ময়নার মা’র ভিটা থেকে বলছি

 

বাড়ির কাছে আইয়া এক কাপ চা না খাইয়া যাইবাইন গ্যায়া, এইডা একটা কতা অইতারে? ভাবতেই আমার নিজের কাছে নিজেরে নার্ভাস লাগে।

রিপনের নার্ভাস শব্দটা ঠমকদার সুন্দরীর মতো হঠাৎ আমার চারপাশে কিছু আনন্দ ছড়িয়ে দেয়। অনেক দুঃখ, লাঞ্ছনা, না পাওয়ার কষ্ট বুকে চেপে মাঝে মাঝে পাগলের মতো বেরিয়ে পড়ি। জীবনটাকে বোঝার মতো টেনে টেনে যখন হাওরের সামনে এসে শুকনা মুখে দাঁড়াই, তখন মায়ের মুখের হাসির মতো বিশালতা দিয়ে সে আমাকে বরণ করে। হাওরের দিগন্তজোড়া মাধুর্য-মমতায় নিজেকে ধন্য মনে হয়।

এই কিছুদিন আগে নার্ভাস শব্দটা হাওরের দেশে এসেছে। তরুণেরাই তার সমজদার। তাই পুরোনো খোলস ফেলে নবযৌবন পাওয়া শব্দটাকে অনেকেই হৃদয়ের রঙে নানা মাত্রায় সাজায়। রিপন বাউলশিল্পী। যান্ত্রিক। সে দোতারা, বেহালা কিংবা মিসরীয় রাবাবের সুরের মতো তার নার্ভাস শব্দটা দিয়ে মাঝে মাঝে আমার দিকে জীবনকে বিস্তার করতে চায়। জীবন একটা মায়া।

হাওরপারের মানুষেরা বলে:
গরু মরে দুঘাসায়,
মানুষ মরে দুআশায়।

আমি এই দুঘাসের সংসার থেকে বেরিয়ে মনের ঘাস খুঁজি। তাই রিপনের সূক্ষ্ম ভাবভঙ্গি ও উচ্চারণ আমাকে গভীরে টানে। নিজের ওপর আমি নিজেই কি কম নার্ভাস? কত দিন ভালো করে ঘুমাই না। রোজ রোজ মাঝরাতে ঘুম ভেঙে যায়। পাষাণের মতো স্তব্ধ অতল অন্ধকারে কান পেতে নিজের আত্মার আলাপ শুনতে শুনতে বিশ্বমাতার হৃদয়ের বাণীও শুনবার চেষ্টায় কান খাড়া করে রাখি। নিশুতি রাতের স্তব্ধতর মুহূর্তে কার হিমশীতল দীর্ঘশ্বাসে আমার সকল অন্ত্র-তন্ত্র ও ইন্দ্রিয়মণ্ডলী উন্মুখ হয়ে ওঠে! চরম কিছু পাওয়ার আশায় আমি উৎকর্ণ হয়ে মরার মতো পড়ে থাকি। মহাবিশ্বের অসীমতাকে হৃদয় দিয়ে পলে পলে অনুভব করতে থাকি! এই জীবন্ত অসীমের মাঝে আমি কত ছোট! ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র!

এইভাবে আমার জীবন থেকে অনেক অনেক ক্ষণ-মুহূর্ত ভেসে যায় শেষ রাতের অন্ধকারের দিকে, অনন্তের দিকে, বহুদূর আলোকবর্ষের শূন্যতার দিকে। শুধু রহস্য আর কার বিলাপের অস্পষ্ট সুর! এই অবাঞ্ছিত-অদম তখন বিষণ্ন প্রেমিকের মতো কার আত্মার উত্তাপের আশায় শোয়া থেকে উঠে বসে পড়ে। বুকের মাঝে ধকধক করে জীবনটা খেলছে। আরও অন্ধকারের গভীরে লুকিয়ে কে খেলছে? কে খেলায়! এই সব ভাবতে ভাবতে কার আত্মার সাথে যেন মিশে যেতে চায় আমার পাপাত্মা। তবু তবু ভবিতব্যের মতো নির্লিপ্ত মহাকালের ক্লান্তশ্বাস ছাড়া আমি অদম আর কিছুই শুনতে পাই না!

আমি মাটির মানুষ, এইটা আমার অপরাধ না। তার জন্য আমাকে দায়ী করাও ঠিক না। সে আমার দেহ-মন গড়েছে পাপ-তাপ-লোভে। পিত্তাশয়ে ভরে দিয়েছে কামনার আগুন, রক্তে মিশিয়ে দিয়েছে দুরারোগ্য ব্যাধি লোভ। তবু এই সব রোগজীবাণু চেপে রেখে এই গরিব যেদিকে কান পাতে, শুধু রক্তমাংসের দুনিয়া, শুধু ঘুমন্ত মানুষের ক্লান্ত শ্বাস শুনতে পায়। মানুষ! মানুষ কি শুধু তার দোষগুলোর সমষ্টি?

দুনিয়াদারির হিসাবে তোমার এই পরাজিত সন্তানকে ক্ষমা করতে হবে মা! সবাই আমার সাথে জবানের বরখেলাপ করেছে, কনুই মারতে মারতে আমাকে প্রায় থেঁতলে দিয়েছে। তাই অপরের ভালো চাকরি, সুন্দরী বউ কিংবা কোনো রকম সফলতা দেখলে হিংসায় কাতর হতে ইচ্ছা করে। হাওরপারের বাড়িগুলোর দিক থেকে ভেসে আসা ঝাল ছালুনের গন্ধে মাঝে মাঝে আমার ক্ষুধা বেড়ে যায়। নানান রকম লোভ হাতছানি দেয়। আসলে এই সবের মধ্য দিয়ে আমার হতাশাগুলা নিজের ওপর প্রতিশোধ নেয়।

কোনো কোনো রাতে এই রকম নিঃসঙ্গ রুমের জটিল অন্ধকারে অন্ধকার হয়ে শুনি: ঘরের পেছনের আমতলা দিয়ে, মরা পাতায় খসখস শব্দ তুলে শিয়ালের দল হাওরের দিকে নেমে যাচ্ছে। হঠাৎ একদল পরিযায়ী হাঁস আমার সমস্ত স্নায়ু ছিঁড়ে, আমার ঘরের ছাদের ওপর দিয়ে, পতপত বেগে কত দিন ছুটে গেছে অবাধ পৃথিবীর দিকে। অথচ আমি আশরাফুল মাকলুকাত হয়ে, বউয়ের তাড়া খেয়ে, মাটির বিছানায় আত্মগোপনে আছি পরাজিত ব্যর্থ প্রেমিক। কারণ, আমার অর্থ কিংবা ক্ষমতা কোনোটাই নাই।

আমার লজ্জাগুলো আড়াল করবার জন্য করোনার নামে মাক্সের সুবিধা আমাকে প্রায়ই খুশি করে। তার বদলে সভ্যতার কাছ থেকে আমিও কিছুটা স্বাধীনতা চুরি করি। আমি মনের আনন্দে চারপাশের জীবন দেখি, পুষ্পের বুকে লুকিয়ে থাকা বিষপোকা দেখে চমকে উঠি, চোরের নাওয়ে সাউদের নিশান দেখে কষ্ট পাই, সুন্দরীদেরকেও অবাধে দেখতে পেয়ে খুশি হই। সুখ পাই। শান্তি পাই না। শান্তি! শান্তি! জানি শান্তির মা মরে গেছে। তাই মানুষের কামনা-বাসনার আগুন দেখতে দেখতে নিজেকেও কিছুটা দেখা হয়। ভালো করে চেয়ে দেখি: আমি এক আজব ক্রীতদাস! আমার হাত-পা, মনন-মগজ সভ্যতার শিকলে বাঁধা। পেট ভরে খাবার বদলে জীবনের অমূল্য সব রত্ন বিকিয়ে ফেলেছি। আমি নপুংসক ছিলাম। সভ্যতা আমাকে নপুংসক করেছে। আমার বুকের আগুন, মুখের ভাষা এইখানে হায়ারোগ্লিফিকস! কেউ আমাকে বোঝে না। কেউ আমাকে পোছে না।

মাঝে মাঝে পাশের রুম থেকে খাটের কড়মড় শব্দ ভেসে আসে। আমি মারফতের জগৎ ছেড়ে আদম-হাওয়ার দুনিয়ায় নেমে আসতে বাধ্য হই। এই অধঃগমন আমাকে লজ্জিত করে না; বরং গভীর ঘুমের মাঝে বউ পাশ ফিরেছে বুঝে আমি আশা করিতার ঘুমটা ভেঙে যাক। সে ঘুমন্ত মেয়ের ভয়ে চোরের মতো বাথরুম সেরে আমার বিছানায় আসুক! কোনো অলৌকিক আলো নয়, উদ্ধারের কোনো সম্ভাবনা নয়, শুধু বউয়ের শরীরের গন্ধ আস্ত করিডোর পেরিয়ে শিথান দিকের দরজা দিয়ে আমার রক্তে এসে হামলে পড়ে। ডাকু মাস্তানের মতো বুকের জমিনে খাল কেটে কুমির ডেকে আনে। রক্তমাংসের এই সংসার একটা কুমির। সে চিবিয়ে খায় না। সব গিলে ফেলে।

আমার আর বিশ্বদর্শন হয় না। সৃষ্টি-রহস্য ভেদ করা হয় না। নিগূঢ় তত্ত্ব নয়, শারীরতত্ত্বের দাস বলেই জল-কাদায় মুখ ডুবাবার লোভে আমি অধীর হই। তখন আমার যাবতীয় সুখ-অসুখ নিয়ে আমি শুধু একটা পরিচিত শরীরের স্বাদের আশায় পুড়ি।

মাটির গন্ধমাখা বিছানায় পড়ে আমি দিব্যি চোখে দেখছি, খোলস ফেলে আমার জীবাত্মা চলে গেছে তার খাটের পাশে। জ্বালাধরা চোখ দুটো গভীর অন্ধকারে চকচক করে জ্বলছে। মশারির ভেতর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে মেয়ে ঘুমাচ্ছে! মাটির পৃথিবীর এই পবিত্রতম দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে আমি লজ্জায় মরে যাই। নিজেকে কেমন পশু! পশু! লাগে।

এই সব বোধ কিংবা মূর্খতার নিয়তি বুকে চেপে চোরের মতো ফিরে আসি নিজের রুমে। ফজরের আজান হয়। সুবেহসাদেকের মিষ্টি আমেজে আমার আত্মায় একটা আশা দানা বাঁধতে থাকে। আজ নিশ্চয়ই সে আমার কাছে আসবে। ইভের কুটুরিতে আমি আদম নাঙল চালাব, রক্তপলাশের বীজ বুনব।

বউয়ের গম্ভীর মুখ মনে পড়তেই সন্দেহ দানা বাঁধে। বেশ কবছর আগেই সে আমাকে নিরালায় ডেকে সাবধান করে দিয়েছে, যখন-তখন ঝামেলা করবা না, মেয়ে বড় হচ্ছে।

আমি আবদারের গলায় বলি, তবে তুমি এসো।

সে চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকায়, আমার ফজরের নামাজ, কোরআন তিলাওয়াত?

আমি গভীর গলায় বলি, গোসলের পরিবর্তে তায়ামুম করে নিবা।

সে উপহাসের সুরে ফুঁসে ওঠে, বাজে কথা।

বাজে না, তোমার বুখারি শরিফ খুলে দেখো।

সে চমকে যায়। তার চোখের পাতা দুটো কেঁপে ওঠে। দশ খণ্ড বুখারি শরিফ তন্নতন্ন করে খুঁজে দেখা আর সাগর সেচা সমানে সমান। তাই ঠাণ্ডা গলায় বলে, তোমার দরকার তুমি দেখাও।

তারপর একটু থেমে আক্ষেপের সুরে বলে, তোমরা যে কী, এইটা একটা জিনিস হইল!

তার এই সব অবাক পস্তানি আর উপদেশেও দমি না। দ্বিগুণ উৎসাহে তাকে সাফ জানিয়ে দিই, কাল পাবা।

আমি বুঝে ফেলি, এই নারীকে কবজা করতে হলে রসুলের পাক্কা বাণী লাগবে। তাই বিকেলের রোদে দুনিয়াটা রঙিন হয়ে উঠতেই আমি বেরিয়ে পড়ি। আমার এক চেনা-জানা হুজুর আছেন। তিনি পাশের টাইটেল মাদরাসার মাহতামিম। একটা মসজিদেও ইমামতি করেন। রোজ রোজ বাজারের পথে দেখা হয়। আমি সালাম দিয়ে শ্রদ্ধায় পথ ছাড়ি। তিনি নীরব হাসিতে আমার কুশল জানতে চান। তারপর চারপাশে পান-জর্দা-আতড়ের জটিল সুবাস ছড়িয়ে ধীরগতিতে চলে যান।

মার্চে ভালো করে গোঁফটোফ ঢেকে মাদরাসা চত্বরে পা দিলাম। জিনসের সাথে পরা পাঞ্জাবিটা একটু স্বস্তি দিলেও চারপাশের আবহাওয়া যেন আমাকে একটুও নিতে চাইছে না। টানা বারান্দাসহ এল প্যাটার্নের তিনতলা দালানটা দুর্গের মতো খোপ খোপ মুখে আবছা অন্ধকার নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। পাশের ছোট পুকুরের বুকটাও থমথমে। এই সব দেখতে দেখতেই পাকা বারান্দায় পা দিই। সস্তা আতরের ঝাঁজ আমাকে থামিয়ে দিতে চায়! আমার নার্ভাস নার্ভাস লাগে। আমি হাঁটতে হাঁটতে চোখ রাখছিলাম প্রতিটা দরজার ওপরের মাথায় যেখানে লেখা থাকতে পারে কুতুবখানা, ইয়াতিমখানা কিংবা দায়িত্বরত বড় বড় আলেমের নাম ও পদবি। কিন্তু আমার চোখ বারবার ছুটে যাচ্ছিল ছোট ছোট গুহার মতো আবছা অন্ধকারে ঢাকা রুমগুলোর গভীরে। সেদিকের কোনাকানায় কিছু কিছু অন্ধকার জড়াজড়ি করে বসে আছে। মড়াবাড়ির আগরবাতির গন্ধের মতো সস্তা আতরের গন্ধ ভরা রুমগুলার ছমছমে অন্ধকারে গুটিয়ে রাখা হয়েছে অসংখ্য বিছানা-বালিশ। সারিবদ্ধ অই সব বিছানার পাশে জমাট হয়ে উঠতে থাকা গভীর অন্ধকার আমাকে আরও বিষণ্ন করে।

দপ্তরখানার সামনে এসে দেখি, মেঝের বিছানায় একটা কোলবালিশে শরীর ছেড়ে বসে আছেন তিনি। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। সালাম দিই। তাঁর দুই ঠোঁটে পানের রসের নরম হাসি, শরীরে তৃপ্তি ও আলস্য জড়ানো মখমলে সুখ। আড়চোখে এই সব দেখতে দেখতে আমি উবু হয়ে পায়ের জুতা খুলি। তারপর যথেষ্ট আদপের সাথে রুমে ঢুকি, একটা কাজে এলাম।

ইমানিদায়িত্ব কিংবা বহুদিনের অভ্যাসে তিনি অলস ভঙ্গিতে হাত নাড়িয়ে বিছানার কোনার দিকে আমাকে বসতে বলেন। রুমে আর কেউ নাই দেখে আমি বসতে বসতে বলি, পরিবারগত সমস্যা।

ইন্নালিল্লাহ..., বলে হুজুর আমার দুঃখে সমবেদনা প্রকাশ করেন। তারপর ডান হাতের আঙুল দিয়ে মেহেদি দেওয়া রঙিন দাড়ি বারবার আঁচড়াতে থাকেন। তাঁর চোখ দুটো বন্ধ, মেদবহুল শরীরে তৃপ্তির শৈথিল্য। আমি জানি এই কিছুদিন আগে তিনি দ্বিতীয় বিয়েটা সেরেছেন। বিবিসাহেবান তার ছোট মেয়ের বয়েসী। এই সব তথ্য বিবেচনায় আমার দুই কান গরম হয়ে উঠতে থাকে। বিপরীতধর্মী সব চেতনার জটিল ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সামলাবার জন্য আমাকে বারকয় কাশতেও হয়। তারপর মরিয়া হয়েই বলি, আমাদের ইন্টারকোর্সে জটিলতা দেখা দিছে।

ইন্নালিল্লাহ! ইন্নালিল্লাহ! বলতে বলতে হুজুরের ভারী শরীটা একটু কেঁপে ওঠে। এবার তিনি কোলবালিশ ছেড়ে সোজা হয়ে বসেন। তারপর আমার দিকে পূর্ণচোখে চেয়ে ফিসফিস করে বলেন, ইন্টারকোর্স...

জি।

কঠিন মসিবত!

জি।

হুজুর কাঠি দিয়ে দাঁত খিলাল করছেন দেখে আমি নির্বিকার গলায় আবার বলি, করোনার কবলে পড়ে আমাদের একমাত্র মেয়ে হোস্টেল ছেড়ে বাসায় আছে। তাই মাঝরাতে আমার কাছে আসলে ম্যাডামের ফজরের নামাজে ঝামেলা হয়। গোসল করতে গেলেই মেয়ের কাছে ধরা পড়তে হবে। আবার ফজরের পরে হলেও বিনা গোসল-অজুতে সকালের নাশতা খেতে হবে। তাই আমি উনাকে তাইমুমের কথা বলেছিলাম...।

আমার কথায় হুজুরের নাক-কপাল এবং দাড়ির মধ্য থেকে উঁকিমারা একটুখানি গাল লাল হয়ে গেছে। তিনি চোখ বন্ধ করে, মুঠি দিয়ে দাড়ি টানতে টানতে বেহেস্তি আবেশের গলায় আমার কাছে জানতে চান, উনি মানেন না?

না।

ঠিক আছে। সহবাসের পর গোসল ছাড়া নামাজ চলবে না। কিন্তু খানাপিনা চলতে পারে।

এই সব বলতে বলতে হুজুর দাঁত-খিলানটা কামড়ে ধরে কাঠের ডেস্কের সামনে গিয়ে বসেন। ড্রয়ার টেনে মাদরাসার প্যাড বার করে, কলম হাতে তার ওপর ঝুঁকে পড়েন। লিখতে লিখতে একেবারে শেষ লাইনে অবস্থা বিবেচনায় এইক্ষেত্রে তায়মুম জায়েজ লিখে যখন তিনি প্যাডের কোনায় জোরে সিল মারেন, তখন আমি বিজয়ের আনন্দে কেঁপে উঠেছিলাম।

ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা উতরে যায়। বাসায় ঢুকে দেখি মেয়ে তার রুমে বসে পড়ছে। খুশি মনে পাকঘরে সেঁধিয়ে পড়ি। বউ রুটি বেলছে। চুলার কড়াইয়ে ভাজি হচ্ছে আমার ছাদবাগানের বিষমুক্ত শিম। প্রায় হয়ে আসা সবজির সুঘ্রাণ আমাকে স্বাগত জানায়। আমি আমুদে তার পাশে বসে কাগজটা মেলে ধরি, এই যে দেখো, তায়মুমের সপক্ষে হুজুর কত সহি হাদিস লিখে দিছেন!

একই ছন্দে রুটির সামান্য বুকের ওপর বেলান চালাতে চালাতে সে নিরাবেগ গলায় শেষ রায় ঘোষণা করে, তাইলে কি আর গোসল ফরজ হইত?

তবু বহুরাত অন্ধকার ভরা করিডোর পেরিয়ে তার বিছানার পাশে গিয়ে চোরের মতো দাঁড়িয়ে থেকেছি। গভীর অন্ধকারে ঘুমন্ত মেয়ের কায়া দেখতেই আমার পা দুটো অসার হয়ে আসে। মেয়ের ঘুম খুব পাতলা। একটুতেই জেগে ওঠে। তাই কত দিন সে আমাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, সাবধান! মেয়ে এখন বড় হইছে। আত্মপক্ষ সমর্থন করে আমি যখন নানান রকম চোরা পথ দেখাই, সে উপহাসের সুরে বলে, তোমরা পুরুষেরা মানুষ হইবা কবে? খোদায় তুমগরে একটা জিনিস দিছিন!

তবু আমার লজ্জা হয় না। আমি নাছুরের মতো মিনমিন করে বলি, কত দিন ভালো ঘুম হয় না।

শুয়ে শুয়ে জিকির করবা, শ্বাস টানতে আল্লা, ছাড়তে হু; আল্লাহু, আল্লাহু...।

তার পরেই সে আমাকে জিকিরের ফজিলত বিষয়ে সবক দিতে শুরু করে। আমি বিরক্ত হয়ে ভাবি, এই এম এ পাস মহিলা কোনো আলেমকে বিয়ে করল না কেন?

বাজে একটা অনুভূতিতে কানে আর কিছুই ঢোকে না। তীক্ষ্ণ হয়ে নেমে আসা তার ভুরুর পাশের রক্ততিলটার দিকে আমি শুধু ফকিরের মতো তাকিয়ে থাকি।

আজ ভোরটা বড় নার্ভাসে গেছে। আজানের পরেই লেপের তলা থেকে বীরের মতো বেরিয়ে পড়েছিলাম। পেশাব করতে গিয়ে বাথরুমের দরজায় একটু-আধটু সংকেতময় শব্দ করলাম। তারপর ডাইনিংয়ের বাতি ধরিয়ে এক মগ পানি খেলাম ঢকঢক করে। সবই তাকে শুনিয়ে। খাবার টেবিল আর সেলাই-মেশিনের মাঝের সামান্য স্পেসটুকুর মধ্যে সে নামাজ পড়ছে। আমি পা টিপে টিপে তার পিছনে গিয়ে দাঁড়াই। সেজদায় পড়ে সে জায়নামাজে মিশে আছে। চোখ ফেরাতে গিয়ে দেখি, এলইডি বাল্বের সাদা আলোর দাপটে, পুবের ভেন্টিলেটরের ফাঁকে আটকে আছে সুবেহসাদেকের পবিত্র আলো!

আমি ঘাড় ত্যাড়া করে তার পেছনে দাঁড়িয়ে থাকি। একটু পরে সে সালাম ফিরিয়ে আমার দিকে ঘুরে বসে, দাঁড়িয়ে আছ কেন? যাও, আরেকটু ঘুমাও গিয়া।

আমার খুব খারাপ লাগছে! এই কথা বলে আমি দাঁড়িয়ে থাকি।

সে এক আচান্নক ঠাণ্ডা গলায় বলে, মেয়ের জন্য পাঁচ খতম কোরান মানত করছিলাম...

তার কথা শেষ হবার আগেই আমি কাতরে উঠি, তায়মুম করবা, প্লিজ...

তার বড় বড় চোখে তিরস্কার ঝলসে ওঠে, আমার কষ্ট বুঝ অ...? আর কয়দিন পরেই মেয়ে আমার হোস্টেলে চলে যাবে...

তার দুই চোখ ছলছল করছে দেখেও আমার রাগ লাগে। নার্ভাস লাগে। মন খারাপ করে নিজের বিছানায় ফিরতে ফিরতে শুনি বউ তেলাওয়াত করছে, মাখালাকনাকুম ওলা বাড়াছনাকুম ইল্লা কানাফসিন ওয়াহিদাতিন ইন্নাল্লাহা সামিউম বাসির।

তোমাদের সৃষ্টি করা, তোমাদের সবাইকে পুনরুত্থিত করা একজন মানুষের সৃষ্টি ও পুনরুত্থানের মতোই; নিঃসন্দেহে আল্লাহ তায়ালা (সবকিছু) শোনেন এবং দেখেন।

আর ঘুম হয় না। কোনো কিছুতে উৎসাহ পাই না। বিছানায় মরার মতো পড়ে ভেন্টিলেটরের ছোট ছিদ্রে ভোর দেখছিলাম। দেখতে দেখতে স্থির করেছিলাম, আজ বেরিয়ে পড়ব। তাই বনরুটির মতো চারপাশ থেকে কামড়ে খাওয়া ছোট একটা দ্বীপের এক কোনায় দুপুর থেকে বসে আছি। শীতের এই শেষ বিকেলে ছিমছাম নদীটার রঙ্গ ভরা অঙ্গ পেরিয়ে দৃষ্টি চলে যায় শুকনা হাওরের গভীরে। সেদিকের শূন্যতায় আকাশ শুয়ে আছে মাটির দিকে হাত বাড়িয়ে। এই রহস্য ঘেরা বিস্তার জীবনকে বুঝি একটা অদৃশ্য সুতা দিয়ে বেঁধে রাখতে চায়!

রিপন অ্যান্ড্রয়েড ফোনের চওড়া বুকে সিদ্দির পোঁটলা খুলছে। আমি উঠে পড়ি। প্রায় এক কিলোমিটার লম্বা, পতিত এই দ্বীপটার নাম ময়নার মায়ের ভিটা। বুড়োদের মুখে শুনেছি, অসম্ভব সুন্দরী, তেজি আর বিধবা ময়নার মা চাঁদনি রাতে এই দ্বীপটায় ঘোড়া দৌড়াত। আমি পায়ে পায়ে এগিয়ে যাই। সামনে ময়নার মায়ের বাড়ির সিংহদরজা, ভাঙা দেয়াল। কত কত গোপন কথা বুকে নিয়ে নীরবে পড়ে আছে ইটের আধলা। তার গায়ে জমে আছে শেওলার স্তর। আমি সিংহদরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে, চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে রিপনের কাছে জানতে চাই, ময়নার মা খুব সুন্দরী আছিন?

হ...। রানির মতন সুন্দর...।

ময়নার মায়ের ভিটাটা গিলতে গিলতে নদী এখন সিংহদরজার কোমর কামড়ে ধরেছে। তার বুকে বিকেলের ঝিলিমিলি রোদ। তারপর হাওর! হাওর! দৃষ্টিসীমার সবটুকুজুড়ে কুয়াশাঘেরা ইতিহাস। বহু দূরে কালো কালো গ্রাম ভূতের মতো উবু হয়ে বসে আছে। আমি জানি, আবছা অন্ধকারে ডুবে থাকা এই সব জনপদে ময়নার মাকে নিয়ে তিনটা গল্প চালু আছে। তার মধ্যে সবচেয়ে হিট গল্পটা হলো: ময়নার মা ছিল আচান্নক এক নারী। সে খুব অল্প বয়েসে বিধবা হয়েছিল। এই দ্বীপসহ চারপাশের হাওরগুলা ছিল তার শ্বশুরের। শ্বশুর বিগত, স্বামীও অকালে গত হলে সংসার দেখার কেউ না থাকায় ডুবন্ত নাওয়ের হাল তাকেই ধরতে হয়। খুব অল্পদিনের মাঝে বুদ্ধিতে, সাহসে, দানে, দক্ষতায় আশপাশের মানুষের কাছে রূপসী ময়নার মা রূপকথার রানি হয়ে ওঠে। তবু কী যেন নাই! কী এক চাপা ক্ষোভ যেন রয়ে রয়ে রক্তমাংসের দেহে বিস্ফোরিত হতে চায়। সেই দুঃসহ বিকেলগুলাতে সে জানালা দিয়ে হাওরের দিকে উদাস চোখে তাকিয়ে থাকত। ছুটে আসা বাতাস তার কপালের ওপর পড়ে থাকা বেয়াড়া চুলগুলো নিয়ে খেলত। এর কিছুদিন পর এক রাতে সে নিরুদ্দেশ হয়। রসিক বুড়োদের কেউ কেউ বলে, তলেতলে ময়নার মার পিরিতি আছিন ঘোড়ার জোয়ান সহিসের লগে। তার লগেই ভাগছিন। কেউ কেউ বলে, ময়নার মার পেটে বাচ্চা আইছিন। ঘোড়ার সহিসের বাচ্চা। তাই একদিকে পিরিতি অন্যদিকে সম্মান। এই দোটানায় পড়ে শেষমেশ বিষ খেয়ে জীবনের জ্বালা জুড়িয়ে ছিল রানির মতন লক্ষ্মী মেয়ে ময়নার মা।

আমি ভাঙা সিংহদরজার বাজুতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি। আমার পেছনে রিপনের দোতারা টুংটাং সুরে আলাপ জুড়ছে। বিকেলের রঙিন আলোতে ঝলমল করছে চারপাশ। একটা বক নদীপারের হাঁটুপানিতে পা ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তার পেটের চেষ্টা ছাড়া কোনো দায় নাই। কিন্তু ময়নার মায়ের দায় ছিল অনেকখানে। ঘোড়ার সহিসের সাথে পালানো ছাড়া তার হাতে কোনো অপশন ছিল না। বিকল্প ছিল না বংশের সুনাম বাঁচানোর। দুআশায় মানুষ মরে, দুঘাসে গরু মরে।

দেখতে দেখতে দিনের আলো মরে যাচ্ছে। হাওর পেরিয়ে এসে নদীর পাশে দাঁড়িয়ে আছে রাত। মাথার ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে পাখির ঝাঁক। পশ্চিমের ঝোপটার দিকে বুকে হেঁটে যাচ্ছে একটা লিকলিকে সাপ। এই যাওয়া-আসা সংসারের বিধি। এই হাওরময় রহস্যঘেরা শূন্যতা, ময়নার মায়ের ভিটার মতো ক্ষয় আর দীর্ঘশ্বাস মানুষের নিয়তি।

ময়নার মায়ের সিংহদরজায় দাঁড়িয়ে চোখের সামনে দিনটাকে মরতে দেখি। দেখি দিনের মৃত্যুশোকে পশ্চিমের আকাশটা এখনো লাল। নদীর বুকে অন্ধকার টলমল করছে। আমি আকুল হয়ে নদীর বিশাল বুকটা তালাশ করি: কোন দিকে ছিল ময়নার মায়ের গোলাঘর, বাংলাঘর? নদীর বুকের কোন পাশটায় ছিল ময়নার মায়ের বসতঘর? কোন ঘরের গলিতে দাঁড়িয়ে ময়নার মা ফিসফিস করে কথা বলত ঘোড়ার তরুণ সহিসের সাথে? কোন দিকে ছিল সেই আমগাছটা? যার ডালে ঝুলছিল ভাটির দেশের রাজরানির লাশ!

আমার ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। ছোট দ্বীপটায় রাত নামছে। চারপাশের আবছায়ায় নদীর বুকটা সিসার মতো হিমহিম, অতল-ভার। আমার চৌদিকের অন্ধকারে ভাসছে রিপনের দোতারার সুর, এই যে দুনিয়া, কিসের লাগিয়া, এত যতনে

গড়াইয়াছ সাঁই...।

এই যে দুনিয়া...

সুরের চাপা কান্নায় সারা চরাচর ভার হয়ে ওঠে। আমি করুণ চোখে নদীর বুকটার দিকে তাকিয়ে থাকি। সেখানে একটু একটু করে উঁকি মারছে বাসন্তী পূর্ণিমার চাঁদ। পেছনের ঝোপটা থেকে ভেসে আসছে জংলি ফুলের অচেনা ঘ্রাণ। আমার সারাটা বুকজুড়ে মুচড়ে ওঠে স্ত্রী-সন্তানের মুখ। তাই নিজের অসহায়ত্ব আরও কঠিন হয়। রিপনের মতো আমারও ইচ্ছা করে, এই অনন্ত শূন্যতার দিকে চিৎকার দিয়ে জানতে চাই: এই যে দুনিয়া, কিসের লাগিয়া?