বোহেমিয়ান জাতকবির কণ্ঠস্বর
সময়ের বিষমন্থন করে নির্মলেন্দু গুণ ধীরে ধীরে কবি হয়েছেন। বেদনা এবং অস্তিত্বের মায়াময় জগৎ অবগাহন করতে করতে কবির প্রতিটি কবিতা চিন্তিত, অপূর্বকল্পিত এবং দহনজাত। কবি শুধু শব্দ, ধ্বনি, চিত্রকল্প কিংবা শব্দের প্রতীকী পরশে ঠারে-ঠোরে কবিতা লিখতে চাননি। চেয়েছেন সময়টা লিখতে; চেয়েছেন বহুশ্রুত পরিবেশ আর ফাঁপা অনুষঙ্গ থেকে মুক্তি পেতে। তাই তাঁর কবিতা মুখের ভাষার মতো তাজা এবং নির্মেদ। সব ভালো মানুষের মতো চুপ থেকে নিরাপদে বাসনার অবগাহনে মিশে যেতে পারলে নির্মলেন্দু গুণ কবি না হয়ে ইঞ্জিনিয়ার কিংবা ডাক্তার হতেন। কিন্তু তিনি কবি হয়েছেন। পলায়ন নয়, প্রকৃত কবি দেশ ও জাতির সংকটের শৈলপথ ভেঙে বিপর্যস্ত মানুষের সামনে মুক্তির পথ তুলে ধরেন। দেশ, সময় ও দেশের অন্তস্তলে বহমান ইতিহাসটাই লিখেছেন কবি। স্বদেশ ও স্বকালকে নাড়া দেওয়া এই সত্য ইতিহাস একজন কবির আত্মদহনের ক্ষিপ্র জগৎ। বাংলা কবিতার ইতিহাসে যেমন, তেমনি বাংলা সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে নির্মলেন্দু গুণের জীবন এখনো উজানিয়া। সমস্ত রীতিপদ্ধতি তুড়িতে উড়িয়ে তিনি যা উচিত তা-ই করেন, কবির পাঁচ দশকের সারস্বত আত্মার দিকে তাকিয়ে এ-কথাটা অকপটে বলে দেওয়া যায়।
আমার কণ্ঠস্বর কবি নির্মলেন্দু গুণের আত্মজীবনের লড়াই এবং সময় যাপনের অকপট স্বীকারোক্তি। জীবন পরিধি আর অভিজ্ঞতার পরিসর সবার এক রকম নিরীহ হয় না। আত্মজীবনী লেখার অকপট জ্ঞান ও দৃষ্টিও সবার থাকে না। বাংলা ভাষায় আত্মজীবনী লিখতে এসে অনেকেই আত্মাকে গোপনে রেখে নিজেকে মহিমান্বিত করে লোকরঞ্জনের গদ্য লিখতে থাকেন। কিন্তু ‘আমার কণ্ঠস্বর’ বইয়ে মনের গভীর থেকে নেমে আসা সময়ের সত্যধ্বনি। ১৯৬২ থেকে ১৯৭০ এই সময়টাকে আমরা যারা দেখেছি কিংবা যারা দেখেনি—প্রত্যেকেই গুণের যাপিত জীবনের অক্ষরমালা থেকে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বহুবিচিত্র জানালায় প্রবেশ করতে পারি। খুব সন্তর্পণে অনুধাবনের চোখ নিয়ে এই গ্রন্থে প্রবেশ করলে দেখা যাবে কীভাবে একজন মেধাবী ছাত্র দেশমাতৃকার জন্মলগ্নে ‘অমৃত অক্ষর’ নিয়ে হাজির হয়েছেন। আমার কণ্ঠস্বর মূলত বাংলাদেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি পাঠের সাঁকো। এই গ্রন্থ সম্পর্কে সুরজিৎ দাশগুপ্ত লিখেছেন—
সব মিলিয়ে আমার কণ্ঠস্বর যুগ ও দেশের সম্বন্ধে এক মূল্যবান মানবিক দলিলপাঠের অভিজ্ঞতার অতিরিক্ত কিছু দেয়— ওই ‘কিছু’টা হলো মানব-মনের গহন জটিল রহস্যময় অরণ্যে প্রবেশের ও পর্যটনের রোমাঞ্চ। আমার কণ্ঠস্বর আত্মস্মৃতিমূলক বাংলা সাহিত্যে এক সম্পূর্ণ অভিনব কণ্ঠস্বর আন্তরিক, আদর্শের ও প্রবৃত্তির দ্বন্দ্বে উদ্ভ্রান্ত, শক্তিশালী ও সাহসী, সৎ ও সংরক্ত। বহু দিক থেকেই নির্মলেন্দু গুণের আমার কণ্ঠস্বর অষ্টাদশ শতাব্দীর ফরাসি দার্শনিক জাঁ জাক রুশোর লেখা স্বীকারোক্তি নামক বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থের সঙ্গে তুলনীয়। স্বাধীনতার স্বপ্নে উদ্বেলিত, কিন্তু প্রবৃত্তির নাগপাশে জর্জরিত। এ-গ্রন্থ মানবিক অস্তিত্বে এমন এক বহুমাত্রিক প্রকাশ, যা একাধারে নাটকীয় ও মর্মস্পর্শী।
[সুরজিৎ দাশগুপ্ত; দেশ: ৬৩ বর্ষ ১ সংখ্যা, ৪ নভেম্বর ১৯৯৫]
আমার কণ্ঠস্বর কাকলী প্রকাশনী থেকে প্রথম মুদ্রিত হয় ১৯৯৫ সালে। গ্রন্থটার শুরুই হয়েছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের আরম্ভ-আয়োজনের সাথে সাথে নিজের জীবনের আরম্ভের বর্ণনা দিয়ে। প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় কবি এই গ্রন্থটা লেখার কারণ তুলে ধরেছেন। বলেছেন—
‘আমি যখন কণ্ঠস্বরের সঙ্গে আমার সম্পর্ক-বিষয়ক এই লেখাটি লিখতে শুরু করেছিলাম, তখন আমার সামনে কোনো প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল না। ভেবেছিলাম, কয়েক পাতার মধ্যেই আমি আমার লেখাটি শেষ করবো। কিন্তু নিজের জীবন অভিজ্ঞতার কথা লিখতে লিখতে, পেছনে ফেলে আসা ধূসর স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে, প্রচণ্ড ঘোরের মধ্যে কীভাবে যে আমার সময় চলে যায়, আমি টেরই পাইনি। লেখাটি ক্রমশ বড় আকার ধারণ করে। আমি আমার ভিতরে কবির পাশাপাশি, একজন ইতিহাসসন্ধানী গবেষকের অস্তিত্বকে অনুভব করি। কিন্তু ইতিহাস প্রণেতার একাডেমিক প্রশিক্ষণ, বা ধৈর্য কোনোটাই আমার নেই। ফলে, পাকিস্তানের লৌহমানব আইয়ুব খানের পতনের পটভূমিতে অনুষ্ঠিত ১৯৭০-এর ঐতিহাসিক জাতীয় নির্বাচনের খুব কাছাকাছি পৌঁছে, আমার প্রথম কাব্যগ্রন্থ প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশের সঙ্গে-সঙ্গে, আমি এই রচনার আপাতত সমাপ্তি টেনে দিই। আমি ১৯৭১-এর সামনে এসে থমকে দাঁড়াই, সমুদ্রের সামনে এসে মানুষ যেমন থমকে দাঁড়ায়। আমার ধারণা, ১৯৭১ একটা পৃথক খণ্ডকে দাবি করে। আমার খুব ইচ্ছে আছে, বর্তমান গ্রন্থটির মতো অন্তত আরও দু-তিনটে খণ্ড রচনা করার’। বোঝাই যাচ্ছে একটা জাতির জন্ম পরিসরের অভিজ্ঞানটাই লিখেছেন তিনি।
নির্মলেন্দু গুণ © ছবি: ঢাকা অপেরা
দুই
গ্রন্থ পাঠে খুব বুঝতে পারি, কবি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। বড় হওয়ার স্বপ্ন ও আগ্রহে বাড়ি ছেড়েছেন। এসএসসিতে ভালো ফল করায় পরিবারের সবার প্রত্যাশাও ছিলো। কিন্তু রক্তে সংগুপ্ত ছিল কবিধর্ম। তাই আনন্দমোহন কলেজে ভর্তি হলেন বটে, কিন্তু বড় শহরের বিমুক্ত পরিবেশে মিশতে মিশতে পড়ার টেবিলে মন বসেনি। কলেজে যেতে যেতে বহুবিধ বিচিত্রতায় মিশে গেলেন। ক্লাস ফাঁকি দেওয়া, হোস্টেলে জুয়ার আসর বসানো এবং মেসের বাজার করার টাকা মেরে বেশ বাবুয়ানা করেই দিনাতিপাত করছিলেন। বাদ সাধল ব্যাটা বেরসিক হোস্টেল সুপার। মেসের বাজারের টাকা নয়ছয় এবং জুয়ার আসর বসানোর দায়ে হোস্টেল থেকে নাম কাটা গেল। বদনাম মাথায় নিয়ে ফিরে এলেন নেত্রকোনা কলেজে। তত দিনে জেগে উঠেছে কবিধর্ম। আন্দমোহন কলেজ ম্যাগাজিনেই কবিতা লেখার হাতেখড়ি হয়ে গেছে। তবে বাংলায় নয়, কলেজ ম্যাগাজিনে ছাপা হয়েছিল ইংরেজি কবিতা। উচ্চমাধ্যমিকে আবার পড়াশোনার ট্র্যাকে ফিরলেন। ভালো ফল করলেন।
কিন্তু ভালো ফল করলেও ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে চান্স পেলেন না। কারণটা মর্মান্তিক। ১৯৬৫ সালের সাথে আজকের বাংলাদেশের তফাত কতটা, সেটি ঠিক বিশ্লেষণ করে বলা যাবে না। আমরা কবির কষ্ঠস্নাত কথাটি পড়ে সময়টাকে অনুভব করতে পারি—‘ভারত এনিমি স্টেট বলে বিবেচিত। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুরাও কিয়দংশে এনিমিটিরি দায়ভাগ বহন করে। তারা পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক হিসেবে বিবেচিত হয়। ওই রকম পরিস্থিতিতে আমি আর সুকোমল আর বিব্রত বোধ করি। ভাইভা বোর্ডে আমাকে প্রশ্ন করা হয়, ভালো রেজাল্ট থাকার পরও আমার ব্রেক অব স্টাডি হলো কেন? আমি গত বছরের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাজনিত পরিস্থিতিটা বোর্ডকে বুঝিয়ে বলি। বোর্ডের একজন তখন জানতে চান, আমার পরিবারের কেউ ভারতে আছেন কি না? আমি বলি যে, আমার বড় ভাই ভারতে আছেন, কিন্তু আমি ইঞ্জিনিয়ার হলে এ দেশেই থাকবো। ভারতে চলে যাব না। ওই সময় বেশ কিছু হিন্দু ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ার চাকরি ছেড়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। ফলে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের শিক্ষকেরা ভর্তি-ইচ্ছুক হিন্দু ছাত্রদের পারিবারিক পরিস্থিতিটা কৌশলে জেনে নেবার চেষ্টা করতেন। ওই দিন বোর্ডে আমাকে পাঠ্যসূচি থেকে কোনো প্রশ্ন করা হয়নি। আমি ভাবলাম আমার হবে। কিন্তু যখন ফল বেরোল, দেখলাম হয়নি। সুকোমলের বড় দুই ভাই ভারতে ছিল, কিন্তু সে ওই তথ্যটি বেমালুম চেপে যায়। ফলে সুকোমলের হয়।’
আমার কণ্ঠস্বর গ্রন্থে যেভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণ জীবনকে দেখিয়েছেন, সেসব দেখে মনে হলো—জীবন নিয়ে তিনি একধরনের রসিকতাই করে গেলেন। কবি ছাড়া তিনি অন্য কিছু হতে চাননি। চাননি প্রতিষ্ঠা ও খেতাব। আমাদের যেসব কবি, লেখকেরা প্রতিষ্ঠা আর প্রতিষ্ঠানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাকে জীবনের প্রধান কর্ম ধরে নিয়ে তারপর সাহিত্য রচনা করছেন—তাদের কাছে গুণের জীবনটা অবিশ্বাস্য এবং হয়তো অপাঙ্ক্তেয়। কিন্তু কবি কখনোই জীবনের কাছে নত হননি; শিরদাঁড়া সোজা রেখে কবিধর্ম আর দেশের প্রয়োজনে গণকণ্ঠে কবিতা লিখেছেন।
ইঞ্জিনিয়ারিংরে ভর্তি হতে না পেরে ঢাবির ফার্মেসি বিভাগে ভর্তি হতে চাইলেন। চান্সও হলো। কিন্তু বিধাতার লিখন কে খণ্ডাতে পারে, ‘Man Poses, God this poses.’ ১৯৬৫ সালের আঠারো দিনের পাক-ভারত যুদ্ধ সবকিছু এলোমেলো করে দিল। তখন সংখ্যালঘু সম্প্রদায় কতটা হুমকির মুখে ছিল তার কিয়দংশ জানা যায় যুবক গুণের জবানিতে। যুদ্ধ থামল। তাসখন্দ চুক্তি হলো৷ গুণের স্মরণ এলো ঢাবিতে ভর্তির কথা৷ ঢাকায় ফিরলেন। তত দিনে ভর্তির সর্বশেষ সময় শেষ। গুণের বদলে ওয়েটিং লিস্ট থেকে একজন ভর্তি হয়ে গেছে। এই ঘটনা নির্মলেন্দু গুণের জীবনকে আমূল বদলে দিল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না।
আবারও ফিরতে হলো আনন্দমোহন কলেজে। না, উচ্চশিক্ষা নিতে নয়। সার্টিফিকেটের লোভে তো নয়ই। শুধু পরিবারকে খুশি করার নিমিত্তে এই লোকদেখানো ভর্তি হওয়া।
কলেজে থাকতে সিগারেট, গাঁজায় হাতেখড়ি হয়েছিল। স্নাতক শ্রেণিতে এসে জগতের সম্রাট হওয়ার পণ করলেন৷ সাহিত্যসাধনাও চলছিল। কবি লিখেছেন—‘আমি আমার আনন্দ সন্ধানী ইন্দ্রিয়কে দমন করার পরিবর্তে, জগতের আনন্দযজ্ঞের নিমন্ত্রণ গ্রহণ করি। আমি নবজাগ্রত যৌবনের ডাকে সাড়া দিই—খরতপ্ত গ্রীষ্মের প্রথম বর্ষণের ডাকে ডিমওয়ালা কৈ মাছ যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই—উষ্ণ গাভীর ডাকে বীর্যবান ষাঁড় যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই—মিষ্ট দ্রব্যের গন্ধে পিঁপড়ের দল যেরকম সাড়া দেয়। আমি সাড়া দিই—টারজানের ডাকে অরণ্যের হিংস্রপশুরা যেরকম সাড়া দেয়।...মদ্য-পদ্য-সিদ্ধি-গণিকা-জুয়া,—এই পঞ্চভূতের পাদপদ্মে আমি উৎসর্গ করি আমাকে।’
কিন্তু কবির জীবনে হঠাৎ করেই এক অদ্ভুত সমস্যা উপস্থিত হয়। ডাকাতি করতে এসে এক ডাকাত পুলিশের হাতে ধরা খেয়ে সহযোগী হিসেবে যাদের নাম বলে তাদের মধ্যে নির্মলেন্দু প্রকাশ গুণ চৌধুরীর নামটিও আছে। এক আশ্চর্য অভিঘাত নেমে এলো তাঁর জীবনে। ফেরারী হলেন কবি। এখান থেকে সেখানে শুরু হলো পলাতক জীবন। এই ফেরারী পথই তাঁকে ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে এলো নতুন ঠিকানায়। আশ্রয় দিলো ঢাকার বুকে।
প্রথমে পরিবার কবিকে ভারতে বসবাসকারী তার বড় ভাইয়ের কাছে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিল। সবকিছুর পাকাপাকি বন্দোবস্তও হয়েছিল। কিন্তু নির্মলেন্দু গুণ ভারতে নির্বাসনে যাবার বেলায় কবির প্রাণে দেশানুভূতির একটা বোধ ঢুকিয়ে দেন বন্ধু ইলিয়াস। পলাতক গুণের জীবন আরও ছন্নছাড়া হয়ে গেল। এর-ওর বাড়িতে কাটাতে হয়। থাকতে হয় লুকিয়ে। এক বন্ধুর সঙ্গে ঢাকায় চলে এলেন। পাথেয় বাবার জমি বন্ধক দেওয়া শ’ পাঁচেক টাকা৷
এই হুলিয়া জীবনের ধাক্কাতেই কবি ঢাকায় এসেই পুরোনো বন্ধু মামুনুর রশীদ [প্রখ্যাত অভিনেতা]-এর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ডেরায় ওঠেন। মামুনুর রশীদই পরিচয় করিয়ে দেন—কণ্ঠস্বর সম্পাদক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে। একটি কাজ কবির খুবই দরকার ছিল। কবিতার সুবাদেই পরিচয় হয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদের সঙ্গে। একটা কাজও দিলেন তিনি। তাঁকে দায়িত্ব দেন কণ্ঠস্বর-এর বিজ্ঞাপন জোগাড়ের কাজে। সায়ীদ স্যারের সাইকেল নিয়ে টইটই করে শহর ঘুরে কবি লেগে যান তাঁর কাজে। তাঁর পত্রিকার জন্য বিজ্ঞাপন জোগাড় করা।
কবি ব্যক্তিত্বের বর্ণগন্ধতাপের ঔজ্জ্বল্যে কবির সাথে ঢাকার সারস্বত সমাজের একটা সখ্য তৈরি হয়। এই সময়ে গুণের সবচেয়ে ভালো বন্ধু হয়ে যান কবি আবুল হাসান। দুজন উন্মত্ত বোহিমিয়ানের গল্পে ঠাসা এই আমার কণ্ঠস্বর গ্রন্থ।
তিন
একটা বিচিত্র জীবনের প্রসারণভূমিতে প্রতিনিয়ত অবগাহন করেছেন কবি। কেমন ছিল সেই জীবন? লিখতে গেলে মহাকাব্য হয়ে যাবে। কপর্দকশূন্য একটা লড়াকু জীবন বেছে নিয়েছিলেন তিনি। ভীরু, পলাতক ও উদ্বাস্তু জীবনের অনিশ্চয়তাকে মেনে নেননি। জীবনের বাঁকগুলো নির্মলেন্দু গুণের ছিল খুবই রোমহর্ষ। কণ্ঠস্বর নিয়ে তাঁর আবেগ যখন তুঙ্গে, তখন আবদুল মান্নান সৈয়দের লেখা বেশি পরিমাণে ছাপানোর ইস্যুকে সামনে নিয়ে তিনি কণ্ঠস্বর ত্যাগ করেন। প্রতিবাদ এবং অকপট ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বলতাই স্পষ্ট হয়েছে আমার কণ্ঠস্বরের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। এই প্রতিবাদের উত্তাপ দিয়েই কবিতার ভাষা তৈরি করেছেন।
১৯৬৬, ৬৭, ৬৮, ৬৯ এবং ৭০-এর একটা জ্বলন্ত ঢাকাকে তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন। একজন প্রকৃত কবির মতো সময় ও জাতির পক্ষ থেকে যথার্থ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন পঙ্ক্তিমালাই তিনি লিখেছেন। আওয়ামী লীগের ছয় দফা কর্মসূচির উত্তাল গণজোয়ারের ভেতর থেকে উদ্ভাসিত হয়েছে কবির কাব্য ভাষা। আত্মজীবনের তোয়াক্কা না করে গুণ সময়ের ভাষাকে কবিতায় নিয়ে এসেছেন। ইত্তেফাক কিংবা সংবাদের মতো পত্রিকা তখন সরকারি রোষানলে বন্ধ। সংবাদের সাহিত্য সম্পাদক রণেশ দাশগুপ্ত তখন জেলে। সেই সময় ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছে তিনি ‘শেখ মুজিবুর রহমানকে’ উৎসর্গ করে নিজের লেখা কবিতা ছাপানোর জন্য ক্রমাগত চাপ দিয়ে এসেছেন। শুধু চাপ নয়; রীতিমতো হুমকি দিয়ে এসেছেন। বলেছেন—“শহীদ ভাই, আমি আমার কবিতাটির ব্যাপারে আপনার সিদ্ধান্ত জানতে এসেছিলাম। আর সময় দেয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আগামী সংখ্যায় যদি কবিতাটি না ছাপেন, তবে আমি গভর্নর মোনায়েম খানকে উৎসর্গ করে কবিতাটি ‘পয়গাম’ পত্রিকায় ছাপবো। [তখন পয়গাম নামে মোনায়েম খান একটি পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর পুত্র আখতারুজ্জামান বাচ্চু ছিলেন ওই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তিনি কায়রো প্লেন ক্রাশে নিহত হয়েছিলেন।] আপনি কি তাই চান?
ইতি আপনার নির্মল।” এই হচ্ছেন নির্মলেন্দু গুণ। আত্মজীবনে যা চেয়েছেন, তা-ই করেছেন। ১২ নভেম্বর ১৯৬৭ সালে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুকে উৎসর্গীকৃত এই কবিতা তিনি জেলখানায় পড়ে ছিলেন।
চার
১৯৬৯ সালটি বাঙালির প্রতিরোধ এবং ঘুরে দাঁড়াবার বছর। এই গণ-অভ্যুত্থানে বাংলার মানুষ পথে নেমে আসে। মানুষের এই জয়ে আইয়ুব খানের পরাজয় হয়। আইয়ুবের পতনের এই আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন কবি। বাংলার অগ্নিকন্যা এবং অগ্নিপুত্রদের আন্দোলনে বুমেরাং হয়ে যায় শোষকের গদি। বোঝা যায়, শুধু কবিতা লিখে নয়; মিছিলেও জাগ্রত রেখেছেন কবির কণ্ঠস্বর। কবি লিখেছেন—‘সুন্দরী ছাত্রীদের জঙ্গী মিছিলে অংশগ্রহণের বিষয়টিও আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমার মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভার শেষে ১৪৪ যারা ভঙ্গ করে নীলক্ষেতের পথে-পথে আমরা যখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতাম, তখন অপরিচিত মেয়েরাও কাঁদানে গ্যাসের দম-যন্ত্রণা দূর করার জন্য তাদের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সুগন্ধি রুমাল বের করে জলে ভিজিয়ে তা এনে আমাদের চোখে দিতেন। আমার ঐ মুহূর্তটি খুবই ভালো লাগতো। রুমালের ফাঁক দিয়ে চট করে দেখেই অপরিচিত মুখটাকে আমি মুখস্থ করে ফেলতাম। আহত অবস্থায় আমি হাসপাতালের শয্যায় কল্পনায় আবিষ্কার করে তখন আনন্দ পেতাম। আইয়ুবের পুলিশি নির্যাতন নিয়ে, তাই আমার কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল না। ভালো লাগতো প্রতিদিন মিছিলে যেতে।’
নির্মলেন্দু গুণ © ছবি: ঢাকা অপেরা
পাঁচ
গ্রন্থটিতে কবির পূর্ণাঙ্গ জীবনকাহিনি নেই। জীবন নামের বৃহৎ যাত্রা ও অনুভবের কতটুকুই-বা আমরা লিখতে পারি। তবে এই গ্রন্থের সর্বাংশে একটি রাষ্ট্রের জন্মবৃত্তান্ত অসাধারণভাবে উঠে এসেছে। কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ—প্রেমাংশুর রক্ত চাই প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের আয়োজনের আবহ রেখে গ্রন্থটা শেষ হয়েছে। জুয়া খেলায় অভিজ্ঞ কবি নিজের জীবনটাকে সহজভাবে দেখেছিলেন। ছিলেন আশুতোষ। আমার কণ্ঠস্বর গ্রন্থে যেভাবে কবি নির্মলেন্দু গুণ জীবনকে দেখিয়েছেন, সেসব দেখে মনে হলো—জীবন নিয়ে তিনি একধরনের রসিকতাই করে গেলেন। কবি ছাড়া তিনি অন্য কিছু হতে চাননি। চাননি প্রতিষ্ঠা ও খেতাব। আমাদের যেসব কবি, লেখকেরা প্রতিষ্ঠা আর প্রতিষ্ঠানের সিঁড়ি বেয়ে উপরে ওঠাকে জীবনের প্রধান কর্ম ধরে নিয়ে তারপর সাহিত্য রচনা করছেন—তাদের কাছে গুণের জীবনটা অবিশ্বাস্য এবং হয়তো অপাঙ্ক্তেয়। কিন্তু কবি কখনোই জীবনের কাছে নত হননি; শিরদাঁড়া সোজা রেখে কবিধর্ম আর দেশের প্রয়োজনে গণকণ্ঠে কবিতা লিখেছেন।
কবি লিখেছেন—‘সুন্দরী ছাত্রীদের জঙ্গী মিছিলে অংশগ্রহণের বিষয়টিও আমাকে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করে। আমার মনে পড়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় ছাত্রসভার শেষে ১৪৪ যারা ভঙ্গ করে নীলক্ষেতের পথে-পথে আমরা যখন পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হতাম, তখন অপরিচিত মেয়েরাও কাঁদানে গ্যাসের দম-যন্ত্রণা দূর করার জন্য তাদের ভ্যানিটি ব্যাগ থেকে সুগন্ধি রুমাল বের করে জলে ভিজিয়ে তা এনে আমাদের চোখে দিতেন। আমার ঐ মুহূর্তটি খুবই ভালো লাগতো। রুমালের ফাঁক দিয়ে চট করে দেখেই অপরিচিত মুখটাকে আমি মুখস্থ করে ফেলতাম। আহত অবস্থায় আমি হাসপাতালের শয্যায় কল্পনায় আবিষ্কার করে তখন আনন্দ পেতাম। আইয়ুবের পুলিশি নির্যাতন নিয়ে, তাই আমার কোনো ব্যক্তিগত ক্ষোভ ছিল না। ভালো লাগতো প্রতিদিন মিছিলে যেতে।’
বাংলা সাহিত্যে ‘হুলিয়া’ কবিতাটি তিনি নিজের জীবন দিয়ে লিখেছেন। লিখে প্রসিদ্ধ হতে হবে এমন বাসনা থেকে তিনি লেখেননি। লেখার ক্ষমতার জন্যই মানুষকে টেনেছে। কবির এমন বোহিমিয়ান জীবন কাটানো নিয়ে আলোচনা হতে পারে, চায়ের টেবিলে ঝড় উঠতে পারে, কিন্তু তিনি সময় ও দেশের দায় নিয়ে প্রকৃত কবির মতো সত্য উচ্চারণ করেছেন। আমার কৈফিয়ত কবিতায় কবি নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন—
বর্তমানের কবি আমি ভাই, ভবিষ্যতের নই নবী
কবি ও অকবি যাহা বলো মোরে মুখ বুঁজে সই সবি!
...
বড় কথা বড় ভাব আসে না’কো মাথায়, বন্ধু বড় দুঃখে
অমর কাব্য তোমরা লিখিও, বন্ধু, যাহারা আছো সুখে।
কবি সুখ কিংবা শান্তির চেয়ে একটি বিষণ্ণ পরিস্থিতির ভেতর দিয়ে যাচ্ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই একটা সাহসী কলমে কবি কালের ইতিহাস লিখেছেন। বাজারে আত্মজীবনীর নামে যেসব প্রকাশনা পাই, সেগুলোতে সময়ের সত্য বর্ণনা নেই। সময় ও জীবনকে তুলে দিয়ে কবি মূলত ইতিহাসের কাছে নিজেকে নির্মল রেখেছেন। দায়িত্ব পালন করেছেন। বাংলা ভাষায় ও বাঙালি সংস্কৃতিতে কবি একটা জাগ্রত কলমে জাতির পক্ষ থেকে দায়িত্ব পালন করেছেন। ‘হুলিয়া’ কবিতাটি সম্পর্কে আব্দুল গাফ্ফার চৌধুরী বলেন—
‘এই আসরে একটি আশ্চর্য সুস্থ, সাম্প্রতিক কণ্ঠ শুনলাম একটি কবিতায়। কবিতার নাম সম্ভবত হুলিয়া। কবির নাম নির্মলেন্দু গুণ। ফেরারী নায়ক গ্রামে ফিরেছেন। তার শৈশব ও কৈশোরের অতি-পরিচিত খাল-বিল, মাঠ-ঘাট, পথ সবই তার কাছে বহুবার দেখা ছবির মতো। অথচ কেউ তাকে চিনতে পারছে না। যেমন তাকে চিনতে পারেনি স্টেশনের গোয়েন্দা পুলিশ এবং টিকিট চেকার। নায়ক ফিরে এলো মায়ের কাছে, সংসারের প্রাত্যহিক দাবির কাছে। কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে সকলের কণ্ঠেই একটি প্রশ্ন—দেশের কী হবে? শেখ সাহেব এখন কী করবেন? কবিতার নায়ক জবাব দেয়... আমি এসবের কিছুই জানি না—আমি এসবের কিছুই বুঝি না।
জানি না কবিতাটির আখ্যান সংক্ষেপে বর্ণনা করতে পেরেছি কি না। দীর্ঘ কবিতা। তাতে শুধু কবিতার স্বাদ নয়, সাম্প্রতিক রাজনীতির যুগ-জিজ্ঞাসাও বেশ স্পষ্ট। এ যেন বাংলার ক্ষুব্ধ তারুণ্যের স্বগতোক্তি। এই জবাবের চাইতে বড় সত্য এই মুহূর্তে জন-চেতনায় আর কিছু নেই।’
ছয়
ক্রমে এই দুনিয়াটা ছোট হয়ে যাচ্ছে। একটা স্মার্টফোনের ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে প্রত্যেকের জীবনী। নিজেকে দেখার কিংবা চেনার মতো মাঠ কিংবা নদী আর দেখা যাচ্ছে না এই নগরকীর্তনে। এখানে শেষ পর্যন্ত আকাশের মতো, গভীর রাতের নিঃসঙ্গতায় অনেক অনেক নক্ষত্র দেখা যায় না আর দূষণের কারণে। ধনতন্ত্রের বিপুল উন্নয়নে ভূমির পরিতাপ বাড়ছে। ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে অতীত ইতিহাস। অথচ ইতিহাস হচ্ছে আত্মপরিচয়ের জানালা। পোলট্রি ফার্মের খাঁচার ভেতরে মুখস্থ খাওয়া-দাওয়ার ভেতরে থাকতে থাকতে এই সমকালটা স্টার জলসার চরিত্রের মতো মেকাপের প্রলেপে অনেক কৃত্রিম। এই সময়ের চরিত্রগুলো কেমন যেন মৃত। বারো ফুট বাই বারো ফুটের ফ্ল্যাট জীবনে কেউ আর প্রতিবাদ কিংবা আত্মানুসন্ধানী নয়। আধুনিকতার স্তব্ধ ও স্থবিরতা থেকে মুক্ত হতে হলে গুণের জীবনী খুব কাজে দেবে।
পেছনের ইতিহাস সবাইকে জাগিয়ে দেয়। মানুষ তার উৎস সম্পর্কে না জানলে ভবিষ্যতে পৌঁছুবে কী করে। গুণের এই সহজ ও শৈল্পিক গদ্যে বাঙালির ইতিহাসই আছে। এই ইতিহাস সাবলীল ও পরিক্রমজাত। গদ্যও অসাধারণ। গুণের জীবনের মুখোমুখি হওয়া মানে নিজেকেই চেনা। মূলত নির্মলেন্দু গুণ একজন সৎ লেখক। সৎ লেখক দায় থেকে লেখেন। এই গ্রন্থে যেভাবে তিনি ষাটের দশকটাকে উঠিয়ে এনেছেন—এমনটা খুব বেশি দেখা যায় না। কবি জীবনকে, দেশকে, শৈশবের কংশ নদীকে খুব ভালোবাসেন। প্রেম ছাড়া কেউ কবিতা লিখতে পারে না। ভাষা ও জাতির কাছে নিজের স্বপ্ন ও কল্পনাকে উপস্থাপন করতে পারে না। কবি নির্মলেন্দু গুণ পেরেছেন। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে আমার কণ্ঠস্বর মূলত গুণের জীবনকথায় বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আন্তরিক ইতিহাস। এই ইতিহাস লিখতে লিখতেই কবি নিজের কাব্যভাষা আবিষ্কার করেছেন। শৈশবের নদী কংশের জলে ভাসতে চেয়েছেন।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যদি শিমুলের তুলা হতাম, বাতাসে উড়িয়ে দিতে বলতাম,
কিন্তু আমার দুর্ভাগ্য, আমি বাতাসের চেয়ে হালকা নই।
আমাকে তোমরা কাঠের আগুনে পুড়িয়ে ফেলো না,
কিংবা মাটি খুঁড়ে কবর দিও না আজিমপুর বা বনানীতে।
বর্জ্যপদার্থের মতো আমি চাই না মাটিতে মিশে যেতে।
মৃত্যুর পর তোমরা আমাকে কংশের জলে ভাসিয়ে দিও।
যাতে জলপথে ভাসতে-ভাসতে, ভাসতে-ভাসতে
আমি পৌঁছুতে পারি পৃথিবীর নব-নব দেশে।
সংগ্রহে রাখার মতো।
Fardoush Alam Kabir
জানুয়ারি ০২, ২০২২ ০৬:০৬