বিবাগী কবি আওলাদ হোসেনের কথা
কেউ-না-কেউ হয়তো বলেছে কথাটা—‘কবিতা লিখতে হলে ঘরের বাইরে এসো। তাকাও পৃথিবীর দিকে। কবি ও কবিতার দিকে।’ কলেজ-জীবনের দিনগুলোতে তাই কবিদর্শনের আশ্চর্য রোমাঞ্চে মাঝেমধ্যে বড় শহরের বড় নদীটির তীরে চলে আসতাম। এই মফস্বলে সামনাসামনি কবিসঙ্গ, কবিদের চাক্ষুষ করা সহজ ছিল না মোটেও। ময়মনসিংহের ‘চন্দ্রাবতীর সন্তানেরা’ তখন সুবিদিত। মকশো পর্বের পবিত্র যাত্রায় কাব্যজগতে নিজেদের অনুভব ও আত্মভাষার দিকে নিজেরাই উড়ছিলাম। নামহীন, গোত্রহীন আমরাও বিস্ময়ে-আবেগে ‘চন্দ্রাবতীর সন্তান’ কবি আশরাফ রোকন, কবি মুজিব মেহদী, কবি মশিউর রহমান খান, কবি শতাব্দী কাদেরের সান্নিধ্য নিয়েছি। আমরা মানে, আমি ও মিজান মল্লিক। আন্তরিকতা ও সহজতায় মুগ্ধতা নিয়ে ব্রহ্মপুত্রের কবিদের সাথে মিলিত হতে সকালের মহুয়া ট্রেনে উঠে বসেছি। আশি মিনিটের ট্রেনযাত্রার পর জয়নুল পার্কের খোলা হাওয়ায় কোনো এক শুক্রবারে পৌঁছে গেলাম বীক্ষণের দরগায়। কবি-শিল্পীদের তীর্থস্থানগুলো যেমন, বীক্ষণও তাই। নতুন-পুরাতনের গমনাগমনে বীক্ষণের গোলঘর সত্যি তখন ছিল আনন্দ নিকেতন। সেখানেই আড্ডার অন্দরমহলে কবিদর্শন। দূরাগতের মতো সামান্য সান্নিধ্য; কবিতা ও কণ্ঠ শোনা।
ব্রহ্মপুত্রের কূলে এই সাপ্তাহিক মচ্ছব। পাশেই রাস্তা। মানুষজন যাচ্ছে, যাচ্ছে কুড়ি বয়সের স্বাপ্নিক যুগল। প্রকৃতির এই সহনীয় কোলাহলে খাতা খুলে নিবেদন আর উৎসাহ নিয়ে কবিতা পড়ছেন নতুন দিনের কবি। কৌতূহলী পথচারী মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে শুনছেন দুদণ্ড। সে রকম একটা আয়োজনে কবি আওলাদ হোসেন উঠলেন, কবিতা পড়তে শুরু করলেন। আমাদের চোখে শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রম। কবিতার ভাষা, প্রকরণ, ছন্দ ও বিষয় স্পষ্টতই আধুনিক। উপরন্তু পড়াটায়, কবিকণ্ঠে একটা প্রত্যয় ও মাধুর্য আছে। পড়াটাও বেশ স্বাভাবিক, বাড়তি কোনো চাপ নেই। উচ্চারণের সতেজ ভঙ্গি, কণ্ঠস্বরের ওঠানামায় মজমায় একটা প্রাণ তৈরি হয়েছে। যেন শ্রোতার উৎসুক্য না থাকলেও কবিতা পড়বেন—এমন ভাবনাতেই একটার পর একটা কবিতা পড়ে চলেছেন। তারপর ধন্যবাদ দিয়ে বসে পড়লেন। মনে হলো আমরা এসে ভালো কাজ করেছি। কবিদর্শন করেছি। পাবার কী শেষ আছে! অভিভূত হতে হতে দিনে দিনে বেড়েছে সঞ্চয়।
দুই
মানবজীবন এমনই, স্মৃতিবিস্মৃতি নিয়ে বসে থাকে ঘরে। সব সম্পর্ক কিংবা স্মৃতি ঘুমন্ত থাকে না। নীরবে-গহিনে উঠে আসে। জড়িয়ে ধরে। জীবন এমনই। আফসোসে ভরা। কিন্তু অনিবার্যভাবেই সময়ের ধূলিঝড়ে লড়াই করতে করতে জীবিতেরা বহন করে সহযাত্রীর স্মৃতি। গুণী সহযাত্রী অনুপ্রেরণার মতো আত্মায় বসে থাকেন। ময়মনসিংহের সংস্কৃতি ও সারস্বতচর্চার দিগন্তে কবি আওলাদ হোসেন কোনো সংঘের লোক ছিলেন না। ছিলেন, কবিতার ছোট একটা ফুল। সে ফুলের দিকে কেউ না-তাকালেও তিনি ফুটেই ছিলেন। সংঘে থাকা-না-থাকার অনির্ধারিত বেঞ্চে বসে বড় নদীর তীরে পৃথিবীকে তিনি বড় চোখেই দেখছিলেন। চোখে তাঁর কবিতার ইতিহাস। আড্ডার ভেতরে, ভিড়ের ভেতরে তিনি কবিতার কাছেই সমর্পিত ছিলেন।
কবিকে বলা হয় দূরদ্রষ্টা। জীবন ও সম্ভাব্য সময়কেও নাকি কবি দেখতে পান! কিন্তু কত দূর! কবি হবেন তিনি—এমন একটা বাসনা ছিল তাঁর। সব ছেড়েছেন। ৮২ ব্যাচের ময়মনসিংহের তথ্য কর্মকর্তার চাকরি ছেড়েছেন, সংসার ছেড়েছেন। হেথা নয়, হোথা নয়, অন্য কোথাও এই অনুভবে পীরের দরগায় দরগায় ঘুরেছেন। উদাস ও বিবাগী পথে হাঁটতে হাঁটতে কবিতার পথেই ছিলেন তিনি।
পালাতে পালাতে সময়ের সাথে নিজের জীবনকে তিনি মিনিমাইজ করে নিয়েছিলেন। কবির পৈতৃক ভূমি সিরাজগঞ্জের সলব স্টেশন-সংলগ্ন পঞ্চক্রোশী গ্রামে। তাঁরা এই গ্রামের সম্ভ্রান্ত জমিদার পরিবার। পিতা আব্দুল করিম তালুকদার এবং মাতা জমিলা খাতুন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের কৃতী ছাত্র ছিলেন। বিসিএস তথ্য কর্মকর্তা হয়ে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ঘুরে আশির দশকে ময়মনসিংহ শহরে থিতু হন। চাকরি ত্যাগ করে ব্রহ্মপুত্রের খোলা হাওয়ায় মরমি-বিবাগী পথে হাঁটতে থাকেন। কিছুদিন আব্দুল হকের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক ফ্রন্টের ময়মনসিংহ জেলার যুগ্ম সম্পাদকও ছিলেন। সবকিছুতেই তিনি ছিলেন পরমহংসের মতো। সব পথে হেঁটেও কবিতাতেই নিজেকে সমর্পিত রেখেছিলেন। তাঁর প্রকাশিত কাব্য গ্রন্থগুলো হচ্ছে—বন্দী দেবতা, অবতার। মানবধর্ম সূর্যমুখী নামে একটি আধুনিক মহাকাব্যও প্রকাশিত হয়েছে। তাই অধিকাংশ লেখাই বিভিন্নজনের হাতে সংরক্ষিত আছে। হয়তো কাউকে কম্পোজ করতে দিয়েছেন। কাউকে দিয়েছেন প্রকাশের দায়িত্ব। তাঁর মৃত্যুর পর মাহবুব বাবু লিখেছেন—‘কবি আওলাদ হোসেনের ‘লিলি’ উপন্যাসটির কপি আমার কাছে। আমাকে দিয়েছিলেন পড়তে এবং একটু দেখতে। তারপর সম্ভব হলে কম্পোজ করা যায় কি না, এ কথাটি সরাসরি বলেননি তিনি, সঙ্কোচ করছিলেন। আমরা জানতাম, কম্পোজ করানোরও সক্ষমতা হারিয়েছেন একসময়ের তুখোড় আমলা।’
ময়মনসিংহ শহরে কবির অন্তরতম জুনিয়র বন্ধু ছিলেন কবি শামীম আশরাফ। কবির অনেক লেখা তাঁকে প্রকাশের জন্য দিয়ে গেছেন। তিনি লিখেছেন, ‘তাঁর বড় বাজিতপুরের যাত্রী গ্রন্থটি করোনার জন্য প্রকাশ করতে পারিনি। করোনার পর তাঁর সাথে কথা হলেই বলতেন, গ্রন্থটি যদি করা যেত, তবে দেখে যেতে পারলে ভালো লাগত।’ এতো নিবিড়ভাবে মানুষ চলে যেতে পারে, আপনি দেখালেন ভাই। আমাকে রেখে গেলেন নিজেরই কাঠগড়ায়!’
সত্তরের নিমগ্ন পাঠশালা থেকে উঠে এসেছেন কবি আওলাদ হোসেন। তাঁর বন্ধুরা সবাই বিখ্যাত। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কবি কামাল চৌধুরী, তসলিমা নাসরিন, সলিমুল্লাহ খান। মূলত অগ্রজ আহমদ ছফার ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। নির্মোহ জীবন এবং কিছু হতে না চাওয়ার উদাসীন পথে হেঁটে হেঁটে চলে গেছেন
তিন
কী কী অনুভবে একজন পাঠক কবিতার মানসূচক নির্ধারণ করবেন। কবিতা এবং কবিজীবনের দীপ্তি ছাড়া পাঠকের সামনে আর কিছুই থাকে না। কবি আওলাদ হোসেনের কাব্যজগৎ অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি মানসূচকের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। প্রথমত, শব্দের ভেতরে আত্মা তৈরি হয়েছে কি না? অর্থাৎ কবিতাটি শিল্প হয়েছে কি না অর্থাৎ পাঠক গ্রহণ করছে কি না, কবির কল্পনাটা পাঠকের মনে বিশ্বাস তৈরি করছে কি না, কবিতার ভেতরে মিশে যেতে যেতে পাঠক আন্দোলিত হচ্ছে কি না। দ্বিতীয়ত, কবিতায় পরিচিত জগতের দৃশ্যায়ন আছে কি না। তৃতীয়ত, কবিতার বয়ানে তাৎপর্যময়তা আছে কি না, অর্থাৎ কবিতার বক্তব্য ও দার্শনিকতায় পাঠকের মনন উদ্দীপ্ত হচ্ছে কি না, পাঠক ভাবিত হচ্ছে কি না। চতুর্থত, কবিতার বিশেষ পঙ্ক্তিতে শাশ্বত সত্য অনুভব উঠে এসেছে কি না। পঞ্চমত, কবিতায় ব্যবহৃত ভাষা ও সৌন্দর্যে কবির নিজস্বতা উপস্থাপিত হয়েছে কি না। ভাষা, আঙ্গিক ও বর্ণনাভঙ্গিতে কবি নতুনত্বের স্বাক্ষর রেখেছেন কি না। ষষ্ঠত, কবির কবিতাটি সামগ্রিকভাবে মৌলিক কি না এবং সপ্তমত, কবিতাটি সময় ও মানবিকতার অনুভবচিহ্ন নিয়ে শিল্পময় হয়ে উঠেছে কি না, সময় ও ভূমির সব সত্য লেগে থাকার পরও কবিতা বিশ্বজনীন আবেদন তৈরি করতে পেরেছে কি না। এই সব মানসূচক দিয়ে কবি আওলাদ হোসেনের কাব্যজগৎকে আবিষ্কার করা যেতে পারে। কবি মূলত সাধক। সমাজের ভেতরে শব্দ ও কল্পনার রূপকার। এই মানসূচকগুলো প্রয়োগ করে আমরা কবির জাত ও শক্তি চিনে নিতে পারি। কবি তো সত্যদ্রষ্টা। সময় ও সত্যকে তিনি বুক চিরে হাজির করেন। পাঠকের বোধের তরঙ্গটাকে কীভাবে স্পর্শ করে দেখুন। এই যে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষিত সমাজ—এদেরকে কীভাবে স্পর্শ করে দেখুন কবির কবিতায়। আমাদের শিক্ষকসমাজ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর চিত্রই উঠে এসেছে এই কবিতায়।
তবু বিশ্ববিদ্যালয়
অনিরুদ্ধ গৃহযুদ্ধে জেগে থাকে নদী
তবু চাঁদ আসে ঘাস ফুলে জোসনায় যদি
গড়িয়ে যায় সময়
ঘুমোয় পাথুরে খাদ
আলোকিত গহ্বর উদ্ধারের গবাক্ষ হৃদয়
খিড়কি পুকুর থেকে ছায়া রমণীর কলাপাতা দোলা কামের আস্বাদ
তবু বিশ্ববিদ্যালয়
নীল নির্মম তীর তীব্র শীতে
পৌষের শিশিরবিন্দু মাড়িয়ে, জড়িয়ে
জারকিত গামবুট পায়ে বদজামানার মদ পিয়ে ওই
গরু ও জুতা চোরেরা গিয়েছে জামাতে
বকরা ঈদের নামাজ আদায় করতে
যখন প্রভূত প্রাইভেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় সমমূহের
ডক্টরেট ডিগ্রিধারী গরুগুলো
ঘাড়ে ও গর্দানে গজে বেশ খাচ্ছে চাবাতে চাবাতে
চাবাচ্ছে জাবরকাটা, সাম্রাজ্যবাদের খড় বিচালি ও ঘাস
বাণেশ্বরের বোগদা ও বোগদীগুলো নন্দীদের ছানা মাখন গায়ে-গতরে
বহুদিন কবির হৃদয়! তবু বিশ্ববিদ্যালয়।
কবি যখন কবিতা লেখেন তখন জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে তাঁর পুরো অভিজ্ঞতাকেই প্রকাশ করেন। লিখতে লিখতে কবি একটা অতি-নিবিষ্টতার জগতে প্রবেশ করেন। বিশেষত এই কথাটি কবি আওলাদ হোসেনের ক্ষেত্রে খুব সত্য। কবিতা লেখার একটা জগৎ তৈরিতে তিনি সব ঐশ্বর্য এবং সামাজিকতাকে জলাঞ্জলি দিয়েছেন। নিজেকে সম্পূর্ণ প্রস্তুত করেছেন পদ্যের জগতে। একজন কবি মূলত তাঁর জাবনযাপনকে লেখেন। এই জীবন কেবল ব্যক্তিগত নয়, চারপাশের সময় ও সমাজ অভিজ্ঞতার সাথে মিশে উচ্চারিত হয়।
চার
সত্তরের নিমগ্ন পাঠশালা থেকে উঠে এসেছেন কবি আওলাদ হোসেন। তাঁর বন্ধুরা সবাই বিখ্যাত। কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ, কবি কামাল চৌধুরী, তসলিমা নাসরিন, সলিমুল্লাহ খান। মূলত অগ্রজ আহমদ ছফার ভাবশিষ্য ছিলেন তিনি। নির্মোহ জীবন এবং কিছু হতে না চাওয়ার উদাসীন পথে হেঁটে হেঁটে চলে গেছেন। কবিকে স্মরণ করে মোরশেদ শফিউল হাসান লিখেছেন—
তাঁকে স্মরণ করছি গভীর ভালোবাসায়। প্রথমদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মহসিন হলে যেদিন সলিমুল্লাহ খান ও আওলাদ দুই বন্ধু একসঙ্গে আমার রুমে গিয়ে দেখা করে সেই দিনটির কথা মনে পড়ে। তারপর কতদিনের কত স্মৃতি! গফুর মিয়ার ক্যান্টিনের আড্ডায়, ছফা ভাইয়ের আন্তর্জাতিক ছাত্রাবাসের ১০৭ নম্বর কক্ষে দেখাসাক্ষাত...। এক সময় তাকে হারিয়ে ফেললাম। হয়তো ভুলেও গেলাম আমরা তাকে। আজ যখন আবার তার খোঁজ পেলাম তখন সে আমাদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। কবির আত্মার শান্তি কামনা করি।
কবির একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং অন্তরতম সহচর ছিলেন লেখক তসলিমা নাসরিন। সে সময় ময়মনসিংহ শহরে খুব আন্তরিকভাবে বিচরণ করেছেন তাঁরা। তসলিমার অন্য ভুবনের একটা অংশ এখানে তুলে দিচ্ছি। যেখানে কিছুটা আঁচ করা যাবে কবির ব্যক্তিত্ব:
১৯৮৯ সালে অনেক কিছু ঘটে। অনেক ভাল কিছু, অনেক মন্দ কিছু।... আজকের এই সকাল কবিতা পরিষদ গড়ার আগে সকাল নামে একটি প্রকাশনী গড়েছিলাম। প্রকাশনীর প্রথম বই যেটি বের করেছিলাম, সেটি কবি আওলাদ হোসেনের কাব্যনাট্য। আওলাদ হোসেনের কথা বলতে গেলে সময় দুবছর পিছিয়ে নিতে হয়।...
তুমি নিজে জানো যে আওলাদকে নিতান্তই একজন বন্ধু ছাড়া অন্য কোনও ভাবে তুমি দেখ না। তুমি কখনও কল্পনাও করোনি আওলাদের সঙ্গে এই বন্ধুত্বের বাইরে তোমার আর কোনও রকম সম্পর্কের কথা। বরং আওলাদকে বন্ধু বলতেও দিনদিন তোমার আপত্তি হচ্ছে, তাঁর অদ্ভুত আচরণ যে তুমি লক্ষ্য করছ না এমন নয়, করছ। লোকটি উদাসীন, আবার উদাসীনও নয়। কী এক দুর্ভেদ্য ঘোরের মধ্যে থাকেন তিনি। কখনও অনর্গল কথা বলেন, কখনও কোনও কারণ ছাড়াই হেসে ওঠেন, হারমোনিয়ামে মরমিয়া সব সঙ্গীতের সুর তোলেন, আবার কখনও একেবারে চুপ, কোনও কিছুই তাঁর নিমগ্নতা ভাঙতে পারে না। এই আছেন তিনি, এই নেই। আপিসের গাড়ি করে দূর দূরান্তে চলে যাচ্ছেন। গাড়ির চালককে রাতভর খাটাচ্ছেন, কখনও আবার খুব হাসিমুখে চালকের পকেটে টাকা গুঁজে ছুটি দিয়ে দিচ্ছেন। এক আওলাদ হোসেনের অনেকগুলো চরিত্র। কোনটি আসল, তা তুমি বুঝতে পারো না। ক্রমে ক্রমে তুমি আবিষ্কার করছ যে শম্ভুগঞ্জের এক পীরের কাছে তিনি ঘন ঘন যাচ্ছেন, পীরের সংসারে টাকা পয়সা ঢালছেন, পীরের সঙ্গে বসে গাঁজা খাচ্ছেন। তুমি লক্ষ্য করছ যে আপিসে লোকটি দিন দিন অপ্রিয় হয়ে উঠছেন। নিজের সহকর্মীদের সঙ্গে মোটেও সম্পর্ক মধুর রাখতে পারছেন না তিনি।... একদিন তুমি এও জানবে যে আওলাদ হোসেন তাঁর বউকে মেরে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ছেলে মেয়ে নিয়ে বউ চলে গেছে সিরাজগঞ্জ। অল্প বয়সে চমৎকার গান গাইত এমন এক মেয়েকে তিনি বিয়ে করেছিলেন। বাচ্চাকাচ্চাও হয়ে গেছে আর সব বন্ধুদের চেয়ে অনেক আগেই। প্রায়ই যখন তুমি বউ ছেলে মেয়ে কেমন আছে জিজ্ঞেস কর, আওলাদ হোসেন ওদের খবর জানেন না বলে জানিয়ে দেন। তিনি কোনও টাকা পয়সাও পাঠান না ওদের জন্য। তুমি লক্ষ্য কর, ওদের জন্য লোকটির মোটেও কোনও মায়া হয় না। বউ তাঁর অবাধ্য হয়েছিল বলে তিনি শাস্তি দিয়েছেন। তিনি স্বামী, তিনি সে ক্ষমতা রাখেন। তিনি কবি, তিনি ভাবুক, তিনি এই, তিনি সেই। তিনি লাটসাব, তিনি জমিদার। জমিদারের খবর নিতে তুমি আগ্রহ হারাতে থাকো। না দেখা বউটির জন্য তোমার খুব মায়া হতে থাকে। তুমি বউটির কষ্ট অনুভব করতে থাকো। বছর চলে যায়...তুমি খোঁজ নিয়ে দেখলে আওলাদ হোসেন আর ক্লিন শেভড স্যুটেড বুটেড ভদ্রলোক নন। তিনি শম্ভুগঞ্জে পীরের আসরে গাঁজা টেনে টেনে, পীরকে টাকা পয়সা যা ছিল সব দান করে এখন সর্বস্বান্ত। চাকরিটিও গেছে। মাথা পাগল লোক। খালি পায়ে হাঁটেন। ময়লা কাপড়চোপড়। চুল দাড়িতে মুখ ঢেকে গেছে।... তোমার কাছেও এলেন একদিন টাকা চাইতে। মায়া হল বলে দিলে। আওলাদ হোসেন বগলতলায় একটি বড় বাঁধাই খাতা নিয়ে ঘোরেন আর বলেন তিনি চমৎকার একটি কাব্যনাট্য লিখেছেন, এটি ছাপা হলে, তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস, পৃথিবীতে হৈ চৈ পড়ে যাবে। আওলাদ হোসেনকে দেখে সত্যিই খুব মায়া হয় তোমার। সিরাজগঞ্জের জমিদারপুত্র আওলাদ হোসেন ফার্স্ট ক্লাস গেজেটেড অফিসার থেকে এক বছরের মধ্যে এখন পথের ভিখিরি। যে মানুষ শখ করে নিজের এমন সর্বনাশ করেছে, তুমি কী ইবা করতে পারো তাঁর জন্য! কিছুই না। ——অন্য ভুবন, তসলিমা নাসরিন
জীবন খুব ছোট। সেই ছোট জীবনকে আরও ছোট করে নিয়েছিলেন কবি। ২৩ মে মারা যাওয়ার আগেও খুব স্বাভাবিক মৃদুস্বরে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘বাহিরে যাচ্ছ, একটা গোল্ডলিফ এনো’। স্ত্রী তাঁর জন্য গোল্ডলিফ আনলেন। মাথার পাশে বসে বললেন, ‘তোমার শরীর খারাপ, সিগারেট না খেলে হয় না?’ তিনি বললেন, ‘আমি ঠিক আছি। আমার লেখাগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণে রেখো। একদিন তোমাদের কাজে আসবে।’
পাঁচ
মৃত্যুর ১২ দিন পরে আমরা কবি শামীম আশরাফের স্ট্যাটাস থেকে জানতে পারলাম তাঁর চলে যাওয়ার খবর। বিনা চিকিৎসায়, অভাব ও দৃঢ়তার শক্তি নিয়ে মারা গেলেন তিনি। ঐশ্বর্য ও আকাঙ্ক্ষা রেখে কী এক বিশুদ্ধ ও বিবাগী জীবন তিনি যাপন করে গেছেন। যে জীবন চোখের সামনে দিয়ে চলে গেল সে জীবন নিয়ে সামান্যতম আক্ষেপও তাঁর ছিল না। তিনি যে জীবনকে দেখেছেন সে জীবনকে যত্ন করে তুলে রেখেছেন কবিতার খাতায়। হয়তো ভাবীকালকে বলে গেছেন—যদি অবসর পাও খুলে দেখ আমার অভিজ্ঞতা। কী আশ্চর্য নীরবতায় ময়মনসিংহ শহরের সাংস্কৃতিক সংঘ ও কবিকুলকে কিছু না জানিয়ে তিনি চলে গেছেন। ‘ক্ষমা করবেন, আওলাদ ভাই’ শিরোনামে কবি শামীম আশরাফ লিখেছেন—
‘আওলাদ ভাইয়ের সাথে ২২ মে কথা হয়েছে। দম ফেলে ফেলে কথা বলছিলেন। বলছিলেন তিনি যে হারমোনিয়ামটি কিনেছেন তার টিউনিং হচ্ছে না। কদিন হলো কিনেছেন। সেক্ষেত্রে যার কাছ থেকে কিনেছেন তার কাছে দিয়ে যদি কিছু ভর্তুকি দিয়েও বিক্রি করা যায় তাহলে খুব ভালো হতো। আমি তাকে বললাম আপনি কি এখন খুব অসুস্থ? অর্থকরি লাগবে? তিনি দম ফেলে বললেন, না বেশ সুস্থ আছি। পরের দিন ২৩ মে ২০২২ আওলাদ ভাই মারা গেলেন।
অথচ এর তিন চারদিন আগে মেডিকেলের বারান্দায় চিকিৎসাধীন ছিলেন। অনেক রাতে যখন কোন যানবাহন পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন তার ছোট মেয়ে বাড়ির কাছে পড়ে থাকা ভাঙা ভ্যান চালিয়ে নিয়ে গেছেন মেডিকেলে। ভালো চিকিৎসার জন্য প্রাইভেটে ডাক্তার দেখিয়েছেন। অনেকগুলো পরীক্ষা করতে দেয়া হয়েছিলো, টাকার জন্য করেননি। আমরা হতভাগা, আমাদের কাউকে জানালেন না।
আজ মৃত্যু সংবাদ শোনার পরপরই তাঁর বাসায় গিয়েছিলাম আমরা কয়েকজন। ২২ মে আলাপের সময় আওলাদ ভাইয়ের স্ত্রী শাহিনা আক্তার কাছেই ছিলেন। তিনি আওলাদ ভাইয়ের ফোন কেড়ে নিয়ে সত্যটা বলতে চাচ্ছিলেন, যে উনি অসুস্থ। আওলাদ ভাই ফোন না দিয়ে স্ত্রীকে বললেন, ‘দেখো কারও কাছে হাত পেতো না।’
মাস দুয়েক আগে আওলাদ ভাইয়ের মুখ, পা ফোলা দেখে বলেছিলাম ডাক্তার দেখাতে। ডাক্তারের নাম ঠিকানা দিয়ে বলেছিলাম, উনার কাছে যাবেন, যা লাগে করাবেন। বাদবাকী আমি দেখবো। তিনি বলেছিলেন কিডনীতে সামান্য সমস্যা তাঁর এক বন্ধুর কাছে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসা করাচ্ছেন।’
ছয়
যে জীবন সারল্যনির্ভর, সেই জীবনই সুন্দর। একটা অত্যাশ্চর্য সরলতায় ময়ময়নসিংহ শহর পরিভ্রমণ করতেন। একটা বড় নদীও মানুষের মনকে বড় করে, উদার করে। নিজের একটা দর্শন না থাকলে জগৎকে দেখা যায় না। আলোর সন্ন্যাসী হয়ে তিনি ময়মনসিংহ শহরে ঘুরেছেন। শামীম আশরাফের ‘পরম্পরা’ কিংবা ‘বাতরে’র অনেক আয়োজনে কবির কথা শুনেছি। তাঁর বক্তৃতার একটা গন্তব্য থাকত। বুদ্ধিদীপ্ত সে আলোচনার স্বর ছিলো নমিত। জ্ঞানগর্ভ কোনো ভঙ্গি ছিল না তাঁর। ধীরস্থির ভঙ্গিতে বলবার কথাটা তিনি সহজ করে বলে দিতেন। কথা কিংবা জীবনবাদে কোনো ভণিতা কিংবা ভড়ং ছিল না। তবে কমিউনিস্টদের মতো কথা দিয়ে উদ্দীপ্ত করতে চাইতেন। কিন্তু কতক্ষণ স্থায়ী হয় মানুষের উদ্দীপনা!
জীবন খুব ছোট। সেই ছোট জীবনকে আরও ছোট করে নিয়েছিলেন কবি। ২৩ মে মারা যাওয়ার আগেও খুব স্বাভাবিক মৃদুস্বরে তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, ‘বাহিরে যাচ্ছ, একটা গোল্ডলিফ এনো’। স্ত্রী তাঁর জন্য গোল্ডলিফ আনলেন। মাথার পাশে বসে বললেন, ‘তোমার শরীর খারাপ, সিগারেট না খেলে হয় না?’ তিনি বললেন, ‘আমি ঠিক আছি। আমার লেখাগুলো ভালোভাবে সংরক্ষণে রেখো। একদিন তোমাদের কাজে আসবে।’ এই বলে তিনি ঘুমাতে গেলেন নিজ বাড়ি সিরাজগঞ্জের পঞ্চক্রোশী গ্রামে। কী এক রোমান্টিক ও বিবাগী জীবন কাটিয়েছেন তিনি। শুধু কবিতার জন্য, শুধু প্রেমের জন্য, পীর ও সুফিবাদের নিমগ্ন পথের জন্য তিনি ধীরে ধীরে সবার থেকে হারিয়ে গেলেন। মানুষ হারাতেই আসে। সমাজজীবন, ব্যক্তিজীবন এবং বাসনাতপ্ত অন্ধকারে মানুষকে কতটুকু আর খুঁজে পাওয়া যায়! কবির গমনাগমনের চিহ্ন কবিতাতেই সুভাসিত থাকে।
পড়ুন ► আওলাদ হোসেনের অপ্রকাশিত কবিতা
সরোজ ভাই, পৃথিবীতে অমন মানুষেরাও টেকে না। আশ্চর্য ফুল হয়ে নিভৃতে সুগন্ধ বিলিয়ে সরে যায়। না নিতে পারি সুগন্ধ না নিতে পারি মানুষফুল! আওলাদ হোসেন সর্বোচ্চ শ্রদ্ধায় বাঁচুন কবিতায়।
শামীম আশরাফ
আগস্ট ০২, ২০২২ ১০:৩৮