মঙ্গলেশ ডবরালের কবিতা
মঙ্গলেশ ডবরাল
৯ ডিসেম্বর ২০২০ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিলেন হিন্দি সাহিত্যের স্বনামধন্য কবি মঙ্গলেশ ডবরাল। হিন্দি ভাষার আরেক কবি রঞ্জনা মিশ্রের ইমেল প্রতিউত্তরে সেদিন জানতে পেরেছিলাম কবির মৃত্যুর খবর। ইতিপূর্বে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত হিন্দি ভাষার আরেক সুপরিচিত তরুন কবি-বন্ধু পরাগ পাবন মেসেঞ্জার আলাপে হিন্দি সাহিত্যের উল্লেখযোগ্য বেশ কিছু কবিদের মধ্যে মঙ্গলেশ ডবরাল-এর নামও উল্লেখ করেছিলেন। হিন্দি ভাষার অনলাইন আর্কাইভ কবিতাকোষ-এ মঙ্গলেশ ডবরালের প্রায় অধিকাংশ কবিতাই রয়েছে। সে সময়ে তত মনোযোগ দিয়ে না পড়লেও তাঁর মৃত্যুর পর পর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ পাহাড় পর লালটেন, ঘর কা রাস্তা, হাম যো দেখতে হ্যাঁয়, আওয়াজ ভি এক জগাহ্ হ্যাঁয় বেশ মনোযোগ দিয়েই পড়েছি। তাঁর কবিতার বিষয় এবং উপস্থাপনার নতুনত্ব হিন্দি সাহিত্যের পাঠকদের মাঝে বেশ প্রশংসা পেয়েছে। মার্কসীয় মতাদর্শের অনুরাগী হিন্দি ভাষার এই জনপ্রিয় কবি তাঁর কবিতায় প্রতীকীভাবে তুলে ধরেছেন সমাজ-বৈষম্যের বিভিন্ন দিক। তাঁর কাব্যচেতনাকে কবির অন্তর্নিহিত পরিভ্রমণ বলে মনে হলেও মূলত সেখানে মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ কণ্ঠস্বরে বরাবর উঠে এসেছে পুঁজিবাদী উন্মাদনা, সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রতি তীব্র শ্লেষ। সামাজিক নিপীড়ন থেকে শুরু করে, ভারতীয় বর্ণপ্রথা, সাম্প্রদায়িকতার মতো বিষয়গুলোতেও তিনি সোচ্চার ছিলেন সব সময়।
সুপরিচিত হিন্দি ভাষার কবি আসাদ জায়েদী উল্লেখ করেছেন, ‘কবি হিসেবে তাঁর কোনো দেখনদারি ছিল না তবে তাঁর ভাষার সাবলীলতা এবং সর্বস্তরের সমাজবর্গকে কবিতার ভূমিতে বাঙ্ময় প্রতিষ্ঠা দেওয়ার সারল্য হিন্দি কবিতায় নতুন সম্ভাবনার বীজ বপন করেছিল।’
ভারতের উত্তরাখন্ড রাজ্যের টিহরী গারওয়াল পার্বত্য জেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কাফলপানীতে ৯ মে ১৯৪৮ সালে জন্মগ্রহণ করেন মঙ্গলেশ ডবরাল। দেরাদুনে শিক্ষাজীবনের পাঠ চুকিয়ে চলে যান দিল্লিতে। ১৯৬০ এর শেষ দিকে হিন্দি পেট্টিওট, ভারতভবন এবং আশপাশের বেশ কিছু দৈনিকে কাজ করার পর ভুপাল মধ্যপ্রদেশ কলা-পরিষদ, ভারতভবন থেকে প্রকাশিত ম্যাগাজিন পূর্বাগ্রহ-তে সহযোগী সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত হন। সেখানে বেশ কয়েক বছর কাজ করার পর সত্তর দশকের শেষের দিকে জনসত্তা পত্রিকার সম্পাদক হন। সাহারা সময় পত্রিকায় কাজ করার পূর্বে এলাহাবাদ ও লখনউ থেকে প্রকাশিত অমৃত প্রভাত-এর মতো পত্রিকাও তিনি সম্পাদনা করেন। পাশাপাশি কনসালট্যান্ট হিসেবে যুক্ত ছিলেন ভারতের ন্যাশনাল বুক ট্রাস্ট-এর সঙ্গে। হিন্দি মাসিক পত্রিকা পাবলিক এজেন্ডা’র— সম্পাদক হিসেবেও কাজ করেছেন দীর্ঘদিন।
সত্তরের দশকে নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার মধ্য দিয়ে কবি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন ডবরাল। ভারতের সিপিআইএমএলের সাংস্কৃতিক সংগঠন ‘জনসংস্কৃতি মঞ্চে’র সঙ্গে আজীবন যুক্ত ছিলেন। সেই সময়ে পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত ভয়াবহতা, মুক্ত বাজার অর্থনীতির বিভ্রান্তি ও হুমকিগুলো গভীরভাবে অনুধাবন করতে পেরেছিলেন তিনি। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে বেশ কয়েকটি সেরা হিন্দি কবিতাও লিখেছিলেন।
মূলত জনসত্তা’-র রবিবার পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে প্রভূত খ্যাতি লাভ করেন মঙ্গলেশ ডবরাল। এই পত্রিকায় কাজ করার সময় থেকে নতুন প্রজন্মের অসংখ্য হিন্দি তরুণ কবি ও লেখকদের তিনি পথ দেখিয়ে গেছেন। তাঁর অসামান্য লেখনীর জাদুতে তিনি সাহিত্য ও সাংবাদিকতার মধ্যে এক আশ্চর্য যোগসূত্র স্থাপন করে গেছেন। তাঁর প্রধান পাঁচটি কাব্যগ্রন্থ ছাড়াও হিন্দিতে ‘অপার খুশি কা ঘরানা’ শিরোনামে অনুবাদ করেছেন অরুন্ধতী রায়ের The Ministry of Utmost Happiness গ্রন্থটি।
গদ্যগ্রন্থ হিসেবে লেখক কি রোটি, কবিকা আলোকপান আলাদাভাবে উল্লেখের দাবি রাখে। এ ছাড়া তাঁর ব্যক্তিজীবনের অনেক কিছু প্রতিফলিত হয়েছে ‘এক রাগ কে অবশেষ’ গদ্যে। দারুণ গদ্যশৈলীতে ডবলার তাঁর শৈশব, গ্রাম এবং শাস্ত্রীয় সঙ্গীত শিল্পী পিতার জার্মান রিডের হারমোনিয়ামে বাজানো রাগ দুর্গার বর্ণনা দিয়েছেন। এক রাগ কে অবশেষ গদ্যটি তিনি শেষ করেছেন এভাবে—‘দুর্গা ছিল সভ্যতার মতো একটি অস্থির রাগ। যে রাগ অন্ধকারের পাতলা স্তরে ভেসে বেড়াত জল, নদী, ঘাস পাথর ও পাখিদের নিয়ে। একটি রাগ যা এখন এর অবশিষ্টাংশে টিকে আছে।’
ডবরাল হাম যো দেখতে হ্যাঁয় কাব্যগ্রন্থের জন্য ২০০০ সালে সাহিত্যে ভারত সরকারের দেওয়া সর্বোচ্চ সম্মান ‘সাহিত্য অকাদেমি’ পুরস্কার-এ ভূষিত হন। তাঁর কবিতাগুলো প্রধান ভারতীয় ভাষাসহ ইংরেজি, রাশান, জার্মান, ডাচ, স্প্যানিশসহ আরও বেশ কয়েকটি ভাষায় অনূদিত হয়েছে। তিনি যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়ার্ল্ড রাইটার্স প্রোগ্রাম’-এ সম্মানীয় অতিথি হিসেবেও অংশগ্রহণ করেন। মূল হিন্দি থেকে বাংলা ভাষার পাঠকদের জন্য মঙ্গলেশ ডাবরালের কিছু কবিতা অনুবাদ করার মধ্য দিয়ে জানাই প্রয়াত এই কবির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা। মূল হিন্দি থেকে অনুবাদ ও ভূমিকা অজিত দাশ
বর্ণমালা
একটা ভাষায় অ লিখতে চাই
অ-তে অজগর অ-তে অপূর্ব
অথচ লিখতে হয় অ-তে অনর্থ, অ-তে অত্যাচার
চেষ্টা করি ক-তে কলম অথবা করুণা লিখতে
অথচ লিখতে থাকি ক-তে ক্রূরতা, ক-তে কুটিলতা
এতদিন খ-তে লিখে এসেছি খরগোশ
অথচ এখন খ-তে খবরদারের পদধ্বনি শুনতে পাই
ভেবেছি ফ-তে শুধু ফুলই লেখা হয়
অনেক অনেক ফুল—ঘরের বাইরে,
ঘরের ভিতর, মানুষের ভিতর
অথচ আমি দেখি সব ফুল চলে যাচ্ছে
নির্দয়, পাষাণদের গলায় দেওয়ার জন্য
কে যেন আমার হাত চেপে ধরে আর বলে—
ভ-তে লেখ ভয় যা এখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে!
দ-তে দমন আর প-তে পতনেরই সংকেত
আততায়ীরা ছিনতাই করে নেয় আমাদের সব বর্ণমালা
তারা ভাষার হিংসাকে বদলে দেয় সমাজের হিংসায়
এখন হ-কে হত্যা লেখার জন্য সুরক্ষিত করা হয়েছে
আমরা যতই হ-তে হল অথবা হরিণ লিখি না কেন
তারা প্রতিবার হ-তে হত্যা লিখতে থাকবে।
অন্তরাল
রাতের সবুজ পাহাড় শিয়রে এসে দাঁড়ায়,
পাহাড়চূড়া থেকে ধেয়ে আসা তোমার আওয়াজ
পলেস্তারা খসা আমার ঘরে এসে পড়ে
আর ফেলে আসা দৃশ্যের আবহ সঙ্গীতে
পরিশ্রুত হয়ে আসে তোমার দেহবর্ষণ
পাথরে নুইয়ে থাকা ঘাস
স্ব-ইচ্ছায় অজস্র ঝরে পড়ে
এক নির্গন্ধ মৃত্যু আর সেই সব—
যা দিয়ে তৈরি তোমার দেহ লাবণ্য
ফিরে আসে আমার রক্তের স্রোতে
আবারও টেনে হেঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
ছায়া
ছায়া ততটাই জীবিত
যতটা তুমি
তোমার আগে পিছে
অথবা তোমার ভেতরে
লুকিয়ে রয়েছে
অথবা সেইখানে
যেখান থেকে তুমি
চলে এসেছ।
এই সেই চোখ
করুণা আর ক্রূরতা গলাগলি করে আছে
কিছুটা গৌরব গভীর শরমে ডুবে আছে
লড়াই করার বয়স যখন
লড়াই ছাড়া অবসর কেটে যাচ্ছিল—
সেখানে কোনো যুদ্ধ শেষে
ফিরে আসা সৈনিকের যাতনা রয়েছে
আর এই সেই চোখ যে আমাকে বলে—
প্রেম—যার ভেতর আর সব টিকে আছে
কতটা বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে
প্রেম
কোনো এক বড় দার্শনিক
একবার আমাকে বলেছিলেন—
প্রেম একটা ভারী পাথরের মতো
কি করে তোমার মতো দুর্বল
সেই পাথরের ভার বহন করবে!
আমি ভেবেছি, সেই পাথরকে
টুকরো-টুকরো করে কেটে কাঁধে নেব
কিন্তু তখন কোথায় থাকবে সেই প্রেম
সেটা হবে একটা হত্যাকাণ্ড!
কোনোদিন
কোনোদিন
দেওয়ালে পিঠ ঠেকে যাবে আমার
আমি যে আলোয় বসে বসে
কবিতা বাছি
কোনোদিন
আমার কাপড় ভেসে যাবে নদীতে
চিঠিগুলুতে ধুলো জমে যাবে
ঘরে সাপ ঢুকে পড়বে কোনোদিন
কোনোদিন
মুখের স্বাদ চলে যাবে
হাতের রেখা অদৃশ্য হয়ে যাবে
রাতের বেলা বই চুরি হয়ে যাবে
চশমা দ্রুত ভেঙ্গে যাবে
কোনোদিন
শুধু দেওয়ালই থেকে যাবে
যেখানে আমার পিঠ ঠেকিয়ে দেব।
পাতার মৃত্যু
কতগুলো পাতা উড়ে আসে অবিরত
আমার মুখের উপর
ছেলেবেলার সেই গাছগুলো থেকে
এক নদী তার ঢেউ পাঠিয়ে দেয় আমার কাছে
আর সেই ঢেউয়ের মতো কাঁপতে থাকে রাত
আর সে রাতে মুখের উপর
মৃত পাতাদের নিয়ে পথ চলতে থাকি আমি
পাখির ডাক ফুরিয়ে গেছে
নেই কোনো মানুষের আনাগোনা
সূর্যের আলো ছাই হয়ে পড়ে আছে
রাস্তার দুপাশে, ঘরের দরজা বন্ধ!
আমি ডাক দেই আর সে ডাক
পুনরায় ফিরে আসে আমার কাছে।
শব্দ
কিছু শব্দ চিৎকার করে
কিছু শব্দ তাদের পোশাক ছিঁড়ে
ঢুকে পড়ে ইতিহাসে
কিছু শব্দ নীরব হয়ে যায়।