেশ্যে ঔপনিবেশিকেরা যেসব ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐতিহাসিককাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসা ধর্মকে কেন্দ্রে রেখে বিভেদ সৃষ্টি করা। ব্রিটিশ কূটনীতির কাছে ওটার বহিঃপ্রকাশ ছিল—‘ভাগ করো, শাসন করো’ নীতিতে। শাসকগোষ্ঠীর এই ভেদনীতির বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সচেতনতার পাশাপাশি মুসলিম আলেম সমাজ ও হিন্দু ধর্মবেত্তাদের মধ্যে ঐক্যের যে ফল্গুস্রোত সে সময়ে বহমান ছিল, তারই একটির তৃণমূলীয় উদ্ভাসন হলো মাইজভাণ্ডারী তরিকার প্রতিষ্ঠাতা সৈয়দ আহমদ উল্লাহ ও তাঁর সমকালে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির সুয়াবিল গ্রামে আশ্রমের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুরুদাস ফকির বা গুরুদাস পরমহংসের মধ্যে বন্ধুত্ব ও প্রীতির সম্পর্ক গড়ে ওঠা। তাঁরা দুজনই ছিলেন নিজ নিজ সাধনমার্গে সিদ্ধপুরুষ। তাঁরা প্রবল প্রতাপান্বিত ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠীর প্রতিকূল তৎপরতার ভেতর সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির যে অস্মিতা লালন করেন পরমত ও পরধর্মসহিষ্ণুতার, আর তার সুদূরপ্রসারী আবেদন তাঁদের কাল ছাড়িয়ে ভবিষ্যতের দিকে দুর্বার গতিতে নিয়ে যেতে যে প্রণোদনা সৃষ্টি করেছিলেন উভয়ে, বহু ঝড়ঝাপ্টা পেরিয়ে আজও তা সচল ও সপ্রাণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, ওই সুবেদী পরম্পরা উভয় দিকের উৎপীড়িত আত্মার জন্যে যে প্রশান্ত বাতাবরণ সৃষ্টি করেছিল সারা ভারতের লাখো-লাখো সাধক ও মাটির সন্তানকে, তা চুম্বকের স্বভাবে আকর্ষণ করেছে। মাইজভাণ্ডারী তরিকার সর্বধর্ম সমন্বয়ী চাতালে। সেই ধারার অনলপ্রবাহে পুড়ে ছাই হয়েছে সাম্প্রদায়িকতার প্রেতাত্মারা, মানুষে-মানুষে ভেদাভেদের কলুষতা, জাতপাতবর্ণের ঘৃণ্য আচার-আচরণকারীরা। সৈয়দ মহিউদ্দিন সেই সাধনপথের অনুরাগী এক নতুন জীবনমন্থনের সুদক্ষ অরণি। বিগত শতকের আশির দশক থেকে সৈয়দ মহিউদ্দিন নামের অরণির স্পর্শ যে নতুন অগ্নিশিখার আলো ছড়াল সারা বাংলাদেশে, সেটি তাঁরই রচিত ও সুরারোপিত মাইজভাণ্ডারী গানের অপূর্ব সম্ভার। একটি ছোট্ট উদাহরণ:
তুমি প্রেমের নায়ক সুরের গায়ক বিশ্বগীতিকার
তুমি সর্বকলা সর্ববলা নিপুণ ভাষ্যকার
তুমি নূর-এ-রূপম দয়ার কসম কাঙ্গালেরই কুল॥
তুমি শাস্ত্র-কিতাব অংক হিসাব যুক্তি চূড়ান্ত
তুমি মর্ত্যমণি পাতালখনি গভীর অনন্ত
তুমি সেনাপতি দ্রুতগতি শত্রুনিধন শূল॥
তুমি ঐশী আলো কলব্ জ্বালো সরাও অন্ধকার
তুমি সত্যপথের কুদরতের শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়
তুমি খেলছ বলে দলে-দলে মাঠে হুলুস্থুল॥
তুমি ৭-এর নিদান ভাগ্যবিধান ললাটেরই তাক
তুমি ফাগুন হাওয়া কোকিল গাওয়া যৌবনেরই ডাক
তুমি জিকির চেমা স্বর্গী মেমা আসমানি বাউল॥
তুমি সদ্যশিশু কৃষ্ণযিশু কালের সম্মোহন
তুমি পঞ্চরঙ্গী মানবসঙ্গী মুক্ত আলিঙ্গন
তুমি ভেদহারামি মনগোঁড়ামি করিছ নির্মূল॥
পূর্বসূরি বহু নামজাদা কবি ও সাধক, গীতিকার ও সুরকারের অবদানে ঋদ্ধ মাইজভাণ্ডারী গানের ঘরানায় নতুনতর প্রতাপ প্রতিষ্ঠা করেছেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। আবার ঠিক এই তরিকার পাশ ঘেঁষে সৈয়দ মহিউদ্দিনের কলমে ঝলসে উঠল চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবনের আরেক ভাষ্য। এ কোনো আপতিক বা আকস্মিক কিছু নয়। মাইজভাণ্ডারী তরিকার ভেতরেই রয়েছে গণমানুষের প্রতি, তাদের বৈচিত্র্যমণ্ডিত জীবনযাপনের প্রতি সহজিয়া, দরদিয়া পক্ষপাত। সৈয়দ মহিউদ্দিনকে সেই দরদই চালিত করেছে জনপ্রাণস্রোতে। চট্টগ্রামের লোকায়ত জীবনের অবিমিশ্র ভাষাবাহনে তিনি রচনা করলেন হৃৎছোঁয়া সুরের আয়ত ভুবন। এখানে তাঁর কবিত্বমণ্ডিত উপমাবহুল শব্দচয়নের ঝংকারে খুলে গেল প্রাকৃত ও চলমান চট্টগ্রামী জীবনধারার খাসমহলের সকল দুয়ার। এখানকার আধ্যাত্মিক মনোভাবাপন্ন, জীবনরসিক, অরণ্য-পাহাড় আর সাগরের উদাসী হাওয়ায় বেড়ে ওঠা মৃত্তিকার সন্তানেরা তাঁর গানের কথা আর সুরের জাদুকরি ছোঁয়ায় খুঁজে পেল জীবনের আসল দ্বৈরথ ও ছন্দের মর্তবা, যেমন:
গর্কি তুয়ান, বন্যা খড়া
মোহামারী ঘুন্নিঝড়
ভাসাই মারে ধ্বংস গড়ে
মাইনচে-ত আর বঅই নরর॥
হক্কল কামর ধান্ধা চলের
আবার নয়া সিষ্টি অর॥
ভাংগা গাছত নয়া ঠেইল্
পাতা মেলি দেখার খেইল্
পংখি আবার উডের-ঘুরের
চুপ্পে প্রেমর কথা কঅর॥
দুনিয়া দুরগইত্যা বোঝা
বাচন কঠিন মরণ সোজা
পক্কীতির ইচ্ছার উদ্ধি গরার কিছু নাই
আশায় আনে মনর বল
নইলে জীবন টলমল
আপদ-বলাই চাই নো আইয়ে
গরীব মইধ্য তোয়াংগর॥
দৃশ্যের বাস্তবতা আর বাস্তবতার কাব্যিকতা নির্মাণ সৈয়দ মহিউদ্দিনের এক সহজাত রূপদক্ষতা। আঞ্চলিক বুলিতেই যখন বলেন, ‘ভাংগা গাছত নয়া ঠেইল্/ পাতা মেলি দেখার খেইল্/ পংখি আবার উডের-ঘুরের / চুপ্পে প্রেমর কথা কঅর...’ তখন দৃষ্টিপথে সাবলীলভাবে জেগে ওঠে ধ্বংসস্তূপের ওপর কর্মবীর আর অপরাজেয় মানুষের ডাগর, কর্মলিপ্ত ঘেমো মুখমণ্ডল। হতাশার করাল কুয়াশা ভেদ করা এ আশাদীপ্ত সৌন্দর্য। এ কাব্যিকতা সুদূরের কোনো বিমূর্ততা নয়, কষ্টকল্পনার ত্রাহি কোষ্ঠকাঠিন্য নয়। এ একেবারে সহজ-সুন্দরের নিটোল প্রতিমান। প্রতিদিন ভোরের আলো ফুটে ওঠার মতো। নদীর বয়ে চলার মতো। বিকেলের পর সন্ধ্যার অবতরণের মতো। আর রাতের নিবিড় সখ্যের মতো।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের দাপটে জনজীবনধারা থেকে হারিয়ে যেতে থাকা লোকায়ত মানুষের মাটিবর্তী ভাষা ও লব্জ, কাহিনি-কিংবদন্তি ও গানের ধারাকে আবার ঘরের আনাচ-কানাচে, আঙিনাজুড়ে সগৌরবে তার স্থানটি ফিরিয়ে দেওয়ার এক সুরেলা সেনাপতির নাম সৈয়দ মহিউদ্দিন।
একালে, এখনকার বাংলাদেশে সৈয়দ মহিউদ্দিনের প্রাসঙ্গিকতা এখানেই, এভাবেই।
হাফিজ রশিদ খান: কবি ও সম্পাদক, পুষ্পকরথ
তর্ক বাংলার নোট
বাংলাদেশের সংগীতজগতের সুফিসাধক ও জনপ্রিয় সংগীতশিল্পী সৈয়দ মহিউদ্দিন। জনসমাজে তিনি মহিআল ভাণ্ডারী নামে পরিচিত। তাঁর অসংখ্য গান দেশে-বিদেশে বিপুল জনপ্রিয়তা পায়। ছোটবেলায় তিনি গানের তালিম নেন ওস্তাদ আয়াত আলী খান, ওস্তাদ পণ্ডিত প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের কাছে। তাঁর অসংখ্য গান সাধারণের মুখে মুখে ঘুরে বেড়াত। তিনি লোক সংগীতের অনন্য ঘরনা মাইজভাণ্ডারী গানের পুরো জীবন সমর্পন করেছেন। অনন্য এই সুফিসাধক ও সংগীতজ্ঞ মহিয়াল ভাণ্ডারীর সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছেন কথাসাহিত্যিক মহীবুল আজিজ, কবি হাফিজ রশিদ খান, সংগীত শিল্পী শফিকুর রহমান, কথাসাহিত্যিক খোকন কায়সার ও কবি ভাগ্যধন বড়ুয়া।
—সম্পাদক
চট্টগ্রামে আসার পর শ্যামবাবুর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। টেলিভিশন এবং বেতারে আমার ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তারপর একটা আঞ্চলিক গানের ক্যাসেট বের করলাম। টেলিভিশনে ‘ও জেডা ফইরার বাপ একদিন বুঝিবা’ শ্যামসুন্দরের কণ্ঠে রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই গানটা আমি লিখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পর, ১৯৭২ সালের দিকে। গাওয়া হলো ’৮০ সালের দিকে। খুবই জনপ্রিয় একটি গান...
প্রশ্ন: শৈশব, গ্রামের বাড়ি, কোথায় জন্ম এবং আপনার গ্রামের পরিবেশ নিয়ে বলুন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন : আমার গ্রামের বাড়ি ফটিকছড়ি উপজেলার সুয়াবিল গ্রাম। একদম হালদার পাড়ে। চন্দ্রনাথ পাহাড়র পাদদেশে। চা-বাগান আছে—শান্তি লাগে। এখানে আমার পূর্বপুরুষেরা ছিলেন। শৈশবেই আমি পিতৃহারা হই। তখন আমার দেড় বছর বয়স। আমার বাবার নাম সৈয়দ আবুল হোসেন, উনি ডাক্তার ছিলেন। আমার মায়ের নাম সৈয়দা আনোয়ারা বেগম। আমার মা এবং আমার বাবা দুজনই সৈয়দ পরিবারের। ওই পরিবারের কোনো মেয়েকে বাইরে বিয়ে দেওয়া যেত না। মজার ব্যাপার হচ্ছে কি জানেন—সেই জন্য এই পরিবারের পাত্রপাত্রী বেশির ভাগই নিজেদের মধ্যে বিয়ে হয়ে যেত। সেই দিক থেকে আমার বাবা ছিলেন আমার মায়ের জেঠাতো ভাই। আর আমার মা আমার বাবার চাচাতো বোন।
শৈশবে আমি পিতৃহারা হই—তারপরও আমার কোনো অসুবিধা হয়নি, যেহেতু আমার মামারা ছিলেন। আবার আমার নানা আগরতলা বীরবিক্রম বাহাদুর স্কুলের টিচার ছিলেন। তিনি এ বাড়িতে প্রথম শিক্ষিত ব্যক্তি। এবং নানা যখন পাস করেন, অনেকে তাকে ঘোড়ায় চড়ে দেখতে আসছিলেন। এ বাড়ির মানুষ কী করে ম্যাট্রিক পাস করল। উনি ফারসি, উর্দু এবং ইংরেজিতে খুবই পারদর্শী ছিলেন। পরে আমার নানা আমার মামাদের আগরতলা নিয়ে গেলেন লেখাপড়া করাতে—যে স্কুলে এসডি বর্মন [শচীন দেববর্মন] লেখাপড়া করতেন সেখানে। ওদের কালচারের স্পর্শ পেয়ে আমার মামারা একটু-একটু সংগীতরসিক হয়ে ওঠেন। এরপর গানও গাইত আমার মামারা। ফলে আমার মামাদের চিটাগাং আসার পরে গানের চর্চা বেড়ে গেল। ওখান থেকে চিটাগাং এসে আমার এক মামা পোর্টে চাকরি নেন। ফলে আমার সংগীতচর্চা চলে মামার বাড়ি থেকেই। আমার মা ভালো গজল গাইতেন।
আমার লেখাপড়া ফটিকছড়ি হাই স্কুল ও ফটিকছড়ি কলেজে। এরপর খণ্ড-খণ্ড সংগীতচর্চা হলো। ইচ্ছে ছিল, ছবি আঁকব—যেহেতু ছবি আঁকাও হলো না—ফলে তখন আমি তবলা ধরলাম। তবলা বাজাতে বাজাতে আস্তে আস্তে ছন্দ বুঝলাম—গান লেখাটা কিন্তু পরে আসছে। কিন্তু প্রথমে আমার তবলায় শুরু। তখন আমার অ্যারাবিক এবং কর্ণাটকের সংগীত খুব ভালো লাগত। আমি বুঝতাম না কিন্তু আমার কেন জানি এই দুইটা সংগীতের সাবজেক্ট ভালো লাগত। আমি এগুলো রেওয়াজ করতাম।
প্রশ্ন: আপনার গ্রাম ফটিকছড়িতে কত বয়স পর্যন্ত ছিলেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: গ্রামে ১৯৬৪ সাল পর্যন্ত ছিলাম। তখন আমার বয়স ২০ বছর।
প্রশ্ন: চিটাগাং পোর্ট কলোনিতে তো আসলেন একটা বয়সের পর। ২০ বছর পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্রামেই ছিলেন? এখানে এসে আপনার গান-বাজনার কী রকম প্রভাব-পরিচিতি হয়?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: যেহেতু আমার মামারা গান করতেন। তখন সুচিত্রা-উত্তম কুমারের সিনেমা চলত এখানে। শাপমোচন...ইত্যাদি। তখন মামারা সিনেমা দেখে ওই গানগুলো মুখস্থ করে আবার গাইত। অবিকল গাইত। গলা ভালো—সুর ছিল। আমি কণ্ঠস্বর ফলো করতাম। এবং অনেক সময় ওদের থেকেও ভালো গাইতাম। তখন তারা বলতেন, কোথা থেকে এসব শিখলি?
গানের আরেক ওস্তাদ পণ্ডিত প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের হাতে শিখেছি তত্ত্বীয়ভাবে। স্বরলিপিকরণ, তবলার অনেক কৃতিভিত্তিক জিনিস এবং কীভাবে সৃষ্টি করা যায় বিস্তার—টোটাল সংগীতের পরিভাষা, তার অ্যাকটিভিটি কী—সবগুলো শিখলাম। উনার কাছ থেকে সংগীতের অনেক থিওরি শিখেছি। একজন সুরকার হতে, প্রডিউসার হতে যে উপাদানগুলো না হলে হয় না। পরে আমি চট্টগ্রাম বেতারে রাগপ্রধান গান লিখেছি...
প্রশ্ন: আপনার মামার নাম কী? উনি কি জীবিত আছেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: জহুর আলম—খুব মেধাবী ছিলেন। বলা যায়, মামার হাত ধরেই এখানে আসা। আর একটা কথা বলি। আমি তখন দেড় বছর বয়সেরও আগের। আমাদের ঘরে কলের গান [গ্রামোফোন] ছিল। আমার বাবা শৌখিন লোক ছিলেন। কলের গান—যেটা পিন দিয়ে চালায়। আমার মা সেই সময় সন্ধ্যার পর সবাইকে দাওয়াত করত। সবাইকে গরুর দুধ খাওয়াত আর গান শোনাত। আমাদের ঘরে এসে সবাই গান শুনত। আমার বাবা এমন একটা নেশা করাইছে গান শোনানোর জন্য। পারিবারিকভাবে গান শোনার একটা আবহ সৃষ্টি করল।
প্রশ্ন: আমাদের একটা জানার বিষয় হচ্ছে, ২০ বছর পর্যন্ত আপনি গ্রামে ছিলেন। এরপর কোন্ কারণে গ্রাম থেকে চলে আসছেন... কোনো সমস্যা হয়েছিল? বিষয়টা পরিষ্কার করেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: সেটা বলতে আমাকে একটু পিছনে যেতে হবে। তারপর আমি ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন। স্টাডিব্রেক। লেখাপড়া করতে তো বইয়ের গাঁট্টি আছে। লেখাপড়া তো করব। কিন্তু সংগীতকে সময় দেওয়ার জন্য লেখাপড়া কমিয়ে আস্তে আস্তে গানে ঝুঁকে পড়লাম। তারপর সৌভাগ্যক্রমে আমি কুমিল্লায় ট্রান্সফার হলাম। কুমিল্লায় গিয়ে আমি তখন ওস্তাদ ধরতে চেষ্টা করলাম। গান শিখব।
প্রশ্ন: কুমিল্লায় যাওয়ার ব্যাকগ্রাউন্ড কী? এত জায়গা থাকতে কুমিল্লায় কেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: আমার এক চাচা সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন। ওস্তাদ আয়াত আলী খান সাহেবের কাছে নিয়ে গেল। তো উনি গান শেখালেন। শেখ সাদি খানের বাবা। তখন শেখ সাদি রেডিওতে চাকরি করতেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে।
প্রশ্ন: ওস্তাদ আয়াত আলী খানকে কোথায় পেলেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: কুমিল্লায়। উনি আমাকে বললেন, বাংলাদেশে কোনো সানাইবাদক নাই। তোকে আমি সানাইবাদক বানাইয়া ফেলব। আমার খেয়াল আছে এখনো। তখন আমি মনে মনে বলি, যন্ত্র কে শেখে! আমি গানই শিখব। তারপর আমাকে নিয়ে গেল ওস্তাদ সুরেন দাশের কাছে। কলকাতার বিখ্যাত সংগীতজ্ঞ। আমাকে নিয়ে গেছে আমার বন্ধু সুজিত চৌধুরী। সুজিত চৌধুরীও উনার কাছে গান শিখতেন।
আমার গানের আরেক ওস্তাদ পণ্ডিত প্রিয়দা রঞ্জন সেনগুপ্তের হাতে শিখেছি তত্ত্বীয়ভাবে। স্বরলিপিকরণ, তবলার অনেক কৃতিভিত্তিক জিনিস এবং কীভাবে সৃষ্টি করা যায় বিস্তার—টোটাল সংগীতের পরিভাষা, তার অ্যাকটিভিটি কী—সবগুলো শিখলাম। উনার কাছ থেকে সংগীতের অনেক থিওরি শিখেছি। একজন সুরকার হতে, প্রডিউসার হতে যে উপাদানগুলো না হলে হয় না। পরে আমি চট্টগ্রাম বেতারে রাগপ্রধান গান লিখেছি। কাবেরী সেনগুপ্তা শিল্পী।
প্রশ্ন: আপনি কুমিল্লার কোথায় থাকতেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: আমি কুমিল্লার মোগলটুলীতে থাকতাম। সেখানে আমি একজন লেখকের দেখা পেয়েছিলাম। মাকসুদ রহমান মরমি। ইত্তেফাকে লিখতেন। তারপর আমি শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর কাজ করলাম প্রায় পাঁচ বছর। তারপর আমি চট্টগ্রামে ফিরে আসি। তারপর দেখলাম দেশে যুদ্ধ বাধার অবস্থা। এই যে আমি আঞ্চলিক রাইটার হবো, মাইজভাণ্ডারী রাইটার হবো—এগুলো আমার অঙ্কের বাইরে। আমি রাগপ্রধান লিখব, আধুনিক গান করব—এগুলো আমার স্বপ্ন ছিল। কুমিল্লা থেকে আসার পর আমার একদম ভালো লাগত না। রাতে আমার ঠিকমতো ঘুমও হতো না।
প্রশ্ন: মাইজভাণ্ডার—এই বিষয়টা এলো কখন থেকে?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: আমি কুমিল্লায় থাকতে ওস্তাদ সোবাহানজি আমাকে খুব স্নেহের চোখে দেখতেন। বাম হাতে তবলা বাজাতেন। উনার কাছে হাতেখড়ি নিলাম। উনি একদিন আমাকে বললেন, তোর দেশ মাইজভাণ্ডার—তুই মাইজভাণ্ডার যাস না? আমার ওস্তাদের কথা শুনে মাইজভাণ্ডার যাওয়া। বাবা ভাণ্ডারীর চরণধুলা নিলাম। আমার ওস্তাদজি মাইজভাণ্ডারের অন্ধ ভক্ত। খুবই ভালো গাইতেন। কুমিল্লা থেকেই আমার মাইজভাণ্ডার শুরু।
প্রশ্ন: মাইজভাণ্ডারী গাইতে গিয়ে কোনো বাধা আসছে?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: বাড়িতে আসার পর মাইজভাণ্ডারে আসা-যাওয়া শুরু করলাম। একেক মঞ্জিলে মাইজভাণ্ডারে দেখলাম উলঙ্গ, লেংড়া, পাগল, মৌলভী, আলেম, চাকমা, পাহাড়ি—সর্বজাতের মানুষে বাবা ভাণ্ডারীতে জ্যাম!
প্রশ্ন: এটা কত সালের কথা?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: স্বাধীনতার পরে। এই শুরু হলো আমার যুদ্ধ। আমি যখন মাইজভাণ্ডারে ঢোল বাজাইতে শুরু করলাম, লোকে বলাবলি করছে—সৈয়দ পরিবারের ছেলে নষ্ট হয়ে গেছে। লোকে আমাকে নিন্দা করতে লাগল। আমি আবার কলেজে ছাত্রলীগ করতাম। কিন্তু যত যা-ই কিছু হোক, লেখালেখি কিন্তু ছাড়ি নাই। কারণ, একদিন আমাকে গীতিকার হতে হবে। তখন আমি ব্যবসা করতাম। কিছু টাকা জোগাড় করে একটা গাড়ি কিনলাম দুইজনের শেয়ারে। তখন আমি ফটিকছড়ি বাজারে থাকি। ওই গাড়ির ইনকাম দিয়ে চলতাম। এই সময়ে আমি আজমীর শরিফে গেলাম। তখন এই গানটি গাইলাম:
হিন্দুস্তানে খাজাবাবা, এই বঙ্গে বাবা ভাণ্ডারী
সঙ্গে দুজন রঙ্গ খেলে সম বাণিজ্যের কারবারি
আমার বাবা ভাণ্ডারী...
সৈয়দ মহিউদ্দিন © ছবি: কমল দাশ
প্রশ্ন: আমার সকল ব্যবসা গুনাগারী যায়—এই গান লেখার ব্যাকগ্রাউন্ড একটু বলেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: তখন আমি গাড়ি বিক্রি করে দিয়ে আজমীর শরিফে চলে যাই। সেখান থেকে আসার পর আমাকে বিয়ে দেবার পরিকল্পনা নিয়ে আমার খালা এলো রংপুর থেকে। কারও কাছ থেকে শুনছে আমি চলে যাব, সে কারণেই তার এই আসা। আমি ওই রাতেই পালাইছি। পালাইয়া শুলকবহরে আসি। ওখানে করিম ভাইয়ের [করিম আবদুল্লাহ] সাথে দেখা। ওখানেই মনের দুঃখে ‘আমার সকল ব্যবসা গুনাগারী যায়’—এই গানটা গাই। গাড়িঘোড়া নষ্ট হয়ে গেল—আমার জীবনের সকল ব্যবসা গুনাগারী গেল—আমি গৃহত্যাগ করলাম। তারপর থেকে মাইজভাণ্ডারের সঙ্গ আর ছাড়াছাড়ি নাই। এবার আমি মহিআল ভাণ্ডারী।
প্রশ্ন: আপনি গানের সাথেই আগাগোড়া জড়িত ছিলেন। মাঝখানে দেখলাম যে, আপনি শুলকবহরে আকতার নামের একজনের সঙ্গে মেসে থাকেন। তখন আপনার সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়ে প্রবাল চৌধুরী, শেফালী ঘোষ, হাফিজ রশিদ খানের সঙ্গে। তখন আপনাকে তবলা বাজাতেই দেখি। তবলা বিষয়ে আপনার বিশেষ ঝোঁকের কারণটা যদি বলেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: যেহেতু আমি ছবি আঁকতে পারলাম না, আবার সিরিয়াসলি গীতিকার হবো, আমার মনমানসিকতা তখন এমনও ছিল না। আশা ছিল আমি তবলাবাদক হবো। কেন জানি তবলাটা আমাকে টানত। তবে আমার একটা প্লাস পয়েন্ট আমি সুরকার হলাম। রেডিওতে তখন সেলিম উদ্দিন আহমেদ সাহেব আমাকে সঙ্গীত পরিচালক বানাই দিলেন। সেলিম সাহেব তখন বেতারের আরডি। হারুন সাহেবও মাইজভাণ্ডারীর ভক্ত ছিলেন। বেতারের এআরডি।
প্রশ্ন: শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক নিয়ে কিছু বলেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: আমি মাঝখানে ঢাকায় চলে যাই। আমাকে ওখানে পাঠিয়েছিলেন করিম ভাইয়ের ভগ্নিপতি সিদ্দিক সাহেব। উনি ফার্স্ট ক্লাস কন্ট্রাক্টর ছিলেন। উনার অফিস ছিল মোহাম্মদপুরে। উনি তখন দৈনিক আমার বাংলা নামে পত্রিকা বের করবেন বলে কবি নাসির আহমেদসহ প্রস্তাব দিলেন কাজ করার জন্য। একসময় পরিচয় হলো ঢাকা বেতারের তরুণ ঘোষের সঙ্গে। উনি প্রস্তাব দিলেন মাসিক সংগীত পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করার। আমার ওপর পাঁচ ব্যক্তির সাক্ষাৎকার নেবার দায়িত্ব পড়ল—শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব, শেফালী ঘোষ, সুচরিত চৌধুরী, ওস্তাদ নির্মলেন্দু বড়ুয়া ও অরুণা বিশ্বাস। ওই পাঁচজনের সাথে বিজয় দিবসের সংবর্ধনার জন্য সাক্ষাৎ নেবার সুযোগ হলো। ওখান থেকেই শ্যামসুন্দর ও শেফালী ঘোষের সঙ্গে পরিচয়। এটা ১৯৮০ সালের আগে হবে। তখন আমি আমার পাণ্ডুলিপি নিয়ে ঢাকায় সত্য সাহার বাড়িতেও যাই। আর আমি ঢাকা বেতারে গীতিকার হই ১৯৮০ সালের জানুয়ারিতে। চট্টগ্রামে আসার পর শ্যামবাবুর সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। টেলিভিশন এবং বেতারে আমার ব্যস্ততা বেড়ে গেল। তারপর একটা আঞ্চলিক গানের ক্যাসেট বের করলাম। টেলিভিশনে ‘ও জেডা ফইরার বাপ একদিন বুঝিবা’ শ্যামসুন্দরের কণ্ঠে রাতারাতি জনপ্রিয়তা লাভ করে। তবে এই গানটা আমি লিখেছিলাম মুক্তিযুদ্ধের পর, ১৯৭২ সালের দিকে। গাওয়া হলো ’৮০ সালের দিকে। খুবই জনপ্রিয় একটি গান। শ্যামসুন্দর আমাকে আঞ্চলিক গান লেখা চালিয়ে যেতে অনুরোধ করলেন। আঞ্চলিক গানে শুদ্ধ শব্দ অনেকেই তখন ব্যবহার করত। শ্যামদা, তারপর এমএন আখতার ও গফুর কাকার [আবদুল গফুর হালী] গানেও ছিল। শুধু কাউয়াতে গেল মোহাম্মদ নাসির।
প্রশ্ন: শ্যামসুন্দর বৈষ্ণবের সাথে তো আপনার সম্পর্ক স্থায়ী হয়ে গেল। তারপর শেফালী ঘোষের সাথে আপনার গাঁটছড়া বাঁধা আর গান গাওয়া—এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: শেফালী ঘোষ তখন জনপ্রিয়তার তুঙ্গে। ননীবাবু [ননীগোপাল দত্ত] ছিলেন শেফালী ঘোষের অভিভাবক প্লাস ওস্তাদও। তখন আমারও বেশ নামডাক। একদিন বেতারে শেফালী ঘোষের সঙ্গে দেখা। সেই সময়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে একটা ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান হতো। ওই সময়ে একটি আঞ্চলিক গান শেফালীকে দিলাম। তিনি পরবর্তী সময়ে আমার লেখা অনেক জনপ্রিয় গান গেয়েছেন। যেমন: মন কাচারা মাঝি তোর ছাম্মানত উইটতাম নঅ..., আঁর বউয়েরে আঁই কিলাইয়ুম..., ও লি লি আয় আয়..., চইয্যা-চড়ইর পিরিতি..., থগ্যাই-থগ্যাই-রে-তে..., পিরিত মানি পুডুর-পাডুর..., আসকার ডিঁর পূকপারে আঁর..., তালাকনামা পাডাই দিলাম..., চল আঁরা ধাই...। এ ছাড়া তিনি আমার আরও অনেক গান গেয়েছেন; পাশাপাশি বেতারে আমার লেখা অনেক সচেতনতামূলক গানেরও শিল্পী ছিলেন।
প্রশ্ন: আগে চট্টগ্রামের মানুষের মধ্যে যে আন্তরিকতা ও মিলেমিশে থাকার মনমানসিকতা ছিল, নগরায়ণের ধাক্কায় ২০ বা ২৫ বছর আগেকার সেই আবহ এখন নেই বললেই চলে। এখনকার নগরমনস্ক মানুষ আপনার গানকে কীভাবে নেবে বলে মনে করেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: একই প্রশ্ন আমাকে বিভিন্ন জায়গা থেকে করা হয়। ঘর থেকে আমরা যে অবহেলা পাচ্ছি, আমার মনে হয় না, এভাবে আঞ্চলিক ভাষা ও গান বেশি দূর এগোতে পারবে। আমাদের ঘরকে আগে সামলাতে হবে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে যাচ্ছে আমাদের ভাষা। আমি নিরাশ এ ব্যাপারে। এই গান আগামীতে থাকবে কি না জানি না। সময়ই তা বলে দেবে। কারণ, পৃথিবী এগিয়ে যাচ্ছে, এগিয়ে যাবে। তখন আমাদের গান হয়তো থাকবে আর্কাইভে বা লাইব্রেরিতে। এভাবেই হয়তো ঐতিহ্য হিসেবে টিকে থাকবে।
প্রশ্ন: শেফালী ঘোষ-শ্যামসুন্দর চলে যাওয়ার পর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান পিছিয়ে পড়ছে, এটা আমাদের মনে হচ্ছে। নতুন শিল্পী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আপনি কি দায়বোধ করেন? নতুন প্রজন্মের ভেতর এ রকম শিল্পী পাওয়া যাচ্ছে কি না বা আপনার নলেজে আছে কি না...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: শ্যামসুন্দর-শেফালী ঘোষকে এখনো সবাই অনুভব করে। আপনিও করেন, আর করেন বলেই এ প্রশ্নটা করলেন। আসলে শ্যাম-শেফালী ছিলেন একান্ত আঞ্চলিকমনা। এঁরা অন্য গানকে খুব একটা প্রাধান্য দেননি। এই একটি শাখাতেই তাঁরা সফল। শ্যাম-শেফালীর মধ্যে মাঝখানে বেশ মান-অভিমান সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু মঞ্চে তাঁরা তা কাউকে বুঝতে দেননি। নিজেদের মধ্যে মান-অভিমান থাকা সত্ত্বেও তাঁরা কখনো আঞ্চলিক গানকে বিসর্জন দেননি। সেই জিনিসটা এখন আর নেই। পরবর্তী সময়ে আমি শ্যামদার ছেলে প্রেমসুন্দর বৈষ্ণবকে দিয়ে গান গাওয়াই। প্রেমসুন্দর নামটাও আমার দেওয়া। শ্যামসুন্দরের অগোচরে প্রেমসুন্দরকে দিয়ে আমি প্রথম আঞ্চলিক গান গাওয়াই। তবে শ্যাম-শেফালীর মতো আঞ্চলিক গানের শিল্পী আমরা পাইনি। প্রেমসুন্দর তার বাবার কাছাকাছি না হোক, এখন খুব ব্যস্ত। প্রেমের একমাত্র অসুবিধা হলো, সে শ্যাম-শেফালীর মতো জুটি পায় নাই। একদিক থেকে শ্যামের সেট, প্রেমের সেট ঠিক আছে। কিন্তু শেফালীর সেট আমরা পাচ্ছি না বলে আমরা কিছু করতে পারছি না। কোনো প্রকারে কাজ চালাচ্ছি।
মানুষ কি প্রেম ছাড়া আছে নাকি? আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। আমারও একটা মন আছে। একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। সে নিশ্চয় এখন অন্যের ঘরনী। এই প্রেমের কারণেই আমি একা হয়ে গেলাম...
প্রশ্ন: আমরা আপনাকে পাচ্ছি গীতিকার, সুরকার এবং কণ্ঠশিল্পী—এই তিন গুণের বিরল সমষ্টি হিসেবে। যা খুব কম লোকের বেলায়ই ঘটে। অর্থাৎ সংগীত জগতের এমন কিছু বৈশিষ্ট্য আপনার ভেতরে আছে, যেটা সবার ভেতরে থাকে না। থাকে, তবে তা পৃথকভাবে। যেমন, প্রথমত আপনি গীতিকার, তারপর একজন চমৎকার সুরকার, ইয়াং বয়সে আমরা আপনার বেশ কিছু গান শুনেছি, যেখানে ছিল আপনার সুন্দর গায়কিও। তার ওপর তবলাবাদনে আপনার ভালো হাত চলে। এখন আপনার কাছে জানতে চাচ্ছি, আপনার এসব চ্যাপ্টারগুলোর কোনটাতে আপনি বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: বলতে হয় গাইতে-গাইতে গায়ক, বাজাতে-বাজাতে বাদক। সময় যাকে যেদিকে নিয়ে যায় আরকি। আমি চাইনি যে, এটা আসুক, কিন্তু ওটা এসে গেছে। আবার চাইনি যে, এটা আমার কাছে এসে ফিক্সড হোক, কিন্তু তা-ও হয়ে গেছে।
প্রশ্ন: আপনার আগে রমেশ শীল, আসকর আলী পণ্ডিত, মলয় ঘোষ দস্তিদার, এমএন আখতার, আবদুল গফুর হালী, মোহন লাল দাশ, মোহাম্মদ নাসির—আরও অনেকে গান গেয়েছেন, লিখেছেন। এঁদের মাধ্যমে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক গানের যে চিরায়ত ধারা, সেখানে এখন আমরা অনেক বাহির মুখ দেখতে পাচ্ছি। আমাদের জন্য এটা কি আশংকার কথা হতে পারে যে, হয়তো সৈয়দ মহিউদ্দিনই আমাদের প্রজন্মের শেষ প্রতিনিধি! এভাবে কি আমরা আপনাকে চিহ্নিত করতে পারি? আপনার নিজেকে কি নিঃসঙ্গ মনে হয়?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: মাঝে-মাঝে নিজেকে খুব অসহায় মনে হয়। আমরা শ্যাম-শেফালীকে হারিয়েছি। তাঁদের সাথে গান করতে যে আনন্দটা পেতাম—যেমন, তাঁরা একটা গানকে বারবার করতেন। শুদ্ধতার দিকে যেতে চাইতেন। আর এখনকার শিল্পীরা ও রকম রেওয়াজে কেমন যেন বিরক্তিবোধ করেন। শ্যাম-শেফালী আমার খুব প্রিয় ছিলেন। এই দুই শিল্পীকে হারিয়ে আমিও অসহায় হয়ে গেলাম। আমার যেন এক হাত অচল হয়ে গেল।
প্রশ্ন: আপনি একা জীবন কাটাচ্ছেন। কারও সঙ্গী হিসেবে সান্নিধ্যে আসতে আপনার কি কখনো ইচ্ছে হয়নি?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: মানুষ কি প্রেম ছাড়া আছে নাকি? আমার জীবনেও প্রেম এসেছিল। আমারও একটা মন আছে। একটি মেয়ের প্রেমে পড়েছিলাম। সে নিশ্চয় এখন অন্যের ঘরনী। এই প্রেমের কারণেই আমি একা হয়ে গেলাম। নাম ছিল শিখা। কুমিল্লার মেয়ে।
প্রশ্ন: আপনার নতুন কোনো পরিকল্পনা বা গান নিয়ে নতুন কিছু ভাবছেন কি না...
সৈয়দ মহিউদ্দিন: আমার আগামী পরিকল্পনা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে একটি অ্যালবাম বের করা। যেটি এ দেশের জনগণের উদ্দেশে উৎসর্গ করব।
প্রশ্ন: আপনি অনেক দিন থেকে গান লিখছেন। অনেক গানে সুর দিয়েছেন। অনেক মানুষের সাথে মিশেছেন। অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। কারা বা কোন্ সংগঠন আপনাকে সম্মাননা দিয়েছে, উল্লেখ করবেন?
সৈয়দ মহিউদ্দিন: অনেক সম্মাননা, পদক পেয়েছি। সেগুলোর মধ্যে আছে লোক উৎসব, পুরাতনী মেলা পরিষদ-চট্টগ্রাম, মহান একুশে উদযাপন পরিষদ স্বর্ণপদক, সমাজ সমীক্ষা সংঘের ড. রশীদ আল ফারুকী স্মারক, চট্টগ্রাম উৎসব উদযাপন পরিষদ, ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-চট্টগ্রাম সম্মিলিত সম্মাননা, ফটিকছড়ি পরিষদ-চট্টগ্রাম সম্মাননা, অবসর, চট্টগ্রাম বিনোদন সাংবাদিক সংস্থা, দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ, সঙ্গীত পরিষদ, নবান্ন উৎসব, শিশুমেলা, পহেলা বৈশাখ উদযাপন পরিষদ ২০১৮, রাহে ভাণ্ডারসহ অনেক। তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী দুটি পদক আমি বর্জন করেছি। তার কারণ, যার কাছ থেকে পদক নেব, তিনি ঘাতক দালাল মন্ত্রী ছিলেন।
ধারণ: ১ মে ২০১৮