বিনা মেঘের মতো

 

যেদিন সুরুজ আলি মারা গেল, সেদিন পুরো গ্রাম আচমকা একটা মোচড় খেয়েছে। হঠাৎ করেই যেন গ্রামবাসীর চোখের সামনে গাছের অনেকগুলো হলুদ, খয়েরি পাতা ঝুরঝুর করে ঝরে পড়েছে। কঙ্কালের মতো অনেকগুলো ডালপালা বেরিয়ে এসেছে। আর তাতে বাতাস লেগে উড়ছে হু হু কান্না। মানুষ মারা যেতেই পারে। তার বয়স হল, বা নাই হল। মৃত্যু হয়তো এরকমই। কথা নেই বার্তা নেই একটা অধ্যায়ের সূর্য টুপ করে ডুবে যায়। আর সুরুজ আলিরতো কিছুটা বয়স হয়েছে। এই বয়সে যদিও অনেক মানুষ দাপট নিয়েই বাঁচে। তবু, ৬০—৭০ বছর একেবারে কমওতো না। 
তারপরও সুরুজ আলির মৃত্যুতে একটা চমক ছিল। মেঘ ছাড়া বাজ পড়ার কথা শনগাঁওয়ের মানুষ কমবেশি জানে। দুয়েকটা ঘটনাকে তারা মনেও করতে পারে। যেদিন করিম মুন্সীর লাল দামাটি খোলা মাঠে ঘাস খাওয়ার সময় কড়াত করে ডাকের সাথে সাথে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষ প্রথম কিছুই বুঝতে পারেনি। আকাশে সেদিনতো মেঘের তেমন ঘনঘোর ছিল না। কিছু টুকরো টাকরা মেঘ ভাসছিল। হয়তো কোথাও বৃষ্টিও ঝরেছিল। ঠিক তখনই আকাশ ভেঙে পড়ার মতো আরেকটা বাজ পড়ার শব্দ সবাইকে চমকে দিলে, মানুষ তখন পড়িমরি করে কাছেপিঠে ঘরের চালার নিচে ঢুকেছে। তারা বুঝতে পারে, লাল দামাটি এমনি এমনি লুটিয়ে পড়েনি। এমন বাজ পড়েই মারা গেছে। ছাইকালো মেঘ ছাড়া অমন বাজ পড়ার ঘটনা শনগাঁওয়ের মানুষের কাছে চরম এক বিস্ময় হয়ে বহুদিন আলোচনায় ঘুরপাক খেয়েছে।
মৃত লাল দামাটির পাশে বসা করিম মুন্সীর বেজার মুখ, আর অনন্তের দিকে তাকিয়ে থাকা শূন্য চোখের ছবিটি বহুকাল অনেকে ভুলতে পারেনি। এই দামাটি তার বড় শখের ছিল, আদরেরও ছিল। নিজের ঘরের গাভির বাছুর ছিল। বলা যায়, নিজের ছাওয়ালের মতো তার কোল-কাঁখ ঘেঁষে বড় হয়েছে। সবাই দেখেছে, সকাল হলেই করিম মুন্সী দামাটিকে ধান কেটে নেওয়া খোলা মাঠে ছেড়ে আসতে। বিকেল হলেই দামাটি একাই বাড়ি ফিরেছে। অন্য সময় এখানে ওখানে ঢিগরার রশিতে বেঁধে রাখা হয়েছে। কখনও ঝাঁকা ভরে দামাটির সামনে দেওয়া হয়েছে তোলা ঘাস, নয়তো খইল গোলা খাদা ভর্তি কাটা খড় ও পানি। এটা তার একটা সচল সম্পদও ছিল। বিপদে-আপদে বেচে দুপয়সা পাওয়ার একটা অবলম্বন। এই ঘটনার পর শনগাওয়ের মানুষ অনেকদিন করিম মুন্সীকে হাসতে দেখেনি।
সুরুজ আলির মৃত্যু সম্পূর্ণ আলাদা একটা বিষয়। ওই মৃত্যুতে মেঘতো দায়ী নয়ই, অন্য কারো হাত, বা ভূমিকা আছে কিনা—তা জানতে আরও অনেক সময় লাগবে। তবু তার মৃত্যুটিকে কেউই সহজ করে মেনে নিতে পারেনি। সুরুজ আলিতো আর একেবারে দ্বীন-দুঃখী মানুষ ছিল না। পাকা দালানবাড়ি, অনেক চাষের জমিন। ছেলেমেয়েরাও দেশে-বিদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রোজগার করা লোক। নিজেও অনেক বছর দেশের বাইরে ছিল। শনগাঁওয়ের মানুষ তাকে টাকার কুমির না ভাবুক, টাকাঅলা বলেই জানে। টাকা-পয়সা নিয়ে তার বাড়তি কোনো দেমাগ ছিল, এমনও না। তবু তার টাকা যে আছে, তার সম্পদের প্রাচুর্যের কারণে এটা বুঝতে কারো কোনো সমস্যা হতো না। 
তবু কী যে হলো, শনগাঁওয়ের এক সকাল সম্পূর্ণ নতুন এক ধারণা ও বিস্ময় নিয়ে আসে। মানুষ শীতের কুয়াশার পুরু চাদরের ভেতরে আটকা পড়ে। তারা চাইলেই সে জাল ছিঁড়ে-ফুঁড়ে বাইরে আসতে পারে না। সূর্যে উঠলেও তারা আলোর নাগাল পায় না। তারা যদিও দিনের সকল কাম-কাজই করে। খাওয়া-দাওয়া করে। বউয়ের সাথে ঝগড়া-পীরিত সবকিছুই করে। তবু সুরুজ আলির মৃত্যু তাদেরকে যে ঘোরে ফেলেছে, সে ঘোরেই তারা কানামাছি খেলে। কেন এমন মৃত্যু, তার সন্ধান করতে একে অন্যকে খোঁচাখুচি করে। অন্ধকারে ঢিল মারে। কিন্তু রহস্যের কোনো গিঁটই খুলে না। 
শনগাঁওয়ের মুরব্বি সেতাব মিয়া যখন বলেন, ‘আশিকের বাপ যে মরল। তারতো একটা কারণ ছিল। মানুষটা দায়-দেনায় ফতুর ছিল। অসুখে-বিসুখে এত ঋণ করেছিল। এনজিও থেকেও টাকা নিছিল। জাগা-জমি যা ছিল, তা বেচেও শোধ করবার উপায় ছিল না। মানুষটা সবাইরে ফাঁকি দিয়া এমন করেই এক রাতে চোখ বুঁজল। তার কারণটাতো আমরা কিছুটা বুঝছি।... কিন্তু সুরুজ আলির কি অইল!’
আশিকের বাপকে অনেকেই ভুলে গিয়েছিল [তার নাম যে মোবারক মিয়া ছিল, এখন আর অনেকে মনে করতে পারে না বলে অই আশিকের বাপ নামেই সবাই ডাকতে থাকে]। সময়টা এতো দৌঁড়ের, মানুষ ছুটতেই আছে। নিজের নামও যেন হঠাৎ ভুল পড়ে যায়। সেখানে আশিকের বাপকে তার কাছের লোকজনও কি খুব একটা মনে করে। কিন্তু সেতাব মিয়া যখন নামটা উচ্চারণ করে। তাতে আবারও আলোচনাতে আশিকের বাপ ওঠে আসে। বাইরে থেকে তারওতো সবই ছিল মনে হতো। বউ ছিল, সন্তান ছিল—চাষবাসে বিভোর, মগ্নতা ছিল। কিন্তু একদিন সূর্য নিভে গেলে শেষে আশিকের বাপ আর চোখ মেলে আলো দেখেনি। যদিও পরদিন সূর্য ঠিকই উঠেছে। আশিকের বাপ খেটে খাওয়া মানুষ, তাই খুব দ্রুতই আলোচনা থেকে হারিয়ে গেছে। অনেকের কাছেই আশিকের বাপ বলে আর কোনো ছায়া বেঁচে নেই।
কিন্তু সুরুজ আলির বিষয়টাতো ভিন্ন। মানুষটা তিল তিল করে কত বড় একটা সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছে। শনগাঁয়ের সবচেয়ে বড় দোতলা বাড়িটি তার। ফসলের মাঠে তার সবচেয়ে বেশি জায়গা-জমি। ছেলেমেয়েরা দেশে-দেশের বাইরে বড় বড় শহরে থাকে। নিজেও সকাল-বিকাল গাড়ি চড়ে শহরে আসা-যাওয়া করে। বাড়িতে হাঁকডাকের লোকও কম না। গরিব-গোরবা লোকের বিপদে-আপদে হাত বাড়াতেও তার কৃপণতার দুর্নাম নেই। কারো মেয়ের বিয়ে আটকে গেছে, সুরুজ আলি গোপনে তার হাতে টাকা গুঁজে দিয়ে এসেছে। কেউ অসুখে পড়েছে, চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছে। অনেক সময় কার জন্য কি করছে, জানাও যেত না। কমবেশি সবাই জানতো, কারো কোনো সমস্যার কথাটা সুরুজ আলির কানে একবার কোনোভাবে পৌঁছাতে পারলে কিছু না কিছু সহযোগিতা পাওয়া যাবে। 
সেই সুরুজ আলির নিজেরই কি না কোনো সংকট দানাদার হয়ে ওঠেছিল ভেতরে ভেতরে। তাকে নীরব-নৈঃশব্দে ক্ষয় করছিল ঘুণপোকার মতো। এটা কেউ জানতেও পারেনি। একটা সরল, হাসিখুশিমাখা সময়ের ভেতর একজন সুরুজ আলি আলো-অন্ধকারে অন্য কোথাও বসবাস করছিল। এরকম হয়তো হয়, কিন্তু এই শনগাঁওয়ের সাদাসিধা মানুষের কাছে গভীর-গোপন কথা খোঁজ করার মতো সময় নেই—নয়তো তারা এতো জটিলতার ভেতর ঢুকতে চায় না। সামনে যা পায়, তাই দেখে। যা শোনে, তাই দশমুখে প্রচার করে। দুঃখের হলে দুঃখ পায়, মজার হলে হাসি-মশকরা করে সময়কে ভেঙেচুরে ছাতু করে।
অনেকটা বাঁক-মোচড় ছাড়া যে গ্রামটি চলছিল, যেরকম বেশিরভাগ সময়েই চলে। সেখানে সুরুজ আলির মৃত্যু বেশ কেঁপে ওঠার মতো একটা ঘটনা। এই মৃত্যুটাকে মেলাতে মানুষের বৈষয়িক কোনো হিসাবই কাজ করছে না। তাদের একটা সহজ বোঝাপড়া হল, যখন কারো আর কিছু করার থাকে না। চোখের সামনে থেকে সূর্যটা, চাঁদটা নাই হয়ে যায়—গভীর অন্ধকারের চাদরে ঢেকে যায় কারো চারপাশ। কেবল সেরকম লোকই এই ধরনের মৃত্যুকে বেছে নিতে পারে।
সুরুজ আলিতো তার উল্টো। মানুষ মনে করতে পারে, একদিন এই গ্রামে বিশাল বিশাল পাকা খাম্বায় ঝুলন্ত তারে বিদ্যুৎ আসে। এতো দিন যে জোনাক পোকা রাতের কালো শরীরে আলোর রেখা ফুটিয়ে আসছিল, তাদেরকে উধাও করে সুরুজ আলির বাড়ি বিদ্যুৎ বাতিতে ফকফকা হয়ে ওঠে। দূর থেকে সেই আলো পথিকের চোখে পড়তে থাকে। ধীরে ধীরে বিদ্যুতের তার গ্রামের প্রতিটি বাড়িকে প্যাঁচাতে থাকে, আর জোনাক পোকা হারাতে থাকে। পূর্ণিমা রাতে শনগাঁওয়ের খেত, গাছপালা, বাড়িঘর যেরকম আলোতে ডুবে থাকতো। তাতে ছেদ ঘটে। কেমন পানসে হয়ে যায় সেই আলোর বন্যা, আলোর ঢেউ। যদিও শনগাঁওয়ের মানুষ এই জোছনা হারানো নিয়ে কিছুই ভাবেনি। তারা খুশিই হয়েছে বিদ্যুতের আলোতে। 
সেতাব মিয়া বলে, ‘ভাবতো, যদি সুরুজ আলি চেষ্টা না করতো। জাগা মতো টাকা-পয়সা না দিত। তাইলে এই শনগাঁওয়ের মানুষ এখনও বিদ্যুৎ পাইতো কিনা আমারতো সন্দেহ।’ উপস্থিত সকলেই তাতে সায় দেয়। ঠিকইতো।
সেতাব মিয়া যেন এখন শনগাঁওয়ের মুখপত্র।—‘এই যে পাকা সড়কটা দিয়া এখন সবাই গাড়ি দৌড়াও। এই সড়কটা আগে কি ছিল, মনে আছে। হাঁটু পর্যন্ত কাদা ওঠতো বৃষ্টির সময়। আর শুকনার সময় ধুলা। একটা গাড়িও এদিকে আইতে চাইতো না। এই সুরুজ আলি নেতাদের কাছে গেছে। অফিসারদের তেল দিছে। টাকাও হয়তো দিছে, আমরাতো আর সবকিছু জানি না। নেতারাতো ভোটভাট আইলে আমাদের মতো গ্রামে আসে। ভোট শেষে কথাবার্তাও এমন, কাছে যাইতে ডর লাগে। নিজের ঘামে, নিজের ভোটে জমিদার বানাই আমরা!’
একটু থামে সেতাব মিয়া।—‘সুরুজ আলি যখন যেখানে যাওয়া লাগছে, দৌড়ছে। আমারে তখন একবার কইছিল, চাচা এই দেশটার হাড়-মাংস সব পচি গেছে। যেখানে যাও, হাঙ্গরের মতো সবাই হা করি রইছে। খালি টাকা দেও। টাকা ছাড়া কিচ্ছু হওয়ার নায়। আমারতো এসব না করলেও হয়। শহরেই থাকতে পারি। কিন্তু ভাবলাম, রাস্তাটা অইলে গ্রামের মানুষের কিছুটা উপকার অইলো। সেই মানুষটার কোথায় অতো অভাব ছিল, কষ্ট ছিল—কওতো! ৩০—৪০টা বছর ধরে গ্রামের জন্য কতকিছু করল।’

সুরুজ আলি এখন শনগাঁও কেন, পাশের গ্রামগুলোরও আলোচনার একমাত্র বিষয়। মানুষতো মরণশীল প্রাণী [শুধু মানুষ কেন, সকল প্রাণীই]। এটা সকলেই জেনে গেছে। কিন্তু সুরুজ আলির মৃত্যুর ধরন কেউই সহজ করে নিতে পারছে না [যারা সুরুজ আলির রক্তের সম্পর্কে নিকটে, যারা সুরুজ আলিকে বিপদে-আপদে কাছে পেয়েছে, যারা দূর থেকে সুরুজ আলিকে দেখেছে—কেউই মানতে পারছে না]। 
সেতাব মিয়া যখন বলে, ‘আমরাতো ভাবি না। সারদিন খালি খাই খাই করে ছুটছি। ভাবিয়া দেখ, জীবন বড় এক মায়া রে ভাই। এই রোদ দেখছো, তো এই অন্ধকার। এই একটা জীবনেই কতকিছু দেখলাম। যারে দেখলাম, একটা ভালা লুঙ্গি পরার ক্ষমতা নাই। সে এখন বাড়িগাড়ি, কতকিছু নিয়া বেটাগিরি করে। বাহাদুরি করে। চোখ রাঙায়। যে একসময় বাজারের বড় রুই মাছটা কিনছে, তার ঘরের বেড়া দিয়া এখন দিনের বেলায় হিয়াল-কুত্তা ঢুকে। কি যে আজব দুনিয়া। তবু মানুষের হুশ নাই। খালি মায়ারে ভাই, বড় মায়া! বড় লোভ জগত-সংসারে।’
সেতাব মিয়ার এরকম কথাবার্তায় একটা মন খারাপের হাওয়া সকলকে ছুঁয়ে যায়। যতটা বিষাদে তারা ডুবেছিল, সেই বিষাদটা আরও গাঢ় হয়ে ওঠে তাদের মধ্যে। মানুষের চোখের সামনে শনগাঁওটা ওলটপালট হয়ে ধরা দিতে থাকে। এই কয়টা বছর মাত্র, তারমধ্যেই ধুলাকাদার পথঘাট বদলেছে। শণের চাল, তরজার বেড়ার ঘর বদলে চকচক করছে টিনের ঘর। পাকা দালান ওঠছে। শুধু কি তাই, মানুষওতো কত বদলে গেছে। আগে যেখানে এক মোরগ কাটলেও আরশি-পড়শিকে খোঁজ করছে। এখন আস্ত গরুই জবাই করে গিলে ফেলছে একা। সবার সাথে সবার একটা গিট্টু ছিল। বিপদ-আপদ, আনন্দে সবাই সবার সাথে মিলেমিশে সময় কাটিয়েছে। এখন ঘরে ঘরে ভাগাভাগি। এক ঘর ভেঙে হয়েছে চার-ছটা। সবাই নিজের আয়নার সামনে দাঁড়ায়, আর গা-গতরের তেল-চর্বি দেখে।
এসময় পুলিশের একটা গাড়ি এসে ঢুকে সুরুজ আলির বাড়িতে। মানুষের ভাবনায় আবার সুরুজ আলি চলে আসে। সুরুজ আলির বাড়িতে ঢোকার আগে ডাক্তার নলিনী রায়ের বাড়ির পুকুর পাড়ে যে বিশাল বটগাছ ঝাকড়া মাথায় ছায়া ধরে আছে। সেই ছায়ার নিচেই গোল হয়ে, ছড়িয়ে ছিটিয়ে শনগাঁওয়ের ১০/১২ জন মানুষ বসে আছে। শনগাঁওয়ে এই একটাই বটগাছ এখন শিকড়-বাকড় ছড়িয়ে পুরোনো সময়টাকে ধরে আছে। অনেকগুলো বটগাছ ছিল শনগাঁওয়ে। কেটেছেঁটে সব শেষ। কি করে যে এই গাছটা টিকে আছে, আল্লাহ মালুম। বারো মাসই গাছটিতে কিছু পাখি বসে, কিচিরমিচির করে। যখন ফল আসে, ঝাঁক ঝাঁক টিয়ে আসতো আগে। এখনও আসে কিছু, তবে টিয়ের চেয়ে বুলবুলি, শালিক—এগুলোই বেশি। 
বেশ কবছর অবশ্য মানুষ একলা এই গাছের তলায় বসতো না। যদিও রাস্তার পাশের গাছ, তাই বটগাছটিকে এড়ানোরও সুযোগ নেই। ১৯৭১ সালে এই বটগাছের নিচে আরও বেশ কয়েকজনের সাথে ডাক্তার নলিনী রায়কেও পাকিস্তানি বাহিনি হত্যা করেছিল। চার-পাঁচজনের লাশ কেওলাকেওলি করে পড়েছিল বটের তলাতে। তিন-চার দিন কেউ সাহস করে কাছে ভিড়েনি। গ্রামটাই তখন ফাঁকা ছিল। পরে কিছু লোক মৃত সবাইকে বট গাছেরই কাছে একটা গর্তে মাটি চাপা দিয়েছিল।
নলিনী রায়দের জমজমাট সহায়সম্পত্তি ছিল, জৌলুস ছিল। নলিনী রায় বাড়ির টঙ্গি ঘরে বসে গ্রামের রোগীদের হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা দিতেন। কেউ টাকা দিতে পারলে ভালো, না হলেও মাগনা ওষুধ বিলি করতেন। মানুষটার নাম বহুদিন চেনাজানারা কথায় কথায় আড্ডায় তুলেছে। সেই নলিনী রায়ের নামে বাড়িটির নাম-পরিচিতি এখনও রয়ে গেছে। 
বটতলায় যারা বসেছিল, তাদের মধ্যে তখন চড়ুই পাখির ছটফটানি। পারলে ফুরুত করে সুরুজ আলির বাড়ির মধ্যে উড়ে যায়। সবার চোখ বাড়ির দিকে, পুলিশের ভ্যানের দিকে। কিন্তু কেউ উঠে দাঁড়ায় না। নড়েচড়ে না। ইচ্ছা সত্তে¡ও বাড়িতে যেতে চাইছে না। মৃত্যুটা যদি অসুখেবিসুখে হতো, তাহলে এখন মানুষে গিজগিজ করতো বাড়ির ভেতরটা। এখানে যারা বসে আছে, তাদেরই বেশিরভাগ তৎপর থাকতো কবর খোঁড়া, লাশের দাফন-কাফন করা নিয়ে। মৃত্যুটা যে চমকে দেওয়া, অনেক বিস্ময়ের—ভয়টা সেখানেই। 
শমসের আলি, যে সুরুজ আলির কিছুটা দূর সম্পর্কে গোষ্ঠীর লোক। এতক্ষণে তার মুখেও কথা আসে। চুপ থাকতে চাইলেও মনের ভেতর যে কথার বুঁদবুদ ফুটছে। শমসের আলি বলে, ‘সুরুজ আমার বয়সে ছোট। বড় আপন করে ভাই ডাকতো। তোমরা কেউর মনে থাকতো পারে, তারার পূবের ভিটায় আগে একটা কাঠের ঘর ছিল। একবার কলের গান নিয়া আইল। সারা রাত আমরা আব্বাস উদ্দিন, আব্দুল আলিমের গান বাজাইছি।’
শমসের আলি একটু থামে।—‘মাঝেমাঝে চাচা ঘুম থাকি উঠি আইতা। কিতারে তোমরার ঘুমটুম নাইনি। খালি গানই হুনবায়নি। হকলটিরে শয়তানে আছর করছে। এর বেশি কিচ্ছু কইতা না। চাচায় নিজেও একসময় বাঁশি বাজাইতা। তান রক্তেতো গান, সুর এসব আছিলই।’
করিম উদ্দিন যে সুরুজ আলির সাথে নেংটাকালে পুকুরে সাঁতার দিছে। ডোবা, খালে মাছ ধরছে। পাঠশালায় একসাথে পড়ছে। সেই করিম উদ্দিন বলে, ‘আমিতো পাঠশালা শেষে আর স্কুলে গেলাম না। খেতর মাঝেই মজা পাইলাম। খেত-কৃষি নিয়াই জীবন শেষ। সুরুজ শহরে পড়তে গেল। এরপর বিদেশ গেল। এরপর দেশেও আইল। দেশেতো প্রায় সবসময় থাকতো। একবার গিটার না কিতা, একটা যন্ত্র লইয়া আইলো। সন্ধ্যা অইলেই ডাকতো। আমরাও আইতাম। হে গিটার বাজাইতো। টুংটাং করে বাজতো। ভালাই লাগতো।’
—‘আমরারে কইতো খালি মিয়া হারা জীবন খেত খেত করলায় আর বউর পেট বছর বছর বাইচ্চা দিলায়। কয়দিনর দুনিয়া, একটু মজা কর। গান গাও, ফুর্তি কর। আমরারে ভিডিও দিয়া রাজ্জাক-ববিতা, ফারুক-কবরীর... কত ছবি দেখাইছে। বড় আনন্দ আছিল তার মাঝে।’
রশিদ উদ্দিন বলে, ‘আনন্দ করতো না! অভাবতো আছিল না। আমরারতো ঘুম থাকি ওঠলেই খাই খাই জ্বালা। ওটা জোগার করালায়তো আরেকটা নাই। বউ খেটখেটায়। পোয়া-পুরিতে ছিল্লায়। কেমনেদি ফূর্তি আইতো!’
সকাল থেকেই বাড়ির আশপাশে, কলাগাছের ছায়ায়। সুপারি গাছের তলে। বাঁশঝাড়ের নিচে অনেক মানুষ জড়ো হয়েছিল। পুলিশ ভ্যান আসার পর সেই ভিড় যেন বন্যা হয়ে উপচে পড়ছে। কিন্তু একেবারে নিকটজন, ইউনিয়নের মেম্বার-চেয়ারম্যান ছাড়া আর কেউই বাড়ির ভেতরে ঢুকছে না। সবার মধ্যে ভয়, মৃত্যুটাতো গ্রামের আর দশটা মৃত্যুর মতো না। সুরুজ আলিও আর দশজনের মতো ছোটখাটো মানুষ না। অনেক মানুষের সাথে তার খাতির, চেনা-জানা। সবচেয়ে বড় কথা, এই মৃত্যুর সাথে পুলিশ জড়িয়ে গেছে। বাড়ির ভেতরে গিয়ে কিনা আবার কোনো প্যাঁচে পড়ে। মাকড়ের মতো পুলিশের জালের কোনো সরল-সোজা প্যাঁচ নাই, টানলেই যে খুলে যাবে। শনগাঁওই না, আশপাশের মানুষও দূরে থাকাটাকে নিরাপদ মনে করছে। 
সেতাব মিয়া বলে, ‘কও চাই। কিসের অভাব ছিল তার। পোয়া দুই-তিনটা সবাই কাজর মানুষ। পুরিও বিয়া দিলাইছে। সম্পদেরও কমতি নাই। এরপরও এমন একটা কাজ করলো। এমনভাবে মরল। আমরা তার ধারকাছেও যাইতে সাহস পাইরাম না।’
সূর্যটা পূব থেকে পশ্চিমে গড়ায়। বটের ছায়া লম্বা হতে থাকে। মানুষের কথাবার্তাও লাগামছাড়া এদিকওদিক ওড়াউড়ি করে। কেউ বলে বউটা নাকি খুব দজ্জাল। সংসারে একটুও শান্তি ছিল না। বাড়িতে একা থাকতো বলে নানা বদনাম দিত। শেষদিকে ছেলেমেয়েরাও তার সাথে যোগাযোগ ছেড়ে দিয়েছিল। সেতাব মিয়া বলে, ‘কওতো, কোনোদিন তার মাঝে খারাপ কিছু দেখছো। চাইলেতো খইয়ের মতো টাকা উড়াইতে পারতো। যা খুশি করতো পারতো।’
কথা যখন শুরু হয়েছে, তা থামারতো সুযোগ নেই। কতজনের মুখ। কোনো না কোনো মুখেতো কথা ফুটতেই পারে। কথাগুলো সুরুজ আলির ক্ষেত্রে সত্য হতেও পারে, নাও হতে পারে। যেহেতু প্রকৃত ঘটনা সম্পর্কে কেউই কিছু জানে না। পাখির পালক হয়ে কথা এক দেশ থেকে আর দেশে উড়তেই পারে। 
মন্তাজ মিয়া বলে, ‘হুনলাম শহরে নতুন একটা বাসা করছে। অনেক টাকা খরচ অইছে। ব্যাংক থাকি অনেক টাকা ঋণ নিছে। এখন সেই টাকা দিতে পারছিল না...।’
সেতাব মিয়া অনেকটা ছোবল দেওয়ার মতো মন্তাজ মিয়ার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘মন্তাজ, এটা কোনো বিশ্বাস করার কথা কইলায়। তার নগদ টাকা ফুরাইলেও জাগাজমির কি অভাব আছে। এগুলা বেচলেওতো টাকা পাইতো। ব্যাংকর টাকার লাগি এরকম একটা কাজ করতে পারে মনে হয় না।’
—‘আর ব্যাংকর টাকাতো বড় লোকরার বাপর সম্পত্তি। টেলিভিশন, পত্রিকা খুললেই দেখ না। হাজার হাজার কোটি টাকা নিচে, ফিরত দের না। তারার কিচ্ছু অয়নি। আমি সেতাব মিয়া যদি ১০-২০ হাজার টাকার ঋণ আনি। সময় মতো না দিলে কোমরও দড়ি দিয়া টানিয়া নিব। সুরুজের তো এরকম হওয়ার কথা না।’
মানুষ তখন তার একা থাকার কারণটাকেও খুঁজতে থাকে [যদিও এতোদিন এ নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামায়নি কেউ। তার ভালো লাগছে, থাকছে। তবে আজ সকাল থেকেই একা থাকার বিষয়টি বেশি করে আলোচনা হচ্ছে]। স্ত্রী, ছেলে-মেয়ে অনেক দিন থেকেই দূরে দূরে। বাড়িতে কিছু কাজের লোক নিয়ে একাই থাকতো সুরুজ আলি। আজ সকালবেলা অনেক বেলা হলেও কক্ষের দরজা বন্ধ ছিল। কাজের লোক অনেক ডাকাডাকি করেছে। সাড়া-শব্দ মিলেনি। প্রতিটি ডাক শূন্যতায় আচড়ে মরেছে। একসময় আশপাশের লোকজনও আসে। তারাও ডাকে। যখন ডাকাডাকিতে কোনো কাজ হয়নি। তখন সবাই মিলে ঠিক করেছে, দরজা ভাঙার। 
দরজা ভাঙতেই এক নতুন জগত তাদের চোখের সামনে খুলেছে। সুরুজ আলি বিছানার উপর বৈদ্যুতিক পাখার রডের সাথে গলায় গামছা পেঁচিয়ে ঝুলে আছে। মানুষ বিহ্বল, স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কিছু মানুষতো পাথর হয়ে যায়। চরম এক বিস্ময়ের ঘোর তাদেরকে অনেক সময় ধরেই ঘিরে রাখে। সুরুজ আলি কেন এরকম মৃত্যুকে বেছে নিবে। তারতো কোনো অভাব-অভিযোগ থাকার কথা না। দুই মুঠোতে সোনা-মাণিক ধরে আছে যে, তার কেন এমনভাবে ঝুলে থাকা! এমন শূন্যতাকে আঁকড়ে ধরার শখ হলো!
এর আগে আশিকের বাপকেও এমন করে ঝুলে থাকতে দেখেছে শনগাঁওয়ের মানুষ। কিন্তু গ্রামের মানুষের মধ্যে কিছুটা হা-হুতাশ ছাড়া তেমন বিস্ময় তৈরি হয়নি। আশিকের বাপ যে গলায় দড়ি দিতে পারে, এ যেন শনগাঁয়ের অনেক মানুষের জানাই ছিল। তাই আশিকের বাপের মৃত্যুতে চমকে ওঠার মতো কিছু ঘটেনি। শুধু বাড়ি জুড়ে নারী-শিশুর কান্না বাতাসের শরীরটাকে ভারী করেছে বিষাদে। 
বেলা বাড়ছে, ফাল্গুন মাসের রোদেও তেজ বাড়ছে। বটগাছের মাথা থেকে শুকনো পাতা ঝরে পড়ছে মানুষের চুলে, শরীরে। ধুলোমাখা ঘাসের বুকে। কেউ হেঁটে গেলে তার পায়ের তলায় কিছু একটা ভেঙেচুরে যাওয়ার মচমচ শব্দ ফুটছে। দু-তিনটে কুকুরও ভিড়ের কাছে এসে দলা পাকিয়ে ঘুমিয়ে আছে। মানুষের বিষন্নতা বুঝি তাদেরকেও ছুঁয়েছে এখন। না হলে সবটা মিলে লেপটালেপটি, কচলাকচলি করার কথা। 
বটতলায় হঠাৎ ভিড়টা আবার নড়েচড়ে ওঠে। বাড়ির দিকেই সকলের চোখ। পুলিশের ভ্যান-গাড়িটা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসছে। ভ্যান গাড়িতে সুরুজ আলির নিথর শরীর। এই শরীরটা এখন হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। তবে তাকে জাগিয়ে তুলতে নয়। সবাই এটা জানে, এই শরীর আর কখনও জেগে উঠবে না। এই শরীরটাকে ডাক্তার ও ডোম মিলে লাশকাটা ঘরে কাটাছেঁড়া করবে। ওখানে খোঁজা হবে মৃত্যুর রহস্যসমূহ। স্থবির, বিহ্বল, একদল শোককাতর মানুষের চোখের সামনে পুলিশের ভ্যান-গাড়িটা একটু একটু করে শনগাঁও থেকে বেরিয়ে যেতে থাকে।