বন্ডু সিক্রেট সোসাইটির বৃত্তান্ত

বেশ কিছুক্ষণ হলো বোর্ডিং-পাস হাতে বসে আছি ফ্রিটাউন বিমানবন্দরের ডিপারচার লাউঞ্জে। আমার ফ্লাইট ডিলে হয়েছে। গেল বছর তিনেক আমি সিয়েরা লেওনের রাজধানী ফ্রিটাউনে ইবোলা রিকভারি প্রোগ্রামে কাজ করেছি। আজ এদেশে আমার বসবাসের মেয়াদ শেষ হয়েছে। তাই এয়ারপোর্টে এসেছি ভিন্ন একটি দেশের দিকে ফ্লাই করতে। এয়ারপোর্টের লাউঞ্জে বসে অপেক্ষা করতে করতে খেয়াল হয়, পেসেঞ্জারদের মধ্যে বেশ ক’জন চেনা মুখ। আমি তাদের দিকে তাকাতেই সিলভাসটার ওডেকার আমার দিকে তাকিয়ে হাত নাড়েন। মানুষটি দর্শনে ঘোরতর কৃষ্ণাঙ্গ, তবে তাঁর মস্তিষ্কটি কাজ করে ইংরেজদের কায়দায়। কারণ ঔপনিবেশিক আমলে তাঁর পিতামহ ছিলেন সিয়েরা লেওনের কাবালা ডিসট্রিক্টের ডিসি। সিলভাসটার আংশিকভাবে বড়ো হয়েছেন বিলাতে। কিন্তু প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে ফিরে এসেছেন তার মেন্ডি গোত্রের কৃষ্ণাঙ্গ পিতামহীর স্বদেশ সিয়েরা লেওনে। পেশায় ব্যবসায়ী, ফ্রিটাউনের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য ইলেকট্রিক জেনারেটার ও এয়ারকন্ডিশনারের সরবরাহকারী ইনি। ইবোলাতঙ্কের দুর্বিষহ দিনগুলোতে আমি তাঁর কোম্পানি থেকে অনেক জেনারেটর কিনেছিলাম। আমার দায়িত্ব ছিল ইবোলা সংক্রমণের সন্দেহে রোগীদের ধরে নিয়ে মেডিকেলি মূল্যায়ন করার জন্য যে হোল্ডিং সেন্টারে রাখা হতো, ওখানে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা। কোনো কোনো হোল্ডিং সেন্টার ছিল সাময়িকভাবে তৈরি করা ত্রিপল ও পলিথিন খাটানো বৃহৎ ছাউনিবিশেষ। প্রচণ্ড গরমে রোগীদের নাভিশ্বাস উঠত। সিলভাসটারের সহায়তায় আমি হোল্ডিং সেন্টারগুলোতে জেনারেটর ও ফ্যানের ব্যবস্থা করতে পেরেছিলাম।

সিলভাসটার লাউঞ্জে অপেক্ষমান একজন পেসেঞ্জারের সঙ্গে কথা বলছেন, আর সুযোগ পেলেই আমার দিকে তাকিয়ে হাসছেন। ব্যবসায়িক সূত্রে সম্পর্ক হলেও মানুষটির সঙ্গে আমার জানপহচান দোস্তি হতে দেরি হয়নি। নেশায় ইনি মিউজিশিয়ান, পিয়ানো বাজানোর ধাত আছে। ইবোলার দুর্বিপাকে ফ্রিটাউনের তাবৎ বার ও রোস্তোরাঁ বন্ধ হয়ে যায়, তাতে লাইভ গান করনেওয়ালা শিল্পীরা সব বেকার হয়ে পড়েছিল। তখন সিলভাসটার তাঁর বিরাট আকারের বাড়িটিতে মিউজিকের মজমা করতে শুরু করেন। শনিবারের সন্ধ্যায় সঙ্গীতশিল্পীরা জড়ো হতো ওখানে। তাঁর পরিচারিকা সরবরাহ করত বিয়ার ও মুড়মুড়ে করে ভাজা কেচকি মাছ বা কাঁচকলা। বাদকরা গিটার অথবা মারিমবায় পিড়িং পিড়িং করলে তিনি তাতে সংগত করতেন পিয়ানো। তাঁর ড্রয়িংরুমের সেলফে রাখা, ১৯২০ সালে বিলাতে মুদ্রিত হওয়া শেক্সপিয়ারের মরোক্ক লেদারে বাঁধানো খণ্ডগুলো দেখে আমি ভারি ইমপ্রেসড্ হয়েছিলাম। বাতচিতে জেনেছিলাম যে, পুস্তকগুলো তিনি কাবালায় ডিসি হিসাবে এক জামানায় কর্মরত শ্বেতাঙ্গ দাদা মশাইয়ের কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছেন। মানুষটি কথায়বার্তায় হামেশা শেক্সপিয়ার থেকে উদ্ধৃতি দিতে ভালোবাসেন। ইবোলার কারণে কর্মচ্যুত গায়ক-বাদকদের হরদম উৎসাহ দিয়ে সরাসরি শেক্সপিয়ার থেকে কোট করতেন, ‘ইফ মিউজিক বি দ্য ফুড অব লাভ, প্লে অন।’

অকৃতদার সিলভাসটার এ সময় ম্যাচমেকার হিসাবে তারিফের পাত্র হয়েছিলেন। তাঁর বসতবাড়ির মিউজিক মজমায় বাদ্যবাজনা করতে গিয়ে দু’জোড়া মিউজিশিয়ান পারস্পরিক প্রেমে দারুণভাবে জড়িয়ে ছিলেন। ইবোলার কারণে কিছুদিন পরিস্থিতি এমন খারাপ হয়েছিল যে, গির্জা ও মসজিদে বিয়ে পড়ানোর সার্ভিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তো সিলভাসটার উদ্যোগ নিয়ে তাঁর বাসভবনে পাদ্রি ও মোল্লা ডেকে পর পর দুটি বিয়ে সম্পন্ন করে দিয়েছিলেন। বেকার সঙ্গীত শিল্পীদের পার্টির ইন্তেজাম করে ভোজ দেয়ার আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। সিলভাসটার আমিসহ আরো তিনজন সম্পন্ন অ্যাংলো-আমেরিকানকে দুলহা-দুলহিনের গডফাদার ও গডমাদার নিযুক্ত করেছিলেন। আমাদের দায়িত্ব ছিল সাদামাটাভাবে আয়োজিত বিবাহ মহফিলে খাবার ও পানীয় সরবরাহ করা। কবুল পড়ানোর পর পাত্রপাত্রীরা তাঁকে ধন্যবাদ জানাতে যান, তিনি তখন দরাজভাবে হেসে শেক্সপিয়ার থেকে কোট করেছিলেন, ‘লাভ অল, ট্রাস্ট আ ফিউ, ডু রং টু নান।’

সিলভাসটার পেসেঞ্জারের সঙ্গে বাতচিত শেষ করে চলে আসেন আমার কাছে। কব্জি মুঠো করে ধরে আন্তরিকভাবে চাপ দিতে দিতে আমার সাথে কথা বলেন। কোথাও যাচ্ছেন না তিনি। লাউঞ্জে তাঁর ইলেকট্রিক গুডসের আড়ত থেকে সরবরাহ করা এয়ারকন্ডিশনার বেগড়বাই শুরু করছে, তাই এয়ারপোর্টে মেকানিক নিয়ে এসেছেন। প্রসঙ্গ পাল্টিয়ে সিলভাসটার আমার কাঁধ চাপড়ে বলেন, ‘ইউ আর রিয়েলি আ গ্রেট ম্যান।’ আমি জিন্দেগিতে কখনো মহৎ কিছু করিনি, তাই প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করি, ‘লিসেন সিলভাসটার, আমাকে গ্রেট বলা—দাড়িওয়ালা ছাগলকে উট বলার সমার্থক।’ দরাজ হেসে আমার কাঁধ টিপে ঝাঁকুনি দিয়ে উঠে পড়তে পড়তে বলেন, ‘ইয়োর জোকস্ আর গ্রেট অ্যাজ ওয়েল।’ তিনি অতঃপর ‘সো লং, গুডবাই মাই ফ্রেন্ড’ বলে করমর্দনের জন্য হাত বাড়ান, বুঝতে পারি, পারহেপ্স আই উইল নেভার সি হিম অ্যাগেইন। তো আমি তাঁকে আলিঙ্গন করি। 

বোর্ডে আমার ফ্লাইট ফের বিলম্বিত হওয়ার তথ্য ঝলকায়। মনকে অন্যদিকে ফেরানোর জন্য লাউঞ্জের এদিক-ওদিক তাকাই। আমার গড-ডটার বা ঈশ্বর প্রদত্ত কন্যা আলমা তুরে ছুটে এসে ‘পাপা সুলতান’ বলে জড়িয়ে ধরে। পেশায় কণ্ঠশিল্পী সে। ইবোলা পরবর্তী মিউজিক মার্কেটে রমরমিয়ে বিক্রি হচ্ছে তার একাধিক সিডি। সিলভাসটার ওডেকারের মিউজিক মজমায় সে ছিল বাদ্যবাজনায় মাতিয়ে তোলা অতিথি। ওখানেই যশস্বী গিটারবাদক ড্রিজলিক মাকুন্দের সঙ্গে জমে উঠে তার গভীর প্রণয়। তাদের বিয়েতে সিলভাসটার আমাকে গডফাদার নিযুক্ত করেছিলেন। আলমা সে থেকে স্নেহময়ী কন্যার মতো আমার ডাক-খোঁজ করে। সে আমার পাশের চেয়ারে বসে তাদের দাম্পত্য জীবন সম্পর্কে আপডেট করে। তার স্বামী আমার গড-সান ড্রিজলিককে নিয়ে কিছু ঝামেলা হচ্ছে। খুব স্মুদ বিটের সঙ্গে সঙ্গত রেখে ক্যাচি মেলোডির সুর বাজাতে তার গিটারের জুড়ি মেলা ভার। কিন্তু ফুরসত পেলে পাড়ার মস্তানদের সাথে ভিড়ে মোটরবাইক হাঁকিয়ে মারপিট করার স্বভাব আছে। অত্যধিক বিয়ার পানের পরিণতিতে ইতোমধ্যে সে গজিয়ে বসেছে নোয়াপাতি ভুঁড়ি।

আলমার একটি লিরিক হালফিল তরুণদের মধ্যে জনপ্রিয় হয়েছে। গানটির প্রথম ছত্র হচ্ছে, ‘বা লাই টিমা,’ মেন্ডি গোত্রের ভাষায় এর মর্মার্থ হচ্ছে, ‘ডোন্ট লিসেন টু দেম... ওদের কথার কোনো ভিত্তি নেই।’ আলমার নিজের লেখা এ লিরিকটি বিস্তৃত হয়েছে সিয়েরা লেওনে প্রচলিত ‘ফিমেল জেনিটাল মিউটিলেশন’ বা ‘ফিমেল সারকামসিশন’-এর প্রতিবাদ হিসাবে। সঙ্গীতটি কম্পোজ করার জন্য আমি তাকে সাধুবাদ জানিয়ে বলি, ‘মাই ডটার, ইউ ডিড সামথিং রিয়েলি ব্রেইভ, এ জন্য তোমাকে চমৎকার একটি গিফ্ট দেয়া উচিত, আলমা... টেল মি, হোয়াট ডু ইউ ওয়ান্ট?’ জবাবে ফের সে আমার গলা জড়িয়ে ধরে বলে, ‘জাস্ট রিমেমভার মি পাপা সুলতান, দ্যাট ইজ গোয়িং টু বি মাই বেস্ট গিফ্ট।’ আমরা ফিমেল সারকামসিশন বিরোধী আন্দোলনে তার ভূমিকা নিয়ে টুকটাক কথা বলি। ফিমেল সারকামসিশন হচ্ছে—সিয়েরা লেওন তথা পশ্চিম-আফ্রিকার নানা দেশের পুরুষ নিয়ন্ত্রিত সমাজে প্রচলিত একটি নির্মম সাংস্কৃতিক প্রথা। মেয়েরা ঋতুমতী হলে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাচ্চা মেয়েদেরও যৌনাঙ্গ থেকে কিছুটা কেটে নিয়ে ক্লিটরাল হুড অপসারণ করা হয়। প্রথাটি দেশের সর্বত্র চালু রেখেছে ‘বন্ডু’ নামে এক ধরনের সিক্রেট সোসাইটি বা বয়স্ক নারীদের পরিচালিত গোপন সমিতি।

ছবি: ফ্রিটাউনের লুঙ্গি এয়ারপোর্ট  © মঈনুস সুলতান

যদিও কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থা ও আঞ্চলিক এনজিও এ প্রথা রোধ করার দাবি তুলছে। বাস্তব পরিস্থিতি হচ্ছে, সিয়েরা লেওনের প্রায় নব্বই শতাংশ নারী ফিমেল সারকামসিশনের শিকার, প্রথাটি আইনিভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়নি এখনো। অত্যন্ত দুঃখজনক সত্য, দেশটিতে এ প্রথার পক্ষে কথা বলার মানুষের অভাব নেই। সচরাচর বলা হয়ে থাকে, ক্লিটোরাল হুড কেটে অপসারণের ফলে নারীদেহে পরিশুদ্ধি আসে, হ্রাস পায় যৌন কামনার তীব্রতা, সন্তানরা বেড়ে ওঠে সৎভাবে, পতিতাবৃত্তির আশঙ্কা হ্রাস পায় প্রভৃতি। সবচেয়ে বড়ো যে যুক্তি দেয়া হয়, তা হচ্ছে বিধানটি স্রেষ্টা প্রদত্ত। সমাজে চালু আছে যুগ যুগ ধরে। ধর্মগ্রন্থাদিতেও এ প্রথার পক্ষে সমর্থন বিবৃত আছে। আলমার লিরিকে—উপরিউক্ত মতামত যে সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, তা হাইলাইট করে সে গেয়েছে ‘বা লেই টিমা’, বা ‘ওদের কথা শোনো না... ওদের কথার কোনো ভিত্তি নেই।’ সে আজ পাশের দেশ ফ্রেঞ্চ গিনির রাজধানী কনোক্রি শহরে যাচ্ছে। মাইক্রোফোনে তার ফ্লাইটের ফাইনাল কল শোনা যায়। সে উঠে গিয়ে পেসেঞ্জার লাইনে দাঁড়ায়। আমিও লাইনের কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি।

আলমা স্যুটকেসটি লাইনে দাঁড় করিয়ে রেখে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বলে, ‘পাপা, মারিয়াতু গিফ্ট শপে কাজ করছে, তুমি তাকে হ্যালো বললে সে খুব খুশি হবে।’ আমি সম্মতিতে মাথা হেলিয়ে জবাব দেই, ‘ইয়েস, আই উড বি হ্যাপি টু সে হ্যালো টু মারিয়াতু।’ পেসেঞ্জারদের একজন একজন করে আগ বেড়ে বোর্ডিং পাস দেখিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বেলা পড়ে আসছে, খানিক দূরে কনোক্রি যাওয়ার এরোপ্লেনটি দেখা যায়। আগ বাড়তে গিয়ে থেমে পড়ে ঘুরে দাঁড়ায় আলমা। কাচের দেয়ালের ওপাশে অরেঞ্জ বর্ণের প্যান্টের সাথে লেপার্ড প্রিন্টের টপ পরা সানগ্লাস চোখে মেয়েটিকে প্রসন্ন দেখায়। আমি হাত নেড়ে ফিরে আসি লাউঞ্জে, তখনই মনের ঈষাণ কোণে মেঘের কালোনির মতো একটি উদ্বেগ জমাট বাঁধে। ফিমেল সারকামসিশনের বিরুদ্ধে সাহস করে দাঁড়ানো শুধু নৈতিক দায়িত্বই নয়, সমাজ সংস্কারের অত্যন্ত জরুরি কাজও বটে। আলমা সঙ্গীতের  মাধ্যমে এ দায়িত্ব পালন করছে। সে তারিফের দাবিদার। কিন্তু এ উদ্যোগে যে রিস্ক আছে, রক্ষণশীলদের হাতে তার আক্রান্ত হয়ে খুন-জখম হওয়ার আশঙ্কা যে এ ক্ষেত্রে ষোলো আনা, এ বিষয়ে ভাবতে গিয়ে আমি দারুণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হই!

খানিকক্ষণ লাউঞ্জে একা বসে অপেক্ষার প্রহর গুনে বিরক্ত হয়ে অবশেষে উঠে চলে আসি গিফ্ট শপের কাছে। আলমার বান্ধবী মারিয়াতু এ দোকানে কাজ করছে। তাকে ব্যস্ত দেখায়, সে পেসেঞ্জারদের হরেক কিসিমের পণ্য দেখাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে পড়ে অপেক্ষা করি—তার কাজ থেকে একটু ফ্রি হওয়ার জন্য। মেন্ডি গোত্রের এ তরুণী অল্পবয়সে শিকার হয়েছিল ফিমেল সারকামসিশন প্রথার। পাড়াগাঁয়ের গুপ্ত সমিতি বন্ডুর নারীরা নৃত্যগীতে রীতিমতো উৎসব করে অনিচ্ছুক কিশোরীটিকে নিয়ে গিয়েছিল পবিত্র বনানিতে। ওখানে তার শরীর থেকে অঙ্গহানি ঘটানোর আগে কীভাবে যেন সে পালিয়ে সরাসরি চলে আসে রাজধানী ফ্রিটাউনে। শহরে আসামাত্র সে শিকার হয়েছিল যৌন হয়রানির। অতঃপর সে এক সাহায্যকারী সংস্থার বিদেশি কর্মকর্তার বাসায় গৃহকর্মীর কাজ পায়। শ্রমের বিনিময়ে তার সংস্থান হয় আহার ও বাসস্থানের। এ রকম ডমেস্টিক ওয়ার্কার হিসাবে কাজ করে করে কেটে যায় তার বছর কয়েক। তারপর একদিন ফ্রিটাউন মল থেকে বাজার সেরে ফেরার পথে মরিয়াতু সড়কে কিডন্যাপড্ হয়। অপহরণকারীরা মুখে রুমাল গুঁজে হাতপা বেঁধে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যায় গ্রামে। বন্ডু সমিতির নারীরা জোর করে কোনো ধরনের অ্যানিসথিশিয়া ছাড়া ধারালো ক্ষুরে তার শরীর থেকে অপসারণ করে ক্লিটোরাল হুড। এ ঘটনার পরও পরিবারে সে ফিরে যেতে পারে না, কিশোরী বয়সে অবাধ্যতার অপরাধে বাবা-মা সমাজ ডেকে ভিলেজ চিফের তত্ত্বাবধানে তাকে ত্যাজ্য করেছিলেন সম্পূর্ণরূপে। তাকে পরিবারে ফিরিয়ে নেয়া গ্রামীন সমাজে সম্ভব ছিল না। তো শরীরে ইনফেকশনজনিত তীব্র জ্বর নিয়ে সে ফিরে আসে ফ্রিটাউনে। যে বিদেশির বাসায় কাজ করত, তিনি চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। পুলিশে অবৈধ অপহরণের এজাহার দেন। মন্ত্রণালয়ে চিঠিচাপাটি লিখেন, কিন্তু প্রতিকার কিছু হয় না। এ ঘটনা আমি জানতে পারি আমার গড-ডটার আলমার কাছ থেকে। খুব সুন্দর করে বিয়ের গান গাইতে পারে মারিয়াতু, তার কণ্ঠস্বর চমৎকার। সে-সুবাদে মেয়েটি সিলভাসটারের বসতবাড়ির মিউজিক মজমায় যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিল। আমি লেখাজোখার আগ্রহে তার মুখ থেকে বন্ডু সমিতির তৎপরতা সম্পর্কে শুনতে চেয়েছিলাম। সে আমাকে সময় দিতে রাজি হয়েছিল। কিন্তু কথা রাখেনি, আবার সরাসরি না-ও বলেনি।

পেসেঞ্জাররা গিফ্ট শপ থেকে বেরিয়ে যেতেই আমি দোকানে ঢুকে পড়ে মারিয়াতুকে হ্যালো বলি। আমাকে দেখতে পেয়ে সে খুশি হয়েছে কী না—ঠিক বুঝতে পারি না। তার কথাবার্তায় সৌজন্য আছে, কিন্তু আন্তরিকতার আভাসটি ঠিক খুঁজে পাই না। দায়সারা ভঙ্গিতে সে জানায় তার পেশা পরিবর্তনের কথা। গিফ্ট শপের পেছনে পুঁজি খাটছে একজন ইংরেজ বংশোদ্ভূত সিয়েরা লেওনিয়ানের। মারিয়াতু সেলসে কাজ করছে, সাথে সাথে শিখছে মূর্তিগুলোকে পালিশ করে পেইন্টের রিটাচ্ দেয়ার পদ্ধতি। ব্যবসায়ী ভঙ্গিতে তার ঘঁষামাজায় মসৃণ হওয়া একটি মূর্তি তুলে সে আমাকে দেখায়। খিন্ন মনে আমি তাকে গুডবাই বলে লাউঞ্জে বেরিয়ে আসি। আমার মাথা থেকে মারিয়াতুর প্রসঙ্গ সহজে মুছে ফেলতে পারি না। ভীষণ গ্লানি হয়, ভাবি—তবে কী আমার লেখাজোখাজনিত তথ্যের প্রয়োজনে আমি মারিয়াতুর ওপর অজান্তে অহেতুক চাপ সৃষ্টি করেছিলাম? স্রেফ নিজের স্বার্থের জন্য যে এ ধরনের আচরণ অনুচিত—তা বুঝতে পেরে খারাপ লাগে! চেয়ারে হেলান দিয়ে কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকি। কাচের দেয়ালের বাইরে ঘন হয়ে সন্ধ্যা নামছে। ফ্লাইট ফের বিলম্বিত হয়। হাল ছেড়ে দিয়ে একটি পেপারব্যাক বইতে মনযোগ দেয়ার চেষ্টা করি।

পায়ের মুদৃ আওয়াজে চোখ তুলে তাকাই, দেখি—সামনে দাঁড়িয়ে মারিয়াতু। মৃদুস্বরে সে আমার ইমেইল আইডি চায়। আমি বিজনেস কার্ডের পেছন দিকে পার্সন্যাল ইমেইলের অ্যাড্রেসটি লিখে দিই। সে ধন্যবাদ দিয়ে বলে, ‘দেয়ার আর থিংস্ আই অ্যাম নট কমফরটেবোল টু টেল ইউ... ইট ইজ রিয়েলি হার্ড, আই উইল ট্রাই টু রাইট।’ আমি উঠে দাঁড়িয়ে তার কব্জি চেপে দিয়ে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ দিতে দিতে বলি, ‘মারিয়াতু... সুইট পার্সন, তুমি যে তথ্য আমাকে দিয়েছো, এ জন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ। কিছু বিষয় নিয়ে কথা বলা তোমার জন্য পেইনফুল... আই আন্ডারস্ট্যান্ড দিস্। আমাকে আর কোন তথ্য পাঠানোর প্রয়োজন নেই।’ সে চোখ তুলে আমার দিকে তাকায়। মাইক্রোফোনে ফ্লাইট চেক ইন-এর ঘোষণাটি এবার জোরেশোরে শোনা যায়। পেসেঞ্জারদের মধ্যে ক্যারিঅন ব্যাগ ও বোঁচকা টানাটানিতে তুলতবিল শুরু হয়। আমি মারিয়াতুকে ‘টেক কেয়ার এন্ড গুডবাই,’ বলে আস্তে-ধীরে উঠে চেকইন লাইনে গিয়ে দাঁড়াই। গিফ্ট শপের দিকে ফিরতে গিয়ে মারিয়াতু ঘাড় বাঁকিয়ে হাত নাড়ে। আমি ওয়েভ ব্যাক করতে করতে ভাবি, এদেশে তিন বছর কাটিয়েও  লেখাজোখার জন্য কিছু ক্রিটিক্যাল তথ্য আমি জোগাড় করতে পারিনি। কিন্তু একেবারে খালি হাতে তো ফিরে যাচ্ছি না, কিছু অভিজ্ঞতার সারোৎসার, কিছু স্মৃতি বোধ করি আমার সাথে সাথে থাকবে, যে-দেশেই যাই না কেন, আরো অনেক দিন।