আবুল হাসানের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে!

 

প্রথম পর্ব পড়ুনআমার সামনে দিয়ে শাবানা বেরিয়ে আসছেন...

শেষ পর্ব পড়ুন  আবুল হাসানের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে

রুদ্র: আপনার আরও ঘনিষ্ঠ বন্ধু কারা ছিল?

বুলবুল: আবুল হাসান ছিল সবচেয়ে কাছের। ওর জন্য আমার কান্না পায়। হাসানকে ঘিরে, এত অদ্ভুত ছিল যে ওরা, বলার মতো নয়।

রুদ্র: আপনার দুজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু—কায়েস আহমেদ ও আবুল হাসানদুজনেরই অকালমৃত্যু হয়েছে এবং দুজনই ছিলেন অসম্ভব প্রতিভাধর

বুলবুল: কায়েসের লেখালেখি যদি বলো, তুমি চিনেছ; কিন্তু কায়েসকে বৃহৎভাবে চেনে না। তার লেখা মারাত্মক। সে খুবই কাছের ছিল। আর হাসান ছিল আমার সবচেয়ে কাছের। তার কবিতা নিয়ে কী বলব? সে বেঁচে থাকলে অনেকের কবিতাই আজকে ধূসর হয়ে যাইত।

রুদ্র: আবুল হাসানের সাথে আপনার ব্যক্তিগত সম্পর্কের কথা একটু জানতে চাই।

বুলবুল: ওর [হাসান] তো রাতের বেলায় থাকার জায়গা থাকত না। আমি তো চাকরি করতাম, ফলে আমি বাসায়ও থাকতাম না, নিজেই বাসা ভাড়া নিয়া থাকতাম। ও আমার ওখানে যেত। আবুল হাসানের মৃত্যু আমাকে কাঁদিয়েছে। আমার এমনিতে কান্না পায় কম। তারপরেও চোখে পানি এসে গিয়েছিল। হাসানের ঘটনা কিছু বলি। ও তো বোহিমিয়ান ছিল। একবার সে আমার গ্রামের বাড়িতে গেল। গিয়ে ওখানে ছড়া লিখল প্রচুর। জগন্নাথ হলের বন্ধুবান্ধব আরও কিছু ছিল ওখানে। ওখানে যেত সে। ওখানে এক রাতে চৌদ্দটা গান লিখল সে। সে গানগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। সে মুখে মুখে বলে গেল, মধুসূদন হইয়া... এ রকম একটা অবস্থা।

যা হোক, হাসানের বাঁদড়ামোপনার কিছু কথা বলি। আমি তখন ওয়াপদায় চাকরি করতাম। ফুলবাড়িয়া স্টেশনের কাছে কিছু গভর্নমেন্ট কোয়ার্টার ছিল, স্টেশনের লোকজনের জন্য। ওখানে একটা ঘর ভাড়া নিয়েছিলাম আমি। ওখানেই আমি থাকতাম। প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে বাসায় চলে যেতাম, শুক্রবার এখানে আসতাম রাতের বেলা। হাসানও যাইত, নির্মলও যাইত। নির্মলেন্দু গুণকে বলতাম যেনির্মল যেটা করত যে, রাত একটা নাই, দুইটা নাই, হুট করে এসে দরজায় দমাদম বাড়ি দেওয়া শুরু করতকেয়ারটেকার যেন, এ রকম ভাব আর কি! নির্মল ছিল এ রকম; একটু বেশি সাহস।

হাসানের কথা বলি। একদিন হাসানকে চাবি দিয়ে গেলাম, বললাম যে, ফিরতে দেরি হয়ে যাবে বৃহস্পতিবার রাত্রে, যেহেতু তার থাকতে হবে। আমি থাকতে পারব না। তাকে চাবি দিয়ে বললাম যে, আমি শুক্রবার দশটার মধ্যে আইসা পড়ব। আইসা দেখি যে, সে নাই তো নাই। এখন কই চাবি পাই? তখন দশটার পরে, বাইরে ও। সেই সময়ের হোটেলগুলো দশটার পরে ঢুকতে দিত না, পয়সা থাকলেও বাইরে থাকার উপায় নাই। এদিকে হাসান নাই তো নাই। তখন নির্মল আইসা কয়, কী করা যায়? তখন ফুলবাড়িয়া স্টেশনটা ভেঙে ফেলেছে। মেঝে থাকে না? মেঝে আছে। গরমের দিন, আর কতক্ষণ বইয়া থাকোন যায়? শুয়ে পড়লাম, মশাও কামড়ায়। করলাম কি, তখন তো পরিপাটি থাকতাম, ঊর্ধ্বমুখে শুইয়া পরলাম নিচে রুমাল দিয়া, যেন ময়লা না ভরে, আবার মশাও তাড়াই।

একটা ঘটনা বলি: হঠাৎ করি দেখি, আরও একটা লোক শুইয়া রইছে। ভাবলাম, আমি একভাবে আইছি, এই ব্যাটাও বোধ হয় আরেকভাবে এ রকম। আমার পয়সা আছে, ও পয়সা ছাড়াই ঘুমায়। কিছুক্ষণ পর একটা মহিলা আসল। লোকটা জিজ্ঞেস করল, কই গেছিলি? এদিকে আমি সব শুনতে পাচ্ছি কিন্তু। লোকটা ভাবছে আমি ঘুমিয়ে আছি। [মহিলা] কয়, গেছলাম একটু কোতোয়ালি থানায়, পুলিশে লইয়া গেছিল।

তারপর? তারপর যা হওয়ার হইছে। লোকটা কিছু বলল না। দেখলাম মেয়েটার সাথে খুব মিলে গেছে।

হাসান লিখতেন। আমরা পোস্তগোলা যাইতাম, বাবুবাজার যাইতাম, হাসানও যাইত। গিয়ে নেশাপাতি করতাম। ওখানে গিয়া হাসানের সাথে একটা ঘটনা ঘটল। ওখানে আমি যাইতাম, হাসান যাইত, নির্মল খুবই হঠাৎ হঠাৎ। একদিন গিয়া, একটা মেয়ে দেখলাম ওর দিকে পড়ে গেল। মেয়েটার নাম আলেয়া। কেন জানি না যে খুব সমাদর করে, ডেকে নিয়ে যায় ও খুব চা খাওয়ায়। আমাকেও চা খাওয়ায়; কিন্তু আমার দিকে তার যত্ন নাই। আমার এমনিতে এসবে কোনো ঈর্ষা নাই। কিন্তু এখানে এসে ঈর্ষা হইত যে, সে তো ওর দিকে না তাকিয়ে আমার দিকে তাকালেও পারত! না, এগুলো করতে পারত না। মেয়ে-টেয়ে আমার জীবনে ছিল না আর কি!

আর নির্মল তোএকদিন গেলাম, পট্টিতে খাইতে। পয়সা তো আমার ঘাড়েই, আমি যেহেতু চাকরি করি, বাড়ি থেকে টাকা আনি। সে মদ-টদ খায়, সেখানে খাওয়াইত এক মাসি। মাসি মানে কি, সে বৃদ্ধ হয়ে গেছে, মদ বেচে। আমি গিয়া আগেই কইতাম যে, স্বীকার করতাম যে, দোস্ত, আমার কাছে কিন্তু টাকা-পয়সা কম, একটু কম খাইস। ওর [নির্মলেন্দু গুণ] এগুলো নিয়া কোনো গা নাই। কয়, চিন্তা করিস না। বইলাই মদ খায় আরও বেশি! তারপর হিসাব করতে গিয়া দেখি, এখন এত টাকা কই পাই? [সে] কয় যে, না, তুমি এত টাকা পাও। পরে গিয়া অবশ্য আমি টাকাটা শোধ করে দিয়ে আসতাম। এই ছিল নির্মল। এদিকে হাসান ওই বোকার মতো তাকিয়ে থাকত। তারপর ওখানে একটা খুনের ঘটনা ঘটে, এরপরে আর এখানে আসা হইত না। ...কী বলব, বুঝতে পারছি না!

হাসানের কথা বলি। একদিন হাসানকে চাবি দিয়ে গেলাম, বললাম যে, ফিরতে দেরি হয়ে যাবে বৃহস্পতিবার রাত্রে, যেহেতু তার থাকতে হবে। আমি থাকতে পারব না। তাকে চাবি দিয়ে বললাম যে, আমি শুক্রবার দশটার মধ্যে আইসা পড়ব। আইসা দেখি যে, সে নাই তো নাই। এখন কই চাবি পাই? তখন দশটার পরে, বাইরে ও। সেই সময়ের হোটেলগুলো দশটার পরে ঢুকতে দিত না, পয়সা থাকলেও বাইরে থাকার উপায় নাই। এদিকে হাসান নাই তো নাই। তখন নির্মল আইসা কয়, কী করা যায়? তখন ফুলবাড়িয়া স্টেশনটা ভেঙে ফেলেছে। মেঝে থাকে না? মেঝে আছে। গরমের দিন, আর কতক্ষণ বইয়া থাকোন যায়? শুয়ে পড়লাম, মশাও কামড়ায়। করলাম কি, তখন তো পরিপাটি থাকতাম, ঊর্ধ্বমুখে শুইয়া পরলাম নিচে রুমাল দিয়া, যেন ময়লা না ভরে, আবার মশাও তাড়াই।

রুদ্র: আপনারা কয় ভাই-বোন ছিলেন?

বুলবুল: ৫ ভাই, ১ বোন ছিলাম। বাবার নাম আবদুল মতিন চৌধুরী। মায়ের নাম সুফিয়া বেগম চৌধুরী। আমার নাম [স্কুলের নাম] আব্দুর রউফ চৌধুরী। বুলবুলনানার দেওয়া নাম। পরে যখন লিখব চিন্তা করলাম, তখন নানার প্রতি একটা শ্রদ্ধা রাইখা বুলবুলের পেছনে চৌধুরী লাগাইয়া বুলবুল হইয়া গেলাম, এইভাবেই আরকি। আমার এক ভাই মারা গেছেন। ভাইবোনদের মধ্যে আমি বড়।

প্রশ্ন: আপনার জীবনে প্রেমের কাণ্ড ঘটে নাই?

বুলবুল: প্রেমে পড়া বলতে যা বোঝায়, সেটা কিন্তু আমার কখনো স্ফুরণ হয়নি। আছে না যে, একটা মেয়ে, একটা মেয়ে কিন্তু...। আমার পাঁচ নম্বর ভাইও যখন বিয়ে করছে, তখনো কিন্তু আমার বিয়ে করার কোনো খবর নাই। একটা নিজের মতো জীবনযাপন করি, বাইরেই থাকি, চাকরি-বাকরি করি। এই সময় আমার ভাই বলল যে, আমার বউয়ের এক আত্মীয় আছে তার সাথে তোমার... এর মধ্যে মেয়েও দেখেছি অনেক... কোনো কথা নাই, বার্তা নাই চাচায় আইয়া কইল, ঘটক আইয়া কইল, বন্ধুবান্ধব কইল, মায়ে কইল যে, বিয়া না করলেও দেখ, কোনটা যদি পছন্দও হয়। তবে যাওয়ার মধ্যে সারা। মনের মধ্যে কোনো আঁচড় নাই। তো, ওই মেয়েটাকে দেখার পরে আমি যতটা হইলাম, ওই হইল বেশি। এটা হচ্ছে ১৯৮২ সালের দিকে।

সে আসত। বন্ধুবান্ধবের আসা-যাওয়া ছিল। আমার মনে পড়ে, আমাদের সম্পর্কটা এমন ছিল, আমি তখন, মানে ওই সময় আজকের মতো শয়তানি বুদ্ধি তখনো হয় নাই আরকি। জীবনযাপন ওইগুলো তখনো এত বুঝি নাই। এই সব খেলা-খেলি নাই তখন! সবারই এ রকম মনে হইত বোধ হয়। উনি আসতেননাম না বলাই ভালোকোনো দিন তাকে আমি স্পর্শ করিনি। তখন আমার অবস্থা খারাপ। চাকরি হারাইছি। নতুন চাকরি দরকার। বললে বলতাম যে, এই তো, চাকরি-বাকরি না করলে তো সংসার করা মুশকিল। তখন এগুলো বলতাম। উনি তখন বলতেন যে, এগুলো নিয়া চিন্তা করতে হইব না। আমার বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে বিয়ের জন্য। আমার বাবার অবস্থা ভালো। আমার নামে জায়গা-জমি আছে। বলতেন যে, জানেন, আমি জমায় জমায় চল্লিশ হাজার টাকা জমাইছি। আমার যে শাড়ি আছে, তাই দিয়ে আমার দশ বছর চইলা যাইব। চিন্তা করছেন কেন? এইগুলাই সে বলত। আমি তখন একটা চাকরির জন্য চেষ্টা করেছিলাম। মাজারে গিয়া, হাইকোর্টের মাজারে গিয়া কইলাম যে, বাবা...। এখন তো বুঝি যে, মৃত লোক জীবিত লোকের কথা শুনতে পায় নাতখন মনে হয়েছিল চাকরিটা পাইলে তাকে বিয়া করমু। কিন্তু চাকরিটা তখন হয়নি কপালে।

আমার ছোট বোনের বিয়ে হচ্ছে তখন, ওই সময় ও এলো। পারিবারিকভাবে সে আসত। বিয়ের দিন সে আমাকে ডেকে নিয়ে আড়ালে বলল যে, আমাকে তো চলে যেতে হবে, বাসায় খুব চাপ দিচ্ছে। শুধু একটা কথাই বলুন যে, আপনি কি বিয়ের পরেও আমার বন্ধু হয়ে থাকবেন? বললাম, থাকব। খুবই কাপুরুষোচিত ব্যাপার হয়তো, কিন্তু সেটাই জীবনের ঘটনা।

পরে গুরুদেব [আবু শাহরিয়ার] ছিল। উনি আসলে খুবই উচ্চমার্গীয়; গুরু বলতে যা বোঝায়, তার সমস্ত গুণাবলি তার মধ্যে ছিল। আমি গিয়ে গুরুদেবের কাছে আমার দুঃখটা বয়ান করলাম। উনি তো মুখে বললেও পারতেন। এমনিতেই তাকে কেউ কিছু বললেই লিখে জবাব দেয়, মুখে কিছু বলে না। উনি লিখলেন, আপনার না পাওয়াটাই জীবনের বড় প্রেম। এখন মনে হয় যে, এই না পাওয়াটাই গভীর প্রেম হয়েছে।

পরে তার [প্রেমিকা] সাথে দেখা হয়েছে। এখনো তার অনুরাগ আমি ভুলতে পারি না। বিয়ের পরেও, সংসার করার সময়েও তার সাথে দেখা হয়েছে। তারপরে আমি

রুদ্র: ওটাই প্রথম প্রেম?

বুলবুল: আরেকটা প্রেম, ঠিক প্রেম করা নয়। বয়ঃসন্ধিকালের কিছু ছেলেমানুষি আছে না? আমার এক চাচা তখন আমাদের বাসায় থাকতেন। এখানে থেকে পড়াশোনা করতেন। আমার সমবয়সী। পাশের বাসায় দোতলায় একটা মেয়ে ছিল। জাহানারা নামে। মারা গেছেন উনি। সেই চাচা একদিন বলল যেওই বোধ হয় মেয়েটাকে পটাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না, চেহারাটা ভালো ছিল না; সে বলল যে, চাচা, তোমারে দেইখা তো মেয়েটা জানালাটা বন্ধ কইরা দিছে, তোমারে অপমান করছে। ভাবলাম যে, মেয়েটাকে প্রেমে ফেলতে হবে, একটা শিক্ষা দিয়ে দিতেই হইব! লেগে রইলাম।

এখানে-সেখানে লেগেই থাকতাম। ঘটনাটা ৬৮-৬৯ সালের ঘটনা, যুবক বয়সের কথা। অবশেষে সে প্রেমে পড়ে গেল। একদিন সে করল কি, আমাকে একটা কাগজ দেখিয়ে ইশারা দিল যে, তুমি পেছন দিকে আসো। পেছন দিকে রাস্তা, গেলাম। ঘুইরা গেলাম। প্রেমপত্র দেওয়া-নেওয়া শুরু হয়ে গেল। আমিও লিখি, সেও লিখে। জায়গা আছে, [চিঠি] নিয়ে যাই, রেখে আসি।

আমার নানি কিন্তু সব সময় আমার দিকে চোখ রাখত। আমার মঙ্গল-অমঙ্গল, আমার বেড়ে ওঠা, শেষ বয়স পর্যন্ত উনি এটা করে গেছেন। রাত্রেবেলা জানালার দিকে তাকায় থাকি, উনি টের পাইয়া পিছে লেগে পড়ল। যখন বাইরে বের হইতাম...। আমার তো তখন প্রেম বলতে যেটা বোঝায়, সেই চেতনাই হয় নাই। আমি এটাকে একটা খেলার মতো ভাবছি যে, আমি খেলায় জিইত্যা গেছি। আমার তো কোনো কিছু নড়ে না! মেয়েটা হলো কি [একটা দুর্ঘটনা ঘটাইল]। হাসপাতালে গিয়া বাঁচায় আনছি। এখন মনে হয় যে, এটা আমার জন্যই হয়েছিল। এই দায়বদ্ধতাটা এখনো আমাকে পীড়া দেয়। পরে কিছুদিনের মধ্যেই সেই মেয়ের বিয়া হয়ে যায়। ওরা ব্যাপারটা টের পাইছিল, কিন্তু ওরা কোনো উচ্চবাচ্য করে নাই। আমি শুধু ভয়ে ছিলাম যে, আমার নানি যদি কয়া দেয়!

মাস চারেক আমাদের মধ্যে চিঠি চালাচালি হয়েছিল। আমি ভয়ে ছিলাম যে, উনি যদি বইল্যা দেয়, [আমার জন্যই মেয়েটা আত্মহত্যা করতে চাইছিল]? আমি তো অনেক কিছু করেছি, কিন্তু উনি কিছু বলেন নাই। বিয়ের পরেও [ওই মেয়ের সঙ্গে] দেখা হয়েছে। সে দূরে থাকত, মাঝে মধ্যে আসত। সামনাসামনি হতাম না। জানালা থেকে তাকিয়ে, লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতাম। নিজের মুখটা তাকে আর কখনো দেখাই নাই।

আরেকটা মেয়ে ছিল। নাম সাইয়িদা। এরা আসত আমার বাসার ঠিক উল্টো দিকে। ৬৬ সালের দিকে। এই মেয়ে নাচতে পারত, খুবই ভাল নাচত, বাফার [বুলবুল ললিতকলা একাডেমি] ছাত্রী ছিলেন। আমার মা বলত যে, ছেলেরা তো নাচতে পারে, কিন্তু মেয়েদের নাচই সুন্দর। মেয়েদের নাচই সুন্দর হয়ে ওঠে ছেলেদের চেয়ে, মানায় বেশি। আমি মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেলাম। ওদের জন্মদিন হলো, ঘরে গান-বাজনা হবে। ওরা দাওয়াত দিল, সে নাচবে। সেই দিন... সুচিত্রা-উত্তমের যুগ আছে না? সেই যুগের কিড তো। আমিও যাচ্ছি, সেও দৌড়ায় আসছে, গেটের মধ্যে দুজনই পরস্পরে ধাক্কা খাইয়া গেলাম। সিনেমার মতো দেখা গেল। ওই প্রথম তার সাথে আমার ছোঁয়াছুঁয়ি হলো।

কয়দিন পরেই আমার এক বন্ধু এসে আমার কাছে বলল যে, দোস্ত, আমি তো ওই মেয়েটার প্রেমে পড়ে গেছি। অনেক ছেলেমানুষি কাজ করেছি ওই যুবক বয়সে। আমি শুনে তো ঘাবড়ে গেলাম। চিন্তায় পড়ে গেলাম, সেও আবার ওই মেয়েটার প্রেমে পড়েছে। সে রোজই এখানে আসত, যাতে তাকে দেখা যায়; এসে ঘুর ঘুর করে। তারপরে একদিন কয়, আমি তো কবিরাজ ধরছি। তাবিজ-কবচ করা যায় না দোস্ত? তুই একটা চুল আইনা দে। এমনিতেই ওই অবস্থা! আমি কইলাম যে, এখন আমি ক্যামনে চুল আইনা দিমু? এটা তো সম্ভব না। ওদের [বাড়িতে] একটা [লোক] কাজ করে, ওইডা আসে, ওরে ধইরা দেখি, পয়সাকড়ি দিয়ে কোনো ব্যবস্থা করা যায় কি না। এই রকম হুদাই মিছা কথা কয়া কাটায়া দিতাম। এর পরে কিছুদিনের মধ্যে তারা [মেয়েটির পরিবার] স্থানান্তরিত হয়ে গেল। এরপরে আর কোনো দিন দেখা হয় নাই।...লেখা কঠিন রে ভাই

আরেকটা প্রেম, ঠিক প্রেম করা নয়। বয়ঃসন্ধিকালের কিছু ছেলেমানুষি আছে না? আমার এক চাচা তখন আমাদের বাসায় থাকতেন। এখানে থেকে পড়াশোনা করতেন। আমার সমবয়সী। পাশের বাসায় দোতলায় একটা মেয়ে ছিল। জাহানারা নামে। মারা গেছেন উনি। সেই চাচা একদিন বলল যেওই বোধ হয় মেয়েটাকে পটাবার চেষ্টা করছিল, কিন্তু পারছিল না, চেহারাটা ভালো ছিল না; সে বলল যে, চাচা, তোমারে দেইখা তো মেয়েটা জানালাটা বন্ধ কইরা দিছে, তোমারে অপমান করছে। ভাবলাম যে, মেয়েটাকে প্রেমে ফেলতে হবে, একটা শিক্ষা দিয়ে দিতেই হইব! লেগে রইলাম।

রুদ্র: বিয়ের ঘটনা কী?

বুলবুল: বিয়া করলাম। যখন বিয়া-টিয়া করি নাই, তখন ঘুইরা-ঘাইরা বেড়াই। তখন একদিন ছোট ভাই আইসা বলল যে, এটা খুবই অদ্ভুত ঘটনা: তুমি বারবার এই রকম করো, মেয়ে দেখতেছ। এইবার আমি আর মিলু, দুই ভাই যাইতাছি, আমরা নরসিংদী যাইতাছি, এক ভাইয়ের বউয়ের বাড়ি ওইখানে। ওইখানে গিয়া যে মেয়েই সামনে পাই, ওই মেয়েরে দিয়াই তোমারে বিয়া করায় দিবো। রাজি? আমি কইলাম, ঠিক আছে। এটা একদম শেষদিকে, ১৯৮৮-৮৯ সালের ঘটনা। আমি বললাম, ঠিক আছে।

ওরা ওখানে গিয়া সন্ধ্যার দিকে ফিইরা আইসা বলে যে, আমরা তোমার জন্য মেয়ে দেইখা আসছি। গরিব, অবাঙালি, পশ্চিম পাকিস্তানি লোক, বাপের স মিলের ব্যবসা ছিল, উনি মারা গেছেন। মেয়েটা খুবই [ভালো], ওদের বাড়িঘর খুবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন, ছিমছাম। আমি নিরুপায় হয়ে বললাম যে, ঠিক আছে। ওরাও আমাকে দেখে কেন জানি পছন্দ করে ফেলল। বয়সের কিন্তু একটা তারতম্য আছে। আমার চেয়ে বারো-চৌদ্দ বছরের মতো কম বয়স। গেলাম বোকার মতো। এতবার মেয়ে দেখলাম, খবর নাই, এবার মেয়ে না দেইখাই চলে গেছি। গিয়া বিয়া করলাম। আয়নার মধ্যে ভাবি-ভাবি ডাকে ওরা [ভাইরা]। মুখ দেখলাম বাসের মধ্যে বইসা। মানে, পাশে যে বসছি আমি, খুবই থতমত খেয়ে গেলাম: এটা আসলে কী হয়্যা গেলাম, এটা কী হইল! নিজে একটু লেখালেখি করি, বয়স্ক একটা মানুষের সাথে এটা কী হয়্যা গেল!

বিয়েতে গিয়েছিল শেখ আবদুল হাকিম, মাহবুব কামরান আর আবু সাঈদ জুবেরী। ওরা তিনজন বরযাত্রী হয়ে গেল। কল্যাণপুরে তখন বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতাম। একটা দোকান দিয়েছিলাম, স্টেশনারি দোকান। যা হোক, ওরা আসলো এখানে। কামরান বলল যে, বুলবুল ভাই, আমরা তো আউড়া-তাউড়া চালে আপনার জীবনটা দেইখা আসলাম, ভাবিরে নিয়া সংসার করতে বসছেন, কখন কী যে গ্যাঞ্জাম কইরা বসেন! তো, বিয়ার রাত্রেই ওর কাছে, পায়ে ধইরা মাফ চায়্যা নিবেন! বলবেন যে, ভবিষ্যতে কোনো গ্যাঞ্জাম করলে এইটা একটু ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেইখো।

আমি তো এমনিতেই বয়সে বড়। সত্যি বলতে কি, রাত্রেবেলা বোকার মতো করে তার পায়ে হাত রাখতে গেছি, ছিটকে চলে গেল! আর বলা হলো না। ওই সংসারই আছে।

পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার কথা বলতেছিলাম, যেমন আমি যদি বইয়া চা খাইয়া কাপটা থুইলাম, থোয়ার লগেই আবার ওইটা মোছা হইয়া যায়। কামের লোক আইসা কাম কইরা থুইয়া গেলেও কয়, এইটা তো হইছে না। লইয়া আবার সাবান নিয়া যায় ওইটা ধুইতে। সারাক্ষণই এইগুলা করতেছে। জীবনের চূড়ান্ত পর্যায়! জীবন বিপন্ন!

রুদ্র: সন্তান?

বুলবুল: আমার তিন ছেলে। দ্বিতীয় ছেলের আঠারো বছর পরে তৃতীয় ছেলেটা জন্মাল। আমার কোনো ইচ্ছাই ছিল না একটার বেশি সন্তান নেওয়ার। দুইটা নিলাম ওর পরামর্শে। তৃতীয়বার একটা ঘটনা ঘটে গেল! আমি ভাবলাম কি, কবিভাব আছে না নিজের মধ্যে? ভাবলাম যে, আমার তো বয়স বেশি, বাই চান্স মইরা গেলাম, আবার যদি বিয়ে হয়, নতুন জামাই আইসা বাচ্চাকাচ্চা চায় যদি, তখন কী হইবো? পরে ভাবলাম যে, না। সতেরো বছর পরে এসে কনসিভ করে বসল। চার মাস পরে আমাকে বলল যে, এ রকম—‘পেটে বাচ্চা দেখছি। আমি সব সময় স্বপ্নে দেখি যে, একটা মেয়ে পাবো, এই জন্য পেটে বাচ্চা ধরছি। লগে লগে ডাক্তার দেখাইলাম।এখন তো বড় ছেলে বিয়া করেছে প্রেম করে। মেজ ছেলেও প্রেম করে বিয়ে করেছে। দুইজনই চাকরি করে।

রুদ্র: আপনি কেন লেখেন? আপনার লেখার অনুপ্রেরণা কী?

বুলবুল: আমি আসলে লাজুক টাইপের। এমনি ধরো সামনাসামনি বা লোকের সামনে, এখন হয়তো পারি। ভাবলাম যে, লেখাটা রপ্ত করি। এখন সবকিছু ছেপেটেপে যেটা হয়েছে যে, অনেক সময় মনে হয়েছে হুদাহুদি লেখতেছি! পরে মনে হয়েছে, আমার তো একটা বোধ আছে, কথা আছে, দেখা আছে। আমি মূলত এটাই, শেষ পর্যন্ত দেখাটাই ধরতে গিয়ে [লেখার] নেশা হয়ে গেছে। আর লিখতে না পারলে খুব রাগ ধরে। কাজ করতে পারি না কাঙ্ক্ষিতভাবে। রোজই আমি কিছু না কিছু কাজ করি, যেটা আগে হইলে ভালো হইতো। আর কোনো দিন মাইর খাইলে, ওই যে টুকা কাহিনী লিখছিলাম, সেখানে টুকা রাইগা গিয়া আসমান দেশে উষ্ঠা খায়, মেঘের সাথে উষ্ঠা খায়; লিখতে না পারলে এখনো এ রকম রেগে যাই আর নিজে আবার উষ্ঠা খাই।

রুদ্র: আপনার ভাষা বাংলা সাহিত্যের ধ্রুপদি ভাষা, একটা পরম্পরা আছে। আপনার আর কায়েস আহমেদের ভাষা এক রকম না। কায়েস আহমেদ একধরনের টিনেজ বয়সীদের মতো তাগড়া, সাঁই সাঁই করে কেটে দিচ্ছেএ রকম মনে হচ্ছে। আপনার ভাষা অনেকটা মিহি, একটা ধ্রুপদি ভাব আছে...

বুলবুল: আসলে এই সুরটা বোধ হয় পেয়েছিলাম মাটি থেকে। বাংলা সাহিত্যের যাত্রাই তো শুরু হয়েছিল গ্রামবাংলাকে ঘিরে। এখনকার আবহমান বাংলা বলতে যেটা বোঝায়, তা-ও নয়। আমি আসলে ওই মাটিটা পেয়েছিলাম। মাটিটাই আসলে আমাকে এইখানে নিয়া আসছে। ভাষাভাষার ব্যাপারটা আমি জানি না, তুমি যেটা বলছ। কিন্তু এখন আমি বুঝি যে, আমি যে ভাষাটা লিখছি আরকি, এটা কিন্তু এপার বাংলায় সরাসরি নির্মাণ হয়। এটা আছে। এটা হয়েছে আরকি। কীভাবে হয়েছে, জানি না! আর লেখালেখি নিজে চাইয়া হয় না। আমি একটা ভালো গল্প লিখব বললেই হয় না। আবার না চাইয়াও হয়ে যায়। ভালো লেখা হলো ভর করে। এই ভরের অপেক্ষায় থাকি সারাক্ষণ। সেটা হয়তো পুরা হইয়া ওঠে না, তবু খোলামেলাটা আছে, ঝিলিকটা আছে।

রুদ্র: আপনি এখন পর্যন্ত কয়টা গল্প লিখেছেন?

বুলবুল: গোটা ষাটেক গল্প আছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে, ষাটটা গল্পের মধ্যে বেশির ভাগ গল্পই কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। কিন্তু নিজে সংগ্রহ করে কখনো রাখি নাই।

রুদ্র: উপন্যাস?

বুলবুল: উপন্যাস লিখেছি গোটা দশেক। বাচ্চাদের বই কয়েকটা।

রুদ্র: লেখালেখির জন্য কোনো অপরাধবোধ কাজ করেছে কি না?

বুলবুল: না। অপরাধবোধ কেন জাগবে? আমার কাছে মনে হয় যে, এটা একটা ভালো প্রাপ্তি। যেটা দিয়ে মানুষকে নিজের দিকে আকৃষ্ট করা যায় এটা মনে হয়।

রুদ্র: লেখার মন্ত্র কী?

বুলবুল: প্রকৃত সাহিত্য কল্পনা দিয়ে হয় না। রূপকথার গল্প কল্পনা দিয়ে হয়। প্রকৃত সাহিত্য কল্পনানির্ভর নয়। মাটিটা লাগবে। ওই যে, কায়েস বলে গিয়েছিল, জীবনকে দেখতে জানা জানতে হবে। এটা সে পরে আমাকে স্পষ্ট করে বলেছিল। ওই দেখাটা, তাকায়া দেখলে হবে না, অনুভব করতে হবে।

রুদ্র: গল্প লেখার তাড়না, অনুপ্রেরণা কোথায় পান?

বুলবুল: আমি যে কয়টা গল্প লিখেছি, সব কয়টা গল্পই বাস্তব দেখাটা আছে। কিন্তু দেখাটাই সর্বস্ব নয়, কিছু কল্পনা ও রস আসলে যোগ করতে হয়। এই দেখাগুলোই আসলে জীবনের কাজে লেগে গেছে। ধরো, আমি একটা শেষ বই লিখেছিলাম যে এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে। কৌতূহল, লোক দেখা থেকেই। এই ঘরে লক্ষ্মী থাকার গল্পটা আমাকে একজন বলেছিল যে, সে দৌলতদিয়া গিয়েছিল। সেখানে সে নিষিদ্ধ পল্লিতে ঢুকেছিল। একটা ঘরে গিয়া দেখে যে, লেখা—‘এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে। সে জিজ্ঞেস করে, এটার মানে কী? এটা লিখছ ক্যান? মেয়েটা কয় যে, লক্ষ্মীর দাম অনেক বেশি, এই জন্য লিখছি। মেয়েটা সুন্দরী। বিষয়টা হলো মূল জিনিস। বিষয় থাকলে লেখা তোমার লেখা সহজে হয়ে যায়।

যা হোক, ও বলার পর আমি ভাবলাম যে, ও যেহেতু এই ঘরে লক্ষ্মী থাকে লিখছে, নিজে তো লিখি, এটা তো একটা মারাত্মক নাম। উপন্যাস লেখা যায়, এখন লিখলেই উপন্যাস হয়ে যাবে না তো। পরে ভাবলাম যে, যেখানে দেখিবে ছাই, উড়াইয়া দেখো তাই, পাইলেও পাইতে পারো অমূল্য রতন...। কোথাও কোনো ইয়ে নাই, আমি [দৌলতদিয়া] যাই। কৌতূহলী হয়ে উঠলাম। এখনো আমি অনেক বেশি কৌতূহলী, এই বয়সেও আমি ভারি কৌতূহলী।

যাহোক, গেলাম, গিয়া ওর [লক্ষ্মী] সাথে কথাবার্তা কইলাম। হাজার দুয়েক টাকা দিয়ে কইলাম, তোমার জীবনের কাহিনি শুনব। শুনতে শুনতে একটা সময় টের পাইলাম যে, জীবনের কাহিনি বলতেনটি বিনোদিনীর আত্মজীবনীতে পড়েছিলাম; উনি লিখেছিলেন, কেউ কেউ বেশ্যা হয় স্বেচ্ছায়, কেউ কেউ পরিবেশের কারণে বাধ্য হয়ে বেশ্যাবৃত্তি অবলম্বন করে। ও দেখলাম যে, এ রকমনিজে স্বেচ্ছায় এসে গেছে। গল্পটা পাওয়া হলো না। পরে হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। পরে নামটা মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে।

সেকেন্ড টাইমে [দৌলতদিয়া যাওয়ার পর] হলো কি, আরেকটা মেয়ে আরকি, গান-টান গায়, বিউটি পার্লার করে, দেখা হয়ে গেল। পাবলিশার নিয়ে গেল, বেশ সখ্য হলো। হঠাৎ দেখি যে, তার হাতের মধ্যে একটা দাগ। মামা, মামা ডাকে তো? নামটা মনে নাই। বললাম, কী হইছে রে মামা তোর? কয়, জানো মামা, বিয়ের পরে না আমার জামাই আমারে মাইরা ফেলতে ধরছিল। আমার হাত-পা বাইন্ধা রগ কাটছিল। রগটা ঠিকমতো কাটা হয় নাই। পরে রগটা শুকায় গেছিল। আর মরি নাই। বাঁইচ্যা গেছি। পরে আমারে বিষ খাওয়াইয়া আত্মহত্যা করছি বলে হাসপাতালে নিছে। পরে আমি যখন বুঝতে পারছি, টের পাইছি, তখন ভাইগ্যা আসছি। এটা একটা [গল্প] হলো।

শেষ পর্যন্ত গেলাম নিজের গ্রামে। গ্রামে গিয়া একটা মেয়েকে দেখলাম, খুবই কিশোরী। আমার বন্ধুর মেয়ে। ওকে বিয়ে করে বর ফেলে চলে গেছে বিদেশে ৭-৮ বছর। ওখানে গিয়ে দেখলাম, শূন্যতা। এগুলো মিলেই, এই তিনটা বিষয় আমি বোধ হয় মিলিয়ে ফেললাম। তাতে একটা ইয়ে পেয়েছি যে, এটা একটা ভালো লেখা হতে পারে। ওইভাবেই আসল লেখাটা। ঘটনা থাকলে, মানে জিনিস থাকলে সেটা আসে, লেখা যায়।

সেকেন্ড টাইমে [দৌলতদিয়া যাওয়ার পর] হলো কি, আরেকটা মেয়ে আরকি, গান-টান গায়, বিউটি পার্লার করে, দেখা হয়ে গেল। পাবলিশার নিয়ে গেল, বেশ সখ্য হলো। হঠাৎ দেখি যে, তার হাতের মধ্যে একটা দাগ। মামা, মামা ডাকে তো? নামটা মনে নাই। বললাম, কী হইছে রে মামা তোর? কয়, জানো মামা, বিয়ের পরে না আমার জামাই আমারে মাইরা ফেলতে ধরছিল। আমার হাত-পা বাইন্ধা রগ কাটছিল। রগটা ঠিকমতো কাটা হয় নাই। পরে রগটা শুকায় গেছিল। আর মরি নাই। বাঁইচ্যা গেছি। পরে আমারে বিষ খাওয়াইয়া আত্মহত্যা করছি বলে হাসপাতালে নিছে। পরে আমি যখন বুঝতে পারছি, টের পাইছি, তখন ভাইগ্যা আসছি। এটা একটা [গল্প] হলো।

রুদ্র: কাদের লেখা আপনার বেশি ভালো লাগে?

বুলবুল: আমি এখন পড়িই না বললে ধরা চলে। ধ্রুব আমাকে বলে, একটা লাইনও পড়ি না; আমার ওপর রেগে যায় এই কারণে। কুলাইতে পারি না। মনে হয় সময় নাই, সময় নাইএ রকম একটা ব্যাপার হয়ে গেছে। নিজের লেখাই পড়তে পারি না। এমনিতে ধরো, রাশিয়ান সাহিত্য আগে যেগুলো অনুবাদ বের হইত, সেগুলোর কোনোটাই বাদ নাই। কায়েসের দৌলতে বা রাস্তার ধারে কম দামে পাওয়া যাইত। পড়ে ফেলেছিলাম। এখন বাইরের, পৃথিবীর সাহিত্য সম্বন্ধে যদি বলো, এগুলো নিয়ে আমার কোনো ধারণা নাই বলা চলে। কোনো খোঁজখবর আমি রাখি না। ওই পত্রিকায় যা দেখি আরকি।

বাংলা সাহিত্যে দুটো লোকের লেখা আমাকে খুব প্রাণিত করে, একজন তারাশঙ্কর, আরেকজন হলেন মানিক বন্দোপাধ্যায়। মনে হয় যে, এরা বাইচ্যা থাকলে, আমি এখনো এদের পায়ের কাছে গিয়া বইসা থাকতাম, গুরু মানতাম। এদের লেখার চমৎকারিত্ব আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রাণিত করে। মনে হয়েছে, এ রকম লিখতে না পারলেও, এ রকম কিছু একটা ঘটেছে আমার জীবনে। অনেক মিলমিশ পাই নিজের সাথে।

রুদ্র: মানিক বা তারাশঙ্করের কোন লেখা পড়ে চমৎকৃত হয়েছেন? নিজের সাথে মিল পেয়েছেন, এ রকম?

বুলবুল: মানিক বা তারাশঙ্কর—এরা কী? এরা তো পাঠকের লেখক নন। এরা লেখকেরও লেখক। সেই অর্থে তারাশঙ্করের কবি পড়ে, শুধু পাঠক হিসেবে পড়েছি তা নয়, ওই যে কবি হতে গেলে যে তাগাদা লাগে, এইটাও নিজের মধ্যে উনি ইয়ে করেছেন। অথবা মানিকের পুতুলনাচের ইতিকথা’—‘শরীর শরীর, তোমার কি মন নেই...? এই লেখাগুলো এখনো আমাকে অনেক বেশি আন্দোলিত করে। মনে হয় যে, এইদিক দিয়েই আমার ঘোরাফেরা করা উচিত।

রুদ্র: আপনি তো বাংলা একাডেমিসহ আরও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। পুরস্কার নিয়ে আপনার বক্তব্য কী?

বুলবুল: পুরস্কার বিষয়টা হইল, যেটা পাওয়া উচিত, সেটা পাইব। কিন্তু আমার নিজের বিষয়ে যদি বলি, আছে না যে, যোগ্য হয়ে গেছি বা পাওয়ার ইচ্ছা? যখন শেষ পাইলাম, তখন শামসুজ্জামান [শামসুজ্জামান খান] ফোন কইরা কইল যে, তুমি তো পেয়ে গেছ। আমি তো চমকাইলাম। আমার মনে হয় যে, যখন আমি পাইছি, এখন আমার যে পরিণতি, আরও পাকা হওয়ার পরে পুরস্কারটা দেওয়া উচিত ছিল। এ রকম মনে হয়। কেউ কেউ কয়, এ দেশে সাহিত্যের মাঠ খালি, বল মারলেই এ দেশে গোল। এ রকম বল মারার মতোই, গোল পেয়ে যাওয়ার মতো মনে হয়। তবে এখন হয়তো ওজনটা বেড়েছে, এটা হতে পারে।

রুদ্র: জীবনকে আপনি কীভাবে দেখেন?

বুলবুল: আমি নামৃত্যুচিন্তা আছে না মানুষের? আমি কিন্তু মৃত্যুচিন্তা করি না সাধারণভাবে। আর বারবার মনে হয় যে, পৃথিবীর সপ্তম আশ্চর্য আছে না? আমার কাছে মনে হয় যে, মানুষের বেঁচে থাকাটাই পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি আশ্চর্যের ঘটনা। অপরিসীম যদি শুধু সুখ থাকত, তাহলে একটা কথা ছিল। এই যে জীবনে এত কিছু ঘটে যাচ্ছে, আমার কোনো আজাইর নাই। মানুষের এটা-সেটা, নিন্দা, যেন চক্কর খাচ্ছি।

মৃত্যুচিন্তা কাজ করে না। আমার মনে হয়, মৃত্যুচিন্তা নিয়ে আমি মোটেই ভাবি না। অসুখ হলেও ভাবি না। কিছু হলেও ভাবি না। এটা নিয়ে ভাবার আমার মনেই থাকে না। চলে যেতে হবে। মৃত্যুচিন্তা নিয়ে আমি এটা ভাবি যে, যখন শয্যাশায়ী হবো, তখন চেষ্টা করব যে, মরে যাচ্ছি, নিশ্বাস-প্রশ্বাস কী রকম হচ্ছেসেটা ভাবার। তখন মনে হয়, ভাব বুঝলে কী হইব? তখন আর আমার ক্ষমতা নাই যে, এটাকে নিবৃত্ত করে রাখার। এটার এখানেই ইস্তফা। আর এখন জীবনবোধ নিয়ে আর কী বলব? মানুষ নানা রকম কইরা বেড়াইতাছে। এর ভিতর দিয়া ঘুরে-বেড়িয়ে জাড়িতই হচ্ছি আরকি।

রুদ্র: আপনি তো প্রচুর আড্ডাবাজিও করছেন?

বুলবুল: জীবনে প্রচুর আড্ডাবাজি করছি। ধরাও খাইছি অনেক সময়। যেমন ধরো, মীর হাজীরবাগে আমার এক পরিচিত বন্ধু ছিল। তখন তার একটা মৎস্য প্রজেক্ট ছিল, বিশাল। এটা ৭৭ সালের দিকের ঘটনা। হলো কি, প্রচুর তাসের আড্ডা হতো। রেগুলারই তাস খেলা হতো। আড্ডার মধ্যে সারওয়ার ভাই [সাংবাদিক গোলাম সারওয়ার] আসতেন, শেখ আবদুর রহমান আসতেন, শেখ আবদুল হাকিম আসতেন। একবার এক আড্ডায় ঢুকলাম জলটুঙ্গির মধ্যে। সেখানে মুস্তাফা নামে একজন লোক ছিলেন, তিনিই মূল লোক। নৌকা থাকত, নৌকা ডেকে নৌকায় চড়ে পার হয়ে আমরা জলটুঙ্গি যেতাম। তিনটা ঘর, একটা তাসের আড্ডা দেওয়ার জন্য। সেখানে গিয়ে তাস খেলা খুব জমে গেল।

একবার হলো কি, একজন উকিল আমাদের পাশে বইসা থাকত, খুব বিরক্ত করত, নিজে খেলত না, খামোখাই বইসা থাকত। আমি একদিন রুষ্ট হইয়া ওকে দুই-চার কথা শুনায় দিলাম আর কি। মদ খাওয়া ছিল সবাই। আমি একটু উইঠ্যা ঘর হতে বাইর হইয়া বারান্দায় গেছি এক ফাঁকে। ও করল কী, রাগ ফেলাবার জন্য লাত্থি মেরে ফেলে দিল আমাকে পানিতে। পড়লাম পানিতে। চশমা পরে থাকি। সেদিন জিনসের প্যান্ট পরা, তখন একটু যুবক বয়স। জাল ফেলে পরে আমাকে উঠানো হইলো। পরে উইঠ্যা আমি কইলাম যে, মুস্তাফা, আমি যে আইছি, আমি আপনার কে হই? কয়, আপনে আমার বন্ধু হন। আমি বললাম, বন্ধু হয়া বন্ধুরে ডাইকা আইনা এভাবে অপমান করেন! যে উকিল, সে হইলো আপনার ভালো বন্ধু। এই শুইন্যা সে করল কী, উকিলরে একটা লাত্থি মারল। উকিল রেলিং ভাইংগ্যা গিয়া পড়ল। রাগারাগি কইরা চইল্যা গেল। আমার জিনসের প্যান্ট শুকাইল। ভাবলাম যে, আর ওই দিকে যাব না। তারপর একদিন শুনলাম যে, ওখানে একটা মার্ডার হয়েছে। একটা মেয়ে। মুস্তাফা মারে নাই। শুনছিলাম, যে নাকি নৌকা বাইত, সে নাকি এই কাজটা করছে। মনে মনে ভাবলাম, ধাক্কা খাইয়া ওখান থেকে ফিইরা আসছি ভালো হইছে, না হইলে ওখানে জড়াই যাইতাম। এ রকম ঘটনা ঘইটা যায়। পরে আমি জলটুঙ্গি নামে একটা উপন্যাস লিখেছিলাম, এই ঘটনাটা নিয়ে।

রুদ্র: বিচিত্র ঘটনা, আপনি আর কায়েস আহমেদ একবার দৌড় দিয়েছিলেন...

বুলবুল: কায়েস দৌড় দিয়েছিল। কায়েস খুব লাজুক প্রকৃতির ছিলেন। কথা বলতেন খুবই নম্রভাবে। কুঁজো হয়ে চলতেন। নম্র হয়ে কথা বলার জন্য বোধ হয় এ রকম কুঁজো হতেন। কায়েসকে নিয়ে, ওই সাহিত্যের আড্ডাই হতো। এর বাইরে কিছু ঘটেনি।

রুদ্র: আমি একটা খারাপ জিনিস জানতে চাই। কায়েস আহমেদ যেদিন মারা গেলেন, ওই দিনটা আপনার জন্য কেমন ছিল?

বুলবুল: আমি জানছি পরে। আমি তখন ছিলাম বাড়িতে। ফিরে এসে শুনেছি। আমি জানতাম যে, সে বিয়ে করেছে। দেখা হতো বাংলাবাজারে। খুবই স্তব্ধ দুপুর বলতে যা বোঝায়, তাই হয়ে ছিলাম। মনের মধ্যে বিষণ্ণতা। কায়েসের থেকে বেশি খারাপ লেগেছিল হাসানের জন্য। হাসানের সময়েও যাওয়া হয়নি। তখন আমি বেশির ভাগ সময় বাড়িতে কাটিয়েছি। কী হইব এইসব দিয়া! তোমার হইছে না কাম?

রুদ্র: আমার কাজ হয়ে গেছে...

বুলবুল: কও কী!