স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র: কামাল লোহানীর স্মৃতি ও বিস্মৃতি
History is not the past. History is the past in so far as it is historicised in the present—historicised in the present because it was lived in the past.
অতীতকে ইতিহাস বলা চলে না। ইতিহাস বর্তমানের একটা মাপকাঠি মাত্র। অতীত শুদ্ধ বর্তমানে আসিয়াই ইতিহাস পদবাচ্য হয়।
—Jacques Lacan (1991: 12)
এক বছরের কিছু বেশি হইল প্রবীণ সাংবাদিক কামাল লোহানী (১৯৩৪-২০২০) কলেবর রাখিয়াছেন। তিনি যখন একেবারে জীবন-সায়াহ্নে পৌঁছিলেন মাত্র তখনই তাঁহার দেখা পাইয়াছিলাম। এক্ষণে বড়ই আপসোস হইতেছে তাঁহার অপরিমেয় স্মৃতির ভাণ্ডার হইতে যতটা পারিতাম ততটা শিখিতে পারি নাই। অপরাহ্নে চোখের আলো ম্লান হইয়া আসিতেছিল তাঁহার। তবে মনের চেরাগ শেষদিন পর্যন্তও জ্বলিতে দেখিয়াছিলাম। এই করোনা মহামারির প্রাদুর্ভাব ঘটিবার কিছুদিন আগে তাঁহার সহিত শেষ দেখা হইয়াছিল আমার।
ঘটনাচক্রে দেখিলাম, তাঁহার প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীর দিন—২০ জুন ২০২১—নাগাদ প্রবীণ রাজনৈতিক নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম কোথায় যেন এক সাক্ষাৎকারযোগে উক্তি করিয়াছেন, ১৯৭১ সালের ‘মুক্তিযুদ্ধ হারাইয়া গিয়াছে’। (সেলিম: ২০২১) শুনিয়া অবধি এই অবোধের মনে একটা প্রশ্ন জাগিয়াছে। মুক্তিযুদ্ধ যদি হারাইয়া গিয়াই থাকে তবে কখন হারাইল? কামাল লোহানীর পরলোকগমনের কিছুদিন পর তাঁহার লিখিত কয়েকটি বই আদ্যোপান্ত পড়িয়া মনে হইল এই প্রশ্নের একটি উত্তর দিয়া গিয়াছেন তিনি। বইগুলি কর্জ দিয়া আমাকে আরও কর্জগ্রস্ত করিয়াছেন সাগর লোহানী। স্থির করিয়াছি এই নাতিদীর্ঘ নিবন্ধে আমি কামাল লোহানীর দেওয়া উত্তরটির সংকলন করিব।
এখানে আগাম বলিয়া রাখি, উত্তরটি গোটা চারি ভাগে লেখা যাইবে। বলিয়া রাখা ভাল, কামাল লোহানী ১৯৭১ সালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় পর্বে সবসময়ের কর্মীর ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। এই নিবন্ধের উদ্দেশ্য কামাল লোহানীর স্মৃতিতর্পণ নহে। তাঁহার স্মৃতিকথা সংকলনের অতিরিক্ত কোন অভিলাষ আমার নাই। অতিক্রমের মধ্যে, তাঁহার দুই চারিটি বিস্মৃতির কথাও হয়ত বা বলিব। কারণ মুনিদেরও কখনো কখনো মতিচ্ছন্ন হয়।
মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হইতে যাইবার এই ঘটনা বড় সহজ কাজ ছিল না। লোহানী বিরচিত উপাখ্যান হইতে খানিক বুঝিতে পারি কেন ছিল না। তাঁহার ভাষায়, ‘চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। চীনপন্থী পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির যে ইউনিটটি ছিল খবরের কাগজে তার দায়িত্বে ছিলেন কেজি [মানে খন্দকার গোলাম] মোস্তফা।
মহাপ্রস্থানের পথে
ঢাকায় ২৫ মার্চে ও তারপরে গণহত্যার চিত্রটি আমি নিজের চোখে দেখেছি। তাই বাবার মৃত্যুসংবাদ পেয়েও চোখে সেদিন জল আসেনি।
—কামাল লোহানী (২০১২: ১৩৯)
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের সময় লোহানী ‘পূর্বদেশ’ নামক একটি দৈনিক পত্রিকায় কাজ করিতেন। বাংলা পত্রিকা ‘পূর্বদেশ’ আর ইংরেজি কাগজ ‘পাকিস্তান অবজার্বার’ ছিল হামিদুল হক চৌধুরীর পত্রিকা। বলা হয়ত বাহুল্য, হামিদুল হক চৌধুরী ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিশ্বস্ত কলাবরেটরের ভূমিকা পালন করিয়াছিলেন। ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকায় ঐ সময়—অন্যান্যের মধ্যে—সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী, এরশাদ মজুমদার এবং কবি মহাদেব সাহা প্রভৃতি মহাজনও কাজ করিতেন। কামাল লোহানীর জবানি অনুসারে, ‘দৈনিক পূর্বদেশে ঐ দিন রাতের শিফটে আমার ডিউটি ছিল।’ (লোহানী ২০১২: ৮৫)
২৫ মার্চের রাত হইতে ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ উঠিয়া যাওয়া পর্যন্ত অন্যান্য সাংবাদিকদের সঙ্গে ‘পূর্বদেশ’ অফিসেই ছিলেন তিনি। ২৭ মার্চ সকালে পত্রিকার আলোকচিত্রশিল্পী মানু মুন্সিকে লইয়া—মোটর সাইকেলযোগে—তিনি ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গা দেখিতে গিয়াছিলেন। গিয়াছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়—সরেজমিন দেখিয়াছিলেন, ‘একেবারে বিধ্বস্ত অবস্থা’। (২০১২: ৮৮)
কয়েকদিন ‘পূর্বদেশ’ অফিসে থাকার পর তিনি মতিঝিল কলোনিতে অবস্থিত নিজ বাসায় চলিয়া যান। কিন্তু ‘পূর্বদেশে’র কাজও চালাইতে থাকেন যথারীতি। এমতাবস্থায় একদিন হঠাৎ ভারতীয় বেতার—‘আকাশবাণী’—হইতে একটি বিশেষ ঘোষণা শুনিতে পাইলেন। লোহানী লিখিয়াছেন, ‘ঘোষণা শুনলাম, মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান প্রচারিত হবে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে।’ (লোহানী ২০১২: ৯০) শপথগ্রহণের এই ঘটনা ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখের। সেদিন মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলা নামক একটি গ্রাম ‘মুজিবনগর’ নাম ধারণ করিয়াছিল। এই ঘটনা আকাশবাণী প্রচার করিয়াছিল ঐদিন রাতেই। তখন হইতে যুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারকে আদর করিয়া মুজিবনগর সরকার বলার একটা চলও শুরু হয়।
কামাল লোহানীর স্মৃতিকথা হইতে তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সভ্য ছিলেন তাহা ঠিক বোঝা যায় না। আন্দাজ করা চলে, সেকালের ‘চীনপন্থী’ কমিউনিস্ট পার্টির কোন উপদলের অংশ কিংবা ঘনিষ্ট মিত্র ছিলেন তিনি। তিনি সিদ্ধান্ত লইলেন ভারতে—তাঁহার কথায় ‘মুক্তিযুদ্ধে’—চলিয়া যাইবেন। ৬ মে নাগাদ অল্প কয়েকজন সঙ্গী লইয়া চলিয়াও গেলেন। মে মাসের ৯/১০ তারিখ নাগাদ আগরতলা পৌঁছিবার পর—১৭/১৮ তারিখের দিকে—কলিকাতায় উপনীত হইয়াছিলেন সপরিবার কামাল লোহানী। যাইবার পথে—অন্যান্যের মধ্যে—সাংবাদিক ফয়েজ আহমদও তাঁহার দলসঙ্গী হইয়াছিলেন। কামাল লোহানী অধিক জানাইয়াছেন, ‘ফয়েজ আহমদ ২৫ মার্চ রাতে প্রেসক্লাবে আটকা পড়েন এবং মর্টার শেলিংয়ে আহত হন।’ (লোহানী ২০১২: ১১৫)
মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হইতে যাইবার এই ঘটনা বড় সহজ কাজ ছিল না। লোহানী বিরচিত উপাখ্যান হইতে খানিক বুঝিতে পারি কেন ছিল না। তাঁহার ভাষায়, ‘চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে তখন মুক্তিযুদ্ধের প্রশ্নে অনেক দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছিল। চীনপন্থী পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির যে ইউনিটটি ছিল খবরের কাগজে তার দায়িত্বে ছিলেন কেজি [মানে খন্দকার গোলাম] মোস্তফা। আমি কেজি ভাইকে ২৭/২৮ মার্চ বলেছিলাম, এখন আমাদের কি করা উচিত। তিনি বললেন, রাখ মিয়া, তিন-চার দিনের মধ্যে সবকিছু ঠিক হয়ে যাবে। এ নিয়ে চিন্তা-ভাবনার কিছু নেই। পরে আমি তাঁকে না জানিয়ে সীমান্ত পার হওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি।’ (লোহানী ২০১২:১১৭)
কেজি মোস্তফাকে জড়াইয়া আরও উপাখ্যান আছে কামাল লোহানীর আখ্যানে। দেখিতেছি, জনৈক পাকিস্তানি ও অবাঙ্গালি সাংবাদিক যাহা এস্তেমাল করিলেন বাংলাদেশের ‘কমিউনিস্ট’ পুরুষ তাহা ঠাহর করিতে পারেন নাই। ২৫ মার্চ রাতে গোলাগুলি শুরু হইবার আগে পাকিস্তান ফেডারেল ইউনিয়ন অব জার্নালিস্টের সভাপতি—লোহানীর পরিচয় মোতাবেক অবাঙ্গালি এবং পাকিস্তানি—আফতাব আহমদ দৈনিক ‘পাকিস্তান অবজার্বার’ পত্রিকার দপ্তরে আসিয়াছিলেন কেজি মোস্তফার সহিত দেখা করিতে। এখানে পুনরাবৃত্তি করা যাইতে পারে, এই পত্রিকাও ছিল হামিদুল হক চৌধুরীর। লোহানী লিখিতেছেন: ‘ফিরে যাওয়ার সময় তিনি আক্ষেপ করে বললেন, তোমরা তো লড়াই করে তোমাদের মাতৃভূমিকে রক্ষা করলে কিন্তু আমার তো মাতৃভূমি বলে কিছু থাকল না। পরে তিনি হোটেল পূর্বাণীতে চলে যান। তবে যাওয়ার আগে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন—আজ রাতে (২৫ মার্চ) একটা কিছু হতে পারে।’ (লোহানী ২০১২:৮৬)
পাকিস্তানি সাংবাদিকের মন্তব্যের সহিত বাংলাদেশি খন্দকার গোলাম মোস্তফার মন্তব্য তুলনায় আলোচনা করিলে মুক্তিযুদ্ধ কেন এবং কিভাবে অচিরেই হারাইয়া যাইবে তাহার পূর্বাভাস পাওয়া যায় বলিয়া আমাদের ধারণা। সঙ্গে আরও একটি যোগাযোগ বিবেচনা করা যাইতে পারে। কামাল লোহানী যে পত্রিকায় চাকরি করিতেন তাহার সম্পাদক ছিলেন মাহবুবুল হক। লোহানীর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ‘সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে পরাজিত হয়েছিলেন এই মাহবুবুল হক।’ একসময় ইনি রেলওয়ে শ্রমিক-কর্মচারী লীগের সভাপতিও ছিলেন। লোহানী যোগ করিয়াছেন, ‘শুনেছি, তিনি নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামীর কাছ থেকে সমর্থনও নিয়েছিলেন।’ (লোহানী ২০১২:৮৫)
এই মাহবুবুল হকের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী দলের অন্তর্গত জনৈক সাংবাদিকের সম্পর্কের কথাও লোহানী খোলামেলা বলিয়াছেন। যুদ্ধের সময় সাংবাদিকটি জামায়াতের আধা-সামরিক আলবদর বাহিনীর নেতা হইয়াছিলেন। ১৯৭১ সালের পর দেশত্যাগ করিয়া—তখন হইতেই—তিনি লণ্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করিয়া আসিতেছেন। লোহানী লিখিয়াছেন, ‘সেই মাহবুবুল হক একদিন আমাকে ডেকে বললেন, চৌধুরী মঈনুদ্দিনকে কুমিল্লা, নোয়াখালি, চট্টগ্রাম এসব এলাকায় রিপোর্ট সংগ্রহের জন্য পাঠাচ্ছি।’ লোহানীর ধারণা, সময়টা ২৫ মার্চের একটু পরে অর্থাৎ ২৭/২৮ মার্চ হইবে। তাঁহার মন্তব্য: ‘মঈনুদ্দিন দৈনিক পূর্বদেশে আমাদের রিপোর্টিং টিমে একজন সম্ভাবনাময় কর্মী ছিলেন। কিছুদিন পরে তিনি ফিরে আসলেন। পরে বুঝতে পারলাম এ সফরের পেছনে একটা অন্য উদ্দেশ্য ছিল—জামায়াতে ইসলামীর অর্থ বিভিন্ন জেলায় পাঠান। চৌধুরী মঈনুদ্দিনের মাধ্যমে এ কাজটি করা হয়েছিল।’ (লোহানী ২০১২: ৮৬)
এই জায়গায় সংক্ষেপে স্মরণ করা যাইতে পারে যে কামাল লোহানী ছিলেন ষাটের দশকের গোড়ার দিকে প্রতিষ্ঠিত ‘ছায়ানট’ নামক ভদ্র বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদী প্রতিষ্ঠানের একসময়ের সাধারণ সম্পাদক। পরে—১৯৬৭ সালের দিকে—তিনি ‘ক্রান্তি’ নামে আরেকটি সংগঠন গড়িয়া তোলেন। সেই সংগঠনের মধ্যে কেহ কেহ ছিলেন যাহারা তখন—আগে হইতেই—ভারত সীমান্তের ঐপারে আসা-যাওয়া করিতেন। উহাদের সাহায্যেই কামাল লোহানীর সঙ্গের ক্ষুদ্র দলটি মহাপ্রস্থানের পথে ত্রিপুরা সীমান্ত পার হইয়াছিলেন। (লোহানী ২০১২: ১১৫)
তখন ধাঙ্গড়বাজারের কাছে বালুহাক্কাক লেন হইতে ‘জয় বাংলা’ নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকাও বাহির হইতেছিল। সম্পাদনা করিতেছিলেন আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান। তিনি ‘আহমদ রফিক’ ছদ্মনাম ধারণ করিয়াছিলেন। কোন মন্তব্য না করিয়াই লোহানী তথ্যটি পরিবেশন করিয়াছেন।
অরণ্যে রোদন
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধে স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের ভূমিকা অবিস্মরণীয়। একই সাথে ভারতের আকাশবাণী কলকাতার সহযোগিতা অকৃত্রিম।
—কামাল লোহানী (২০০৮: ৩১)
কামাল লোহানীর জবানবন্দি অনুসারে ১৯৭১ সালের মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে তিনি কুমিল্লার চান্দিনা হইয়া নৌকাপথে ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তের এক ফাঁড়ি এলাকায় পৌঁছাইলেন। তখন তিনি পূর্ব পাকিস্তান সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক। লোহানী লিখিতেছেন, ‘একই রাজনৈতিক চিন্তা ও মানসিকতার হওয়ায় স্বাভাবিকভাবেই ফয়েজ [আহমদ] আর আমি একত্রে ভেবেচিন্তে কাজ করেছি। কিন্তু আগরতলায় পৌঁছবার পর আমরা—ফয়েজ [আহমদ] বাদে—সবাই একত্রে ধর্মনগর স্টেশন থেকে ট্রেন ধরলাম। কলকাতায় পৌঁছলাম।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫২) বলিয়া রাখা যাইতে পারে, ফয়েজ আহমদ দল হইতে আলাহিদা হইয়া বিমানযোগে কলিকাতা পৌঁছিয়াছিলেন।
কলিকাতা পৌঁছিবার পর ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের’ সহিত তিনি কিভাবে যুক্ত হইলেন সেই গল্পে মশগুল হইবার আগে কামাল লোহানী সেকালের ভারতীয়—বিশেষ পূর্বভারতের—সমাজচিত্র সামান্য হইলেও না বলিয়া ছাড়েন নাই। তিনি জানাইয়াছেন, তিনি ও তাঁহার ছোট্ট শরণার্থী দলটি আগরতলা ছাড়িয়া কলিকাতা যাইবার পথে নামিলেন মে মাসের ১৭ কি ১৮ তারিখ। তখন অহমের রাজধানী গুয়াহাটিতে ভারি বাঙ্গালিবিরোধী আন্দোলন চলিতেছে, ফলে অহমিয়া জাতীয়তাবাদীরা বাঙ্গালি পাইলে হামলাও করিতেছিল। লোহানীর জবানিতে জানা যাইতেছে: ‘গুয়াহাটিতে বাঙ্গালিবিরোধী একটা মনোভাব সবসময়ই ছিল। আমাদের আগরতলা থেকে এ বিষয়ে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল, কোথায়ও কোন অসুবিধা হলে স্থানীয় সিপিএম ও কংগ্রেসের স্বেচ্ছাসেবকরা থাকবে, তাদের সাহায্য নেবেন।’ (লোহানী ২০১২: ১২০)
লোহানী প্রণীত আরেকটা গল্পও বেশ—মধ্যবিত্ত রেখাচিত্রের মতন ফুরফুরে। তিনি লিখিয়াছেন, ‘আমার স্ত্রী দীপ্তি লোহানী ঢাকায় একটি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। ছোট মেয়ে উর্মিকে নিয়ে উনি আগরতলা পৌঁছালেন। বন্ডেল এলাকায়—কলকাতায়—আমি পরিবারবর্গসহ বাসা নিয়েছিলাম। এলাকাটা ছিল খুবই খারাপ। নকশালদের উপদ্রব ছিল। একদিন আমাদের বিল্ডিংয়ের সামনে একজন মার্ডার হল। শাশুড়ি আমার বাসায় ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন, প্রকাশ্য দিবালোকে সংঘটিত এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে। শুনে খোঁজখবর নিলাম। জানতে পারলাম, আমাদের বাড়িওয়ালার পাঁচ ছেলে। একেকজন একেক দল করে।’ (লোহানী ২০১২: ১২০)
কামাল লোহানী কলিকাতা আসিয়াছিলেন প্রবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের সংবাদ রাষ্ট্র হইবার কিছুদিন পর। এখানে পৌঁছিয়াই দেখিলেন, ‘নিরাপত্তা এবং বিশ্বব্যাপী যোগাযোগ স্থাপন ও সংরক্ষণের জন্য কলকাতার থিয়েটার রোড আর [পার্ক] সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ সচিবালয় ও মিশন স্থাপিত হয়েছে। কড়া প্রহরায় মন্ত্রিসভার সদস্য, প্রধানমন্ত্রী, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট এবং গুরুত্বপূর্ণ নেতৃবৃন্দকে থাকতে দেয়া হয়েছে বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৩)
কলিকাতা জায়গাটা ষোল আনা অপরিচিত ছিল না লোহানীর। তিনি স্মরণ করিয়াছেন: ‘পার্ক সার্কাস এলাকায় আমি ছোটবেলা কাটিয়েছি। ঐ এলাকা আমার বেশ পরিচিত। শুনলাম থিয়েটার রোডে বাংলাদেশ সরকারের অফিস এবং সার্কাস অ্যাভিনিউতে বাংলাদেশ মিশন। আমি সার্কাস অ্যাভিনিউতে গেলাম। এখানে দেখলাম বাংলাদেশ মিশনের ঠিক উল্টোদিকে রাস্তার ওপারে নজরুলজয়ন্তী অনুষ্ঠানের জন্য প্যান্ডেল টাঙ্গান হচ্ছে। বাংলাদেশ মিশনে ঢোকার একটা চেষ্টা করেও সুযোগ পেলাম না।’ (লোহানী ২০১২: ১২৯)
তখন ধাঙ্গড়বাজারের কাছে বালুহাক্কাক লেন হইতে ‘জয় বাংলা’ নামে একটা সাপ্তাহিক পত্রিকাও বাহির হইতেছিল। সম্পাদনা করিতেছিলেন আওয়ামী লীগের টিকিটে নির্বাচিত পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান। তিনি ‘আহমদ রফিক’ ছদ্মনাম ধারণ করিয়াছিলেন। কোন মন্তব্য না করিয়াই লোহানী তথ্যটি পরিবেশন করিয়াছেন। মুক্তিযুদ্ধে লড়িতে নামিবার পর—বিশেষ পত্রিকা সম্পাদনা করিতে বসিয়া—জাতীয় পরিষদ সদস্যকেও কেন নাম বদলাইতে হইবে? এই প্রশ্ন না উঠাইলে মুক্তিযুদ্ধ কিভাবে হারাইয়া গেল তাহা আদৌ বোঝা হইবে না। দৈনিক ইত্তেফাকের সাংবাদিক মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরীর মধ্যস্থতায় কামাল লোহানী অনতিবিলম্বে সাপ্তাহিক ‘জয় বাংলা’য় যোগ হইলেন। তবে একটু পরেই আমরা দেখিব, তাঁহার সেই কাজটা বড় বেশিদিন স্থায়ী হয় নাই।
২৫ মে সকালবেলা সাংবাদিক ও ছাত্রনেতা আমিনুল হক বাদশাহর হস্তক্ষেপের দৌলতে কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কাজ করিতে শুরু করেন। এই বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হইয়াছিল—ঘটনাচক্রে—বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের সেই দোতলা বাড়িতে যে বাড়িটি প্রথম প্রথম বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আদি মন্ত্রিসভার সদস্যদের জন্য বরাদ্দ ছিল। বাড়িটি ভারতের বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ওরফে বিএসএফ ঘাঁটির পাশে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারের কর্মী মুস্তফা আনোয়ার অন্যত্র জানাইয়াছেন—বাড়িটির নম্বর ৫৭। কামাল লোহানী লিখিয়াছেন, ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’ সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন সম্প্রচার শুরু করেছিল ২৫ মে ১৯৭১—বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে’। (লোহানী ২০১৬: ৩৭৬)
২৫ মে ১৯৭১ তারিখে যাহা শুরু হইল তাহা এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি নাগাদ ঘোষিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের ফল। লোহানী ঠিকই বলিয়াছেন, বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি দোতলা বাড়ির উপরতলায় স্থাপিত এই স্টুডিও স্থাপন ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ‘দ্বিতীয় পর্যায়’। সঙ্গে সঙ্গে আর এক সত্যের দিকে অঙ্গুলি হেলন করিয়াছেন তিনি—দ্বিতীয় পর্যায়ে এই বেতার কেন্দ্রের নাম দাঁড়াইল শুদ্ধ ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র’। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের কয়েকজন দেশপ্রেমিক অনুষ্ঠান সংগঠক ও প্রকৌশলী স্বতস্ফূর্ত উদ্যোগে যাহার নাম রাখিয়াছিলেন ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’—সেই কেন্দ্র আর এই কেন্দ্র ঠিক এক পদার্থ নহে। সত্যের খাতিরে একথা অবশ্য অস্বীকার করার উপায় নাই যে ‘স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র’ হইতে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি অনেক আগেই—খুব সম্ভব মার্চ মাসের ২৭ কিংবা ২৮ তারিখেই—খসিয়া পড়িয়াছিল।
লোহানী একের অধিক লেখায় বিষয়টি লইয়া আন্দোলন করিয়াছেন । ২০১৬ সালে সংকলিত এক গ্রন্থে তিনি লিখিয়াছেন: ‘পাঠক, “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” থেকে “বিপ্লবী” শব্দটা বাদ পড়েছে। খেয়াল করলেই বুঝতে পারবেন কেন এমন হল।’ (লোহানী ২০১৬: ৩৭৬) তাঁহার দেওয়া বিবরণ যদি অসত্য না হয় তো মানিতে হইবে ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ পড়িয়াছিল মুক্তিযোদ্ধা সেনা কর্মকর্তা মেজর জিয়াউর রহমানের ইচ্ছায়। লোহানীর ভাষ্য অনুসারে, মেজর জিয়াকে পটিয়া হইতে বলিয়া-কহিয়া কালুরঘাট সম্প্রচার কেন্দ্রে লইয়া আসেন বেতার সংগঠক বেলাল মোহাম্মদ ও তাঁহার সঙ্গীসাথীর দল। তাঁহাকে রাজি করান ‘স্বাধীনতার ঘোষণা’ পাঠ করিতে। (লোহানী ২০১২: ১২২) তবে ঘোষণা পাঠ করিতে যাইবার আগে মেজর সাহেব ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়াছিলেন। কামাল লোহানীর কথায়, ‘শব্দটি বাদ না দিলে তিনি পড়বেন না বলে জানিয়ে দেয়া হয়েছিল।’ (লোহানী ২০১৬: ৩৭৬)
দ্বিতীয় এক জায়গায় অবশ্য লোহানীর কথায় একটু হেরফের ঘটিয়াছে। তিনি লিখিয়াছেন: ‘চট্টগ্রামের কালুরঘাট ট্রান্সমিশন ভবনটিতে ছিল ছোট একটি স্টুডিও। কেউ কেউ পরামর্শ দিলেন ওখান থেকে অনুষ্ঠান প্রচারের। নাম ঠিক করা হল: “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র”। সম্ভবত দুদিন অধিবেশনের পর মেজর জিয়ার কথা বলে লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরী “বিপ্লবী” শব্দটি বাদ দিতে বললেন। তাই হল।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫০; মোটাহরফ এই নিবন্ধকারের) লোহানী যেন সত্য সত্য মনস্থির করিতে পারিতেছেন না। তৃতীয় বিবরণ একটু ভিন্নভাবে লিখিলেন: ‘এখানে একটি কথা বলে রাখতে চাই যে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ যখন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে তাঁর ঐ ঘোষণা প্রচার করবেন বলে ঠিক করলেন তখন তিনি তাঁর সহকারী লেফটেন্যান্ট শমসের মবিন চৌধুরীর মাধ্যমে বেতার কেন্দ্রটির মৌল নামকরণ থেকে “বিপ্লবী” শব্দটি পরিহার করে তবেই ঘোষণা প্রচার করেছিলেন।’ (লোহানী ২০০৮: ৪০; মোটাহরফ এই নিবন্ধকারের)
চতুর্থ বিবরণ নাগাদ লোহানী প্রথম বিবরণেই ফিরিয়া গেলেন। মেজর জিয়াউর রহমান প্রসঙ্গটি উল্লেখের পর তিনি লিখিলেন: ‘তবে তিনি একটা শর্ত দিলেন, “বিপ্লবী” [শব্দটা] বাদ দিতে হবে। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের পরিবর্তে “স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র” বলতে হবে।’ (লোহানী ২০১২: ১২৪) পরিষ্কার বোঝা যাইতেছে না ঠিক কোন সময় জিয়াউর রহমান ‘বিপ্লবী’ শব্দটা বাদ দেওয়ার নির্দেশজারি কিংবা উপদেশ দান করিয়াছিলেন। এদিকে আমরা যতদূর জানি, স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রমে কামাল লোহানী নিজে সরেজমিন উপস্থিত ছিলেন না। অতএব তিনি যাহা লিখিয়াছেন তাহা নিশ্চয়ই কোন না কোন প্রত্যক্ষদর্শীর বরাতে লেখা হইয়াছে।
দুঃখের মধ্যে, তিনি তেমন কাহারও দোহাই দান করেন নাই। বলেন নাই কথাটা কাহার মুখে বা কোন লেখায় পাইয়াছেন। এদিকে ‘বিপ্লবী’ বেতার কেন্দ্রের ছয়জন উদ্যোক্তার জবানবন্দি লইয়া ২০১১ সাল নাগাদ সৈয়দ আবুল মকসুদ যে সংকলন প্রকাশ করিয়াছিলেন তাহাতে সামান্য ভিন্ন তথ্য পাওয়া যাইতেছে। মকসুদ জানাইতেছেন, তাঁহার হাতে আসা ছয়টি জবানবন্দি আদতে গ্রহণ করা হইয়াছিল তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে—১৯৭২ সালে। মোট তিরিশ জনের মধ্যে মাত্র ছয় জনের সাক্ষাতকার বই আকারে ছাপা হইয়াছে। তাহাও প্রায় চল্লিশ বছর পর। ছয়ের ভিতর একজন—আ. ম. শারফুজ্জামান—বলিয়াছেন বেতার কেন্দ্রের নাম হইতে ‘বিপ্লবী’ শব্দটি উঠাইয়া দেওয়া হইয়াছিল ২৮ মার্চ দুপুরবেলা কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে অনুষ্ঠিত একটি সভার সিদ্ধান্ত অনুসারে। তবে তিনি জিয়াউর রহমান কিংবা শমসের মবিন চৌধুরী কাহারও নামোল্লেখ করেন নাই।
আ. ম. শারফুজ্জামানের জবানে বয়ানটা এইরকম: ‘২৮ মার্চ দুপুরবেলা বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল ফারুক, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, কাজী হাবিব উদ্দিন আহমদ ট্রান্সমিটারে আসেন। দুপুর একটা থেকে দেড়টা পর্যন্ত অনুষ্ঠান প্রচার করেন। অনুষ্ঠান শেষে আমরা এক জরুরি মিটিংয়ে বসি। এ মিটিংয়ে আমি প্রস্তাব রাখি, আমাদের স্টেশন পরিচিতির জন্য অনুষ্ঠানের শুরুতে ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়, হবে হবে নিশ্চয়’ গানটির প্রথমাংশ এবং অনুষ্ঠান শেষে দ্বিতীয় অংশ বাজানোর জন্য। আমার প্রস্তাব গৃহীত হয়। পরবর্তী সময়ে এটাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচিতি সুর হিসেবে বাজে। ওই মিটিংয়ে “বিপ্লবী” শব্দটি উঠিয়ে দিয়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত হওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তা গৃহীত হয়।’ (মকসুদ ২০১১: ১২৬)
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে যে বেতার প্রচার শুরু হইয়াছিল ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী আগরতলার কাছে বগাফা জঙ্গলে পৌঁছিয়া তাহা আবার চালু হইল। এই জায়গাটা ছিল বাংলাদেশের বিলোনিয়া সীমান্তের অদূরে। অন্যান্য কয়েকজনের মতন চট্টগ্রামের বেতার সংগঠক মুস্তফা আনোয়ারও স্মরণ করিয়াছেন, ৩০ মার্চ দুপুর ২ টা ১০ মিনিট নাগাদ চট্টগ্রাম কালুরঘাট ট্রান্সমিটারের উপর পাকিস্তানি বিমানের আক্রমণ হয়। তাই তাঁহারা ট্রান্সমিটার সরাইবার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করিতে উদ্যোগী হইলেন। বেতারনেতারা অবশ্য ৩০ মার্চ রাতেই সিদ্ধান্ত লইয়াছিলেন প্রয়োজনবোধে তাঁহারা সরাইবার উদ্দেশ্যে ট্রান্সমিটার খুলিয়া লইবেন। ৩১ মার্চ সকাল ১০ টা হইতে ১১ টার মধ্যে মুস্তফা আনোয়ার, সৈয়দ আবদুশ শাকুর, রাশেদুল হাসান ও আ. ম. শারফুজ্জামান—এই চারিজন—মিলিয়া এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি খুলিয়া লইয়াছিলেন। ট্রান্সমিটার সংশ্লিষ্ট সব খুচরা যন্ত্রাংশও তাঁহারা—গুদাম ভাঙ্গিয়া—সঙ্গে লইয়া গিয়াছিলেন। (মকসুদ ২০১১: ১০৬৩-০৭)
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের আদিকর্মীদের স্মৃতিকথা হইতে জানা যায়, এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি তাঁহারা প্রথমে পটিয়া পর্যন্ত লইয়া যান। একটা কারণ মেজর জিয়াউর রহমানের বাহিনী তখন সেখানে। তারপর ভারত সীমান্তের কাছে রামগড় বরাবর সরিয়া যাইবার সিদ্ধান্ত হয়। সেদিনের কাহিনী মুস্তফা আনোয়ার স্মরণ করিয়াছেন: ‘আমরা একটি ফক্সওয়াগন মাইক্রোবাস নিয়ে জনশূন্য শহরের পেট্রোল পাম্প থেকে ট্যাংকভর্তি করে পটিয়ার দিকে চললাম। আমাদের ড্রাইভার ছিল—খুব বেশি হলে ২০ বছরের অবিস্মরণীয় সাহসী তরুণ—এনাম। বাসে ছিলাম মহাপ্রস্থানের পথে বেলাল মোহাম্মদ, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, রাশেদুল হাসান, [আ. ম.] শারফুজ্জামান, সৈয়দ আবদুশ শাকের, কাজী হাবিব উদ্দিন আহমদ, আমিনুর রহমান ও আমি। পটিয়া থেকে রামগড়ে যাওয়ার পথে আমরা রেজাউল করিম [চৌধুরী] ও আবুল কাশেম সন্দ্বীপকে গাড়িতে তুলে নিই।’ (মকসুদ ২০১১: ১১১)
মুস্তফা আনোয়ারের জবানিতে জানা যাইতেছে, রামগড়ের পর তাঁহারা দশজন দুই ভাগে ভাগ হইয়া যান। এক ভাগ ভারতের বিএসএফ ৯২ নম্বর ক্যাম্পে ৬০ মিটারের একটি ক্ষুদ্রতরঙ্গ বা শর্টওয়েব ট্রান্সমিটারে যুদ্ধকালীন প্রচারের কাজে নিয়োজিত হইলেন। আনোয়ার বলিতেছেন, ‘এই ক্ষুদ্রতরঙ্গ থেকে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় ৪ এপ্রিল সন্ধ্যা সাতটায়।’ (মকসুদ ২০১১: ১১১)
এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি পটিয়া হইতে রামগড় লইয়া আসার দায়িত্ব পালন করিয়াছিলেন চট্টগ্রামের দুইজন বেতার প্রকৌশলী—আমিনুর রহমান ও রাশেদুর রহমান। এই মধ্যমতরঙ্গের ট্রান্সমিটারটি বিলোনিয়ার কাছে বগাফা ক্যাম্পে পুনরায় সংযোজিত করার দায়িত্ব পাইয়াছিলেন উপরের দুইজনের সঙ্গে—আরো দুইজন—সৈয়দ আবদুশ শাকের ও রেজাউল করিম চৌধুরী। মুস্তফা আনোয়ার স্মরণ করিতেছিলেন, ‘এই মধ্যমতরঙ্গের প্রথম অনুষ্ঠান প্রচারিত হয় বিকেল চারটায়, ৮ এপ্রিল।’ (মকসুদ ২০১১: ১১২)
মুস্তফা আনোয়ারের আরো একটি বিবৃতি যথাযথ উদ্ধৃত না করিলে অন্যায় করা হইবে: ‘এপ্রিল মাসের শেষের দিকে কলকাতার দৈনিক স্টেটসম্যান পত্রিকায় একটি বক্স কলাম প্রকাশিত হয়। শিরোনাম ছিল ‘দে ওয়েন্ট টু জাঙ্গল’। ২৫ মে থেকে [এই] অরণ্যের বেতার বালিগঞ্জের বেতার হয়ে যায়, প্রবাসী সরকারের একটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। মার্চ থেকে মে পর্যন্ত ইতিহাসহীন ওই বেতারই ছিল (অরণ্যের বেতার) একমাত্র ঐতিহাসিক বেতার। স্বাধীন বাংলা বেতারের নয় মাসের জীবনে ওই দুই মাসকেই অন্ধকারময় যুগ বলা যেতে পারে। আর ওই অন্ধকারের ভ্রূণেই লুকিয়ে রয়েছে স্বাধীন বাংলা বেতারের তথ্য—স্বাধীনতার খাঁটি ইতিহাস।’ (মকসুদ ২০১১: ১১২)
সৈয়দ আবুল মকসুদ জানাইয়াছেন, ‘একাত্তরের এপ্রিলে কলকাতার দি স্টেটসম্যানের বিশেষ সংবাদদাতা অমূল্য গঙ্গোপাধ্যায় আরগতলায় শরণার্থী শিবিরগুলোর সংবাদ সংগ্রহ করতে যান। সেখান থেকে তিনি কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়া সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাঠান। প্রকৌশলী সৈয়দ আবদুশ শাকেরকে উল্লেখ করে সেই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল: ‘হি ফ্লেড টু জাঙ্গল উইথ এ স্পেয়ার ট্রান্সমিটার’। সেই বেতার কেন্দ্রকে তিনি অভিহিত করেছিলেন ‘জাঙ্গল রেডিও’ বা ‘অরণ্য বেতার’ বলে। ১৯৯৪ সালে নয়াদিল্লিতে আমি শ্রী অমূল্য গঙ্গোপাধ্যায়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। তিনি তখন দি টাইমস অব ইন্ডিয়ার সম্পাদকীয় বিভাগের একজন শীর্ষস্থানীয় কর্তা।’ (মকসুদ ২০১১: ভূমিকা)
খাঁটির সহিত অবশ্য কিছু খাদও না মিশিয়া যায় না। নহিলে গহনা গড়া হয় না। বাংলায় একটি কথা আছে—যুদ্ধের পহিলা বলি সত্য। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রেও এই কথাটার বিশেষ অমর্যাদা হয় নাই। পরিতাপের মধ্যে, কামাল লোহানীর গোটা চারি স্মৃতিকথার চারিসীমায় এই সত্যের বিশেষ উল্লেখ দেখিলাম না। অবশ্য অলি আহাদ সামান্য এক টীকা লিখিয়া উল্লেখ করিতে কসুর করেন নাই যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হইতে কিছু অসত্যও প্রচারিত হইয়াছিল। যেমন: ‘২৯ মার্চ উক্ত বেতার কেন্দ্র হইতে ঘোষণা করা হয় যে শেখ মুজিব মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গেই আছেন, নেতৃত্ব দিতেছেন, এবং সংঘর্ষে জেনারেল টিক্কা খান নিহত হইয়াছেন।’ (আহাদ ১৯৯৭: ৪০১) ইতিহাসের খাতিরে অলি আহাদ সাক্ষ্য দিয়াছেন: ‘উক্ত ঘোষণা দেশবাসীর মনে বর্ণনাতীত সাহস সঞ্চার করে। ভারত গমনকালে হাটে-মাঠে-ঘাটে সংবাদটি প্রত্যেকের মুখে মুখে আমি স্বকর্ণে শুনিয়াছি এবং পাক বেতার কেন্দ্রের বিপরীত সত্য ঘোষণা কেহ সেই দিন বিশ্বাস করে নাই। স্বজাতির বেতার কেন্দ্রের ঘোষণার প্রতি সে কি অবিচল আস্থা স্বীয় প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা ব্যতীত উহা অনুধাবন করা সম্ভব নয়।’ (আহাদ ১৯৯৭: ৪০১)
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের মধ্যে সৈয়দ আবদুশ শাকের অবশ্য একটা বেশ জমকাল কৈফিয়ত দিয়াছেন: ‘সে সময় প্রয়োজনের খাতিরে এবং মুক্তিযুদ্ধে জনগণকে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করতে কিছু চাঞ্চল্যকর খবর প্রচার করার জন্য আমরা আলোচনাক্রমে ঠিক করলাম। তার মধ্যে ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের সঙ্গেই আছেন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করছেন’—এ খবরটি তৈরি করা হয়। এ খবরটি বিতর্কমূলক ছিল। কিন্তু এর পেছনে তখন আমাদের যুক্তি ছিল, যদি আমরা এ ধরনের একটি খবর প্রচার করি, তাহলে হানাদার পাকিস্তানি সরকার স্বাধীন বাংলা বেতারের দাবির অসারতা প্রমাণ করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকলে এবং তাঁকে অ্যারেস্ট করা হয়ে থাকলে পাকিস্তান বেতার থেকে বলতে পারে যে আমাদের প্রিয় নেতাকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে। তাতে আমরা জানতে পারব তিনি জীবিত আছেন। আর একবার যদি পাকিস্তান বেতার স্বীকার করে তাহলে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে প্রাণে শেষ করতে পারবে না। এমন কিছু করতে চাইলে তারা বিশ্ববাসীর কাছে ধরা পড়ে যাবে। এ রকম আশা করার আরও কারণ ছিল যে তারা এরই মধ্যে স্বাধীন বাংলা বেতারের অস্তিত্ব সম্পর্কে ভ্রান্তি সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পাকিস্তান রেডিও থেকে প্রচার করছিল যে হুগলি নদীর মোহনা থেকে ভারত একটি বেতার কেন্দ্র চালু করে কুৎসা প্রচার করছে এবং দুষ্কৃতিকারীদের উত্তেজিত করছে। আমাদের যুক্তি সঠিক প্রমাণিত হয়েছিল। আমরা এ খবরটি প্রচারের পরপরই পাকিস্তানি বেতার স্বীকার করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট করা হয়েছে।’ (মকসুদ ২০১১: ১৪৯)
অলি আহাদও এই যুক্তির মর্মার্থ অস্বীকার করেন নাই: ‘চতুর্দিকে গুজব ছিল শেখ মুজিব মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দিতেছেন। ইহা মিথ্যা প্রমাণ করিবার জন্যই ২ এপ্রিল করাচি বিমানবন্দরে তোলা [বন্দি শেখ মুজিবের] ছবি বিভিন্ন দৈনিক পত্রিকায় ছাপান হয়।’ (আহাদ ১৯৯৭: ৩৮৩/৪০১) কামাল লোহানী আক্ষেপ করিয়াছেন: ‘কেন ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঘরে থাকলেন, কেন তিনি গ্রেফতার হলেন এটা আমরা আজো বুঝতে পারি না।’ তিনি লিখিয়াছেন, ‘এ বিষয়ে বঙ্গবন্ধুকে একদিন [বলা বাহুল্য, স্বাধীনতা লাভের পর] জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, আপনি কেন গ্রেফতার হলেন? তিনি বলেছিলেন, আমাকে তো সবলোক চিনে, আমি কোথায় আন্ডারগ্রাউন্ডে যাব? তখন আমি বলেছিলাম, পশ্চিম বাংলার সিপিএম নেতা জ্যোতি বসুর মত মানুষ যদি আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে পারেন আপনি কেন পারবেন না? বঙ্গবন্ধু উত্তরে বলেছিলেন, জ্যোতিবাবুকে তো সবাই চিনে না, আমাকে সবাই চিনে।’ লোহানী এই যুক্তিতে পুলকিত হইতে পারেন নাই। তাঁহার দীর্ঘশ্বাস ছুটিয়াছিল: ‘বঙ্গবন্ধুর এ কথার পিছনে হয়ত একটা যুক্তি আছে কিন্তু রাজনৈতিকভাবে এ যুক্তি টেকে না।’ (লোহানী ২০১২: ৮৫)
সলিমুল্লাহ খানকে লোক সাহিত্য পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে কামাল লোহানী : ছবি © নাহিদ হোসেন [ উইকিপিডিয়ার সৌজন্যে]
কামাল লোহানীর অভিজ্ঞতা অবশ্য একটু আলাহিদা। তাঁহার কথায়, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র যুদ্ধের বাইরে কেমন যেন ছন্নছাড়া ছিল’। একটা উদাহরণও দিয়াছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ একজন লড়াকু সাংবাদিককে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম পলিটিকাল ভেটিং করার দায়িত্ব দান করিয়াছিলেন। এই সাংবাদিক ভদ্রলোক ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী। এই অজুহাতে সরকারের ভিতর হইতে আপত্তি তোলা হইল আর তিনদিন পর প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে ‘টেলিফোনে ভেটিং দায়িত্ব পালন না করার জন্য নির্দেশ দিলেন’।
অলাতচক্র
মুক্তিযুদ্ধে যারা অংশগ্রহণ করার জন্য ভারত গিয়েছিলেন তারা সবাই যে দেশকে ভালোবেসে গিয়েছিলেন, এটা আমি স্বীকার করতে পারব না। ব্যত্যয় ঘটেছিল কতিপয়ের আচরণে।
—লোহানী (২০১৬: ৩৭৯)
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের আদি উদ্যোক্তাদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল ফারুক স্মরণ করিতেছেন, ২৫ মে মুজিবনগর সরকারের ব্যবস্থাপনায় পঞ্চাশ কিলোওয়াট মধ্যম-তরঙ্গ ট্রান্সমিটার চালু হওয়ার সময় তাঁহাদের নির্দেশ দেওয়া হয় ‘ট্রান্সমিশন বন্ধ করে মুজিবনগরে যোগ দিতে। [সৈয়দ আবদুশ] শাকের সাহেবকেও অনুরূপ নির্দেশ দেওয়া হয়।’ আল ফারুক জানাইতেছেন: ‘আমরা ২৪ মে তারিখে ট্রান্সমিশন বন্ধ করে দিই। আগেই আমাদের সঙ্গে আগরতলায় সুব্রত বড়ুয়া যোগ দিয়েছিলেন। আমি, সুব্রত বড়ুয়া ও [আবুল কাশেম] সন্দ্বীপ ২৬ মে মুজিবনগরে যোগ দিই। মুস্তফা [আনোয়ার], [আ. ম.] শারফুজ্জামান ও বেলাল [মোহাম্মদ] আমাদের আগের দিন যোগ দেন।’ (মকসুদ ২০১১: ১০৩-০৪)
মুস্তফা আনোয়ার বলিয়াছেন: ‘কলকাতায় ৫৭ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের একটি বাড়ি ভাড়া করে স্বাধীন বাংলা বেতারের রেকর্ডিং স্টুডিও তৈরি করা হয়েছিল। সারাদিনের অনুষ্ঠান তিনটি অধিবেশনে বিভক্ত ছিল। অনুষ্ঠান ঘোষণাসহ তিনটি অধিবেশনই সম্পূর্ণ রেকর্ড করা হত। রেকর্ডকৃত অনুষ্ঠানের টেপগুলো তৎকালীন প্রবাসী সরকারের কর্তৃপক্ষকে আমরা হস্তান্তর করতাম। যুদ্ধের স্ট্রাটেজি অনুযায়ী প্রবাসী সরকার প্রচারের স্থান সম্পর্কে চূড়ান্তরূপে গোপনীয়তা রক্ষা করতেন।’ (মকসুদ ২০১১:১১৩)
এই সত্য কামাল লোহানীও সমর্থন করিয়াছেন। ভারত সরকারের সৌজন্যে ৫০ কিলোওয়াট মধ্যম-তরঙ্গের শক্তিমান একটি ট্রান্সমিটার পাওয়ার কথা আমরা একটু আগেই শুনিলাম। কামাল লোহানীর কথায়, ‘কিন্তু সেটা কোথায় ছিল তা আমরা জানতাম না নিরাপত্তার কারণে। ভারতের নিরাপত্তা বিভাগ এ ব্যাপারে অত্যন্ত সজাগ ছিল যেন এই গোপন বেতার সম্প্রচারের বিষয়টি কেউ না জানতে পারে। আমি আজও বলতে পারব না, কোথায় ছিল এই ট্রান্সমিটারটি।’ (লোহানী ২০১৬: ৩৭৬)
অন্য এক রচনায় কামাল লোহানী আরও বিশদ হইয়াছেন। অনেকেরই—এমনকি বাংলাদেশের প্রধান সেনাপতি কর্নেল মুহম্মদ আতাউল গণি ওসমানীরও—ধারণা ছিল আকাশবাণী কলিকাতা কেন্দ্র হইতেই বুঝি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হইত। (লোহানী ২০১২: ১৫৭) লোহানী জোরের সহিত লিখিয়াছেন: ‘এটা নেহায়েতই অজ্ঞতাপ্রসূত। [আকাশবাণীর] ধারেকাছেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটার ছিল না’। (লোহানী ২০০৬: ১৫৭)
রেকর্ডিং স্টুডিও আর ট্রান্সমিটার পরস্পর অধিক দূরত্বে থাকায় কখনো কখনো ভারি বিপদ দেখা দিত। এই রকম দুইচারিটা বিপদের উপাখ্যান কামাল লোহানীর বয়ানেই জানা যায়: ‘একবার তো ফাঁপরে পড়লাম সবাই। আমরা এবং আমাদের সহায়তাকারীরা। কারণ সিপিএম [ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)] এক নাগাড়ে তিনদিন “বন্ধ” ডেকে বসে আছে। আর এরা ডাক দেবার পর কারো সাধ্য নেই কোন যানবাহন বের করে—একমাত্র ইমার্জেন্সি ছাড়া। বেতার ইমার্জেন্সি বটে কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার তো গোপন কেন্দ্র। এর আইডেন্টিটি প্রকাশ করা যাবে না।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৭)
ফলে সিদ্ধান্ত হইল, তিন দিনের প্রয়োজনমাফিক গান, কবিতা, নাটক, জীবন্তিকা ইত্যাদি টেপ করিয়া ট্রান্সমিটারের দ্বারে লইয়া যাওয়া হইবে। অধিক কি, সিকিউরিটি ক্লিয়ারেন্স লইয়া কয়েকজন—খবর লিখিতে ও পড়িতে পারেন এমন দুইজন আর রেকর্ড করার মতন একজন—বেতারকর্মী ট্রান্সমিটারটি যে জায়গায় সে জায়গায় যাইবেন। লোহানী লিখিতেছেন: ‘আমাকে, আবদুল্লাহ আল ফারুক ও [আ. ম.] শারফুজ্জামানকে মনোনীত করা হল। আমি মূল বুলেটিন তৈরি করব এবং বাংলাটা পড়ব, ফারুক ইংরেজিটা পড়বেন, শারফুজ্জামান রেকর্ড করবেন আর উর্দু বুলেটিন সম্ভব হলে আমি তৈরি করব এবং পড়ব। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এসব বাতিল হয়ে গেল, যাওয়া সম্ভব হবে না। তিন দিনের আগাম সংবাদ বুলেটিনও তৈরি করেই দিতে হবে। তাই সবাই লেগে গেলাম আমাদের ফর্মুলা অনুযায়ী বুলেটিন তৈরি করতে। দিলাম তৈরি করে।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৭)
ইহাকেই কি বলে মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ বা—খোদ লোহানীর কথায়—সাইকোলজিকাল ওয়ারফেয়ার? এই গল্পের আড়ালে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অনুসৃত যুদ্ধকৌশল বেশ খানিকটা ফাঁসই করিয়া দিলেন কামাল লোহানী: ‘প্রতিদিনের তিনটি—সকাল, দুপুর ও সান্ধ্যকালীন—ট্রান্সমিশনে বাংলা, উর্দু ও ইংরেজি তিনটি ভাষায় মোট নটি করে বুলেটিন তৈরি হচ্ছে। সংবাদ পাঠ ও রেকর্ডিং করে তবেই কাজ শেষ হচ্ছে। সংবাদ পাচ্ছি একমাত্র রণাঙ্গন থেকে পাঠান টেলিগ্রাম আর হাতে পাওয়া ভারতীয় খবরের কাগজ থেকে। এছাড়া একটা উপায় আমরা উদ্ভাবন করেছিলাম। সেটা ছিল: কোন সেক্টরে কি ধরনের অস্ত্র বা সমরসম্ভার আছে, ঐ অস্ত্র কি ধরনের হামলায় কতটা ক্ষতি করতে পারে—কোন কোন সময়ে হামলা বা পাল্টা-হামলার সম্ভাবনা বা আশঙ্কা থাকে—তা থেকে আমরা রণকৌশলের ধারা বিশ্লেষণ করে ক্ষয়ক্ষতির হিসেবনিকেশ করে খবর পরিবেশন করতাম। ঢাকায় গেরিলা আক্রমণের খবর সেক্টর থেকে আমাদের জানিয়ে জানিয়ে দেয়া হত। আর এইভাবেই সংগৃহীত ও পরিবেশিত হত আমাদের সংবাদ বুলেটিন। দুই একসময় ক্ষয়ক্ষতি সম্পর্কে যে ভুল হত না তা নয়, তবে আমরা সেটাকে [হিসাবে] ধরতাম না।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৬-৫৭)
এই কৌশলে অবশ্য কাজ হইত না সবসময়। ডিসেম্বর মাসের গোড়ায় একদিন—সময়টি ছিল সন্ধ্যার পর—বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ কর্নেল এমএজি ওসমানী লোহানীকে থিয়েটার রোডের দপ্তরে ডাকিয়া নির্দেশ দিলেন: ‘পাকিস্তান পশ্চিম ফ্রণ্টে ভারত আক্রমণ করেছে, এ খবর আমাদের বেতারে ব্রেক করতে হবে।’ উত্তরে লোহানী বলিলেন: ‘আমাদের থার্ড ট্রান্সমিশনের সমস্ত রেকর্ড করে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে।’ তাহার পরও ওসমানি যাহা বলিলেন তাহার মর্মার্থ দুর্বোধ্য নয়: ‘না, না, আপনাকেই এ খবর আমাদের রেডিও মারফত সবার আগে প্রচার করিতে হইবে।’ লোহানী পড়িলেন বিপদে: ‘ট্রান্সমিটার কোথায় আমরা তো জানি না। তা ছাড়া আর কোন উপায়েই ধরান যাবে না।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৭-৫৮) দুই নম্বর সেনাপতি আবদুল করিম (ওরফে একে) খন্দকার সাক্ষী। লোহানী আক্ষেপ করিলেন: ‘রেডিও অস্ট্রেলিয়া ইতিমধ্যেই এ খবর ব্রডকাস্ট করেছে। আমাদের সময়সূচি অনুযায়ী নিউজ হতে হতে আকাশবাণীও এ খবর প্রচার করে ফেলবে।’ (লোহানী ২০০৬: ১৫৮)
কামাল লোহানীর স্মৃতি আর মুস্তফা আনোয়ারের বয়ান এক জায়গায় দেখি ঠিক মিলিতেছে না। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কলিকাতা পর্ব বিষয়ে আনোয়ার বলিয়াছেন, ‘স্বীকার করতে বাধা নেই, অনুষ্ঠান পরিকল্পনায় আমরা কখনো বিব্রতকর অবস্থায় পড়িনি। আমাদের বেতারে আমাদের কথক, শিল্পী, নাট্যকার—এঁরাই মুক্তমনে অনুষ্ঠান করে গেছেন। বাইরে থেকে কিছুই চাপিয়ে দেওয়া হয়নি, আমাদের বেতার কেন্দ্র ছিল সম্পূর্ণ স্বাধীন—“মুক্ত বেতার” বলা যায়।’ (মকসুদ ২০১১: ১১৩)
কামাল লোহানীর অভিজ্ঞতা অবশ্য একটু আলাহিদা। তাঁহার কথায়, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চরিত্র যুদ্ধের বাইরে কেমন যেন ছন্নছাড়া ছিল’। একটা উদাহরণও দিয়াছেন তিনি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় অভিজ্ঞ একজন লড়াকু সাংবাদিককে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রোগ্রাম পলিটিকাল ভেটিং করার দায়িত্ব দান করিয়াছিলেন। এই সাংবাদিক ভদ্রলোক ভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্বাসে বিশ্বাসী। এই অজুহাতে সরকারের ভিতর হইতে আপত্তি তোলা হইল আর তিনদিন পর প্রধানমন্ত্রী তাঁহাকে ‘টেলিফোনে ভেটিং দায়িত্ব পালন না করার জন্য নির্দেশ দিলেন’। লোহানীর আক্ষেপ: ‘মুক্তিযুদ্ধের ভিতর হলেও এমনতর বহু ঘটনাই প্রায়ই অঘটন ঘটিয়েছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে রাজনীতি বলতে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী একটি অংশ—বিশেষ করে তাজউদ্দিনবিরোধী গোষ্ঠী—সবসময়ই চাইত এ যুদ্ধ আওয়ামী লীগের বলে জাহির করতে।’ (লোহানী ২০১২: ১৫৮-৫৯)
সব অঘটনের গোড়ায় হাত দিয়াছেন লোহানী: ‘মুক্তিযুদ্ধের সময়কালে বিশেষ বাহিনী হিসেবে মুজিব বাহিনী গঠন ছিল একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত যার সাথে মুজিবনগর সরকার জড়িত ছিল না। আমি মনে করি একাত্তরে এভাবে মুজিববাহিনী গঠন সঠিক ছিল না। মুক্তিযুদ্ধ যাঁরা করেছে তাঁদের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ ছিল তা তো নয়। সেখানে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল, কমিউনিস্ট পার্টি ছিল, মওলানা ভাসানী নিজে ছিলেন, চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির একটি অংশ ছিল। জাফর-মেনন-রনোরা মুক্তিযুদ্ধে ছিলেন। অথচ এই মুজিব বাহিনী মেননপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ওয়াজীউল্লাহসহ ১২ জনকে হত্যা করে। মুজিব বাহিনী থেকে পরে হল রক্ষী বাহিনী। স্বাধীনতা উত্তর আওয়ামী লীগ শাসনামলে অন্তত ৩৬,০০০ বামপন্থী কর্মীকে এরা হত্যা করেছে। রক্ষী বাহিনীর আরেকটি অংশ হিসেবে তৈরি হয়েছিল লাল বাহিনী।’ (লোহানী ২০১২: ১৩৬-৩৭)
কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রকেন্দ্রিক আরও কয়েকটি ‘অদ্ভুত ব্যাপার’ সবিস্তার বয়ান করিয়াছেন। এখানে স্থানাভাবে আর সংকলন করিলাম না। একটা বিষয়ে খুবই অকপট হইয়াছেন তিনি: ‘তবে সচেতনভাবে আমি যেটা প্রত্যক্ষ করেছি তা হল, যাঁরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যোগ দিতে গিয়েছিলেন তাঁরা সবাই আন্তরিকতার সাথে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন হলফ করে তা বলা যাবে না।’ (লোহানী ২০১২: ১৫৮)
একটা নগদ প্রমাণ: ‘ক’দিন বাদেই এলেন চট্টগ্রামের কজন বন্ধু। বেতার কেন্দ্রে এসে উঠলেন প্রথম ৪/৫ জন। কিন্তু ওঁদের দেখে [অনেকেই নাখোশ হলেন।] ইতিমধ্যেই যাঁরা ঢাকা থেকে এসে আগে জায়গা নিয়েছেন তাঁরা চাইছিলেন না অন্য কেউ এসে তাঁদের জায়গা দখল করুক।’ বিষয়টা বিশুদ্ধ নীল—বা সংকীর্ণ স্বার্থপরতার—প্রকাশনা মাত্র নহে, ‘কৌলিন্যেরও একটা প্রচ্ছন্ন প্রশ্ন’ জড়াইয়া গিয়াছিল তাহার সহিত। লোহানী লিখিয়াছেন, ঢাকা—রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্টেশন—হইতে যাঁহারা আসিয়াছিলেন তাঁহারা নিজেদের সহিত অন্য স্টেশনের কাহাকেও মিলাইতে চাহিতেছিলেন না। কথাটা খোদ ঘোড়ার মুখেই শুনি: ‘কেউ কেউ তো বলেই বসলেন আপনারা এখানে কেন? বিএসএফ ক্যাম্পে যান। কারণ চট্টগ্রাম কালুরঘাট থেকে ট্রান্সমিটার উঠিয়ে নিয়ে এসে ওঁরা আগরতলায় বগাফার জঙ্গলে বিএসএফের সহায়তায় বেতার চালু করেছিলেন।’ (লোহানী ২০১২: ১৪৮)
কামাল লোহানী টিপ্পনি কাটিয়াছেন: ‘কিন্তু এঁরাই সেই তরুণ দেশপ্রেমিক যাঁরা ট্রান্সমিটারটি উঠিয়ে এনে নতুন করে রিইনস্টল করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করেছিলেন যা দেখে দিল্লি থেকে আসা ভারতীয় তথ্য প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী [শতপথী] এবং অল ইন্ডিয়া রেডিওর কেন্দ্রীয় প্রধান প্রকৌশলী পর্যন্ত স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন।’ (লোহানী ২০১২: ১৪৮) লোহানী প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ‘রাজনৈতিকভাবে আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, এঁরা বেতার-সংশ্লিষ্ট কর্মী ও সংস্কৃতিজন মিলেই তো প্রথম “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র” চালু করেছিলেন। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত। সময়োপযোগী উদ্যোগও বটে। এ প্রয়াস কি অন্য কোন [ব্যক্তি কিংবা] রেডিও পাকিস্তানের অন্য কোন কেন্দ্র নিতে পেরেছেন?’ (লোহানী ২০১২: ১৪৮-৪৯)
অদ্ভুত ব্যাপারের উপাখ্যান আরো কিছু বিবৃত করিয়াছেন কামাল লোহানী। তাঁহার বিবৃতি অনুসারে লিখিতেছি। একদিন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে কিছু ব্যক্তি বাঁকিয়া বসিলেন আকস্মিকভাবে। দাবি তুলিলেন, বেতারকর্মীদের বেতনের স্কেল ও পদমর্যাদা নির্ধারণ করিতে হইবে। এই মর্মে একটি স্মারকলিপি তৈরি করিয়া—সকলের দস্তখত আদায়পূর্বক—প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের হস্তে ন্যস্ত করিলেন তাঁহারা আর টাটকা জবাব না পাইয়া রীতিমত তিন দিনের ধর্মঘট ডাকিয়া বসিলেন।
এই ধর্মঘটের বিরুদ্ধে দাঁড়াইয়াছিলেন লোহানী। তিনি লিখিতেছেন, ‘এই উদ্ভট ও অপ্রত্যাশিত পরিস্থিতিতে বেশ কিছু শব্দযোদ্ধা দৃঢ় মনোভাবের পরিচয় দেন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীন বাংলার প্রচারযন্ত্র বন্ধ রাখার বিরোধিতা করে নিয়মিত অধিবেশন চালু রাখতে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তাতে সূচনাসঙ্গীত, কাব্যপাঠ, বজ্রকণ্ঠ, সংবাদ বুলেটিন (ইংরেজি, বাংলা ও উর্দু) গণসঙ্গীত—অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের গান—কথিকা, জীবন্তিকা নিয়মিত প্রচার হতে থাকল। তবে ধর্মঘটিরা কাজে যোগ দিতেন না। এ অবস্থায় যাঁরা অধিবেশন চালিয়ে নিচ্ছিলেন তাঁদের ধর্মঘটিদের হাতে অপদস্থ [হতে আর] হুমকি এবং অপ্রত্যাশিত নিপীড়নের শিকারেও পরিণত হতে হয়েছিল।’ (লোহানী ২০১২: ৩৭৯)
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র সম্পর্কে যাঁহারা লিখিয়াছেন ‘তাঁহাদের মধ্যে কেহই’ এই তিন দিনের ধর্মঘট সম্পর্কে ‘একটি বাক্যও’ লেখেন নাই—অর্থাৎ ঘটনাটা চাপা দিয়াছেন—বলিয়া আক্ষেপ করিয়াছেন লোহানী। সঙ্গে যোগ করিয়াছেন: ‘কেন চেপে গেছেন তা জানি না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে চাই, [যিনি] সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান “চরমপত্র” পড়তেন—প্রবাসী সরকারের তথ্য ও প্রচার দফতরের অন্যতম পরিচালক এম আর আখতার মুকুল—তিনি চরমপত্র প্রচার থেকে [বিরত] ছিলেন। পরবর্তীকালে তিনি অভিযোগ করে বক্তৃতাও করেছেন উপযুক্ত পারিশ্রমিক পাননি বলে। এ পরিস্থিতিতে প্রবাসী সরকারের একজন পরিচালক হয়ে তাঁর তো কোন পারিশ্রমিক নেয়ার কথা ছিল না। তাহলে তিনি কেন এই ধর্মঘটে যোগ দিয়েছিলেন?’ (লোহানী ২০১৬: ৩৮০) প্রশ্নের একটা সাক্ষাৎ জবাব কামাল লোহানী নিজেই দিয়াছেন: ‘এটা করে তাঁরা চেয়েছিলেন নিজেদের আখের গোছাতে। তাঁরা ভেবেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ফিরে গেলে তাঁরা যেন সমমর্যাদা বা তার চেয়ে বড় কিছু দাবি করতে পারেন।’ (লোহানী ২০১৬: ৩৭৯)
১৯৭২ সালে প্রদত্ত জবানবন্দিযোগে চট্টগ্রাম ‘বিপ্লবী’ বেতারের মুস্তফা আনোয়ার একটা পরোক্ষ জবাব দিয়াছিলেন প্রশ্নটির। তিনি বলিয়াছিলেন, ‘সশস্ত্র যুদ্ধের সহায়তার জন্যই বেতার কেন্দ্র তৈরি করা হইয়াছিল। তাঁহার কথায়: ‘আমরা যা তৈরি করেছিলাম, তা একটি বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। কাজটি যে কত কঠিন, তা সহজেই অনুমেয়।’ দুঃখের মধ্যে, পরবর্তী বংশধরদের অনুপ্রেরণার জন্য তেমন কিছু (সমগ্র মুক্তিযুদ্ধে) রক্ষিত হইয়াছে বলিয়া তিনি জানেন না। মুস্তফা আনোয়ারের সন্তাপ: ‘এমনকি আমাদের নেওয়া কালুরঘাটের এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি আজও বিধ্বস্ত অবস্থায় অবহেলায় এই রাজধানীতেই কোন এক জায়গায় পড়ে আছে বলে শুনেছি। যে সব অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে), তা আর রেডিও বা টেলিভিশনে বাজানো হয় না। দুটি ট্রাংকভর্তি টেপ ছিল। শুনেছি একটি ট্রাংক এসিড পড়ে নষ্ট হয়ে গেছে।’ (মকসুদ ২০১১: ১১৪)
এই নষ্ট হওয়াটা নিছক দুর্ঘটনা কিনা সন্দেহের কারণ আছে। অন্তত কামাল লোহানীর কথা শুনিলে সেই সন্দেহ ঘন হয়: ‘ঢাকাতে অনেকে মুক্তিযুদ্ধকালে আমাদের পক্ষে ছিলেন। তাঁরা এখানে বসে বঙ্গবন্ধুর নামে কবিতা লিখেছেন, মুক্তিযুদ্ধকে গোপনে নানাভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করেছেন। তবে [স্বাধীনতা লাভের পর] রেডিওতে প্রো-পাকিস্তানি যে গ্রুপটা ছিল এঁরাও অনেকে ভোল পাল্টে ফেলল। এঁদের চিহ্নিত করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। অথচ তাঁদের দাপটে টেকাই দায় হয়ে গিয়েছিল।’ (লোহানী ২০১২: ১৬৫)
কামাল লোহানী প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ‘বিদ্রোহী বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তারা যদি মুক্তিযোদ্ধাই হবেন তবে কেন তাঁরা তিন দিন বেতারে ধর্মঘট পালন করেছিলেন?’ তাঁহার জিজ্ঞাস্য, এ ধরনের বেতারে ‘পদমর্যাদা’ কিংবা ‘বেতনের হার’ দাবি করার যুক্তি কি হইতে পারে? তিনি মন্তব্য করিতেও পিছপা হন নাই যে ইতিহাসের সততার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখ থাকা উচিত।
ফয়েজ আহমদের তিন কন্যা
একটি প্রশ্ন: কালুরঘাটের এক কিলোওয়াট মধ্যমতরঙ্গের ট্রান্সমিটারটি এখন কোথায়?
—মুস্তফা আনোয়ার (মকসুদ ২০১১: ১১৬)
কামাল লোহানী প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ‘বিদ্রোহী বেতার কেন্দ্রের কর্মকর্তারা যদি মুক্তিযোদ্ধাই হবেন তবে কেন তাঁরা তিন দিন বেতারে ধর্মঘট পালন করেছিলেন?’ তাঁহার জিজ্ঞাস্য, এ ধরনের বেতারে ‘পদমর্যাদা’ কিংবা ‘বেতনের হার’ দাবি করার যুক্তি কি হইতে পারে? তিনি মন্তব্য করিতেও পিছপা হন নাই যে ইতিহাসের সততার জন্য মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই ঘটনার উল্লেখ থাকা উচিত। কারণ লোহানীর ধারণা, মুক্তিযোদ্ধা পরিচয়ে বেতারে যাঁহারা কাজ করিয়াছিলেন তাঁহারা সকলেই স্বভাবে মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন না। অন্তত ছিলেন কিনা তাহা প্রমাণের অপেক্ষা রাখে।
স্বাধীনতা পাওয়ার পর—বেশিদিন না যাইতেই—সেই প্রমাণই পাওয়া গেল। ১৯৯৯ সালে—নজরুল জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে মাসব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে—বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের দপ্তরে কামাল লোহীনসহ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের উদ্যোক্তা পুরুষেরা সেই জমানার সংস্কৃতি বিষয়ক প্রতিমন্ত্রীর হাতে প্রস্তাব দিয়াছিলেন, তাঁহাদের স্ব স্ব অধিকারে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের যে সকল উপায়-উপকরণ সংরক্ষিত ছিল সে সকল তাঁহারা একটি অনুষ্ঠানের মধ্যস্থতায় জাতীয় জাদুঘরে জমা দিতে চাহেন। আর দিতে চাহেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত দিয়া। প্রতিমন্ত্রী সেদিন নিরুত্তর ছিলেন। সেই অবধি ২০০৮ সাল পর্যন্ত লোহানী লিখিতেছেন: ‘কিন্তু যে কারণেই হোক, আজও [সেই প্রস্তাবের উত্তর] দেয়া হয়নি।’ (লোহানী ২০০৮: ৩৪)
দুঃখের মধ্যে, কামাল লোহানীর দুঃখ আর ঘুচিল না। কাগজে আর টেলিভিশনে তিনি হঠাৎ একদিন দেখিলেন—স্বাধীন বাংলা বেতারের অন্যতম জনপ্রিয় অনুষ্ঠান (এম আর আখতার মুকুল লিখিত ও পঠিত) ‘চরমপত্রের’ পাণ্ডুলিপি জাদুঘরে জমা দেওয়ার জন্য এক বিরাট আয়োজন। তাহাতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাই প্রধান অতিথি। লোহানী পুরাতন পাথরের যুগের মানুষের মতন লিখিলেন, ‘ভেবে কুল পেলাম না, কেন এমন হল? কিংবা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের এই জনপ্রিয় অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি সুরক্ষার ব্যবস্থা হল কিন্তু স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সব ধরনের উপকরণ সংরক্ষণে কেন প্রতিমন্ত্রী আগ্রহ দেখালেন না?’ (লোহানী ২০০৮: ৩৪)
এমন হওয়ার কথা তো ছিল না, তবুও এমন হইল। কেন হইল? কেন? কেন? লোহানীর প্রশ্নের উত্তর অচিরাৎ পাওয়া যায় নাই, তবে কয়েক বছর পর অন্য রচনায় তিনি নিজেই দিয়াছেন সেই উত্তর—উত্তর আকারে নহে, অধিক প্রশ্নের মধ্যস্থতায়। এই উদ্ধৃতিময় লেখার তামাম এই অধমকে বোধ হয় আরও একপ্রস্ত উদ্ধৃতি উৎকলন করিয়াই শোধ করিতে হইবে। কামাল লোহানী উক্তি করিয়াছেন: ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র আমরা কিভাবে পরিচালনা করতাম এটা বঙ্গবন্ধুকে বিস্তারিত জানাতে চাইলাম। তিনি স্বাধীন বাংলা বেতারের সকলকে গণভবনে ডাকলেন। অনেকে পরিবারবর্গসহ গেলেন। আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে যেভাবে অনুষ্ঠান করতাম—অনুষ্ঠান উপস্থাপনাসহ—সবকিছু বঙ্গবন্ধুকে দেখালাম। তিনি খুশি হলেন। তিনি সবার সাথে কথা বললেন। একপর্যায়ে তিনি আমাকে ডাকলেন। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা সর্বদলীয় পরামর্শক কমিটি গঠিত হয়েছিল মুজিবনগরে। তার একটা বৈঠক ডাকলে বুঝতে পারতেন কেমন করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল। কিন্তু তিনি বললেন, আরে রাখ, আমি তো এসে গেছি, আর কমিটির দরকার কি?’ (লোহানী ২০১২:১৩৭)
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে এই বৈঠকে তাঁহারা কত তারিখে বসিয়াছিলেন সে কথা লোহানী লিখিয়া রাখেন নাই। তবে সত্যটা খণ্ডন করার উপায় কোথায়? কামাল লোহানী নিজেই লিপিবদ্ধ করিয়াছেন সে সত্য: ‘প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দকে নিয়ে একটি সর্বদলীয় রাজনৈতিক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা হয়েছিল, যাতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, মনোরঞ্জন ধর, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ, [আর] সরকারের পক্ষ থেকে তাজউদ্দিন আহমদ আহবায়ক হিসেবে ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় শেষ প্রান্তে এসে এটি গঠন করা হয়েছিল। দুটি বৈঠকও হয়েছিল। প্রথম বৈঠক চলে সাড়ে তিন ঘণ্টা, যার সবটাই ছিল মওলানা ভাসানীর দিক-নির্দেশনামূলক বক্তৃতা—যার খবর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের বার্তা বিভাগে এসেছিল কিন্তু বৈঠক দুটোই গোপনীয় ছিল বলে এর কোন সংবাদ প্রচার করা হয়নি। ১৬ ডিসেম্বরের পর এ কমিটির কোন নামগন্ধ আর কখনোই শোনা যায়নি।’ (লোহানী ২০১২: ১৫৯-৬০)
বাংলাদেশের এই নীরব শুরুটা মোটেও ভাল হয় নাই। একটি কাহিনী হইতেই অনুমান করা যায় কেন ভাল হয় নাই। কাহিনীটি কামাল লোহানী হইতে উদ্ধার করি: ‘ঢাকাতে আসার পর ফয়েজ আহমদ খবরের কাগজে যুক্ত হয়ে গেলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর খুব প্রিয়পাত্র ছিলেন। বঙ্গবন্ধু ফিরে এলেন। ফয়েজ আহমদ বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা তৈরির অ্যাসাইনমেন্ট পেলেন। প্রথম সরকারি গণমাধ্যম হিসেবে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা (বিএসএস) গড়ে উঠল। যশোরে বঙ্গবন্ধু সফরে গিয়ে এক জনসভায় বক্তৃতা করলেন। তিনি বক্তৃতায় বললেন, ‘ভুট্টো সাহেব, তোমরা কি কীর্তি করে রেখে গেছ দেখে যাও।’ বঙ্গবন্ধুর এ বক্তৃতা পত্রপত্রিকায় বিকৃতভাবে প্রচার করা হল। প্রশ্ন উঠল, বঙ্গবন্ধুর এভাবে বক্তৃতা দেওয়া কি ঠিক হয়েছে? রিপোর্টটি বিএসএস থেকে করা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু ফয়েজ আহমদকে [টেলিফোন করে] জানতে চাইলেন, কে এই রিপোর্ট করেছে এবং এভাবে আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছে? তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার জন্য তিনি ফয়েজ আহমদকে বললেন। উত্তরে ফয়েজ আহমদ বঙ্গবন্ধুকে বললেন, রিপোর্ট যেই করুক না কেন যেহেতু আমি বিএসএসের প্রধান তাই সকল দায়দায়িত্ব আমার।’
অধিক কি! ‘ফয়েজ আহমদ এ ঘটনার যৌক্তিকতা বিশ্লেষণ করে একটা চিঠি লিখলেন এবং এরকম একটা নীতিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ হওয়ায় তিনি দায়িত্বপালনে অপারগতা প্রকাশ করে বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা থেকে পদত্যাগ করলেন। তারপর ফয়েজ ভাই নানা পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন। তাঁর তিনটি বিখ্যাত বই রয়েছে। ‘মধ্যরাতের অশ্বারোহী’ নামে বইটি বেশ প্রশংসিত হয়েছে। আমি এ তিনটি বইয়ের উপর আলোচনা লিখেছিলাম দৈনিক প্রথম আলোতে। লেখাটির নাম ছিল ‘ফয়েজ আহমদের “তিন কন্যা”।’ (লোহানী ২০১২: ১৬২-৬৩)
এইখানে কানে কানে বলিয়া রাখিতে পারি, এই তিন কন্যাও হয়ত কিছু কিছু জানেন মুক্তিযুদ্ধটা কখন হারাইয়া গিয়াছে।
ঢাকা # ১৪ জুলাই ২০২১
দোহাই
১. অলি আহাদ, জাতীয় রাজনীতি: ১৯৪৫-১৯৭৫, ৩য় সংস্করণ (ঢাকা: খোশরোজ কিতাব মহল ১৯৯৭)।
২. সৈয়দ আবুল মকসুদ, অরণ্য বেতার: স্বাধীন বাংলা বেতারকর্মীদের প্রথম জবানবন্দি (ঢাকা: প্রথমা প্রকাশন, ২০১১)।
৩. কামাল লোহানী, এদেশ আমার গর্ব (ঢাকা: গ্রন্থকানন, ২০১৬)।
৪. কামাল লোহানী, রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার (ঢাকা: ভূমিকা, ২০১২)।
৫. কামাল লোহানী, লড়াইয়ের গান (ঢাকা: জাতীয় সাহিত্য প্রকাশ, ২০০৮)।
৬. কামাল লোহানী, আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম, ২য় সংস্করণ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ২০০৬)।
৭. মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, মুক্তিযুদ্ধ হারিয়ে গেছে, বাংলা ট্রিবিউন রিপোর্ট, ঢাকা: বাংলা ট্রিবিউন, ২০ জুন ২০২১।
৮. Jacques Lacan, Freud’s Papers on Technique: The Seminar of Jacques Lacan, Book I, ed. Jacques-Alain Miller, trans. John Forrester (New York: WW Norton, 1991).
কামাল লোহানী স্মৃতিচারণে জিয়াউর রহমান পরপর দুবার ঘোষণা দিয়েছে এবং তার আগে হান্নানের ঘোষণা বা বক্তৃতা সম্পর্কে কিছু লেখেন না কেন। প্রথমত এম এ হান্নান 26 তারিখের দুপুরে বক্তৃতা বা ঘোষণা দেন সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তেমন তথ্য দিয়েছিলেন। ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান নিজেকে সুপ্রিম কমান্ডার দাবি করে একটি ঘোষণা পাঠ করেন, সেখানে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর কোন কথাই ছিল না। দ্বিতীয় ঘোষণা ২৮/ ২৯তারিখ সন্ধ্যায় দেন সেখান on behalf of bangabandhu বলেন, এই লেখাটা লিখে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি একে খান।( নিজেই চট্টগ্রাম শহর থেকে শুনেছিলাম)
গাজী সালেহ উদ্দিন
জুলাই ১৫, ২০২১ ১১:৩০
কামাল লোহানী স্মৃতিচারণে জিয়াউর রহমান পরপর দুবার ঘোষণা দিয়েছে এবং তার আগে হান্নানের ঘোষণা বা বক্তৃতা সম্পর্কে কিছু লেখেন না কেন। প্রথমত এম এ হান্নান 26 তারিখের দুপুরে বক্তৃতা বা ঘোষণা দেন সেখানে তিনি মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তেমন তথ্য দিয়েছিলেন। ২৭ তারিখ সন্ধ্যায় জিয়াউর রহমান নিজেকে সুপ্রিম কমান্ডার দাবি করে একটি ঘোষণা পাঠ করেন, সেখানে আওয়ামী লীগ বা বঙ্গবন্ধুর কোন কথাই ছিল না। দ্বিতীয় ঘোষণা ২৮/ ২৯তারিখ সন্ধ্যায় দেন সেখান on behalf of bangabandhu বলেন, এই লেখাটা লিখে দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের ধনাঢ্য ব্যক্তি একে খান।( নিজেই চট্টগ্রাম শহর থেকে শুনেছিলাম)
গাজী সালেহ উদ্দিন
জুলাই ১৫, ২০২১ ১১:২৪
Very collective and informative writing. Dr. Salimullah Khan is one of my favorite writer.
Sheikh Raihan Siddique
জুলাই ৩০, ২০২১ ২৩:০৫
স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র এই শব্দটি উচ্চারিত হয়েছে আবুল কাশেমের সন্দীপের কন্ঠে। যারা রেডিওটি নিয়ে গেছিল কালুরঘাটে তারা সবাই ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ এর সমর্থক ছিল। সম্ভবত সে জন্যই বিপ্লবী শব্দটা যুক্ত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কেন দেশ ত্যাগ করেননি কামাল লোহানী যুক্তি দিয়েছে বঙ্গবন্ধু দিয়েছে, আমরা তখন যুদ্ধ চলাকালীন কিন্তু এ ধরনের তথ্য শুনিনি, আমরা যেটা শুনেছিলাম সিরাজুল আলম খান শহর সবাই বঙ্গবন্ধুকে প্রেসার দিয়েছিল চট্টগ্রামে চলে আসার জন্য, এবং চট্টগ্রাম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয় এবং কিন্তু তিনি রাজি হননি, যেহেতু তিনি সম্ভাব্্য প্রধানমন্ত্রী পালিয়ে গেলে যে কোন সময় তাকে হত্যা করতে পারে। কামাল লোহানীর সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল তিনিভাসানীর ন্যা প করতেন।
গাজী সালেহ উদ্দিন
জুলাই ১৫, ২০২১ ১১:৫২