আকবর আলি খানের ‘বাঙালি মুসলমান’ বিচার
সতত অনুসন্ধানী একজন জ্ঞানতাত্ত্বিক গবেষক ছিলেন আকবর আলি খান। জ্ঞানকাণ্ডের বিভিন্ন বিষয়ে প্রশ্ন যেমন জারি রেখেছিলেন, তেমনি ব্রতী ছিলেন সেসবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও ‘সুলুকসন্ধানী’ সিদ্ধান্তে। ‘সুলুকসন্ধানী’ এই অর্থে যে, উনার সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রবণতা ছিল অভিনব ও আগ্রহোদ্দীপক। সিদ্ধান্তে উপসংহার টানতেন না কখনোই। উসকিয়ে রাখতেন নতুন আলোচনা-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও প্রশ্নের সুযোগ। উনার সিদ্ধান্তের ব্যতিক্রমিতা ছিল নতুন গবেষণার দ্বার খুলে দেওয়ার মধ্যে। গবেষণাও যে প্রবহমান নদীর মতো হতে পারে, আকবর আলি খানের গবেষণা সেই সত্যকে করেছে উন্মোচন। বহুধা বিষয়ে ছিলেন আগ্রহী। বাংলা গবেষণা সাহিত্য নানাভাবে ধন্য হয়েছে এ রকম একজন ভিন্নমাত্রার এবং প্রথাভাঙা গবেষককে পেয়ে। বিবিধ কাজের মধ্যে উনি সম্ভবত আগ্রহী ছিলেন বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষাকে খুঁজে ফেরায়। এরই অংশ হিসেবে বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য নিয়ে গবেষণায়ও ছিলেন নিবিষ্ট। আমাদের হাতে রয়েছে এ-সম্পর্কিত দুটি বই।
আকবর আলি খান ‘বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা’ এবং ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ নামে গবেষণালব্ধ দুটি বই লিখেছেন; যা গবেষকদের বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণের পাশাপাশি সমীহ ও সম্মানও অর্জন করেছে বিদ্বজ্জন মাঝেও। কিন্তু বই আকারে বের করার পরও তিনি এতদ্বিষয়ক গবেষণায় আরও অনুসন্ধানী ছিলেন। গবেষণাকে দায়সারা কিংবা প্রকল্পের অংশ হিসেবে না নিয়ে কেবল জীবনব্যাপী সাধনারূপে জ্ঞান করলেই একজন আকবর আলি খান হওয়া যায় বলে আমরা মনে করি। সকল বাধা ও বন্ধুর পথ উজিয়ে গবেষণার সঙ্গে লেগে থাকার অনন্য এক নজির রেখে গেছেন তিনি। তর্ক বাংলা থেকে প্রকাশিত সাহিত্য পত্রিকা ‘তর্ক’র প্রথম বর্ষের প্রথম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে আকবর আলি খানের একটা অভিভাষণ। রিডিং ক্লাব ট্রাস্ট ও জ্ঞানতাপস আব্দুর রাজ্জাক বিদ্যাপীঠ আয়োজিত জনবক্তৃতার অনুষ্ঠানে তিনি ওই অভিভাষণ দেন। অভিভাষণটি পাঠে স্পষ্ট হয় যে, তিনি বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা, বাঙালি মুসলমানের উৎপত্তি, বাংলায় ইসলামের প্রচার ও প্রসার এবং বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্যের নেপথ্যের কারণ ও যুক্তি নিয়ে অনসন্ধিৎসু ছিলেন। ব্যক্তিগত দুঃখ-কষ্ট-অসুখ-বিসুখ এবং পারিবারিক শোক ও প্রিয়জন হারানোর ব্যথা নিয়েও গবেষণা ও চিন্তা উৎপাদনে তিনি সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু আকস্মিক মৃত্যুতে স্থায়ী দাঁড়ি পড়ল উনার ইচ্ছা-সাধনা ও প্রত্যয়ের ওপর। এই লেখা কৃতী ও কীর্তিময় জীবন-কর্মের প্রতি শ্রদ্ধাস্বরূপ। আমরা প্রথমে চকিতে উনার জীবনরেখা ও কর্মপরিসর উপস্থাপনের পাশাপাশি আগ্রহের কেন্দ্রে থাকা গবেষণালব্ধ কাজ পাঠপূর্বক আমাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-সিদ্ধান্ত ও প্রশ্ন হাজির করার চেষ্টা করেছি।
এক. আকবর আলি খান ইতিহাসের ছাত্র ছিলেন। উচ্চতর শিক্ষা নিয়েছেন অর্থনীতিতে। চাকরিসূত্রে কাজ করেছেন বিভিন্ন জায়গায়। সরকারি চাকরিবিধির শুরু থেকে শেষের সব পাঠ নিয়েছেন প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। রাষ্ট্র-প্রশাসন-সমাজ, দেশ ও জনগণকে বুঝেছেন নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে। বলা যায়, এখানে তিনি রাষ্ট্র ও সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষার্থী। ছাত্রজীবনের কৈশোরক বয়সেই হয়ে ওঠেন বই পড়ুয়া। মা ও পরিবার এবং অন্যান্য আত্মীয়স্বজনের সহযোগিতায় বই সংগ্রহ করতেন দূরের লাইব্রেরি থেকে, কিনতেনও। এ সময় সাহিত্য ছিল তাঁর আগ্রহের কেন্দ্রে। একজন ব্যক্তির এভাবে নানান পাঠের মধ্য দিয়ে আমরা যাঁকে খুঁজে পাই, তিনি হলেন লেখক-গবেষক-সমাজ ও রাষ্ট্রচিন্তক আকবর আলি খান।
‘প্রহেলিকা’ শব্দটা আকবর আলি খান ব্যবহার করেছেন ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ে। সুলুকসন্ধানের বিষয় হলো, এই শব্দের প্রয়োগ করে তিনি চমৎকারভাবে সেসব খোলতাই করার চেষ্টাও করেছেন। আকবর আলি খানের বেশির ভাগ লেখালেখি এবং গবেষণা যেহেতু ‘টেক্সট টু টেক্সট’, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি
একজন ব্যক্তি কীভাবে প্রতিষ্ঠান হয়ে ওঠেন, দেশ ও জাতির দিশা হয়ে দেখা দেন, তার অনন্য এক উদাহরণ তিনি। বিরলপ্রজ শব্দের অতি ব্যবহারে, আক্ষরিক অর্থে এর আবেদন-ওজস্বিতা স্তিমিত প্রায়। সদর্থক অর্থেই এই শব্দের প্রয়োগ প্রধানত যাঁদেরকে মানায়, আকবর আলি খান তাঁদের অন্যতম।
বিরলপ্রজ এই ব্যক্তিত্বের সকল কাজের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি যুক্তি দিয়ে কথা বলতেন। লেখালেখি ও বয়ানে সবিশেষ এই গুণপণার সঙ্গে জারি ছিল স্পষ্টবাদিতার প্রতি পক্ষপাত। সহজাতভাবেই ছিলেন ভীষণ রকমের অধ্যবসায়ী-গবেষণানিষ্ঠ প্রাণ। এবং এই গুণপনাই তাঁকে পরিচিতি দিয়েছিল স্পষ্টবাদী এক বক্তারূপে। যা বিশ্বাস করতেন, যাতে আস্থা রাখত উনার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ ক্ষমতা-এষণাপ্রাপ্ত উপাদান ও অনুষঙ্গ, তাই-ই বলতেন অনায়াসে। এবং এসবের মধ্য দিয়ে আমরা খুঁজে পাই একজন জনযুক্তিবাদী চিন্তককে, একজন জনবাদী স্পষ্ট বক্তাকে, স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ একজন জ্ঞানতাত্ত্বিককে।
যখন সত্য প্রকাশে অনেকেই দ্বিধান্বিত ও নানা সমীকরণে ব্যতিব্যস্ত, তখন আকবর আলি খান ছিলেন কুণ্ঠাহীন-সত্যবাদী একজন যুধিষ্ঠির। যিনি জন্মেছিলেন ১৯৪৪ খ্রিস্টাব্দে, চিরপ্রয়াণের পথে পাড়ি দিলেন ২০২২-এর ৮ সেপ্টেম্বর। মারা যাওয়ার ঠিক এক সপ্তাহ আগে প্রধান আলোচক হিসেবে হাজির হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাহিত্যিক-সাংবাদিক-রাজনীতিক আবুল মনসুর আহমদের বই ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ নিয়ে আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত সকলেই বিস্মিত হয়েছেন তাঁর বক্তব্যে। আশি ছুঁইছুঁই বয়সে তিনি যেভাবে লিখিত আলোচনা করেছেন। গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহের যে রকম নোট দিয়েছেন। বইয়ে উল্লিখিত বিষয়কে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মতামত দিয়েছেন এবং বর্তমান সময়ে সেসবের প্রাসঙ্গিকতা কীরূপে-কীভাবে-কত প্রকারে জারি থাকার বিষয়টি দেখিয়েছেন, এককথায় ব্যাপারটা যতটা বিস্ময়ের, ততটাই প্রশংসার। আবুল মনসুর আহমদ এই বই লিখেছিলেন, যাতে রাষ্ট্রে গণতন্ত্র আসে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ধর্মনিরপেক্ষতা বিরাজিত থাকে। আকবর আলি খানের এষণা হলো, গণতন্ত্র না থাকলে এসবের কোনোটাই বাস্তবায়িত হবে না। তিনি মনে করেন, কেবল গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব। ধর্মনিরপেক্ষতার জন্য গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির বাস্তবায়ন করা জরুরি। তিনি মনে করতেন, সমাজতন্ত্র অর্থ কেবল মার্কস, লেনিনের সমাজতন্ত্র নয়, স্থানীয়ভাবেই সমাজতন্ত্র কায়েম করা সম্ভব।
আকবর আলি খান সরকারি চাকরি থেকে অবসর নিয়ে শিক্ষকতা পেশায় যুক্ত হলেও লেখালেখিকেই তিনি সাধনা হিসেবে নিয়েছিলেন। সত্যিকারার্থে যাপন করতেন আপাদমস্তক একজন গবেষক-লেখকের জীবন। প্রায় এক দশক ধরে শারীরিকভাবে জটিল রোগে আক্রান্ত ছিলেন। স্ত্রী ও একমাত্র সন্তানের চিরবিদায়ের পর লেখালেখির মধ্যে নিজের দুঃখ-কষ্ট-বেদনার উপশম খুঁজে ফিরতেন কিংবা সবাইকে ধরে রাখার চেষ্টা করতেন। একমাত্র সন্তান নেহরীন খানের ইচ্ছা ছিল, বাবা যেন সবিস্তারে লেখেন পূর্বপুরুষের ঠিকুজি। কন্যা মারা যাওয়ার পরও তিনি আত্মজার সেই ইচ্ছার কথা বিস্মৃত হননি, লিখেছেন আত্মস্মৃতিমূলক বই, ‘পুরানো সেই দিনের কথা’।
কন্যার প্রতি একজন পিতার অপত্যস্নেহ যেমন কখনো শেষ হওয়ার নয়, আকবর আলি খানেরও সেটা হয়নি; বরং তিনি যেমন কন্যাস্নেহের দায়বদ্ধতা পালন করেছেন, তেমনি জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থেকেছেন সর্বক্ষণে। জনগণের প্রতি এই দায়বদ্ধতা থেকেই তিনি দেশপ্রেমের দায় মিটিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হয়েছেন কেবল দেশপ্রেমের দায় থেকে নয়—দেশকে ভালোবেসেও। এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে আমি যুদ্ধে যোগ দিইনি। যোগ দিয়েছিলাম যখন দেখলাম, ওরা নির্বিচারে আমার দেশের মানুষকে হত্যা করছে। দেশের মানুষের প্রতি এই অবিচার-অন্যায় আমি সহ্য করতে পারিনি। এসব দেখে-শুনে আমার মনে হয়েছে, মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়া আমার দায়িত্বের মধ্যে পড়ে—আমি যুদ্ধে যোগ দিয়ে সেই দায় মিটিয়েছি। উল্লেখ্য, পাকিস্তান সরকারের একজন চাকরিজীবী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন, তিনি ছিলেন একেবারে শুরুর দিকের একজন। একজীবনে যতটা ঝুঁকি নেওয়া যায়, ঠিক ততটাই নিয়েছেন। ব্যাংকের ভল্ট ভেঙে ট্রাকে করে তিন কোটি টাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করেছেন যুদ্ধকালীন প্রবাসী সরকার পরিচালনার সুবিধায়-মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যার্থে। এসবের কারণে উনার অনুপস্থিতিতে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছে পাকিস্তান সরকার। তিনি মনে করতেন, বাঙালির ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ঘটনা স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়া।
মুক্তিযুদ্ধ শেষে তিনি কিছুদিনের জন্য শিক্ষকতা পেশা ছাড়াও জীবনের পুরোটা সময় কাটিয়েছেন সরকারি চাকরিতে, থেকেছেন বিভিন্ন পদে নানান জায়গায়। এ সময় ন্যায়নিষ্ঠা ও সততার মূর্ত প্রতীক হিসেবে গড়ে তুলেছেন নিজের ভাবমূর্তি। যার সুবাদে ও কল্যাণে অলঙ্কৃত করেছেন সরকারি চাকরিবিধির সর্বোচ্চ পদ। হয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টা, যদিও ন্যায্যতার সঙ্গে কাজ করার সুযোগ ও পরিবেশ না পাওয়ায় আরও তিনজন উপদেষ্টার সঙ্গে ইস্তফা দেন এই পদ থেকে। এসব পরিচয়কে ছাড়িয়ে তিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অন্য এক উচ্চতায়। যার আয়ুষ্কাল সহসা হারিয়ে যাওয়ার নয়, চাইলেই বিস্মৃত হওয়ার নয়। এখানেই নিহিত আছে একজন আকবর আলি খানের জীবনের সাফল্য ও সার্থকতা।
যত দিন বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি থাকবে, তত দিন আকবর আলি খানের গবেষণানিষ্ঠ কাজগুলো তাঁকে স্মরণীয়, প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয় করে রাখবে। কারণ, তিনি আমাদের জাতিসত্তার অন্বেষণে ব্রতী ছিলেন। ‘বাংলাদেশের সত্তার অন্বেষা’, ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারের সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের শিকড়ে নতুন আলো খোঁজার চেষ্টা করেছেন। নতুন চিন্তাকে হাজির করার চেষ্টা করেছেন। এ ক্ষেত্রে রিচার্ড ইটন, অসীম রায়ের গবেষণার বাইরেও তাঁর চিন্তাভাবনা নতুন আলোচনার খোরাক জুগিয়েছে। শুধু এই বইগুলোতে নয়, আকবর আলি খানের বইয়ের বিশেষত্ব হলো, সকল গবেষণাতেই তিনি বহুমাত্রিক অর্থ অনুসন্ধানের চেষ্টা জারি রাখেন। তিনি যেহেতু ইতিহাস-অর্থনীতি-সমাজ ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান-সাহিত্যের শিক্ষার্থী-অনুরাগী ও অভিজ্ঞতালব্ধ ছিলেন, সেহেতু তাঁর সকল লেখালেখিতে বহুধাবিস্তৃত জ্ঞানান্বেষণের প্রয়াস ও প্রচেষ্টা ছিল উদ্দিষ্ট প্রসঙ্গের ভরকেন্দ্রস্বরূপ। এ কারণে তাঁর অভিনিবেশ-অনুসন্ধান-ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ-সিদ্ধান্ত ও মতামতের সঙ্গে অমিল হলেও উপেক্ষা কিংবা খারিজ করা সম্ভব নয়। এখানেই উনার যুক্তিবাদী সত্তার সার্থকতা।
আকবর আলি খানের যুক্তিবাদিতার প্রধান লক্ষ্য ও ঝোঁক ছিল ‘জন’ মনস্তত্ত্বকে আবিষ্কার করা। এবং সেই প্রবণতা যেমন দেখা যায় অর্থনীতি-সমাজ-রাষ্ট্র-জাতিসত্তাবিষয়ক গবেষণায়, তেমনি দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দবিষয়ক অনুসন্ধানেও।
জীবনানন্দ দাশের বহুল আলোচিত কবিতার কেন্দ্রীয় চরিত্র বনলতা সেনকে নিয়ে যে বয়ান তিনি হাজির করেছেন, তা নিঃসন্দেহে কৌতূহলের ও আগ্রহোদ্দীপক। বনলতা সেন সম্পর্কে যে অনুসন্ধান তিনি দিয়েছেন, তা পূর্বে জারি থাকা সকল পাঠ থেকে একেবারেই ভিন্নার্থের। তিনি নানা যুক্তিতর্কের মধ্য দিয়ে বলেছেন, নাটোরের বনলতা সেন আসলে একজন রূপোপজীবিনী। এই অন্বেষণের সবিশেষ গুরুত্ব হলো কারও পছন্দ-অপছন্দের চেয়েও এখানে যেসব যুক্তিতর্ক হাজির করা হয়েছে এবং তার মধ্য দিয়ে কত বিষয়কে যুক্ত করা হয়েছে। জীবনানন্দ দাশকে নিয়ে লেখা ‘চাবিকাঠির খোঁজে’ সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। যদিও জীবনানন্দ দাশ তাঁর প্রবন্ধে কবিতার চরিত্র সম্বন্ধে সুলুকসন্ধানী এক ধারণা দিয়েছেন এবং প্রচলিত ও আক্ষরিক অর্থে তার সৃষ্ট চরিত্র সম্পর্কে মন্তব্য ও সিদ্ধান্ত দেওয়ার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করেছেন।
আকবর আলি খান অর্থনীতিতে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় যুক্ত করেছেন, যা যতটা প্রশংসিত, ঠিক ততটা আলোচিতও। ‘শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি’, ‘সুকতলার অর্থনীতি’, ‘জুতার রাজনীতি’, ‘জন্মদিনের অর্থনীতি’ প্রভৃতি। এসব বিষয় যে একেবারে আনকোরা তা নয়। ব্রিটিশ শাসনের সময়েই ‘শুয়োরের বাচ্চার অর্থনীতি’র বিষয়টা সেই সময়ের প্রশাসনে আলোচিত ছিল। আকবর আলি খান স্বাধীন বাংলাদেশের বাস্তবতায় নতুন করে এসবের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
‘প্রহেলিকা’ শব্দটা আকবর আলি খান ব্যবহার করেছেন ‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ে। সুলুকসন্ধানের বিষয় হলো, এই শব্দের প্রয়োগ করে তিনি চমৎকারভাবে সেসব খোলতাই করার চেষ্টাও করেছেন। আকবর আলি খানের বেশির ভাগ লেখালেখি এবং গবেষণা যেহেতু ‘টেক্সট টু টেক্সট’, এখানেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। এসবের ব্যাখ্যা তিনি এমনভাবে করেছেন, যাতে পাঠক-গবেষকেরা নতুন চিন্তার খোরাক পান। ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতিই তাঁর অভিনিবেশ সীমায়িত করেছেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো প্রকার সিদ্ধান্তে যাননি। এমনকি ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ক্ষেত্রেও টেক্সটের কাছেই থেকেছেন সমর্পিত। কখনোই টেক্সটের বাইরে গিয়ে নিজস্ব দর্শন-অনুসন্ধান ও অভিজ্ঞতাকে যুক্ত করার চেষ্টা করেননি। কেন করেননি, তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে বিষয়টা আমাদের কাছে ‘প্রহেলিকা’র মতোই রয়ে গেল।
যুক্তিবাদ যখন শৃঙ্খলিত এবং চোখ রাঙানোতে শাপ ও শঙ্কাগ্রস্ত তখন একজন আকবর আলি খানের যুক্তিবাদিতা আমাদের দিশা দেখায়। এবং এই যুক্তিবাদিতার সঙ্গে যখন ‘জন’ যুক্ত হয় কিংবা সর্বৈব গুরুত্বে হাজির-নাজেল থাকে, তখন দেশ-জাতিও আশান্বিত হয়। তাঁর চিরবিদায়ের মধ্য দিয়ে আমাদের সেই দিশা দেখার সাহস ও সত্যনিষ্ঠ হওয়ার মন্ত্র ফিকে হয়ে গেল। এখন তাঁর বইগুলো আমাদের অনুপ্রেরণার শক্তি হিসেবে বিবেচিত হতে পারে, যদি সেসব থেকে দীক্ষা নিই।
একজন পেশাদার আমলা ছাড়াও আকবর আলি খান প্রশাসনিক জীবনের শুরু ও শেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক হিসেবে জীবনের অনেকটা সময় ব্যয় করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের মেধাবী ছাত্রের তকমা পেয়েছেন স্নাতক ও স্নাতকোত্তর উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে। পিএইচডি করেছেন কানাডার কুইন্স বিশ্ববিদ্যালয়ে। এসব উল্লেখ করার কারণ হলো, একজন প্রথাগত আমলা ও অ্যাকাডেমিশিয়ান হয়েও তিনি এসবের ঊর্ধ্বে ছিলেন। একজন আমলাও যে কীর্তিমান হতে পারেন, তাঁর শিক্ষা নিতে পারেন এ সময়ের আমলারা আকবর আলি খানের জীবন ও কর্মের আলোকে। আবার একজন অ্যাকাডেমিশিয়ানও যে প্রথাগত গবেষণার বাইরে গিয়ে নতুন প্রশ্ন, নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ হাজির করতে পারেন, নতুন চিন্তা উৎপাদন করতে পারেন, তার শিক্ষা নিতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা। যুক্তিবাদিতা যদি ধ্যানজ্ঞান হয় এবং এর সঙ্গে জন’র স্বার্থকে দেওয়া হয় প্রাধান্য, তাহলে সকল সময়ে সকল পরিস্থিতিতে যুক্তিগ্রাহ্য ও স্পষ্ট কথা কীভাবে বলতে হয়, তার সবক নিতে পারেন আমাদের লেখক-কবি-সাংবাদিক-সুশীল সমাজ এমনকি রাজনীতিবিদেরাও।
আকবর আলি খান জীবনভর আলোর সন্ধান করেছেন, এই সন্ধান ব্যক্তির জন্য নয়, দেশ ও জাতির জন্য। তাঁর একটি বইয়ের উপশিরোনামে ‘আলোক সন্ধান’ শব্দবন্ধ রয়েছে। এতেও অনুমিত হয়, একজীবনে তাঁর ব্রত ছিল আলোর ফেরিওয়ালা হয়ে ওঠা, বাস্তবে তিনি সেটাই হয়েছেন।
আলোর ফেরিওয়ালা আকবর আলি খানের লক্ষ্য ছিল সমাজকে আলোকিত করা। এবং সেই আলোর জন্য তিনি হেঁটেছেন ইতিহাসের পথে। বাংলার সমাজকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন-জানতে চেয়েছেন, আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছেন। তিনি সামাজিক পুঁজির তত্ত্বকেও তাঁর গবেষণায় ব্যবহার করেছেন। আমাদের জাতিসত্তার অন্বেষায় যেখানে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় হাত দেননি, সেখানেই তিনি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং তাঁর যৌক্তিকতাও উপস্থাপন করেছেন। সামাজিক পুঁজির ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান পাকিস্তান, ভারতের চেয়ে কম নয় শুধু, গড় সামাজিক পুঁজির পরিমাণেও আমরা পিছিয়ে। আমাদের সমাজের এই প্রবণতা কেন এবং কবে থেকে তা জারি রয়েছে, তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন তিনি।
বাংলাদেশের সমাজ ও প্রাচীন বাংলার সমাজের স্বাভাবিক প্রবণতা হলো, এখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের প্রকাশটা বেশি। যেটা পশ্চিমবঙ্গেও এভাবে নেই, ভারতের অন্যত্রও নেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়াতেও নেই। আকবর আলি খান মনে করেন, আমাদের সমাজ রাষ্ট্রকে বুঝতে হলে এবং আমাদের জাতিসত্তার প্রশ্নে ফয়সালা করতে হলে সমাজের এই সব বৈশিষ্ট্য ও স্বরূপ সম্পর্কে পরিষ্কারভাবে জানতে হবে। তিনি গ্রামের গড়ন নিয়েও অনুসন্ধানী ছিলেন। সমাজের মতো গ্রামের গড়নের ক্ষেত্রেও ভিন্নতা লক্ষণীয়। যে ভিন্নতা ব্যক্তিতে-সমাজে-গ্রামের গড়নে, প্রকৃতার্থে সেসবের মধ্যেই বাঙালির শিকড় ও ইতিহাসের সুলুকসন্ধান রয়েছে বলে তার অনুসন্ধান জারি রেখেছিলেন।
আকবর আলি খানের অনন্যতা ও স্বতান্ত্রিকতা হলো, তিনি যেমন ইতিহাসের ধূসর পথে একজন পরিব্রাজক-গবেষকের মতো নিরলস অনুসন্ধানী ছিলেন, তেমনি সমাজ-রাষ্ট্রের বর্তমানের সংকট ও সম্ভাবনার দাবি ও দায় মেটাতেও অবিচল ও কুণ্ঠাহীন ছিলেন। দেশ ও জাতির যেকোনো প্রয়োজনে তিনি স্পষ্টবাদী ছিলেন। ক্ষুরধার যুক্তি ও জ্ঞানের অভিনিবেশে তিনি ক্ষমতাকে প্রশ্ন করার সাহস দেখিয়েছেন, যা শুধু ব্যতিক্রম নন, তুলনারহিত। মেধা, মনন, যুক্তিবাদিতা ও সাহসের সম্মিলনে আকবর আলি খান ছিলেন তাঁর সময়ের শ্রেষ্ঠ একজন জ্ঞানতাত্ত্বিক।
দুই. রিচার্ড ইটন, অসীম রায়, আকবর আলি খানসহ আরও অনেকেই বাঙালি মুসলমানের ঠিকুজি খোঁজার চেষ্টা করেছেন। নানা যুক্তি, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ ও তর্ক হাজির সাপেক্ষে চেষ্টা করেছেন যুক্তিযুক্ত কিছু মত ও সিদ্ধান্ত হাজির করার। মত ও পথে প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্যিক, এবং সেটাই স্বাভাবিক-সঙ্গত ও গবেষণার নিয়ম-রীতি। রিচার্ড ইটন ও অসীম রায় গবেষণায় একেবারে আনকোরা কিছু বিষয় অনুসন্ধান করেছেন। উনারা বিভিন্ন তথ্য ও তত্ত্বের জন্য ফিল্ড ওয়ার্ক পদ্ধতি যেমন বেছে নিয়েছেন, তেমনি বিভিন্ন সূত্র থেকে এ-সংক্রান্ত নানান দলিল-দস্তাবেজ সংগ্রহ করেছেন। দ্বিবিধ এই পদ্ধতি প্রয়োগ করে নির্দিষ্ট কিছু সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে দাঁড় করার চেষ্টা করেছেন বাঙালি মুসলমানের সত্তার অন্বেষাপূর্বক প্রকৃত ঠিকুজি।
আকবর আলি খান হেঁটেছেন এসবের বাইরে, ভিন্ন পথে, স্বতন্ত্র ভঙ্গিতে। উনি মূলত ‘টেক্সট টু টেক্সট’ পদ্ধতিতে দাঁড় করিয়েছেন এতদ্বিষয়ক অনুসন্ধান এবং তা থেকে প্রাপ্ত নতুন ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ। সে ক্ষেত্রে অনেকের অনুসন্ধানকেই তিনি বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করেছেন, তবে এঁদের টেক্সটকে প্রণিধানযোগ্য মনে করেছেন বিশেষ করে রিচার্ড ইটন ও অসীম রায়ের গবেষণাকে।
‘বাঙালি মুসলমানের সত্তার অন্বেষা/ আকবর আলি খানের পথ ধরে নতুন বয়ান’। গবেষণালব্ধ এই লেখাও তৈরি হয়েছে ‘টেক্সট টু টেক্সট’ পদ্ধতিতে। তবে এখানে প্রাপ্ত টেক্সটের কেবল বিশ্লেষণ করা হয়নি, টেক্সটের বাইরে ফিল্ড ওয়ার্ক যেমন যুক্ত হয়েছে, তেমনি জারি থাকা ব্যাখ্যা বিশ্লেষণের বাইরে নতুন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও তর্ক উপস্থাপনপূর্বক অন্বেষণ করা হয়েছে নতুন সিদ্ধান্ত।
আমরা মনে করি, বাঙালি মুসলমানের সত্তার অন্বেষা বলবৎ রয়েছে তার নদীর পথে-নদী সংলগ্নতার ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ভেতরে। এ জাতির ঠিকুজি যদি সদর্থক অর্থে খুঁজে পেতে হয়, তাহলে নদীর কাছে ফিরে যেতে হবে নানানভাবে। নদীর কাছেই হাজির করতে হবে উত্থিত সকল প্রশ্ন এবং নদীর গতিপ্রকৃতি ও প্রবহমানতার অতীত-বর্তমানের মধ্যে তালাশ করতে হবে সমুদয় উত্তর। কেননা, নদীমাতৃক বাংলাদেশের নদী-সংস্কৃতির মধ্যেই নিহিত আছে বাঙালি মুসলমানের জাতিসত্তার ঠিকুজি।
‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ের একেবারে শেষাশেষি আকবর আলি খান মোটা দাগে চারটি প্রশ্ন হাজির করেছেন। সেসব প্রশ্নপাঠ শেষে আমরা কিছু ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ ও তর্ক এবং আমাদের উত্তর ও প্রশ্ন হাজির করার চেষ্টা করব।
প্রথম প্রশ্ন, বাংলার বেশির ভাগ মুসলমান স্থানীয় ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধর। কিছু বিদেশি অভিবাসী এর মধ্যে রয়েছে। এদের বেশির ভাগ নিম্নবর্ণের ধর্মান্তরিত হিন্দুদের বংশধর। নৃতাত্ত্বিক গবেষণা এ অনুমানকেই সমর্থন করে। তবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান/প্রমাণ নেই। মধ্যযুগের ঐতিহাসিকেরা রাজা-বাদশাহদের ইতিহাস লিখেছেন, নিম্নবর্ণের মানুষদের নিয়ে তাঁদের কোনো আগ্রহ ছিল না। তাই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের ধর্মান্তর সম্পর্কে যথেষ্ট ঐতিহাসিক উপাদান পাওয়া যায় না।
এই প্রশ্নে অর্থাৎ আকবর আলি খানের প্রথম প্রশ্নে আমাদের মত হলো, বাংলার বেশির ভাগ মুসলমান স্থানীয় ধর্মান্তরিত ‘হিন্দু’দের বংশধর নন। কিছু বিদেশি অভিবাসীর কথা তিনি বলেছেন। আমরা মনে করি, বিদেশি অভিবাসীর সংখ্যা খুবই কম। সেই তুলনায় বরং ভারতবর্ষের বিভিন্ন জায়গা থেকে বাংলায় বেশিসংখ্যক অভিবাসীর আগমন হয়েছে। প্রথমেই বলে নেওয়া ভালো, বাংলায় মুসলমানের আগমন ও বসতি শুরু হয়েছে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় ও আকবর আলি খান যে সময়ের কথা বলছেন, তার কয়েক শ বছর আগে। আমাদের মত হলো, হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশাতেই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে। বিশেষ করে তাঁর মৃত্যুর কয়েক বছরের মধ্যে যখন চারদিকে ইসলামের প্রচার ও প্রসার হচ্ছে, তখনই এখানে শাসনক্ষমতার বাইরে ইসলামের প্রচার ও প্রসার শুরু হয়। আরব বণিকদের ভারতবর্ষ ও বাংলায় আগমনের ইতিহাস অনেক পুরোনো। হজরত সোলায়মান (আ.)-এর সময়ে মিসরের সঙ্গে এই অঞ্চলের বাণিজ্যিক যোগাযোগ ছিল। চীন থেকে সিল্করুট দিয়ে প্রাচীনকালে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকার সঙ্গে শক্তিশালী বাণিজ্যিক যোগাযোগের নজির রয়েছে। এই যোগাযোগ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অন্যান্য অঞ্চলের সঙ্গেও বৃদ্ধি পায় এবং ইউরোপের সঙ্গেও যোগসূত্র স্থাপিত হয়। ভারতবর্ষের এই অঞ্চলের সঙ্গে ব্যবসা-বাণিজ্যে আরব বণিকদের দাপট ছিল বেশি। এ কারণে আফগান-তুর্কিদের আগমনের আগেই এখানকার সাধারণ মানুষের সঙ্গে বোঝাপড়া ও মানসিক নৈকট্যের সুযোগ হয়। মৌসুমি বায়ুর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে তাদের ব্যবসায় আসা-যাওয়ার সময় নির্ধারিত হতো। মৌসুমি বায়ু যখন অনুকূলে থাকত, তারা এই অঞ্চলে আসত এবং বাণিজ্য শেষে পরবর্তী মৌসুমি বায়ুর জন্য অপেক্ষা করত। মাঝখানের সময়টাতে তারা এখানে বিয়েশাদি করে সংসারও করেছে। চট্টগ্রাম এলাকায় এখনো আরব কলোনি বলে একটা জায়গা রয়েছে, যা এই মতকে সমর্থন দেয়। ইসলাম ধর্ম প্রবর্তন-প্রচার ও প্রসারের সঙ্গে এই প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। সেই সময়ের শাসন ক্ষমতায় যিনি বা যাঁরা থাকতেন, তাঁদের সঙ্গে সমাজের বা সাধারণ মানুষের কোনো প্রকার যোগাযোগ ছিল না। ফলে, শাসনক্ষমতার বাইরে বাংলার সমাজে কী পরিবর্তন হচ্ছে, তার কিছুই তাদের পক্ষে ওয়াকিবহাল হওয়া সম্ভব হয়নি। ফলে, সুফিদের আগমনের পূর্বে এমনকি সুফি মতবাদ আবির্ভূত হওয়ার ঢের আগেই এবং বাংলায় মুসলিম শাসকদের রাজত্ব শুরু হওয়ার আগেই এই অঞ্চলের মানুষের সঙ্গে ইসলাম ধর্মের আন্তযোগাযোগ শুরু হয়ে যায় এবং সময় পরিক্রমায় এ ধারা গতিপ্রাপ্ত হয়।
ইসলাম ধর্মের প্রচার যখন মৃদু পরিসরে হচ্ছে, তখন বাংলায় হিন্দুধর্মের পাশাপাশি আরও কিছু ধর্ম প্রচলিত ছিল। ব্রাহ্মণ্যধর্ম, জৈনধর্ম, বৈষ্ণবধর্ম, বৌদ্ধধর্ম, শাক্তধর্ম তার মধ্যে অন্যতম। জনসংখ্যার একটা বড় অংশ ছিল সমতলের আদিবাসী। যাদের উপস্থিতি সামান্যসংখ্যক হলেও এখনো নাটোর, দিনাজপুর, শেরপুর অঞ্চলে রয়ে গেছে। এ ছাড়া স্থানীয় অধিবাসীদের একটা বড় অংশ ছিল প্রকৃতি পূজারি। এদেরকে ঠিক হিন্দুধর্মের অনুসারী বলে ঠাহর করা ঠিক হবে না। প্রকৃতি পূজারিদের সংখ্যা কেমন ছিল এবং তারা কতটা প্রভাবশালী ছিল, তা এখন অনুমান করা কষ্টসাধ্য হলেও একটা বিষয় খেয়াল করলে আমরা এ সম্পর্কে শক্ত একটা ধারণা পেতে পারি। লক্ষণীয়, কিছুদিন আগপর্যন্ত বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের অন্যতম প্রধান বিষয় ছিল সাপ। এমনকি এখন পর্যন্ত এ দেশের সর্বাধিক জনপ্রিয় ও ব্যবসাসফল চলচ্চিত্রের নাম হলো তোজাম্মেল হক বকুল পরিচালিত ‘বেদের মেয়ে জোছনা’। বাঙালি মুসলমানের কাছে কেন এই ধরনের এবং এই ধারার ও রকমের চলচ্চিত্রসমূহ প্রিয় হলো এবং দীর্ঘ সময় ধরে পছন্দের জায়গায় স্থায়ী আসন করে নিল, সেই প্রশ্নের উত্তর নিহিত আছে বাঙালি মুসলমানের জাতির ঠিকুজির মধ্যে। বাঙালি মুসলমানের পূর্বপুরুষদের একটা বড় অংশ ছিল প্রকৃতি পূজারি। পূর্বপুরুষের সেই প্রবণতা এখনো তার সত্তায় রয়ে গেছে বলেই বাঙালি মুসলমানের সর্বাধিক প্রিয় চলচ্চিত্রের নাম ‘বেদের মেয়ে জোছনা’ এবং সাপনির্ভর কিংবা পশুপাখিকেন্দ্রিক চলচ্চিত্র এখনো তার পছন্দের শীর্ষ জায়গা জুড়ে রয়েছে। সুতরাং বাঙালি মুসলমানের বেশির ভাগ স্থানীয় হিন্দুধর্ম থেকে ধর্মান্তরিত হয়েছে, এ মত যৌক্তিক নয়। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত যুক্তি-তথ্য-তত্ত্ব রয়েছে, পরিসরজনিত স্বল্পতায় সেসবের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও সিদ্ধান্ত হাজির করা হলো না।
দ্বিতীয় প্রশ্ন, কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, বাংলায় মুসলমান শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলাম প্রচার শুরু হয়। এ সম্পর্কে সুস্পষ্ট কোনো ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে আরব বণিকেরা বাংলায় ব্যবসা করলেও তাঁরা এখানে ইসলাম প্রচার করেননি কিংবা বসতি স্থাপন করেননি। যেখানে আরব বণিকেরা বসতি করেছেন, সেখানে শাফেয়ি-মাজহাবের প্রাধান্য দেখা যায়। বাংলার কোথাও মুসলমানদের মধ্যে শাফেয়ি-মাজহাবের অস্তিত্ব দেখা যায় না।
দ্বিতীয় প্রশ্নে আমরা মনে করি, বাস্তবিকই বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার আগেই ইসলাম প্রচার শুরু হয়েছে। ভারতের কেরালা প্রদেশে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় ৬২৯ খ্র্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ এবং বাংলাদেশের লালমনিরহাটের রামদাস গ্রামে ৬৯ হিজরি অনুযায়ী ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত একটি মসজিদ তার প্রমাণ। আমাদের ধারণা, বাংলায় সেই সময় কিংবা কাছাকাছি সময়ে আরও কয়েকটি মসজিদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে; যেগুলো কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। বাংলায় এবং ভারতবর্ষে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর অঙ্গুলি নির্দেশে চাঁদ দ্বিখণ্ডিত হওয়ার ঘটনা প্রচলিত রয়েছে। এবং সেটা রাজা নিজে দেখে, রাজকন্যার দর্শন থেকে শুনে এবং স্বপ্নযোগে জানার পর আরব বণিকদের মাধ্যমে তার সত্যতা যাচাই করে ধর্মান্তরিত হওয়ার একাধিক কাহিনি এখনো প্রচলিত রয়েছে। এই কাহিনিতে কেবল রাজাই ধর্মান্তরিত হয়েছে বলে উপস্থাপিত হয়েছে। রাজা যদি ধর্মান্তরিত হয়, তার সঙ্গে প্রজারাও কিছুসংখ্যক হলেও ধর্মান্তরিত হবে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন ভারতবর্ষের বেশির ভাগ অঞ্চলে শাসনক্ষমতায় ছিলেন সম্রাট হর্ষবর্ধন। যার রাজত্বের সময়সীমা ৬০৬ থেকে ৬৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত। আর বাংলার তথা গৌড়ের শাসনক্ষমতায় ছিলেন শশাঙ্ক।
আরব বণিকেরা এখানে বসতি স্থাপন করেননি এ মত-আক্ষরিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। উনারা সাময়িক বসতি স্থাপন করত, এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই। কেননা প্রাকৃতিক কারণেই তাদেরকে এমনটা করতে হতো। মসজিদ নির্মাণের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণিত হয় যে, তারা স্থায়ী বসতিও স্থাপন করত। চট্টগ্রামের আরব কলোনি এই যুক্তিকে সত্যরূপে হাজির করে। শাফেয়ি-মাজহাবের প্রাধান্যের কথা বলা হয়েছে, আমরা যে সময়ের কথা বলছি তখন ইসলামে মাজহাবের ধারণাগত কোনো ভিত্তিই প্রতিষ্ঠিত হয়নি।
তৃতীয় প্রশ্ন. বাংলায় ইসলাম প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছেন সুফি, দরবেশ ও পীরেরা। পীরদের মাজেজায় অভিভূত হয়ে এঁদের জীবদ্দশায় অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছেন। এঁদের মৃত্যুর পর দরগার মাধ্যমে অনেক বিধর্মীকে ইসলাম ধর্মে আকৃষ্ট করা হয়েছে। সুফি, পীর ও দরবেশ ভারতের সর্বত্রই ইসলাম প্রচার করেছেন। কিন্তু বাংলার বাইরে তাঁরা তেমন সাফল্য অর্জন করতে পারেননি। তার কারণ হলো, বাংলার বাইরের গ্রামগুলোতে শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন ছিল। এই সামাজিক সংগঠন অস্বীকার করে মুসলমান হওয়া অনেক শক্ত ব্যাপার ছিল। বাংলায় সামাজিক সংগঠন ছিল দুর্বল। তাই এখানে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে পেরেছে।
তৃতীয় প্রশ্নে আমাদের মতামত হলো, সুফিরা ইসলামের প্রসারে যতটা শক্তিশালী ভূমিকা পালন করেছে তার চেয়ে অধিক ভূমিকা পালন করেছে ইসলামের ভিত্তি শক্তিশালীকরণে। ইসলামের প্রচার ও প্রসার সুফিরা আসার আগেই প্রবহমান ছিল। এবং বাংলার গ্রাম সমাজে ইসলাম ধর্মের অনুসারী মানুষের বসবাস ছিল। তবে তাঁরা যে খুব শক্তভাবে ইসলাম ধর্মের অনুসারী ছিলেন এমনটা নয়। সুফিদের যখন আগমন শুরু হয় তখন বাংলায় মুসলমান রাজাদের শাসনকাল হলেও স্থানীয়ভাবে দাপুটে হিন্দু রাজা ছিল। সুফিরা আসায় তাদের দাপট ফিকে হয়ে আসে। এবং যারা ইসলামের অনুসারী ছিল, আবার অন্যধর্মের সংস্কার-কৃত্য ও রীতি-নীতির সঙ্গেও যুক্ত ছিল। ওই সময় তারা শক্তভাবে ইসলাম ধর্মাবলম্বী হয়ে ওঠেনি। পাশাপাশি সুফিদের কারণে অন্য ধর্মাবলম্বী যারা নামেমাত্র ধর্মের সঙ্গে যুক্ত ছিল কিংবা সেই অর্থে কোনো ধর্মই পালন করত না, তারা ইসলামের দিকে ঝুঁকে পড়ে। কোথাও কোথাও পরিস্থিতিও বাধ্য করে ঝুঁকতে।
আকবর আলি খান মনে করেন, সামাজিক সংগঠনের কারণেই ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য পাওয়ার অন্যতম কারণ। তিনি মনে করেন, বাংলার সামাজিক সংগঠন দুর্বল ছিল। অন্যত্র শক্তিশালী সামাজিক সংগঠন থাকায় সেই বেষ্টনী ভেদ করে কারও পক্ষে ধর্মান্তরিত হওয়া সহজসাধ্য ছিল না।
আমরা মনে করি, সামাজিক সংগঠনের এই রহস্য লুকিয়ে রয়েছে বাংলার নদী সংস্কৃতির ভেতরে। এখানে প্রশ্নটা দুর্বলতা বা সবলতার নয়। প্রশ্নটা সেই সমাজ গড়ে উঠছে কোথায় এবং তার সঙ্গে নদ-নদীর সম্পর্ক কী। ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে নদ-নদী থাকলেও, বাংলার মতো এতসংখ্যক নদীর উপস্থিতি নেই। এমনকি আমরা যদি পশ্চিমবঙ্গের দিকে খেয়াল করি, তাহলে দেখব সেখানকার চেয়ে এখানে নদীর উপস্থিতি রয়েছে বেশি। নদীর ধর্ম কেবল প্রবহমান থাকা নয়, প্রাকৃতিক কারণে তার বাঁকবদলের প্রবণতাও অনেক বেশি। নদী মানুষকে অনেক বেশি স্বাধীনচেতা করে গড়ে তোলে। এবং নদীসংস্কৃতির সঙ্গে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদেরও গভীর যোগসূত্র রয়েছে। এ কারণে নদীসংলগ্ন মানুষেরা তুলনামূলক বেশি ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী হয়ে ওঠে। আমরা যদি বাউলসংস্কৃতির বিকাশ ও তার পরিণত হওয়ার দিকে লক্ষ করি, তাহলে দেখব, এগুলো সেই সব এলাকায় কিংবা এলাকা ধরে বিকশিত হয়েছে, যেখানে নদ-নদীর সংখ্যা তুলনামূলকভাবে বেশি। এমনকি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামের দিকেও যদি আমরা খেয়াল করি, তাহলে দেখব, সেই সব অঞ্চল ও এলাকাতেই এ ধরনের আন্দোলন ও সংগ্রাম হয়েছে, যেখান নদ-নদীর প্রাবল্য রয়েছে। নদীসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য হলো ব্যক্তিকে স্বতন্ত্র সত্তার সঙ্গে পরিচিতি করে তোলা। এখানকার সমাজও এই বৈশিষ্ট্যতাড়িত হয়। এখানে ব্যক্তির মতো সমাজও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ইউনিটে বিভক্ত থাকে এবং প্রত্যেকেই নিজের মতো করে নিজস্ব অবস্থান তৈরি করে। তারা বৃহত্তর এক সমাজে বসবাস করলেও তাদের ভেতরে ব্যক্তি ও সমাজকেন্দ্রিক নিজস্ব ভাবনা তৈরি হয়। আমরা যদি প্রাচীন সময়ের দিকে খেয়াল করি, তাহলে দেখব, এখানে হরিকেল, সমতট, বঙ্গ, পুন্ড্র, চন্দ্রদ্বীপের মতো পৃথক জনপদ গড়ে উঠল, তার পেছনেও রয়েছে নদীসংস্কৃতির বৈশিষ্ট্যাবলি। এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হওয়াও সেই বাস্তবতারই ফসল। উপমহাদেশে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দুটে স্বাধীন দেশের জন্মের সিকি শতাব্দীর মধ্যেই ভারত উপমহাদেশের এই জনপদেই কেন, একটি স্বাধীন দেশের জন্ম হলো। তার কারণ, ওই নদী সংস্কৃতির গভীরে নিহিত আছে। ১৮৭২ সালের আদমশুমারিতে প্রথমবারের মতো জানা গেল, বাংলায় মোট জনসংখ্যা ৩৫,৭৬৯,৭৩৫ জন। এর মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ১৮,২০০,৪৩৮ জন এবং মুসলমান জনসংখ্যা ১৭,৬০৯,১৩৫ জন; বাকিরা ছিল অন্য সম্প্রদায়ভুক্ত। শতকরা হিসাবে মোট জনসংখ্যার তুলনায় হিন্দুর হার ছিল ৫০.১ শতাংশ আর মুসলমান ৪৮.৮ শতাংশ। পরের আদমশুমারিতে পাল্টে যায় এই চিত্র। ১৮৮১ সালের আদমশুমারিতে দেখা যায়, মোট জনসংখ্যা ৩৫,৬০৭,৬৬৮ জন। তাদের মধ্যে হিন্দু জনসংখ্যা ১৬,৩৭০,৯৬৬ জন এবং মুসলমান ১৭,৮৬৩,৪১১ জন। শতকরা হিসাবে হিন্দু ৪৮.৪৫ শতাংশ এবং মুসলমান ৫০.১৬ শতাংশ। প্রথম জনগণনার তুলনায় দ্বিতীয় জনগণনায় দেখা গেল, মুসলমানের সংখ্যা ১৫ লাখ বেড়েছে। আমরা মনে করি, এর বাস্তব কারণ অনুসন্ধান করতে হলে আমাদের নদীসংস্কৃতি বুঝতে হবে এবং সদর্থক অর্থেই এ-সংক্রান্ত গবেষণায় আগ্রহী হতে হবে। পরিসরস্বল্পতার কারণে শুধু এটুকু বলা। প্রথম জনগণনার ঠিক ১০০ বছর পর একটা স্বাধীন দেশের অভ্যুদয় হয়েছে। আমরা জানি, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতাসংগ্রামে প্রকৃতিও আমাদের সঙ্গে ইতিবাচক ভূমিকা পালন করে। বিশেষ করে নদীর ভূমিকা অপরিসীম। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে যে বিজয় অর্জিত হলো, তার পেছনে অনেক বড় কারণ কিন্তু আমাদের সমাজ শক্তিশালী বলে। লক্ষণীয়, মুক্তিযুদ্ধে কিন্তু একটা রাষ্ট্রশক্তির সঙ্গে আমাদের সামাজিক শক্তির যুদ্ধ হয়েছে এবং সেই যুদ্ধে সামাজিক শক্তির বিজয় হয়েছে। একটা সামরিক রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে, যারা অস্ত্রশস্ত্রে কেবল শক্তিশালী নয়, সেনাবাহিনীর দিক থেকেও তারা বিশ্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সেনাশক্তি ছিল। এ রকম একটা সামরিক স্বৈর রাষ্ট্রকে পরাজিত করা সম্ভব হয়েছে শুধু এই কারণে যে আমাদের সামাজিক সংগঠন শক্তিশালী ছিল। মুক্তিযুদ্ধে কোনো কারণে ভারত যদি আমাদের সহযোগিতা না করত, তাহলেও আমাদের বিজয় অর্জিত হতো; কারণ, আমাদের সামাজিক সংগঠন শক্তিশালী ছিল। সুতরাং, আমাদের সামাজিক সংগঠন দুর্বল ছিল, এ ধারণা যুক্তিযুক্ত নয়। আমাদের সামাজিক সংগঠনের চরিত্রকাঠামো একেবারে নদীর মতো। নদী যেমন শুষ্ক মৌসুমে মূল খাত থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়, পৃথক পৃথক ধারা তৈরি করে প্রবাহিত হয় কিংবা শুকিয়ে মৃতবৎ অবস্থায় থাকে। কিন্তু ভরা মৌসুমে কিংবা তার প্রয়োজনে আবার জেগে ওঠে, সবাই এক হয়ে বৃহৎ এক শক্তিরূপে আবির্ভূত হয়। আমাদের সমাজেও তাই, সেখানে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে সম্মিলিতভাবে লড়াই করার ইতিহাস, প্রয়োজনে জেগে ওঠার অজস্র উদাহরণ। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে আমরা তার প্রমাণ পেয়েছি। রাষ্ট্রের চেয়ে সমাজের ইতিহাস অনেক পুরোনো। এবং ইতিহাসে-ঐতিহ্যে-সংস্কৃতিতে এবং শক্তিতে সে রাষ্ট্র অপেক্ষা সে সবল-সাহসী ও কার্যকর এক সংগঠন।
চতুর্থ প্রশ্ন, অধিকাংশ আধুনিক ঐতিহাসিকই মনে করেন, বাংলায় পীরদের উদ্যোগে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে। কিন্ত কেন পীরেরা বাংলায় সফল হন অথচ ভারতের অন্যত্র ব্যর্থ হন, এ সম্পর্কে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ রয়েছে। অসীম রায় মনে করেন, বাংলার নিষ্ঠুর প্রাকৃতিক পরিবেশে পীরেরা জলাভূমির মানুষের আধ্যাত্মিক প্রয়োজন মিটিয়ে ছিল। তাই স্বল্প সময়ে বাংলায় পীরদের উদ্যোগে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের গণধর্মান্তর ঘটে। অল্প সময়ে (১০০ থেকে ২০০ বছরে) এই ধর্মান্তর ঘটেছে। তবে কখন এ ধর্মান্তর ঘটেছে, অসীম রায় সুস্পষ্টভাবে নির্ধারণ করেননি। রিচার্ড ইটন ও অসীম রায়ের সঙ্গে একমত যে বাংলায় হিন্দুদের গণধর্মান্তর ঘটেছে উদ্যোক্তা-পীরদের উদ্যোগে। যাঁরা পশ্চিম বাংলার মৃতপ্রায় বদ্বীপ অঞ্চল থেকে দুর্দশাগ্রস্ত নিম্ববর্ণের হিন্দুদের পূর্ব বাংলার সক্রিয় বদ্বীপে বসতি স্থাপন করেন। ইটন মনে করেন, মোগল আমলে [১৪৫০-১৬০০ সাল] বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে দুটি প্রশ্নে এখনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। প্রথম প্রশ্ন হলো, বাংলায় ইসলাম কি গোষ্ঠীগত পর্যায়ে প্রচারিত হয়েছে, না ব্যক্তিক পর্যায়ে? দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, বাংলায় ইসলাম প্রচার কি স্বল্প সময়ে হয়েছে, নাকি অনেক দিন ধরে?
চতুর্থ প্রশ্নে পৃথকভাবে দুটো জিজ্ঞাসা হাজির করা হয়েছে। প্রথমত পীরদের উদ্যোগে ইসলাম প্রচারিত হয়েছে বলে যে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন, অসীম রায় ও রিচার্ড ইটন, তার সঙ্গে আমরা একমত নয়। আমরা মনে করি, ইসলামের প্রচার ও প্রসার আগেই হয়েছে পীরেরা সেই অবস্থাকে সংহত ও শক্তিশালী করেছে। ইটন বলছেন, মোগল আমলে বাংলায় মুসলমান সংখ্যাধিক্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু জনগণনা তো সেটাকে সমর্থন করছে না। আমরা মনে করি, ইটনের উল্লিখিত সময়কালের আগেই ইসলাম প্রচারিত হয়েছে এবং তা ক্রম প্রসারমাণ ছিল। মোগল সময় সেই অবস্থাকে যেমন স্থিতি দিয়েছে, তেমনি গতিশীলও করেছে। এবং ইসলাম থেকে ধর্মান্তরের ঘটনা প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। উল্টো অন্যান্য ধর্ম থেকে ইসলামে ধর্মান্তরের প্রক্রিয়া অব্যাহত ছিল। সুফি ও পীরদের জীবনযাপন অন্যদেরকে যেমন আকৃষ্ট করেছে, তেমনি ইসলামের অনুসারীরা বিশেষ করে নতুন অনুসারীরা অন্যদেরকে প্রভাবিতও করেছে। রাষ্ট্রক্ষমতায় যেহেতু মুসলমান শাসক ছিল, তাই এসব কর্ম সম্পাদন অব্যাহত ছিল। ধর্মান্তরের প্রক্রিয়াটা উঁচু পর্যায়ে বা রাষ্ট্রক্ষমতা-সংলগ্ন মানুষদের বলয়ে খুবই কম হয়েছে। বরং এসব কার্যক্রমের বেশির ভাগই সম্পন্ন হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ে-সামাজিক শক্তিবলয়ের মধ্যে। একথা স্বীকার করতে হবে যে সমাজ পর্যায়ে ইসলামের অনুপ্রবেশ ঘটেছে অনেক আগে এবং সমাজের কাছে তার একধরনের গ্রহণযোগ্যতাও তৈরি হচ্ছিল শত শত বছর ধরে।
চতুর্থ প্রশ্নের দ্বিতীয় জিজ্ঞাসায় আমরা মনে করি, বাংলায় ইসলাম প্রচার তাৎক্ষণিকভাবে কিংবা স্বল্প সময়ে হয়নি। এবং এখানে গণধর্মান্তরের তেমন কোনো নজির নেই। বাংলায় ইসলাম প্রচার কয়েক শত বছর ধরে হয়েছে। হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় কিংবা তাঁর মৃত্যুর পরপরই এখানে ইসলামের আগমন ঘটে এবং এই প্রক্রিয়া ক্রমশ প্রসারমাণ ছিল।
‘বাংলায় ইসলাম প্রচারে সাফল্য: একটি ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ’ বইয়ে আকবর আলি খান কিছু পর্যবেক্ষণ ও সুপারিশ হাজির করেছেন। এগুলো হলো:
এক. গণধর্মান্তর এবং সামাজিক সংগঠনের মধ্যে কী সম্পর্ক, সেটা বোঝার প্রয়োজন রয়েছে।
এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, বাংলায় ইসলাম প্রচারের ইতিহাসে গণধর্মান্তর ঘটেনি। নদীর কারণে এখানে যেহেতু ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের বিকাশ বেশি এবং চর্চিত ও সামাজিকভাবে স্বীকৃত একটা বিষয়। এ কারণে এখানে গণধর্মান্তরের ইতিহাস যেমন নেই, তেমনি প্রকৃতি-সমাজ ও মনুষ্যবসতির দিকে লক্ষ করলে এমনটা ঘটার কোনো কারণও নেই। মনে রাখা প্রয়োজন, নদীকেন্দ্রিক এবং নদীতীরবর্তী সামাজিক সংগঠনগুলো কখনো খুব বড় হয় না। এখানে সমাজের মধ্যেও নানা রকমের উপসমাজ থাকে এবং সেখানেও কে কতটা কাছের বন্ধনে যুক্ত, সেসব নিয়ে নানান ধরনের বোঝাপড়া এবং হিসাব-নিকাশের ব্যাপার থাকে।
দুই. পৃথিবীর বেশির ভাগ দেশেই একই ধরনের গ্রামীণ বসতি হয় না। গ্রামীণ সংগঠনের শক্তির হেরফের থাকে। তাই প্রশ্ন ওঠে, গ্রামীণ সংগঠনের শক্তির হেরফেরের ফলে ইসলাম ধর্ম প্রচারে কোনো তফাত হয়েছে কি না।
এ ব্যাপারে আমাদের অভিমত হলো, গ্রামীণ বসতি কোথায়, কোন নদীর তীরে, বড় কোনো নদীর তীরে কি না, যেখানে নদীর সংখ্যা কেবল একটাই, নাকি রয়েছে বড় নদীসহ শাখাপ্রশাখায় বিস্তৃত অনেক নদী এবং সেখানে জলের অবাধ উৎস আছে কি না, তার ওপর নির্ভর করে সেখানকার গ্রামীণ বসতি কেমন। গ্রামীণ সংগঠনের শক্তির হেরফেরের সঙ্গে অবশ্যই ইসলাম প্রচারের সম্পর্ক রয়েছে। মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলার গ্রামীণ বসতির সঙ্গে পৃথিবীর কোনো জায়গার গ্রামীণ বসতির সাযুজ্য বা সাদৃশ্য থাকার নয়। এমনকি ভারতের কোনো এলাকার সঙ্গে উত্তর ভারত-দক্ষিণ ভারতের কোনো অঞ্চলের গ্রামীণ বসতির সঙ্গে এর কোনো মিল নেই। পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গেও এই মিল খুব বেশি দেখা যায়নি। এর একটাই কারণ বাংলা একটা বদ্বীপ ভূমি এবং নদ-নদীর উপস্থিতি রয়েছে অগণন। সাম্প্রতিক হিসাবেই মনে করা হয়, বাংলা তেরো শ নদীর দেশ। প্রাচীন বাংলায় এবং মধ্যযুগে এর পরিমাণ কত ছিল, এই এসব নদীর স্বরূপ কেমন ছিল, তা সহজেই অনুমেয়।
তিন. বাংলায় উন্মুক্ত গ্রাম কি শুধু মধ্যযুগেই ছিল, না প্রাচীন আমলেও বেশির ভাগ এলাকায় উন্মুক্ত গ্রাম ছিল।
এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলো, বাংলায় উন্মুক্ত গ্রামের অস্তিত্ব এখনো রয়েছে, মধ্যযুগে ছিল, প্রাচীন আমলেও ছিল। এবং এমনটা ছিল বলেই লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত এক গ্রামে ৬৯ হিজরি মোতাবেক ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দেই মসজিদ নির্মাণ করা সম্ভব হয়েছে। প্রাচীন আমলের উন্মুক্ত গ্রামের অস্তিত্ব ছিল বলেই সে সময় শক্তিশালী পৃথক জনপদ গড়ে উঠেছিল।
চার. কোন ধরনের সমাজে সহজে ধর্মান্তর হয় আর কোন ধরনের সমাজে সহজে ধর্মান্তর হয় না, সে সম্পর্কে কোনো সাধারণ সূত্র প্রণয়ন করা সম্ভব কি না। বাংলার জলাভূমি পরিবেশে বেশির ভাগ উন্মুক্ত গ্রাম গড়ে উঠেছিল। প্রশ্ন ওঠে, যেখানে জলের সরবরাহের কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, সেখানেই উন্মুক্ত গ্রাম গড়ে ওঠে কি না এবং যেখানে উন্মুক্ত গ্রাম রয়েছে, সেখানে ধর্মান্তর সহজ কি না।
উন্মুক্ত সমাজেই সহজে ধর্মান্তর সম্ভব বলে আমাদের অনুসন্ধান। উন্মুক্ত সমাজের যেমন কিছু ইতিবাচক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, তেমনি নেতিবাচক দিকও রয়েছে। আমরা মনে করি, বিষয়টা ইতি-নেতির আলোকে না দেখে এর সহজাত বৈশিষ্ট্য হিসেবে দেখাই যুক্তিযুক্ত। নদীজাত সংস্কৃতি অর্থাৎ তার আবহাওয়া ও জলবায়ু এর মুখ্য কারণ। জলের সরবরাহের কোনো প্রতিবন্ধকতা না থাকা এবং একাধিক নদীর অস্তিত্ব থাকা উন্মুক্ত সমাজ গড়ে ওঠার ক্ষেত্র ও পরিবেশ তৈরি করে।
পাঁচ. ইটন ও অসীম রায় মনে করেন, বাংলায় ইসলাম প্রচার একটি সহজ কাজ ছিল। কেননা মধ্যযুগে যে ইসলাম প্রচারিত হয়, তা ধ্রুপদি ইসলাম ছিল না, তা ছিল ইসলামের একটি বিকৃত ভাষ্য। কাজেই ধর্মান্তরকরণে বড় ধরনের আধ্যাত্মিক প্রণোদনার প্রয়োজন ছিল না।
বাংলায় ইসলাম প্রচার একটি সহজ কাজ ছিল—ইটন ও অসীম রায়ের এই মতকে আমরা যুক্তিযুক্ত বলেই মনে করি। তবে এটাও মনে রাখতে হবে, ইসলামই সেই সময় প্রধানত ও একমাত্র প্রচারমুখী ধর্ম ছিল। অন্য ধর্মের প্রচার ও প্রসারের কোনো কার্যক্রম ছিল বলে ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় না। ইটন ও অসীম রায় বলছেন, মধ্যযুগে যে ইসলাম প্রচারিত হয়, তা ধ্রুপদি ইসলাম ছিল না, তা ছিল ইসলামের একটি বিকৃত ভাষ্য। আমরা এই বিষয়টাকে এভাবে দেখি এবং ইসলামের বিকৃত ভাষ্য বলে মনে করি না; বরং সেই সময় ধর্মের নিয়ম রীতিকে এতটা শক্তভাবে দেখা হয়নি। একটা নতুন ধর্মের প্রচারটাই তখন মুখ্য, তার ধ্রুপদি রূপ ওই মুহূর্তে গৌণ। সেটাই বাস্তবতা এবং স্বাভাবিক। এমনটা ছিল বলেই লোকধর্ম বলে একটা রীতিও কিন্তু সমাজে বিদ্যমান ছিল। এবং আজও তার রেশ রয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষদের যে পীরালি ব্রাক্ষ্মণ ছিল, তার নেপথ্যের কারণ কিন্তু লোকধর্ম।
ছয়. উন্মুক্ত গ্রামের প্রভাবে নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বেশির ভাগ মুসলমান হয়ে যায়। প্রশ্ন ওঠে, যারা হিন্দু থেকে যায়, তাদের ওপরে উন্মুক্ত গ্রামের প্রভাব পড়েনি? না পড়লে কেন পড়েনি?
আমরা মনে করি, কেবলই নিম্নবর্ণের হিন্দুদের বেশির ভাগ মুসলমান হওয়ার মধ্য দিয়ে বাংলায় মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে ওঠেনি। এটা ছিল দীর্ঘমেয়াদি এক প্রক্রিয়া। হিন্দু বা অন্য ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে যারা সমাজে উঁচু পর্যায়ে ছিল, তারা ইসলাম গ্রহণ না করে নিজেদের ধর্মেই থেকে যান। এদের ওপর উন্মুক্ত গ্রামের কোনো প্রভাব পড়েনি। তবে কোথাও কোথাও সমাজে উঁচু পর্যায়ের অন্য ধর্মাবলম্বীরাও ইসলাম গ্রহণ করে। এ ক্ষেত্রে সুফি ও পীরদের সরল জীবন ও ইসলামের সাম্যের বাণী তাদেরকে মুগ্ধ করে।
সাত. উন্মুক্ত গ্রামে সংগঠনের দুর্বলতা কি শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল? এর প্রভাব বাংলার জীবনে অন্যান্য ক্ষেত্রে কিছু দেখা যায় কি?
আমাদের অনুসন্ধান হলো, উন্মুক্ত গ্রাম সংগঠনের দুর্বলতা (পড়ুন বৈশিষ্ট্য) শুধু ধর্মের ক্ষেত্রেই সীমিত ছিল না; অন্যান্য ক্ষেত্রেও ছিল। যেমন বাউল সংস্কৃতির বিকাশে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে ফকির সন্ন্যাসী বিদ্রোহের কথা। এই অঞ্চলে ওয়াহাবি ও ফরায়েজি আন্দোলন যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সফল না হলেও সমাজে অনেক বেশি প্রভাবক শক্তি হিসেবে আবির্ভূত হলো, তার পেছনে ছিল উন্মুক্ত গ্রামসমাজের ভূমিকা। বাংলাদেশের ৬৪টি জেলার মধ্যে ৮ থেকে ১০টি জেলার নামকরণ হয়েছে মুসলমান পীর দরবেশ আউলিয়াদের নামানুসারে। এর কোনোটাই রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে হয়নি, হয়েছে সমাজ পর্যায়ে এবং এটা সম্ভব হয়েছে উন্মুক্ত গ্রামসমাজের দুর্বলতার (পড়ুন বৈশিষ্ট্যের) কারণে।
আট. উন্মুক্ত গ্রামের প্রভাব সম্পর্কে অনুমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হলে নতুন গবেষণার সুযোগ কোথায় কোথায় রয়েছে, সে ক্ষেত্রগুলোকে চিহ্নিত করা প্রয়োজন।
এ ক্ষেত্রে আমরা মনে করি, উন্মুক্ত গ্রামের প্রভাব সম্পর্কে ইসলামে ধর্মান্তরের বাইরে আরও যেসব ক্ষেত্র রয়েছে, যা নিয়ে বিশদভাবে গবেষণা হতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা সাত নাম্বারের সুপারিশের ক্ষেত্রেই আলোকপাত করেছি। এক. বাউলসংস্কৃতির বিকাশে, দুই. ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে, তিন. ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের প্রভাব নিয়ে, চার. স্থানের নামকরণের ক্ষেত্রে বিশেষ করে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের নামানুসারে একটা জেলার নামকরণ কীভাবে হলো, তার নেপথ্যের সামাজিক কারণ অনুসন্ধানের ক্ষেত্রে।
‘বাঙালি মুসলমানের সত্তার অন্বেষা: নদীর পথেই জাতির ঠিকুজি’ গবেষণালব্ধ এই লেখায় আমরা যে তথ্য, তত্ত্ব, ব্যাখ্যা, বিশ্লেষণ, তর্ক ও সিদ্ধান্ত সাপেক্ষে রিচার্ড ইটন, অসীম রায় ও আকবর আলি খানের গবেষণা ও অনুসন্ধানের সঙ্গে বেশ কিছু ক্ষেত্রে একমত হতে পারছি না। তার অন্যতম কারণ সময়। আমরা বলছি বাংলায় ইসলামের আবির্ভাব মধ্যযুগে হয়নি—এমনকি মুসলমানের শাসকদের হাত ধরেও হয়নি। ইসলামের আবির্ভাব হয়েছে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জীবদ্দশায় এবং তাঁর মৃত্যুর পরপরই। এ ক্ষেত্রে আরব বণিকেরা প্রথম কার্যকর ভূমিকা পালন করে এবং তারপর এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকে। মুসলিম শাসনকালে এবং সুফি-দরবেশ-পীর-ফকির-আউলিয়াদের সময়কালে ইসলামের প্রসার বাড়ে এবং ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের সংহত এক রূপ সংগঠিত হয়। এবং ১৮৭২ সালের প্রথম আদমশুমারির মধ্য দিয়ে বিষয়টা দৃশ্যমান হয়। লালমনিরহাটের প্রাচীন মসজিদকে আমরা এই গবেষণার জন্য গুরুত্বপূর্ণ এক উপাদান মনে করছি। যার মধ্য দিয়ে বাঙালি মুসলমানির সত্তার অন্বেষা যেমন স্পষ্ট হবে, তেমন নদীর পথেই মিলবে জাতির ঠিকুজি। এ কারণে এক্ষণে এই বিষয়টার ওপর আলোকপাতের চেষ্টা করব।
খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে সুফিদের হাত ধরে চট্টগ্রাম অঞ্চলে ইসলামের সূত্রপাত—বাংলায় মুসলানদের আগমন নিয়ে প্রভাবশালী মত এটাই। তবে ঐতিহাসিকদের এ ধারণাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে লালমনিরহাটের পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের রামদাস গ্রামের একটি ঘটনা। যার সূত্রে পাল্টে যাচ্ছে দক্ষিণ এশিয়ায় মুসলিম আগমনের ইতিহাস। ওই গ্রামের বাসিন্দারা প্রায় সাড়ে তিন দশক আগে (১৯৮৩-৮৪) একটি টিলা খুঁড়তে গিয়ে পুরোনো ইটের সন্ধান পান। এগুলোর মধ্যে একটি ইট প্রকৃতার্থে ছিল প্রাচীন শিলালিপি। তাতে আরবি হরফে খোদিত রয়েছে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯’।
স্থানীয়দের ধারণা, হিজরি ৬৯ অর্থাৎ ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবা আরব থেকে চীন যাওয়ার পথে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে বর্তমান রামদাস গ্রামে অবস্থান করেন এবং মসজিদ নির্মাণ করেন। শিলালিপিটি হারিয়ে যাওয়া সেই মসজিদটির।
প্রাচীন ওই শিলালিপি বর্তমানে রংপুরের তাজহাট জমিদারবাড়ি জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে। সাড়ে তেরো শ বছর আগের এই শিলালিপির সূত্র ধরেই বাংলায় তথা উপমহাদেশে মুসলমানদের আগমনের ইতিহাস নতুনভাবে চর্চার সুযোগ উন্মোচন করেছে। যদিও ইতিহাস পাল্টে দেওয়ার সম্ভাবনা জাগানো এ আবিষ্কারের এত বছর পরও এ নিয়ে এই দেশের ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকেরা মোটেই আগ্রহ দেখাননি। এ কারণে আজও অজানা রয়েছে হারানো মসজিদের ইতিহাস। যে ইতিহাস আবিষ্কৃত হলে পাল্টে যাবে এই অঞ্চলে মুসলমানদের আগমনের চেনা সন-তারিখ।
স্থানীয় বাসিন্দারা কালের অতলে হারিয়ে যাওয়া মসজিদটির নাম দিয়েছেন ‘হারানো মসজিদ’। যে জমিতে ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছিল, সেখানেই নির্মাণ করা হয়েছে নতুন একটি মসজিদ। যে শিলালিপির সূত্র ধরে হারানো মসজিদকে ৬৯ হিজরির বলা হচ্ছে, সেটা নানা হাত ঘুরে এখন জাদুঘরে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রেডিও কার্বন ডেটিং পরীক্ষার মাধ্যমে এর বয়স নির্ণয় সম্ভব। সেটা করা গেলে এক অজানা ইতিহাসের দ্বার যেমন উন্মোচিত হবে, একই সঙ্গে এই অঞ্চলে ইসলামের ইতিহাস নতুন করে লেখার সুযোগ আসবে। কিন্তু প্রথাগত দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে ইতিহাস অনুসন্ধানের অনুসন্ধিৎসু মানসিকতার অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে হারানো মসজিদের অমূল্য ইতিহাস।
আমরা মনে করি, কেবল রেডিও কার্বন ডেটিং পরীক্ষার মাধ্যমে হারানো মসজিদের সময়কাল নির্ধারণ করা যুক্তিযুক্ত হবে না। কার্বন পরীক্ষা অনেকগুলো প্রক্রিয়ার একটি হতে পারে। মনে রাখা প্রয়োজন, হিজরি ৬৯ সাল লেখা শিলালিপিটি অনেক পরেরও হতে পারে। মসজিদটির কোনো এক সংস্করণের সময় হয়তো ওটা লিখিত হয়েছিল। ভারতের কেরালা রাজ্যেও চেরামন পেরুমলের মসজিদকে এ ক্ষেত্রে আমরা উদাহরণ হিসেবে নিতে পারি। এই মসজিদ হজরত মুহাম্মদ (সা.) বেঁচে থাকতে ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত হয়। বিভিন্ন সময়ে যার সংস্কার হয়েছে। ওই মসজিদের রেডিও কার্বন ডেটিং পরীক্ষা করে কি তাঁর সময়কাল নির্ধারণ করা সম্ভব? উত্তরবঙ্গে উমাইয়া শাসনামলের মুদ্রা পাওয়ায় প্রমাণিত হয়, এই অঞ্চলে একদা ওই সময়ের মুদ্রার লেনদেন ছিল। এই মসজিদের সময়কাল খুঁজে পেতে স্থান নাম, লোক ইতিহাস, নদীর প্রবাহ-বিশেষ করে ব্রক্ষ্মপুত্র অববাহিকার প্রবহমানতা এবং পথ বদলানোর ইতিহাস, স্থানের বৈশিষ্ট্য এবং ভৌগোলিক অবস্থান, সিল্ক রুটের ইতিহাস এবং তার বাণিজ্যপথের মানচিত্র, আন্তর্জাতিক মানচিত্রের নিরিখে এই স্থানের গুরুত্ব, আবহাওয়া ও জলবায়ুগত দিক দিয়ে এই স্থানের বৈশিষ্ট্য এবং তার কয়েক শতাব্দীর ইতিহাস, জনবিন্যাসগত বৈশিষ্ট্য, অন্য ধর্মাবলম্বীদের ইতিহাস ও অবস্থান, এখানকার প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য, ভূমির ধরন, অর্থনৈতিক ইতিহাস, সামাজিক বৈশিষ্ট্যাবলি প্রভৃতিকে গুরুত্বের সঙ্গে পর্যবেক্ষণপূর্বক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সাপেক্ষে সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হবে।
উল্লেখ্য, এখন যেখানে হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স সেখানে একসময় ছিল উঁচু টিলার মতো। ওই স্থানটির নাম ছিল মোস্তের আড়া বা মজদের আড়া। আড়া শব্দের অর্থ জঙ্গলপূর্ণ স্থান। দীর্ঘদিনের পতিত ওই টিলা সাপ-বিচ্ছুসহ হিংস্র জীবজন্তু থাকায় কেউ সাধারণত সেখানে যেত না। তবে অনেকে সেখানে অনেক আগরবাতি, ফুল, ধূপ, মোমবাতি দিত। ১৯৮৩-৮৪ সালের দিকে ওই টিলা সমান করার জন্য খোঁড়া শুরু হলে মাটির তলা থেকে প্রচুর পুরোনো ইট উঠে আসতে থাকে। আশপাশের লোকজন সেসব ইট নিজেদের বাড়িতে নিয়ে যান। এর মধ্যে রামদাস গ্রামের আইয়ুব আলী তার বাড়িতেও ইট নিয়ে যান।
আইয়ুব আলী তাঁর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া ইটগুলো পরিষ্কার করতে গেলে স্তূপ থেকে একটি ইট ছিটকে পড়ে। তিনি এ ঘটনায় কৌতূহল বোধ করেন। ভালো করে দেখতে গিয়ে তার চোখে পড়ে, ইটটিতে কী যেন লেখা আছে। টিউবওয়েলের পানিতে ইটটা ভালো করে ধুয়ে নেন তিনি। ৬ ইঞ্চি দৈর্ঘ্য, ৬ ইঞ্চি প্রস্থ ও ২ ইঞ্চি পুরুত্বের ইটটা অন্যদের তিনি দেখান। এরপরই আবিষ্কৃত হয় সেটা সাধারণ ইট নয়। একটি শিলালিপি। ওপরে স্পষ্টাক্ষরে লেখা, ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ, হিজরি সন ৬৯’। এ ঘটনায় স্থানীয়দের দৃঢ় ধারণা জন্মে, এটা কোনো হারানো মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।
ওই আবিষ্কারের পর রামদাসের বাসিন্দা আফছার আলীর জীবনে একটি অলৌকিক ঘটনার সূত্রে মোস্তের আড়ায় নতুন করে মসজিদ নির্মিত হয়। স্থানীয় বাসিন্দাদের মতে, এক রাতে আফছার আলী শুনতে পান, একজন বলছেন, ‘(কণ্ঠটা ঠিক তার ভায়রা নওয়াব আলীর মতো) চলো, আমরা মোস্তের আড়ায় নামাজ পড়ি।’ একথা শোনার পর নামাজ পড়ার জন্য তিনি বেরিয়েও পড়েন। একসময় পৌঁছে যান ভায়রার বাড়িতে। অপেক্ষা করতে থাকেন, কিন্তু ভায়রা আর বাড়ির ভেতর থেকে বের হন না। পরে ডাকাডাকি শুরু করেন এবং বলেন, নামাজ পড়ার জন্য ডেকে নিয়ে এসে তুমি আর বেরোচ্ছ না কেন? এ কথা শুনে নওয়াব আলী তাজ্জব বনে যান। ঘটনাটা এলাকায় জানাজানি হলে, সবাই মিলে ওই দিন থেকেই নামাজ পড়া শুরু করেন। এলাকাবাসীর মতে, সেটা ’৮৬ সালের ঘটনা, ওই দিন ছিল মহররমের ১০ তারিখ। পরবর্তী সময়ে এখানেই নির্মাণ করা হয় হারানো মসজিদ কমপ্লেক্স এবং একটি নূরানী মাদ্রাসা।
এখন যেখানে হারানো মসজিদ, তার তিন কিলোমিটারের মধ্যে সুবেদার মুনছুর খাঁ নিদাঁড়িয়া মসজিদ অবস্থিত। পঞ্চগ্রাম ইউনিয়নের নয়ারহাট পাড়ায় অবস্থিত এই মসজিদ মোগল আমলের স্থাপত্যকীর্তির সাক্ষ্য বহন করছে। অবশ্য এটিও দীর্ঘদিন লোকচক্ষুর আড়ালে ছিল। স্থানীয় লোকজন গরু খুঁজতে গিয়ে একটা জঙ্গলের ভেতর মসজিদটি খুঁজে পান।
রামদাস গ্রামের বাসিন্দারা মনে করেন, হারানো মসজিদটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর একজন সাহাবির স্মৃতি। তিস্তা-ব্রহ্মপুত্রের এই অববাহিকা ধরে আবু আক্কাছ (রা.) নামের ওই সাহাবা একসময় চীনে গিয়েছিলেন। চীনের বিস্মৃত কোয়াংটা নদীর ধারে কোয়াংটা শহরে তার নির্মিত মসজিদ ও সমাধি রয়েছে। ৬৯ হিজরি বা ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে হারানো মসজিদটি তার হাতেই নির্মিত। উল্লেখ্য, আবু আক্কাছ নামে হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর কোনো সাহাবি ছিলেন না। চীনে ইসলাম ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে যে সাহাবি যান, তাঁর নাম সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.)। তিনি ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে চীনের চাংঘান নগরে পৌঁছান। আমাদের ধারণা, সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) রামদাস গ্রামের মানুষের কাছে অপভ্রংশ হয়ে আবু আক্কাছ (রা.) হয়েছে। আমরা বিস্মিত হই যখন দেখি নামের এ রকম মিলই নয় শুধু সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস (রা.) চীনে পৌঁছান ৬৫১ খ্রিস্টাব্দে আর লালমনিরহাটের রামদাস গ্রামের প্রাচীন মসজিদটি নির্মিত হয়েছে ৬৯ হিজরি মোতাবেক ৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে। লালমনিরহাট থেকে চীনের যোগাযোগও তুলনামূলকভাবে সহজ। এখান থেকে সিকিম হয়ে খুব সহজেই যাওয়া যায় চীনে এবং চীনের যে স্থানে তিনি যান, সেই স্থানটি লালমনিরহাট থেকে নিকটবর্তী।
উল্লেখ্য, ইতিহাসবিদেরাও মনে করেন, খ্রিস্টীয় সন গণনার অনেক আগেই তিস্তা-ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় গড়ে ওঠে সভ্যতা। এই অববাহিকা পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন অববাহিকা। বর্তমান বাংলাদেশের উত্তর ও মধ্যাঞ্চলজুড়ে ওই সভ্যতার সঙ্গে প্রাচীন রোমান ও আরব সভ্যতার যোগাযোগ অস্বাভাবিক কিছু নয়। এ কারণে ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা ধরে নবীর সাহাবা সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাছ (রা.)-এর লালমনিরহাটে আসাটা অসম্ভব কিছু নয়। এখনো হারানো মসজিদের কাছে বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ রয়েছে। এলাকাবাসী এটিকে চকচকার বিল বলেন। তবে প্রবীণদের কাছে এটি সাগরের ছড়া নামে পরিচিত। ছড়া বলতে বোঝায়, যা ছিটিয়ে বা ছড়িয়ে থাকে। সাগরের ছড়ার অর্থ সাগর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা। ব্রহ্মপুত্রের রূপ একদা এমনই ছিল যে তাকে সাগর বলেই মনে করার পাশাপাশি লোকমুখে প্রচলিতও ছিল। গ্রামবাংলায় বড় নদীকে এখনো সাগর বলা হয়। ব্রহ্মপুত্র শুধু বাংলার নয়, পৃথিবীর প্রধানতম নদীগুলোর একটি। বর্তমান সময় থেকে তেরো শ বছর আগের প্রাচীন বাংলায় ব্রহ্মপুত্রের স্বরূপ কেমন ছিল, তা সহজে অনুমেয়। আমাদের অনুমান ব্রহ্মপুত্রের একটা শাখা বেরিয়ে সেই সময় রামদাস গ্রামের পাশ দিয়ে প্রবাহিত হতো এবং লোকমুখে যার পরিচিতি ছিল সাগরের ছড়া নামে। প্রাচীন মানুষের সাগরের ছড়া সময় পরিক্রমায় হয়েছে চকচকার বিল। কিন্তু আদিম সাগরের ছড়াও রয়ে গেছে বয়স্কজনের মুখে মুখে। স্থানীয়ভাবে এই জনশ্রুতি এখনো জারি আছে যে, এই ব্রহ্মপুত্র ধরেই হয়তো সিকিম পেরিয়ে চীনে পৌঁছেছিলেন সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাছ (রা.)।
বাংলাদেশের ইতিহাসবিদ ও প্রত্নতাত্ত্বিকদের এ ব্যাপারে আগ্রহ না থাকার পেছনে প্রধান কারণ, ইসলামের ইতিহাস নিয়ে প্রথাগত ধারণাতেই তাঁরা অনড় রয়েছেন। তাঁদের বদ্ধমূল ধারণা, খ্রিস্টীয় দশম শতাব্দীতে চট্টগ্রাম অঞ্চলে সুফিদের আগমনের মধ্য দিয়ে বাংলা অঞ্চলে প্রথম মুসলমানদের আগমন। ১১০০-১২০০ শতকে সুফিদের মাধ্যমেই পূর্ব বাংলায় ইসলামের বিস্তার। পরে সুলতান ও মোগলদের মাধ্যমে এখানে ইসলামের প্রসার। তবে ক্ষীণ ধারা হলেও কোনো কোনো ঐতিহাসিক মনে করেন, খ্রিস্টীয় সপ্তম বা অষ্টম শতাব্দীতেই বঙ্গোপসাগর দিয়ে চট্টগ্রাম অঞ্চলে আরব বণিকেরা এসেছিলেন।
ভারতীয় উপমহাদেশে বর্তমান ভারত রাষ্ট্রের কেরালায় আরও আগে থেকেই আরবীয়দের আসার সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া যায়। কেরালার ত্রিসুর অঞ্চলের কুদুঙ্গালুর তালুক শহরের মিথালা নামক গ্রামে অবস্থিত চেরামান জামে মসজিদকে এখন পর্যন্ত উপমহাদেশের সবচেয়ে প্রাচীন মসজিদ বলে মনে করা হয়। মসজিদটির সম্মুখভাগে স্থাপিত শিলালিপির ভাষ্যানুযায়ী পঞ্চম হিজরি মোতাবেক ৬২৯ খ্রিস্টাব্দে সাহাবি হজরত মালিক বিন দিনার (রা.) মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।
৬৪৮ খ্রিস্টাব্দে লালমনিরহাটে মসজিদ নির্মাণ হতে পারে কি না, এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্নতাত্ত্বিকদের সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান আমেরিকান ইনস্টিটিউট অব আর্কিওলজিস্টের মত হলো, এমনটা ঘটা অসম্ভব কিছু নয়। কেননা, রোমান ও জার্মান ইতিহাসবিদের লেখায় আরব ও রোমান বণিকদের ব্রহ্মপুত্র অববাহিকায় নৌবাণিজ্যের সূত্রে আসা-যাওয়ার কথা লিপিবদ্ধ আছে। ব্রহ্মপুত্র-তিস্তা অববাহিকা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার ইতিহাস এখন প্রতিষ্ঠিত এক সত্য। ব্রহ্মপুত্র ও তিস্তার পাড় ধরে সিকিম হয়ে চীনের ভেতর দিয়ে আরব বণিকদের বাণিজ্য বহরের যাতায়াতের অনেক প্রমাণও মিলেছে এ গবেষণায়। খ্রিস্টপূর্ব সময় থেকে ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা দিয়ে চীন ও ভারতবর্ষ থেকে রোমান ও আরবেরা পণ্য নিয়ে যেত।
ইতিহাসের এসব তথ্য-প্রমাণ থেকে এটা স্পষ্ট যে, লালমনিরহাটের প্রত্যন্ত গ্রামে টিলা খুঁড়তে গিয়ে যে ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে, তার একটি ঐতিহাসিক যোগসূত্র অবশ্যই রয়েছে। তবে ইতিহাস তো শুধু ধারণাগত বিষয় নয়, প্রমাণ করতে হয় তার সত্যকে। ইতিহাসের এই সত্য প্রমাণে প্রাধান্য দিতে হয় বহুকৌণিক মতামত। একপক্ষীয় কিংবা নির্দিষ্ট কোনো সীমায় যদি সীমিত করে দেওয়া হয়, তাহলে তার অনুসন্ধানও সীমাবদ্ধ হয়ে ওঠে। এ কারণে ইতিহাসকে দেখতে হবে পাখির দৃষ্টিকোণে এবং আলো ফেলতে হবে সর্বত্র।
আমরা মনে করি, প্রথমত, বাঙালি মুসলমানমাত্রই নিচুজাতির হিন্দুর উত্তরপুরুষ নয়, এ সংখ্যা এক তৃতীয়াংশের কম। দ্বিতীয়ত, বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস সাম্প্রতিক নয়, এমনকি মধ্যযুগেরও নয়। বাঙালি মুসলমানের ইতিহাস আরবের মুসলমানদের সমসাময়িক। অর্থাৎ হজরত মুহাম্মদ (সা.) যখন ইসলামের আলো ছড়িয়েছেন আরব বিশ্বে। ঠিক তখনই কিংবা তার কিছুদিনের মধ্যেই বাংলায় হাজির হয়েছে ইসলামের আলো। তারপর নানা ঘটনা এবং চড়াই-উতরাইয়ের মধ্য দিয়ে তার প্রচার ও প্রসার অব্যাহত থেকেছে এবং আজকের সংহত অবস্থানে এসে দাঁড়িয়েছে।
আকবর আলি খানের প্রতি সুবিচার হয়নি। লেখক নিজের বক্তব্যের পক্ষে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য ও রেফেরান্স দেন নি।
শমশির
অক্টোবর ০২, ২০২২ ১৩:১৫
অসাধারণ লেখনি।ধন্যবাদ এমন আরও লেখনি চাই তর্ক বাংলার কাছে।
Ahmad Bin Abdus Salam
অক্টোবর ০২, ২০২২ ১৩:০৬