আমি ভারতীয় হবো ভেবে এমন কিছু করিনি
যোগেন চৌধুরী
উপমহাদেশের খ্যাতনামা চিত্রশিল্পী। জন্ম ১৯৩৯ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ফরিদপুর জেলার কোটালীপাড়ায় ডহরপাড়া গ্রামে। দেশভাগের পর ১৯৪৮ সালে পরিবারের সঙ্গে স্থায়ীভাবে তিনি ভারতে চলে যান। কলকাতার সরকারি কলেজ অব আর্টস অ্যান্ড ক্রাফটস থেকে চিত্রকলায় স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন ১৯৬০ সালে। ফরাসি সরকারের বৃত্তি পেয়ে ১৯৬৫ সালে প্যারিসে যান চিত্রকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। ১৯৬৮ সালে দেশে ফিরে এসে কয়েক বছর টেক্সটাইল ডিজাইনার হিসেবে কাজ করেন। পরে ১৯৭২ সালে দিল্লিতে রাষ্ট্রপতি ভবনে কিউরেটর হিসেবে নিযুক্ত হন। ১৯৮৭ সালে শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতীর কলাভবনে চিত্রকলা বিভাগে অধ্যাপক হিসেবে তিনি যোগদান করেন। বর্তমানে তিনি এ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রফেসর ইমেরিটাস হিসেবে যুক্ত আছেন। প্রত্যক্ষভাবে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করে দিল্লিতে রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন ২০১৪ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত। দেশ-বিদেশে এখন পর্যন্ত তাঁর একক প্রদর্শনী হয়েছে ত্রিশের অধিক। রেখাপ্রধান এবং যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে সৃষ্টি হয়েছে তাঁর প্রসারিত সৃজনজগৎ। ১৯৬৩ সালে শিল্পী যোগেন চৌধুরীর প্রথম একক প্রদর্শনী দেখে কথাসাহিত্যিক ও কলাবিশারদ কমলকুমার মুজমদার লিখেছেন, ‘তাঁহার ড্রইং-এ স্বতঃস্ফূর্ত কাব্য বর্তমান। মুখ্যত, তাঁহার শিল্পকর্মে মাধুর্য, ড্রইং-এর অব্যর্থ ব্যঞ্জনা এবং কোথায় ড্রইং-ভাঙ্গন—বিশেষভাবে লক্ষণীয়।...যোগেন চৌধুরী নিশ্চয়ই বিশ্বাস করেন চিত্র সংস্থান নয়। সংস্থান খণ্ড বাস্তবতা মাত্র।’ ২০১৬ সালে তিনি জয়নুল সম্মাননা লাভ করেন। বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আমন্ত্রণে ১৮তম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনীতে অতিথি হয়ে এসেছিলেন শিল্পী যোগেন চৌধুরী। বাংলাদেশ থেকে যাওয়ার আগে ২০১৮ সালের ২০ ডিসেম্বর এ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছেন আশফাকুর রহমান।
২০১৯ সালে নিজের রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনীতে শিল্পী যোগেন চৌধুরী আলোকচিত্র © সৌজন্যে: ইমামি আর্ট
আশফাকুর রহমান: ২০০০ সালের মার্চে দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত আপনার একটি লেখার শিরোনাম ছিল ‘যে আকাশে প্রান্তিক কিংবা দেশজ দিগন্ত নেই: আধুনিকতাকে আমি যেভাবে দেখি’। লেখাটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৮ বছর আগে। লেখাটির সূত্র ধরে আজকের আধুনিকতা, উত্তর আধুনিকতা এবং ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রেক্ষাপটকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
যোগেন চৌধুরী: আমার ধারণার খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আগে যেভাবে ভেবেছি, আমার ভাবনাটা এখনো একই রকম রয়েছে। লেখাটির মূল ভাবনা ছিল এ রকম, পশ্চিমে আমাদের শিল্পকলা বিষয়ে যথেষ্ট অজ্ঞ। এক প্রকাশনায় তারা রবীন্দ্রনাথের চিত্রকলা বিষয়ে মাত্র এক লাইনে উল্লেখ করেছে। যামিনী রায় নিয়েও দু-একটি লাইন ছিল বোধ হয়। অন্যদের কোনো নামই দেয়নি। অথচ তাদের দ্বিতীয় শ্রেণির শিল্পীদের নিয়ে ‘এনসাইক্লোপিডিয়া অব মডার্ন আর্ট’ বইয়ে প্রায় এক থেকে দেড় পৃষ্ঠা করে লেখা ছাপা হয়েছে।
আমরা মনে করি, বিদেশে যা ঘটে সেটাই উৎকৃষ্ট। এ রকম একটা ভাবনা আমাদের মধ্যে আছে। আমরা বিদেশে গিয়ে বিখ্যাত হতে চাই। আমাদের শিল্পীরা বাইরে গিয়েছে, প্রদর্শনী করেছে, পুরস্কার পেয়েছে—এটা আমাদের কাছে যেন বড় একটা ব্যাপার। আমার মনে হয় এই ভাবনাটা ভুল। আসলে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী যদি উল্লেখ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, তাহলে বিদেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনি কেন অপেক্ষা করবেন? আমার নিজের ভাবনাটা অনেকটা এ রকম। ঝাঁকি মাথায় করে বিদেশে যাচ্ছি, ছবি দেখাচ্ছি—এটা কোনো বড় ব্যাপার নয়। পুরো প্রক্রিয়াটি হবে সমান্তরাল। আমরা দেখাতে যেতে পারি। সেখানে তাদের কাছে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্যে যাব না। রবীন্দ্রনাথের ছবি যখন আমরা দেখাতে যাই—আমরা কিন্তু স্বীকৃতি পাওয়া কিংবা চেনাবার আশায় দেখাতে চাই না। আমরা বলতে চাই, তোমরা দেখো—আমরা কী করেছি।
আজ সকালে [২০ ডিসেম্বর ২০১৮] আড্ডায় এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। পোলিশ-আমেরিকান শিল্পসমালোচক মারেক বার্টেলিক [Marek Bartelik] বলছিলেন, এখানকার শিল্পকলা কী রকম সেটাই আমরা দেখতে চাই। বিশ্বের অন্য জায়গায় যা দেখেছি, তা-ই পুনরায় দেখছি এখানে। এখানকার শিল্পীরা সেগুলোই করার কথা বেশি ভাবছে। অর্থাৎ একই রকম জিনিস তারা করতে চেয়েছে। আমি তখন বলেছি, আমাদের শিল্পকলার একটি মৌলিক জায়গা থাকবে। সেটাকে আমি ঐতিহ্য বলছি না শুধু; কিংবা ঐতিহ্যকে ভিত্তি করে মৌলিক হওয়ার কথাও বলছি না। একজন মানুষ হিসেবে আমরাও চিন্তা করতে পারি। আমরাও সৃজনশীল। আমরাও নতুন কিছু ভাবতে পারি—সেই পর্যায়ে আমরা নতুনভাবে কী করলাম। অর্থাৎ আমরা মৌলিকভাবে এবং সৃজনশীলভাবে এখানকার পরিবেশ থেকে, এখানকার জীবনযাত্রার মধ্যে থেকে এখনকার পৃথিবীতে আমরা নতুন কী করছি। আমাদের নতুন মানে এই নয় যে, লন্ডন-প্যারিস-বার্লিন-নিউইর্য়কের শিল্পীদের কাজের মতো হচ্ছে কি না। এটা আমাদের মূল আগ্রহের বিষয় হতে পারে না। আমরা আমাদের নিজেদের জায়গায় দাঁড়িয়ে এমন কিছু করব, যা তাদের থেকে ভিন্ন হবে—আধুনিকও হবে।
আমাদের জীবন-যাপনের মধ্যে যেসব বিষয় আছে, মৌলিক কিছু উপাদানও আছে—আমাদের ভারতীয় জীবনের সংকট, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং আমাদের আলাদা রকমের চরিত্র—এসব বিষয়ই আমাদের ছবিতে আসবে। একজন ইউরোপীয় শিল্পী যা করল, সেটাই অবিকলভাবে অনুকরণ করলাম, তা কোনো কাজের কথা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী-তরুণ শিল্পী এমনভাবে কাজ করে। তারা আসলে ভুল করে...
আশফাকুর: শিল্প এখন নানা মাত্রায়, নানা মাধ্যমে প্রসারিত। এ রকম প্রেক্ষাপটে শিল্পকে আসলে কিসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হয়? কিংবা শিল্পের পরিচয় আমরা কীভাবে বিবেচনা করতে পারি?
যোগেন: স্বকীয় হওয়া। মৌলিক হওয়া। শিল্প ও শিল্পীকে সৃজনশীল হওয়া এবং নতুন কিছু করা। শিল্পী কখনো বাঁধাধরা দেখিয়ে দেওয়া রাস্তা ধরে যাবে না। সব সময় শিল্পী বেঁকে বসবে। আজকের আড্ডায় এসব নিয়ে কথা হচ্ছিল। মারেক বার্টেলিক বলছিলেন, এস এম সুলতানের কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আমিও তাঁকে বললাম, আমারও তাঁর কাজ খুব আসল মনে হয়। দক্ষতার করিতকর্মার বিষয়টি সব সময় নেই। কিন্তু তাঁর কাজ মনে থাকে অনেক বেশি। সুলতানের সব কাজের প্রদর্শনী হলে দেখা যাবে, তাঁর কাজ অন্য শিল্পীদের কাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা সারা পৃথিবীর কাছে দর্শনীয় বিষয় হবে। কিন্তু যারা অন্যের চিন্তা ও শৈলী নিয়ে এখন চর্চা করছে, তারা কিন্তু সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। তাই শিল্পের বিষয়ে মৌলিক ও সৃজনশীল শব্দ দুটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
শিল্পী যোগেন চৌধুরী © আলোকচিত্রী: রোহিত চাওলা
আশফাকুর: ২০১৬ সালে আপনার রেট্রোস্পেকটিভ প্রদর্শনী উপলক্ষে দ্য হিন্দু পত্রিকায় দেওয়া সাক্ষাৎকারে আপনি বলেছিলেন, ‘Master of Unbroken Lines is not a serious phrase. Art is more than just unbroken lines...
যোগেন: Unbroken Lines কোনো গর্বের বিষয় নয় বলে আমি মনে করি। এটা নিজের থেকেই হয়। কোনো রকম পেন্সিলে ড্রইং না করে কাগজে এক লাইনে আমি এঁকে দিতে পারি। কিন্তু এটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে আমার মনে হয় না। এই রেখা আসলে কী সৃষ্টি করল, সেটা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আশফাকুর: আসলে আপনার এই রেখায় আমরা শিল্পের অস্তিত্বকে কীভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি?
যোগেন: Unbroken Lines একটা করণকৌশল। কিন্তু আমি যা আঁকছি সেটা কখনো উল্লেখযোগ্য হতে পারে, কখনো সৃজনশীল হতে পারে। কখনো মৌলিক কোনো বিষয় আঁকতে পারি। তখনই সেটা গুরুত্বপূর্ণ।
আশফাকুর: কলকাতা আর্ট কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন ১৯৫৫ সালে। এর আগেই দেশভাগের কারণে বাধ্য হয়ে দেশত্যাগ করা। উত্তাল কলকাতা দেখা, দাঙ্গার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া, বামপন্থী রাজনীতিকে সমর্থন করা, সামাজিক আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে যাওয়া। এই সব মিলিয়ে আপনার জীবনযাপন কিন্তু ক্রমেই সবার থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। সেটা তো আপনার সৃজনযজ্ঞে ছাপ রেখেছে নিশ্চয়ই...
যোগেন: সেই পঞ্চাশ দশক থেকে আমরা যাওয়ার পর কলকাতায় ঐতিহাসিক কারণে নানা রকম ঘটনা ঘটেছে। এগুলোর মধ্যে যেমন রয়েছে বামপন্থী আন্দোলনের প্রসার, মার্কসিস্টদের নতুনতর একটা অবস্থান তৈরি হওয়া। যা আবার পূর্ব বাংলা থেকে যাওয়া লোকজন গিয়ে আরও শক্তিশালী করে তুলেছে। যারা শরণার্থী হয়ে গিয়েছিল, তাদের জীবনেও বিশাল চাপ পড়েছিল খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চাকরি, জীবিকা নির্বাহ—এ সবকিছুর কারণে। আমার মনে আছে, সেই সময়ে ঘরে ঘরে টিবি রোগ হতো। এ ছাড়া কলোনিগুলোতে নানা অসুবিধার মধ্যে থাকত মানুষজন। ব্যক্তিগতভাবে আমি শিল্পী হিসেবে বলি, আমি এসব নিয়ে বিষণ্নতায় ভুগেছি। তবে সেটা আমাকে পুরোপুরি গ্রাস করতে পারেনি। আমি কখনো অসুবিধার মধ্যে নিজেকে আত্মসমর্পণ করিনি। এটা যদিও আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু ওই অবস্থাটা আমার ছবিতে নানানভাবে এসেছে। আমার আগের ছবি এমনকি এখনকার ছবিতেও সেই স্মৃতি এবং সেই ধারাবাহিকভাবে বিষণ্ন থাকার ছাপ আছে। এমনকি এই সময়ে মানুষের জীবনে যে কষ্ট আছে, সেটা আমাকে বিচলিত করে—আমার চিন্তায় ব্যাঘাত ঘটায়। আমার মনে হয়, আমার জীবনে এই বিষয়টির কখনো সমাধান হয়নি।
আমরা মনে করি, বিদেশে যা ঘটে সেটাই উৎকৃষ্ট। এ রকম একটা ভাবনা আমাদের মধ্যে আছে। আমরা বিদেশে গিয়ে বিখ্যাত হতে চাই। আমাদের শিল্পীরা বাইরে গিয়েছে, প্রদর্শনী করেছে, পুরস্কার পেয়েছে—এটা আমাদের কাছে যেন বড় একটা ব্যাপার। আমার মনে হয় এই ভাবনাটা ভুল। আসলে যেকোনো জায়গায় দাঁড়িয়ে একজন শিল্পী যদি উল্লেখ করার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন, তাহলে বিদেশের কাছ থেকে স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য তিনি কেন অপেক্ষা করবেন?
আশফাকুর: আপনি যখন ছবি আঁকতে শুরু করলেন—আপনার সামনে আছে বেঙ্গল স্কুল। এ ছাড়া আছে পশ্চিমা শিল্পের অভিজ্ঞতা। উচ্চশিক্ষা সূত্রে ইউরোপীয় শিল্পের সঙ্গে যোগাযোগও বেড়েছে আপনার। এসব অভিজ্ঞতা কীভাবে আপনার সৃজনজগতে যুক্ত করলেন?
যোগেন: এটা দুটোভাবে করা হয়েছে। একটা হচ্ছে কোনোটা বাদ দিতে হবে। অনেকে সবটা গ্রহণ করার কথা বলে। আমি ভেবেছি কোনটা রাখব। কোনটা থেকে দেখার আছে, শেখার আছে আর কোনটা বাদ দেব। এটা আমি ছাত্রদেরও বলতাম, বাদ দেওয়াটা শিখতে হবে। আরেকটি হচ্ছে, অন্যরা যা করছে তার থেকে সরে গিয়ে আমাকে কিছু একটা করতে হবে। আমি যা দেখেছি, তার নির্যাসটা বোঝার চেষ্টা করছিলাম। একটা গুরুত্বপূর্ণ শিল্পকর্ম, ভালো শিল্পীদের কাজ—এসব দেখে বুঝেছি একটা ভালো শিল্পকর্ম কিংবা একজন ভালো শিল্পীর কাজে এ রকম অপরিহার্য গুণগুলো থাকতে হয়। বিষয়টি আমি বোঝার চেষ্টা করেছি।
শিরোনামাহীন [দম্পতি-১ নারী ও পুরুষ], সাইজ: ৬৮.৫ সে.মি ৯৮.৫ সে.মি., মাধ্যম: কাগজে কালি ও প্যাস্টেল ১৯৮৬ © যোগেন চৌধুরী
আশফাকুর: আপনার ছবিতে পরিণত মানুষের সম্পর্ক, অবদমন, ব্যর্থতা এবং রূঢ়তার মতো বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে ভারতীয় পৌরাণিক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। মানুষ নিয়ে আপনার এমন চিন্তার সূত্র সম্পর্কে জানতে চাই।
যোগেন: ভারতীয় ঐতিহ্যের কিছু কিছু বিষয় আমার ভালো লাগে। সেগুলো আমার ছবিতে নতুন করে আনার চেষ্টা করেছি। যেমন আমার ছবিতে আলংকারিক বিষয়টি আছে কোথাও কোথাও। সেটা আবার আগেকার মতো নয়—এটা আমার মতো। এ ছাড়া মানুষের সম্পর্ক আমি দেখি, উপভোগ করি, পর্যবেক্ষণও করি। সেই বিষয়গুলো আমি খুব নাটকীয়ভাবে ছবিতে আনার চেষ্টা করি। এ ছাড়া আমার ছবিতে ইন্দ্রিয়সুখ-সম্পর্কিত বিষয় এসেছে—যেটা জীবনেরই অংশ। আমি কিন্তু ভারতীয় ঐতিহ্য বা বেঙ্গল স্কুল, মিনিয়েচার পেইন্টিং বা অজন্তার মতো বা পুনরায় আঁকা একই ছবিকে আধুনিক ভারতীয়তা বলে মনে করি না। কিন্তু আমাদের জীবন-যাপনের মধ্যে যেসব বিষয় আছে, মৌলিক কিছু উপাদানও আছে—আমাদের ভারতীয় জীবনের সংকট, দারিদ্র্য, দুর্নীতি এবং আমাদের আলাদা রকমের চরিত্র—এসব বিষয়ই আমাদের ছবিতে আসবে। একজন ইউরোপীয় শিল্পী যা করল, সেটাই অবিকলভাবে অনুকরণ করলাম, তা কোনো কাজের কথা নয়। অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী-তরুণ শিল্পী এমনভাবে কাজ করে। তারা আসলে ভুল করে। এর মধ্য থেকে যারা বেরিয়ে আসে, তারা অন্য জায়গায় অর্থাৎ মৌলিক ও স্বকীয় একটা জায়গায় পৌঁছায়।
আশফাকুর: ঢাকায় ১৮তম এশীয় দ্বিবার্ষিক চারুকলা প্রদর্শনী উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বক্তৃতায় আপনি শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিষয়ে নতুন কাঠামোর কথা বলেছেন। আপনার প্রস্তাবিত কাঠামো বিশ্বের অন্যান্য স্থানের শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যায়...
যোগেন: হ্যাঁ, ঠিকই বলেছ। সেটার মধ্যে কোনো ভুল নেই। সেটা আমাদের দেশেও আগে ছিল। আমাদের শিল্পকে বিভাজন করার বিষয়টি সম্পর্কেই আমি বলেছি। এখন শিল্পকলা সৃষ্টির বিষয়টি অনেক খোলামেলা। তার পরিসর আরও বিস্তৃত। বিষয়টি অবশ্যই গ্রহণযোগ্য। এখন যেটা হচ্ছে সেটা আরও সচেতনভাবে করা হচ্ছে। আগে যেমন ছিল সঙ্গীত, নৃত্য, নাটক, দৃশ্যশিল্প, আবার ভাস্কর্য, ম্যুরাল, পেইন্টিং ইত্যাদি সবই ছিল। তখন এগুলোকে খুব আলাদা করে ভাবা হতো।
এখন যেটা হচ্ছে, শিল্পসৃষ্টির নানান রূপ ও প্রকাশভঙ্গিকে জ্ঞানের একাধিক শাখার সম্পর্কের সঙ্গে যুক্ত করে দেখা হচ্ছে। ধরা যাক, আজকাল যেমন একটা শিল্পকর্মের সঙ্গে বিশেষ ধরনের সঙ্গীত বা শব্দ, গন্ধ, আবহাওয়া জুড়ে দেওয়া হলো। আমাদের নাটক বা নৃত্যের সঙ্গে যেমন সঙ্গীতের সম্পর্ক আগে থেকেই ছিল। সুতরাং এটা একটি স্বাভাবিক ব্যাপার।
আমি মনে করি, সবকিছুর মধ্যেই সৌন্দর্য জড়িয়ে আছে। আমার নিজস্ব ভাবনাও একই রকম—গাছাপালা, ঘরবাড়ি, আসবাবপত্র, শব্দ, গন্ধ, আলোছায়া ইত্যাদি সবকিছুতেই জড়িয়ে আছে সৌন্দর্যের বিষয়টি। শিল্পে নানা মাত্রার আন্তঃসম্পর্ক আগেও ছিল, এখনো আছে। সচেতনভাবে বর্তমান সময়ে পশ্চিমের দেশগুলোতে শিল্পচর্চায় এসব আরও স্পষ্টভাবে প্রকাশিত।
পৃথিবীজুড়ে দেশে দেশে কত কিছু নতুনভাবে আবিষ্কৃত হচ্ছে, সেসবকে আমরা অস্বীকার করতে পারি না। সেটা যেখানেই বিজ্ঞানীরা আবিষ্কার করুক না কেন, তাকে আমরা এড়িয়েও যেতে পারি না। যদিও ইউরোপীয় জীবনযাত্রা থেকে আমাদের অবস্থান ও সংস্কৃতি অনেক ভিন্ন। সেই কারণে আমাদের শিল্পকলা সৃষ্টির পটভূমি শেষ পর্যন্ত আলাদাই হবে। তাই শিল্পশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাপদ্ধতির আন্তসম্পর্কীয় কাঠামোটা আমি গ্রহণ করার কথা বলেছি। এর ফলে যেটা হবে, সেটা অবশ্যই নতুন কিছু হবে। সৃজনশীলভাবে আমাদের অস্তিত্ব—আমাদের জীবনযাপন এবং মনোজগতের সম্মিলন সেখানে ঘটবে। এর মাধ্যমে ভিন্ন কোনো সৃজনশীলতা অবধারিতভাবে বেরিয়ে আসবে, যা অবশ্যই স্বকীয় এবং মৌলিক হয়ে উঠবে।
একাকী নারী, সাইজ: ১৯ সে.মি ১৮.৫০ সে.মি., মাধ্যম: কাগজে কলম, কালি এবং প্যাস্টেল ও পেন্সিল ,২০১৬ © সৌজন্যে: আর্ট এক্সপোজার
আশফাকুর: প্রায় ৬০ বছর ধরে আপনি ছবি আঁকছেন। নানাভাবে এগিয়েছে আপনার এই জগৎ। পেছনে ফিরে তাকালে আপনার এই শিল্পযাত্রায় কোন বিষয়টি মূল্যবান বলে মনে হয়?
যোগেন: আমার মনে হয়, আমি নানানভাবে শিল্পকলা বিষয়ে ব্যস্ত থেকেছি। একজন ইউরোপীয় শিল্পী যেভাবে শুধু ছবি এঁকেই জীবন কাটায়—আমার বা আমাদের পক্ষে সেটা সম্ভব হয়নি। আর্ট কলেজ থেকে পাস করার পর আমার সমস্ত জীবনটা চাকরি করার মধ্য দিয়ে গিয়েছে—প্রয়োজনও ছিল। সুতরাং এর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া করতে হয়েছে। কারণ, আমাদের এখানে তেমনভাবে ছবির কোনো বাজার ছিল না। মাত্র ১৫-২০ বছর হয়, একটা বাজার তৈরি হয়েছে। তাই চাকরি করে অর্থ উপার্জন করতে হয়েছে। পরিবার নিয়ে ভাবতে হয়েছে। সংগঠন-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও যুক্ত থেকেছি। কিছু লেখালেখিও করেছি।
মারেক বার্টেলিক বলছিলেন, এস এম সুলতানের কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হয়েছেন। আমিও তাঁকে বললাম, আমারও তাঁর কাজ খুব আসল মনে হয়। দক্ষতার করিতকর্মার বিষয়টি সব সময় নেই। কিন্তু তাঁর কাজ মনে থাকে অনেক বেশি। সুলতানের সব কাজের প্রদর্শনী হলে দেখা যাবে, তাঁর কাজ অন্য শিল্পীদের কাজ থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। সেটা সারা পৃথিবীর কাছে দর্শনীয় বিষয় হবে। কিন্তু যারা অন্যের চিন্তা ও শৈলী নিয়ে এখন চর্চা করছে, তারা কিন্তু সেই জায়গায় পৌঁছাতে পারবে না। তাই শিল্পের বিষয়ে মৌলিক ও সৃজনশীল শব্দ দুটি আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ...
আমি মনে করি, শিল্পকলা কোনো ব্যবসায়িক বা যান্ত্রিক কাজ নয়। আমি দরকার হলে করব—আবার না-ও করতে পারি। এর ভেতরেই কিছু কিছু কাজ করেছি। সেই দিক থেকে দেখলে ছবি আঁকার পুরো সময়টাই গুরুত্বপূর্ণ। এর মধ্যে কোন কোন পর্ব বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। দিল্লি এবং শান্তিনিকেতনের সময়ে আমি প্রচুর ছবি এঁকেছি। প্রস্তুতিপর্ব হিসেবে প্যারিস এবং পরবর্তী সময়ে মাদ্রাজে থাকার সময় নানা রকমভাবে শিল্প সৃষ্টির বিষয়ে বোঝাপড়া ঘটেছে।
একটা কথা বলি। আজকের কোনো তরুণ শিল্পীর মতো এই সময়ে আমি যদি ছবি আঁকতে শুরু করতাম, তাহলে আমিও হয়তো তাদের মতো ভিন্ন ভাবধারায় ছবি আঁকতাম।
আশফাকুর: আপনার আঁকা ছবি থেকে শুরু করে লেখালেখি, প্রতিষ্ঠান তৈরি, শিক্ষকতাসহ যাপিত জীবনে ভারতীয়বোধের চিহ্ন পাওয়া যায়। আপনার জগতের এ বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে আগেই বলেছেন। এটা আসলে কোন ধরনের ভারতীয়বোধ বলে আপনার মনে হয়?
যোগেন: আমি এটাকে ভারতীয়বোধ বলি না। অনেকে এটাকে ভুলভাবে বুঝতে পারেন। আমি ভারতীয় হবো ভেবে এমন কিছু করিনি। আমার সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অবস্থান ও আবহাওয়া, বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথ আমাকে আজীবন অনুপ্রাণিত করেছেন—এভাবে কাজের মধ্যে যুক্ত হতে।
আশফাকুর: বিশ্বায়ন ধারণার পরিপ্রেক্ষিতে আপনার এই ভারতীয়বোধকে কীভাবে বিবেচনা করবেন?
যোগেন: আমি যদি আমার মতো সঠিক কাজ করতে পারি, তাহলে সেটাই বিশ্বায়ন ধারণার অংশ হয়ে উঠবে। আমার গ্রামের তালগাছটাও সারা পৃথিবীর তালগাছগুলোর মধ্যে একটা। এখানকার গাছগুলোও তো পৃথিবীরই গাছ।
আশফাকুর: নিজের কাছ থেকে আর কী প্রত্যাশা করেন?
যোগেন: যতটা সময় আছে, এর মধ্যে শিল্পকলা চর্চার ক্ষেত্রে কিছু অর্থপূর্ণ কাজ যেন করতে পারি। এটাই এখন আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পচর্চা-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও আমি আন্তরিকভাবে জড়িত আছি। সামান্য যা কিছুই করেছি, তার সঙ্গে আর সামান্য কিছু যদি করতে পারি।
নিজের সীমাবদ্ধতার বিষয়টি আমি স্বীকার করি। মানুষ কত কিছুই করতে চায়—শেষ পর্যন্ত কতটুকুইবা করতে পারে! স্বামী বিবেকানন্দের মতো মানুষ, সুভাষচন্দ্র বসু কিংবা সুকান্ত ভট্টাচার্যের মতো মানুষ কত অল্প বয়সে দেহত্যাগ করেছেন। কিন্তু তাঁদের জীবনের এই অল্প সময়ে কত কিছুই না করে গিয়েছেন। আমরা ভাবি, তাঁরা আরও দীর্ঘদিন বেঁচে থাকলে আরও কত কিছুই না করতে পারতেন।
নোট: প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি © মোহাম্মদ আসাদ