ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রে দেশভাগ

 

চলচ্চিত্রে আমার আগমনের সাথে টাকার কোন সর্ম্পক নেই। বরং আমাদের ভুক্তভোগী মানুষের নিদারুণ যন্ত্রণা ও ক্লেশকে তুলে ধরতেই চলচ্চিত্রে আমার আগমন।

...আমি একজন শিল্পী নই, চলচ্চিত্রশিল্পীও নই। এটা আমার জনগণের সেবা করার মাধ্যম মাত্র। আমি সমাজবিজ্ঞানী নই, তাই আমি মনে করি না যে আমার চলচ্চিত্র মানুষজনকে বদলে দেবে। কোন চলচ্চিত্রকারই মানুষকে বদলে দিতে পারে না। মানুষের অবস্থান খুব উঁচুতে। তারা নিজেরাই নিজেদের বদলাচ্ছে। আমি কিছুই পাল্টাছি না। আমি শুধু বদলানোটা নথিবদ্ধ করছি মাত্র। চলচ্চিত্র আমার কাছে অভিব্যক্তি ব্যতীত আর কিছুই নয়। এটা মানুষের দুঃখ-কষ্ট ও ভোগান্তির ব্যাপারে রাগ প্রকাশের একটি মাধ্যম।  

ঋত্বিক কুমার ঘটক

১৯৪৭ সাল। ভারতবর্ষ ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে ভাগ হলো। ভাগ হলো বাংলা। ভাগ হলো পাঞ্জাব। ভাগ হলো ভারতবর্ষ। এই দেশভাগের পৌনে এক শতাব্দী হলো এ বছরের আগস্ট মাসে। কালের বিচারে পঁচাত্তর বছর সময়টি খুব বেশি নয়। আবার খুব কম, এমনটাও বলা যাবে না। দেশভাগের ফলাফল হিসেবে প্রথম পর্যায়ে দুটি দেশভারত ও পাকিস্তান। পরে দেশভাগের ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্বকে মিথ্যা প্রমাণ করে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম। ধর্মকে রাষ্ট্র থেকে পৃথক রাখার প্রয়োজনীয়তা ও প্রত্যয় থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। তবে বাংলাদেশ ও গোটা উপমহাদেশ কী ধর্মান্ধতার সেই নেতিবাচক প্রভাব থেকে কি বেরোতে পেড়েছে? দীর্ঘ সময়ের ব্যবধানে দেশভাগ আমাদের সামনে সে প্রশ্ন নতুন করে জাগ্রত করে। ভারত-পাকিস্তান, বাংলাদেশসহ উপমহাদেশের দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই রাজনৈতিক বাস্তবতা আজ প্রকাশ্য উপস্থিত। যা আজ আপনার-আমার জীবনের প্রতিদিনকার ঘটনা। এই অঞ্চলের মানুষের প্রতিদিনকার ঘটনা ও লড়াই।

দেশভাগ এই উপমহাদেশজুড়ে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে যায়। যার ক্ষত ও প্রভাব দৃশ্যমানরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাহিত্য, সাংস্কৃতিকসহ সকল পরিমণ্ডলে। দেশভাগের পরিসর, পরিমণ্ডল ও পাত্রপাত্রীদের বোঝার ক্ষেত্রে ঋত্বিক ঘটকের [১৯২৫-১৯৭৬] চলচ্চিত্র আমার কাছে একটি মানবিক ও সর্বজনীন দর্পণ। ঋত্বিক ঘটক বাংলা চলচ্চিত্রে প্রবাদপ্রতিম চরিত্র। ঋত্বিক ঘটক আদিতে পূর্ববঙ্গের সন্তান। সেই সাথে প্রকাশ্য ঘটকের চলচ্চিত্রের প্রতি আমার বিশেষ ভালো লাগার বিষয়টি জানাতে আমি পছন্দ করি। বিশেষত তাঁর রাজনৈতিক দার্শনিকতার জন্য। ঘটকের রাজনৈতিক দর্শন ও দেশীয় ভাবনার আঁধার, আমার আকর্ষিত হবার মূল কারণ। আর ঘটকের চলচ্চিত্র প্রয়াসের সাথে জড়িয়ে রয়েছে দেশভাগ, দেশত্যাগের এবং চল্লিশ-পঞ্চাশের এক কঠিন ইতিহাস। ঘটকের চলচ্চিত্র তাঁর জীবনসংগ্রাম ও সময়ের গভীর দাগ, ক্ষত ও সর্বোপরি তাঁর শৈল্পিক অভিব্যক্তি প্রকাশ ও বিকাশ। এ প্রবন্ধে ঋত্বিকের চোখে দেশভাগের ব্যাপ্তি ও গভীরতাকে বোঝার প্রচেষ্টা থাকবে।

শুধু বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে দুজন প্রধান ব্যক্তিত্ত্ব ভারতীয় তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন, ঘটক সেখানেই অন্যতম ও অনন্য। ঘটক সারা জীবন দেশভাগকে গভীর মানবিকতা ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখেছেন। দেশভাগকে ঋত্বিক সংস্কৃতির ভাগ হিসেবে দেখেছেন। বস্তুত ঋত্বিক সেই বিরল স্রষ্টাদের অন্যতম, যাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রতিনিয়ত আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে নতুন নতুন সব ভূখণ্ড। দেশভাগ তাঁর কাছে গভীর এক মর্মবেদনা আর যন্ত্রণার কারণ ছিল। তাই দেশভাগের মর্মযন্ত্রণা আর বামপন্থী মতাদর্শের বিশ্বাসের ছায়া তাঁর প্রতিটি ছবিতে রেখে গেছেন, যা ইতিহাসে মানবসৃষ্ট রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বিপর্যয়। আর ঋত্বিকের দেশভাগের ওপর নির্মিত ছবিগুলো সময়ের এক সামাজিক দলিল।

এমন পরিস্থিতিতে বলা যায়, ঋত্বিক ঘটক বাংলাভাগের জটিল গভীর ফাটল থেকে গড়ে ওঠা দেশজ চারণ চলচ্চিত্রকার। আমার চোখে তিনি একজন দার্শনিকও বটে। এক অর্থে চারণ ও দার্শনিক উভয়ই। তাই তাঁর চলচ্চিত্র সময়ের সম্পূর্ণ ভিন্ন স্বর, বক্তব্য আর নিজের বলার ঢং নিয়ে হাজির হয়েছেন। ঋত্বিক সাংস্কৃতিক বিভাজনকে বড় করে দেখেছেন। তাঁর এই সাংস্কৃতিক ধারণার তলদেশে বহমান রয়েছে, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান ও সাংস্কৃতিক ধারা। দেশভাগের কারণ খুঁজতে ও তার নথিকরণের জন্য দলিল হিসেবে যেন তিনি বিষয় ও উপাদানগুলো তাঁর চলচ্চিত্রে রেখে গেছেন। দেশভাগের ব্যাপারের একজন চলচ্চিত্রকার, তাঁর ব্যক্তির অবস্থান ও দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করেছেন, নথিভুক্ত করেছেন। বিষয়টিকে আমরা যেন সেভাবে দেখি।

১৯৪৭ সালে বাংলাভাগের ফলে একদা অবিভক্ত বাংলার পশ্চিম অংশ ভারতে এবং পূর্ব অংশ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। যার ফলে উভয় বাংলা থেকেই ব্যাপক হারে বাস্তুচ্যুতি ঘটে। উভয় অংশের মানুষের জীবনে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। পরিবর্তন আসে, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সর্ম্পকে। শুধু ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে রাতারাতি, হাজার বছরের সম্প্রীতি আর সহযোগিতার সামাজিক সর্ম্পক শত্রু-সম্পর্কে পরিণত হয়। নতুন এক অধ্যায় কিংবা ইতিহাসের নতুন অধ্যায়ের যেন শুরু হয়।

 

আগেও বলেছি, ঋত্বিক ঘটক পূর্ববঙ্গের সন্তান। পড়াশোনা করেছেন রাজশাহী কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহী কলেজে। আর জন্ম খোদ ঢাকায়। ১৯২৫ সালের ৪ নভেম্বর অবিভক্ত বাংলার ঢাকা জেলার বুড়িগঙ্গার তীরে বর্তমানের পুরান ঢাকায়, ২ ঋষিকেশ লেনে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁদের এই বাড়ি ঝুলনবাড়ি বলে খ্যাত ছিল। ঋত্বিক ও প্রতীতি দেবী [১৯২৫-২০২২] যমজ ভাইবোন। প্রতীতি দেবীর মেয়ে উন্নয়নকর্মী ও বর্তমানে সংরক্ষিত নারী সংসদ সদস্য আরমা দত্ত। উল্লেখ্য, ১৯৪৮ সালের ২৯ আগস্ট পূর্ববঙ্গের বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতা ও কুমিল্লার লব্ধ প্রতিষ্ঠিত উকিল ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের [১৮৮৬-১৯৭১] পুত্র সঞ্জীব দত্তের সাথে প্রতীতি দেবীর বিয়ে হয়। উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ রাতে কুমিল্লায় তাঁর বাড়ি থেকে ছোট ছেলে দিলীপকুমার দত্তসহ ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাঁদেরকে ময়নামতি সেনানিবাসে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়।

ঋত্বিকেরা ছিলেন ৯ ভাইবোন। ঋত্বিক আর প্রতীতি দেবী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। ঋত্বিকের বাবা শ্রী সুরেশচন্দ্র ঘটক [আইসিএস] ছিলেন ঢাকার ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট। কাজের কারণে তাই তাঁকে অবিভক্ত বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় থাকতে হয়েছে। তাই ঋত্বিকের শৈশব-কৈশোর কেটেছে বিভিন্ন জেলায়। তবে পূর্ববঙ্গ ছিল ঋত্বিকের আত্মার অংশ। ঋত্বিকের প্রথম সিনেমা নাগরিক। যদিও তা নাগরিক সিনেমা সময়মতো ছাড় করা যায়নি। তাঁর দ্বিতীয় সিনেমা অযান্ত্রিক। এরপর তিনি পরপর তিনটি সিনেমা করেন।

শুধু বাংলা বা ভারত নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে যে দুজন প্রধান ব্যক্তিত্ত্ব ভারতীয় তথা বিশ্ব চলচ্চিত্রকে সমৃদ্ধ করেছেন, ঘটক সেখানেই অন্যতম ও অনন্য। ঘটক সারা জীবন দেশভাগকে গভীর মানবিকতা ও রাজনৈতিক অর্থনৈতিক দৃষ্টিতে দেখেছেন। দেশভাগকে ঋত্বিক সংস্কৃতির ভাগ হিসেবে দেখেছেন। বস্তুত ঋত্বিক সেই বিরল স্রষ্টাদের অন্যতম, যাঁর সৃষ্টিকর্মে প্রতিনিয়ত আবিষ্কারের সুযোগ রয়েছে নতুন নতুন সব ভূখণ্ড। দেশভাগ তাঁর কাছে গভীর এক মর্মবেদনা আর যন্ত্রণার কারণ ছিল

সিনেমা তিনটি যথাক্রমে; মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধারসুবর্ণরেখা। সিনেমাগুলো নির্মিত হয় ১৯৬০, ১৯৬১ ও ১৯৬২ সালে। জনপ্রিয়তার বিচারে এই সিনেমা বা ছবিগুলো ছিল ঘটকের সবচেয়ে সফল ছবি। এই তিনটি ছবি, তাঁর একটি ট্রিওলজি। দেশভাগ বা বাংলাভাগ যেখানে প্রধান উপজীব্য। ঋত্বিকের দুর্ভাগ্য যে, জীবিত থাকাকালীন বাংলার মানুষ তাঁর মূল্য বোঝেনি। তাঁর জীবদ্দশায় একমাত্র মেঘে ঢাকা তারা-ই জনগণের মন জয় করতে পেরেছিল। ঋত্বিক সারা জীবন আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান, মাটিসংলগ্ন উপলব্ধি আর গভীর জীবনবোধ দ্বারা তাড়িত। যার ছায়া আর উপস্থিতি আমরা পাই তাঁর প্রতিটি চলচ্চিত্রে। এই দৃষ্টিভঙ্গির আতশি কাচে, ঋত্বিক বাংলা চলচ্চিত্রের দার্শনিক চলচ্চিত্রকার। আমার চোখে দার্শনিক ছবিওয়ালা

ঋত্বিকের মনে দেশভাগের প্রভাবের কথা বলতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় লিখেছিলেন, বাস্তবিকভাবে ঋত্বিক দেশভাগের ট্র্যাজেডির প্রতি আবেশিক ছিলেন। তিনিই এককালে পূর্ব বাংলার মানুষ ছিলেন, তাঁর শিকড়ও ছিল সেখানে। একজন পরিচালককে একই থিম নিয়ে আজীবন খুবই কম ভাবতে দেখা যায়। এর থেকে বোঝা যায়, এই বিষয়ের প্রতি তাঁর অনুভূতির গভীরতা কতখানি। পূর্ব বাংলাকে ঋত্বিক মুহূর্তের জন্য ভুলতে পারেননি।

এ বিষয়ে ঋত্বিকের ভাষ্য আরও স্পষ্ট। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর, তিনি অদ্বৈত মল্লবর্মণের [১৯১৪-১৯৫১] উপন্যাস তিতাস একটি নদীর নাম নিয়ে চলচ্চিত্র তৈরি করেন। এই ছবি তৈরির পর তাঁকে প্রশ্ন করা হয়শরণার্থীজনিত সমস্যা বারবার আপনার চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে। আপনি কি মনে করেন, বাংলাদেশে আপনার নির্মিত তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্রের সাথে এর কোথায় সরাসরি প্রাসঙ্গিকতা...। উত্তরে ঘটক বলেন, এই সমস্যা আমাকে সরাসরি প্রভাবিত করে না। তবে বৃহত্তর প্রসঙ্গে করে, নিজের অজান্তে। বাস্তবতা সম্পর্কে নিজ অনুভূতি ব্যতীত একজনের দ্বারা চলচ্চিত্র নির্মাণ সম্ভব নয়। আমি শরণার্থীজনিত সমস্যা তুলে ধরছি, আপনি যেভাবে বলেছেন সেভাবে, তবে শরণার্থীজনিত সমস্যা হিসেবে নয়। আমার কাছে দেশভাগ ছিল সম্পূর্ণ একটা সাংস্কৃতিক বিভাজন, আমি ছিলাম স্তম্ভিত। সে সময়টায় আমাদের স্বাধীনতা, আমাদের মুক্তি নিয়ে কোলাহল করা ভণ্ডদের আমি ঘৃণা করতাম। আমার সেই বাংলাকে আপনারা দেখেননি। জাতীয় মুক্তির নামে মানুষের আচরণে যে পরিবর্তন আসছিল, আমি শুধু তা-ই দেখে যাচ্ছিলাম। এবং আমি অনুভব করি, তা প্রকাশও করছিলাম। আজও আমি খুশি নই, যা কিছু আমি দেখেছি তা আমার অজ্ঞানে ও সজ্ঞানে আমার চলচ্চিত্রে প্রকাশ পায়।

ঋত্বিকের সরল এই ভাষ্য, দেশভাগ ও তাঁর চলচ্চিত্রবিষয়ক তাঁর ভাবনা স্পষ্ট। ঋত্বিকের চলচ্চিত্রযাত্রা ১৯৫১-৫২ সালে। তাঁর চলচ্চিত্রযাত্রার শুরুটা শ্রী নির্মল দের কাছ থেকে ঋত্বিক ঘটক চলচ্চিত্রটির পরিচালনার দায়ভার নেন। প্রাথমিকভাবে ছবিটির নাম ছিল বেদেনি। ঋত্বিক চিত্রনাট্য নতুন করে লিখলেন, অভিনয়শিল্পীদের মাঝে কিছু পরিবর্তন আনেন। চলচ্চিত্রটির নতুন নাম হয় অরূপ কথা। প্রথমে বোলপুর ও পরে ঘাটশিলার সুবর্ণরেখার তীরে মোট ২০ দিন শুটিং হয়। শুটিংয়ের দ্বিতীয় ভাগে সরঞ্জাম নষ্ট হওয়ার শুটিং বন্ধ হয়ে যায়, ফলে চলচ্চিত্রটি আর আলোর মুখ দেখেনি।

ঋত্বিকের দ্বিতীয় চলচ্চিত্র উদ্যোগ নাগরিক [১৯৫২-৫৩] কিন্তু প্রথম ছবি। এখানেও দুর্ভাগ্য, তাঁর জীবদ্দশায় চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায়নি। তাঁর মৃত্যুর প্রায় এক বছর পর আবিষ্কৃত হয় যে অরিজিনাল নেগেটিভটি হারিয়ে গেছে। ১৯৫১ সালে তিনি চিত্রনাট্য তৈরি করেন। ১৯৫৩ সালে তার অল্প কিছু প্রিন্ট খুঁজে পাওয়া যায়। বাকি বেশির ভাগটা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। পরে ২৫ বছর পর চলচ্চিত্রটি মুক্তি পেলেও আইনগত কারণে প্রদর্শন বন্ধ হয়ে যায়। বলাই বাহুল্য, ঋত্বিক সিনেমার প্রেমে পড়ে সিনেমায় আসেননি। সিনেমায় তাঁকে আসতেই হয়েছে। একটা তাগিদ একটা তাড়া থেকে এসেছেন। একসঙ্গে অসংখ্য মানুষকে আঘাত করতে পারবেন এমন একটা আশায়, এভাবেই তিনি এই মাধ্যমটিকে বেছে নিয়েছিলেন। সিনেমা ছিল ঋত্বিকের কাছে, তাঁর বক্তব্য প্রকাশের মাধ্যম, বক্তব্য প্রকাশের হাতিয়ার।

ঋত্বিকের প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র অযান্ত্রিক [১৯৫৭-৫৮]। এই ছবির আগে-পরে তিনি বেশ কিছু প্রামাণ্যচিত্র তৈরি করেন, তৈরি করেন পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র বাড়ি থেকে পালিয়ে [১৯৫৯]। তবে ষাটের দশকে শুরুতে ঋত্বিক তাঁর জীবনের সফল তিনিটি চলচ্চিত্র পরপর তৈরি করেন। যার কেন্দ্রীয় বিষয়বস্তু দেশভাগ। আরও সুস্পষ্টভাবে বললে বাংলাভাগ। এই প্রবন্ধে আমরা এই তিনটি ছবি নিয়েই আলোচনায় সীমিত রাখব। যে ছবিগুলোতে দেশভাগের প্রবল উপস্থিতি রয়েছে।

 

ঋত্বিক ঘটক নির্মিত ছবিগুলোর একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো, দুই বাংলার বিভক্তি ও সেই বিভক্তি নিয়ে হতাশা আর যন্ত্রণাকাতরতার কথা। দেশভাগ দুই বাংলার মানুষের জন্য ছিল এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য হঠাৎ মানুষ উপলব্ধি করল নিজের দেশে তাদের আর বসবাস করা নিরাপদ নয়। রাতারাতি ধর্ম হাজার বছর ধরে পাশাপাশি বাস করা একই জনপদে মানুষদের পরস্পরের শত্রুতে রূপান্তর করেছে। নিজের দেশ হয়ে উঠেছে অনিরাপদ। ফলে, মানুষকে বাধ্য হয়েই পূর্ব বাংলা ছেড়ে পশ্চিম বাংলায়, আবার পশ্চিম বাংলা ছেড়ে পূর্ব বাংলায় আসতে হয়েছে। একই ঘটনা ঘটেছে পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে।

দেশভাগে দুই বাংলা হয়ে ওঠে পৃথক দুই রাষ্ট্রের পৃথক দুটো অংশ। এই রাজনৈতিক মানচিত্র, জাতিসত্তা ও সাংস্কৃতিক আচার-আচরণের ওপর পর্বতসম প্রাচীর তুলল। ফল যা দাঁড়াল, এক বাংলা থেকে অন্য বাংলায় চাইলেই আর এই স্থানের অধিবাসীদের পক্ষে প্রবেশ করা সম্ভব হয় না।

বাংলার বিভক্তিতে বিপুলসংখ্যক মানুষ শিকার হয়েছেন দুঃখ, কষ্ট ও বেদনার। হারিয়েছে ভিটে-মাটি, সহয়-সম্বল। যা পরবর্তীকালে বাস্তচ্যুতির সেই দুঃখকষ্টের কথা জায়গা করে নিয়েছে আমাদের সাহিত্য ও শিল্পকলায়। তবে ১৯৪৭ সালের দেশভাগ ও উদ্বাস্তু বিষয় নিয়ে উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র পাওয়া যায় না। ঋত্বিক এ ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম। পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম বাংলায় বাধ্য হয়ে আসা মানুষের মনোযন্ত্রণা ঋত্বিক তাঁর ছবিতে গভীরভাবে তুলে এনেছেন। যা এক অর্থে তাঁর জীবনেরই গল্প। ষাট বছরের ব্যবধানে, এদঞ্চলের ভূগোল, অর্থনীতি, সংস্কৃতি, জীবন-আচরণ ও বিশ্বরাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত নানাভাবে পাল্টে গেছে। এই পরিবর্তনগুলোর মধ্যে বিশেষভাবে তিনটি পরিবর্তনের কথা বলতে হয়।

এক. ১৯৪৭ সালের পর পূর্ব বাংলায় ১৯৭১ সালে রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের পরিচয়ে নতুন রাষ্ট্রের জন্ম হয়। সেই মুক্তিসংগ্রামের সাথে ভারতবর্ষ ও বাংলার রাজনৈতিক ও সর্বাত্মক সহাযোগিতা ছিল। সেই সাথে ভূরাজনৈতিক অনুকূল কৌশলগত একটি সহযোগিতা আমরা পেয়েছিলাম। মুক্তিযোদ্ধারা ও দেশের ভেতরের সর্বস্তরের মানুষ সব ধরনের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছিলেন।

দুই. বাংলাদেশ পঞ্চাশ বছর পূর্ণ করল। এই সময়ের ব্যবধানে পৃথিবী, ভারতবর্ষ ও উপমহাদেশ ও বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিস্থিতির বড় ধরনের পরিবর্তন হয়েছে। বিশ্বজুড়ে ধর্মীয় উন্মাদনা নতুন করে ফিরে এসেছে। রাষ্ট্রের ঘাড়ে নতুন করে ধর্ম চড়ে বসেছে।

তিন. দেশভাগের পঁচাত্তর বছরের ব্যবধানে পূর্ব বাংলা বলে খ্যাত বাংলাদেশের দুবার রাষ্ট্রীয় পরিচয় পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৭১ সালে রক্তের দামে কিনেছে দেশের স্বাধীনতা। স্বাধীন দেশের পাসপোর্ট নিয়ে পৃথিবীজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে বাংলাদেশের মানুষ।

কাজেই বাস্তব এই পরিস্থিতি নিয়ে, আমাদের দেশভাগ, উদ্বাস্তু সমস্যা ও ঋত্বিক ঘটকের দেশভাগবিষয়ক চলচ্চিত্রগুলোর দিকে ফিরে তাকাতে হবে। সার্বিকভাবে ঋত্বিকের ছবিগুলোকে বিষয়ভিত্তিক চারটি ভাগে ভাগ করা যেতে পারে। ভাগগুলোকে এক এক করে সাজানো গেল।

প্রথমত, ঋত্বিকের প্রথম ধারার ছবিতে বাস্তুহারা জীবনের প্রেক্ষাপট ও মানবিক মূল্যবোধের অবলুপ্তির কথা বরাবার উঠে এসেছে। বিষয়গুলো বিশেষভাবে উঠে এসেছে তাঁর নাগরিক, মেঘে ঢাকা তারাকোমল গান্ধার ছবিতে।

দ্বিতীয়ত, ঋত্বিক তাঁর প্রথম ধারার ছবিতে মধ্যবিত্তের আত্মসম্মান জাতি ধর্মে বিশ্বাস ও বিশেষ ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও ভূমিজ আদি মিথ ও প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান তুলে এনেছেন। সুবর্ণরেখাযুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছবিতে আমরা তার দেখা পাই।

তৃতীয়ত, ঋত্বিকের তাঁর তৃতীয় ধারার ছবিতে, আমার মানুষ ছাড়াও প্রকৃতি বা অপ্রাকৃতিক বিষয়ের সাথে সর্ম্পক ও মানবিক অবক্ষয়ের চিত্র তুলে আনতে দেখি অযান্ত্রিকতিতাস একটি নদীর নাম-এ।

চতুর্থত, ঋত্বিকের তৃতীয় ধারার ছবি, বাড়ি থেকে পালিয়ে। এই ছবিতে শিশু মনস্তত্ত্বের বিশ্লেষণ ও বয়স্কদের মনোভাব মানুষের সূক্ষ্ম সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরতে চেয়েছেন।

 

ঋত্বিক ঘটক নিজের ছবি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেছেন, আমি মনে করি আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ কর্ম এই মেঘে ঢাকা তারা। শুধু এ কথা বলে থামেননি, বরং সে সাথে আরও স্পষ্ট করে বলেছিলেন—‘যেটা অন্য লোকেরা শুনে আপত্তি করবেন। আমার কিছুই বলার নেই। আমার মত আমার কাছে, অন্যের মত অন্যের কাছে।

ঋত্বিকের ছবিতে মেলোড্রামা নির্ভর গঠনরীতি দৈনন্দিন আখ্যায়িকাকে প্ররোচিত করে ইতিহাসাশ্রিত হতে। ঋত্বিকের রচনাপ্রণালির সমর্থন আসে সিনেমার স্বক্ষেত্রের বাইরে থেকে। বিষ্ণু দে, চলচ্চিত্র সমালোচক নন, তিনি মেঘে ঢাকা তারাকে একজন কবি হিসেবে বরণ করে নেন। বলাই বাহুল্য, ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রকর্মের সাধারণ সমীকরণ বয়ানান্তর্গত নয়, বরং বয়ানবহির্ভূত। মেঘে ঢাকা তারা তার অন্যতম উদাহরণ। এই চলচ্চিত্র ঋত্বিকের বয়ানরীতি লক্ষ করলেই বোঝা যায় কেন অদ্যাবধি তাঁর সৃষ্টি সিনেমার প্রথাসিদ্ধ রুচিতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া জাগায়। যা লোকপ্রিয়তা বা জনপ্রিয়তার জন্য প্রধান বাধা। তাই স্বাভাবিকভাবেই তিনি কখনোই সাধারণের মধ্যে জনপ্রিয় চলচ্চিত্রকার হয়ে ওঠেননি।

এবার ছবিগুলো নিয়ে আলোচনা শুরু করা যাক, ঋত্বিক ঘটকের মেঘে ঢাকা তারা ছবি দিয়ে। গোধূলি গগনে মেঘে ঢেকে আছে তারা এই রূপকের আঁধারে সাতচল্লিশ-উত্তর কলকাতার উদ্বাস্তু জীবনের সৃষ্টিশীল আখ্যান বা বয়ান তুলে ধরছেন। যা এক অর্থে দেশভাগ, বাংলাভাগ আর উদ্বাস্তু মানুষের জীবনসংগ্রামের দলিল ও নথি। যে সৃষ্টি সময়ের নথি আর সৃষ্টিশীলতার রসায়নে কালজয়ী। চিরন্তনী ক্ল্যাসিক। ইতিহাসের সেই ঘনঘোর দিন দেশভাগের স্মৃতি স্মরণ করিয়ে দেয় মেঘে ঢাকা তারায়। নীতা নামের মেয়েটি এই চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্র।

নীতা কি গড়পড়তা মেয়েদের থেকে খানিকটা আলাদা। পঞ্চাশ দশকের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারের বোন চরিত্রে নীতা কি তার সীমা পার হয়ে গিয়েছিল? শুধু কি বাস্তবতার কারণেই নীতা পরিবারের জন্য নিজের জীবনকে বলি দিয়েছিল? এই প্রশ্ন আমাকে প্রবলভাবে ভাবিত করে। তখন নিজের অজান্তেই আমার মনে হয়আমাদের চেতনায় সেদিন অনেক নক্ষত্রই ফুটে ওঠেনি মেঘে, কুয়াশায়, অপরিচয়ে। দিনের আলো যেন তাকে প্রকাশ্যে নিবেদন করেছে। রৌদ্রের চরাচর নীতাকে দিবসের শশীলেখা মনে করেনি, সময়ের মুখপাত্রী হিসেবে বর্ণনা করেছে। উদ্বাস্তু জীবনের বর্ণনা ও দেশভাগের সমাজবাস্তবতাকে একসময় চূড়ান্ত মনে হয়েছিল। ‘আজ মনে হয় নীতা যে শাড়ি পরেছিল তা যথার্থ দ্রৌপদীর।

ঋত্বিক মেঘে ঢাকা তারা গল্পটা সাহিত্য থেকে নিয়েছিলেন। কিন্তু চলচ্চিত্র তৈরিতে তিনি স্বাধীনতা নিয়েছেন। এ বিষয়টি বলতে গিয়ে তিনি বলেছিলেন, মূল লেখাটা পড়ে আমার জঘন্য লেগেছিল। তারপর কাটতে কাটতে গিয়ে একটা জায়গায় গিয়ে পৌঁছলাম যেখানটাতে আমি বুঝতে পারলাম যে এর মধ্য দিয়েও কিছু প্রকাশ করা যায়।’

এই ছবির কাহিনি সেই সময়কার একটি সাধারণ গল্প। একটি নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের সাধারণ এক গল্প। বৃদ্ধ পিতা-মাতা, বেকার ভাইবোনের দরিদ্র সংসারের সমস্ত দায়িত্ব নেয় পরিবারটির বড় মেয়ে নীতা। নীতা তাঁর বড় ভাই শঙ্করের ও তাঁর প্রেমিকা সনতকে প্রতিষ্ঠা করার স্বপ্ন দেখতেন। নিজের সমস্ত স্বার্থ বলি দিয়ে। সর্বগ্রাসী অভাবগ্রস্ত একটি নিম্নবিত্ত পরিবারের ত্রাণকর্তার ভূমিকা নিয়েছেন। যা তৎকালীন বাঙালি সমাজের সাধারণ ঘটনা ও প্রপঞ্চ। অর্থাৎ পরিবারের বড় ছেলে বা মেয়ের ঘাড়ে যেন এ দায়িত্ব বর্তায়। পরিবারের সকলের স্বপ্ন ও আশা পূরণের জন্য নিজে ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাওয়া এক অর্থে তো ভীষণ বোকামি। বাস্তব জীবনে নীতার মতো এমন সব নারী চরিত্রের সাথে ঋত্বিকের পরিচয় ছিল। এই চরিত্র গভীরভাবে বোঝার কারণে, ঋত্বিক নীতার উদ্দেশে শঙ্করের মুখে একটি মজার কবিতা রেখেছিলেন—‘তোমার খুকি চাঁদ ধরতে চায়, গণেশকে সে বলে গাণুশ।

এই ছবিতে আমরা দেখি, দেশভাগে আঘাতপ্রাপ্ত একটি পরিবারের বড় মেয়েটিকে ঋত্বিক বিজয়ী দেখতে চান। তাই তিনি নীতার লালিত ইচ্ছে পূরণ করেছিলেন। ছবির শেষভাগে দেখা যায়, নীতার বড় ভাই শঙ্কর গায়ক হিসেবে খ্যাতি ও সাফল্যে নিয়ে বাড়ি ফেরে। নীতার প্রাক্তন প্রেমিক সনতের অবস্থান পরিবর্তন হয়েছে, আর্থিক উন্নয়ন ঘটেছে। নীতার ছোট বোন গীতাকে সে বিয়ে করে। নীতার ক্ষয়রোগ বা যক্ষ্মা ধরা পড়ে। ক্ষয়রোগগ্রস্ত তার অন্তরাল জীবন [নিজ গৃহে পরবাসের মতো] দর্শকদের নীতার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়তে শুরু করে। বড় ভাই সাফল্য নিয়ে ফিরে আসায়, নতুন বাড়ি হয়, বড় ভাইয়ের কাছে শোনে পারিবারিক আনন্দোচ্ছলের কথা। পরিবারের একমাত্র বড় ভাই ছাড়া সবার সহানুভূতি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয় নীতা।

সব ঘটনা মিলে নীতার জীবনে ঘটে এক বিয়োগান্ত ঘটনামালা, যা দর্শকদের নীতার প্রতি সকল মনোযোগ কাড়ে। গভীর মমতা আর সহানুভূতি আরও বেশি বেড়ে যায়। ছবির শেষ অঙ্কে ঋত্বিক আমাদের সামনে পাহাড়ঘেরা সেনিট্রারিয়ামে নীতা ও শঙ্করকে হাজির করে। এখানে মুহূর্তের জন্য শিল্পী শঙ্কর যেন আবার ঋত্বিক হয়ে দেখা দেন। নীতার মুখ দিয়ে উচ্চারিত সেই বাক্যটি, ...দাদা, আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম, দাদা আমি বাঁচতে চেয়েছিলাম। ছবিতে পাহাড়ে গায়ে গায়ে বাড়ি খেয়ে ইকো সৃষ্টি করছিল। সময়ের প্রাচীরে সেই কথা বারবার আঘাত খেয়ে, আজও আমাদের মনে নাড়া দিয়ে যায়। ঋত্বিকের এই ছবি, সময় আর সম্পর্কের বহুমাত্রিক অনুচ্চারিত উপাদান নিয়ে দেশভাগের ব্যক্তি, গোষ্টী ও রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের নানা বোধ, উপলব্ধি, দুঃখ-বেদনা ও দ্রৌহের রক্তজবা হয়েনানাভাবে ছবিটিতে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। যা এখনো দেশভাগের মানবিক ও সাংস্কৃতিক বিপর্যয় বুঝতে প্রাসঙ্গিক।

ঋত্বিক তাঁর সব ছবিতেই দেশভাগের একটি প্রচ্ছন্ন ছায়া ও প্রভাব রেখে গেছেন। তাঁর বেদনা, ক্ষোভ আর দ্রোহকথা মৌলিক স্বর আর উচ্চারণে নিজের মতো করে বলেছেন। মেঘে ঢাকা তারা ছবির পর ঋত্বিক কোমল গান্ধার ছবিটি তৈরি করেন। এই ছবি সম্পর্কে ঋত্বিক লিখেছেন, ...সেখানে [অর্থাৎ কোমল গান্ধার] খেটে কিছু কাজ করা গিয়েছিল। এবং তাকে সম্পূর্ণ নস্যাৎ হতে আমি নিজের চোখে দেখেছি এই বাংলাদেশে। কোমল গান্ধার-এর মূল সুর হচ্ছে মিলনের। দুই বাংলা খণ্ড হয়ে যাওয়ায় যে অপরিসীম ব্যথা আমি পেয়েছিলাম, তাকেই আমি প্রকাশ করার চেষ্টা করেছিলাম এই কোমল গান্ধার-এ। আমি রাজনীতিক নই। আমার কারবার হচ্ছে মানুষের মন নিয়ে। আমি শুধুই ভালোবাসতে পারি। মানুষ, দেশ ও সংস্কৃতির প্রতি প্রবল অন্তর্দৃষ্টি আর সৎ ভালোবাসার নিদর্শন মেঘে ঢাকা তারার মতো অন্য সব ছবি।

কোমল গান্ধারে আমরা শুরুতেই যে মুখটাকে দেখি, তা একজন গ্রাম্য বৃদ্ধের। সে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে সরোষে বলছে, যামু ক্যান? আমার পদ্মা মায়ের কোল ছাইড়া যামু ক্যান? যা ছিল চলচ্চিত্রে ব্যবহৃত থিয়েটারের কোনো দৃশ্যের সংলাপ। সেই সাথে ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে ওপার বাংলার লক্ষ মানুষের কণ্ঠে উচ্চারিত সেই জিজ্ঞাসার প্রতিধ্বনি শোনা যায়।

এ ছবি সম্পর্কে ঋত্বিকের নিজস্ব ব্যাখ্যা শোনা যাক, কোমল গান্ধার-এর ভৃগু ও অনুসূয়ার ব্যক্তিগত ব্যাপার থেকে আরম্ভ করে একটি স্থির মতে বিশ্বাসী অভিনেত্রী সংঘের মধ্যে দিয়ে গোটা বাংলাদেশ তার সমস্ত ভালো-খারাপ নিয়ে আমার কাছে বিধৃত হয়েছিল যেভাবে, তাকেই আমি এ ছবিতে প্রকট করার চেষ্টা করেছি।

ঋত্বিকের কোমল গান্ধার ছবিতে আমরা দেখি, পদ্মার কোল ছাড়া শিকড় হারানো উদ্বাস্তু, আশাহত কিছু মানুষ মুখে রং মেখে এপার বাংলার মঞ্চ থেকে দর্শকদের সেই যন্ত্রণার কথা শোনাচ্ছেন। কোমল গান্ধারের মূলত একটি নাট্যান্দোলন, কিন্তু ছবির গল্পের বুনন গড়ে উঠেছে অতীত ও বর্তমানকে পাশাপাশি রেখে। স্বপ্ন ও নতুন করে স্বপ্ন দেখা। এই বৈপরীত্যের সন্ধিতে ভৃগু ও অনুসূয়ার অবস্থান। এই চলচ্চিত্রের কাঠামোগত কেন্দ্রবিন্দুটি মুখ্যত আমরা একটি বিশেষ স্থান দেখি। সে স্থানটির নাম পদ্মা তীরে লালগোলা। অবিভক্ত বাংলায় যা ছিল যোগচিহ্নের মতো, কোমল গান্ধারে সেখানে থমকে থেকে যাওয়া রেললাইনের বিযুক্ত রেখা। সেই সীমান্তে ভৃগু-অনুসূয়ার ভাবনা—‘ওপারটা কত কাছে তবু আমি কোনো দিন ওখানে পৌঁছাতে পারব না। বোঝা যায়, তার ভূখণ্ড পেরিয়ে হারানো সময়ের দিকে ব্যর্থ হাত বাড়ানো কিংবা ফেলে আসা অতীত-সন্ধ্যার শাঁকের আওয়াজ, মেঘের কোলে নানা রঙের খেলা, কৈশোরের সুর্যব্রতর মধ্যে বিফল স্বপ্নচারণ।

ঋত্বিক তাঁর কোমল গান্ধার-এ আরেকটি থিয়েটারের একাঙ্কিকা যুক্ত করেন, যেখানে অনুসূয়া পূর্ব বাংলার গ্রামের বধূর ভূমিকায় শহরে তার মেয়ের ওপর অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাতে গিয়ে স্বামী-সংসার হারাচ্ছে, সেখানে ঋত্বিক ছবির প্রেক্ষাপটে একটা ফ্যাক্টরির স্ট্রাকচারকে প্রতীকের মতো রেখে দেন। সেই বধূটি আমার পিদিমটা নিভ্যা গেল বলে হাহাকার হয়ে ওঠে। সব আলো নিভে যায়। ফ্যাক্টরির চেহারটা ঋত্বিক খুব প্রকট করে সাজান। কলকাতার আকাশ ধোঁয়ায় গ্রাম থেকে আসা উন্মূল মানুষের অনেকের পিদিম নিভে গেছে। ছবি ও সময়ের উপাদান হিসেবে অনুসূয়ার মায়ের ডায়েরি, ভৃগুর যন্ত্রণাময় স্মৃতি থেকে জানা যায় দেশভাগের সেই সব মুহূর্ত। একে একে চোখের সামনে এসে হাজির হয়, ভিখিরির মতো অনাহারী মানুষের মৃত্যু, স্মৃতিতে ঋত্বিকের ছবির বাইরে প্রায় একই সময়ের কিছুটা আগের প্রতিচ্ছবি দুর্ভিক্ষের দৃশ্যপট জয়নুলের চিত্রমালা ভেসে ওঠে। মনে করিয়ে দেয় মানুষের জীবন নিয়ে মানুষের জুয়া খেলার কথা।

এই ছবিতে মেঘে ঢাকা তারার নীতার শেষ দাবির স্বরে, ভৃগুর বাবার মৃত্যুকালীন জিজ্ঞাসা দেশ ও কালের প্রাচীর পার হয়ে এসে ভৃগুর মধ্যে বিঁধে থাকে—‘কী নির্মল ছন্দে জীবনটা শুরু করছিলাম, এইভাবে শেষ হয়ে যাওয়া কি উচিত? এখানেও ঋত্বিকের সেই দুই বাংলার আকুতি।

কোমল গান্ধারের পর ঋত্বিক তাঁর পরবর্তী ছবি সুবর্ণরেখা নির্মাণ করেন। এই ছবি সম্পর্কে ছবিটি মুক্তির প্রাক্কালে ঋত্বিক বলেছিলেন, ...ছবিটা এখনো মুক্তি পায়নি, কাজেই বললে শোনাবে ধৃষ্টতা। নিজেরা আপনারা দেখুন, নিজেরাই ঠিক করবেন কোনটা সত্য কোনটা মিথ্যা। আমার বক্তব্য আর বিশেষ কিছুই নেই। আপনাদের কাছে আছি। হয়তো আবার কিছু করব। হয়তো করব না। তবে আপনাদের ছেড়ে আমি নেই। আমি আপনাদেরই দাস।

ঋত্বিক তাঁর যাপিত জীবনে, স্বপ্ন দেখেছেন অবাধ্যের মতো। স্বপ্ন দেখেছেন সময়কে পেরোবার। তাঁর ভাবনা ও দৃষ্টি ছিল উভয়মুখী। অর্থাৎ সামনে ও পেছনেউভয় দিকে। তাই স্বাভাবিকভাবেই আঘাত এসেছে উভয় দিকে থেকে। যার প্রভাব আমরা ঋত্বিকের মধ্যে দেখি, আর্তি ও আঘাতের দ্বৈরথ আকারে। যার ছাপ আমরা দেখি, সুবর্ণরেখাযুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে। যদিও এই দুই ছবি তৈরির মধ্যকার ব্যবধান বা সময় ছিল বেশ দীর্ঘ। দেশভাগের মতো বিশেষ সময়ের বিধ্বংসী চেহারা সুবর্ণরেখায় অনেক স্বপ্নকে ভেঙে দিয়েছেঅন্তত দুটো প্রজন্মকে। এই ছবিতে প্রথম প্রজন্মের চরিত্রগুলো ঈশ্বর ও হরপ্রসাদ। দ্বিতীয় প্রজন্মের চরিত্রগুলো অভিরাম ও সীতা। তৃতীয় প্রজন্মের চরিত্রগুলো বিনু।

এখানেও ঋত্বিক তৃতীয় প্রজন্মে বিনুর ভবিতব্যের কথা ভেবে প্রশ্ন রেখে যাচ্ছেন। কোনো মিথ্যা প্রতিশ্রুতির ধারাবাহিকতায় বিনু তার প্রজন্ম ভবিষ্যতের দিকে যাত্রা শুরু করেছে। এক বড় স্বপ্নভঙ্গের সমাপ্তিপর্বের পর। আমরা জানি না ভবিষ্যৎ তার ও তার প্রজন্মের জন্য কী জমা রেখেছে?

ছবিতে ঋত্বিক বিনু চরিত্রে যে স্বপ্ন বুনে দেন, অর্থাৎ সুবর্ণরেখায় সীতার যে শৈশবের স্বপ্ন, আঁকাবাঁকা নদী, আর দূরে দূরে নীল নীল পাহাড়; সেইখানে বাগানে প্রজাপতিরা ঘোরে আর গান গায়। যে স্বপ্ন বিনুকে হাতছানি দেয়। যদিও সীতার সেই স্বপ্নরেখা ছোঁয়া তাঁর পক্ষে কখনো সম্ভব হয়নি।

এই ছবির একটি দৃশ্য দর্শক হিসেবে আমার চোখে আজও লেগে আছে। যেখানে আমরা দেখি একদা ধ্বংসের উৎসমূল পরিত্যক্ত মিলিটারি এয়ার বেসের ওপর যে ছোট ছেলেমেয়ে দুটি স্বপ্ন বুনতে বুনতে সময় পরিক্রমা করছিল। তারা যখন তাদের তারুণ্যে যূপকাষ্ঠ বলি হচ্ছে তখন পূর্ব প্রজন্ম থেকে পরাজিত তিনটি মানুষকে আকস্মিকভাবে সেখানে টেনে আনে। যাদের প্রত্যেকেরই স্বপ্ন ছিল নতুন জমিতে নবজীবনের। এই স্বপ্নপূরণে ছবির চরিত্রগুলোর আচরণ লক্ষণীয়; প্রথমত, আদর্শবাদী সত্যনিষ্ঠ ঈশ্বর এস্টাবলিশমেন্টের সাথে আপোস করে। হরিপ্রসাদ তার প্রতিবাদ করে। সেই স্বপ্নপূরণের পথে ঈশ্বর সীতাকে হারায় [সীতা ঈশ্বরকে বলেছিল, আমি তো তোমার মা]। এর সমান্তরালে আপোসহীন হরপ্রসাদ ভিক্ষা করতে লজ্জিত হয় না। চরম লাঞ্ছনার মুখে স্ত্রীপুত্র বিসর্জন দেয় এবং শেষ পর্যন্ত এই চূড়ান্ত উপলব্ধিতে পৌঁছায়—‘আমরা মিইটা গেছিআসল কথা কি জানো ভাইডি, ও প্রতিবাদই করো আর লেজ গুটাইয়া পালাইয়াই যাও, কিছুতেই কিছু যায় আসে না। সব লোপাট, আমরা সব নিরালম্ব, বায়ুভূত। দেশভাগের মধ্য দিয়ে, স্বাধীনতা ওপর সময়ের পায়ের মাটি সরে যাওয়া একটি জাত বা জনগোষ্ঠীর প্রকৃত অস্তিত্বের মূল ধরে টান দিয়েছে ঋত্বিক। তাই তাঁর ছবিগুলোতে দেশভাগ ও আত্মিক পূর্ণপাঠের বিষয়টি বারবার ফিরে আসে।

সাংস্কৃতিক আতশি কাচের নিচে, সে সময়, রাজনীতি, সমাজ ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক বুঝতে চেয়েছেন। সংযোগ খুঁজেছেন গভীর লোকসংস্কৃতির উপাদান ও আঁধারে। এখানেই ঋত্বিক ঘটকের সাথে ইতালির মার্কসবাদী দার্শনিক ও কমিউনিস্ট নেতা আন্তোনিও গ্রামসির সাথে আমি মিল খুঁজে পাই। উভয়ের মধ্যে ইতিহাসবোধ, ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গির একটি সমান্তরাল দার্শনিক ও সৃষ্টিশীল শক্তিশালী অবস্থা লক্ষণীয়। গ্রামসির মতো সংস্কৃতির প্রশ্নে গ্রামসি আমার আপনজন ও প্রিয় হয়ে ওঠেন। হয়ে ওঠেন আমার প্রিয় কমরেড। হয়ে ওঠেন গোপনে ও নীরবে আত্মার আত্মীয়। অগ্রজ ও প্রিয় সহোদর।

 

ঋত্বিক ঘটক ১৯৭২ সালে তিতাস একটি নদী নাম ছবিটি তৈরি করেন। এই ছবির প্রযোজক ছিলেন হাবিবুব রহমান খান। তিতাস একটি নদীর নাম তাঁর প্রথম প্রযোজিত ছবি। বয়সে তখন তিনি তরুণ। মাত্র ২৭ বছর। তিনি এই ছবির পটভূমি সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলছেন, ...এই বয়সে না বুঝেই ওই ধরনের একটা গল্প বাছাই করেছিলাম। স্বপ্ন ছিল, ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে ছবি বানাব। তিতাস একটি নদীর নাম শুরুতে পরিকল্পনায়ও ছিল না। ঋত্বিকদার সঙ্গে কথাবার্তা হলে তিনিই বললেন, তিতাস করবে। আমি বললাম, আপনি যা-ই করেন না করেন, আমি আপনাকে দিয়ে ছবি বানাতে চাই। সমস্যা নেই। তিতাসই হোক।

বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ঋত্বিক ঘটকের তিতাস একটি নদীর নাম ছবি করাটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। সভ্যতা ও নদী হাত ধরাধরি করা সম্পর্ক। আর বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ, ঋত্বিক সে কথা ভালোভাবে জানতেন।

তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসের লেখক অদ্বৈত মল্লবর্মণ ছিলেন জেলে পরিবারেরই ছেলে। জেলের ছেলে হওয়া সত্ত্বেও তিনি বিএ পাস করেছিলেন। তিনি সাংবাদিকতা করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। সাতচল্লিশ-আটচল্লিশের দিকে তিনি কলকাতার এক খালাসি পাড়ায় থাকতেন। সে সময় কলকাতার আশপাশে জেলেদের অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল। অদ্বৈত মল্লবর্মণ তিতাস একটি নদীর নাম উপন্যাসটি ট্রামে ভুলে ফেলে গিয়ে প্রথমবার হারান। দীর্ঘ পরিশ্রম করে তিনি দ্বিতীয়বার লেখাটি সমাপ্ত করেন। উপন্যাসটি প্রকাশকের কাছে ছাপতে দেবার পর যক্ষ্মায় আক্রান্ত হন। তবে শেষ পর্যন্ত তিনি বইটি দেখে যেতে পারেননি। বইটি প্রকাশিত হবার পর পর প্রচণ্ড সাড়া তোলে। ঋত্বিক বইয়ের কাহিনি পড়ে তখনই অভিভূত হয়ে যান। তখনই ঋত্বিক মনস্থির করেন, বইটি নিয়ে তিনি ছবি করবেন।

এই বই আর ছবি করার ব্যাপারে ঋত্বিক বললেন, জেলেজীবনের কাহিনি মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ও লিখেছেন পদ্মা নদীর মাঝি। সে কাহিনিও অনবদ্য। তবে অদ্বৈত মল্লবর্মণের কাহিনি তার চেয়েও বেশি সততা, বিশ্বস্ততা ও আন্তরিকতাপূর্ণ। জেলেজীবনকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় দেখেন বাবুর চোখ থেকে। আর অদ্বৈত মল্লবর্মণ দেখেছেন একবারে ভেতর থেকে। কাহিনির এই সততা ও আন্তরিকতাই আমাকে এর প্রতি আকৃষ্ট করেছে।

ছবিটি তিনি গোড়া থেকেই বাংলাদেশে করতে চেয়েছেন। তিনি বলেন, ...কোলকাতার আশেপাশে জেলে গ্রাম এবং নদীগুলোকে আমার কাছে ঠিক এ-কাহিনী চিত্রায়ণের জন্য উপযুক্ত পটভূমি বলে মনে হয়নি। তাই এতদিন ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি তিতাস একটি নদীর নাম-এর কাজে বিরত ছিলাম। আমার ইচ্ছে ছিল বাংলাদেশে এ ছবি করব। আজ সুযোগ পেয়েছি। তাই তার সদ্ব্যবহার করেছি।

ঋত্বিক ঘটক এই ছবি করার আগে নদী নিয়ে তিনি আরেকটি স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র তৈরি করেছিলেন। সেই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের নাম দুর্বার গতি পদ্মা। ঋত্বিক নদী দিয়ে পূর্ব বাংলাকে চিনেছেন। দেশভাগ ও জন্মভূমির প্রতি তাঁর সকল টান, দেশের ওপর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী দুর্বার পদ্মার মাঝে খুঁজেছেন। এ ছবি মুক্তির সময় তিনি খুবই দৃঢ়ভাবে বলেছিলেন, আমি ছাড়া তিতাস সৃষ্টি হতো না। তিতাস ছিল আমার স্বপ্ন। আমার মমতা দিয়ে এ কাহিনিকে কেউ তুলে ধরতে আগ্রহী হতেন না।

এই ছবি এক অর্থে বাংলায় নির্মিত ছবিগুলোর মধ্যে উভয় বাংলার প্রাকৃতজনের জীবন-সমাজের গভীর আন্তরিকতাপূর্ণ চিত্রায়ণ, যা আমার দৃষ্টিতে এ ছবিতে সফলভাবে উঠে আসছে। সে বিচারে ঋত্বিক বরাবর দুঃসাহসিকতার পথিকৃৎ। এই ছবিতে নদীমাতৃক বাংলাদেশের, তিতাস নদীর পাড়ের এক জেলেপল্লির মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ব্যথা ও ব্যর্থতার ছবি তুলে ধরার মাধ্যমে, এই অঞ্চলের লোকসমষ্টির ইতিহাসনিষ্ঠ গ্রামসমাজের পরিচয় ও সত্যস্পর্শী জীবনদর্শন তুলে ধরেছেন। উপমহাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে, এই ছবিকে একটি সামাজিক মানব-দলিল হিসেবে চিরকালীন ও স্থায়ী মর্যাদা ও সম্মান পাবে বলে আমার বিশ্বাস।

ঋত্বিক ঘটক তাঁর সময় ও দেশভাগকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে বিষয়গুলোর একটি আন্তরিক, আবেগময় ও সর্বোপরি বুদ্ধিবৃত্তিক ব্যাখ্যা তাঁর নিজের মতো প্রতিটি চলচ্চিত্রে করে গেছেন। সেই সাথে সময়ের আর ঘটনার মন্থনে, নতুন প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছেন তিনি নিজে এবং দর্শক হিসেবে আমরাও। তিনি পরিবর্তনের অনিবার্যতার দর্শনে আস্থাশীল। প্রশ্ন তোলাকে তিনি কর্তব্যজ্ঞান করেন। তাঁর শেষ ছবি যুক্তি তক্কো আর গপ্পো, এতে তাঁর মুখের সংলাপের আধারে তাঁর শিল্পদর্শনের সামগ্রিক রূপটি ফুটে ওঠে। যা নিশ্চয়ই আমার মতো অনেক দর্শকের কানে ও মনে দীর্ঘদিন লেগে থাকার মতো। যেমন ভাবো, ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। কিংবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমি পুড়ছি। এমন সব কথা ঋত্বিকের দার্শনিক তলটি বোঝার ও খুঁজে পাবার জন্য যথেষ্ট।

 

দেশভাগের পঁচাত্তর বছর পর, ঋত্বিক ঘটকের ছবিগুলো নতুন করে দেখার পরিপ্রেক্ষিতে, বেশ কিছু বিষয় সতুন করে ভাববার অবকাশ আছে। বিষয়গুলো দেশভাগ-পরবর্তী বাস্তবতার সাথে যুক্ত। এই পরিবর্তন অভ্যন্তরীণ ও বৈশ্বিক উভয়ভাবে ঘটেছে। এই পরিবর্তনগুলোর সাথে বিষয়গুলো ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। বিষয়গুলোর মাধ্যমে এ প্রবন্ধ শেষ করা যাক।

প্রথমত, এই লেখায় ঋত্বিকের ছবির মাধ্যম দেশভাগের তাঁর প্রতিক্রিয়া বা নথীকরণ দেখি, তা দেশভাগ নিয়ে নানা দৃষ্টিভঙ্গির একটি দৃষ্টিভঙ্গি। যা এক অর্থে একপক্ষীয়। ঋত্বিক দেশভাগের অভিজ্ঞতা পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিমবঙ্গে উদ্বাস্তু জীবনযাপনের অভিজ্ঞতা থেকে তাঁর ছবিগুলো তৈরি করেছেন। দেশভাগের এর বিপরীত অভিজ্ঞতাটিও রয়েছে।

পশ্চিমবঙ্গ থেকে যাঁরা পূর্ববঙ্গে এসেছিলেন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, খানবাহাদুর আহ্‌ছানউল্লা, রেহমান সোবহান, বদরুদ্দীন উমর, আনিসুজ্জামান, বিচারপতি হাবিবুর রহমান, কলিম শরাফী ও প্রফেসর সালাউদ্দিন আহমেদ [এই তালিকা আরও বড় হতে পারে]। এঁদের লেখা স্মৃতিকথা থেকে আমরা দেশভাগের আরেকটি চিত্র পেতে পারি। দেশভাগ নিয়ে পশ্চিমবঙ্গে যতটা কাজ হয়েছে, পূর্ববঙ্গে এ ধরনের কাজ হয়নি।

দ্বিতীয়ত, দেশভাগ পূর্ববঙ্গের আধুনিকায়নে ও নগরায়ণে ভূমিকা রেখেছে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে বিশেষ করে যাঁরা কলকাতা থেকে আসেন, তাঁরা পূর্ববঙ্গের বড় শহরগুলোতে এসে বসবাস করেন। শিক্ষা-সংস্কৃতি ও রাজনীতিতে এই অংশ আধুনিকতা ও নাগরিক রুচি তৈরিতে ভূমিকা রেখেছে। যাদের এই অংশ ছিল কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি ও ইসলামী কলেজের শিক্ষার্থী। অন্যদিকে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গে ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে একটি বড় অংশ চলে যায়। ফলে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজে বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব রেখে যায়।

তৃতীয়ত, ১৯৪৭ সালের ঠিক এক বছর পর থেকে ভাষা প্রশ্নে, শক্তিশালী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯২১ সালে ঢাকায় প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে নতুন এক মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্ম হয়। দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গে যেখানে ইংরেজদের হাতে গড়া মধ্যবিত্ত সমাজের ক্ষয়িষ্ণুতা দেখি; বিপরীতে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আসা শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর সাথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণি যুক্ত হতে থাকে। যা পরে ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসিত আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত গড়িয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীলতার ধারা ষাট ও সত্তর দশকে প্রবল হয়েছিল।

চতুর্থত, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ভাষাভিত্তিক বাঙালির স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পর, নতুন ধরনের গতিশীলতার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এগিয়েছে। বাংলাদেশ সৃষ্টির মধ্য দিয়ে বাঙালি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলাদেশে আজ দুই ধরনের মাইগ্রেশন হচ্ছে। স্থায়ী অভিবাসন ও প্রবাসী শ্রমিক হিসেবে বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাচ্ছে। বিশ্বের নানা দেশের সংস্কৃতির অভিঘাত সরাসরি এসে পড়ছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন ও সংস্কৃতির ওপর।

নব্বইয়ের দশকে সমাজতান্ত্রিক বিশ্বের পতনের মধ্য দিয়ে বিশ্ব মুক্তবাজার অর্থনীতিতে প্রবেশ করে। বিশ্বের নয়া উদারীকরণ ব্যবস্থার সাথে বাংলাদেশ ক্রমশ যুক্ত হতে থাকে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সম্পর্কের সাথে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে যুক্ত হয়ে পড়ে। গড়ে উঠছে নতুন অর্থনৈতিক মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক সহায়তাপুষ্ট বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ।

পঞ্চমত, ৯/১১ এর পর বিশ্বজুড়ে, ধর্ম প্রশ্নটি রাষ্ট্র ও রাজনীতিতে নতুন করে ফিরে এসেছে। ফলে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিশ্বসহ উপমহাদেশের রাজনীতিতে যুক্ত হয়েছে। বিশ্বের ভূরাজনীতি এশিয়াকে ঘিরে, নতুন বিশ্বব্যবস্থা আবির্ভাব অপেক্ষমাণ।

ষষ্ঠত, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক সংস্কৃতির চেয়ে অনেক বেশি অর্থনীতি ও পানিসম্পদকে ঘিরে আবর্তিত। বাংলাদেশের নদীগুলোর উৎসমুখের ওপর ভারতের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশের কৃষি ও জলবায়ুর ওপর বড় প্রভাব রেখে যাচ্ছে। সেই সাথে রয়েছে ভারতের বড়ভাইসুলভ আচরণ, যা বাংলাদেশের মানুষ কখনোই ভালো চেখে দেখে না। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের সহযোগিতাকে কৃতজ্ঞতার সাথে দেখেতবে কখনোই নিজস্ব জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে নয়।

সপ্তমত, বাংলাদেশ স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সেই সাথে ধারাবাহিকভাবে অর্থনৈতিক সামর্থ্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতেঢাকা বাঙালির সাংস্কৃতিক কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। শিল্প ও সাহিত্যসহ সকল ক্ষেত্রে।

দেশভাগ-পরবর্তী পশ্চিমবঙ্গকে এই বাস্তবতা ও পরিবর্তনগুলোকে অবশ্যই মেনে নিতে হবে। এই প্রশ্নগুলোর আলোকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, দেশভাগের প্রতিক্রিয়াকে পড়তে হবে। শুধু অতীত আশ্রয়ী না হয়ে বর্তমানের চোখ নিয়ে অতীতের দিকে আমাদের ফিরে তাকাতে হবে।

ঋত্বিক ঘটকের ইতিহাস বোধ ও ইতিহাসের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি আমার চোখে তাই বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। তিতাস একটি নদীর নাম ছবিটির মাধ্যমে, দেশভাগের সময় ডিঙিয়ে, ঋত্বিক পূর্ব বাংলার সাথে তাঁর আত্মার পূর্ণ সংযোগ ঘটালেন। এই ছবির মাধ্যমে একজন শিল্পী প্রথম আমাদের দ্রষ্টায় রূপান্তরিত হবার সুযোগ সৃষ্টি করে দেয়। জলের ঐশ্বর্য ও জলের কঙ্কালনদীমাতৃক সভ্যতার বিবরণে ঋত্বিকের গভীর প্ররোচনাকে বিবেচনায় না নিলেও আমাদের মেনে না নেবার উপায় নেই যে, এ ছবি আস্তিক্য ও ইতিহাসের বিস্তার।

মানুষের মৃত্যু হলে তবু মানব থেকে যায়। তারা ইতিহাসের মাত্রা নিজেদের মতো পুনর্বিবেচনা করবে নাএমন হতাশা কোনো শিল্পীকে মানায় না। ঋত্বিককে তো নয়ই। ঋত্বিক তাই রাত্রির তপস্যা শেষে খুঁজে পেয়েছিলেন সময়ের পরতে পরতে আত্মার রেখাচিত্র। সেখানেই ঋত্বিকের ব্যক্তিসত্তা ও বিশ্বসত্তা এক পাটাতনের ওপর দাঁড়ায়। ঋত্বিকের মুখের এক সংলাপ চিরকালীনতায় রূপ নেয়; যুক্তি তক্কো আর গপ্পোতে সেই সংলাপ—‘ভাবো, ভাবা প্র্যাকটিস করো। কিংবা বিশ্বব্রহ্মাণ্ড পুড়ছে, আমি পুড়ছি

দোহাই

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায় [২০১৪], ঋত্বিকতন্ত্র, সপ্তর্ষি প্রকাশন, কলকাতা।
ঋত্বিক কুমার ঘটক [২০১৮], চলচ্চিত্র মানুষ এবং আরো কিছু, ঋত্বিক মেমোরিয়াল ট্রাস্ট, কলকাতা।
নাদির জুনাইদ [২০১৫], বাংলা রাজনৈতিক চলচ্চিত্র, সত্যজিৎ-ঋত্বিক-মৃণালের প্রতিবাদী ছবি, বিপিআই, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সুরমা ঘটক [২০০৯], ঋত্বিক, পরিমার্জিত সংস্করণ, অনুষ্টুপ, কলকাতা।
চলচ্চিত্র ও ঋত্বিক [২০২২], ঋত্বিক ঘটক, ভাষান্তর, আকাশ বিশ্বাস, মন্তাজ, ঢাকা, বাংলাদেশ।
সাজেদুল আউয়াল [২০১২], ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্র, সমাজবাস্তবতা ও নির্মাণভাবনা, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ।
চলচ্চিত্র চর্চা [২০১৭], সম্পাদক, বিভাস মুখোপাধ্যায়, ঋত্বিক, ঘটকের সামগ্রিক মূল্যায়ন, কলকাতা।
সাজেদুল আউয়াল [২০০১], সংগ্রহ, সম্পাদনা ও ভূমিকা, ঋত্বিকমঙ্গল, বাংলাদেশে ঋত্বিকচর্চার দলিল: ১৯৭২-২০০০, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, বাংলাদেশ।