আসাদ চৌধুরীর টুকরো টুকরো স্মৃতি
বাংলা ভাষার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কবি আসাদ চৌধুরী। পঞ্চাশের অধিক গ্রন্থের রচয়িতা তিনি। টিভি ব্যক্তিত্ব হিসেবেও রয়েছে তাঁর বিশেষ পরিচিতি। ‘তবক দেয়া পান’-এর এই কবির কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় সেই কিশোর বয়স থেকেই। তবে সামনাসামনি পরিচয় ঘটে অনেক পরে, এই শতকের শুরুর দিকে, ঢাকায় আসার পর কোনো এক বইমেলায়। এরপর বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডা এবং টিভি চ্যানেলে অনুষ্ঠান নির্মাণের সূত্রে বহুবার তাঁর সঙ্গে সময় কাটানোর সুযোগ হয়েছে। প্রাণবন্ত ও আড্ডাবাজ এই মানুষ খুব সহজেই মানুষকে আপন করে নিতে পারেন, খুলে বসেন স্মৃতির ভাণ্ডার। একথাটি পুনরায় মনে পড়ল তাঁর ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’ বইটি পড়তে গিয়ে। বইটিকে আসাদ চৌধুরীর আত্মজীবনী বলা না গেলেও, এটাকে তাঁর জীবনের উজ্জ্বল স্মৃতিভর্তি একটা মূল্যবান আলমারি বলা যেতে পারে।
আসাদ চৌধুরীর জীবন বর্ণিল ও বিচিত্র। তবক দেয়া পান-এর মতো সুস্বাদু ও সুগন্ধবিস্তারী। শিল্পচারী এই মানুষ লিখেছেন যেমন দু’হাত ভরে, তেমনি দু’পা ছড়িয়ে চষে বেড়িয়েছেন বাংলার এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। পৃথিবীর এক দিগন্ত থেকে আরেক দিগন্ত। যেখানেই গেছেন, যেভাবেই থেকেছেন, উদযাপনময় করে তুলেছেন চারপাশ। ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’ বইটি সেসব প্রসঙ্গেরই অন্তরঙ্গ বয়ান। আশি বছরের এই কবি এখনো বেরিয়ে পড়তে, নিজেকে ছড়িয়ে দিতে, মানুষের সাথে মিশতে, মানুষ-সমাজ-সংস্কৃতিকে পাঠ করতে তুমুল আগ্রহী। বিনয়ী, দরদি, মিশুক, ভ্রমণবিলাসী আসাদ চৌধুরীর টুকরো টুকরো জীবনের সংকলনই হচ্ছে ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’।
প্রবন্ধ, ব্যক্তিক উপলব্ধি, দেশ-বিদেশে ঘোরাঘুরির বৃত্তান্ত, মুক্তিযুদ্ধ, স্মৃতিচারণা—এ ধরনের বিচিত্র প্রসঙ্গের মোট ২২টি গদ্য রয়েছে ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’ বইটিতে। বইটির গদ্যগুলো সম্পর্কে ভূমিকায় তিনি লিখেছেন, ‘বিভিন্ন সময়ে লেখা, সময়ের ছাপ তো থাকেই, তার ওপর আমার বিখ্যাত স্ববিরোধিতা, যুক্তিহীন মুগ্ধতা, আবেগতাড়িত মুহূর্ত—এসবের ছাপ তো রয়েই গেল।’ উল্লেখ্য, বইটির শেষে দুটি সাক্ষাৎকারও যুক্ত করা হয়েছে।
লক্ষণীয় বিষয়, গদ্যগুলোর শিরোনামের দিকে চোখ বোলালেই ভেতরের বিষয়বস্তু সম্পর্কে পাঠক সহজেই আঁচ করতে পারবেন। যেমন—বইটির শুরুতেই রয়েছে ‘মাটির দেশ বিলাত’। শিরোনাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে এটি তাঁর বিলাতভ্রমণ কাহিনি অর্থাৎ তাঁর লন্ডনে ভ্রমণের অভিজ্ঞতা বর্ণিত হয়েছে লেখাটিতে। এ ছাড়া অন্যান্য উল্লেখযোগ্য শিরোনাম হচ্ছে—‘মেলবোর্নের একটি ঝকঝকে বিকেল’, ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’, ‘চিঠি লেখার দিনগুলো ও আমার কিছু কথা’, ‘আমার জীবনের দুটি স্মরণীয় ঈদ’, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতি’ প্রভৃতি।
২
যেকোনো স্মৃতিকথাতেই সময়ের ছাপ থাকে, নানা চরিত্রের বিচিত্র স্বরূপ থাকে। এদিক থেকেও আসাদ চৌধুরীর ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’ বইটির গুরুত্ব অপরিসীম। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে ‘এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া’ শিরোনামে ভ্রমণগদ্যটির কথা। পঁচাত্তরের শুরুর দিকের দুটি মফস্বল শহরের সাহিত্য উৎসব নিয়ে লেখা এ গদ্য। প্রথম উৎসবটি ছিল গাইবান্ধায়, পরেরটি যশোরে। আজকের এই ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে দাঁড়িয়ে অনেক তরুণ কবির হয়তো জানতে ইচ্ছে হতে পারে, সেই সময়ের সাহিত্য-আড্ডা কেমন ছিল, সে বিষয়ে। আমি নিশ্চিত, এ গদ্যের পাঠ কিছুটা হলেও তাদের সে ইচ্ছা পূরণ করবে। গদ্যটি পাঠে বোঝা যায়, কতটা প্রাণোচ্ছলতা নিয়ে উদযাপিত হতো ওই সময়ের সাহিত্য সম্মেলনগুলো! এসব সম্মেলনে ঘটত সাহিত্যের মহারথীদের মিলনমেলা। গাইবান্ধার দিকে আসাদ চৌধুরীর যাত্রা শুরু হয়েছিল ট্রেনে, কমলাপুর থেকে। সহযাত্রী ছিলেন বশীর আল্হেলাল, সুকুমার বড়ুয়া, ড. আবুল কাশেম চৌধুরী, ড. সুনীল কুমার মুখোপাধ্যায়। ময়মনসিংহ জংশন থেকে উঠেছিলেন গুরু-শিষ্য যতীন সরকার ও নির্মলেন্দু গুণ। এ সম্মেলন কথা-কবিতা-ছড়া আর গানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল তা নয়, এঁদের কেউ কেউ ছড়িয়ে পড়েছেন গাইবান্ধার দিগন্তবিস্তৃত প্রকৃতির কোলে, গরুর গাড়ির ছন্দময় দুলুনিতে, গাড়িয়াল ভাইয়ের আকুল বিলাপে।
একজন মানুষের মূল বীজতলা হচ্ছে তার শৈশব। পৃথিবীর সমস্ত ভূমণ্ডল জয় করার পরও মানুষ তার ‘শৈশব’ নামক আদি ও উর্বর পললভূমিতে বারবার ফিরে আসতে চায়। ‘স্মৃতিগুলো সুখের ছিল’ গ্রন্থের ‘শিককাবাব আর ফালুদার স্বাদ’, ‘সেই সময়ের স্মৃতি’ শিরোনামের গদ্য দুটিতেও শৈশব থেকে কুড়িয়ে আনা আসাদ চৌধুরীর নরম কোমল দিনগুলোকে প্রত্যক্ষ করা যায়। ঈদ-রোজা-পূজার কথা তো আছেই; আছে সেই সময়ের গ্রাম ও শহরের দৃশ্যপট, পারিবারিক ও সামাজিক রীতিনীতি, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতি। ঈদ নিয়ে তিনি যে স্মৃতিচারণা করেছেন, তা হয়তো তাঁর সমসাময়িক অনেককে নস্টালজিক করে ফেলতে পারে, আবার এ প্রজন্মের মনে জাগাতে পারে বিস্ময়। যেমন—
‘‘ঈদের দিনটি যদিও ব্যতিক্রম লাগত আমাদের সবার কাছেই কিন্তু পুরো রোজার মাসটাও আমাদের কাছে কম আকর্ষণের ছিল না। মনে পড়ে শবে বরাতের রাতে এবং শবে কদরের রাতে আমরা হারিকেন নিয়ে গামছা-টামছা বগলদাবা করে পুকুরে গিয়ে গোসল করতাম। তারপর ফিরে আতরটাতর মেখে মসজিদের দিকে ছুটতাম। রোজা রাখি বা না রাখি তারাবিহ মিস করতাম না। ফিরে এসে ক্যারাম বা বাঘাটুলি বা লুডুর উপর ঝাঁপিয়ে পড়তাম। বড়রাই খেলতেন, তাদের অনুপস্থিতিতে আমরা চান্স পেতাম। তারপরই অপেক্ষা কখন নাগরা (নাকাড়া) বাজবে। রোজায় ইফতারির সময় নাগরা বাজতো, ঈদের চাঁদ উঠলে বাজত আর শুক্রবার জুম্মার ঘণ্টাখানেক আগে কাছারি বাড়ির বিরাট পেতলের ঘণ্টা বাজতো। ’’
[শিককাবাব আর ফালুদার স্বাদ, পৃ: ৪৯]
এই বইয়ের স্মৃতিচারণাগুলোতে উঠে এসেছে তাঁর সময়ের সাহিত্যিকদের বোহিমিয়ানাপনার খণ্ড খণ্ড চিত্র। এসেছে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, রফিক আজাদ, আবদুল মান্নান সৈয়দ, নির্মলেন্দু গুণ, কায়েস আহমেদ, বিপ্রদাশ বড়ুয়াসহ তাঁর সমসাময়িক অনেক বিখ্যাত কবি-সাহিত্যিকের প্রসঙ্গ। ‘ব্যক্তিগত’ শিরোনামের গদ্যটিতে আসাদ চৌধুরী ভিন্ন এক আবদুল মান্নান সৈয়দকে উন্মোচন করেছেন। গভীর অনুরাগ ও নির্মোহ দৃষ্টি দিয়ে মান্নানকে তুলে ধরেছেন এখানে। এ বইয়ের উল্লেখযোগ্য দুটি স্মৃতিচারণা হচ্ছে ‘মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্মৃতি’ ‘তখন সত্যি মানুষ ছিলাম’। শিরোনাম থেকেই বোঝা যাচ্ছে, এ গদ্য দুটি মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নিয়ে। আসাদ চৌধুরী কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে সরাসরি যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে। এটি তাঁর জীবনে সেরা একটি অধ্যায়। লক্ষণীয় বিষয়, মুক্তিযুদ্ধের নানা অনুষঙ্গ তাঁর কবিতা ও স্মৃতিকথায় বারবার উঠে এসেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে নিজের সম্পৃক্ততা নিয়ে তিনি এখানে লিখেছেন,
‘কবিতা পড়ি, আমার গলার স্বর ভালো, পড়িও ভালো, অতএব কথিকাও লিখতে হলো, সপ্তাহে দুটি কথিকা—একটি মৃত্যুহীন প্রাণ, অপরটি মোদের গরব মোদের আশা। প্রথম প্রথম আমার মডেল দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভঙ্গিতেও পড়তাম—বেশি দিন নকল করতে হয়নি।
মৃত্যুহীন প্রাণ—আমার তো সন-তারিখ মনে থাকে না, পড়লাম— পড়ার সময় টের পাচ্ছিলাম, গলা বসে আসছে আবেগে। আমার শ্রেষ্ঠ রচনা এই মৃত্যুহীন প্রাণ এর প্রথম কিস্তিটি। আশরাফুল আলম ছিলেন ঘোষণায়—তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে উচ্চারণ করলেন, ‘ওরা মানুষ হত্যা করছে। আসুন আমরা পশু হত্যা করি।’ আমার সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠেছে। একবারও ফাম্বলিন না করে পড়ে গেলাম। পরদিন মুকুল ভাই হাসতে হাসতে বললেন, “ব্রাদার কারামাজভ তুমি তো কামাল করে ফেললে। প্রধানমন্ত্রী তোমার বাণী শুনেছেন।”’
কবি আসাদ চৌধুরী যে আদ্যোপান্ত একজন ইতিবাচক মানসিকতার মানুষ, এই বইয়ের নামকরণ থেকে আবারও তা প্রমাণ পাই। সব স্মৃতি সুখের হয় না। জীবন তো মায়ের ওমের ভেতর গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকা পৌষের সকাল না। কত খড়-দুপুর, কত তীব্র ঝড়, সয়ে সয়ে একটা জীবন বয়ে যেতে হয় আমাদের। কিন্তু সেগুলো ভুলে, ভাবনার জন্য যা আরামদায়ক, জীবনের জন্য যা ইতিবাচক, সেগুলোকে মনে আনা উচিত। কবি আসাদ চৌধুরী তাই-ই করেছেন। জীবনের সুন্দর স্মৃতিগুলোকেই শেয়ার করেছেন আমাদের জন্য। খেদহীন কণ্ঠে বলেছেন—স্মৃতিগুলো সুখের ছিল। বইটি পাঠকহৃদয় স্পর্শ করুক—এমনটাই কামনা।