ইংরেজের কলকাতায় ঢাকার নবাব

 

বাংলার রাজধানী হিসেবে ঢাকা অন্তত চারশ বছরের ইতিহাসের ধারক-বাহক। বিপরীতে শহর কলকাতার বয়স তিনশ'র মতো। যখন ঢাকাই মসলিন বিশ্বজয় করে ফেলেছে, তখন কলকাতা নিতান্তই কোনো গণ্ডগ্রাম। কিন্তু ভারতবর্ষে মোগলদের পতনে, আর ইংরেজদের উত্থানে কলকাতার জৌলুস ছড়িয়ে পড়ে পুরো উপমহাদেশে। শুধু ঢাকা নয়, দিল্লিকেও দখল করে নেয় সে। কেননা ইংরেজের যে ভারত- তারই রাজধানী শহর হয়ে ওঠে কলকাতা। এই নগর থেকেই বাংলার মানুষ ইউরোপীয় আধুনিকতার ছোঁয়া পায়। বিলেতি সেই সভ্যতা-ভব্যতা কী বাংলার হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, মুসলমান সবার দুয়ারে সমানে এসে করাঘাত করেছে? মোটেই তা নয়। মোগলরা মুসলিম শাসক, তাই তাদের হাত থেকে ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে গেলে হিন্দু সমাজ খুব একটা ব্যথিত হয়নি। তারা নয়া-শাসকদের সঙ্গে সহজেই মিশে যেতে পেরেছে সহযোগী হিসেবে। তাদের অগ্রগতির বিপরীতে নবতর শাসনে পিছিয়ে পড়ে বাংলার মুসলিম সমাজ। ফারসির বদলে ইংরেজির দাপ্তরিক দাপটের সঙ্গে সহজে অভ্যস্ত হতে পারেনি তারা। এই উপলব্ধির জায়গা তৈরি হতে হতে গঙ্গায়-পদ্মায় অনেক জল গড়িয়ে যায়। ততদিনে বুড়িগঙ্গার তীরে থিতু হয় একটি কাশ্মিরি বণিক পরিবার। পরে যারা ‘ঢাকার নবাব’ হিসেবে উপমহাদেশের ইতিহাসের বাঁকবদলে বড় ভূমিকা রাখে। এক্ষেত্রে সেই পরিবারের প্রধানতম ব্যক্তি হলেন নবাব সলিমুল্লাহ। বাঙালি মুসলমানের অগ্রগতি শুধু নয়, কলকাতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে ঢাকার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধারের লড়াইয়েও পাওয়া যায় তাকে সবার সামনে। নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময় বইখানিতে সেই বিবরণই তুলে ধরেছেন লেখক, গবেষক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ আবুল মকসুদ।

কবি, গবেষক, সাংবাদিক x সমাজকর্মী নানা পরিচয়ে আমরা পেয়েছি সৈয়দ আবুল মকসুদকে [২৩ অক্টোবর ১৯৪৬—২৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১]। তবে গবেষণাকর্মে তাঁর যে মৌলিকত্ব তথা চর্বিতচর্বণ না করে নতুন কিছু প্রকাশের ব্যাপার রয়েছে, তা অতুলনীয়। আড়াল ইতিহাসকে সামনে আনতে তিনি ভূ-ভারতের অনেক প্রান্তেই গিয়েছেন। আলোচ্য কেতাবের তথ্যসূত্রেও কিন্তু সেটা যথেষ্ট স্পষ্ট। কিন্তু ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহকে নিয়ে কেন লিখতে গেলেন সৈয়দ আবুল মকসুদ? মুখবন্ধে অবশ্য বলেছেন, তাঁর বাবার ইচ্ছে ছিল পুত্র যেন ঢাকার এই নবাবের জীবনী লেখে। সেটা একটা দিক। অন্যদিকে তাকালে আমরা দেখবো, এই কৃতি গবেষক ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য-ব্যক্তিত্ব নিয়ে বরাবরই আগ্রহী। বই লিখেছেন `বুদ্ধদেব বসুর ঢাকার জীবন’, `ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ও এর প্রথম উপাচার্য' এবং `সলিমুল্লাহ মুসলিম হল' বিষয়ে।

স্রোতের প্রবল তোড়ে পড়া মানুষ যেমন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে শেষ রক্ষার চেষ্টা করে, ঢাকার নবাব তেমনি শহর ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী করে হলেও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হলেন। প্রদেশের রাজধানী হিসেবে যে উন্নয়নকর্ম হাতে নেয়া হয়েছিল, অন্তত সেটুকু ধরে রাখারও চেষ্টা ছিল তাঁর। কিন্তু এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর তেমন কোনো সান্ত্বনা পুরস্কার পাননি নবাব সলিমুল্লাহ...

গবেষণা আসলে গোয়েন্দাগিরির মতোই সূত্র ধরে এগুতে থাকে। একটি সূত্র অন্যটির কাছে নিয়ে যায়, উন্মোচিত করে রহস্য। তাই হুট করে নয়, ধারাবাহিক গবেষণার ফসল হিসেবে সৃজিত হয়েছে নবাব সলিমুল্লাহ ও তাঁর সময়। এই বইয়ে যদি চোখ রাখি, আমরা দেখবো বাংলার ইতিহাসের মোচড় ফেরানো ঘটনা বঙ্গভঙ্গের সময়ের বড় এক মনীষী নবাব সলিমুল্লাহ। এই ভাগ যে তারই চিন্তার ফসল তা সহজেই আঁচ করা যায়। প্রথমত এর মাধ্যমে পূর্ববঙ্গের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়ন। যাদের বেশিরভাগই হিন্দু জমিদারদের মুসলিম প্রজা। দ্বিতীয়ত অস্তমিত মোগল রাজধানী ঢাকার তিলোত্তমা রূপ ফেরানো। কিন্তু কলকাতাকেন্দ্রিক জমিদার বাবুদের পাশাপাশি সেখানকার সুশীল সমাজ, রাজনীতিক—যাদের প্রায় সবাই ধর্মীয় পরিচয়ে হিন্দু, তাদের ঘোর বিরোধিতা থেকে সৃষ্ট সশস্ত্র আন্দোলন—এমন বিবিধ কারণে তিতিবিরক্ত ইংরেজ শাসক যখন ছয় বছরের মাথায় এসে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বিলোপ করে দিলো, তখন নবাব সলিমুল্লাহ যে কতটা আঘাত পেয়েছেন, সেই ইতিহাস যেনবা করুণ রসে বিশ্লেষণে করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ।

স্রোতের প্রবল তোড়ে পড়া মানুষ যেমন খড়কুটো পেলেও আঁকড়ে ধরে শেষ রক্ষার চেষ্টা করে, ঢাকার নবাব তেমনি শহর ঢাকাকে দ্বিতীয় রাজধানী করে হলেও মর্যাদা রক্ষায় সচেষ্ট হলেন। প্রদেশের রাজধানী হিসেবে যে উন্নয়নকর্ম হাতে নেয়া হয়েছিল, অন্তত সেটুকু ধরে রাখারও চেষ্টা ছিল তাঁর। কিন্তু এক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ছাড়া আর তেমন কোনো সান্ত্বনা পুরস্কার পাননি নবাব সলিমুল্লাহ। নইলে সেই ব্রিটিশ আমলেই কলকাতার পাশাপাশি ঢাকা শহরেও ট্রাম চলাচল করতো। কারণ রাজধানী হাতছাড়া হলেও ট্রাম চালুর উদ্যোগ এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন তিনি। ইতিহাসের বিচারে এর দায় বর্তায় কলকাতার বাবুদের কাঁধেই। সেই কথা লিখতে গিয়ে সৈয়দ আবুল মকসুদ দেখিয়েছেন, অবিভক্ত বাংলা ফিরে পেলেও কলকাতাপন্থীরা কীভাবে দিল্লির হাতে সঁপে দিলো সর্বভারতীয় রাজধানীর মর্যাদা। ঢাকাপন্থীরা পরাস্ত হয়েছে—এর বিনিময়ে শুধু বাংলার রাজধানীতেই যেনবা সুখি হলো সেদিনের ‘বিজয়ী’ বাঙালিরা। ভারতের রাজধানী কলকাতা থেকে দিল্লি গমনে তাই হয়নি তেমন কোনো প্রতিবাদ, হয়নি কোনো শোকসভা।

সৈয়দ আবুল মকসুদ। ছবি © ঢাকা অপেরা

তবে বঙ্গভঙ্গের উত্তাল সময়কে অনেকটা ইংরেজবান্ধব নবাব পরিবারের জনপ্রিয়তম মুখ সলিমুল্লাহর পক্ষে বা চোখেই যেনবা তুলে ধরেছেন লেখক। সেই অগ্নিযুগে সশস্ত্র আন্দোলনে গিয়ে যারা রক্তপাত করেছে, নয়তো আপন রক্ত দিয়েছে, সেই স্বদেশিদের ‘সন্ত্রাসবাদী’ হিসেবেই দেখিয়েছেন গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ। অবশ্য সেই হিংসাবাদীদের রবীন্দ্রনাথও ভালো চোখে দেখেননি, পছন্দ করেননি চরমপন্থা। একদা আন্দোলনের সমর্থনে ‘আমার সোনার বাংলা’ লেখার অবস্থান থেকে সরে এসেছিলেন কবিগুরু নিজেও। এ প্রসঙ্গে সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেছেন—‘নতুন প্রদেশ গঠনের প্রথম দিকে রবীন্দ্রনাথ রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে তার বিরুদ্ধে দুর্বার আন্দোলনে সমর্থনই শুধু দেননি, নিজে রাজপথে নেমেছেন। অবিস্মরণীয় দেশাত্মবোধক সঙ্গীত রচনা করেছেন এবং নিজে গেয়েছেন। সেসব সঙ্গীতের একটি বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত।’ আন্দোলনকারীরা জয়ী হলেও এর ফল শেষে এসে বাংলা বা বাঙালির জন্য ভালো হয়নি, তার যৌক্তিক বিবরণও অবশ্য বিশদে উঠে এসেছে সৈয়দ আবুল মকসুদের বইখানিতে।

তবে বঙ্গভঙ্গের ব্যাপারে কলকাতার সুশীল সমাজের সঙ্গে বিরোধ হলেও ঢাকার নবাব পরিবার যে সেখানেও যথেষ্ট মর্যাদার আসনে ছিল, তা নবাব সলিমুল্লাহ কলকাতায় চৌরঙ্গীর বাসভবনে মৃত্যুর পরও দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। তাঁর মৃত্যুতে বাংলার প্রধান দুই শহরেই নেমে আসে শোকের ছায়া। কলকাতায় জানাজা শেষে ঢাকায় যখন মরদেহ আনা হবে, সেই দৃশ্য এভাবে তুলে ধরেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ—‘ওয়েলসলি থেকে শিয়ালদা স্টেশন পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে হাজার হাজার মানুষ অশ্রুসিক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে নেতার প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা জানান। কেউ কেউ উচ্চস্বরে কেঁদে ওঠেন।’ শুধু গণমানুষ নয়, তাঁকে শেষ সম্মান দেয় ইংরেজ আমলা, হিন্দু জমিদার, মুসলিম মনীষী তথা সর্বস্তরের জনতা।

নবাবের মৃত্যুর বিশদ যেমন ঠাঁই পেয়েছে আলোচ্য বইয়ে, তেমনি ঢাকার নবাব পরিবারের গোড়াপত্তন, উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠার কার্যকারণ—আরো নানা বিষয় উঠে এসেছে। এই মুসলিম লীগের হাত ধরেই উপমহাদেশে মুসলমানদের আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা পায়। দলটির প্রতিষ্ঠাতা সলিমুল্লাহ শুধু পুর্ববঙ্গের মুসলমানদের ভাগ্যোন্নয়ন নিয়েই ভাবতেন, এ বিষয়টিও সামনে এনেছেন লেখক। তবে নবাবদের পরের প্রজন্মের বাংলাদেশবিরোধী অবস্থানের কারণে এদেশে সলিমুল্লাহও যে অবহেলার পাত্র হয়ে পড়েছেন, সেই আক্ষেপ করেছেন সৈয়দ আবুল মকসুদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ঢাকার উন্নয়নে তাঁর সব অবদানই বিস্মৃত হয়ে পড়ছে অনেক ইতিহাসবিদের বিমাতাসুলভ দৃষ্টির কারণে। সে আঁধার কাটিয়ে এই বই নতুন প্রজন্মের চোখে নতুন আলো ফেলতে পারে। সেই আশা নিয়েই সৈয়দ আবুল মকসুদ শেষ করেছেন এভাবে—‘তাঁর জীবনকালেই তাঁর বিরোধীরা তাঁদের ভুল উপলব্ধি করতে পারেন। ফলে শত অপপ্রচার সত্ত্বেও ইতিহাসে নবাব সলিমুল্লাহর আসন চিরস্থায়ী।’

লেখকের শেষকথার সঙ্গে দ্বিমতের সুযোগ কমই আছে। কিন্তু কাউকে নিয়ে ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে তার নায়কোচিত বিষয় তুলে ধরা এবং দুর্বল দিকে আলো না ফেলা—লেখক সেই খামতি এড়াতে পারেননি বইখানিতে। তাই ঢাকার নবাব সলিমুল্লাহর আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকার বিষয় এলেও তাঁর ভুলের কোনো দিক মেলেনি এখানে। আশা রাখি, সৈয়দ আবুল মকসুদের সেই শূন্যতা পূরণে এগিয়ে আসবেন নতুন দিনের কোনো গবেষক। অনেক গবেষণার ফসল বইটি সেই পথ মসৃণই করে রেখেছে।