কবি শামসুর রাহমানের দুষ্প্রাপ্য সাক্ষাৎকার
শামসুর রাহমান
আধুনিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি শামসুর রাহমান। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ভাগে দুই বাংলায় তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব ও জনপ্রিয়তা প্রতিষ্ঠিত। জন্ম ঢাকায়, ১৯২৯ সালের ২৩ অক্টোবর। পুরোনো ঢাকার পোগোজ স্কুল থেকে ম্যাট্রিকুলেশন ১৯৪৫ সালে। ১৯৪৭ সালে ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে আই এ পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ে ভর্তি হন এবং তিন বছর নিয়মিত ক্লাসও করেছিলেন সেখানে। শেষ পর্যন্ত আর মূল পরীক্ষা দেননি। পাসকোর্সে বিএ পাশ করে তিনি ইংরেজি সাহিত্যে এম এ [প্রিলিমিনারি] পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করলেও শেষ পর্বের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেননি।
১৯৪৩ সালে তাঁর প্রথম কবিতা ‘উনিশ শ’ঊনপঞ্চাশ’ প্রকাশিত হয় নলিনীকিশোরগুহ সম্পাদিত সোনার বাংলা পত্রিকায়। তিনি স্বৈরশাসক আইয়ুব খানকে বিদ্রুপ করে ১৯৫৮ সালে সিকান্দার আবু জাফর সম্পাদিত সমকাল পত্রিকায় লেখেন ‘হাতির শুঁড়’ নামক কবিতা। ১৯৬৮ সালে আইয়ুব খান পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করলে কবি ক্ষুব্ধ হয়ে লেখেন ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। ১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি শহীদ আসাদের রক্তাক্ত শার্ট দিয়ে বানানো পতাকা দেখে মানসিকভাবে মারাত্মক আলোড়িত হন শামসুর রাহমান এবং তিনি লিখেন ‘আসাদের শার্ট’ কবিতাটি। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিবার নিয়ে চলে যান নরসিংদীর পাড়াতলী গ্রামে। এপ্রিলের প্রথম দিকে তিনি লেখেন যুদ্ধের ধ্বংসলীলায় আক্রান্ত ও বেদনামথিত কবিতা ‘স্বাধীনতা তুমি’ ও ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’। শামসুর রাহমান ১৯৮৭ সালে এরশাদের স্বৈরশাসনের প্রতিবাদে দৈনিক বাংলার প্রধান সম্পাদকের পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৮৭ থেকে পরবর্তী চার বছরের তিনি প্রথম বছরে ‘শৃঙ্খল মুক্তির কবিতা’, দ্বিতীয় বছরে ‘স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কবিতা’, তৃতীয় বছরে ‘সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে কবিতা’ এবং চতুর্থ বছরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কবিতা’ লেখেন । ১৯৯১ সালে এরশাদের পতনের পর লেখেন ‘গণতন্ত্রের পক্ষে কবিতা’। অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনমানুষের প্রতি অপরিসীম দরদ তাঁর চেতনায় প্রবাহিত ছিল।
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ৬৬ টি, প্রবন্ধগ্রন্থ ২টি, উপন্যাস ৪টি, অনুবাদ কবিতাগ্রন্থ ৩টি, অনুবাদ নাটকগ্রন্থ ৩টি। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে, রৌদ্র করোটিতে, বিধ্বস্ত নিলীমা, নিরালোকে দিব্যরথ, নিজ বাসভূমে, বন্দী শিবির থেকে, দুঃসময়ে মুখোমুখি, ফিরিয়ে নাও ঘাতক কাটা, আদিগন্ত নগ্ন পদধ্বনি, এক ধরনের অহংকার, আমি অনাহারী, শূন্যতায় তুমি শোকসভা, বাংলাদেশ স্বপ্ন দেখে, প্রতিদিন ঘরহীন ঘরে, প্রেমের কবিতা, ইকারুসের আকাশ, মাতাল ঋত্বিক, উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে প্রভৃতি। ২০০৬ সালের ১৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যু হয়।
শামসুর রাহমানের এই দুর্লভ সাক্ষাৎকারটি নিয়েছিলেন সাংবাদিক এবং শিক্ষাবিদ নূরজাহান মুরশিদ। সাক্ষাৎকারটি ছাপা হয়েছিল নূরজাহান মুরশিদ সম্পাদিত এদেশ পত্রিকায়।
ছবি © সাহাদাত পারভেজ
নূরজাহান মুরশিদ: কেমন করে জানলেন আপনি কবিতা লিখতে ‘আহুত’ এবং আপনাকে কবিতা লিখতেই হবে।
শামসুর রাহমান: ভালো বলেছেন এই ‘আহুত’ হবার ব্যাপারটা। কী করে যে হঠাৎ একদিন এক বেয়াড়া চুলকানি হলো বলতে পারব না। তারপর থেকেই কাগজে আঁচড় কাটতে লেগে গেলাম সেই চুলকানিকে তাবে রাখার জন্যে। আমাদের বাড়িতে কোনো কালেই শিল্প-সাহিত্যের হাওয়া বয়নি, যদিও চোঙঅলা গ্রামোফোনের চারদিকে জড়ো হয়ে পরিবারের অনেকেই নানা ধরনের গান শুনতেন। কাজী নজরুল ইসলামের গানের রেকর্ডের সংখ্যাই ছিল বেশি। আমাদের বাড়িতে তখন সাহিত্য নিয়ে কেউ কখনো আলোচনা করেছেন বলে মনে পড়ে না। অন্তত আমি শুনিনি। আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন আব্বার বন্ধু ছিলেন। ফর্সি টানার ফাঁকে ফাঁকে তাঁরা কী কী বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতেন, সে-সব জানার অধিকার আমার ছিল না। কারণ, আমরা ছোটরা মুরুব্বিদের আশেপাশে ঘেঁষতেই পারতাম না। তা ছাড়া আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্ন যে একজন লেখক, এই তথ্যটি আমার অজানা ছিল। আমি তখন আমার মানসের গুহাযুগে বসবাস করছি। সেখানে সাহিত্য ও সাহিত্যিক বিষয়ে আমি ষোলো আনা অচেতন ছিলাম। এ জন্যে আমাদের বাড়ির সাহিত্যছুট পরিবেশ অনেকাংশে দায়ী। এক মেঘলা দুপুরে আমার মন খুব খারাপ ছিল। কিছুই ভালো লাগছিল না, মন বসছিল না কোনো কিছুতে। সেই মনোভাব কমাবার তাগিদেই হাতে কলম তুলে নিয়েছিলাম, আবছা মনে পড়ে। তারপর থেকেই কিছু একটা লেখার জন্যে ছটফট করতাম, আমার ভেতরে কে যেন ভরাট, স্বপ্নিল কণ্ঠস্বরে আমাকে প্রায়শই জাগাতেন, ‘লেখো’।
আরেকটা কথা। আপনাদের ‘আহুত’ হবার সূত্র ধরেই বলছি। আসলেই ‘আহুত’ হয়েছি কিনা, কে জানে! আর ‘আহুত’ হলেই যে সামনে পাত পড়বে তা-ই বা কে বলে দেবে। তবে হ্যাঁ, যতদিন বেঁচে আছি লিখতে আমাকে হবেই।
নূরজাহান মুরশিদ: প্রায় সব কবিরই একটা শিক্ষানবিশি কাল থাকে, আপনার শিক্ষানবিশি সম্পর্কে কিছু বলবেন কি?
শামসুর রাহমান: কৈশোর পেরুনোর পর কবিতা পড়তে ভালো লাগত, মন কাড়ত শব্দশোভা। শব্দের বিভিন্ন বিন্যাসে আন্দোলিত হতাম। কিন্তু কোনো দিন কবিতা লিখব, ভাবিনি। বলা যায়, ১৯৪৮ সালের প্রান্তে এসে কবিতা লেখার তাগিদ অনুভব করি। কবিতা লেখার জন্যে আমার তেমন কোনো প্রস্তুতি ছিল না। লেখা শুরু করার পর বিভিন্ন কবির কবিতার বই পড়ার সুযোগ পেলাম। মনে পড়ে, আমি প্রথম যে কবিতার বই বৃন্দাবন ধর অ্যান্ড সন্স নামক বইয়ের দোকান থেকে কিনে আনি, সেটি মোহিতলাল মজুমদারের ‘বিস্মরণী’। তারপর হাতে আসে বুদ্ধদেব বসুর ‘বন্দীর বন্দনা’ এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের ‘প্রথমা’। ইতিমধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের ‘অগ্নিবীণা’ও কেনা হয়ে গিয়েছিল। জীবনানন্দ দাশের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে আরও পরে, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকীর সৌজন্যে। তাঁর কাছ থেকে ধার নিয়ে পড়েছিলাম ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, যে কাব্যগ্রন্থ আমাকে অভিভূত ও মোহগ্রস্ত করে ফেলেছিল। তখন আমার মনে হয়েছিল, হায় আমি যেমনটি লিখতে চাই, তিনি অনেক আগেই তা লিখে ফেলেছেন। কবুল করতে দ্বিধা নেই, কবি হিসেবে শিক্ষানবিশিকালে তিরিশের দশকের কবিদের নুন আমি খেয়েছি, তাই তাঁদের গুণকীর্তনে আমি কোনো দিন কার্পণ্য করিনি।
আধুনিকতা যেহেতু মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, তাই জীবনযাত্রার টানাপোড়েনে নিজস্ব তাগিদেই একটি সমাজ ও তার সাহিত্য আধুনিক হয়ে ওঠে। আধুনিকতা শিল্পের মতোই একটা হয়ে-ওঠা ব্যাপার। তবে সেজন্যে কিছু কাঠখড় পোড়াতেই হয়। আমি মনে করি, পাশ্চাত্যপ্রভাবের আওতায় না এসেও একদিন বাংলা কবিতা আধুনিক হয়ে উঠত তার নিজের প্রয়োজনে
নূরজাহান মুরশিদ: আপনার কবিতায় কোনো দেশি-বিদেশি কবিতার প্রভাব বিষয়ে আপনি সচেতন? কার কাছ থেকে কী শিখেছেন?
শামসুর রাহমান: দেশি-বিদেশি অনেক কবির কবিতা পড়ে আমি উপকৃত হয়েছি। তবে আমি বেশি শিখেছি জীবন নামক মহাবিদ্যালয় থেকে, যে-শিক্ষার কোনো তল নেই, অন্ত নেই। প্রতিটি মুহূর্তেই আমি শিখছি।
নূরজাহান মুরশিদ: আপনার কাছে কবিতা কীভাবে আসে—ধ্বনি চিত্র কথা চিন্তা অনুভূতি হিসেবে অথবা এদের কোনো সমবায়ে? প্রাথমিক তাগিদ থেকে কবিতার পূর্ণরূপে আপনি কেমন করে পৌঁছান?
শামসুর রাহমান: সৃজন-প্রক্রিয়ার মধ্যে একটা রহস্যময়তা আছে বলে আমার ধারণা। কখন যে কী করে একটা শিল্পকর্ম তৈরি হয়ে যায়, অনেক সময় স্বয়ং শিল্পীও ঠিকঠাক বলতে পারেন না।
আমার কাছে কখনো কখনো কবিতা এসে যায়, যেমন গাছের ডালে আসে পাতা। আবার এমনও হয়, কোনো কোনো কবিতা লেখার জন্যে প্রচুর শ্রম স্বীকার করি, একটি কবিতায় একটি কি দুটি পঙ্ক্তির জন্যে দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হয়; কিছু কিছু শব্দ বারবার কাটি, বদলাই, অনেক ওলট-পালটের পর হয়তো কাঙ্ক্ষিত শব্দটির দেখা মেলে। হয়তো অফিসে রওনা হওয়ার আগে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুল আঁচড়াচ্ছি কিংবা জুতোর ফিতে বাঁধছি, হঠাৎ একটা সুর জেগে উঠল মনের ভেতর, একটি কি দুটি শব্দের ঝিলিমিলি, জন্ম নিলো কবিতার একটি পঙ্ক্তি। এই সম্ভাব্য কবিতাটি কীভাবে এগোবে কিংবা শেষ হবে তখনো জানি না। আবার কোনো কোনো কবিতা একটি প্রতিমার মতোই পূর্ণ অবয়বে হাজির হয়ে যায়। কখনো কখনো চলতি পথে দেখা কোনো মুখ পার্কে কিংবা রেস্তোরাঁয় শোনা কথায় টুকরো কিংবা আনন্দঘন কোনো উপলব্ধি অথবা শোকার্ত মুহূর্ত আমাকে দিয়ে কবিতা লিখিয়ে নেয়। যৌথ অচেতনতাও অনেক কবিতার ধাত্রী। আমার ধারণা, কবিতা লেখার কাজ কবির মনের ভেতর প্রায় সব সময়েই চলতে থাকে। একটি বড় ছবি আঁকার আগে যেমন একজন চিত্রকর অনেক ছোট ছোট স্কেচ করেন অবিরাম, তেমনি একজন কবিও কাগজে অক্ষর সাজানোর আগে অনলসভাবে মানসপটে আঁচড় কাটতে থাকেন। তার অনেক কিছুই হয়তো বাদ পড়ে যায়, যেটুকু থাকে তা-ই পরে কোনো এক সময়ে কবিতা রূপে উঠে আসে মনের গহন থেকে। যেমন সমুদ্রের ফেনা থেকে আফ্রোদিতি।
নূরজাহান মুরশিদ: কবিতা লেখার জন্য পারিপার্শ্বিকতাকে কতখানি স্বীকার এবং কতখানি অস্বীকার করতে হয়েছে আপনাকে?
শামসুর রাহমান: সমর সেন তাঁর একটি কবিতায় বলেছেন, ‘জীবনের ছাপ চেতনাকে গড়ে।’ আমার পারিপার্শ্বিকতা আমার চেতনায় ছাপ ফেলবে, আমার কবিতাকে প্রভাবিত করবে, এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তা বলে পারিপার্শ্বিকতার সবকিছুকেই আমি মেনে নিই না। আমার সঙ্গে আমার সমাজ ও পারিপার্শ্বিকতার একটা বিরোধ আছে বলেই আমি লিখি। অর্থাৎ আমার পারিপার্শ্বিকতাকে স্বীকার এবং অস্বীকার করেই আমার কলম কাজ করে যায়।
নূরজাহান মুরশিদ: আপনার বিবেচনায় আধুনিকতার মূল উপাদানগুলো কী? বাংলা কাব্যের আধুনিকতা কতখানি ধার করা বা আরোপিত, আর কতখানি মন আর পরিস্থিতির ব্যাপার?
শামসুর রাহমান: আধুনিকতা ব্যাপারটা বেশ জটিল। এ নিয়ে একটা বড়সড় প্রবন্ধ লেখা যায়, কিন্তু সংক্ষেপে কিছু বলা মুশকিল। অনেকে আধুনিকতা ও সমকালীনতাকে সমার্থক মনে করেন। আসলে আধুনিকতা ও সমকালীনতার মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। এ জন্যেই রবীন্দ্রনাথ আধুনিকতাকে পাঁজির হিসেবের সঙ্গে মেলাতে রাজি হননি।
একজন আধুনিক কবি কখনো প্রথাসিদ্ধ কাব্যরচনায় উৎসাহী নন; তিনি পুরোনো আঙ্গিককে ভেঙেচুরে নতুন ফর্ম সৃষ্টি করেন। প্রতিষ্ঠিত বিষয়সমূহের প্রতাপ থেকে নিজের কাব্যপ্রয়াসকে সরিয়ে এনে নতুন বিষয়ের সন্ধান করেন। আবার এটাও দেখা যায় যে প্রেমের মতো একটি অতিপুরাতন বিষয় নিয়ে কবিতা লিখতে গিয়েও একজন আধুনিক কবি নতুন মাত্রা যুক্ত করেন। এখানে আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, জেরার্ড ম্যানলি হপকিন্সের বন্ধু কবি রবার্ট ব্রিজেস এবং প্রাচীনকালের লাতিন কবি কাতাল্লুস—দুজনই প্রেম সম্পর্কে কবিতা লিখেছেন। কাতাল্লুসকেই আধুনিক মনে হয় এবং রবার্ট ব্রিজেস তাঁর অনাধুনিকতাকেই প্রকট করে তোলেন। তাই, দেখা যাচ্ছে যে, আধুনিকতা কোনো বিশেষ কালে সীমাবদ্ধ নয়। এই যে কাতাল্লুসকে আধুনিক মনে হয়, তার কারণ সেই প্রাচীন কবির মেজাজেই রয়েছে আধুনিকতা। জীবনকে তিনি যে দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন, তাতেই এটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে তিনি আমাদের কালেরই লোক, যেমন মনে হয় শেক্সপিয়রকে। যে-কবিতা সমকালীনতাকে ধারণ করে কালোত্তীর্ণ হতে পারে, তাকেই আমরা আধুনিক কবিতা বলে শনাক্ত করব।
পাশ্চাত্য সাহিত্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতার ফলে বাংলা কবিতার আধুনিক চেহারা ফুটে উঠেছে সত্য, কিন্তু এই আধুনিকতার পুরোটাই ধার করা—এরকম মন্তব্যের প্রতি আমার সায় নেই। একজন কবি তাঁর নিজস্ব ফর্ম সৃষ্টির ব্যাপারে ভিনদেশি কবির ফর্ম থেকে তাঁর পক্ষে জরুরি উপাদান আহরণ করতে পারেন। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক কবি টি.এস. এলিয়ট তো সারা ইউরোপের কাব্য-সমুদ্র মন্থন করে, এমনকি প্রাচ্যের উপনিষদ ঘেঁটেও তাঁর কাব্যের উপকরণ সংগ্রহ করেছেন, অনুরণন সৃষ্টির জন্যে প্রাচীন কবির হুবহু পঙ্ক্তি ব্যবহার করেছেন তাঁর ‘পোড়ো জমি’ কাব্যে।
সত্যি কথা বলতে কি, আধুনিক বাংলা কবিতার যাঁরা স্থপতি তাঁরা অন্তর্তাগিদ থেকেই আধুনিক হয়ে উঠেছেন। জীবনধারার ছাপেই গড়ে উঠেছে তাঁদের আধুনিক চেতনা। দু’-দুটো বিশ্বযুদ্ধ মানুষের ধ্যানধারণায় বিরাট পরিবর্তন এনেছে। সেই পরিবর্তন শুধু ইউরোপেই সীমিত থাকেনি, ছড়িয়ে পড়েছে সারা বিশ্বে। পুরোনো মূল্যবোধের বিপর্যয়, বিচ্ছিন্নতাবোধ, অনিকেতচেতনা যা আধুনিক সাহিত্যের কুললক্ষণ, শুধু পাশ্চাত্যের লেখকদের স্পর্শ করেনি, ছুঁয়েছে প্রাচ্যের সাহিত্যিকদেরও। ফলে বলা যাবে না, আধুনিক বাংলা কবিতা শুধু ধার করেই তার পুঁজি বাড়িয়েছে।
একথা ঠিক যে পাশ্চাত্যের সমসাময়িক কবিরাই—আমরা যাঁদের বাংলা কাব্যে তিরিশের কবি বলে চিহ্নিত করি, তাঁদের সামনে আধুনিকতার দরজা খানিকটা খুলে দেন, তবে বাকি কাজটা তাঁরা নিজেরাই করেন।
নূরজাহান মুরশিদ: ইউরোপীয় প্রভাব এবং সূত্র ছাড়া আর কোনো উপায়ে কি বাংলা কাব্যে/সাহিত্যে আধুনিকতার বিকাশ হতে পারত? আপনি কী মনে করেন?
শামসুর রাহমান: সত্য, আধুনিক বাংলা কবিতায় পাশ্চাত্যপ্রভাব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বিহঙ্গী দৃষ্টিতে তাকালে দেখা যাবে মাইকেল মধুসূদন থেকে শুরু করে হাল আমলের বাংলা কবিতায় ইউরোপীয় কবিতার ছায়া বেশ গাঢ়। আধুনিকতা যেহেতু মেজাজ ও দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপার, তাই জীবনযাত্রার টানাপোড়েনে নিজস্ব তাগিদেই একটি সমাজ ও তার সাহিত্য আধুনিক হয়ে ওঠে। আধুনিকতা শিল্পের মতোই একটা হয়ে-ওঠা ব্যাপার। তবে সেজন্যে কিছু কাঠখড় পোড়াতেই হয়।
আমি মনে করি, পাশ্চাত্যপ্রভাবের আওতায় না এসেও একদিন বাংলা কবিতা আধুনিক হয়ে উঠত তার নিজের প্রয়োজনে।
বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন কবির অভিজ্ঞতার পরিধি প্রসারিত হবে, উপলব্ধি হবে গাঢ়তর অর্থাৎ তিনি পরিণত মানসের অধিকারী হবেন, জীবনের গভীরে যাত্রা করবেন। কিন্তু এটাও তো আমরা লক্ষ করি যে, বয়স বাড়লেও অনেকের মনের বয়স বাড়ে না। তাঁরা চিরনাবালক থেকে যান। আমি জীবনের যে-পর্যায়ে উপনীত হয়েছি, সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে নাবালক ভাবতে কেমন অস্বস্তি বোধ করি
নূরজাহান মুরশিদ: তিরিশি কবিদের অব্যবহিত প্রভাব এবং সাহিত্যে তাদের স্থায়ী মূল্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
শামসুর রাহমান: রবীন্দ্রনাথের পর তিরিশের কবিগোষ্ঠী বাংলা কাব্যে নতুন যুগের প্রবর্তন করেন। তাঁদের যৌথ প্রয়াসে বাংলা কবিতা সমৃদ্ধ হয়েছে। সুদূরপ্রসারী তাঁদের প্রভাব। তাঁদের পরবর্তী কবিদের ওপর তিরিশের পঞ্চ-প্রধানের প্রভাব ফলপ্রসূ হয়েছে। বাংলা কবিতার অগ্রসরণে তাঁদের অবদানের একটা স্থায়ী মূল্য রয়েছে। কালক্রমে তাঁদের প্রভাব ক্ষীয়মাণ হয়ে উঠবে সত্য, ইতিমধ্যেই তার কিছু লক্ষণ দেখা যাচ্ছে, কিন্তু তাঁদের ঐতিহাসিক ভূমিকা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
নূরজাহান মুরশিদ: আপনি একটি কবিতায় বলেছেন, রবীন্দ্রনাথের চাইতে আপনি তিরিশের কবিদের কাছে বেশি ঋণী। কিন্তু আপনার কি মনে হয় না রবীন্দ্রনাথের গভীরে আপনি এমন কিছু পেতেন, যাতে করে আপনি রবীন্দ্রনাথের পুরাতন দিগন্তে নতুন তারকা ফোটাতে পারতেন? এবং আপনার আধুনিকতা না হারিয়েই?
শামসুর রাহমান: আমি কখনো এ-কথা বলিনি যে আমি রবীন্দ্রনাথের চেয়ে তিরিশি কবিদের কাছে বেশি ঋণী। আমি বলেছি রবীন্দ্রনাথ নন, তিরিশের কবিসংঘই আমার মন কেড়েছেন। আমাদের বন্ধুবান্ধব আমাদের মন কাড়েন, কিন্তু তা হলেও এ-কথা বলা ন্যায়সঙ্গত হবে না যে আমি আমার পিতার চেয়ে তাঁদের কাছে বেশি ঋণী।
রবীন্দ্রনাথের বিশাল ব্যাপ্তি এবং মহিমা সম্পর্কে আমি সচেতন। বিরাটত্বের দিক থেকে তাঁর প্রতিভা শুধু নাগাধিরাজ হিমালয়ের সঙ্গেই তুলনীয়, এ-কথাও আমার অজানা নয়। তবে আমি নিজে রবীন্দ্রনাথের কেউ নই, আমি রাবীন্দ্রিক জগতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি না, বরং স্বস্তি পাই রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কবিদের সাহচর্য। রবীন্দ্রনাথের গভীরে আমি কিছু পাইনি, এ-কথা আপনারা ভাবলেন কী করে? কিন্তু রবীন্দ্রনাথের পথ আমার পথ নয়, এ-কথা আমরা কবিজীবনের গোড়াতেই উপলব্ধি করেছিলাম।
নূরজাহান মুরশিদ: স্পিনোজা কিয়ের্কেগার্ড গৌতম বুদ্ধ আপনাকে আকর্ষণ করে বলে মনে হয়। এ বিষয়ে একটু আলোকপাত করবেন কি?
শামসুর রাহমান: দর্শন আমাকে আকর্ষণ করে এবং সেই সূত্রেই আমার বিভিন্ন দার্শনিকের সঙ্গে কিছু পরিচয় ঘটেছে। ফলে তাঁদের কারও কারও প্রভাব আমার মানসগঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে বলে আমি মনে করি। যাঁরা মানুষের মনীষার বিকাশ ও অভিজ্ঞতার পরিধি প্রসারিত করার পক্ষে কাজ করেন, তাঁদের কাছে আমরা চিরঋণী।
ছবি © সাহাদাত পারভেজ
নূরজাহান মুরশিদ: আপনি একজন অতিপ্রজ কবি। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কি কবিতা নিয়ে আসে? কবিতার জন্য কতখানি প্রতীক্ষা, কবিতাকে মনের মধ্যে তৈরি হয়ে উঠবার জন্য কতখানি সময় প্রয়োজন বলে আপনি মনে করেন?
শামসুর রাহমান: জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই কাব্যপ্রসূ, এ-কথা বলি না। তবে আমি প্রায়শই কবিতা বিষয়ে চিন্তা করি; কবিতাই আমার জীবনের কেন্দ্রবিন্দু। কাব্যক্ষেত্রে আমার সাফল্য কতটুকু, তা নিয়ে মাথা ঘামাই না, তবে জীবনের একটা বড় অংশই যে কবিতাকে অর্পণ করেছি, এ-কথা আমি জোরের সঙ্গে বলব। আমি আগেই বলেছি, একেকটি কবিতা একেকভাবে রচিত হয়। কোনো কোনো কবিতা হাওয়া থেকে ঝরে পড়ে আমার ভেতরে, উড়ে আসে মেঘ কিংবা পাখির মতো। আবার কোনো কোনো কবিতার জন্যে অপেক্ষা করতে হয় দীর্ঘ সময়, হঠাৎ একদিন সেই কবিতা লেখার কাজটি শুরু হয়। কখনো কখনো এক দিনেই তিন-চারটি কবিতা লিখে ফেলি, আবার নিষ্ফলা সময় চলে বহুদিন, কোনো কোনো কবিতা লিখতে দু-তিন সপ্তাহ লেগে যায়।
নূরজাহান মুরশিদ: আপনার মতো প্রতিভাবান কবির কাছ থেকে কবিতা ছাড়াও কাব্যসাহিত্যের অন্য শাখাতেও আমরা আপনার পদধ্বনি শুনতে চাই। যেমন বলতে পারি, আপনি কাব্যনাট্য লিখলেন না কেন?
শামসুর রাহমান: আপনাদের প্রত্যাশাকে অকুণ্ঠ সম্মান জানাই। আমার তো অনেক কিছুই লিখতে ইচ্ছে করে। নানা জল্পনাকল্পনা চলে মনে ভেতর। কিন্তু ইচ্ছে করলেই সবকিছু লেখা যায় না, লেখা হয়ে ওঠে না।
আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধুরা জানেন যে, বহু বছর ধরে আমি শিরি-ফরহাদের কাহিনি অবলম্বনে একটি কাব্যনাটক লেখার বাসনা নিজের মধ্যে লালন করছি। কিন্তু মূলত আলসেমি সেই রচনার অন্তরায় হয়ে আছে। জানি না অদূর ভবিষ্যতে এই আলসেমি কাটিয়ে উঠতে পারব কি না।
নূরজাহান মুরশিদ: আপনার লেখা তিনটি উপন্যাস সম্পর্কে কিছু বলুন। আপনার উপন্যাস রচনায় হাত দেবার পেছনে কী ধরনের প্রেরণা কাজ করেছে?
শামসুর রাহমান: নিজের সম্পর্কে কিছু বলতে বরাবরই সংকোচ বোধ করি। বিশ্ববরেণ্য মনোবিজ্ঞানী কার্ল গুস্তাভ ইয়ুং বলেছেন, শিল্পী একটি ফর্ম সৃষ্টি করে খালাস, সেই ফর্ম নিয়ে কূটকচাল চালাবেন ব্যাখ্যাপরায়ণ ব্যক্তিবর্গ। অর্থাৎ সমালোচকদের ওপরই সেই দায়িত্ব বর্তায়। আমার বন্ধু এবং বাংলাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কথাশিল্পী রশীদ করীম আমার তিনটি ঔপন্যাসিকা বিষয়ে বলেছেন যে, ‘সেগুলো একেবারে ফেলনা নয়। ভালোই বলা যায়।’ তাঁর সাহিত্যিক মতামতের প্রতি আমি শ্রদ্ধাশীল।
সত্যি বলতে কি, আমি ঠিক কোমর বেঁধে উপন্যাস লিখতে বসিনি। আমি উপন্যাস লিখতে শুরু করার আগেই আমার কয়েকজন বন্ধু এবং শুভানুধ্যায়ী অকারণেই আমাকে উপন্যাস লিখতে প্ররোচিত করেছেন। আমার নিজের খামখেয়াল এবং প্ররোচনা—উভয়ের যোগসাজশেই তিনটি ঔপন্যাসিকা লিখে ফেলেছি।
নূরজাহান মুরশিদ: আমাদের কথাসাহিত্য সম্পর্কে আপনি কী মনে করেন? আমাদের কথাসাহিত্য কি অগ্রসর হয়েছে? নতুন কোনো দিগন্ত উন্মোচন করেছে? আমাদের কবিতা ও কথাসাহিত্যের তুলনামূলক বিচার করতে হলে আপনি কী বলবেন?
শামসুর রাহমান: আমার বিবেচনায় বাংলাদেশের কথাসাহিত্য বেশ সমৃদ্ধ। আমাদের কথাসাহিত্যের বিশিষ্ট স্থপতি হলেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, শওকত ওসমান, আবু রুশদ, রশীদ করীম, শহীদুল্লা কায়সার, সৈয়দ শামসুল হক, মাহমুদুল হক, হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস প্রমুখ। জীবনের জটিলতা ও মানুষের অন্তর্জগৎ বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ উপন্যাস লিখেছেন সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ এবং রশীদ করীম। এ দুজন অসামান্য প্রতিভাবান কথাশিল্পী এবং আরও অনেক প্রবীণ ও নবীন লেখকের প্রচেষ্টায় আমাদের কথাসাহিত্য অনেকখানি অগ্রসর হয়েছে বলে আমার বিশ্বাস। হাসান আজিজুল হক ও মাহমুদুল হক যদি সৃষ্টিধর্মী সাহিত্যের প্রতি অধিকতর নিষ্ঠাবান হতেন, তাহলে আমাদের কথাসাহিত্য আরও সমৃদ্ধ হতো।
উৎকর্ষের দিকে বিবেচনা করলে হয়তো কবিতার পাল্লাই ভারী হবে; তবে সচরাচর যেভাবে আমাদের কথাসাহিত্যের মূল্যায়ন হয়, তার প্রতি আমার কোনো সায় নেই। অর্থাৎ আমাদের কবিতার সিদ্ধির পাশে কথাসাহিত্যের সাফল্য দাঁড়াতে পারে না, এমন উক্তি আমার কাছে গ্রাহ্য নয়।
সত্তরের দশকে রাজপথের মিছিলে নেতৃত্ব দিচ্ছেন নূর জাহান মুরশিদ ।। ছবি © পারিবারিক এলবাম থেকে
নূরজাহান মুরশিদ: প্রতিভাধর কবির রচনায় তারুণ্য ও যৌবন একটি বিশেষ আকর্ষণ ও গুণ, কিন্তু সে সম্পদ বয়োবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে হারিয়ে যায়। পরিণত বয়সে কবির দৃষ্টি বা উপলব্ধিগত কোনো ক্ষতিপূরণ আছে কি? জীবনের একবারে মর্মস্থলে পৌঁছে কবি তখন আরও অর্থমান কোনো জিজ্ঞাসার জবাব উপড়ে আনতে পারেন কি? আপনার অভিজ্ঞতা বলুন।
শামসুর রাহমান: এটা সাধারণত আশা করা যায় যে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে একজন কবির অভিজ্ঞতার পরিধি প্রসারিত হবে, উপলব্ধি হবে গাঢ়তর অর্থাৎ তিনি পরিণত মানসের অধিকারী হবেন, জীবনের গভীরে যাত্রা করবেন। কিন্তু এটাও তো আমরা লক্ষ করি যে, বয়স বাড়লেও অনেকের মনের বয়স বাড়ে না। তাঁরা চিরনাবালক থেকে যান। আমি জীবনের যে-পর্যায়ে উপনীত হয়েছি, সেখানে দাঁড়িয়ে নিজেকে নাবালক ভাবতে কেমন অস্বস্তি বোধ করি। নিজের কথা বলা মুশকিল, তবু সবিনয় নিবেদন করি, আমি এখন জীবনের গভীরে প্রবেশের চেষ্টা করছি, নানান জটিল জিজ্ঞাসায় আন্দোলিত হচ্ছি। সে-সব জিজ্ঞাসার উত্তর মিলবে কি না জানি না, তবে আমার অন্বেষণে কোনো যতি পড়বে না, যত দিন মৃত্যু আমাকে উপড়ে না নিয়ে যায়।
নূরজাহান মুরশিদ: এ কথা কি বলা যায়, কবির নিজস্ব মেজাজের মধ্যেই তাঁর পরিণতি এবং বৈচিত্র্যের সীমা নির্ধারিত? কবির মেজাজ ও পরিবেশের বাইরে গেলে পদ্য বানানো সম্ভব—কাব্যসৃষ্টি সম্ভব নয়?
শামসুর রাহমান: এ ব্যাপারে আমি আপনাদের সঙ্গে একমত। একেকজন কবির কাব্যচরিত্র একেক রকম। সেই চরিত্রচ্যুত হলে পদ্য রচিত হতে পারে, কবিতা নৈব চ নৈব চ।
নূরজাহান মুরশিদ: বাংলাদেশের কবিতা সম্পর্কে কিছু বলুন। আমাদের কবিতা কি শিল্পগুণ এবং চেতনায় সাবালক? বাংলাদেশের কবিতা কোন অর্থে বিশিষ্টতা লাভ করেছে? সমাজের সঙ্গে কবির এবং কবিতার সম্পর্ক কী? কবির আসল কাজ কী?
শামসুর রাহমান: ইতিমধ্যে বাংলাদেশের কবিতার অনেক সুকৃতি জমা হয়েছে। আমার বিবেচনায় আমাদের দেশের কিছু কিছু কবিতা বর্তমান পৃথিবীর যে-কোনো দেশের শ্রেষ্ঠ কবিতার সমতুল্য। আমাদের কবিতা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে এবং সেই দাঁড়াবার ভঙ্গিটি নিঃসন্দেহে সুদৃঢ় এবং শিল্পিত।
পশ্চিমবঙ্গের কবিতার সঙ্গে আমাদের কবিতার বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য কী, এ নিয়ে বাগ্বিতণ্ডার অন্ত নেই। উভয় দেশের কাব্য-ঐতিহ্য একই; তবু বাংলাদেশের অবস্থান, নিসর্গ ও সংগ্রামী জনজীবন, ভাষা ব্যবহার এতদঞ্চলের সাহিত্যকে একটা আলাদা চেহারা দিয়েছে। আমরা ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি। এত অল্প সময়ের ব্যবধানে এ রকম তিনটি বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা সচরাচর কোনো দেশে ঘটে না। এই আন্দোলনত্রয় আমাদের সাহিত্যকে প্রভাবান্বিত করবে, এটা খুবই স্বাভাবিক। তা ছাড়া আমাদের জীবনের সিংহভাগ জুড়ে রয়েছে সামরিক শাসন। এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটিও আমাদের সাহিত্যে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে রেখাপাত করেছে। ফলে, পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য ও আমাদের সাহিত্যের মধ্যে একটা পার্থক্য সূচিত হয়েছে। আমাদের সাহিত্য ক্রমান্বয়ে হয়ে উঠেছে বিশিষ্ট। এক হিসেবে দেখতে গেলে মানুষের জন্যে কোকিলের গান এবং গোলাপের উন্মীলন প্রয়োজনীয় কিছু নয়। এ দুটো জিনিস না থাকলেও মানুষের জীবনযাত্রা চলত অব্যাহত গতিতে। কিন্তু খাদ্য কিংবা হাওয়া ছাড়া মানুষের পক্ষে জীবন রক্ষা অসম্ভব। কিন্তু অপ্রয়োজনীয় হলেও কোকিলের গান এবং গোলাপ সুন্দর। মানুষ কোকিলের গান শুনতে ভালোবাসে, পছন্দ করে ফুটন্ত গোলাপ। তবে সে জন্যে মানুষের পেটে ভাত পড়া চাই। বোধ হয় পৃথিবীর অধিকাংশ সুন্দর জিনিসই এক অর্থে অপ্রয়োজনীয়। এই অর্থে কবিতারও হয়তো তেমন প্রয়োজন নেই। তবে মানুষের নান্দনিক ক্ষুধা বলে একটা জিনিস আছে, যে-জন্যে সে বাঁশির সুরে সচকিত হয়, কবিতা শুনে আন্দোলিত হয়। মানুষ নিজেকে অতিক্রম করতে চায়, অন্য কিছু হতে চায়; তাই সে তৈজসপত্র এবং হাতিয়ারে নকশা আঁকে, জ্যোৎস্নারাতে বনে গিয়ে নাচে মেতে উঠতে চায়, গান বাঁধে আপন মনে, নৌকা বাইতে বাইতে গান গেয়ে ওঠে ভরাট গলায়, গুহার গায়ে জীবজন্তুর ছবি আঁকে, কবিতা উৎকীর্ণ করে পাথরে।
কবিও যেহেতু সমাজেরই বাসিন্দা, তাই সমাজকে বাদ দিয়ে সে চলতে পারে না। যে সমাজে সে বসবাস করে, তার ঘাত-প্রতিঘাত কবির মনে রেখাপাত করে—কখনো পরোক্ষ কখনো প্রত্যক্ষভাবে। আমি আমার চারপাশে যে জীবনপ্রবাহ লক্ষ করি, তাকে উপেক্ষা করব কী করে? তাই একধরনের দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে কবির মানসে। আমি মনে করি, কবি মূলত কবিতার কাছেই দায়বদ্ধ।
কবির প্রধান কাজ হলো ভাষাকে পরিশুদ্ধ করা, ভাষাকে অশ্লীলতার মালিন্য থেকে রক্ষা করা। কিন্তু কবির দায়িত্ব শুধু এ কাজেই সীমিত নয়। তিনি নিজস্ব অভিজ্ঞতাকে পাঠকের মনে সঞ্চারিত করেন, সম্প্রসারিত করেন অনুভবের পরিমণ্ডলকে। ফিলিপ লার্কিনের মতো আমিও মনে করি যে, যে-সব জিনিস দেখেন, অনুভব করেন, সেগুলো সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে কবি কবিতা লেখেন। নিজস্ব অভিজ্ঞতার প্রতিই তাঁর প্রাথমিক দায়িত্ব। এই অভিজ্ঞতাকে বিস্মরণের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টাই করেন একজন কবি।
কবি শুধু বায়ুভুক গগনবিহারী কোনো প্রাণী নন; তাঁর মাথা নক্ষত্রপুঞ্জকে স্পর্শ করলেও পা মাধ্যাকর্ষণের গুণে মাটিতেই থাকে। তাই আশপাশের অনেক কিছুর ওপর তাঁর নজর পড়ে, পারিপার্শ্বিকের নানামাত্রিক বিষয়আশয় তাঁকে ভাবায়। সঙ্গত কারণেই এই ভাবনা ছায়া ফেলে তাঁর কবিতায়।
কিন্তু তা বলে আমি এ-কথা মানতে নারাজ যে, কবিতা বিক্ষুব্ধ পৃথিবীকে বাঁচাবে কিংবা তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধকে, খোদা না খাস্তা যদি সেই ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে, ঠেকিয়ে রাখতে পারবে। অবশ্য একটি সৎ কবিতা পড়লে সংবেদনশীল পাঠকের চিত্তশুদ্ধি ঘটে, তিনি অন্য এক মানুষে রূপান্তরিত হন। তবে সমরনায়কেরা একটি কাব্যসংকলন হাতে নিয়ে কিংবা সেটি আদ্যোপান্ত পড়ে মেডেলঝলসিত টিউনিক ছেড়েছুড়ে গেরুয়া বসন অঙ্গে ধরে বাউল বনে যাবেন, এমন বিশ্বাস আমার নেই। এতে যদি কেউ মনে করেন, সিগনিফিক্যান্ট ফর্ম হিসেবে কবিতার মূল্য কমে গেল, তাহলে ভুল করবেন। কবিতা তার নিজের জন্যেই মূল্যবান।
কবিতা বিক্ষুব্ধ পৃথিবীকে বাঁচাতে পারুক আর না-ই পারুক, কবিতা নিজে বেঁচে থাকবে, ক্ষীণায়ু কবি কীটস সাক্ষী, এ আমার দৃঢ় বিশ্বাস। অন্তত যত দিন না মানবজাতি পৃথিবী নামক গ্রহ থেকে বিলুপ্ত হয়ে যায়, তত দিন কবিতার মৃত্যু নেই।
নূরজাহান মুরশিদ: কবি হিসেবে আপনার পরিবার, রাষ্ট্র ও সমাজের কাছ থেকে কী চেয়েছেন?
শামসুর রাহমান: না, তেমন কিছু চেয়েছি বলে মনে পড়ে না। কিছু সহনশীলতা, কিছু প্রীতি চেয়েছি। ব্যস, এই পর্যন্ত।
নূরজাহান মুরশিদ: জীবনের কাছে একজন সভ্য মানুষের প্রত্যাশা কী?
শামসুর রাহমান: একজন মানুষ যাতে জীবনশিল্পী হয়ে উঠতে পারে, জীবনের কাছে একজন সভ্য মানুষের মূলত এটাই প্রত্যাশা।
নূরজাহান মুরশিদ: জীবন থেকে কী—কিংবা কী কী হারিয়ে গেলে—বেঁচে থাকার আর কোনো মানে হয় না?
শামসুর রাহমান: জীবন থেকে যদি প্রেম, শিল্প-সম্ভোগের ক্ষমতা ও কবিতা রচনার শক্তি লুপ্ত হয়, তাহলে অন্তত আমার বেঁচে থাকা অর্থহীন।
নূরজাহান মুরশিদ: কবি হিসেবে নারী আপনাকে কী দিয়েছে? বাঙালি নারীর কোন রূপটি আপনার সবচেয়ে ভালো লাগে?
শামসুর রাহমান: আমার জীবনে, কবি হিসেবে কিংবা সাধারণ মানুষ হিসেবে, যা-ই বলুন না কেন, নারীর অবদান অপরিসীম।
আমার জীবনে নারীর উজ্জ্বল উপস্থিতি না থাকলে আমার অনেক কবিতাই লেখা হতো না। তবে এখানে একটি পুরোনো কথা বলে নিতে চাই। আমি অনেক নারীকেই প্রত্যক্ষ করেছি, তারা আমার কবিতায় গাঢ় ছায়াপাত করেছে। তবে শেষ পর্যন্ত সেই ছায়াপাতের অবয়বের অনেকটাই আমার মনের সৃষ্টি। বাঙালি নারীর মধ্যে যে স্নিগ্ধ অথচ বুদ্ধিদীপ্ত রমণীয়তা লক্ষ করি, সেটাই আমাকে বেশি আকর্ষণ করে। যে-নারী অষ্টপ্রহর বিলাসে নিমজ্জিতা অনেকটা সিয়ামিজ বিড়ালের মতো, মোটেই কর্মিষ্ঠা নন, সেই নারীর আলস্যমদিরতা আমার মনে মোহ বিস্তার করতে পারে কয়েক ঘণ্টার জন্যে, তার বেশি নয়।
নূরজাহান মুরশিদ: সবশেষে, নারীর সমান অধিকারের প্রশ্নে কেউ কেউ পুরুষালি অহমিকার যুগে বসে পরিহাস করেন, আবার কেউ কেউ শজারুর কাঁটার রূপ ধারণ করেন। আপনার অবস্থান কী?
শামসুর রাহমান: আমাদের এই পুরুষশাসিত সমাজে অনেক বান্দাই নারীকে হয় পণ্য কিংবা আসবাবের শামিল মনে করেন। আমার মধ্যে কখনো এ ধরনের বর্বরতা প্রশ্রয় পায়নি। আমি নারীকে কখনো ভোগের সামগ্রী হিসেবে দেখিনি। প্রেমে, কর্মে, জীবনচর্চায় নারী পুরুষের সহচরী। কারও গুরুত্ব কারুর চেয়ে কম নয়। আমি নারীকে ব্যক্তিসত্তা (ইনডিভিজুয়াল) হিসেবে দেখি। এই সংসারে নারী পুরুষের কাঁধের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কল্যাণ ও প্রগতির পথে এগিয়ে যাবে, এই প্রত্যাশায় স্পন্দিত আমার জীবন। রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ কাব্যনাট্যে নায়িকা চিত্রাঙ্গদা নারীর অধিষ্ঠান সম্পর্কে নাটকের শেষে যে-কথা উচ্চারণ করেছে, আমিও তার প্রতিধ্বনি করি।
নূরজাহান মুরশিদ
সাহিত্যিক এবং শিক্ষাবিদ। জন্ম ১৯২৫ সালের ২২ মে তারানগর, অবিভক্ত ভারতের মুরশিদাবাদে। তিনি ভিক্টোরিয়া ইনস্টিটিউশন, কলকাতা থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। নূরজাহান অল ইন্ডিয়া রেডিও-তে ঘোষিকা হিসেবে কাজ করেছেন। তিনি ছিলেন ঐ প্রতিষ্ঠানে কাজ করা প্রথম মুসলিম মহিলা। দেশ ভাগের পর পাকিস্তান রেডিও-তে তার এই পেশা অব্যাহত থাকে। পরবর্তীতে তিনি বরিশালের সাইদুন্নেসা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের অধ্যক্ষ হন এবং ঢাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেন। নূরজাহান মুর্শিদ ১৯৫০-এর দশকের শুরুর দিকে রাজনীতিতে সংশ্লিষ্ট হন। ১৯৪৮ সালে খান সারোওয়ার মুর্শিদ-কে বিয়ে করেন। যুক্তফ্রন্টের মনোনয়ন নিয়ে তিনি ১৯৫৪-এর নির্বাচনে অংশ নেন। পূর্ব বাংলার আইন পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে আইন পরিষদ সচিব [পার্লামেন্টারি সেক্রেটারি] হিসেবে কাজ করেন।
মুর্শিদ ছিলেন ১৯৫৪ সালের পূর্ব বাংলার প্রাদেশিক সংসদ নির্বাচনে, যুক্তফ্রন্টের মনোনয়নে সরাসরি অংশ নিয়ে জয়ী হওয়া ২ জন নারীর একজন। তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে ভারতীয় বিধানসভার উভয় কক্ষের যৌথ অধিবেশনে ভাষণ দিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে ভারত সরকারের প্রতি আহবান জানান। ফলে তাঁর প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা তাকে নিরুদ্দেশ অবস্থাতেই ১৪ বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত করে। স্বাধীন বাংলাদেশে, ১৯৭২ সালে তিনি মুজিব সরকারের স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। তিনি ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে সাংসদ হিসেবে নির্বাচিত হন। ১৯৮৫ সালে তিনি একাল নামে একটি বাংলা সাময়িকী প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক হন। পরে এটির নাম বদলে রাখা হয় এদেশ একাল। তিনি বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রথম সভাপতি ছিলেন। অসংখ্য সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। ২০০৩ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন।