গদারের নব তরঙ্গবাদ এবং নয়া হলিউড সম্পর্ক
গত শতকের ষাটের দশকে পৃথিবীতে কি প্লাবন হয়েছিল? বালাই ষাট। প্লাবন হতে যাবে কেন? তবে যে, বড় বড় ঢেউ বা তরঙ্গের সংবাদ শোনা যায়? হ্যাঁ, সেটা অস্বীকার করা যাবে না। ষাটের পরে ভর করেছিল ষাটের স্বপ্ন। আর তার প্রায় ষাট বছর পরে আমরা এখনো ষাট-ষাট রব তুলি। না, শুধু সাহিত্যে নয়, রাজনীতিতে নয়, চলচ্চিত্রেও ষাট প্রণোদনা জোগায় নতুন দিনের। একদিকে যুদ্ধফেরত প্রজন্মের হতাশা, অন্যদিকে আমেরিকার সাম্রাজ্যবাদী চরিত্রের সর্বোচ্চ প্রকাশ শুধু উপমহাদেশ নয়, পুরো দুনিয়াজুড়ে তৈরি করে আন্দোলন, যে আন্দোলন মানচিত্র আর ইতিহাস পাল্টাতে নিয়ামকের ভূমিকা রাখে। আর এই সময়েই প্যারিসে গড়ে ওঠে ন্যুভেলভাগ তথা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ ওর্ফে ফরাসি নব তরঙ্গবাদ নামে এক বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্র আন্দোলন। যার প্রভাব আজও এবং আগামীতেও চলচ্চিত্রের ইতিহাসে উজ্জ্বলতম অধ্যায় বলে বিবেচিত হবে। মজার বিষয়, এই ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ, আমেরিকান গ্যাংস্টার ঘরানা থেকে ভায়োলেন্সের উপাদান খুঁজে নেয় এবং সেই উপাদানকেই রূপান্তর করে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী হাতিয়ারে। পরবর্তীকালে ষাটের দশকের শেষার্ধে আমেরিকান নিউ ওয়েভ নামে আরও একটি আন্দোলন খোদ আমেরিকার বুকেই গড়ে ওঠে, যা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভ বা ফরাসি নব তরঙ্গবাদ দ্বারা তরঙ্গায়িত। কিছুটা আগে পরে শুরু হওয়া দুটো চলচ্চিত্র আন্দোলনেরই গল্প বলার ক্ষেত্রে ভায়োলেন্স বা সহিংসতার ব্যাপক প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। আমেরিকান চরিত্রের অনেক গহিনে প্রোথিত সন্ত্রাস বা সহিংসতার বীজ গদার এবং তাঁর সহযোগী চলচ্চিত্রকারদের হাতে নতুন শৈল্পিক রূপ ধারণ করে। অন্যদিকে, গদারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের আলোচ্য চলচ্চিত্র ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’-এর লেখকদ্বয় এমন গল্পের অবতারণা করেন, যা পুরোনো বা চিরায়ত হলিউডি গল্প বলার ভঙ্গিকে ভেঙে নয়া হলিউডের জন্ম দেয়। এই পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়া সম্পর্কে মার্শা কাইন্ডার বলছেন,
বনি অ্যান্ড ক্লাইড-এর লেখক ডেভিড নিউম্যান এবং রবার্ট ব্রেনটন, পরিচালক আর্থার পেনকে দায়িত্ব দেওয়ার আগে ফ্রাঁসোয়া ত্রুফো এবং জঁ-লুক গদারের কথা ভাবেন। কারণ, এই দুই ফরাসি পরিচালকের অভিনব ফিল্ম টেকনিক সমৃদ্ধ সন্ত্রাসনির্ভর ছবিসমূহের দ্রুত লয়, চরিত্রের গতিময়তা, ক্যামেরার কাজ, গল্প বলার ধরন এবং সর্বোপরি ব্যবহৃত স্ক্রিন ভায়োলেন্সের পদ্ধতি দ্বারা, তাঁরা ভীষণভাবে প্রভাবিত হন।’ [Slocum 77]
বিভিন্নভাবেই বনি অ্যান্ড ক্লাইড গদারের ফিল্ম টেকনিকের কাছে ঋণী, যদিও বিষয়বস্তু এবং আঙ্গিকের মধ্যে রয়েছে তাদের বিস্তর ফারাক। দুপক্ষেরই প্রতিপক্ষ এক, কিন্তু চলার পথ ভিন্ন। এই বিভিন্নতা নিয়েই তাদের পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়া। আর তা কতটা কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছুতে পেরেছে, সেটা বিশ্লেষণের দাবিদার।
এই লেখার মূল প্রতিপাদ্য নয়া হলিউড বা আমেরিকান নিউ ওয়েভের অন্যতম আইকনিক সিনেমা আর্থার পেন পরিচালিত বনি অ্যান্ড ক্লাইড [১৯৬৭] এর সাথে ফরাসি নব তরঙ্গবাদ বা ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম দিকপাল জঁ-লুক গদারের চারটি চলচ্চিত্র যথাক্রমে ব্রেথলেস [১৯৫৯], লে ক্যারাবিনিয়ের [১৯৬৩], পিয়েরো লা ফু [১৯৬৫] এবং প্রেনম কারমেন [১৯৮৪]-এর তুলনামূলক আলোচনা, যা দুই চলচ্চিত্র আন্দোলনের ফিল্ম স্টাইল এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যকে পরিস্ফুট করে।
অস্পষ্ট অবয়ব—বনি অ্যান্ড ক্লাইড
১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার প্রেক্ষাপটে একটি সত্যি ঘটনা অবলম্বনে এই চলচ্চিত্র নির্মিত। অর্থনৈতিক মুক্তির খোঁজে ক্লাইড ব্যারো এবং তার দলের বেপরোয়া ব্যাংক ডাকাতিতে জড়িয়ে পড়া, হত্যাকাণ্ড সংঘটন, ধনীর প্রতি ঘৃণা আর গরিবের প্রতি দরদ প্রভৃতি তাদেরকে একদিকে রাষ্ট্রের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়, অন্যদিকে সমাজের নিম্নবিত্তের কাছে কিংবদন্তিতে পরিণত করে। যদিও এই বিপজ্জনক হিরোইজম তাদেরকে আখেরে ট্র্যাজেডির দিকেই টেনে নিয়ে যায়।
‘প্রথম থেকেই একটা অস্থির গতি এই চলচ্চিত্রে দেখা যায়। প্রোটাগনিস্টরা সব সময় কেমন যেন একটা দৌড়ের মধ্যে থাকে। প্রথম ডাকাতির দৃশ্যের পর মোটরগাড়ির উদ্দাম গতিতে পলায়ন, দ্বিতীয় ডাকাতির শেষে পুলিশের গাড়ির স্ল্যাপেস্টিক ধাঁচে ধাওয়া করা, সবচেয়ে মারাত্মক বন্দুকযুদ্ধের সময় সীমানাদেয়ালের ভেতর গাড়ির ঘুরপাক খাওয়া এবং পরিশেষে, এমবুশের আগে ধীর লয়ে ক্লাইডের গাড়ির এগিয়ে চলা—মোটরগাড়িগুলোর এই যে চলার বিভিন্নতা এবং এর গতিই প্রধান দৃশ্যগুলোর টোন ঠিক করে দেয়।’ [Cawelti 52]
প্রশ্ন জাগে, মোটরগাড়িতে ছুটে বেড়ানোর হেতু কী? এইভাবে, ঘরবাড়ি ছেড়ে উদোম রাস্তায় বেরিয়ে পড়াই-বা কেন? জেফ কিং এর উত্তরে বলছেন, বনি অ্যান্ড ক্লাইড যেন যুদ্ধক্ষেত্রের পুরোনো মিথলজিকেই সম্মুখে নিয়ে আসে। খোলা দিগন্তে—ভ্রমণ, এই ক্ষেত্রে রাজপথ, বারবার সভ্যতার বাতাবরণ ভেঙে রোমান্টিক মুক্তির সম্ভাবনাকে জাগিয়ে তোলে। [King 45]
তা না হয় জাগিয়ে তুলল। কিন্তু এই জাগিয়ে তোলাটা আরেকটা সম্পূরক জিজ্ঞাসার উদ্রেক করে, এত পরিশ্রমে গড়ে তোলা সভ্যতা তথা নাগরিক জীবন অবরুদ্ধ হতে যাবে কেন? জবাবের জন্য অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় না। আমাদের মূল চরিত্রগুলোর উদ্বোধনী সংলাপেই তার দেখা মেলে। ক্লাইড ব্যারো, বনি পার্কারকে দলে ভেড়ানোর আশায় বলে...‘ওয়েট্রেস হওয়ার চাইতে আরও ভালো কিছু হওয়ার সম্ভাবনা তুমি ধারণ করো...’, যা ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দায় তাদের সামাজিক অবস্থানের প্রতি একধরনের অতৃপ্তি বা অনীহাকে ব্যক্ত করে। কিন্তু অর্থনৈতিক মুক্তির সমাধান কোনো সাদামাটা বিষয় নয় যে ত্বরিত উত্তর পাওয়া যাবে। এটা গবেষণা আর অধ্যয়নের ব্যাপার। কিন্তু ক্লাইড ব্যারোর হাতে সেই সময় নেই। তাই সে সরাসরি সমাধানের দিকে ঝোঁকে। সে ভাবে, ত্রাসে যদি মুক্তি মেলে তো আরও গভীরে যাওয়ার দরকার কী। তাই সে সহিংস ডাকাতির পথ বেছে নেয় এবং অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করে। কিন্তু এই অগভীর সমাধানই তাদের সুগভীর পতনের সূচনাকাল। কাহিনির শেষে ব্যারো গ্যাং-এর উদ্ভ্রান্তের মতন ছুটে চলাকে, তাদের সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ রূপে প্রতীয়মান হলেও, সেটা কোনো গ্রহণযোগ্য সমাধানের চরিত্র ধারণ করতে ব্যর্থ হয়।
বাস্তবতা হচ্ছে, পরিচালক আর্থার পেন যদিও তারুণ্যের ক্ষোভ চিত্রায়িত করার মানসে হলিউডের তথাকথিত MPAA নামক কড়া সেন্সরশিপ কোড’ [Schatz 186-187] ডিঙিয়ে যান স্ক্রিনে মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতা এবং রক্তপাত দেখিয়ে; তিনি কখনোই হলিউডের অদৃশ্য নিয়মটি ভাঙেন না, যা পুঁজিবাদী অর্থনীতির মূল সংকট বা সংঘাতকে এড়িয়ে যেতে দায়বদ্ধ। মার্ক লরিয়া তাঁর থিসিসে এই মতের সমর্থনে বলছেন,
ব্যারো গ্যাং-এর প্রাপ্তির প্রত্যাশা সামাজিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে হলেও, এই নব্য গ্যাংস্টার ঘরানার ছবি আমেরিকার সমাজব্যবস্থার বিপরীতে কোনো দার্শনিক বা রাজনৈতিক সমাধান দেয় না। আমেরিকার সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার দৈন্য ও বিচ্যুতিগুলো হয়তো গোপন থাকে না, কিন্তু বিদ্যমান কাঠামোর মৌলিক বিষয়বস্তু নিয়ে কোনো গঠনমূলক বাদানুবাদ এতে অনুপস্থিত। [Lauria 25]
র্যাডিকেল কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষণ হলিউডের চলচ্চিত্রে খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। ইন্ডাস্ট্রির শীর্ষ ব্যক্তিদের রাজনৈতিক সুবিধাবাদের কারণে এটা ঘটে তা নয়, বরঞ্চ দর্শকের মধ্যে বিভাজনের উদ্রেককারী বিষয়বস্তুর ব্যাপারেই হলিউডের অনীহা চরমে। যথাসম্ভব কোনো প্রকার দ্বন্দ্বকে পাশ কাটিয়ে স্বস্তির সঙ্গে পথ চলাটাই তার লক্ষ্য। একটি চলচ্চিত্রের বিভিন্ন রকমের বিশ্লেষণের পথ সে খোলা রাখে, যাতে বিপুল দর্শকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। মোট কথা, মুনাফাই তার লক্ষ্য, জীবন নয়। জেফ কিং এই প্রসঙ্গে বলছেন,
এমনকি নয়া হলিউডের চলচ্চিত্রগুলোতেও শ্রেণি, সম্পদ, অসাম্য, প্রাতিষ্ঠানিক সাম্প্রদায়িকতা প্রভৃতি সচেতনভাবেই অনুপস্থিত ছিল। আর যদিও কোনো র্যাডিকেল ইস্যু উঠে এসেছে, সেটাও সীমাবদ্ধ ছিল ব্যক্তিগত গণ্ডির ভেতরেই। এতে বোঝা যায়, এই সময়ের সিনেমাগুলোও হলিউডের অন্যান্য বাণিজ্যিক প্রোডাক্ট থেকে খুব একটা আলাদা কিছু নয়। [King 45-46]
ব্যাপারটা আরেকটু খোলাসা করার স্বার্থে ক্লাইড ব্যারো এবং বনি পার্কারের সংলাপে ফিরে যাওয়া যাক ফের। ক্লাইড বলছে, ‘...তাহলে একটা ক্যাফেতে তুমি চাকরি পেলে, কিন্তু এখন প্রতিদিন ঘুম থেকে উঠে সেটাকে তুমি ঘৃণা করো...শুধু ঘৃণা করো...’। এতে তার সামাজিক-অর্থনৈতিক অসন্তুষ্টির প্রকাশ অব্যাহত থাকে, কিন্তু বনিকে কোনো আদর্শগত বা রাজনৈতিক সমাধান দেওয়ার বুদ্ধিবৃত্তিক মুরোদ বা ইনটেনশন তার নেই। উপরন্তু প্রতিবাদের উপায় হিসেবে, বিদ্যমান আইনকে নিজ হাতে তুলে নেওয়ার প্রণোদনা দিতে থাকে। ক্লাইডের সংলাপেই বাকিটা শোনা যাক, ‘...সুতরাং তুমি প্রতিদিন ঘরে ফিরো... তোমার কক্ষে বসো এবং চিন্তা করো... কবে... কীভাবে এই চক্র থেকে বের হওয়া যাবে? এবং তুমি তার উপায়টা এখন পরিষ্কার জানো...’। উপায় জানার উপায় একটু আগে ক্লাইড কর্তৃক সংঘটিত একটি সুনিপুণ ডাকাতির দৃশ্য, বনি যার প্রত্যক্ষ সাক্ষী। ক্লাইডের বিশ্বাস সমাধান এখানেই নিহিত। বনি নিজেও ক্লাইডের স্টাইলিস্টিক পেশাদারিত্বে মুগ্ধ। কিন্তু বনি কি জানে, আপাত সমাধানের এই ভ্রান্ত ফ্যান্টাসি তাকে কোথায় নিয়ে যাবে? অপরদিকে, নিজেদের রচনায় মুগ্ধ বনি অ্যান্ড ক্লাইড-এর চিত্রনাট্যকারদ্বয় এই অজানার পথে পা বাড়ানোকেই বলছেন সমূহ সুন্দর, ‘অবশ্যই, গন্তব্যকে না জানাটাই তাদের আকর্ষণীয় করে। তারা বোঝে যে—একটা কিছু করতে হবে; কিন্তু যে পথে তারা পা বাড়ায়, সেটা অনিবার্যভাবেই তাদের ধ্বংস ডেকে আনে। [Hayden & Wake 19]
আমেরিকা লা ফু: বনি অ্যান্ড ক্লাইডের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট
বনি অ্যান্ড ক্লাইডের উন্মত্ততাকে বুঝতে হলে এর নির্মাণকাল অর্থাৎ ষাটের দশকের আমেরিকার উন্মত্ততাকে বুঝতে হবে। ভিয়েতনাম যুদ্ধ এবং কৃষ্ণাঙ্গ নিপীড়ন তখন আমেরিকার মূল ক্ষত। অন্যদিকে তরুণদের একটা বিরাট অংশ বিশ্ববিদ্যালয়মুখী, যা তাদের দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি সম্পর্কে সচেতন করে। তার ওপর, সদ্য জনপ্রিয় হওয়া টেলিভিশন প্রযুক্তির কল্যাণে প্রতি সন্ধ্যায় প্রদর্শিত যুদ্ধের বীভৎস নিউজ ফুটেজও তাদের মনে অনুঘটকের কাজ করে। সমাজের তরুণ অংশ ক্রমশ দেশে-বিদেশে সরকারের গৃহীত অন্যায্য নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। বনি অ্যান্ড ক্লাইড এমন এক সময় [১৯৬৭] মুক্তি পায়, যে বছর ১২৭টি আমেরিকান শহরে, নিরাপত্তারক্ষী এবং জনতার মধ্যে লড়াইয়ে ৭৭ জন নিহত এবং ৪০০০ বিক্ষোভকারী আহত হয়। এই সময়েই মানবাধিকার নেতা মার্টিন লুথার কিং যুদ্ধকে প্রত্যাখ্যান করেন এবং আমেরিকাকে ‘পৃথিবীর জঘন্যতম সন্ত্রাসী রাষ্ট্র’ হিসেবে অভিহিত করেন। [Friedman 74-76] এই নিপীড়ন ও নির্যাতনের ফলস্বরূপ গণমাধ্যমে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক চর্চার বিপরীতে একধরনের কাউন্টার কালচারের উন্মেষ ঘটে। পাশাপাশি একই সময়ে হলিউডের তথাকথিত ‘ব্লকবাস্টার চলচ্চিত্রগুলোও যেহেতু ব্যবসায়িক অনিশ্চয়তা প্রদর্শন করে,’ [Schatz 190-191] হলিউড দ্রুত এই নতুন সামাজিক-রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আত্মস্থ করার চেষ্টা করে।
ষাটের দশকে প্যারামাউন্টের মতন বড় স্টুডিও ‘তারুণ্যের প্রতিবাদ’কে কমোডিটি রূপে বিবেচনা করে এবং এই ব্যাপক তরুণ দর্শককে লক্ষ্য করেই ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড’ এবং ‘ইজি রাইডার’-এর মতন ছবি বাজারজাত করে। টমাস সাট্জ ষাটের দশকের চলচ্চিত্রের মূল্যায়ন করে লিখেছেন,
‘এই বছরগুলোতে মূলত চলচ্চিত্র পরিচালকেরা কর্মক্ষেত্রে অনেক বেশি স্বাধীনতা ভোগ করেন, যখন স্টুডিও মালিকেরা বুঝতে পারেন, তারুণ্যনির্ভর এই এন্টি-এস্টাবলিশমেন্ট সিনেমাগুলোর বাজারদর কী রকম বিপুল হতে পারে।’ [Schatz 197]
বনি অ্যান্ড ক্লাইডকে এই উন্মত্ত তরুণদের কাছেই পরিবেশন করা হয়েছিল। বোসলি কাউথারও তাতে সায় দিয়ে বলছেন, ‘বনি অ্যান্ড ক্লাইড নির্মাণের পেছনের সমীকরণটা ছিল, বিটলস্ এবং বব ডিলানের সাথে বেড়ে ওঠা স্বাপ্নিক এবং আচ্ছন্ন তারুণ্যকে খুশি করা, যারা নিজের কাজ নিজে করার দর্শনে বিশ্বাসী এবং এন্টি-এস্টাবলিশমেন্টকে মনে করত সুন্দর ও সাহসী পন্থা।’ [Friedman 94] যদিও ১৯৩০ সালের অর্থনৈতিক মন্দার পটভূমিতে এই চলচ্চিত্র নির্মিত, রবার্ট ব্রেনটন, চিত্রনাট্যকারদের একজন মনে করেন, ‘দর্শকেরা বারংবার ধারণা করেছেন, চলচ্চিত্রটি মূলত ভিয়েতনাম সম্পর্কিত... লি হার্ভি অসওয়াল্ড বা পুলিশি নিষ্ঠুরতাকেন্দ্রিক...।’ [Slocum 70]
যাহোক, টেক্সট-সাবটেক্সট দুই-ই আমেরিকান হলেও, হলিউডের এই গুরুত্বপূর্ণ চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের ধারণা বা নির্মাণের অনুপ্রেরণা ছিল প্রকৃতপক্ষে ফরাসি নব তরঙ্গবাদী আন্দোলন, যার সঙ্গে হলিউড এবং তার কমোডিটি চলচ্চিত্রগুলোর রয়েছে বহুমাত্রিক সম্পর্ক।
ইউরোপের ঢেউ: গদার এবং ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে গদার এবং তাঁর সহযোদ্ধারা হলিউডকে একটু অন্য দৃষ্টিতে দেখা শুরু করেন। জিল ফর্বসের বিশ্লেষণে, ‘হ্যারল্ড ব্লুম যাকে the anxiety of influence বলছেন, তার পূর্ণাঙ্গ প্রয়োগ দেখা যায় নিউ ওয়েভ ফিল্মগুলোতে। যা কিনা হলিউডকে একদিকে দেখেছে ইউরোপীয় উঁচু দরের শিল্পের সংহারকারী রূপে, অন্যদিকে অনুকরণের উপাদান বা উৎস হিসেবেও বিবেচনা করেছে। এ থেকে বোঝা যায়, কেন গদার এবং ত্রুফো ব্রেথলেস এবং স্যুট দ্য পিয়ানো প্লেয়ার-এর জন্য আমেরিকান সাহিত্যের রূপান্তর চেয়েছিলেন, অথচ প্রয়োগের ক্ষেত্রে বিপ্রতীপ পদ্ধতি এবং সচরাচর গল্প বলার রীতি উপেক্ষা করে নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।’ [Wills 109]
আর এই প্রবণতাকে বুঝতে হলে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর ফ্রান্সে (৫০ ও ৬০) সিটুয়্যাশনিস্ট বা আধুনিক মার্কসবাদীদের উত্থানের প্রেক্ষাপট অতীব গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা ‘Detournement’ সাহিত্যিক অনুবাদে ‘পথ পরিবর্তন বা বিপথে পরিচালন’-এর পদ্ধতি অনুসরণ করতেন। সিটুয়্যাশনিস্টরা এই প্রক্রিয়াকে ‘সাংস্কৃতিক ছিনতাই’ বা ‘বুদ্ধিবৃত্তিক শুদ্ধীকরণ’ বলেও বিবেচনা করতেন। যে পদ্ধতিতে শত্রুর প্রভাব বিস্তারকারী সংস্কৃতির একটা ক্ষুদ্র অংশ তার বৃহৎ প্রেক্ষাপট থেকে আলাদা করে ছিনিয়ে নিয়ে, তাকে আধুনিক জীবনের নিপীড়নের বিরুদ্ধে পরিচালনা করা অর্থাৎ যে উৎস থেকে তার সৃষ্টি, সেই উৎসকেই আঘাতের দিকে ধাবিত করা যেত। [Wills 54-55]
গদারও তাঁর চলচ্চিত্রে এই পদ্ধতির সফল ব্যবহার করতে পিছপা হন না। তাঁর হাতে হলিউডের ব্যবহৃত Genre বা ঘরানাসমূহ, যেমন—কমেডি, মেলোড্রামা, যুদ্ধছবি, সায়েন্স ফিকশন প্রভৃতি নতুনভাবে নির্মিত হয়েছে। প্রতিবারই তিনি হলিউড থেকে হাওলাদকৃত সহিংসতা এই চলচ্চিত্রগুলোর অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাঁর বুদ্ধিবৃত্তিক গভীরতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার আলোকে সেই উপাদানকেই হলিউড এবং তার মোড়ল পুঁজিবাদ—আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পরিচালনা করেতে দ্বিধা বোধ করেননি। এ বিষয়ে কলিন ম্যাকাভি বলছেন, ‘গদারের শুরুর দিককার চলচ্চিত্রগুলোর রাজনৈতিক অনুসন্ধিৎসা মূলত চলচ্চিত্রের আঙ্গিকের অনুসন্ধান, যা রাজনীতিকে ব্যক্ত বা বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে; যেমনটা দেখা যায়, থ্রিলারের ক্ষেত্রে আলফাবিল (Alphavile) এবং ওয়ার ফিল্মের ক্ষেত্রে লে ক্যারাবিনিয়ের (Les Carabinier)-এ। কিন্তু ষাটের দশকে যখন রাজনৈতিক চাপ বৃদ্ধি পেতে থাকে, বিশেষ করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রভাবে, গদার কর্তৃক রাজনীতিকে ধারণ করার মতন সঠিক ফর্মের অনুসন্ধান যা নিজেই রাজনীতির জন্ম দেয় এবং যে রাজনীতি আবার আঙ্গিকেরই পরিপূরক—এই পুরো প্রক্রিয়াটাই একটা ব্যাপক গতিশীলতা লাভ করে।’ (MacCabe 51) এ ছাড়া গদার এবং সেই সময়কার ফ্রাঁন্সের তরুণ প্রজন্ম যারা পঞ্চাশের দশকের আলজেরিয়ান ক্ষত দ্বারা বিক্ষত ছিল, তাদের কাছে ঘরোয়া রাজনীতির পাশাপাশি সাম্রাজ্যবাদ—মার্কিন অথবা সোভিয়েত—দুই-ই সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিল। আর সেই ক্ষতের অনূদিত শিল্পরূপ ন্যুভেলভাগ চলচ্চিত্রগুলোর প্রভাব দ্রুতই হলিউড পর্যন্ত বিস্তারিত হয়।
সহিংসতার শৈল্পিক প্রয়োগ
গদার এবং আর্থার পেন দুজনেই সিনেমায় অতিরিক্ত সহিংসতার প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। গদারের নৈতিক ও রাজনৈতিক পরিচ্ছন্নতা থাকা সত্ত্বেও জন সিমন্স তাঁর ব্যবহৃত সন্ত্রাসের সমালোচনা করে বলেছেন,
‘সাম্প্রতিক সিনেমায় ব্যবহৃত সন্ত্রাসের স্বরূপ নিকৃষ্ট এবং আত্মসংহারী। এ চলচ্চিত্রগুলোতে নিজস্ব আঙ্গিকের পাশাপাশি, যাবতীয় সমস্ত আঙ্গিকের সন্ত্রাসের ব্যবহার পরিলক্ষিত হয়, যা এমনকি সর্বোত্তম অ্যাবসার্ডিস্ট বেকেট অথবা দুর্বোধ্য আউট ’ল জেনেটের পক্ষে স্বপ্নেও কল্পনা করা অসম্ভব।’ [Collet 162-163]
এই সন্ত্রাসকে আরও সাবলীল ও গতিময় করে এর সঙ্গে সংযুক্ত কমিক এনার্জি। আর্থার পেনও একই পদ্ধতি অনুসরণ করতে উদ্যোগী। বনি অ্যান্ড ক্লাইডে দেখা যায়, প্রতিবার একটা সফল ডাকাতির পর, সংক্ষিপ্ত কাট-এ চোর-পুলিশ খেলার একটা ফার্সিক্যাল দৃশ্য। যাতে নিরীহ পুলিশের গাড়ি ডাকাতদের (ব্যারো গ্যাং) প্রায় ধরে ফেলে। কিন্তু প্রতিবার তারা ফসকে যায়। একই দৃশ্য দেখা যায়, ব্রেথলেস কিংবা পিয়েরে লা ফু’তেও, কোনোবারই পুলিশ তার কাজে সফলকাম হতে পারে না। বনি অ্যান্ড ক্লাইড-এর জাম্প কাটনির্ভর শুরুটা মূলত ফ্রেঞ্চ নিউ ওয়েভের অন্যতম চলচ্চিত্র গদারের ব্রেথলেস থেকে ধার করা।
চোখ দুই, দৃষ্টি এক: ব্রেথলেস-এর সাথে সাদৃশ্য
একগুচ্ছ ক্লোজ ও মিডিয়াম শটের ডামাডোলে ব্রেথলেস-এর সূচনা। এস্টাবলিশিং শটের কোনো বালাই নেই। তারপর মূল চরিত্র মিশেল, মোটরসাইকেল আরোহী একজন পুলিশ অফিসারকে হত্যা করে। শটগুলো আরও দ্রুত এবং সংক্ষিপ্ত হয়, চিরায়ত ১৮০ ডিগ্রির কোনো তোয়াক্কা না করেই ক্যামেরা মুভ করে। এই দ্রুত লয়ের, মনোযোগ বিনষ্টকারী সিকোয়েন্সগুলো মিশেল কর্তৃক অকারণ হত্যাকাণ্ডের মুডকে প্রতিফলিত করে। ঠিক একই রকম ইফেক্ট আরও একটু নিচু লয়ে, শট-রিভার্স শটের মাধ্যমে তৈরি হয় বনি অ্যান্ড ক্লাইড-এ প্রদর্শিত প্রথম গ্রাফিকস ভায়োলেন্সের দৃশ্যে। যে দৃশ্যে চলমান গাড়ির মধ্যে উঠে পলায়নরত ব্যাংক ক্লার্ককে লক্ষ্য করে গুলি করা হয়।
আরও এক জায়গায় দুই চলচ্চিত্রের সাদৃশ্য মেলে। ব্রেথলেস-এ মিশেল সাধারণত একটি লেন্সসংবলিত চশমা ব্যবহার করে। অন্যদিকে, ক্লাইড ব্যারোকেও ক্লাইমেক্সের সময় দেখা যায়, এক কাচবিহীন চশমাসমেত। দুই চলচ্চিত্রেই এটিকে পুঁজিবাদী সমাজের এক চক্ষুনীতির প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায়। যে নীতি শুধু ধনীকে বিবেচনায় নেয়, গরিবের স্থান যার টেক্সটবুকে নেই। এই ধনী-গরিবের দ্বন্দ্ব কিছুটা ভিন্নভাবে হলেও ওয়ার ফিল্মের গদারীয় সংস্করণ লে ক্যারাবিনিয়ের-এর মধ্যেও পরিলক্ষিত হয়।
বুলেট-রক্ত দর্শন-ইমেজ: লে ক্যারাবিনিয়ের-এর সঙ্গে বৈসাদৃশ্য
লে ক্যারাবিনিয়ের-এ দুই বন্ধু রাজার জন্য যুদ্ধে যায় এবং নিষ্ঠুর বেপরোয়া হত্যাকাণ্ডে লিপ্ত হয়। অনুশোচনাহীন যুদ্ধাপরাধ অব্যাহত থাকে। রাজার কল্যাণই উত্তম দোহাই। রাজাও যুদ্ধ শেষে তাদের চাহিদা মোতাবেক বস্তু ও স্থাপনা দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু যুদ্ধ শেষে, অবস্থা তথৈবচ। পাবার আশা-হতাশায় রূপান্তরিত; প্রত্যাশার ফটোগ্রাফ-সংবলিত পোস্টকার্ডই বাড়ি ফেরার সঙ্গী। একজনের খোয়াবে ছিল দামি মডেলের গাড়ি আর অন্যজনের মিসরের পিরামিডের মালিকানা। অন্তহীন চাহিদার বিপরীতে দুজনই বস্তু না পেয়ে, পায় ইমেজ। গরিবের স্বপ্ন থাকে অধরা। এই প্রেক্ষাপটে সারা দুনিয়ার প্রলেতারিয়েত যেন এক। ব্যবহারের পর তাদের ছুড়ে ফেলে রাজা অথবা পুঁজির মালিক।
ব্যারো গ্যাং-এর আইনের প্রতি বুড়ো আঙুল দেখানোর প্রক্রিয়ায় পরিচালক আর্থার পেন আমেরিকার রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং বিদেশনীতিরও প্রচ্ছন্ন প্রতিবাদ করেন। কিন্তু রাজনীতি-সম্পর্কিত সরাসরি কোনো তথ্য বা বক্তব্য পুরো কাহিনিতে নেই। আর এ অবস্থানে গদার একেবারেই নির্ভীক এবং নিঃসংকোচ। পিয়েরো লা ফু সিনেমায় আলজেরিয়া আর ভিয়েতনাম যুদ্ধের প্রসঙ্গ বারেবারে এসেছে দৃশ্য-সংলাপ-ন্যারেশনের আওতায়। ম্যারিয়েনের কথামতো গাড়ি ধ্বংস করার অভিপ্রায়ে ফার্দিনান্দ যখন রাইফেল বের করে, তখন তাকে শনাক্ত করতে গিয়ে বলে, ‘হায় খোদা! এটা তো একই প্রকৃতির যেটা দিয়ে খোদ কেনেডিকেই হত্যা করা হয়।’ আমেরিকান সন্ত্রাসবাদের থাবা যে প্রয়োজনে, তার রাষ্ট্রপ্রধানকেও বিনাশ করতে দ্বিধাহীন, সেই প্রসঙ্গই যেন অনেকটা কৌতুকের আদলে এই সংলাপে প্রকাশিত হয়। তা ছাড়া একেবারে শেষ দৃশ্যে ফার্দিনান্দের আত্মহত্যার বিস্ফোরণ আমেরিকার নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণের প্যারালাল রূপে ধারণা করা দোষের কিছু নয়। তবে এই প্যারালাল আরও এক মাত্রা বেড়ে অ্যাবসার্ডিটিতে পরিণত হয় গদারের আশির দশকের চলচ্চিত্র প্রেনম কারমেন-এ। যদিও এর নির্মাণ বনি অ্যান্ড ক্লাইডের অনেক পরে, কিন্তু সহিংস দৃশ্যাবলি রচনার অভিনবত্ব চলচ্চিত্রটিকে এই আলোচনায় প্রাসঙ্গিক করে।
ডাকাতির করাল গ্রাস: প্রেনম কারমেন-এর সঙ্গে সম্পর্ক
ব্যাংক ডাকাতির মোট তিনটি দৃশ্য বনি অ্যান্ড ক্লাইডে প্রদর্শিত হয়। প্রথমটা হাস্যকর এবং ব্যর্থ; কারণ, ব্যাংক নিজেই ঋণখেলাপি। দ্বিতীয়টি হাস্যরস এবং ভীতির সংমিশ্রণ, কারণ কাহিনির প্রথম হত্যাকাণ্ড এই পর্বে সংযুক্ত। আর তৃতীয়বারে স্পষ্ট হয়, পুরো দলটি তাদের শক্তি সামর্থ্যের শিখরে এবং ব্যারো কিংবদন্তির সর্বোচ্চ ছাপ জাজ্বল্যমান তাদের কাজে। এখন তারা পাঁচ সদস্যের দল এবং তাদের কর্মকৌশল পুরোপুরি পেশাদারিত্বে ভরপুর। যদিও ডাকাতিগুলো সংঘটিত হয় উচ্ছ্বাসের আবহে এবং সেটাকে আরও গতি দেয় রিদমিক ব্যাঞ্জর মিউজিক; কিন্তু পুরো ব্যাপারটা ঘটে একটা রিয়েলিস্টিক প্যাটার্নে। তা ছাড়া, এই ডাকাতি দ্বারা উপার্জিত অর্থই এখন তাদের জীবিকা ও সুনামের উৎস। সর্বশেষ ডাকাতির দৃশ্যে, ব্যাংকের একজন গরিব কৃষক ক্লায়েন্টকে তারা অব্যাহতি দেয়, কোনো অর্থ তাকে দিতে হয় না; যেটা তাদের নিজ শ্রেণির প্রতি মমত্ববোধের প্রকাশ ঘটায়। এই পক্ষপাত শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে তাদের জনপ্রিয়তা এনে দেয়, যে নিম্নবিত্তরাই তিরিশের অর্থনৈতিক মন্দার মূল শিকার। অপর দিকে, তাদের এই কর্মকাণ্ড কিন্তু প্রলেতারিয়েতের কাছে ত্রুটিযুক্ত প্রতিবাদের ভুল বার্তাও পাঠায়। যাতে আখেরে মালিকপক্ষ বা পুঁজিপতিরাই লাভবান হয়। কারণ, এই ধরনের চিন্তাহীন প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত ধোপে টেকে না এবং একে নিয়ন্ত্রণে আনাও সহজ।
অন্যদিকে প্রেনম কারমেন-এ গদার অভিনব আঙ্গিকে, অনেকটা কমিক এবং অ্যাবসার্ডিস্ট ফর্মে ডাকাতির দৃশ্য চিত্রায়িত করেন। এই চলচ্চিত্রে, কারমেন নামের এক সুন্দরী একটি ব্যর্থ ডাকাতির একপর্যায়ে তাকে প্রতিরোধকারী গার্ডকে বশীভূত করে নিজ বাড়ির পথ চেনায়। যখন গার্ড আর ডাকাতদের মধ্যে গুলি বিনিময় চলে, ব্যাংকের গ্রাহকেরা তাদের স্বাভাবিক কাজকর্ম অব্যাহত রাখে। একজন তো মেঝেতে বসে বই পড়ে, যখন তার চারপাশে চলছে ব্যাপক গুলি বিনিময়। এই ছবির প্রোটাগনিস্টরা পারস্পরিক ভায়োলেন্সের মাঝখানে প্রেমে পড়ে। প্রথমে একজন আরেকজনকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে তাড়া করে। পরে গুলি ফুরিয়ে গেলে পরস্পরের ওপর আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্রোধ রূপান্তরিত হয় প্রণয়ে, একটি গভীর চুম্বন দৃশ্য তার আধার। এর মধ্যে রক্তাক্ত মেঝেতে পড়ে কাতরাচ্ছে আহতরা। একজন ক্লিনার মনোযোগসহকারে বালতি আর ব্রাশ নিয়ে মেঝের রক্ত মোছায় ব্যস্ত, যেন এটা একটা রুটিন ওয়ার্ক। বোঝা যায়, ব্যাংক মানেই মেঝেতে অবশ্যম্ভাবী রক্ত ছোপ এবং তার পরিচ্ছন্নতার দায়ভার উপস্থিত ক্লিনারের। পুরো দৃশ্যটির আবহে এবং ইন্টারকাটে থাকে বিটোবেনের দলীয় পরিবেশনা।
ডাকাতির এই অ্যাবসার্ডিটি সত্যিই স্যামুয়েল বেকেটকেও হার মানায়। এটা স্পষ্ট হয়, পুঁজিবাদী সমাজে সন্ত্রাস কতটা গা সওয়া এবং অর্থের সঙ্গে তার প্রণয় কতটা গভীর। অথবা পুঁজিবাদ নিজেই একটা অ্যাবসার্ডিটিতে ভরা পদ্ধতি, যা সৃজনশীল মানুষের বাসের অনুপযোগী। বনি অ্যান্ড ক্লাইডে ব্যারো গ্যাং ডাকাতি করে অর্থনৈতিক মন্দার সরাসরি শিকার হয়ে জীবনধারণের তাগিদে, আর এখানে কারমেন ডাকাতি করে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের তহবিল সংগ্রহের জন্য। ডাকাতির যৌক্তিকতার দিক থেকে বনি অ্যান্ড ক্লাইড অনেক বেশি গ্রহণযোগ্য, কিন্তু ফিল্ম স্টাইল এবং মেটাফোরের দিক থেকে কারমেন গভীরতম এবং অগ্রগামী।
শেষ গন্তব্য কোথায়?
পরিচালক আর্থার পেন সহিংস দৃশ্যগুলোতে গদারের মতো পুরোপুরি অ্যাবসার্ডিস্ট ফর্মে না গেলেও গতি এবং কমিক টোনের ব্যবহার করেছেন সফলভাবে। কিন্তু ন্যারেটিভের ক্ষেত্রে ক্ল্যাসিক হলিউডের সিমেট্রিক্যাল গল্প বলার রীতিকে পুরোপুরি বর্জন করেননি। বনি অ্যান্ড ক্লাইডে যদিও সন্ত্রাসের প্রায়োগিকতা অনেকখানি গদারের চলচ্চিত্র ধারার সদৃশ; কিন্তু সামাজিক-রাজনৈতিক দিক নির্দেশনার ক্ষেত্রে হলিউডের অন্যান্য ধারার মতোই অস্পষ্টতা প্রদর্শন অব্যাহত থাকে। সে কারণে এই চলচ্চিত্র নিপীড়নের চিহ্নিত হোতা ধনতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে না পৌঁছে, আর্ট ফিল্মের আদলে আরেকটি গ্যাংস্টার ফিল্মেই পরিণত হয়। অন্যদিকে, গদারের চলচ্চিত্রের উচ্চমান তাদেরকে প্রতিবাদী এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চলচ্চিত্ররূপে সিনেমার ইতিহাসে জারি রাখে। তারপরও নিউ হলিউড ফিল্মগুলো ক্ল্যাসিক হলিউডের ঘেরাটোপকে ভেঙে একটি নতুন হলিউডি চিন্তার উদ্রেক ঘটায় এবং আমেরিকার গ্যাংস্টার ঘরানাকে বিষয় ও প্রায়োগিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ করে।
বনি অ্যান্ড ক্লাইডকে যদি আরও র্যাডিকেল দর্শন প্রদর্শন করতে হয়, তবে তাদের অবশ্যই বৃহৎ স্টুডিওর থাবা তথা হলিউডের মৌলিক পুঁজিবাদী ধারা থেকে বেরিয়ে আসার কোনো বিকল্প নেই। আর তা না হলে তারা সেই পুরোনো হলিউডেই ঘুরপাক খাবে শুধু একটি নতুন ভিশনকে মাথায় রেখে। আর সেটাই চান স্টুডিও মালিক অথবা তথাকথিত বুর্জোয়া শ্রেণি। তাই তরঙ্গায়িত তরঙ্গ লক্ষ্যচ্যুত হলেও ষাট বছর পরে আজকের দিনে, চলচ্চিত্রে আবারও ষাটেরই মতন অথবা ভিন্ন মাত্রায় নূতন র্যাডিকেল আন্দোলন গড়ে ওঠার সম্ভাবনাকে নাকচ করা যাবে না। যে আন্দোলন বনি পার্কার এবং ক্লাইড ব্যারোদের মতন সর্বহারা অথবা আমেরিকান তারুণ্যকে সঠিক পথের সন্ধান দেবে এবং দিনবদলের সংগ্রামকে অগ্রগামী করতে উদ্যত হবে। এই ক’বছরে বিশ্ব মানচিত্র পাল্টে গেলেও প্রলেতারিয়েতের জাগার দিন ফুরিয়ে যায়নি বলেই আমার বিশ্বাস। আর গদারের চলচ্চিত্রের ধারায় মার্কসের উদ্ধৃতি ধার করলে বলতে হয়, ‘সর্বহারার হারাবার আছে শুধু শৃঙ্খল, পাওয়ার আছে পুরো দুনিয়াটাই।’ হলিউডের কমরেডরাও এতে সায় দেবেন বলে ব্যাপক প্রত্যাশা রইল।
তথ্যসূত্র
Cawelti, John G (ed.) 1973, Focus on Bonnie and Clyde, Prentice-Hall, Englewood Cliffs.
Collet, Jean (ed.)1970(1963), Jean-Luc Godard, Crown Publishers, New York.
Friedman, Lester D. (ed.) 2000, Arthur Penn’s Bonnie and Clyde, Cambridge UP, Cambridge.
Hayden, Nicola & Wake, Sandra (eds.) 1983 (1972), Bonnie and Clyde, Lorrimer Publishing, Surrey.
King, Geoff 2002, New Hollywood Cinema, An Introduction, Colombia UP, New York.
Lauria, Mark Asa 1987, Tradition and Transformation in new Hollywood Cinema, Griffith University, Brisbane.
MacCabe, Colin 1983, Godard: Images, Sounds and Politics, BFI, London.
Roud, Richard 1967, Godard, Martin Secker & Warburg, London.
Schatz, Thomas 1983 (1976), Old Hollywood/New Hollywood-Ritual, Art, and Industry, UMI Research Press, Michigan.
Slocum, David J. (ed.) 2001, Violence and American Cinema, Routledge, New York.
Wills, David (ed.) 2000, Jean-Luc Godard’s Pierrot le fou, Cambridge UP, London.
চলচ্চিত্রসূত্র
Bonnie and Clyde 1992 (1967), motion picture, Warner Home video, Director: Arthur Penn.
Breathless 2001(1959), motion picture, Fox Lorber home video, New York, Director: Jean-Luc Godard.
Les Carabiniers 2001 (1963), motion picture, Winstar, New York, Director: Jean-Luc Godard.
Pierrot Le Fou 1998 (1965), motion picture, Fox Lorber home video, New York, Director: Jean-Luc Godard.
Prenom Carmen 1998 (1983), motion picture, Fox Lorber home video, New York, Director: Jean-Luc Godard.