শঙ্খ ঘোষের প্রতিধ্বনি

 

১৯৯৯ সালের মার্চের কথা বলছি। তখনো জীবনানন্দ দাশের আবেশ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। আল মাহমুদের ‘সোনালী কাবিন’-এর গীতল প্ররোচনাও মুখরিত ছিলো মনে। অপরাপর কবির কবিতাও পড়ছি, যেমন জয় গোস্বামী, মৃদুল দাশগুপ্ত, রণজিৎ দাশ, আবুল হাসান, সিকদার আমিনুল হক বা বাংলাদেশের আশি ও নব্বই দশকে আবির্ভূত কবিদের কবিতা। জয় গোস্বামীর একটা গ্রন্থের উৎসর্গ পত্রে শঙ্খ ঘোষের ‘বর্ম’ কবিতার দুটো লাইন বেশ ভালো লেগে গেলো আমার:

এত যদি ব্যূহ চক্র তীর তীরন্দাজ, তবে কেন
শরীর দিয়েছ শুধু, বর্মখানি ভুলে গেছ দিতে!

সেই ভালোলাগার প্রেরণায় তাঁর ‘শ্রেষ্ঠ কবিতা’ কিনে ‘বর্ম’ কবিতাটাই প্রথম পাঠ করি। অদ্ভুত এক ধ্যানস্থ অনুভবে মনে হলো: কবির ‘পায়ের তীর্থতল’-এ ‘মুহূর্তে মূর্ছিত হলো’ যে, ‘প্রতি রাত্রে মুখে নিয়ে এক লক্ষ ক্ষত’ সে আমাকেও এই প্রশ্নের সামনে অসহায় ও নিথর করে তুলেছে। যেন প্রশ্নটি জাগতিক নয়, মহাজাগতিক। যেন এ-ভাষ্য জ্ঞানের অভিমুখে কাউকে জাগিয়ে তোলা নয়, প্রজ্ঞার পারিপাট্যে কাউকে থমকে দাঁড়াতে বাধ্য করা। আর আমার ব্যক্তিগত অভিমত, প্রজ্ঞা হলো জ্ঞানের সৃজনশীল রূপ। কবিতা যাকে ধারণ করে অনন্য মাধুর্যে। জ্ঞান কটমট করলে কবিতা কোথাও সেই মাধুর্য নিয়ে দাঁড়াতে পারে না। শঙ্খ ঘোষের কবিতা প্রচল পরিণতির বাইরে প্রজ্ঞায় স্থিত হতে পারে। তাঁর কবিতার ঠিক এই জায়গায় আমার প্রথম মুগ্ধতা। আর প্রজ্ঞার সঙ্গে পরিমিতিবোধের যে-সম্পর্ক তাও তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে সহজেই আঁচ করতে পারি আমি। কত অল্প কথায় অসামান্য বোধে মথিত করেন পাঠকের মন। যারা তাঁর ‘ভিড়’ কবিতাটি পড়েছেন, তারা এই সত্য উপলব্ধি করবেন সহজেই। দুই স্তবকে সমাপ্ত মাত্র আট লাইনের কবিতা। ‘আরো কত ছোট হব ঈশ্বর’ বলেই আত্ম-চেতন একটা প্রশ্নের মধ্যে আটকে ফেলেন আমাদের। বলেন,‘আমি কি নিত্য আমার সমান’—এখানে ‘নিত্য’ সময় কাঠামো ইঙ্গিত করে। পরের লাইনেই যখন বলেন,‘সদরে, বাজারে, আড়ালে?’ তখন স্থান-কাল-পাত্রকে সমন্বিত পরিমাপক হিসেবে আত্ম-বিচারে জারি থাকতে দেখি। ‘সদরে, বাজারে’ কবি সামষ্টিকতায় লীন। ‘আড়ালে’ কবি নিজেই নিজের পরিমাপক। এভাবে ব্যক্তির সঙ্গে সমষ্টির ঐক্য আছে বলেই তাঁর কবিতা বিশেষ থেকে নির্বিশেষে যাত্রা করে। আর যে-আত্মচেতন প্রশ্নের কথা বললাম, অন্তর্গহনে তা তো আমাদের সবারই প্রশ্ন।

ওই সময় কলকাতার কেউ কেউ তাঁকে ‘বাবরের প্রার্থনা’র কবি বলে সম্বোধন করতো। ‘বাবরের প্রার্থনা’ কবিতায় এমন এক সংহতি, নিবিড় পরিপাট্য আছে যে, মনে হয় প্রতিটি শব্দই অনিবার্য। গভীর অন্তর্দৃষ্টিসম্পন্ন কোনো নিষ্ঠুর সমালোচকও বাহুল্য বা সংযোজনযোগ্য একটি শব্দও আবিষ্কার করতে পারবেন না। তো এই কবিতায় ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ পড়তে পড়তে আমার কেবলি ভারতচন্দ্রের লাইন মনে আসতো: ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’। আর ভাবতাম, বাৎসল্য ভাবনায় কে বেশি আধুনিক? ভারতচন্দ্র নাকি শঙ্খ? ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের কবি হলেও সরাসরি বলেছেন। সন্তানের পক্ষে আবরণহীন সোজাসাপ্টা একটা চাহিদার বয়ান। শঙ্খ সেখানে ‘স্বপ্নে থাক’ বলে ভাবের আবরণে অনন্ত চাহিদাকে সন্তানের পক্ষে পরিব্যাপ্ত করে তুলেছেন তাঁর প্রার্থনায়। পরে ভেবেছি, প্রচ্ছন্নতা কম থাকলেও ভারতচন্দ্রের ‘দুধেভাতে’র ব্যাপ্তি কম নয়। অপার সমৃদ্ধি এবং সুখ-শান্তিতে থাকার রূপক হিসেবে প্রবাদপ্রতিম কথাই তো ‘দুধেভাতে থাকা’। তবু শঙ্খ ঘোষ যেন ‘স্বপ্নে থাক’ বলার মধ্য দিয়ে আরো বেশি জমাট ব্যঞ্জনায় আবৃত করে রেখেছেন স্থান-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ অতল বাৎসল্য বোধ। মানুষের বেঁচে থাকা মানেই তো স্বপ্নে থাকা। স্বপ্নের মধ্যেই গচ্ছিত সকল চাওয়া-পাওয়া, সুখ, সমৃদ্ধি, আশা ও আকাঙ্ক্ষার বস্তুগত ও মানসিক উপাদান। স্বপ্নহীন মানুষ তাই মৃত। তাই ‘এই তো জানু পেতে বসেছি, পশ্চিম-’ বলেই ‘বসন্তের শূন্য হাত’ উত্থিত হয় সন্তান যাতে স্বপ্নে থাকে, সেই বাসনায়। কাজেই স্বপ্নের আবরণে তার প্রার্থনা স্নেহ-মমতায় জারিত গতানুগতিক বাৎসল্য ভাবনা ডিঙিয়ে যায়। সব সময়ের সব স্থানের সব পিতার জন্যেই যেন এই প্রার্থনা। সন্তানের জন্য নিরূপিত এবং অনিরূপিত সমস্ত আকাঙ্ক্ষা ‘স্বপ্নে থাক’-এর মধ্য দিয়ে সর্বময়তা নিয়ে হাজির থাকে। আর শঙ্খ ঘোষ নিজেও তাঁর গদ্যে বলেছেন: ‘কবিতার একটা নিজস্ব আবরণ আছে। তার ভিতরে প্রচ্ছন্ন রেখে অনেক কথা বলে নেওয়া যায়...’। ‘বাবরের প্রার্থনা’ পড়তে পড়তে আমারও মনে হয়েছে ‘আমার সন্ততি স্বপ্নে থাক’ সেই অনেক কথার ব্যঞ্জন।

বাৎসল্য ভাবনায় কে বেশি আধুনিক? ভারতচন্দ্র নাকি শঙ্খ? ভারতচন্দ্র মধ্যযুগের কবি হলেও সরাসরি বলেছেন। সন্তানের পক্ষে আবরণহীন সোজাসাপ্টা একটা চাহিদার বয়ান। শঙ্খ সেখানে ‘স্বপ্নে থাক’ বলে ভাবের আবরণে অনন্ত চাহিদাকে সন্তানের পক্ষে পরিব্যাপ্ত করে তুলেছেন তাঁর প্রার্থনায়...

‘দৃষ্টিতে মেলেনি যাকে সৃষ্টি ভ’রে তাই অনুভব’ করবার একটা অপার শক্তি আছে শঙ্খ ঘোষের কবিতায়। কিন্তু সেই অনুভব দার্শনিক সমাধানের মতো সিদ্ধান্তমূলক হয়ে ওঠে না বলেই পাঠকের ভাবনার সুযোগ থাকে। পাঠক নিজে জড়িত হয়ে পড়েন। এ প্রসঙ্গে হোর্হে লুইস বোর্হেসের একটা কথা প্রাসঙ্গিক মনে হলো। বোর্হেস যা বলেছেন তার মর্মার্থ হলো, লেখকের লেখায় পাঠক ভূমিকা রাখেন। [নিজের সম্পর্কে: হোর্হে লুইস বোর্হেস, অনুবাদ: মশিউল আলম]।  তো এই যে ভূমিকা রাখা, তার মানে হলো পাঠকের নিজস্ব ভাবনার রেশ তৈরি হওয়া। শঙ্খের কবিতা পড়ে যেটা আমি পেয়েছি। কবিতায় ফর্মের দিক থেকে তাঁকে খুব নিরীক্ষাধর্মী বলে মনে হয় না আমার। যতটা বুঝি এদিক থেকে তিনি ঐতিহ্যের অনুসারী। কিন্তু বহু কবিতায় তিনি ক্রীড়াময়। সেটা শুধু ছন্দ বা রিদমের পারঙ্গমতা হিসেবে বলছি না। তাঁর কবিতায় কোথায় যেন একটা বোধের খেলা কাজ করে। যেন বোধকেই তিনি ক্রীড়াময় করে তোলেন। কখনো কিছু পঙক্তিতে আবার কখনো পুরো কবিতায় তিনি তা প্রোজ্জ্বল করে তোলেন। দার্শনিকতাকে উসকে দিলেও কোনো মীমাংসায় যান না তিনি। ফলে এই ক্রীড়াময়তার একটা উৎসমূল তাঁর কবিতার বিরোধাভাসমূলক ভঙ্গি। বাংলায় যাকে বলতে পারি কূটাভাসময়। ঠিক প্যারাডক্স না হলেও তার কাছাকাছি তো বটেই। ‘মানে’ কবিতার কথাই ধরা যাক। ‘কোনো-যে মানে নেই, এটাই মানে’ বলেই সামান্য বিস্তৃতির মধ্যে সমগ্র কবিতাটি জীবনের অর্থ নিয়ে দাঁড়ায়। বলেন, ‘এই নে বুক মুখ, হাত নে পা নে—’। তারপরই বলেন: ‘ভাবিস পাবি তবু আমার মানে?’ জীবন-যে অর্থহীনতার মধ্যেই একটা অর্থময় প্রচ্ছন্নতা নিয়ে থাকে অথবা অর্থময়তার মধ্যেও অর্থহীনতার প্রপঞ্চ নিয়ে তাড়িয়ে বেড়ায়, এই বিরোধাভাস কত সামান্য কথায় প্রগাঢ়ভাবে উঠে আসে এই কবিতায়। আবার ‘সত্য’ কবিতায় শেষটায় এসে বললেন, ‘সত্য থেকে সঙ্ঘ হতে পারে’। ঠিক পরের লাইনটাতেই একটা মীমাংসাহীন ভাবনার আলোড়ন তুলে বলেন, ‘সঙ্ঘ তবু পাবে না সত্যকে’। সত্যের রহস্য তখন উন্মোচনের তাড়নায় পাঠকের মনে কড়া নাড়ে। দুই স্তবকের ‘মাতাল’ কবিতা পুরোটাই মাতাল সত্তার দ্বৈত দাবি নিয়ে লিখিত। এই দ্বৈততা বোধের বিরোধ তৈরি করেনি, বরং ঐক্য তৈরি করেছে। ‘সইতে পারবে না’ আর ‘বইতে পারবে না’র আপাত বিরোধের মধ্যে সেই অন্তর্গত ঐকতান কূটাভাসের মতো চোখে পড়ে:

আরো একটু মাতাল করে দাও।
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ও সইতে পারবে না।

এখনো যে ও যুবক আছে প্রভু!
এবার তবে পৌঢ় করে দাও—
নইলে এই বিশ্বসংসার
সহজে ওকে বইতে পারবে না!

শঙ্খ ঘোষ ‘কলহপর’ কবিতায় লিখেছেন: ‘আমাকে ভুবন দাও আমি দেব সমস্ত অমিয়’। কিন্তু এই ভুবন তিনি কোথায় কীভাবে চান অন্য কবিতায় তারও একটা সুরাহা দেন: ‘বাড়ি চাই বাহির-ভুবনে’। বাহির-ভুবনে যদি বাড়িই হলো তাহলে আর ভুবন থাকে কোথায়? আবার ভুবন যদি বাহিরেই হয়, বাড়ির প্রশ্নটি অবান্তর। এখানেও সেই প্যারাডক্স। তবু এই প্রসঙ্গ এখানে মুখ্য নয়। ‘ঘরে থাকতে অল্প মতি’, তাই ‘রোদে রোদে পথে ঘুরে ফেরা’ তার স্বভাব। তবু ‘আকাশে বিচিত্র মেঘ নানা ছন্দে তোলে যে অপেরা’ তা দেখতে দেখতে কিংবা ‘তাতে লুপ্ত হতে হতে রুক্ষ চুলে বাড়ি ফিরে আসা’ দিন শেষে তার পরিণাম। ফলে তাঁর কবিতা পড়ে ঘরমুখো একটা মনস্তত্ত্ব আবিষ্কার করতে পারি আমি। ‘ঘর’ কবিতায় তিনি তো সরাসরিই বলেন: ‘এসো আমার ঘরে, আমি ঘর পেয়েছি’। সেই ঘরে ফেরার উপলক্ষ্য লক্ষ্যেরও অধিক হয়ে দাঁড়ায় ‘তুমি’ কবিতায়। আমাদের প্রত্যেকের ব্যক্তিগত প্রেমপর্বে এই ‘তুমি’র অনুভব দুর্নিবার, আবেগের ফল্গু শঙ্খের কবিতার মতোই স্ফূর্ততায় অধীর:

আমি উড়ে বেড়াই আমি ঘুরে বেড়াই
আমি সমস্ত দিনমান পথে পথে পুড়ে বেড়াই
কিন্তু আমার ভালো লাগে না যদি ঘরে ফিরে না দেখতে পাই
তুমি আছো, তুমি

এই প্রেম যেন বোহেমিয়ানের নয়, গৃহীর। বাঙালির বাউলপনাতেও একটা আখড়ায়ি স্থিতির মানসিকতা কাজ করে। শঙ্খ ঘোষ সেই মনস্তত্ত্বের অনুগামী বলেই আমার মনে হয়েছে। তাঁর সময়ে সুনীল কিংবা শক্তি বোহেমিয়ান জীবনের আর্তি নিয়ে কবিতায় যেভাবে চিহ্ন রেখেছেন, শঙ্খ সেই পথ মাড়াননি। Good Morrow কবিতায় জন ডানের প্রেম যেমন makes one little room an everywher, শঙ্খ ঘোষ ঠিক তেমনি গৃহ-ঋষির মতো ঘরের মধ্যে ভুবন এনেছেন। অথবা বাহির-ভুবনে মনে মনে অনুভব করেছেন গৃহের অনন্ত সম্ভাবনাকে। তাই হয়তো কবিতায় লিখেছেন: ‘ওরা চলে যাবার পর মনে হলো ঘরই আমার আকাশ’। তাঁর গৃহ কূপমণ্ডূকের সীমিত পরিসর নয়, যাপনের ফসলি মাঠে বিচিত্র ধ্যানের চাষাবাদস্থল। বুদ্ধদেব বসু বহির্বিশ্বে রবীন্দ্রনাথের ‘ঋষি’ পরিচয় নিয়ে বিব্রত ছিলেন। আর রবীন্দ্রানুরাগী শঙ্খ ঘোষ সেই ঋষিত্বকেই আরাধ্য ভেবে প্রজ্ঞার পরিমিতিতে যাচাই করেছেন কবিতাকে। তাই তাঁর কবিতায় বাউণ্ডেলাবাদের [বোহেমিয়ানিজম] মারদাঙ্গা উচ্ছ্বাস অনুপস্থিত। এই জায়গায় শঙ্খ ঘোষ অনেক বেশি দেশজ। এতে তিনি কতটা আধুনিক হলেন বা হলেন না, প্রশ্নটি যার যার ব্যক্তিগত। কিন্তু বহিরাগত বহু প্রবণতা তথা বাউণ্ডেলাবাদ [বোহেমিয়ানিজম] ধারণ কিংবা ঋষিসুলভতাকে পরিহার আমাদের কবিতাকে কতটা এগিয়ে দিয়েছে, বাংলা সাহিত্যের স্বকীয় চারিত্র্য নির্মাণে এই প্রশ্নটি সামনে আসা উচিত।

তাঁর কবিতায়, যতটা বুঝেছি, পরাবাস্তব অভিঘাত নাই বললেই চলে। যেসব কবিতার কথা বললাম এতক্ষণ তার সবই প্রায় যাপনসত্যের ভেতর থেকে উঠে আসা বাস্তবের অবলীলা। অবলীলা আছে, তবে কি সূক্ষ্মার্থে কোনো লীলা নেই তাঁর কবিতায়? তাঁর কবিতা যখন বলে: ‘তোমার আঙুলে আমি ঈশ্বর দেখেছি কাল রাতে’ তখন তো একটা লীলার আভাস টের পাওয়া যায়। তাঁর ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থে ভাষ্যের অধিক কোনো লীলা যেন প্রতিভাসে জেগে উঠেছে কোথাও ঠিক এরকম। সেখানে অর্থ নয়, অর্থহীন বোধিচক্রের প্রতিভা হেঁয়ালির মতো কিছু শোনায়। আলো-আঁধারির মতো বোঝা আর না-বোঝার, দৃশ্য আর অদৃশ্যের মাঝখান দিয়ে কবির প্রেরিত নন্দন অধরা থেকে যায়। কিন্তু তাঁর প্রভাব শিল্পিত আনন্দের লীলাময় অভিঘাত তৈরি করে পাঠকের মনে। অন্তত আমার অনুভব সেরকমই ছিলো। ‘বাবরের প্রার্থনা’র চাইতেও ‘পাঁজরে দাঁড়ের শব্দ’র দিকে ভালা লাগায় অনেক বেশি ঝুঁকে ছিলাম আমি সেই সময়টায়:

আমি কি মৃত্যুর চেয়ে ছোট হয়ে ছিলাম সেদিন?
আমি কি সৃষ্টির দিকে দুয়ার রাখিনি খুলে কাল?
ছিল না কি শষ্পদল আঙুলে আঙুলে? তবে কেন
হীনতম অপব্যয়ে ফেলে রেখে গেছ এইখানে?

কি এক অস্ফূট আনন্দ যে খেলে যায় এই কবিতাপাঠে, তা অনিরূপিত। কেবল আনন্দের প্রভাবটা গাঢ় প্রস্রবণের মতো সুদীর্ঘকাল বয়ে যেতে দেখেছি। ধরতে চেয়েছি তাঁর স্বরূপ। পারিনি। রবীন্দ্রনাথের গানের কথা মনে পড়েছে কেবল: ‘কেন তারে ধরিবারে করি পণ? অকারণ?’ সেই অকারণ আনন্দ-লীলা শঙ্খ ঘোষের অনেক কবিতাতেই দীপ্যমান হয়ে আছে। তাঁর ‘নিহিত পাতালছায়া’ কাব্যগ্রন্থের ‘জল’ তেমনি একটি কবিতা:

জল কি তোমার কোনো ব্যথা বোঝে? তবে কেন, তবে কেন
জলে কেন যাবে তুমি নিবিড়ের সজলতা ছেড়ে?
জল কি তোমার বুকে ব্যথা দেয়? তবে কেন তবে কেন
কেন ছেড়ে যেতে চাও দিনের রাতের জলভার?

অক্ষরবৃত্তের ক্রীড়া আর ভাবের লীলা এখানে একাকার হয়ে গেছে। এত জলের ছড়াছড়ি অথচ ভাববস্তুটি স্বরূপে ধরা দিচ্ছে না উপলব্ধিতে। জলে যাবার নিষেধাজ্ঞা আছে অথচ ‘নিবিড়ের সজলতা’ এবং ‘দিনের রাতের জলভার’ তাকে ধরে রাখতে চাইছে এক অকারণ প্ররোচনায়। এই গভীর কবিতার অর্থ খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা বৃথা। বরং তাঁর কবিতার মতোই বলতে হয়, ‘কোনো-যে মানে নেই এটাই মানে’। শঙ্খ ঘোষের রবীন্দ্রপ্রীতি সর্বজন বিদিত। তাঁর কবিতার চোরাপথে প্রচ্ছন্ন রবীন্দ্রনাথ খুঁজে পেতেও পারেন কেউ কেউ। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গানের সূত্র ধরে যে অকারণ আনন্দলীলা শঙ্খের কবিতায় ইঙ্গিত করেছি আমি, সেখানে রবীন্দ্রনাথ অনুপস্থিত। শঙ্খ তাঁর নিজের নিনাদ নিজে বাজিয়েছেন এসব কবিতায়। রবীন্দ্রনাথের ‘অকারণ’ রহস্যের অধিচেতনা কোনোভাবে দূরাগত প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে কি না, সেটা শঙ্খ জানেন। পাঠক হিসেবে আনন্দই মুখ্য আমার। তাই সেই অবান্তর প্রশ্নের মুখোমুখি হতেও চাই না।

শঙ্খ ঘোষ যে-সময়ে লেখালেখিতে বেড়ে উঠেছেন, তাদের সামনে তখন পশ্চিমা আধুনিকতা। তবু বোদলেয়ার কথিত ‘অচেনা মানুষ’ মনে হয় না তাঁকে। যতটা তিনি আধুনিক, ততটা সময়ের অনিবার্য প্রয়োজনে। আর যতটা পরিহার করেছেন আধুনিকতা, সেটা কবিতায় নাড়ীর টানের দুর্দমনীয়তা। আমার এমনটাই মনে হয়। রবার্ট ফ্রস্টের Death of a Hired Man কবিতার কয়েকটা লাইন মনে পড়ছে:

And nothing to look backward to with pride,
And nothing to look forward to with hope,
So, now and never any different.

তো আধুনিক মানুষের অবস্থা তো এমনই। অতীতের গৌরব আর ভবিষ্যতের আশা বলে কিছু নেই তার। তাই সে ‘অচেনা’। এসব আধুনিক অনুষঙ্গের কিছু অনুরণন তো শঙ্খের কবিতায় আছেই। তিনি তো বলেছেন: ‘তোমার কোনো বন্ধু নেই তোমার কোনো বৃত্তি নেই’। অথবা, ‘তোমার কোনো ভিত্তি নেই তোমার কোনো শীর্ষ নেই’। অথবা অন্য কবিতায় আরো সরাসরি বলেছেন: ‘আমার অতীত নেই, ভবিষ্যৎও নেই কোনোখানে’। ফ্রস্টের সঙ্গে এখানে তাঁর আধুনিক অনুষঙ্গের সংযোগ। এত কিছু নেই, তবে আছে কী? সেই জবাবও তিনি দেন। আছে ‘কেবল বন্ধন’ যার পরিণতি ‘কেবল দংশন’। এই দংশন নগর যন্ত্রণার ফলশ্রুতি। ‘আমারে তুই বাইন্দা রাখিস’ বলে যে-বন্ধন তিনি অটুট রাখতে চেয়েছেন, আর বিদ্রুপার্থে বলেছেন: ‘কইলকাত্তায় যামু না’, সেই কলকাতায় তাকে যেতে হয়েছে সপরিবারে। ১৯৩২ সালে চাঁদপুরে জন্মলাভ এবং বাবার চাকরি সূত্রে পাবনা থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেছেন তিনি। তখন তাঁর নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ। দেশভাগের দংশন তাঁকেও সইতে হয়েছে। জন্মস্থান ছেড়ে যাওয়ার সেই যন্ত্রণা কোনো হাহাকার তৈরি করেছিলো কি তাঁর কবিতায়? বিশেষত তিনি যখন বলেন: ‘জন্মভূমি? কোথায় জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।’ ‘বৃদ্ধা ঠাকুমার নামাবলির মতো মূঢ় দেয়ালের অসহ্য দুরবলোক্য তর্জনী’ দেখে এজন্যেই কি তার মনে হয়েছে: ‘আশা নেই আশা নেই’? কিন্তু আশাবাদ প্রকট না হলেও নৈরাশ্য তাঁর কবিতার মৌল প্রেরণা হিসেবে দেখা যায় না।

১৯৩২ সালে চাঁদপুরে জন্মলাভ এবং বাবার চাকরি সূত্রে পাবনা থেকে মেট্রিকুলেশন পাস করেছেন তিনি। তখন তাঁর নাম ছিলো চিত্তপ্রিয় ঘোষ। দেশভাগের দংশন তাঁকেও সইতে হয়েছে। জন্মস্থান ছেড়ে যাওয়ার সেই যন্ত্রণা কোনো হাহাকার তৈরি করেছিলো কি তাঁর কবিতায়? বিশেষত তিনি যখন বলেন: ‘জন্মভূমি? কোথায় জন্মভূমি খুঁজতে খুঁজতে জীবন গেল।’ ‘বৃদ্ধা ঠাকুমার নামাবলির মতো মূঢ় দেয়ালের অসহ্য দুরবলোক্য তর্জনী’ দেখে এজন্যেই কি তার মনে হয়েছে: ‘আশা নেই আশা নেই’? কিন্তু আশাবাদ প্রকট না হলেও নৈরাশ্য তাঁর কবিতার মৌল প্রেরণা হিসেবে দেখা যায় না...

নাগরিক মনোবৈকল্য বিচ্ছিন্নতার বোধে যেভাবে তাড়িত করে আধুনিক কবিকে, সেই বোধের প্রখরতা তাঁর কবিতায় নেই। কাজেই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি আধুনিকতার মানদণ্ডে শঙ্খ ঘোষের কবিতার সুরাহা নেই। আধুনিকতা যদি ‘অসম্পূর্ণ প্রকল্প’ হয় তবে শঙ্খ ঘোষের কবিতা সম্পূর্ণতার দিকে। কীভাবে সেই সম্পূর্ণতা তৈরি হয়? নিপীড়নের বিপক্ষে মানুষের দলে ভিড়ে যাওয়া। পশ্চিমা কাব্যতত্ত্বে সেই মূল্যায়ন অসম্ভব প্রায়। ভাষায় উচ্চকিত না হলেও মানুষের পক্ষে তিনি কবিতায় সোচ্চার ভূমিকা নিয়েছেন শুরু থেকে। বিখ্যাত সেই ‘যমুনাবতী’ কবিতার কথা আমরা সকলেই জানি। ১৯৫১ সালে কুচবিহারে পুলিশের গুলিতে নিহত হওয়া ষোল বছরের এক কিশোরীর জন্য মর্মবেদনায় তিনি এই কবিতা লেখেন। তিনি জানতেন,‘মায়ের কান্নায় মেয়ের রক্তের উষ্ণ হাহাকার মরে না’। আর তাই ‘যমুনা তার বাসর রচে বারুদ বুকে দিয়ে’। এই কবিতা একটা জাগ্রত দায়বোধ। কবিতার এই গণমুখী প্রণোদনাকে বুদ্ধদেব বসুর ইউরোপ শাসিত আধুনিক মন কিন্তু মেনে নিতে পারেনি। ১৯৫৩ সালে শান্তিনিকেতনের এক অনুষ্ঠানে সুভাষ মুখোপাধ্যায় স্নেহভরে সেই কবিতার কিয়দংশ পাঠ করলে ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন বুদ্ধদেব। বলেছিলেন: ‘যে-কোনো হাহাকারকেই কবিতা বলা চলে না।’ যে-হাহাকার মানুষের পক্ষে দাঁড়ায়, তা যে ‘শিল্পের জন্য শিল্প’- এই বোধ ডিঙিয়ে অত্যুঙ্গ মহত্ত্ব ছুঁয়ে যেতে পারে, আধুনিক বিচ্ছিন্ন মানুষ তা কি করে বুঝবে? কিন্তু শঙ্খ ঘোষ বুঝেছিলেন। তাই মানুষের স্বপক্ষে তার সরল অভিব্যক্তি এরকম:

এইভাবে হতে থাকে ক্রমাগত
কেউ মারে কেউ মার খায়
ভিতরে সবাই খুব স্বাভাবিক কথা বলে
জ্ঞানদান করে।

বুদ্ধদেব বসুর জ্ঞানদান গণসম্পৃক্ততার প্রশ্নে অকেজো। সেই জ্ঞানে মান্যতা নেই শঙ্খের। তাই সহজেই বলতে পারেন, ‘পুলিশ কখনো কোনো অন্যায় করে না তারা যতক্ষণ আমার পুলিশ’। আরো বলতে পারেন, ‘ভুখা মুখে ভরা গ্রাস তুলে ধরবার আগে প্রশ্ন করো তুমি কোন্ দলে’। এই যে বিদ্রূপে ক্রিটিক্যাল হওয়া, তা রাষ্ট্রতন্ত্রের পক্ষপাতদুষ্টতা, বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে। যে-কোনো সংবেদনশীল কবি এবং লেখকের পক্ষে কেবল সৌন্দর্যচেতন নিরীহ শিল্পের আরাধনা করা সম্ভব নয়। রাষ্ট্র ক্ষমতার সঙ্গে তার দ্বান্দ্বিক অবস্থান তৈরি হওয়া স্বাভাবিক। শঙ্খ ঘোষের ব্যক্তি জীবন ছিলো সেই স্বাভাবিক দ্বান্দ্বিকতার অনুগামী। কোনো কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারই তাকে টলাতে পারেনি। সশরীরে তিনি যেমন প্রতিবাদে অংশ নিয়েছেন কবিতাতেও ছড়িয়ে দিয়েছেন সেই প্রতিবাদের কব্যিক ও শৈল্পিক অনুরণন। তাই তিনি লিখেন: ‘বর্বরতা শব্দ তার সনাতন অভিধার নিত্য নতুন প্রসারণ খোঁজে।’ পশ্চিমবঙ্গের নন্দীগ্রামে ঘটে যাওয়া বর্বরতার প্রতিবাদে লিখেন: ‘আমি তো আমার শপথ রেখেছি অক্ষরে অক্ষরে/যারা প্রতিবাদী তাদের জীবন দিয়েছি নরক করে।’

একবার কর্পোরেট বাস্তবতাকে সামনে রেখে লিখেছেন ‘মুখ ঢেকে যায় বিজ্ঞাপনে’। পঞ্চায়েত ভোটের বিশৃঙ্খলার প্রতিবাদে ‘মুক্ত গণতন্ত্র’ নামক ছড়ায় এবার লিখলেন: ‘দেখ্ খুলে তোর তিন নয়ন/ রাস্তা জুড়ে খড়্গ হাতে/ দাঁড়িয়ে আছে উন্নয়ন’। আর বিজেপির এনআরসি নামক নতুন নাগরিকত্ব আইনের ধান্দাবাজির প্রতিবাদে তিনি লিখলেন:

এখনো পরীক্ষা চায় আগুনসমাজ
এ-মাটি আমারও মাটি 
সেকথা সবার সামনে 
কীভাবে প্রমাণ করবো আজ!

অশান্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির বিপক্ষে শান্ত রসের এই প্রতিবাদে যে উচ্চকিত জাগৃতি প্রচ্ছন্ন আছে, তা মহৎ অঙ্গীকার হয়ে চিরকাল প্রেরণা দেবে মানুষকে। এসব কবিতাকে ‘রাজনৈতিক কবিতা’র অভিধায় সীমিত করা অনুচিত। কেননা নিপীড়ন তথা শোষণ একটা সর্বগ্রাসী প্রবণতা নিয়ে পৃথিবীতে চিরকাল বিরাজমান। শোষিতের পক্ষে কবিও তাই সবসময়ের প্রতিনিধি। শঙ্খ ঘোষ যেখানে আত্মমগ্ন, সেখানে ইঙ্গিতময়। যেখানে গণ সম্পৃক্ত, সেখানে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপে নীরব অথবা সরব প্রতিবাদে মুখর। কিন্তু তার আত্মমগ্নতা কখনোই আত্মকেন্দ্রিকতা নয়। কেননা বিচ্ছিন্নতার আধুনিক বোধে কবিতায় কিংবা কবিতার বাইরে তিনি কখনো মানুষকে ছেড়ে যাননি। এখানে তার মহত্ত্ব।

পাদটীকা
‘আমার জন্য একটুখানি কবর খোঁড়ো সর্বসহা’। বহু আগে ‘কবর’ কবিতায় শঙ্খ ঘোষ লিখেছিলেন এ কথা। আজ মহামারী আক্রান্ত করোনাকাল ঘিরে রেখেছে পৃথিবীকে। একটা মৃত্যুবেষ্টিত জীবন পার করছি আমরা। চারদিকে কবর খোঁড়ার আকুতি। অথচ গোরস্থানে লাশ রাখার জায়গা নেই। শ্মশানে জায়গা নেই সৎকারের। যেন উল্টো করে সে কথাও ইঙ্গিত দিয়েছিলেন তিনি: ‘আগুনই কোথাও নেই— কী হবে-বা জ্বালানির খোঁজে!’ হাসপাতালেও জায়গা নেই। অক্সিজেনের অভাবে মানুষের জীবন ত্রাহি ত্রাহি। কিছুই করার নেই। ডাক্তার নার্স সবাই অসহায়। এ পরিস্থিতিতে মনে পড়ে তার ‘হাসপাতাল’ কবিতার নার্স-২-এর একটা লাইন:
‘আমরা কী করতে পারি! যার যার ঈশ্বর সহায়!’

আজ চারদিকে আমরা কি শঙ্খ ঘোষের এসব পঙক্তির প্রতিধ্বনি শুনতে পাচ্ছি না? গত ২১ এপ্রিল [২০২১] করোনা তাঁকেও নিঃশেষ করে গেলো। ‘কবর’ কবিতার শেষাংশে তিনি এপিটাফ লিখে রেখেছিলেন:

নিবেই যখন গেলাম আমি, নিবতে দিয়ো হে পৃথিবী
আমার হাড়ে পাহাড় করো জমা—
মানুষ হবার জন্য যখন যজ্ঞ হবে, আমার হাড়ে
অস্ত্রো গোড়ো, আমায় করো ক্ষমা।

তিনি কি সত্যিই নিঃশেষ হয়েছেন? নাকি এইসব পোয়েটিক প্রফেসির মাধ্যমে নতুন করে জেগে উঠছেন আমাদের মাঝে?
কবিকে শ্রদ্ধা জানাই।