একটি যুগের নির্মাতা লতা মঙ্গেশকর
ভারতীয় সংগীতের আধুনিক ও জনপ্রিয়ধারার কণ্ঠ রূপকার লতা মঙ্গেশকর [১৯২৯-২০২২] সদ্য প্রয়াত হলেন। গত ৬ ফেব্রুয়ারি বিরানব্বই বছর বয়সে মুম্বাইয়ের ব্রিচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তিনি এক হাজারের অধিক ভারতীয় ছবিতে গান করেছেন এবং দশ হাজারের বেশি গান গাইবার রেকর্ড রয়েছে। ভারতের ৩৬টি আঞ্চলিক ভাষাতে গান গাওয়ার অনন্য রেকর্ডও রয়েছে। বাংলা ভাষাতেও তাঁর দুই শতাধিক গান রয়েছে। তন্মধ্যে ‘প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে’, ‘রঙ্গিলা বাঁশিতে কে ডাকে’, ‘নিঝুম সন্ধ্যায় পান্থ পাখিরা’, ‘আষাঢ় শ্রাবণ মানে না তো মন’, ‘বাঁশি কেন গায়’, ‘সাত ভাই চম্পা’, ‘যদিও রজনী পোহাল তবুও’, ‘কে যেন গো ডেকেছে আমায়’, ‘আকাশ প্রদীপ জ্বলে’, ‘না যেও না রজনী এখনও’, ‘ও মোর ময়না গো’, ‘আজ মন চেয়েছে আমি হারিয়ে যাব’, ‘মঙ্গল দীপ জ্বেলে’, ‘ওগো আর কিছু তো নাই’, ‘কেন কিছু কথা বলো না’, ‘চঞ্চল ময়ূরী এ রাত’ উল্লেখযোগ্য। হিন্দি গানের মধ্যে ‘আজা রে পরদেসি’, ‘লগ যা গলে’, ‘রয়না বিতি যায়ে’, ‘তেরে বিনা জিন্দেগি সে কোই’, ‘দিল তো পাগল হ্যায়’, ‘তুঝে দেখা তো ইয়ে জানা সনম’, ‘চলতে চলতে, ইঁয়ুহি কোই’, ‘আজ ফির জিনে কি’, ‘পেয়ার কিয়া তো ডরনা কেয়া’, ‘দুনিয়া করে সওয়াল তো হাম বহু’, ‘হোঁঠো মে অ্যায়সি বাত’, ‘জিয়া জ্বলে’ গানগুলো এই উপমহাদেশজুড়ে জনপ্রিয় হয়ে আছে।
লতা মঙ্গেশকর একটি যুগের নির্মাতা—এ কথাটা এই উপমহাদেশে খুব একটা গুরুত্ব পাবে না। কারণ, এতদঞ্চলের মানুষ গানকে আস্বাদন করেন ঠিকই কিন্তু তার শিল্পমূল্য নিয়ে ভাবেন কম। ফলে শিল্পভাণ্ডার বিশ্লেষণের অতীতে থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যায়। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের শিল্পীগণ সময়ের পরিসরে ধীরে ধীরে আরও উজ্জ্বল হতে থাকেন, যেমন ষোলো শতকের ক্লডিও মন্টিভেরডি, কিংবা তারও আগের জসকুইনের সংগীত এখনো দেশে দেশে অডিটোরিয়ামে বেজে চলেছে এ সপ্তাহের সৃষ্ট কোনো নতুন সিম্ফনির পরিবেশিত মঞ্চের দেয়ালের ওপাশে। আরও যেমন সতেরো-আঠারো শতকের ইউহান সেবাস্তিয়ান বাখ, কিংবা মোজার্ট-বিঠোভেন প্রমুখের রচনা ও সৃষ্টি একেকটা যুগ বা পিরিয়ডকে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছে। ১৭৫০ সালে যখন বাখ মারা গেলেন, সে বছর থেকে ব্যারোখ যুগের অবসান হলো। এরপর ক্লাসিক্যাল যুগের সূচনা ঘটল মোজার্ট-এর রচনাশৈলীর অভিনবত্ব দিয়ে। সংগীতের কাঠামোগত, তত্ত্বীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যা উন্মোচনের ক্ষেত্রে এসব নিবিড় গবেষণা ও বিশ্লেষণের ফসল। প্রতিটি যুগ কিংবা পিরিয়ড নির্মিত হয় শিল্পের বুনন বা কাঠামোর বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ দিয়ে। তা না করা হলে উত্তরাধিকারগণ সেই ধারা বহন করে নিয়ে যেতে পারেন না। লতা হয়তো এ সময়ের শ্রোতাদের হৃদয়াসন জুড়ে আছেন। মনে করা হচ্ছে, এভাবেই তাঁর গান শাশ্বত হয়ে থাকবে। কিন্তু বাস্তবতা হলো এখনকার শ্রোতাগণ সেই সব ছবির প্রত্যক্ষ দর্শক বলে সেই গানগুলো স্মৃতিতে ভেসে বেড়ায়। কিন্তু আগামীর সন্তানের কাছে কতটুকু গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা নিয়ে সংশয় রয়ে যায়। কারণ, তারা সূচনাকালের সাদাকালো সিনেমাযুগের সঙ্গে পরিচিত নয়। সেই সময়ের পরিবেশ, সভ্যতা ও সংস্কৃতিতেও আগ্রহী নয়, তাহলে তারা কেন এই গান আগামীতেও শুনবে? কিন্তু যদি আমরা ভিয়েনার অপেরা হাউসগুলোর দিকে তাকাই, সেখানে একুশ শতকের কোনো মিউজিকের পাশাপাশি চৌদ্দ শতকের মোটেট মিউজিকও বেজে চলেছে। কিন্তু আমাদের মনোজগৎ থেকে আঠারো শতকের সংগীতই প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অর্থাৎ আমাদের দুশো বছর আগের ঐতিহ্যই হারিয়ে ফেলেছি, পশ্চিমারা সাত-আটশ বছর কীভাবে ধরে রাখল, তাঁর একটু উপায় বের করতে হবে এবং আগামীর জন্যে আমাদেরকে সেই পথ তৈরি করে দিয়ে যেতে হবে।
লতাজি চলে গেলেন, কিন্তু তিনি যা কিছু রেখে গেলেন, তা কি শুধুই আমাদের উপভোগের বস্তু, না তারও অধিক কিছু? তিনি মূলত কণ্ঠশিল্পী। কিন্তু তাঁকে কেন্দ্র করে শত শত গীতিকার ও সুরকারের, সংগীত পরিচালক, বাদ্যশিল্পীর সমাবেশ ঘটেছে উপমহাদেশজুড়ে। সিনেমাযুগের সূচনাকালে তাঁদের হাত ধরে যে একটি সুবিশাল সাংগীতিক বলয় তৈরি হয়েছিল, তা শুধু আধুনিক গান বা ফিল্মের গান বা লতাজির গান, এসব বলে চালিয়ে দেওয়া ঠিক হবে না; বরং তিনি ও তার সাথে অজস্র মানুষ একযোগে শিল্প রচনা করেছেন, তাঁদের প্রত্যেকের যথামর্যাদা প্রদানের সুযোগ তৈরি করতে হবে। শৈশবে পরিবার থেকে একমাত্র সায়গল ব্যতীত আর কিছু গাইবার অনুমতি ছিল না তাঁর। বাবা দীননাথ মঙ্গেশকর চাইতেন ধ্রুপদি গানের শিল্পী হয়ে উঠবার জন্য, কিন্তু তিনি জনমানুষের কাছে, প্রান্তিক জনপদের কণ্ঠস্বর হয়ে উঠতে চাইলেন। এবং ধীরে ধীরে নিজেই একটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠলেন। এই সিদ্ধান্ত ও আধুনিক রুচিবোধ ভারতীয় সংগীতের আরেকটি ভূগোল নির্মাণ করেছে।
লতা মঙ্গেশকর একটি যুগের নির্মাতা—এ কথাটা এই উপমহাদেশে খুব একটা গুরুত্ব পাবে না। কারণ, এতদঞ্চলের মানুষ গানকে আস্বাদন করেন ঠিকই কিন্তু তার শিল্পমূল্য নিয়ে ভাবেন কম। ফলে শিল্পভাণ্ডার বিশ্লেষণের অতীতে থেকে যায় এবং ধীরে ধীরে তা হারিয়ে যায়। কিন্তু ইউরোপ মহাদেশের শিল্পীগণ সময়ের পরিসরে ধীরে ধীরে আরও উজ্জ্বল হতে থাকেন, যেমন ষোলো শতকের ক্লডিও মন্টিভেরডি, কিংবা তারও আগের জসকুইনের সংগীত এখনো দেশে দেশে অডিটোরিয়ামে বেজে চলেছে এ সপ্তাহের সৃষ্ট কোনো নতুন সিম্ফনির পরিবেশিত মঞ্চের দেয়ালের ওপাশে...
লতাজির কিছু সাক্ষাৎকার শুনে ও অভিব্যক্তি জেনে মনে হলো অনেকটা আক্ষেপ রয়ে গেছে তাঁর। প্রশ্ন জাগতে পারে, তাঁর প্রতি মানুষের ভালোবাসার তো কমতি নেই। কোটি কোটি মানুষ এই কণ্ঠকে অনুসরণ করেছে, গুণগ্রাহীগণ গানের চর্চা অব্যাহত রেখেছে। তারপর ভাবার বিষয়, সাধনার মূল্যায়ন কি যথার্থ অর্থে পেয়েছেন? অথবা যেভাবে তিনি চেয়েছেন? তা কি এই অনুরাগীরা বুঝতে পারেন? এ উপমহাদেশে সংগীতানুরাগী মানুষ তাদের হৃদয়ের সবটুকু ভালোবাসা অর্পণ করে চলেছে, প্রত্যেকেই কমবেশি স্মৃতিচারণা করছে। কেউ ‘ভারতের নাইটিঙ্গেল’, কেউ ‘ভারতরত্ন’, কেউ ‘স্বরূপা সরস্বতী’ বলে আত্মতৃপ্তি প্রকাশ করছেন। কর্মজীবনেও অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা অর্জন করেছেন। ভারতের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা ভারতরত্ন [২০০১]সহ পদ্মবিভূষণ [১৯৯৯], পদ্মভূষণ [১৯৬৯]-এ ভূষিত হয়েছেন। এ ছাড়া ২০০৭ সালে ফ্রান্স সরকার লেজিওঁ দনরের খেতাব প্রদান করেছে। দাদাসাহেব ফালকে পুরস্কার [১৯৮৯], মহারাষ্ট্র ভূষণ পুরস্কার [১৯৯৭], এনটিআর জাতীয় পুরস্কার [১৯৯৯], জি সিনে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার [১৯৯৯], এএনআর জাতীয় পুরস্কার [২০০৯], ৩ বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৫টি বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার পেয়েছেন। ৪ বার ফিল্মফেয়ার পুরস্কার অর্জন করেছেন। ১৯৭৪ সালে সবচেয়ে বেশিসংখ্যক গান রেকর্ড করার জন্য গিনেস বুক অব রেকর্ডে তাঁর নাম ওঠে। ১৯৯০ সালে পুনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডক্টরেট দেয়। আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে সাম্মানিক নাগরিকত্বও পেয়েছেন।
তা সত্ত্বেও তাঁর সম্পর্কে, শিল্পভাবনা সম্পর্কে জানতে গেলে দেখি লতাজিকে নিয়ে খুব সামান্য পরিসরে জীবনী-সাক্ষাৎকার, কিছু ভালো গানের স্তুতি ও অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু জানবার সুযোগ নেই। কেউ কেউ ব্যক্তি উদ্যোগে তাঁকে নিয়ে গবেষণামূলক কাজ করেছেন। কিন্তু বিশ্বের শ্রেষ্ঠ কণ্ঠশিল্পীদের গ্রেডিংয়ে লতার নাম পাওয়া যায় না। সেখানে উঠে আসে টেইলর সুইফট, সেলেনা গোমেজ, এড শেরান, কেটি পেরি, জন লেনন, মাইকেল জ্যাকসন, এডেলদের নাম। বিশ্ববরেণ্য কণ্ঠশিল্পীদের তালিকায় লতার নাম ততক্ষণ পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না ইউরোপীয়-আমেরিকানদের দয়া না হয়। অথচ কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বই ‘সিঙ্গারস সংরাইটারস’-এ বিশদ গবেষণায় দেখেছি এডেলের কণ্ঠের ধরন কী রকম, তার ভোকাল কর্ডের গঠন কেমন, শব্দতরঙ্গ উৎপাদনের স্বরূপ কী, স্বর প্রক্ষেপণের কৌশল কী রকম, তা শিক্ষার্থীদের কীভাবে আয়ত্ত করতে হবে ইত্যাদি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। লতার কণ্ঠেরও এ রকম প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণা ও চরিত্রায়ণের সুযোগ রয়েছে, যা অন্তত ভারতীয় শিক্ষার্থীদের জন্য অনুসরণীয় পাঠ্য হতে পারে। সামাজিক মাধ্যমে অনেকে আবেগে বলছেন, তিনি বেঁচে থাকবেন চিরকাল। কিন্তু কীভাবে? উল্লেখ রয়েছে দশ হাজারের অধিক গানের রেকর্ড আছে। কিন্তু সেগুলো কোথায় সংরক্ষিত আছে, সেসব লিরিক কাদের, সুর কে করেছেন? সেসব এলপি, সিডি, ক্যাসেট একত্রে কোথায় পাওয়া যাবে? তাঁর দায়িত্ব নিতে হবে অন্তত আগামী দিনের সাংস্কৃতিক তাৎপর্য বিবেচনায় রেখে। লতাজিকে প্রকৃত মূল্যায়ন করতে হলে ভারত সরকারকে অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় বা গবেষণা ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠা করতে হবে লতা মঙ্গেশকরের নামে। সেখানে তাঁর সহযাত্রী সকল গীতিকার, সুরকার, বাদ্যকার নিয়ে গবেষণা হবে, প্লেব্যাক সিঙ্গিং বিভাগও হতে পারে। সেখানে সুপরিকল্পিত সংরক্ষণাগার, জাদুঘর, অডিটোরিয়াম থাকবে। সেখানে প্রতিনিয়ত পরিবেশনা হবে নতুন রূপে আরও বৃহৎ আয়োজনে সঙ্গীতের, যেখানে লতা আরও দীর্ঘজীবী হবেন। তাঁর জমানো সম্পদ দিয়েও বাস্তবায়ন করা সম্ভব। কিন্তু তা কি আদৌ হবে? মনে হয় না। কারণ, ফিল্মের গান এখনো শাস্ত্রীয় বিদ্যায়তনে প্রশিক্ষণের জন্য অচ্ছুত।