সমকালে রবীন্দ্রনাথ: সম্পাদকের দায়
সাতচল্লিশ-পরবর্তী বাংলাদেশের সাহিত্যাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ সমকাল, আর সমকালের সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর। এবং একই সাথে নানা হিসেবের আলোচনায়: পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী ‘সাহিত্যের গতিপথের’ ইতিহাস বিবেচনায়ও গুরুত্বপূর্ণ সমকাল। বাঙালি জাতীয়তাবাদের এক জাগ্রত লণ্ঠন হিসেবে সমকাল প্রজ্বলিত থেকেছে বহু বছর, দেশের-ই প্রয়োজনে। জেনে রাখা জরুরি যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, আর বাঙালি জাতীয়তাবাদের তীব্র আন্দোলনের সবটুকুই ধারণ করেছিল সমকাল; আর সেই ধারণ-শকট সমমাত্রায় প্রবহমান ছিল সিকান্দার আবু জাফরের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়ই। একই সাথে সমকাল পত্রিকা লালন করেছে ধর্মনিরপেক্ষ প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা, অসাম্প্রদায়িক মনোভঙ্গি। এতে নানাবিধ বিষয়-বৈশিষ্ট্য একত্র হয়ে বিশেষ করে তুলেছিল সমকালকে।
সমকাল সমকালে যে ঝড় তুলেছিল, তার বিস্তৃত সাহিত্য-রাজ্য আজও বিশেষভাবে স্মরণীয় হয়ে আছে; বাংলা সাহিত্যাঙ্গনকে প্রভাবিত করেছে, এবং করছে। সমকাল কখনোই থামেনি; যতই বাধা পেয়েছে ততই সমকাল আরও গতিমান হয়েছে, দ্বিগুণ হারে এগিয়ে গেছে সিকান্দার আবু জাফরের হাত ধরে। এক দুর্বিষহ অবরোধের কালে সমকালের উদ্ভব ও বিকাশ। সমকাল তার নিজস্ব গতি ধরে রাখতে সমর্থ হয়েছিল সেই কালেও; থামেনি শত বাধা-বিপত্তিতেও। আইয়ুব খানের দুর্মর শোষণ, নিপীড়নের কালে সমকালকে বারবার সংকুচিত করার নানাবিধ প্রয়াস লক্ষণীয়। কিন্তু সেসব প্রকল্পকে সমানভাবেই প্রতিহত করেছে সমকাল; মূলত সমকালের সম্পাদক সিকান্দার আবু জাফর।
একধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই যেন এই কাজ করেছেন অনু হেসেন। খুবই দরকারি হবে এই বই, রবীন্দ্র-গবেষকসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন পাঠকের। যেহেতু সমকাল পত্রিকাই সহজপ্রাপ্য নয়; সেখান থেকে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা বের করে পড়া তো আরও কঠিন কাজ! সেই দুষ্প্রাপ্য এবং কঠিন কাজকে সহজ করে দিয়েছেন অনু হোসেন, নিয়ে এসেছেন এক ছাতার তলে
ষাটের দশকের প্রথম দিকে নানা রকম অবরোধ আসতে লাগল; অবরোধ রাজনৈতিক জগতে যেমন ছিল, তেমনি এই অবরোধ সাংস্কৃতিক জগতেও আবর্তিত হয়েছিল সমানভাবে। আইয়ুব খানের ভারতবিদ্বেষী মনোভাব শেষমেশ গিয়ে পৌঁছল বাংলা সাহিত্যজগতে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তো এর বাইরের নন, ফলে তিনিও আমূলে বাদ পড়লেন; ফেলা হলো। যেহেতু ভাষা আন্দোলনের ব্যাপারটা পরবর্তীকালে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মূল প্রণোদনা ছিল; তাই বাংলা ভাষা ও সাহিত্যকে হিন্দুয়ানি সাহিত্য বিবেচনায় এনে তা বাতিল করার একটা কূট প্রয়াস সে সময় আইয়ুব খান ও তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে দেখা গিয়েছিল। আর ভারত-পাকিস্তান বৈরিতার বাতাস তো জায়মান ছিলই। পশ্চিমবঙ্গের বই তো আসা নিষেধ; কোনো বই আসে না, আসতে দেওয়া হয় না। সব ধরনের গুরুত্বপূর্ণ বাংলা-সাহিত্য ‘হিন্দুয়ানি’ তকমায় বাতিল করে দেওয়া হলো। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাংলা বিভাগে পর্যন্ত পড়ানো নিষেধ করে দেওয়া হলো বাংলা সাহিত্যের গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যসমূহ! আর সবচেয়ে বড় আঘাতটা এল ‘রবীন্দ্র-চর্চা’ বন্ধ করে দিয়ে—ঠিক সেই সময়, যে সময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শততম জন্মদিন দোরগোড়ায়! চারদিকের অবস্থা বেগতিক: কোনো সভা-সেমিনার করা যাবে না, রবীন্দ্রবিষয়ক আলাপ-আলোচনা নিষিদ্ধ। তার মধ্যেই সমকাল বের করল ‘রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী’ সংখ্যা! ভীষণ সাহসী আর বিস্ময়কর ব্যাপারই বটে!
সমকালের এই সংখ্যা ছিল নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। আইয়ুব আমলে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপনই যেখানে অবরুদ্ধ, সেখানে এমন একটা সংখ্যা বের করা ছিল সেই সময়ের জন্য এক বিরাট ব্যাপার। এমনকি বাংলাদেশে, রবীন্দ্রচর্চার একটা শক্তপোক্ত ভিত নির্মাণ করে দিয়েছিল সমকাল। এই সংখ্যার পরও সমকালে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা ছাপা হয়েছে ধারাবাহিকভাবে। সেই অবরুদ্ধ সময়ে রবীন্দ্রচর্চা যখন একেবারেই গর্হিত অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, সে সময়ই সিকান্দার আবু জাফর এমন একটা সংখ্যা বের করে তাক লাগিয়ে দিলেন সবাইকে। যা ছিল নিবেদন হিসেবে বিশেষ, আর কালের হিসেবে তা খুব গুরুত্বপূর্ণ তো বটেই! আর এ যে স্পষ্টতই ছিল একটা বিদ্রোহ; আইয়ুবি শাসনের বিরুদ্ধে: তা আর বলার প্রয়োজন হয় না।
যেকোনো পত্রিকার সম্পাদকের জন্য চ্যালেঞ্জিং বিষয় লেখক আর লেখা নির্বাচন করা। ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিষ্ঠিত লেখক যেমন একটা পত্রিকার জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই নতুন লেখক দিয়ে লিখিয়ে নেওয়াটাও সম্পাদকের একটা কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। তাহলে সিকান্দার আবু জাফর কি এই কাজ ঠিকঠাক করতে পেরেছেন? হ্যাঁ, পেরেছেন; খুব ভালো করেই পেরেছেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্কে দিয়ে যেমন তিনি পত্রিকার জন্য লেখা লিখিয়ে নিয়েছেন; তেমনি করে খুবই কাঁচা, বয়স এবং লেখার অভিজ্ঞতার দিক দিয়ে, আবদুল মান্নান সৈয়দকে দিয়েও অসাধারণ প্রবন্ধ লিখিয়ে নিয়েছেন। লেখক নির্বাচনের এই ব্যাপারটা ‘রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী’ সংখ্যাতেও বর্তমান ছিল। আর এর জন্য অভিজ্ঞ ও সম্ভাবনাময় তরুণ—এই দুয়ে মিলে এক অসাধারণ সমকালের সৃষ্টি হতো।
সমকাল প্রকাশের পর থেকে শেষাবধি সমকালে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা ছাপা হয়েছিল মোট সাতাশটি। রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল মোট তেইশটি লেখা। এবং এর পরবর্তী বিভিন্ন সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল মোট চারটি। সেই সময় পূর্ব বাংলার গুরুত্বপূর্ণ এবং প্রতিভাবান প্রায় সবাই রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যাতে লিখেছিলেন। এবং এর পরবর্তী সংখ্যাতেও যাঁরা রবীন্দ্র বিষয়ে লিখেছিলেন, তাঁরাও প্রত্যেকে ছিলেন বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান লেখক; লেখক হিসেবে সব সময়ই গুরুত্বপূর্ণ।
রবীন্দ্র-জন্মশতবার্ষিকী সংখ্যায় লিখেছিলেন ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, আবুল ফজল, শওকত ওসমান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, এস এন কিউ জুলফিকার আলি, আবু রুশদ, হাসান হাফিজুর রহমান, সৈয়দ সাজ্জাদ হোসেন, জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, অশোক বড়ুয়া, মো. দেলওয়ার হোসেন খান, ডক্টর মুহম্মদ কুদরাত-এ-খুদা, এম এম মুরশেদ, আখতার হামিদ খান, সৈয়দ আলী আহসান, শামসুর রাহমান, বে-নজীর আহমদ, জিয়া হায়দার, সৈয়দ নুরুদ্দিন, ফখরুজ্জামান চৌধুরী, শ্রীঅরুণ কুমার তালুকদার, মির্জা হারুণ অর রশিদ প্রমুখ। এর পরবর্তী সংখ্যায় রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা লিখেছিলেন: হাসান হাফিজুর রহমান, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, সিকান্দার আবু জাফর ও আবদুল মান্নান সৈয়দ।
ওপরে সমকালে রবীন্দ্রচর্চা শীর্ষক যে ভূমিকা নির্মাণ করা গেল, তা সম্ভব হলো প্রয়াত প্রাবন্ধিক ও গবেষক অনু হোসেনের কল্যাণে। ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে অনু হোসেনের সম্পাদনায় একটা বই বের হয়। শিরোনাম: সমকালে রবীন্দ্রচর্চা। বইটি বের হয়েছে বাতিঘর প্রকাশন থেকে। এই বইয়ে কী আছে, তা ওপরেই আলোচিত হয়েছে। তবু আরেকটু বলা যাক: মূলত সমকাল প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে শেষ পর্যন্ত সমকাল পত্রিকায় রবীন্দ্রবিষয়ক যেসব লেখা ছাপা হয়েছিল, তারই একটা সম্পূর্ণ সংকলন তৈরি করেছেন অনু হোসেন। আমরা সব সময়ই অতীত ভুলে যাই। তাই সেই অতীতের স্বর্ণোজ্জ্বল সময়কে বর্তমানের কাছে তুলে ধরা একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ—তা রাজনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক যা-ই হোক না কেন। সমকাল আমাদের শিল্প-সাহিত্য জগতের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অতীত-স্তম্ভ। অতীতের বাংলা সাহিত্যে নানা রকম লেখার যেমন গুরুত্ব রয়েছে, তেমনি করে সমকালে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখারও গুরুত্ব সবিশেষ: আর্থসামজিক-রাজনৈতিক কারণ যেমন আছে, তেমনি আছে শিল্প-সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কারণও। ফলে এই সম্পাদনা ও সম্পাদিত গ্রন্থ বিশেষ হয়ে থাকবে, বহুদিন।
সম্পাদকের বেশ কিছু দায় রয়েছে। সেই দায় থেকেই যদি কোনো গ্রন্থ সম্পাদিত হয়, তবে সেটা হয়ে উঠবে সর্বোৎকৃষ্ট সম্পাদনা। সম্পাদকের উচিত এই দায় ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে পালন করা; যেগুলো সঠিকভাবে পালনের ফলেই একজন সম্পাদক যেমন বিশেষ হয়ে ওঠেন, তেমনি করে তাঁর সম্পাদিত গ্রন্থও বিশেষ হয়ে ওঠে।
কী বিষয় সম্পদনা করতে হবে, এবং কী সম্পাদনা করা উচিত নয়, তা না বুঝেই হরদম বই সম্পাদনা করা হচ্ছে আজকাল; করছে যে-সেই, যখন-তখন। এটা কেমন একটা বিচ্ছিরি অবস্থায় পৌঁছেছে! যেমন মাইকেল মধুসূদন দত্তের মেঘনাদবধের শ খানেক সংস্করণ বাংলাদেশেই খুঁজে পাওয়া যাবে! কিন্তু তার কি এতই দরকার ছিল? ছিল না। তবু হলো কেন? হলো ব্যবসা আর নাম-কাটার জন্য! কিন্তু এই কাজটা বুঝে-শুনে করা উচিত। এটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সম্পাদনা-কাজ ব্যবসার জন্য নয়। দরকারি সাহিত্যিক ও সামাজিক দায়বদ্ধতার দিক থেকেও।
অনু হোসেনের এই কাজটা এমনই। একধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই যেন এই কাজ করেছেন অনু হেসেন। খুবই দরকারি হবে এই বই, রবীন্দ্র-গবেষকসহ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাহিত্য বিষয়ে আগ্রহ আছে এমন পাঠকের। যেহেতু সমকাল পত্রিকাই সহজপ্রাপ্য নয়; সেখান থেকে রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা বের করে পড়া তো আরও কঠিন কাজ! সেই দুষ্প্রাপ্য এবং কঠিন কাজকে সহজ করে দিয়েছেন অনু হোসেন, নিয়ে এসেছেন এক ছাতার তলে। যদি অনু হোসেন আবার একটা মেঘনাদবধ সম্পাদনা করে একটা ‘ছ্যাঁচড়া’ প্রকাশনী থেকে বই বের করে ক-টাকা কামাতেন, তো সেটাকে সম্পাদনা বলতাম না, বলতাম ব্যবসা করেছেন অনু হোসেন। কিন্তু সম্পাদনার বিষয় হিসেবে সমকালের রবীন্দ্রবিষয়ক লেখা একত্রীকরণ এবং তা সম্পাদনা করায় এই সম্পাদনা কর্মই অনু হোসেনকে বাঁচিয়ে রাখবে বহুদিন, সম্পাদনার জগতে। কারণ, সম্পাদকের দায়িত্ব ও কর্তব্যের প্রাথমিক কর্মের বেলায়ও উতরে গেছেন অনু হোসেন; বিশেষ করে বিষয় নির্ধারণের বেলায়।
ভাষাজ্ঞান একজন সম্পাদকের প্রধান দক্ষতা এবং প্রধানতম সম্পাদকীয় শর্ত হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেটা অনু হোসেনের ছিল, খুব ভালো করেই ছিল। ব্যাপারটা অনু হোসেন বিশেষভাবে করে দেখিয়েছেন আবদুল মান্নান সৈয়দ রচনাবলি সম্পাদনায়: ভাষা-জ্ঞানের পরীক্ষা দিয়ে। নানা ধরনের গ্রন্থও সম্পাদনা করেছেন তিনি। খুব কাঁচা বয়সেই ভাষা-জ্ঞানের পরিচয় অনু হোসেন দিয়েছিলেন; নানাভাবে, লেখালেখির মধ্য দিয়ে। বাংলা একাডেমির তরুণ লেখক প্রকল্পেও তাঁর প্রবন্ধের বই প্রকাশিত হয়েছিল। কিন্তু সেই কাঁচা বয়সে প্রকাশিত গ্রন্থের ভাষা-জ্ঞান এবং অন্যান্য করণকৌশল ছিল এককথায় প্রাজ্ঞতায় ভরপুর।
মূল পাণ্ডুলিপি এবং সম্পাদিত বইয়ের পাণ্ডুলিপির সাথে সামঞ্জস্য রক্ষার একটা ব্যাপার সম্পাদনার বেলায় সব সময়ই রয়ে যায়; এবং তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই সামঞ্জস্য রক্ষা না করতে পারলে সম্পাদনাই ভেস্তে যেতে পারে। তা ছাড়া সম্পাদিত গ্রন্থের পাঠক যেমন ভুলে ভরা একটা সম্পাদিত গ্রন্থ পাঠ করবে, তেমনি করে যে গবেষক এই গ্রন্থ দেখে গবেষণা করবে, তার গবেষণাও ভুলে ভরা গবেষণা হতে বাধ্য হবে। মূল পাণ্ডুলিপির সাথে সম্পাদিত গ্রন্থের সামঞ্জস্যের ব্যাপারটা অনু হোসেন বেশ নিষ্ঠার সাথে করতে পেরেছেন। মূলানুগ-পাঠের ব্যাপারটা কঠোরভাবে মেনেই সম্পাদনা করেছেন অনু হোসেন; যা সম্পাদনার একটা বিশেষ কর্তব্যের মধ্যেও পড়ে। এবং এই কর্তব্য দায়িত্বের সাথে পালন করতে সমর্থ হয়েছেন অনু হোসেন।
বই সম্পাদনার বেলায় একটা ‘বিস্তারিত ভূমিকা’-এর ব্যাপার থাকে। যেখানে সম্পাদক লেখক এবং তাঁর লিখিত বইয়ের বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করেন। ফলে সম্পাদকের ওই গ্রন্থ-নিরীক্ষা-প্রক্রিয়া যেমন বোঝা যায়; তেমনি করে, একই সাথে, পাঠক ওই গ্রন্থ-পাঠ-পূর্বে ওই লেখকের, এবং ওই গ্রন্থ সম্পর্কে সাধারণ কিন্তু সামগ্রিক ধারণা লাভ করে। যা পাঠককে গ্রন্থ-পাঠ এবং গ্রন্থাকারের সম্পর্কে জানতে বিশেষভাবে সহায়ক হয়। যদিও সমকাল কোনো গ্রন্থ নয়, একটা সাহিত্যবিষয়ক পত্রিকা। এবং সেই পত্রিকায় লিখেছেন বহুজন। আবার রবীন্দ্রনাথ বিষয়ে লিখেছেন বিশেষ বিশেষ লেখকেরা। তারই সংকলন এই গ্রন্থ। ফলে এই গ্রন্থের ভূমিকা নির্মাণ একটা কঠিন বিষয় ছিল। কিন্তু অনু হোসেন, বিশেষ পরিকল্পনায়, বেশ দক্ষতার সাথে নিখুঁতভাবে তা করে ফেলেছেন। এবং একই সাথে সম্পাদক ও পত্রিকার সাথে দেশ-কাল-সময়ের ব্যাপারটাকেও নিয়ে এসেছেন। তৈরি করেছেন একটা জুতসই এবং প্রয়োজনীয় ভূমিকা। সম্পাদক এবং সম্পাদকের পত্রিকা সম্পাদনার সময়ও যে একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তা বিবেচনায় এনে ভূমিকার বিষয়টা সংযুক্ত করেছেন।
‘জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচ’ ভালো সম্পাদনার জন্য জরুরি বিষয়। এ কারণেই অনেক সাংবাদিকের গ্রন্থ-সম্পাদনা অনেক বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রিপ্রাপ্ত লোকজনের গ্রন্থ-সম্পাদনার চেয়ে ভালো হয়; ভালো হয় মূলত জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচ-এর জন্যই। জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচ-এর অভিজ্ঞতা অনু হোসেনের রয়েছে; সংবাদপত্রে কাজ করার সুবাদে। ফলে জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচ-এর বিষয়টা অনু হোসেনের এই সম্পাদিত গ্রন্থে পরিলক্ষিত হয়; এবং তা এই গ্রন্থের ভূমিকা নির্মাণে বিশেষভাবে কার্যকর থেকেছে। ভূমিকা নির্মাণের ক্ষেত্রে যে বিশেষ কৌশল গ্রহণ করেছেন অনু হোসেন; তা মূলত জার্নালিস্টিক অ্যাপ্রোচ-এর কথাই স্মরণ করিয়ে দেবে যে কাউকে।
সম্পাদক সম্পাদিত গ্রন্থের ওপর একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু অর্থপূর্ণ লেখা লিখবেন; এটা সম্পাদনার জন্য বিশেষভাবে জরুরি বিষয়। অনু হোসেন সেটা করেছেন; সমকালে রবীন্দ্রনাথ শীর্ষক গ্রন্থের ভূমিকা প্রণয়নে। বিভিন্ন সময়ে সমকালে প্রকাশিত রবীন্দ্রবিষয়ক নানা প্রবন্ধের সারাংশ সম্পাদিত গ্রন্থের ভূমিকাংশে গ্রথিত হয়েছে। ফলে পাঠক, যারা একেবারেই কাঁচা, রবীন্দ্রবিষয়ক প্রবন্ধ-পাঠের বেলায়, তারা একটা নির্দিষ্ট ধারণা পাবে: প্রবন্ধমালা পাঠ করতে সুবিধা হয় পাঠকের। কারণ, যাঁরা লিখেছেন তাঁরা তো এত সোজাসাপ্টা কথা বলা লোক নন, কেউই! এ গ্রন্থের ভূমিকাংশে সংক্ষিপ্তসার বিশেষভাবে উপাদেয়, প্রাথমিকভাবে প্রবন্ধ-পাঠের প্রস্তুতি হিসেবে।
অনু হোসেন আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন; সম্পাদিত গ্রন্থে প্রবন্ধ সাজানোর বেলায়: বর্ষ-ক্রম ও সংখ্যা-ক্রম মেনেই প্রবন্ধ সাজিয়েছেন, সমকালে যেভাবে ধারাবাহিক প্রকাশিত হয়েছিল সেভাবে। এতে করে রবীন্দ্রচর্চার একটা কালানুক্রমিক ইতিহাস সহজেই নির্ণীত হয়েছে; সমকাল পত্রিকার। আর এই ব্যাপারটা রবীন্দ্রচর্চার ব্যাপারকে আরও বেশি গতিমান করেছে। একজন রবীন্দ্র-গবেষকের জন্যও রবীন্দ্র-গবেষণা সহজ হয়ে যাবে। কারণ, কালের বদলের সাথে সাথে বদলায় সাহিত্য-সমালোচনার রীতি ও পদ্ধতি। আর্থসামজিক-রাজনৈতিক অবস্থা এবং ব্যবস্থা নানাভাবে প্রবাহিত করে সাহিত্য-সমালোচনাকে।
তাই পরিশেষে বলতে হয়, অনু হোসেনের বেশকিছু কাজের মধ্যে এই কাজটাও গুরুত্বপূর্ণ; কারণ সম্পাদনার বিষয় নির্ধারণ ও যথাযথ মূল্যায়ণধর্মীতা লেখা উপস্থাপনের জন্য।