জর্জিও আগামবেনের ‘নীতিশাস্ত্র’
জর্জিও আগামবেন [১৯৪২] প্রভাবশালী ইতালীয় দার্শনিক এবং রাজনৈতিক তাত্ত্বিক। তিনি যে গুরুত্বপূর্ণ ধারণাগুলো নিয়ে কাজ করেছেন, সেগুলোর মধ্যে আছে জৈব-রাজনীতি, জরুরি অবস্থা, কর্তৃত্ব, নীতিশাস্ত্র ইত্যাদি। দ্য কামিং কমিউনিটি বইয়ের ‘নীতিশাস্ত্র’ নামের লেখাটিতে আগামবেন নীতিশাস্ত্রের গোড়ার কিছু ধারণা স্পষ্ট করেছেন। এই লেখায় তিনি বলছেন, মানবজীবনের প্রাক্সিদ্ধ কোনো উদ্দেশ্য বা গন্তব্য নাই। তাকে শূন্যাবস্থা থেকে ‘একটা কিছু’ হয়ে উঠতে হয়। এই সম্ভাবনা ও সম্ভাব্যতাই মানব অস্তিত্বের সহজ সত্য। আবার, সম্ভাবনা একধরনের অভাব, যে অভাবের, এবং তা পূরণ করতে না পারার দায় তাকে নিতে হয়। মানুষের এমন একটা দশাগ্রস্ততার মধ্যে আগামবেন নীতিশাস্ত্রের কার্যকারিতা এবং এর স্বরূপ খুঁজেছেন। উল্লেখ্য বর্তমান লেখাটির উৎস জর্জিও আগামবেনের দ্য কামিং কমিউনিটি। বইটি ইংরেজিতে অনুবাদ করেন মাইকেল হার্ডট।
—ভূমিকা ও অনুবাদ: রায়হান রাইন
যে ঘটনা থেকে নীতিশাস্ত্রের যেকোনো ডিসকোর্সের যাত্রা শুরু হয়, সেটা এই যে—মানুষকে অর্জন বা উপলব্ধি করতে হবে এমন কোনো সারসত্তা আগে থেকে ঠিক করা নেই, ইতিহাস বা ঐশী সত্তার কোনো আহ্বান নেই, কিংবা মানুষের জন্য তেমন কোনো জীবতাত্ত্বিক গন্তব্যও নেই। এটাই একমাত্র কারণ, যার জন্য নীতিশাস্ত্রের মতো কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকা সম্ভব হয়েছে। যেহেতু এটা স্পষ্ট যে, মানুষকে যদি কোনো কিছু হয়ে উঠতে হতো কিংবা নিয়তি বলে কিছু যদি থাকত, তাহলে নৈতিক অভিজ্ঞতা লাভ করা সম্ভব হতো না; মানুষকে কেবল সেই কাজগুলোই করে যেতে হতো, যা তার জন্য নির্ধারিত।
যাহোক, ব্যাপারটা এমন নয় যে, মানুষ কিছুই না, এবং তাকে কোনো কিছু হয়ে উঠতে হবে না। মানুষ স্রেফ শূন্যতার হাতে সমর্পিত, এটা এমন এক পরিস্থিতি যেখানে সে স্বাধীনভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারে কোনো কিছু সে হয়ে উঠবে কি উঠবে না, কিংবা কোনো নিয়তিকে গ্রহণ করবে কি করবে না [নাস্তিবাদ এবং সিদ্ধান্তবাদ এই জায়গায় এসে একসঙ্গে মিলেছে]। কাজেই, মানুষ অবশ্যই কোনো কিছু এবং তাকে কিছু একটা হয়ে উঠতে হয়, কিন্তু এই ‘কিছু একটা’কে সারসত্তা বলা যাবে না, বা এটা ঠিকঠাকমতো কোনো বস্তুও নয়: সম্ভাবনা বা সম্ভাব্যতা হিসেবে কারও অস্তিত্বের এটাই সহজ সত্য। ঠিক এই কারণে ব্যাপারগুলো জটিল হয়ে ওঠে; এবং ঠিক এই কারণে নীতিশাস্ত্র কার্যকর হয়ে ওঠে।
যেহেতু সম্ভাবনা বা সম্ভাব্যতা মানে হচ্ছে মানবজাতির কাছে অধিকতর উপযুক্ত হয়ে ওঠা, কাজেই মানুষের একটা দায়বদ্ধতা থাকে, এবং সে এই দায়বদ্ধতা অনুভব করে [অর্থাৎ, মানবজাতির কাছে যতটা সে উপযুক্ত সত্তা হয়ে উঠতে পারে, যতটা সে সম্ভাবনাময়, এক অর্থে সেটা একটা অভাব, যতটা সে হয়ে উঠতে ব্যর্থ হয়, কাজেই মানবসত্তার ভিত্তি বলতে কিছু নেই, এবং এটা কখনোই ছিল না]। মানুষ যে হওয়া ও না-হওয়ার এই সম্ভাবনার মধ্যে থাকে, অন্য কথায় বললে, এটাই তার দায়বদ্ধতা, সদা-সর্বদাই সে দায়বদ্ধ। কোনো নিন্দনীয় কাজ না করেও তার মধ্যে সব সময় একটা অপরাধবোধ কাজ করে।
এটাই আদিপাপের ধারণা, সাবেকি ধর্মতাত্ত্বিক মতবাদে যার উল্লেখ আছে। অন্যদিকে, নৈতিকতা এ মতবাদ দিয়ে বোঝায় মানুষের করা নিন্দনীয় কাজকে। এভাবে, ব্যাপারটাকে অতীতে নিয়ে গিয়ে মানুষের সম্ভাবনাকে শিকলবদ্ধ করা হয়। মানুষ মন্দকে শনাক্ত করেছে এবং এটা নিন্দনীয় কাজকে শনাক্ত করার চেয়ে বেশি পুরোনো এবং অধিকতর মৌলিক একটা ব্যাপার। এর ভিত্তি হিসেবে একমাত্র যে ঘটনাটি আছে তা হলো—সম্ভাব্য বা সম্ভাবনাময় হতে গিয়ে মানুষকে কোনো না কোনোভাবে ব্যর্থ হতে হয়, এবং তাকে এই ব্যর্থতার দায় নিতে হয়, তাকে ‘অস্তিত্ব’ বজার রাখতে হয় ‘সম্ভাবনা’ হিসেবে। ঠিক যেমন ক্রেতিয়ান দে তোয়ার উপন্যাসের চরিত্র, পেরসেভাল, যা তার নেই তার জন্য সে অভিযুক্ত। মানুষ অপরাধী এমন একটা কাজের জন্য যা সে করেনি।
এ কারণে নীতিশাস্ত্রে অনুতাপের কোনো জায়গা নেই। এ কারণেই একমাত্র নৈতিক অভিজ্ঞতা [যেটা কোনো কাজ বা সিদ্ধান্ত নয়] হলো [কারও নিজের] সম্ভাব্য হওয়ার অভিজ্ঞতা, [কারও নিজের] সম্ভাবনা হওয়ার অভিজ্ঞতা—অর্থাৎ, সকল উপায়ে কারও নিজের নিরাকৃতিকে প্রকাশ করা এবং সকল কাজে নিজের অব্যক্ততাকে প্রকাশ করা।
এখানে মন্দ ব্যাপার বলে যদি কিছু থাকে, সেটার উদ্ভব ঘটে, কেউ যখন সিদ্ধান্ত নেয় সে তার অস্তিত্বের অভাবের মধ্যেই থাকবে, মানব অস্তিত্বের সারসত্তা না থাকাটাকেই সে যখন বজায় রাখতে চায়, কিংবা থেকে যেতে চায় কেবল সম্ভাবনার গণ্ডির ভেতর [এবং এটাই নৈতিকতার ভবিতব্য], যা মানব অস্তিত্বের সবচেয়ে উপযুক্ত দশা; এ এমন এক ত্রুটি যার জন্য সব সময় সে নিগৃহীত হবে।