প্রযুক্তির দর্শন

 

বিজ্ঞানের দর্শন সম্পর্কে প্রায়ই কম-বেশি শোনা যায়। তবে প্রয়োগ বা প্রযুক্তির দর্শন সেই তুলনায় খানিকটা আধুনিক ধারণা। এই দুই দর্শনের মধ্যে পার্থক্য মূলত হতে পারে যে, বিজ্ঞানের দর্শন অদম্য কৌতূহলে জানার চেষ্টা করে আর প্রযুক্তির দর্শন করে নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা। তবে কেবল এটুকুই নয়, বিষয়টিকে বিস্তারিতভাবে বিবেচনা করলে প্রযুক্তির দর্শনের প্রকৃত রূপ উন্মোচিত হবে।

কে না জানে, যার দখলে যখন একটা স্মার্টফোন থাকে তখন সে-ও একটা স্মার্টফোনের দখলে থাকে! বাস্তবে প্রযুক্তিরও কি তবে মন আছে? আছে কি ব্যবহারকারীর থেকে পৃথক কোনো দর্শন? পিস্তল দিয়ে গুলি করে মানুষ মারা যেতে পারে, গাড়ি দুর্ঘটনায় পড়ে মানুষের মৃত্যুর কারণ হতে পারে, কিন্তু পিস্তল কি নিজে নিজে গুলি করে বা গাড়ি কি মনে মনে মানুষের মৃত্যু কামনা করে?

একসময় আমরা প্রাচীন সমাজে বাস করতাম, যা সেই সমাজের কৃষ্টি আর সংস্কৃতি দিয়ে পরিচালিত হতো। সেখানে সমাজের সাংস্কৃতিক নিয়মকে প্রশ্ন করার কোনো অধিকার কারো ছিল না। ধীরে ধীরে আধুনিক সমাজ তৈরি হয়েছে, পদে পদে তা প্রাচীন সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ১৮ শতকে ইউরোপে যে-জাগরণ হয়েছে, তার পর থেকে অযৌক্তিক নিয়ম কানুনের পরিবর্তে বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির উপরে মানুষের আস্থা নিশ্চিত হয়েছে। গ্যালিলিও আর নিউটনের আবিষ্কারের কারণে প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। যেমন, পৃথিবীর বহু দেশে প্রযুক্তি জীবনের স্বাভাবিক স্রোতের সঙ্গে এত অনায়াসে মিশে গেছে যে, প্রযুক্তির অবর্তমানে সেখানকার সমাজ কল্পনা করা অসম্ভব। প্রসঙ্গত জাপানের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। 

উনিশ শতকের শেষের দিকে ‘প্রযুক্তির দর্শন’ কথাটা সবার প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত দার্শনিক এর্নস্ট ক্রিস্টিয়ান ক্যাপ। পশ্চিমে জনপ্রিয় হওয়া শব্দ ‘টেকনোলজি’, যা প্রযুক্তি বা প্রয়োগবিদ্যাকে বোঝায়, আসলে এসেছিল গ্রিক শব্দ ‘টেকনে’ থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘টেকনে’ শব্দের অর্থ শিল্প বা কারুশিল্প। যেমন, তাদের কাছে ঔষধ ছিল এমন এক প্রযুক্তি যা অসুস্থকে আরাম দেয়। কাঠের-কাজ ছিল এমন এক প্রযুক্তি যা ঘরকে সহজলভ্য কাঠের আসবাবে সাজায়। প্রযুক্তিবিদ্যার দর্শনের বিষয়ে ধারণা মেলে পশ্চিমা দর্শনেই। ‘টেকনে’ বা শিল্পের ব্যাপারে গ্রিকদের প্রচলিত ধারণা ছিল, তা প্রকৃতি থেকে উদ্ভূত এবং প্রাকৃতিক নিয়মের উপরেই নির্ভরশীল। উদাহরণস্বরূপ, মাকড়সার জাল বোনার কায়দা থেকে সুতা বা উল বোনার কায়দা আবিষ্কারের কথা বলা যায়। হেরাক্লিটাস বা ডেমোক্রিটাসসহ অনেক গ্রিক দার্শনিক এই মতবাদের সঙ্গে একমত হয়েছিলেন। কেবল মতবিরোধ দেখিয়েছিলেন এরিস্টটল, যিনি উল্লেখ করেছিলেন যে, প্রযুক্তি প্রকৃতিকে অনুকরণ করে তৈরি করা যেতে পারে বটে, তবে কেবল প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে তা নির্ভরশীল নয়। তার যুক্তি ছিল, প্রযুক্তি প্রাকৃতিক নিয়মকেও ছাড়িয়ে যেতে পারে। অর্থাৎ, প্রকৃতি স্বাভাবিকভাবে যা করতে পারে না, প্রযুক্তি অতি সহজে তাই করে দেখায়। তিনি আরো যোগ করেছিলেন যে, প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনার নিজস্ব কৌশল এবং অন্তর্নিহিত গতি বা পরিণতি আছে। অথচ প্রযুক্তি বাইরের কোনো চাপের কারণে প্রকৃতি-বহির্ভূত কোনো উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে, প্রকৃতির অন্তর্ভুক্ত সমস্তকিছু নিজের থেকেই তৈরি হয় কিন্তু প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সাবলীলভাবে উৎপন্ন হবার কোনো নিদর্শন নেই। দার্শনিক প্লেটো মনে করতেন, প্রকৃতি যেমন অস্তিত্ব আর স্বাতন্ত্র্যের উপরে নির্ভরশীল, প্রযুক্তিও তাই। তার এই ধারণা গ্রিক দর্শনের অনন্য এক পটভূমি হয়ে আছে। এই তত্ত্বের উপরে নির্ভর করে অবশ্য বলা চলে যে, প্রযুক্তি এবং পরিবেশের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য নেই। দুই-ই মানুষকে পৃথিবীর সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে সাহায্য করে। 

উনিশ শতকের শেষের দিকে ‘প্রযুক্তির দর্শন’ কথাটা সবার প্রথমে ব্যবহার করেছিলেন জার্মান বংশোদ্ভূত দার্শনিক এর্নস্ট ক্রিস্টিয়ান ক্যাপ। পশ্চিমে জনপ্রিয় হওয়া শব্দ ‘টেকনোলজি’, যা প্রযুক্তি বা প্রয়োগবিদ্যাকে বোঝায়, আসলে এসেছিল গ্রিক শব্দ ‘টেকনে’ থেকে। গ্রিক ভাষায় ‘টেকনে’ শব্দের অর্থ শিল্প বা কারুশিল্প...

মধ্যযুগ থেকে উনিশ শতকের কথা বলতে গেলে, প্রথম এবং দ্বিতীয় শতাব্দীতে রোমান সাম্রাজ্যের জনপ্রিয় লেখকেরা প্রযুক্তিবিদ্যার বিষয়ে গবেষণামূলক কিছু কাজ রেখে গেছেন। যেমন, প্রথম শতাব্দীর রোমান লেখক মারকাস ভিট্রুভিয়াস [যিনি ছিলেন একাধারে লেখক, স্থাপত্যবিদ এবং সেনা-প্রকৌশলী], তাঁর বই ‘দে আর্কিটেকচারা’-তে প্রযুক্তির প্রাথমিক ধারণা দিয়ে গেছেন। ওদিকে জার্মান খনিবিদ ও ধাতু গবেষক জর্জিয়াস অ্যাগ্রিকোলা তাঁর ‘দে রে মেটালিকা’ বইয়ে খনিবিদ্যা ও ধাতুবিদ্যা সম্পর্কে প্রথম বিস্তারিত লিখেছেন যে-কারণে তাঁকে খনিবিদ্যার জনক বলা হয়। রেনেসাঁর সময়ে ইংরেজ দার্শনিক, ফ্র্যান্সিস বেকনের ‘নিউ আটলান্টিস’ বইয়ে স্পষ্টভাবে প্রযুক্তিবিদ্যার ধারণা সমাজে প্রয়োগের চিত্র তুলে ধরা হয়। রচনাটি ছিল অসম্পূর্ণ। তবে তাতে ভবিষ্যতের মানুষের আবিষ্কার এবং নিত্যনতুন প্রযুক্তি প্রয়োগের কথা বলা হয়েছিল। সেখানে পরিষ্কারভাবে বর্ণিত হয়েছিল যে, প্রযুক্তি মানুষের ক্ষমতা বাড়াবে, প্রাকৃতিক নিয়মের উপরে কর্তৃত্ব করে মানুষকে সমাজের উন্নয়নকল্পে কাজ করতে সক্ষম করবে।  

মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যে সুনির্দিষ্ট পার্থক্য আছে। ঠিক যেমনটা ব্যবহারকারী আর সামগ্রীর মধ্যে তাদের জীবনকাল আর স্বভাবের মধ্যে পার্থক্য আছে । শুধু পার্থক্য নয়, মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যে আছে গভীর সম্পর্ক; এক পক্ষ আরেক পক্ষকে ব্যবহার করে বাঁচিয়ে রাখে এবং বেঁচে থাকে। প্রযুক্তি নিজেকে অর্থবোধক প্রমাণের জন্য যেমন মানুষের উপরে নির্ভরশীল তেমনি মানুষও জীবন-যাপনের জন্য নির্ভরশীল প্রযুক্তির উপরে। মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যে যখন যোগাযোগ ঘটে তখন ব্যবহারকারী আর সামগ্রী দুই-ই অংশগ্রহণ করে। একের অনুপস্থিতিতে অপরের তখন অস্তিত্ব থাকে না। প্রযুক্তি মানুষকে তার অবস্থানের সঙ্গে পৃথিবীর পরিচয় ঘটায়। মানুষ আর পৃথিবীর বা প্রকৃতির সম্পর্কের মাঝখানে দাঁড়িয়ে থেকে প্রযুক্তি তাদের সম্পর্ককে ত্বরান্বিত করে। 

এই সমস্ত বিষয়কে বিস্তারিতভাবে বিবেচনায় নিলে তিনটি বিষয় নজরে আসে। প্রথমত, প্রযুক্তির দর্শন, যা প্রধানত মানুষ আর প্রযুক্তির সম্পর্ক ব্যাখ্যা করতে পারে। দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তি থেকে দর্শন, যা বিশেষ ধরনের প্রযুক্তি থেকে আগত নীতিতত্ত্বের কথা বলে। তৃতীয়ত, প্রযুক্তির জন্য দর্শন, যা এক প্রযুক্তি থেকে আরো বহু প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ইঙ্গিত দেয়। এই তিন পর্যায়ের পর্যালোচনা প্রযুক্তিকে মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর যোগাযোগ বর্ণনা করতে পারে। বিজ্ঞানী যেমন বিজ্ঞানের মাধ্যমে পৃথিবীর সঙ্গে তার সম্পর্ক খোঁজে। 

বিংশ শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক ও মনোবিজ্ঞানী, কার্ল জ্যাসপারসের মতে, প্রযুক্তি প্রধানত ব্যবহৃত হয় বিশাল সংখ্যক মানুষের একত্র বসবাসকে সহজতর করতে। যেমন প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বহু মানুষের নির্দিষ্ট প্রয়োজন সরল পদ্ধতিতে এবং স্বল্প সময়ে অনেক বেশি সংখ্যায় উৎপাদন করে মেটানো সম্ভব। অন্যদিকে, একই শতাব্দীর জার্মান দার্শনিক মার্টিন হাইডেগারের মতে, প্রযুক্তি এমন এক প্রক্রিয়া যা প্রাকৃতিক উপাদানকে মানুষের সুবিধামতো ব্যবহার করে মানুষের সঙ্গে পৃথিবীর সম্পর্ক গড়ে তোলে। প্রচলিত যে-পদ্ধতিটির উদাহরণ তিনি দিয়ে থাকেন তা হলো, রাইন নদীর উপরে বাঁধ নির্মাণ করে শক্তি উৎপাদন। ঠিক যেমন বাংলাদেশের কাপ্তাই বাঁধ। বাঁধ নির্মাণ করে প্রকৃতির সাধারণ উপাদানকে শক্তি উৎপাদনে বাধ্য করা বা না করতে পারার ঘটনাই হাইডেগারের মতে প্রযুক্তির দর্শন। এই দর্শনের মাধ্যমেই প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ ঘটে এবং প্রকৃতিতে তার বসবাস সহজতর হয়। নদী বা জলাশয় নিজের ইচ্ছায় শক্তি উৎপাদন করে না। প্রযুক্তির মাধ্যমে তাকে শক্তি উৎপাদনে বাধ্য করা হয়। অন্যদিকে বায়ু শক্তির কথা ধরলে, উইন্ড মিলের মাধ্যমেও শক্তি উৎপাদিত হয়। কিন্তু সেখানে বাতাসকে শক্তি উৎপাদনে বাধ্য করা যায় না। বাতাস তার খেয়াল-খুশিমতো আসতে-যেতে পারে এবং তার উপস্থিতিতে শক্তি উৎপাদিত হয়।

এখন প্রযুক্তি আর মানুষের সম্পর্ক নিয়ে কয়েকটি কথা না বললেই নয়। প্রথমত, প্রযুক্তি নির্দোষ এবং মানুষের সহায়ক। প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করে, মানুষের দুর্ভোগ কমায়। তবে প্রযুক্তি কখনোই নিজে নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে কিছু করে না। মানুষই একমাত্র যে প্রযুক্তিকে পরিচালিত করে। যেমন, হাতুড়ি দিয়ে মানুষ দেয়ালে পেরেক ঠুকতে পারে আবার কোনো মানুষের মাথায় বাড়িও দিতে পারে। এটা সম্পূর্ণ ব্যবহারকারীর উপরে নির্ভর করে যে, সে হাতুড়ি দিয়ে পেরেক ঠুকবে নাকি কারো শারীরিক ক্ষতি করবে। প্রযুক্তি কেবলই এক সামগ্রী যা ধরা-ছোঁয়া যেতে পারে বা না-ও পারে। তবে প্রযুক্তি জানে না সে কীভাবে বা কী কারণে ব্যবহৃত হবে। প্রযুক্তি বাকি পৃথিবীকে কেবল তাকে তৈরীর উপাদান হিসেবে দেখে। অন্যদিকে, কাগজ আর কালি যা কিছু তৈরি করতে পারে তার ব্যাপারে একমাত্র প্রস্তুতকারী বা ব্যবহারকারীই সিদ্ধান্ত নেয় যে, তা গুরুত্বপূর্ণ ছাপানো কাগজ হবে নাকি টাকা হবে, কিংবা টাকা হলে কত টাকার নোট। 

প্রযুক্তি আর মানুষ একত্রে বসবাস করতে করতে তাদের মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্যগুলো ধীরে ধীরে ঘুচে যায়। হয়ত এমন সময় আসবে যখন প্রযুক্তি আর মানুষের মধ্যে সরাসরি কোনো পার্থক্যের রেখা টানা কঠিন হবে। তখন আমাদেরকে পার্থক্যের সেই রেখাটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে...

দ্বিতীয়ত, প্রযুক্তির সঙ্গে মানুষের ব্যবহার অনেকটা ভাবের আদান প্রদানের মতো, যেন কোনো কথোপকথন চলছে। প্রযুক্তি কখনো মানুষেরই শরীরের বর্ধিত অংশ সদৃশ। যেমন, সেভাবে লক্ষ করলে একটা হাতুড়ি আসলে মানুষের মুষ্টিবদ্ধ হাতের মতো যা কিনা কোথাও জোরে আঘাত করার ক্ষমতা রাখে। অর্থাৎ, একটা মুষ্টিবদ্ধ হাতের অনুকরণে ধাতব যন্ত্র যা হাতের মতোই কাজ করতে পারে। অন্যদিকে, একটা করাত কাজ করতে পারে মানুষের দাঁতের মতো। দাঁত দিয়ে যা হয়ত মানুষ কাটতে চাইত কিন্তু সহজে কাজটা সম্পন্ন করতে পারত না, করাত তা সহজেই পারে। আরো গভীরভাবে ভাবতে চাইলে, প্রাথমিক পর্যায়ে যখন তার আবিষ্কার হয়েছিল টেলিফোন বা টেলিগ্রাফ ধরনের যন্ত্র চালনার জন্য তা হয়ত মানুষের শিরা-উপশিরার গঠনের অনুকরণে তৈরি। এভাবেই মানুষ তার শরীর আর চিন্তাকে ব্যবহার করে এমন প্রযুক্তি তৈরি করে যা তার সহায়ক কিংবা বিরোধী ভূমিকায়ও অবতীর্ণ হতে পারে। যন্ত্রাংশকে পরিচালনা করার শারীরিক এবং মানসিক দায়িত্বটি মানুষকে পালন করতে হয়। যান্ত্রিক দায়িত্বটি পালন করে যন্ত্র আর মানুষ বুদ্ধি কাজে লাগিয়ে পালন করে তাকে পরিচালনার কাজ। আবার অটোমেটিক মেশিনের ক্ষেত্রে যন্ত্র, পরিচালনা আর যান্ত্রিক প্রক্রিয়া, দুটোরই দায়িত্ব পালন করে। এভাবে যন্ত্র মানুষেরই বর্ধিত অংশ হয়ে দাঁড়ায়। কখনোবা যন্ত্র মানুষকে প্রতিস্থাপন করে। যন্ত্র কখনো আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এমন অংশ হয়ে যায় যে, তাকে ছাড়া আমাদের কোনো অস্তিত্বই থাকে না। যেন সারা পৃথিবী একটা আস্ত মেশিন, এক তালে চলছে। দার্শনিক হাইডেগারের মতে, এই পরিস্থিতি বা অবস্থান থেকে মানুষের কোনো পরিত্রাণ নেই। কারণ, মানুষ যদি বিপুল পরিমাণ প্রযুক্তির ব্যবহারের হাত থেকে মুক্ত হতে চায় তবে তা করবে নতুন কোনো প্রযুক্তির ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। সে ক্ষেত্রে এক প্রযুক্তি আরেক প্রযুক্তিকে প্রতিস্থাপন করবে কেবল। মানুষের বাঁচার অবলম্বন থাকবে সেই প্রযুক্তিই। তাই প্রযুক্তির সর্বজনীন ব্যবহারের কোনো বিকল্প নেই। মানুষ আর প্রযুক্তির টানাপোড়েন চলতেই থাকবে, অর্থাৎ মানুষ আর যন্ত্রের মধ্যে একরকমের চলমান যুদ্ধ জারি থাকবে। 

তৃতীয়ত, প্রযুক্তি আর মানুষ একত্রে বসবাস করতে করতে তাদের মধ্যে মোটা দাগের পার্থক্যগুলো ধীরে ধীরে ঘুচে যায়। হয়ত এমন সময় আসবে যখন প্রযুক্তি আর মানুষের মধ্যে সরাসরি কোনো পার্থক্যের রেখা টানা কঠিন হবে। তখন আমাদেরকে পার্থক্যের সেই রেখাটিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। উদাহরণস্বরূপ বলতে গেলে, সবচেয়ে সহজ যে প্রযুক্তিটি আমাদের শরীরের সঙ্গে মিশে থাকে তার কথা উল্লেখ করতে পারি, যা হলো, চশমা। শরীরে অবস্থান করলেও খুব অল্পই আমরা তাকে আলাদা করতে পারি। যেমন কখনো কখনো মাথার উপরে রেখেই তাকে খুঁজি। এছাড়াও বলা চলে ক্র্যাচ বা হৃদযন্ত্রের ভালব বা ব্লক খুলতে রিং-এর কথা। বহু যন্ত্রই আছে যেখানে মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যে সূক্ষ্ম ভাগাভাগি করা কঠিন।

মার্কসের পর থেকে সকল সমাজবিজ্ঞানীর মত বিবেচনা করলে দেখা যায়, প্রযুক্তিগত উন্নয়নকেই তারা সমাজিক বিপ্লবের প্রধান কারণ বলে মনে করেন। নিয়তিবাদে বিশ্বাসী দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীরা মনে করেন, প্রযুক্তি এমন জিনিস যা মানুষ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, বরং প্রযুক্তিই মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে। প্রযুক্তির উদ্ভাবন মানুষকে তার উপরে নির্ভরশীল করে তোলে। অন্যদিকে প্রযুক্তির ব্যবহারের ফলে মানুষের মানসিকতা বদলে গিয়ে নতুন সমাজের আবির্ভাব ঘটে। যেমন, গাড়ি আমাদের চলাচলের ক্ষমতা বৃদ্ধি করে, কম্পিউটার বৃদ্ধি করে হিসাব-নিকাশের ক্ষমতা। এ ক্ষেত্রে নতুন নতুন প্রযুক্তি আমরা নিজেরা গ্রহণ করি না, প্রযুক্তির সুবিধাই তাকে গ্রহণ করতে আমাদেরকে বাধ্য করে। আধুনিক সমাজের সর্বত্র এই চিত্র স্বাভাবিক। আবার এক প্রযুক্তি আরেক প্রযুক্তিকে প্রতিস্থাপন করে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, রেকর্ড প্লেয়ার, ক্যাসেট, ডিস্ক, সিডি, ভিসিডি, ডিভিডি, ব্লু-রে ডিভিডি-এর কথা। একটাকে সরিয়ে দিয়ে ক্রমাগত আরেকটার আবির্ভাব। ব্যবহারকারী অতি সহজে নতুন প্রযুক্তিতে আসক্ত হয়ে পড়ে। প্রযুক্তির দর্শনই থাকে ব্যবহারকারীকে নতুন ব্যবহারে আকৃষ্ট করা এবং আগের চেয়েও বেশি করে প্রযুক্তির মধ্যে আটকে রাখা। আর এত শত প্রযুক্তির পরে কেবল ইউটিউব এসে পূর্ববর্তী সমস্ত প্রযুক্তিকে মানুষের জীবন থেকে প্রায় পুরোপুরি প্রতিস্থাপন করে ফেলে। এই ক্রমাগত প্রতিস্থাপন নিয়ন্ত্রণেরই নামান্তর। প্রযুক্তির মধ্যে এই দর্শনও থাকে যে, সে মানুষকে ব্যস্ত রাখে বটে তবে কখনো চিরকালের জন্য তৃপ্ত করে না। প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়ন তাই অবধারিত। মানুষ সে সম্পর্কে আগেই জানতে পারে এবং অপেক্ষা করে। যেমন, একই সেল ফোন কোম্পানি বছরে একাধিক নতুন মডেল নিয়ে হাজির হয়। নতুন নতুন উপাদান আর কার্যক্ষমতা তাতে জুড়ে দেয়া হয়। তবে এতে মানুষের প্রত্যাশা কখনো পুরোপুরি মেটে না। মানুষের মনে আরো চাই, আরো চাই হাহাকার জারি রাখতে প্রযুক্তির ক্রমাগত উন্নয়নের তুলনা নেই।    

সবকিছুর পরে এটাই বলা চলে যে, প্রযুক্তি হলো সেই উপলক্ষ্য যা মানুষকে পৃথিবীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়, তাদের যোগাযোগে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। দার্শনিক হাইডেগারের অনুসারী সমসাময়িক মার্কিন দার্শনিক, ডন আহদে মনে করেন যে, প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের ধ্যান-ধারণা পরিবর্তিত হয়। যেমন, রেডিও একসময় পৃথিবী জুড়ে মানুষের মন-মানসিকতা বদলে দিয়েছিল, শিল্পচর্চার মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। পরে একসময় টেলিভিশন সে জায়গা দখল করেছে। তারপর আরো অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আজকে মানুষের হাতে হাতে স্মার্টফোন উপস্থিত হয়েছে, যা মানুষকে একাধারে টেলিভিশন, দৈনিক পত্রিকা এবং ক্যামেরার উপরে নির্ভরতা কমিয়ে দিয়েছে। ডন আহদের মতে, প্রযুক্তি হচ্ছে মানুষ আর তার চারপাশের পৃথিবীর দুই মেরুর মধ্যস্থতাকারী। যেদিন থেকে মানুষ প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু করেছে সেদিন থেকেই তা পৃথিবী আর মানুষের যোগাযোগের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়েছে। ডন আহদের প্রপঞ্চের ধারণা হলো, মানুষকে জানা না হলে পৃথিবীকে জানা সম্ভব নয়। অর্থাৎ, পৃথিবীকে জানতে হলে মানুষের কীর্তি জানতে হবে। অন্যদিকে, তাঁর মতে, পৃথিবী আর মানুষের মাঝখানে স্থির অবস্থানে আছে প্রযুক্তি। মানুষ বা পৃথিবীকে জানতে হলে তাই প্রযুক্তিকে জানতে হবে। এটা যে পৃথিবী এবং মানুষকে জানার আরো ভালো মাধ্যম তা নিশ্চিত না হলেও, অবশ্যই নতুন এক ব্যবস্থা।

প্রযুক্তির দর্শন কি আসলেই নির্দোষ? হয়ত নয়। আধুনিক সমাজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহ দেয়। নতুন সমাজ সেই খাতকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে যেখানে প্রযুক্তির প্রচুর ব্যবহার উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে। প্রযুক্তির অন্যান্য দিক নিয়ে সমাজ চিন্তিত নয়, যতটা চিন্তিত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে...

সমসাময়িক ডাচ দার্শনিক পিটার পল ভারবিকের [যিনি ডন আহদের দর্শনতত্ত্বে প্রভাবিত] মধ্যস্থতা তত্ত্ব ইতোমধ্যে সুপরিচিত হয়েছে। ডন আহদের প্রপঞ্চ তত্ত্বের পরে তিনিও প্রকৃতি এবং মানুষের যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে প্রযুক্তিকে নিশ্চিতভাবে চিহ্নিত করেছেন। তাঁর মতে, মানুষ পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলে প্রযুক্তির সহায়তা নেয় এবং যোগাযোগ সম্পন্ন হলে মানুষের নিজস্ব ধ্যান-ধারণা গড়ে ওঠে। মানুষ তখন প্রযুক্তির উপস্থিতিতে পৃথিবীকে দেখার ও জানার উপায় এবং ভাবধারা অর্জন করতে সক্ষম হয়। প্রযুক্তিই বলে দেয় কীভাবে আমরা পৃথিবীকে উপলব্ধি করব এবং তাকে কাজে লাগাব। মানুষের জীবনের প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রেও প্রযুক্তি অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। যেমন, গর্ভবতী মায়ের গর্ভে অবস্থানকারী শিশুর অপরিণত ছবি দেখে পিতা-মাতা বা চিকিৎসক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এখানে প্রযুক্তি মানুষকে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করছে এবং তার মাধ্যমেই প্রকৃতি বা আরেকটি মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ গড়ে উঠছে। মানুষ আর প্রযুক্তির মধ্যে সম্পর্কের ক্ষেত্রে ডন আহদের তত্ত্ব থেকে যে চার ধরনের সম্পর্কের ব্যাপারে পিটার পল ভারবিক বিস্তারিত আলোকপাত করেছেন। প্রথমত, সন্নিবেশের সম্পর্ক। যেমন, চশমার সঙ্গে সম্পর্ক, যা নাকের উপরে থাকতে থাকতে মানুষের শরীরের অঙ্গ হয়ে যায়। তা ছাড়া, মানুষ চশমার দিকে তাকিয়ে থাকে না, বরং চশমার ভেতর দিয়ে কোনো দিকে তাকায়। দ্বিতীয়ত, ব্যাখ্যামূলক সম্পর্ক। যেমন, থার্মোমিটার বা ব্যারোমিটার শরীরের কিংবা পৃথিবীর কোনো অবস্থানে এবং অবস্থায় নির্দিষ্ট অবস্থা জানায়। তৃতীয়ত, অবজ্ঞাত সম্পর্ক। যেমন, কোনো বিল্ডিংয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে শীতাতপ নিয়ন্ত্রেণের ব্যবস্থা, যা থাকা সত্ত্বেও তার উপস্থিতির ব্যাপারে আমরা মনোযোগ দেই না। চতুর্থত, পরিবর্তনযোগ্য সম্পর্ক। যেমন, টাকা ওঠানোর জন্য এটিএম মেশিন। এই মেশিন ব্যবহার করলে শেষ পর্যায়ে তা অন্য কোনো প্রযুক্তির কাছে নিয়ে উপস্থিত করে, যা হলো, টাকা। 

প্রযুক্তির নকশা করার সময়ে কিছু নীতিমূলক বিষয়ে নজর দেয়া হয় যা পৃথিবী এবং মানুষের মধ্যে সম্পর্ক তৈরিতে হয় সাহায্য করে নয়ত বাধা হয়ে দাঁড়ায়। যেমন, একটা রাস্তার উপরে এমন নীচু গেট বানিয়ে রাখা হলো যে যেখানে শুধু গাড়ি প্রবেশ করতে পারবে কিন্তু বাস যেতে পারবে না। এটা সহজেই বলে দেয় যে, গেটের নকশাটা কেবল গাড়ির যাত্রীদের সেদিকে স্বাগত জানাচ্ছে এবং একইসঙ্গে বাসের যাত্রী জনগোষ্ঠীকে প্রবেশে বাধা প্রদান করছে। এটা এক ধরনের বৈষম্যমূলক নকশা হতে পারে যাতে প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্ক স্থাপনে বাধার সৃষ্টি করা হচ্ছে। আবার স্কুলের সামনে যে-স্পিডব্রেকার বানানো হয় তাতে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের নিরাপত্তার জন্য যানবাহনকে ধীরে চলতে বাধ্য করা হয়। এটাও এক ধরনের প্রযুক্তি যা মানুষের চলাচলের গতি নিয়ন্ত্রণ করে সামাজিক জীবনে সমতা এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে। অন্যদিকে চালক তার গাড়ির ক্ষতি করবে না বলে স্পিডব্রেকার সামনে দেখলে অবধারিতভাবে গতি কমিয়ে ফেলবে। এক্ষেত্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে মানুষকে নীতির চর্চা করতে বাধ্য করা হচ্ছে। তাই তখন বাহ্যিক পৃথিবীর সঙ্গে তার যোগাযোগটা হচ্ছে স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে অন্যভাবে।

সবশেষে ভাবা যায়, প্রযুক্তির দর্শন কি আসলেই নির্দোষ? হয়ত নয়। আধুনিক সমাজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে উৎসাহ দেয়। নতুন সমাজ সেই খাতকে সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত করে যেখানে প্রযুক্তির প্রচুর ব্যবহার উৎপাদনকে ত্বরান্বিত করে। প্রযুক্তির অন্যান্য দিক নিয়ে সমাজ চিন্তিত নয়, যতটা চিন্তিত উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে। লাভবান হবার নেশায় অনেক উঁচুতে দাঁড়িয়ে মানবজাতির উন্নয়নের দিকে তাকালে হয়ত উপযুক্ত অস্ত্র আর উপযুক্ত ঔষধ উৎপাদনের পার্থক্য ধরা যায় না। হয়ত বোঝা যায় না আদর্শ বহির্ভূত শিক্ষা আর আদর্শে ভরপুর শিক্ষা ব্যবস্থার পার্থক্য। হয়ত গবেষণার নামে কাউকে ব্যবহার এবং মানব উন্নয়নে সত্যিকারের গবেষণামূলক কাজের আয়োজনের ব্যাপারটাকে একই মনে হয়। এই পার্থক্যের প্রতি সততা প্রদর্শনে আদর্শগতভাবে সমাজ কখনো হয়ত সংঘবদ্ধ হবে। ‘পিস্তল খুন করে না, মানুষ খুন করে’; প্রযুক্তির ব্যাপারে কেবল এটুকু বলেই নিশ্চয় মানুষ নিজেদের গা বাঁচিয়ে চলবে না। একদিন তারা নিশ্চয় বুঝতে পারবে যে, মানুষের হাতে পিস্তল তুলে দেয়া সমাজ, মানুষের হাতে পিস্তল না-থাকা সমাজের চেয়ে অনেক আলাদা। কোনো একদিন প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ও বণ্টনের ব্যাপারে সমাজ নিশ্চয় সচেতন হবে। অন্তত এটুকু আশা করা যায় যে, সে দিন দূরে হলেও অনেক দূরে নয়।

তথ্যসূত্র  
1.    Vallor, Shannon, Technology and the Virtues, Oxford University Press (Book); New York: 2016. 
2.    Jan Kyrre, Berg Olsen and Evan Selinger, Philosophy of Technology 5 Questions, New York: Automatic Press (Book), 2006 
3.    Techné: Research in Philosophy and Technology (Journal) Volume 25, Issue 1, 2021.
4.     Society for Philosophy and Technology [Website: spt.org] 
5.    Net Future: Technology and Human Responsibility (Journal: waldorflibrary.org] 
6.    Reydon, Thomas A.C. ‘Internet Encyclopedia of Philosophy’ [Website: iep.utm.edu]
7.    Andrew Feenberg, What Is Philosophy of Technology? [Journal (June 2003): sfu.ca]
8.    Peter Paul Verbeek, (March 2015), Moralizing Technology and the ethics of things [Video: youtube.com/watch?v=S8a1DascnZg]
9.    Don Ihde and Peter paul verbeek (January 2018), How technology changes us [Video:.youtube.com/watch?v=hmBgJjfjG7Q]