আশির দশক : চিত্তের ঔপনিবেশিক মুক্তির দুই লড়াই
বিগত বিশ শতকের আশির দশকটি ছিল প্রধানত কাব্যচর্চায় আমাদের প্রকৃত প্রস্ফুটন ও বিকাশের কালিকপর্ব। দশকটির প্রারম্ভে বিশ্বজগতের প্রতি বাঁধহীন মুগ্ধতা ও আত্মপ্রকাশের স্মারকরূপে আমার প্রথম কাব্য ‘জোৎস্না কেমন ফুটেছে’ [১৯৮২] প্রকাশিত হলে কবিতার নতুন-নতুন প্রণোদনায় অন্য কোনো মোহ বা আসক্তিতে গেড়ে বসার অবকাশ মেলেনি আর। সোজাসাপ্টা একরৈখিক স্রোতোধারায় অগণন সঙ্গ ও সংঘের আশ্লেষে জড়িয়ে পড়া হয় বিভিন্ন আনন্দ-বেদনাময় অভিরুচিতে। তারুণ্যের যা স্বভাব, তারই অনুকূলে এসব সঙ্গ বা সমাবেশে নানা প্রশ্নের জবাবে আর নিজেরও কৌতূহল ও জিজ্ঞাসা চরিতার্থে কিছু ভাবনা যেমন উপস্থিত হয় অকস্মাৎ, তেমনি কখনো-কখনোবা বাচিক অভিব্যক্তিও উপস্থাপন করতে হয় স্ববয়স্য বা তরুণদের মুখোমুখি হয়ে। তারই দুটি পর্ব এখানে রাখা গেল সেই সময়ের ভাবনা-কল্পনার অনুষঙ্গের স্মারকরূপে।
এক
চট্টগ্রামপর্ব : ‘১৪০০’ ছোটোকাগজের সম্পাদক কামাল রাহমান-এর ডাকে চট্টগ্রাম হালিশহরে তাঁর বাসায় আশির দশকের কবি ও কবিতা বিষয়ে একটি অনির্ধারিত বৈঠকে হাজির থাকার সুযোগ হয়। ১৯৯৫ সালের ২৭ জুলাই দুপুরের দিকে কবি রিজোয়ান মাহমুদ ফোনে জানালেন, ওই বৈঠকে উপস্থিত থাকবেন চার কবি সরকার মাসুদ, রিফাত চৌধুরী, কাজল শাহনেওয়াজ ও আহমেদ মুজিব। এঁদের মধ্যে রিজোয়ান, কামাল ও কাজলের সঙ্গে ব্যক্তিগত ও লেখালেখির সূত্রে জানাশোনা কিছুটা থাকলেও সরকার মাসুদ, রিফাত চৌধুরী ও আহমেদ মুজিব-এর সঙ্গে তা ছিল না তেমন। তবে সরকার মাসুদ ও রিফাত চৌধুরীর কবিতা বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন ও কবি খোন্দকার আশরাফ হোসেন সম্পাদিত একবিংশ-এ মাঝেমধ্যে পড়েছি। আর আহমেদ মুজিব-এর কবিতাও আবিদ আজাদ সম্পাদিত শিল্পতরুর পাতায় পড়েছি, যেটি পরবর্তীকালে প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানে রূপ নেয়। ওই আড্ডায় আমাকে বেঁধে দেওয়া সময়ের ঘণ্টাখানেক পর রাত ৮টার দিকে আমার পাহাড়িবন্ধু জুনু মারমাকে নিয়ে কামাল রাহমান-এর ভবনে যখন উপস্থিত হই, মনে হলো, আড্ডাটা তখনো জমে ওঠেনি তেমন। পরিচয়পর্ব সারবার পর কামাল রাহমান-এর প্রস্তাবে আশির দশকের কবিতা বিষয়ে কিছু কথাবার্তা শুরু হলো।
দশকটির ওপর গুরুত্ব দেবার কারণ কী? কালের পরিসরে দশকটি এখন প্রয়াত বলে? বাংলাদেশে এ-সময়েই সর্বাধিক কবির সাক্ষাৎ মেলে বলে? নাকি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ওই দশকেই লিটলম্যাগের মাধ্যমে একটা কেন্দ্রস্থ [যা বহুকাল আগে থেকে চর্চিত হয়ে আসার কারণে একটা প্রবল মোহকারী প্রাতিষ্ঠানিকতায় পরিণত হয়েছে] ধারণার ওপর উপর্যুপরি আঘাত পরিলক্ষিত হয়েছিল বলে? আরও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারও আছে। যেমন—ওই পুরো দশকটাই বলতে গেলে রাজনৈতিকভাবে আলোচিত-আলোড়িত ছিল সমরশাসন ও তার অনিবার্য প্রতিক্রিয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের দুর্বার অনলপ্রবাহের উত্থানে। এ সময়ে বিশেষ করে কবিতাকর্মীরা [ব্যাপক অর্থে সংস্কৃতিকর্মী] নিজেদের দুরন্ত চেতনা আর আত্মজিজ্ঞাসার দাহ্যে পুড়েছেন, দগ্ধ হয়েছেন সবচেয়ে বেশি। অতএব, খাঁটি সোনাও হয়েছেন তাঁরাই সর্বাধিক। আবার ওই চেতনা ও আত্মজিজ্ঞাসা রাজনীতির গুরুত্বকে ফলদায়ী করে তুলতে অর্থাৎ আন্দোলন-মিছিল-সভা-সমাবেশ প্রভৃতিতে নিয়োজিত ছিল অধিক মাত্রায়, এ-ও এক প্রবল সত্য। ফলে প্রকৃতই যে-কাজ, কবিতার জন্য, কবিতারই ভেতরে স্বৈরশাসন, স্বাধীনতাবিরোধী বা যুদ্ধাপরাধীদের জঙ্গি মনোভাব আর ওই কুপ্রভাবগুলোর আন্তর্বাস্তবতাকে অনেককালের পরের পাঠকের কাছে শিল্পের শোভায় পৌঁছে দেবার যে-ধ্যান, তা সম্পন্ন হয়নি কাঙ্ক্ষিত মাত্রায়। বলতে চাচ্ছি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে, উপর্যুক্ত সময়সীমায়, শোভনমাত্রায় হয়নি তা। তবে তা কবিতার শিরায় এবং ধমনিতে প্রকাণ্ড হুঙ্কারসহ জলো ও ত্বরিত সাংবাদিকী তথ্য ও শব্দসম্ভারসহ বিপুল পরিমাণে জায়গা দখল করে নিতে সক্ষম হয়েছে দ্রুততার সঙ্গে। মৌল যে-বস্তু, কবিতার ভেতরে অগ্রাবলোকী প্রগতির ধারণার প্রাণসত্তা ও প্রণোদায়ী অনুরণন—আশির দশকের নগরকেন্দ্রিক কবিতার শরীরে খুব একটা লক্ষ্যযোগ্য নয় তেমন।
হ্যাঁ, এই দশকে প্রধান নগর ঢাকা বাদে অন্যান্য নগর, যেমন: চট্টগ্রাম, সিলেট, বগুড়া, যশোর, বরিশাল, রাজশাহী প্রভৃতি অঞ্চলে [যে-নগরগুলোকে কেন্দ্রমনস্করা আদর করে ‘মফস্বল’ ডাকেন] কবিতাকর্মের মগজী চাষকাজে মনোনিবেশী ছিলেন যে-তরুণেরা, তারাই কবিতার অন্তর্দেশে প্রকৃত নন্দনবোধের উন্মোচক ও অন্তর্ভেদী অবলোকনের ঋত্বিক হয়ে উঠেছিলেন—শোরগোলের রাজনীতিলিপ্ততা থেকে কিঞ্চিৎ দূরে থাকার সুবাদেই। তাঁরাই বুঝেছেন ভালো, ওই আন্দোলনী জোশের ভেতরে জনমুক্তির কথা বলে তথাকথিত প্রচল রাজনীতি যতটা দলীয় স্বার্থে ক্ষমতার আলোপ্রত্যাশী ছিল ক্ষুধার্ত হাঙরের মতো, ঠিক ততটাই নিষ্প্রভ হতেছিল কবিতা বা শিল্পকলার আসল রূপরস ও সৌন্দর্যচেতনার গহনদেশ। তাই বলে অবশ্য এটি বলা যাচ্ছে না যে, রাজনীতি একটি অতীব গর্হিত, ক্ষতিকারক বা ত্যাজ্য বিষয় কিছু। সে অন্য প্রসঙ্গ। বরং এখানে সাচ্চা রাজনৈতিক চেতনার অন্তর্দেশে জীবনানন্দ-কথিত ‘পরিচ্ছন্ন কালজ্ঞান’ ও ‘কল্পনাপ্রতিভা’র অনুপস্থিতির কথাই বলতে চাওয়া হচ্ছে। এই যথার্থ কালজ্ঞান ও কাব্যপ্রতিভার দ্যুতি অধিকতর সুলক্ষ হয়েছে বলে আশির দশকের তথাকথিত ‘মফস্বলবাসী’ তরুণদের কবিতাসম্ভার ও কথাসাহিত্য ওই দশকের সবচেয়ে উজ্জ্বল সাহিত্যকৃতিরূপে দাঁড়িয়ে গেছে এখন। এবং এসব সাহিত্যকৃতি যে-প্রধানত লিটলম্যাগকে আশ্রয় করেই গড়ে উঠেছে, তাতেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণের কোনো অবকাশ নেই আর। এবং আরও যা সত্যের স্বভাবে ঋজু হয়ে দৃষ্টি ও চেতনাকে নাড়ায় বারবার, তা হলো: আমাদের সাহিত্যে নিরন্তরভাবে এত দিন যাবৎ ‘উষ্টা’ পাওয়া মানুষেরা তাদের জীবনের কাদামাটি ও আকাশের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রকৃত জাতিতাত্ত্বিক গন্ধ, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বাতাসসহ উপস্থিত ছিলেন এ সময়েরই অন্তর্প্রবাহে। সভ্যতার ধারাবাহিক অনুষঙ্গ আর শিকড় অন্বেষী নিরীক্ষায় নতুনকালের বাংলা কবিতার অন্তরেরও প্রবিষ্ট হয়েছিলেন তার অস্তিত্বের প্রগাঢ় ডাকসমেত। এই মননখননে গভীর-অতলে ডুব দিয়ে স্বর্ণসরোজ হাতে উত্থিত হয়েছিলেন যাঁরা, তাঁদের বেশির ভাগই ওই আশির দশকেরই তথাকথিত মফস্বলি লোকজন।
অন্যদিকে কবিতার দশকওয়ারী বিভাজন নিয়ে বিভিন্নজনের বিভিন্ন মতামত জারি থাকলেও মনে হয়, এটিই এখন সর্বত্র প্রায়শই গ্রহণীয় ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে যে, দশকের বিচারেই কবি ও কবিতার মূল্যায়ন করা সমীচীন। দশক বিচারের ওপর বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চল ছাড়াও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেও বেশ কিছু প্রকাশনা ও গবেষণাকর্ম দেখতে পাওয়া যায়, যা দশকী চেতনাকে মজবুত করে বলে মনে হয়। বাংলা কবিতায় ৩০-এর দশকের ধাঁচেই দশকচিন্তনটি আমাদের এখানে জোরালো মসনদ পেয়েছে, তাতে সন্দেহ কম। তা সত্ত্বেও এতে তেমন একটা ক্ষতিবৃদ্ধি আছে বলে মনে হয় না। কারণ, একটি দশক থেকে আরেকটি দশকের দশটি বছরের ব্যবধানও তো কম কিছু সময় নয়। বৈশ্বিক ও রাষ্ট্রিক পরিপ্রেক্ষিতের পরিবর্তন, চিন্তার প্রকরণ, তার প্রকাশভঙ্গির বিবর্তন, ভাষা ও ভাষাবোধের বিন্যাসে নবায়ন, এমনকি নিতান্ত আটপৌরে চাওয়া-পাওয়াময় জীবনযাপনের বিষয়-আশয়েও বিস্তর সব পরিবর্তন চোখে পড়ে একটি দশকের পরিধির মধ্যেই। পূর্ববর্তী দশকটির বৃত্ত পেরোতে-পেরোতে আরেকটি দশকের সংস্পর্শে মানবীয় অনুভূতিগুলোর প্রকাশের ক্ষেত্রেও একধরনের নতুনত্ব বা মিশ্রণ বা মিতালিপ্রবণতার আভাস ফুটে ওঠে অলক্ষ্যে। এতে অব্যবহিত আগের ধ্যানধারণাগুলো একেবারেই বিলুপ্ত হয়ে যায়, এমন হয়তো নয়। তবে মিথস্ক্রিয়ার অনিবার্যতায় তাতেও তবু একটা নয়া আদল জেগে থাকে। মূলত কবি ও শিল্পীর চোখে পরিবর্তনের যে-সূক্ষ্ম বাঁকগুলো ধরা পড়ে, তার স্পষ্টতা দিয়েই কাব্য ও শিল্পকর্মের চিন্ময় জগৎটি সৃষ্টি ও শনাক্ত হয়। এবং পরবর্তীকালে তা-ই সাধারণেরও চিন্তার বিষয় হয়ে ওঠে। যেমন, বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে শেখ মুজিবুর রহমানের মহান ভাষণ, মুক্তিকামী মানুষের রক্তছলকানো কবিতা গান চলচ্চিত্র পোস্টার পরবর্তীকালে উপস্থাপনীয় ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ব্যাপার হয়ে উঠেছিল সত্তর দশকের প্রাতিস্বিক বৈশিষ্ট্যের স্মারকরূপেই। এভাবে বাইরের দিক থেকে ও খুবই সূক্ষ্মভাবে বদলে যাওয়া অন্তর্গত প্রবণতাগুলোকে সঠিকভাবে চিহ্নিত করতে দশক বিভাজনকে একটা কার্যকর ও যুক্তিসঙ্গত আধার বলে গণ্য করতে তেমন জোর আপত্তি দেখছি না কোথাও। আর ধ্রুপদি অর্থে কারও বা অনেকের রচনাসম্ভার যদি ‘কালজয়ী’ প্রসাদগুণে দশকের দেয়াল টপকে মহাকালের ময়দানে সতত ভ্রাম্যমাণ বা লীলাময় থাকে নিরন্তর, সে ক্ষেত্রে তাকে বা তাদের তো রুখে দিতে যাচ্ছে না কেউ! বরং জনমনস্তত্ত্ব ঢক্কা নিনাদে স্বাগতই তো জানাতে চায়। আবার দশকবিভাজনের মধ্যে সময়ের বিশেষ ধাঁচকে ধরে রাখতে পারলে আখেরে তো ইতিহাসের কালায়নের দায়ও মোচন করা সম্ভব কিছুটা।
ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের গৎবাঁধা পথে নয়, সেই ‘চৌকস’ মনোভাবে রচিত সাহিত্যে বিধৃত আলগা ‘জাতীয় চেতনা’কে বিদেশি ভাষায় প্রকাশ করবার মধ্যেও নয়, বরং মাটিগন্ধি পরমভাবের জাতীয় সাহিত্যসৃষ্টি করে তা বিদেশি ভাষায় তরজমার মাধ্যমেই আসতে পারে চিত্তের ঔপনিবেশিকতার প্রকৃত মুক্তি ও আপন আলোয় খোলা দিগন্তের আশ্বাস। যার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন আফ্রিকীয় সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো
আশির দশকের কবি ও কবিতা তথা সাহিত্যিক অভিরুচিকে বিবেচনার প্রেক্ষাপটে আনতে যেয়ে এ রকমই একটা চকিতভাবনা আমার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল বারবার ওই আড্ডাস্থলে কামাল রাহমান-এর প্রস্তাবের পরপর। তবে এই যে এখানে বিধৃত ভাবনাটা সেটি আমি ওই আড্ডার পরিসরে উপস্থাপনে সমর্থ হইনি। সাময়িক স্বতঃস্ফূর্ততার অনুপস্থিতি আর অন্য এক কাজের প্রবল তাড়ায় আমার পাহাড়িবন্ধু জুনুকে নিয়ে সহসাই উঠতে হয়েছিল বলে।
দুই
কুমিল্লাপর্ব: কুমিল্লার আবৃত্তিকার ও সংগঠক আরশাদ সিদ্দিকী আর তরুণ কবিতাকর্মী মাসুদ আশরাফ যখন পত্রাঘাতে বারবার স্মরণ করিয়ে দিচ্ছিলেন যে, অতি অবশ্যি ২২ আগস্ট [১৯৯৫] সেখানে যেন উপস্থিত হই—তখনো আমি সিদ্ধান্ত নিতে অক্ষম রই, আদৌ কি আমি কুমিল্লায় যেতে পারি? অথচ পৃথিবীর গতিমান মানুষগুলো কত সামান্য দৌলতেই পৃথিবী নামক গ্রহটার এমুড়ো-ওমুড়ো ওড়ে-ঘুরে এসে কত না ঋদ্ধি ও চক্ষুষ্মানতা অর্জন করে চলেছে আমারই সামনে! আর আমি কিনা একজন চলার সঙ্গী না-পাওয়ার অজুহাতে কবি নজরুলের স্মৃতিধন্য, একদা ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ঋদ্ধ অংশ, সাহিত্য ও সংগীতের পেলবপুরী কুমিল্লায় যাওয়া, না-যাওয়ার দ্বন্দ্বে ভুগে ম্রিয়মাণ হয়ে আছি! এই দ্বিধার গহ্বর থেকে উঠে আসতে সবুজ হোটেলের আড্ডায় আমার প্রীতিভাজন কবি হাবিব আহসানকে আহ্বান জানিয়ে দ্ব্যর্থবোধক সাড়া পেয়ে যখন অকূলপাথার দেখছি মনে-মনে, তখনই ইলিয়াস কবির রানা—‘পথ থেকে পথ’ নামীয় কাগজ বের করার ব্রত নিয়েও যিনি শেষমেশ নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেন এবং ‘বাণিজ্যে বসতে লক্ষ্মী’ ভাবনায় থিতু হতে চাইছেন, বললেন, কুমিল্লায় ওই দিন তাঁরও সবিশেষ কাজের ডাক আছে। আমি যেন সুগভীর অন্ধকারের ভেতর থেকে আলোর ক্ষণে-ক্ষণে বিচ্ছুরণ দেখতে পেলাম। মনে হলো, এবার কুমিল্লা নয় শুধু, গ্রহান্তর যাত্রায়ও আমি তল্পিতল্পাসহ আগবাড়িয়ে প্রস্তুত।
যেহেতু অনিশ্চয়তাহেতু আরশাদদের কথামতো কুমিল্লায় আমার যাওয়ার প্রসঙ্গটি ডাক মারফত আগে থেকে তাঁদের জানানো সম্ভব হয়নি, অতএব কুমিল্লা রেলস্টেশনে নেমে দুই ভাবুকবন্ধু বিভিন্ন বেশভূষাময় মানুষজনের চোখমুখ আর পথঘাট দেখতে-দেখতে ধীরে রিকশায় উঠতে যাব, ওই ভঙ্গিতেই দেখা হয়ে গেল সবুজ হোটেলের অন্যতম আড্ডারু মাহবুব হাসন মামুন আর প্রয়াত কবি লুলুল বাহারসহ আরও জনাকয়েকের সঙ্গে—তাঁরা চলেছেন গ্রামান্তরে কোনো বেসরকারি সংস্থার অধীনে কোনো এক বিষয়ে উপাত্ত সংগ্রহের কাজে। ওদের সঙ্গে কিছু কেজো কথা সেরে রিকশা থেকে যেখানে নামা হলো, সেটি কান্দির পাড়ের একটি ছোট্ট চায়ের দোকান। সবাই যাঁকে দাদু ডাকে, সেই এক ভুবনবিহারী দে, এটির মালিক। বয়স ষাটোর্ধ্ব তাঁর। লোকশ্রুতি মতে, প্রায় আশি বছরের পুরোনো এই দোকানে চা পান করতে-করতে দেখছি-শুনছি-ভাবছি আর তাঁকে এক-আধটু জিগ্যেস করছি নানা কথা। যত প্রসঙ্গ আর অপ্রসঙ্গও বটে সেসব। ভুবনবিহারী বাবু জানালেন, তাঁর এই দোকানেই মিলিত হন কুমিল্লা শহরের তরুণ সব সংস্কৃতি ও সাহিত্যসেবী তরুণ। আবৃত্তি ও সাহিত্য সংগঠনের কর্মীরা। আর শহরের মানীজনেরাও।
ভাদ্রের কড়া দুপুর। ঘামছি দরদর বেগে। রুমাল ভিজে যাচ্ছে রুদিতের অশ্রুধারার মতো। একেবারে জবুথবু দশা পরিধেয়েরও। রানা বললেন, চলুন তবে আরশাদ সিদ্দিকীর বাড়ি। তার পরিচিত একজনের কাছ থেকে ঠিকানা নিয়ে কুমিল্লা হাউজিং এস্টেটের ভেতর দিয়ে চলে রিকশা। এবং আরশাদ আর মুনির নামের কুমিল্লা আবৃত্তিমঞ্চের কর্মীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল পথেই। এবার চারজনে এলাম ‘জলযোগ’-এ। ওখানে কুমিল্লার বিখ্যাত রসমালাই আর মালাইকারি খাওয়া হলো পেটপুরে। তখন মনে পড়ছিল হাবিব আহসানের উক্তি: ‘কুমিল্লার রসমালাই খেতে কিন্তু ভুল করবেন না।’ যশোরের হাবিবের কথা কুমিল্লায় ভুল হলো না দেখি ঘটনাচক্রে।
বিকেলে কুমিল্লার সবচেয়ে রূপসীস্থান ধর্মসাগর পাড়ে হাঁটতে-হাঁটতে আলাপ হলো একঝাঁক তরুণ কবি ও কবিতাপ্রেমীর সঙ্গে। ‘শঙ্খ’ লিটলম্যাগ সম্পাদক মাসুদ আশরাফসহ ‘যোগী’ সম্পাদক দীপ্র আজাদ কাজল, আবৃত্তিশিল্পী রতন ভৌমিক প্রণয়, জাভেদ হুসেইন-এর ধীমান আর স্বচ্ছ সাংস্কৃতিক চেতনা মুগ্ধ না-করে পারে না। এদের মধ্যে জাভেদ হুসেইন-এর উর্দু কবিতাপ্রীতি, বিশেষ করে কাইফি আজমির কবিতা থেকে মসৃণপাঠ আমাকে বিশেষ নম্র ও শোভন করে তোলে তাঁর প্রতি। এভাবে চলতে-চলতে কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমির আয়ত চত্বর পেরোতে-পেরোতে ভেতর থেকে ভেসে আসতে শুনি সম্মিলিত কণ্ঠনিঃসৃত কবিতার ধ্বনি। আরশাদ জানালেন, তাঁর স্ক্রিপ্ট থেকে আবৃত্তির মহলা চলছে। কতিপয় সুশ্রী তরুণ-তরুণী আর তাদের শীলিত উচ্চারণে মন যখন হাওয়া থেকে প্রস্ফুটিত দুর্লভ কুসুমের ঘ্রাণ নিচ্ছে, ঠিক তখনই আমার দৃষ্টি চলে গেল কোনার একটি পুরোনো কাঠের বেঞ্চির দিকে। ওখানে গুটিসুটি বসে আছেন আমাদের বন্ধু কবি মাহমুদ কচি। যাঁর কবিতার হাতযশ ধরে আমার সঙ্গে পরিচয় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। তাঁর দৃষ্টিতে একধরনের বিহ্বলতার চাহনি সর্বক্ষণ চারপাশ ঘুরছে যেন। শরীর থেকে ভেসে আসছে স্নো বা টেলকম পাউডারের সুবাস। মুখেও মেখেছেন শাদা পাউডারের প্রলেপ বেশ গাঢ় করে। আমার বান্ধব-আগ্রহে তিনি করমর্দন করেন কাঁপা-কাঁপা হাতে। ততধিক কাঁপাস্বরে মহীবুল আজিজ, আবু মুসা চৌধুরী আর আহমেদ রায়হান—আমাদের এসব লেখালেখির বন্ধুদের কুশল জানতে চাইলেন। ওই অবস্থাতেই আড্ডাটি বেশ জমে উঠল। একে-একে জড়ো হতে থাকলেন চারুশিল্পী সৈয়দ আহমাদ তারেক, কবি ইসহাক সিদ্দিকী, আবৃত্তিকর্মী রেজাউল করিম শিল্পী, আবৃত্তিশিল্পী কাজী মাহতাব সুমনসহ অনেকে।
তারপর মিলনায়তনের মেঝেয় বিছানো হলো ঘাসরঙা প্লাস্টিকের জাজিম। জ্বলে উঠল মোমের পীতাভ শিখা। গোল হয়ে বসলেন সকলে। যেন আড্ডার তুখোড় বারুদে পোড়ার জন্য সকলের স্নায়ুর কোষকলা কাঁপছে। আবৃত্তিতে কনক চক্রবর্তী স্নিগ্ধ হাসিতে, কখনো প্রতুল গাম্ভীর্যে নতুন ননির মতো সর্বাধিক সমাদরণীয়া ছিলেন উপস্থিত সকল রসিকের কাছে। কথা এলো কবিতার কাঠামো-সংহতি আর রূপদক্ষতার ভেতরের এখনকার আদল নিয়ে। প্রতিষ্ঠানমুখিনতা ও বিপ্রতীপ অনুচিন্তন নিয়েও। আধুনিকতা, পশ্চিমের আধুনিকোত্তরবাদও সাঁতরে-সাঁতরে চলে এলো প্রসঙ্গের লহরে ভাসতে-ভাসতে। আরশাদ সিদ্দিকী বেশ জোরালোভাবেই তুলে আনলেন তাঁর অপ্রাতিষ্ঠানিক দৃষ্টিভঙ্গির সারাৎসার। কাজী মাহতাব সুমন-এর আবৃত্তিধ্যানীকণ্ঠও আকর্ষক ছিল ওই সন্ধ্যার আঁচ লাগা আড্ডায়।
উপস্থিত সুধীবৃন্দের বক্তব্যে পঙ্খিরাজের মতো ভাবের ভুবনে উড়তে থাকা আমাকেও কিছু বলতে বলা হলো আখেরে। আমি বলতে চেষ্টা করি ‘ডি-কলোনাইজিং দ্য মাইন্ড’ বা চিত্তের ঔপনিবেশিকমুক্তি নিয়ে, যা আমার ভাবনায় কাজ করছিল আগে থেকেই। এখন তাতে যেন অগ্নিসংযোগ হলো। তাই বলতে চেয়েছি প্রায় হাজার বছরের মোগল-তুর্কি-ইঙ্গ-পাকিস্তানি ঔপনিবেশিকতার স্ফীত জঞ্জাল ও কদর্যতা আমাদের চেতনার রন্ধ্রে-রন্ধ্রে এখনো বাসা বেঁধে আছে, আমাদেরই অজান্তে। এখনো মননে, বিত্ত-বেসাতিসহ নানাবিধ কেজো ও সাংস্কৃতিক আচরণকলার নিবিড়-অগোচরে ঔপনিবেশিক অভ্যস্ততার বিভিন্ন পরকলা পরে পরবাসী হয়ে আছি আমরা স্বাধীন ভূখণ্ড ও গরীয়ান সাংগ্রামিক ঐতিহ্যের ধারক হয়েও। চিন্তা ও চিত্তবৃত্তির সকল অনুষদসহ সাহিত্য-শিল্পকলার অনুরাগী হলে বি-ঔপনিবেশিকতার সূত্রেই আমাদের অনুধাবন করা দরকার যে, ভূমিজ জীবনঘেঁষা ঋদ্ধিমান সাহিত্য-শিল্পকলাই হলো একটি জাতির প্রকৃত মুক্তির পথ প্রদর্শনকারী চিরায়ু চেরাগের আলো। জাতীয় চেতনার সর্বাধিক শনাক্তযোগ্য সৃজনশীল মানদণ্ড।
ঔপনিবেশিক প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার মাধ্যমে বুদ্ধিবৃত্তিক বিকাশের গৎবাঁধা পথে নয়, সেই ‘চৌকস’ মনোভাবে রচিত সাহিত্যে বিধৃত আলগা ‘জাতীয় চেতনা’কে বিদেশি ভাষায় প্রকাশ করবার মধ্যেও নয়, বরং মাটিগন্ধি পরমভাবের জাতীয় সাহিত্যসৃষ্টি করে তা বিদেশি ভাষায় তরজমার মাধ্যমেই আসতে পারে চিত্তের ঔপনিবেশিকতার প্রকৃত মুক্তি ও আপন আলোয় খোলা দিগন্তের আশ্বাস। যার দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গেছেন আফ্রিকীয় সাহিত্যিক নগুগি ওয়া থিয়ঙ্গো। অথচ একদা যিনি ইংরেজি ভাষায় আফ্রিকীয় ঐতিহ্যের মরম-মদির সাহিত্যরচনা করে খ্যাতি ও শংসার উচ্চমিনারে অবস্থান করছিলেন। ১৯৭৭ সালে তাঁর আত্মগত উপলব্ধির প্রকাশ ঘটিয়ে এক অদ্ভুত, তোলপাড় সৃষ্টিকারী ঘোষণা দিলেন, এখন থেকে তিনি খাস আফ্রিকীয় ভাষাতেই তাঁর সৃজনশীল রচনাসমূহ প্রকাশ করবেন। এরপর থেকে তাঁর সমস্ত রচনাই লিখিত হলো তাঁরই গোত্রভাষা গীকুয়ু ও সোয়াহিলি ভাষায়।
কারণ, তিনি স্বচ্ছতররূপেই বুঝলেন যে, ‘বন্দুকের গুলি দৈহিক বশ্যতা স্বীকার করানোর উপায়। আর আত্মিক বশ্যতা স্বীকার করানোর উপায় হলো ভাষা’।