সাধু ভাষা ও অসাধু ভাষা

  

পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের দোহাই দিয়া কবি মহাত্মা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একদা বলিয়াছিলেন, গল্প আছেবিদ্যাসাগর মহাশয় বলেন উলোয় শিব গড়িতে বাঁদর হইয়া দাঁড়ায়, তেমনি বাংলার মাটির বাঁদর গড়িবার দিকে একটু বিশেষ প্রবণতা আছে লক্ষ্য শিব এবং পরিণাম বাঁদর ইহা অনেক স্থলেই দেখা যায় কথাটা বলিবা মাত্রই ঠাকুর দৃষ্টান্ত দিলেনবৈষ্ণবধর্মের: উদার প্রেমের ধর্ম বৈষ্ণব ধর্ম বাংলাদেশে দেখিতে দেখিতে কেমন হইয়া দাঁড়াইল (ঠাকুর ১৩৯১[ক]: ৩১১)বৈষ্ণবেরা হয়তো কথাটা মানিবেন না তবে আমার মানিতে বাধা নাই, বাংলা ভাষা সম্বন্ধে কথাটি খাটিবে

বাংলা গদ্য সাহিত্য গড়িয়া উঠিয়াছিল দেশের পরাধীনতার যুগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সেই ঘটনার একপ্রস্ত সারানুবাদ লিখিয়াছেন: যখন বাংলা ভাষায় গদ্য সাহিত্যের অবতারণা হল তার ভার নিলেন সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত দেশের ছেলেমেয়েদের মুখে মুখে প্রতিদিনি যে গদ্য বাণী প্রবাহিত হচ্ছে তাকে বহুদূরে রেখে সংস্কৃত সরোবর থেকে তাঁরা নালা কেটে যে ভাষার ধারা আনলেন তাকেই নাম দিলেন সাধুভাষা বাংলা গদ্য সাহিত্যিক ভাষাটা বাঙালির প্রাণের ভিতর থেকে স্বভাবের নিয়মে গড়ে ওঠেনি, এটা ফরমাসে গড়া বাঙালির রসময় রসনাকে ধিক্কার দিয়ে পণ্ডিতের লেখনী বলে উঠল গদ্য আমি সৃষ্টি করব তলব দিলে অমরকোষকে, মুগ্ধবোধকে সে হল একটা অনাসৃষ্টি (ঠাকুর ১৩৯১[খ]: ২২৮)

ঠাকুর অধিক গিয়াছেন: তার পর থেকে ক্রমাগতই চেষ্টা চলচে কি করে ভাষার ভিতরকার এই একটা বিদ্ঘুটে [অসামঞ্জস্যকে] মিলিয়ে দেওয়া যেতে পারে বিদ্যাসাগর তাকে কিছু পরিমাণে মোলায়েম করে আনলেনকিন্তু বঙ্গবাণী তবু বললেন, এহ বাহ্য তার পরে এলেন বঙ্কিম তিনি ভাষার সাধুতার চেয়ে সত্যতার প্রতি বেশি ঝোঁক দেওয়াতে তখনকার কালের পণ্ডিতেরা দুই হাত তুলে বোপদেব অমরের দোহাই পেড়েছিলেন সেই বঙ্কিমের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাও আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হয়ে এসেচেএখনকার সাহিত্যে ঠিক সে ভাষার স্রোত চলচে না (ঠাকুর ১৩৯১[খ]: ২২৮-২৯)

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ইহাকেই বলিয়াছেন বাংলা ভাষার আদিপাপ কবি স্বয়ং ওরিজিনাল সিন কথাটিই প্রয়োগ করিয়াছিলেন তর্জমাটা মাত্র আমার কি সেই আদিপাপ? কবির বক্তব্যানুযায়ী বলিতেছি কৌলীন্যের অভিমানে যে একটা হঠাৎ সাধুভাষা সর্বসাধারণের ভাষার সঙ্গে জল-চল বন্ধ করে কোণ-ঘেঁষা হয়ে বসেছিল’—তাহাই ঐ আদিপাপ কিংবা তাহার আপনাপনি পুনরাবৃত্তি (ঠাকুর ১৩৯১[খ]: ২২৯)

কিন্তু কি ক্ষতি হইয়াছিল তাহাতে? রবীন্দ্রনাথের পদানুসারে যদি বলি, সাধুভাষার শিব গড়িতে বসিয়া সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিত মহাশয়েরা প্রকৃত প্রস্তাবে বাঁদর গড়িয়াছিলেন কবির ভাষায়, একটু আগেই শুনিয়াছি, সে হল একটা অনাসৃষ্টি ইহাতে বাংলা ভাষার স্বাভাবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হইয়াছিল শুদ্ধ কি তাহাই? বিরোধও একটা বাধিয়াছিল ইহাতে সে বিরোধ সাধুতার সহিত সত্যতার

এখন অনেক পণ্ডিত দাবি করিতেছেন, যাহা হইয়াছে তাহা তো আখেরে ভালোই হইয়াছে কিন্তু তাহারা এখনও কবুল করেন নাই, এই পর্যন্ত বাংলা ভাষা যাহা দাঁড়াইয়াছে তাহা সাধুতার অছিলায় হয় নাই, হইয়াছে সত্যতার দায়ে বাংলা ভাষার প্রকাশক্ষমতা যদি বাড়িয়াই থাকে তো তাহার কারণ সত্যতার জয়পতাকা কাঁধে লইয়া যাঁহারা বিদ্রোহে নামিতে কুণ্ঠা করেন নাই তাঁহাদের দৌলতে

সংস্কৃত ভাষায় মহামহোপাধ্যায় না হইলে বাংলা ভাষায় কলম ধরা ধৃষ্টতা’—একদিন ইহাই ছিল পণ্ডিতমহাশয়দের রায় এই রায়ের বিরুদ্ধে আলালের ঘরে দুলাল প্রভৃতির মতো বইরবীন্দ্রনাথের ভাষায়—‘বিদ্রোহের শাঁখ বাজাইয়াও সফল হয় নাই (ঠাকুর ১৩৯১: ৬) কিছু পরিমাণে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আর বেশি পরিমাণে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা গদ্য সাহিত্যের আদিপাপ স্খালন করিয়া ফল পাইয়াছিলেন শেষ পর্যন্ত দেশের ভাষাযাহাকে রবীন্দ্রনাথ গৌরবযুক্ত প্রাকৃত বাংলা নামেই আবাহন করিতেনজয়ী হইলআর সেই জয়ের জোরে, অল্প অল্প করিয়া সাধু ও প্রাকৃতের পংক্তিভেদ ভাঙ্গিয়া দেওয়ার কারণে, একদিন স্বয়ং বঙ্কিমচন্দ্রের দুর্গেশনন্দিনীর ভাষাওঠাকুরের কথায়—‘আজ প্রায় মরা গাঙের ভাষা হইয়া আসিয়াছে

বাংলা ভাষার কথায় ও লেখায় সামঞ্জস্য না থাকার দুঃখকে আরেক জায়গায় রবীন্দ্রনাথ বলিয়াছেন মস্ত একটা দেনা কবির ধারণা, ইহা ব্যবসায়ের স্বাভাবিক প্রণালী নহে তিনি লিখিয়াছিলেন, সেই দেনাটা খোলসা করিয়া দিয়া স্বাধীন হইয়া উঠিবার জন্যই তার চেষ্টা (ঠাকুর ১৩৯১: ৪) স্বাধীন হইবার উঠিবার চেষ্টা মানেতাঁহারই অননুকরণীয় বাক্যে—‘সংস্কৃত ভাষার বাধা ভেদ করিয়া, নিজের যথার্থ আকৃতি ও প্রকৃতি প্রকাশ করিবার জন্য যুঝিয়া আসা (ঠাকুর ১৩৯১: ৪)

এই যুঝিবার অর্থ ভুল করিলে চলবে না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখিয়াছেন, আসল কথা, সংস্কৃত ভাষা যে অংশে বাংলা ভাষার সহায় সে-অংশে তাহাকে লইতে হইবে, যে অংশে বোঝা সে-অংশে তাহাকে ত্যাগ করিতে হইবে (ঠাকুর ১৩৯১: ৭)

শুদ্ধ বঙ্কিমের কেন, খোদ রবীন্দ্রনাথেরও হাত পড়িয়াছে বলিয়াই বাংলা বইয়ের ভাষা কিছু পরিমাণে হইলেও দেশের ভাষার ঠাট গ্রহণ করিয়াছে বাংলা ও সংস্কৃত ভাষার সত্য সীমানা পাকা হইতে শুরু করিয়াছে কিন্তু বাংলা কথায় আর লেখায় কিছু সামঞ্জস্য ঘটিয়াছিল বাংলার সাহিত্য-ভাষা সংস্কৃতের গরাদের ভিতর দিয়া চল্তি ভাষার দিকে মাঝে মাঝে মুখ বাড়াইতে শুরু করিয়াছিল বলিয়া এই ঘটনার নাম রবীন্দ্রনাথ রাখিয়াছিলেন ভাষার স্বভাব’—‘স্বভাব আপনি উভয়ের ভেদ ঘুচাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে আয়োজন করিতেছিল বিদ্রোহের শাঁখ এই স্বভাবের সহিত মিত্রতার সম্বন্ধে জড়িত ছিল তাহাতে সংশয় নাই আমরা ইহাকে ইতিহাস বলিতেই অভ্যস্ত ভাষার স্বভাব বলিতে যাহা বোঝায় তাহাই ইতিহাস এই জন্যই কোন কোন ভাষা মরিয়া যায় নতুন নতুন ভাষা জাগিয়া উঠে

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভরসা এতগুলি কথা পাড়িলাম, কারণ হালে বাংলাদেশে একদল মানুষ বিশেষ ছদ্মনামে সংস্কৃত বাংলা ফিরাইয়া আনিবার যুদ্ধ শুরু করিয়াছেন অধিক কি, তাঁহারা এই বাংলার নাম রাখিয়াছেন প্রমিত ভাষা এখানে আরো হইয়াছে, এই অসাধু ক্রিয়ায় লিপ্ত হইয়া তাঁহারা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নামও ভাঙ্গাইতেছেন অথচ ইঁহাদেরই কোন কোন পূর্বপুরুষ সম্পর্কে স্বয়ং ঠাকুরই জানাইয়াছিলেন, ইহারা যুগপদ আইনকর্তা এবং পুলিশদেবতাও বটেন সাধু ইহাদিগ হইতে সাবধান!

ঠাকুরের জবানে শুনি, আমি যে কথাটা বলিতেছিলাম সে এইযখন লেখার ভাষার সঙ্গে মুখের ভাষার অসামঞ্জস্য থাকে তখন স্বভাবের নিয়ম অনুসারেই এই দুই ভাষার মধ্যে কেবলি সামঞ্জস্যের চেষ্টা চলিতে থাকে ইংরেজি গদ্য সাহিত্যের প্রথম আরম্ভে অনেক দিন হইতেই এই চেষ্টা চলিতেছিল আজ তার কথায় লেখায় সামঞ্জস্য ঘটিয়াছে বলিয়া উভয়ে একটা সাম্যদশায় আসিয়াছে আমাদের ভাষায় এই অসামঞ্জস্য প্রবল সুতরাং স্বভাব আপনি উভয়ের ভেদ ঘুচাইবার জন্য ভিতরে ভিতরে আয়োজন করিতেছিল এমন সময় হঠাৎ আইনকর্তার প্রাদুর্ভাব হইল তাঁরা বলিলেন লেখার ভাষা আজ যেখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে ইহার বেশি আর তার নড়িবার হুকুম নাই (ঠাকুর ১৩৯১: ৯)

লোকে আইনকর্তা হইতে চাহে কেন? কারণ তাহারা জানে, আইনের জোর কেবল যুক্তির জোর নয় পুলিসেরও জোর (ঠাকুর ১৩৯১[গ]: ২৭৯-৮০) ইহারা রাষ্ট্রের ছায়ায় (যথা বাংলা একাডেমি প্রভৃতির নামে) কিংবা জাতীয় সমাজের খানার টেবিলে (অর্থাৎ দৈনিক পত্রিকা আর টেলিভিশনে) বসিয়া পুরাতন আইন নতুন করিয়া জারি করিতেছেন সংস্কৃত ভাষা ভালো করে জানা না থাকলে বাংলা ভাষা ব্যবহারের যোগ্যতা থাকবেই না রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রায় দিয়াছিলেন, ভাষাকে এই অস্বাভাবিক অত্যাচারে বাধ্য করা পাণ্ডিত্যাভিমানী বাঙালির এক নতুন কীর্তি কবির কথায়, একেই বলে ভূতের বোঝা বওয়া (ঠাকুর ১৩৯১[গ]: ২৮১)

এতকাল ধরিয়া সংস্কৃত ব্যাকরণের সাহায্য না লইয়াও যে বহু কোটি বাঙালি প্রতিদিন মাতৃভাষা ব্যবহার করিয়া আসিতেছেন, এতকাল পরে আজ তাহাদের ভাষাই যখন বাংলা সাহিত্যে প্রকাশের অধিকার পাইয়াছে, নতুন বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বলিয়া যখন তাহাদের ভাষার অভিষেক হইয়াছে, তখন পুরাতন সংস্কৃতওয়ালার ভূতের বোঝা বহন করিয়া কিছু প্রতিক্রিয়াশীল মানুষ নতুন করিয়া প্রমিত ভাষা প্রচার করিতেছেন

বিসমিল্লাহ্য় গলদ বলিয়া একটা কথা বাংলায় চালু আছেখোদ প্রমিত কথাটির কথাই ধরা যাক আমরা জানি, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দেশের ভাষাকে প্রাকৃত বাংলা নামই দিয়াছিলেন আর প্রমথ চৌধুরীর কল্যাণে চলিত ভাষা নামেও ইহা আজ অবধি চলিতেছে এখন ইহাকে প্রমিত বলিবার বা নতুন করিয়া চালু করিবার উদ্দেশ্য কি? প্রশ্ন করা নিশ্চয়ই অসংগত নহে প্রমিত শব্দটিই কি একরকম অচলিত, অপ্রাকৃত শব্দ নহে? ফরহাদ মজহার বলিয়াছেন, ‘“প্রমিত ভাষাএই পণ্ডিতী নামকরণের মধ্যেও বোঝা যায় প্রমিত ভাষা ধারণা একটা রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল ধারণা (মজহার ১৪১৪: ৫১)

প্রতিক্রিয়াশীল কেন? কেননামজহারের কথায়—‘প্রাকৃত ভাষা অভিমুখী রাখার যে অসাধারণ গণতান্ত্রিক চিন্তা রবীন্দ্রনাথের মধ্যে ছিল, প্রমিত ভাষাওয়ালারা সেই অভিমুখকে ভোঁতা করে দিতে চাইছে মজার বিষয়, প্রমিত ভাষাওয়ালারা পুচ্ছ নড়াইতেছেন পুরানা সেই কবির কথায় ভাষাকে সকলের কাছে বোধগম্য অর্থাৎ গণতান্ত্রিক করিবার ছুতা তুলিয়াই

সকলের কাছে বোধগম্য করিবার আরেক প্রস্ত উদাহরণ সুশীল সমাজ প্রমিত ভাষার সর্বপ্রধান কীর্তি বোধ হয় ইহাই ইহাতে প্রমাণিত হয় প্রমিত ভাষার দৌড় এই পর্যন্তই ইংরেজি সিবিল শব্দে অনেক কথা বুঝাইতে পারে সোসাইটি পদের আগে বিশেষণস্বরূপ বসিয়া তাহা প্রমিত ভাষাওয়ালাদের বিভীষিকা হইয়াছে

আইনের জগতে সিবিল যখন কার্যবিধির আগে বসে তখন অর্থ দেওয়ানী যখন খোদ আইনের সঙ্গে বসে তখন অর্থ জাতীয় সিবিল ল মানে জাতীয় আইন সোসাইটির সঙ্গেও একই অর্থ হইবে সিবিল সোসাইটি অর্থ জাতীয় সমাজ অথচ তাহারা পদটির সম্ভাব্য সবচেয়ে অপকৃষ্ট অর্থটাই করিলেন সিবিল সোসাইটির মানে করিলেন সুশীল সমাজ অথচ জাতীয় সমাজ বলিলে অর্থও জমিত, বাংলাও কমিত না প্রমিত বাংলার এই দশা হইল কি করিয়া!

আমার কঠিন বিদ্যা নাই সত্য, কিন্তু সহজবুদ্ধিও নাস্তি এ কথা তো আর বলিতে পারিব না বাংলা লিখিয়া উদরান্ন যোগাই আর বাংলার আকাশ দেখিয়া চোখের খিদা মিটাইঅর্থাৎ প্রাণ আর মনের দায় আছেবলিয়াই এই প্রমিত ভাষাওয়ালাদের হাতে ভাষার হালজবানের সর্বস্বছাড়িয়া দিব এমন সাহস পাইতেছি না

 

প্রমিতওয়ালারা বলিয়া থাকেন বাঙালি জাতির মধ্যে ঐক্যবিধানের জন্যই তাহারা প্রমিত ভাষা সৃষ্টি করিতে চাহেন আমরা বলিব ইহা নতুন একটা অনাসৃষ্টির নামান্তর অথবা তাহারা হয়তো আসলে জানেনই না কিবা তৈল কিবা পাত্র! রবীন্দ্রনাথ শেষ বয়সে১৯৩৮ সনের দিকেলিখিলেন, এতকালআমাদের যে বাঙালি বলা হয়েছে তার সংজ্ঞা হচ্ছে, আমরা বাংলা বলে থাকি (ঠাকুর ১৩৭৫: ৩৮) খোদ রবীন্দ্রনাথ জানাইয়াছেন বাংলার সমস্ত প্রদেশেই বাংলা ভাষার ঐক্য আছে তবে কি যেন নাই! নাই সাম্য অনেকটা ঐক্য থাকিলেও সাম্য নাই থাকিতেও পারে না সকল দেশেরই কথিত ভাষায় প্রাদেশিক ব্যবহারের ভেদ আছে

ঐক্য আর সাম্য যে এক কথা নহেএকটার সহিত অন্যটা গুলাইয়া ফেলার যে ইতিহাস আছেতাহা আমরা ভুলিব কি করিয়া? ফরাশিদের বিপ্লবে ঐক্য ও সাম্যের সহিত আরও একটি কথা উঠিয়াছিলস্বাধীনতা তাহার অন্তর্গত তর্জমা হইবে সৃষ্টি’—সৃষ্টি স্বাধীনতার স্বাদ বটে তাহা নহে তো কি! আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কথাটা তো একদম অর্থহীন নহে

একটু আগেই দেখিলাম, সৃষ্টির কি বারোটাই না বাজাইয়াছিলেন গড় উইলিয়মের সংস্কৃতজ্ঞ পণ্ডিতবর্গ সেই অনাসৃষ্টির বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জয়পতাকা হাতেই বাংলা ভাষার ঐক্য আসিয়াছে তথাকথিত প্রমিত ভাষা সেই ঐক্যের গোড়ায় নতুন আঘাত ছাড়া আর কিছু হইতে পারে কি! বাংলা ভাষা যখন হারাইয়া যাওয়া ঐতিহাসিক খাতেই আবার ফিরিয়া আসিতেছে তখন তাহাতে নতুন বিভেদ সৃষ্টির ঘোঁট পাকাইতেছে এই প্রমিত ভাষা আমার কথা এই, প্রতিদিনের যে ভাষার খাতে আমাদের জীবনস্রোত বহিতে থাকে, সাহিত্য আপন বিশিষ্টতার অভিমানে তাহা হইতে যত দূরে পড়ে ততই তাহা কৃত্রিম হইয়া উঠে’—ইহা রবীন্দ্রনাথেরই কথা প্রমিত ভাষায় প্রাণের খোরাক নাই সেই প্রাণের খোরাক কোথায়? খোরাক সাধারণের ভাষার মধ্যে, সেখানে বিশ্বের প্রাণ আপনাকে মুহূর্তে প্রকাশ করিতেছে

আমাদের ভাষাকে আরো একবার কৃত্রিমতার দিকে ঝোঁকাইবার কালবৈরী চেষ্টাটা রুখিতে হইবে এই কাজ কে করিবে? যাঁহাদের সাহস আছে আর মাতৃভাষার দরদ আছে তাঁহারাই এই কাজ করিবেন

প্রমিতওয়ালারা বাংলা ভাষার কি ক্ষতিটা যে করিতেছেন তাহা হয়তো এখনও আমরা ঠিকমতো ধরিতে পারি নাই একটা উদাহরণযোগে বলি রবীন্দ্রনাথের দোহাই দিয়া তাহারা বলেন, কলকাতা শহরের নিকটবর্তী চারদিকের ভাষা স্বভাবতই বাংলাদেশের সকলদেশী ভাষা বলে গণ্য হয়েছে (ঠাকুর ১৩৭৫: ৪৯) ভালো কথা রবীন্দ্রনাথ বলেন, এই এক ভাষার সর্বজনীনতা বাংলাদেশের কল্যাণের বিষয় বলেই মনে করা উচিত (ঠাকুর ১৩৭৫: ৪৯) তাহা সত্ত্বেও কবি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ভাষার বাঁক পরিবর্তন স্বীকার করিয়া বলিলেন, এই ভাষায় ক্রমে পূর্ববঙ্গেরও হাত পড়তে আরম্ভ হয়েছে

এই কথাটি তাঁহার জীবনসায়াহ্ন বা অন্তিমকালের তিনি উদাহরণস্বরূপে বলিয়াছেন তাঁহার আপনকারঅর্থাৎ বাংলাদেশের দক্ষিণের লোকেরাএকসময় সাথে শব্দটা কবিতায় ছাড়া সাহিত্যে বা মুখের আলাপে ব্যবহার করিতেন না, বলিতেন, সঙ্গে ঠাকুর স্বীকার করিয়া লইলেন, কিন্তু দেখা যাচ্ছে, কানে যেমনি লাগুক, সঙ্গে কথাটা সাথের কাছে হার মেনে আসছে (ঠাকুর ১৩৭৫: ৪৯) ঠাকুরের কথায়, ভাষা সবসময়ে যুক্তি মানে না আর এতদিন পরও ঢাকার প্রমিত ভাষাওয়ালাগণ রায় দিতেছেন সাথে লেখা চলিবে না, সঙ্গে লিখিতে হইবে

জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদেরশাসনামলে বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ নাম দান করিয়া একটি চটি বহি বাংলা একাডেমি প্রকাশ করিয়াছিলেন সেনাপতি মহোদয়েরস্বৈরশাসনাধীন নানান কীর্তির মধ্যে নিঃসন্দেহে ইহাও অন্তর্ভুক্ত থাকিবে সেদিন১৯৮৮ সালেএই বইয়ের লেখকরাই দাবি করিয়াছিলেন খাঁটি গরুর দুধ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী লেখা যাইবে নালিখিতে হইবে গরুর খাঁটি দুধ স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী (লাহিড়ী গয়রহ ১৯৮৮: ৭৮) রবীন্দ্রনাথ যাহাকে বলিতেন চলিত ভাষার ঠাট, দেখা যাইতেছে ইঁহারা তাহার সম্পর্কেও ষোল আনা নাদানবিলকুল অনবহিত, বেওয়াকেবহাল

শুদ্ধ কি তাহাই? ইঁহারাই বলেন সৃজন শব্দটি জারজ, ইতিমধ্যে লেখা ভুল, ইতি আদি ইঁহাদের উচিত হয় নতুন করিয়া রবীন্দ্রনাথ পড়িতে বসা নতুবা তাঁহার নামাবলী আওড়ানো বন্ধ করা ইঁহাদের কথা ভাবিয়াই হয়তো ঠাকুর ঈষৎ হাস্য-পরিহাস করিয়াছিলেন: অনেক পণ্ডিত ইতিমধ্যে কথাটা চালিয়ে এসেছেন, ইতিমধ্যে কথাটার ওকালতি উপলক্ষে আইনের বই ঘাঁটবার প্রয়োজন দেখি নেঅর্থাৎ এখন ওই ইতিমধ্যে শব্দটার ব্যবহার সম্বন্ধে দায়িত্ব বিচারের দিন আমাদের হাত থেকে চলে গেছে (ঠাকুর ১৩৯১[গ]: ২৭৬)

কথা এখানে ইচ্ছা করিলে হয়তো আরো একটু বাড়াইতে পারিতাম কিন্তু তাহাতে প্রমিত ভাষাওয়ালাদের সুখের বড়াই বাড়িয়া যাইবে তাহার পরও শুদ্ধ এইটুকু না বলিলে নহে তথাকথিত প্রমিত ভাষা নিতান্ত অনাসৃষ্টি নহে, অসাধু ভাষাও বটে ঠাকুর হইতে আবার ধার লইয়া বলিতেছি: ভাষাকে দুই মুখো করে তার দুই বাণী বাঁচিয়ে চলার চেষ্টাকে অসাধু বলাই উচিত (ঠাকুর ১৩৭৫: ৪৫)

এই অসাধুতার মূলে কি? জায়গা থাকিলে বিস্তারিত বলিতাম অদ্য শুদ্ধ এইটুকুই বলিব—‘[মূলে] আছে এক প্রকারের অহংকার ঐ অহংকার অসাধুতা আকারে দেখা দিয়াছে আমাদের দেশে নহিলে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা কেন জাতীয় সমাজের (অর্থাৎ সিবিল সোসাইটির) ভাষা হইতেছে না?

বাঙালির শিক্ষা বাংলা ভাষার যোগেই হওয়া উচিত’—বলিলে বিস্তর শিক্ষিত বাঙালি কেন আজো মুষ্টি উত্তোলন করিয়া ছুটিয়া আসেন? আজ রবীন্দ্রবাক্যে রবীন্দ্রপূজা করিয়াই আমি নিরুত্তর হইব কলকাতার বাংলাই বাংলা ভাষার স্থায়ী ঐক্যবিধান করিবেএমতো আশা রবীন্দ্রনাথও করিয়াছিলেনকথা তো মিথ্যা নহে কিন্তু কলকাতা পর্যন্ত ইতিহাস, তাহার পর আর ইতিহাস নাই’—এই মতো বাক্যে হয়তো স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও সায় দিবেন না

আমার অনুমানের ভিত্তি খোদ রবীন্দ্রনাথেরই ইশারা একসময় তিনিও সাধু ভাষায় হাত মকশো করিয়াছিলেন কালের প্রহারে একদিন তাঁহারও মতি চুরমার হইয়াছিলএকথা তিনি বেহতর জানিতেন প্রমথ চৌধুরী সম্পাদিত সবুজপত্রের ভাষা লইয়া ঠাকুর নিজেই কবুল করিয়াছেন: বহুকাল পূর্বে তাঁর এই মত যখন আমার কানে উঠিয়াছিল, আমার একটুও ভালো লাগে নাই এমনকি রাগ করিয়াছিলাম নূতন মতকে পুরাতন সংস্কার অহংকার বলিয়া তাড়া করিয়া আসে, কিন্তু অহংকার যে পুরাতন সংস্কারের পক্ষেই প্রবল এ কথা বুঝিতে সময় লাগে (ঠাকুর ১৩৯১: ২)

লাগে নিশ্চয়ই সময়ে সময়ে এই বিষয়েঐক্য, সাম্য আর সৃষ্টি লইয়াহয়তো আরও কথা অন্য কোনদিন অন্য কোথায়ও বলিব যে ভাষা সৃষ্টিসুখের উল্লাস হারাইয়া বসে সে ভাষা মৃত্যুবরণ করে ইতিহাসে নজিরের অভাব নাই

২৬ অক্টোবর ২০২১

 

[এই লেখাটির সংক্ষিপ্ত সংস্করণ প্রথম আলো, ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৮ সংখ্যায় ছাপা হইয়াছিল বর্তমান সংস্করণে লেখাটি আদ্যোপান্ত সংশোধিত, পরিমার্জিত ও খানিক পরিবর্ধিত করা হইয়াছে]

 

দোহাই

১. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘ভাষার কথা’, বাংলা শব্দতত্ত্ব, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৯১), পৃ. ১-১৩।
২. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বাংলাভাষা ও বাঙালি চরিত্র: ১,’ বাংলা শব্দতত্ত্ব, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা, বিশ্বভারতী, ১৩৯১ক), পৃ. ৩১১-৩১৫।
৩. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বাংলা কথ্যভাষা,’ বাংলা শব্দতত্ত্ব, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৯১খ), পৃ. ২২৩-২৩০।
৪. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ‘বানান বিধি,’ বাংলা শব্দতত্ত্ব, ৩য় সংস্করণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৯১গ), পৃ. ২৭৫-২৮৫।
৫. রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বাংলাভাষা পরিচয়, পুনর্মুদ্রণ (কলিকাতা: বিশ্বভারতী, ১৩৭৫)।
৬. ফরহাদ মজহার, ‘বাংলা ভাষার “নিত্য প্রকৃতি” এবং তথাকথিত “প্রমিত ভাষা”, রক্তের দাগ মুছে রবীন্দ্রপাঠ (ঢাকা: আগামী প্রকাশনী, ১৪১৪), পৃ. ৪৮-৫৪।
৭. শিবপ্রসন্ন লাহিড়ী ও অন্যান্য, বাংলা ভাষার প্রয়োগ ও অপপ্রয়োগ (ঢাকা: বাংলা একাডেমী, ১৯৮৮)।