যতীন সরকার ও বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’ প্রসঙ্গ
১
‘বাংলা কবিতার মূলধারা কোনটি?’—এরকম প্রশ্ন সাধারণত কেউ করে না। পাঠের অভ্যাস ও প্রবণতা, লিখিত নথিপত্র ও পদ্ধতিগত ইতিহাস ইত্যাদির নিরিখে এ প্রশ্নের উত্তর আসলে পাঠকমাত্রেরই জানা। কিন্তু যতীন সরকার প্রশ্নটি তুলেছেন। বেশ কয়েকবারই তুলেছেন বিভিন্ন প্রসঙ্গে। তুলনামূলক বড় পরিসরে গুছিয়ে কথাটা উত্থাপন করেছেন ‘বাংলা কবিতার মূলধারা ও জালাল উদ্দীন খাঁ’ প্রবন্ধে। লেখাটি তিনি ছাপিয়েছেন জালালগীতিকা সমগ্রের [নন্দিত, ঢাকা, ২০০৫] ভূমিকা হিসাবে। এ লেখা এবং তাঁর আরো বেশ কয়েকটি প্রবন্ধ প্রমাণ করে, যাকে আমাদের সাহিত্যিক সংস্কৃতিতে মোটাদাগে ‘লোকসাহিত্য’ নামে ডাকা হয়, সে সাহিত্যধারায় যতীন সরকারের যথেষ্ট আগ্রহ ও দখল আছে। কাজেই তাঁকে আমরা ‘লোকসাহিত্যবিদ’ অভিধায় সম্মানিত করতে পারি। অন্য বহুজনকে একই ধরনের আগ্রহ ও অধিকারের ভিত্তিতে আমরা এ অভিধা দিয়েছি। কিন্তু লক্ষণ দেখে মনে হচ্ছে, তিনি নিজে এ ধরনের অভিধা তো চানই না, উপরন্তু অন্য যাঁরা এই প্রচলিত সংজ্ঞা মোতাবেক কাজ করে ওই অভিধা অর্জন করেছেন, তাঁদের ব্যাপারেও তাঁর ঘোরতর আপত্তি আছে। কারণ ‘লোকসাহিত্য’ কথাটা উচ্চারণমাত্রই একটা প্রান্তিকতা ঘোষিত হয়, আর অন্য কোনো ‘মূলধারা’র বিপরীতেই কেবল সে প্রান্তীয় ধারা বিবেচ্য হয়। ঠিক এখানেই যতীন সরকার প্রবলভাবে আপত্তি জানান, আর দাবি করেন, যাকে আমরা প্রায় সবাই মিলে ‘লোকসাহিত্য’ বলে সাব্যস্ত করেছি, সেটাই আসলে বাংলা কবিতা তথা সাহিত্যের ‘মূলধারা’।
খুব বড় দাবি, সন্দেহ নাই। কিন্তু তিনি কোন যুক্তিতে দাবিটা করছেন? ‘বাংলা কবিতার মূলধারা ও জালাল উদ্দীন খাঁ’ প্রবন্ধ থেকে তাঁর বক্তব্যের সারবাহী এক অনুচ্ছেদ উদ্ধৃত করছি:
আমরা, ‘শিক্ষিত’ মানুষজন, আসলে কতকগুলো দুর্মর কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। এগুলো ‘আধুনিকতা’র কুসংস্কার। তথাকথিত আধুনিক শিক্ষাই আমাদের মস্তিষ্ককোষে সেইসব কুসংস্কার ঢুকিয়ে দিয়ে নিদারুণ মানস-প্রতিবন্ধের সৃষ্টি করেছে। সেরকম মানস-প্রতিবন্ধের দরুনই আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিহাসকেও আমরা খণ্ডিত করে ফেলেছি, একটা খণ্ড অংশকেই সমগ্রের মর্যাদা দিয়েছি। বাংলা সাহিত্যের মূলধারা বলে আমরা ধরে নিয়েছি ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মধ্যবিত্তের সৃষ্ট সাহিত্যকে। এর বাইরে বিশাল বাংলায় গ্রামীণ কৃষিজীবী ও অন্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে এসেছেন যে-সব কবি, শতকরা নব্বই জন মানুষ যাঁদের কবিতা বা গান তথা সাহিত্যের উপভোক্তা—তাঁদের তো আমরা গণনীয়ই বিবেচনা করিনি। অথচ এঁরাই আবহমান বাংলার গণকবিতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন।
খুব পরিচ্ছন্ন বক্তব্য। ‘আধুনিকতা’জনিত কুসংস্কারের কারণেই ইংরেজি-শিক্ষিত মানুষেরা ইংরেজি-শিক্ষিত নাগরিক মানুষজনের লেখা সাহিত্যকে ‘মূলধারা’ বলছে। কিন্তু আসলে ‘মূলধারা’ বলা উচিত ছিল বাংলার কৃষকসমাজ ও অন্য বৃত্তিজীবীদের মধ্য থেকে উঠে আসা কবিদের রচনাকে। কোন যোগ্যতায়? যোগ্যতা দুটি। দেশের শতকরা নব্বইভাগ মানুষ ওই সাহিত্যের ভোক্তা; আর ওইসব কবি ‘আবহমান বাংলার গণকবিতার ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন’। এ থেকে আমরা সিদ্ধান্ত নিতে পারি: যেসব রচনাকে ‘মূলধারা’র সম্মান দেয়ার কারণে যতীন সরকার শিক্ষিতসমাজকে কুসংস্কারগ্রস্ত বলছেন, সে ধারার অযোগ্যতাও ওই দুই জায়গায়। ওই সাহিত্যের উৎপাদন ও ভোগের সাথে দেশের খুব নগণ্য সংখ্যক মানুষ যুক্ত; আর বাংলার আবহমান কাব্যধারার সাথে যোগের বদলে ওই সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য ছেদ বা বিচ্যুতি।
প্রাথমিকভাবে এ বক্তব্যের সাথে হয়তো খুব বেশি দ্বিমত ওই ‘কুসংস্কারগ্রস্ত’ মানুষজনও করবে না। কিন্তু এ ভঙ্গিতে সাহিত্যের ইতিহাস লিখতে গেলে বা সাহিত্যের আনুষ্ঠানিক পাঠের বন্দোবস্ত করতে গেলেই বাধবে গোল। উৎপাদন-সম্পর্কের বিচারে যারা কর্তাশ্রেণি, তারা নিজেদের সাহিত্যিক-সাংস্কৃতিক অভিব্যক্তিকে গৌণ বলতে সম্মত হতেও পারে; কিন্তু তাতেই তার অবস্থান গৌণ হয়ে যায় না। তাছাড়া ওই ভদ্রলোকসমাজ যতীন সরকার-কথিত ‘মূলধারা’কে কাব্যের মূলধারা না বললেও এর আদর-কদর যে খুব একটা কম করেছে, তা-ও নয়। এমতাবস্থায় আবেগী প্রতিবেদনের বাইরে বর্তমান মূলধারাকে পদ্ধতিমাফিক বদলে ফেলা, বা এমনকি বদলে ফেলার কোনো সারগর্ভ প্রস্তাব উপস্থাপন করা খুব সহজ কাজ নয়। দেখা যাক, যতীন সরকার এ বাবদ কিভাবে এগিয়েছেন।
তিনি বাংলা সাহিত্যের যুগবিভাগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। সে প্রশ্ন অবশ্য অনেকেই তুলেছেন। তাঁর বড় প্রশ্ন ‘আধুনিক’ যুগ নিয়ে। কারণ, এ যুগেই আমাদের শিক্ষিত শ্রেণির প্রভাবশালী সাহিত্যধারায় ওই দুই বিচ্যুতি ঘটেছে: আবহমান বাংলা সাহিত্যের সাথে বিচ্ছেদ, এবং বিপুল জনমানুষের সাথে বিচ্ছেদ। তাহলে তিনি কি ওই আধুনিকতার দাবিকে নস্যাৎ করে দিচ্ছেন? না, তিনি ওই আধুনিকতার ঘটনার প্রধান দাবিগুলোর সবগুলোর সাথেই একমত। শুধু প্রস্তাব করেছেন, এই স্বীকৃত আধুনিকতার বাইরে বাংলার বিপুল জনগণের মধ্যে এবং জনগণের সৃষ্টিশীল মানুষদের মধ্যেও আধুনিকতার নানা ঘটনা ধারাবাহিকভাবে ঘটেছে। সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে সেগুলোর পর্যালোচনা করতে হবে।
যতীন সরকার তথাকথিত মধ্যযুগের কবিদের একটা ছোট্ট পর্যালোচনায় দেখাচ্ছেন, লোকায়ত ধর্ম ও জ্ঞাননির্ভর ওসব রচনায় এমন সব বৈশিষ্ট্য খুব জোরালোভাবে হাজির, যেগুলোকে আমরা সেকালের ‘আধুনিকতা’ বলে সাব্যস্ত করতে পারি। ওই ধারাটাই উনিশ-বিশ শতকের ভদ্রলোকি আধুনিকতার সাথে সম্পর্কহীনভাবে নিজস্ব বলয়ে সৃষ্টিশীলতা অক্ষুণ্ন রেখে এগিয়েছে। কাজেই এটা নিশ্চিতভাবে বাংলা সাহিত্যের সনাতন ধারা। সনাতন, কিন্তু গতিশীল। ভদ্রলোকেরা এ সাহিত্যকর্মের প্রশংসা করেছে; উপভোগও করেছে কখনো কখনো। কিন্তু যে-বর্গীকরণের ভিত্তিতে ওই প্রশংসা বা উপভোগ হয়েছে, তাতে যতীন সরকারের বেজায় আপত্তি। তিনি জানেন, লালন বা মনসুর বয়াতি বা এরকম অন্য অনেক সৃষ্টিশীল মানুষকে ‘বিস্ময়কর প্রতিভা’ বলে গণ্য করলেও ভদ্রলোকেরা নাগরিক আধুনিক কবিদের সাথে এঁদেরকে এক পঙ্ক্তিতে বসাবেন না। এঁদের ফেলবেন ‘লোককবি’ অভিধায়। অথচ লোককবি শব্দটি, যতীন সরকার দেখাচ্ছেন, ওই ভদ্রলোকদের তৈরি-করা সাহিত্যশাস্ত্র মোতাবেকই অগ্রহণযোগ্য। কারণ, এঁরা অনামা-অচিহ্নিত কেউ নন। একেবারেই স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বসম্পন্ন আলাদা ব্যক্তি-সাহিত্যিক।
তাহলে যতীন সরকার কি ‘লোককবি’ অভিধাটি বাদ দিয়েছেন? না। আমরা বলতে পারি, তিনি অভিধাটিকে সমস্যায়িত করেছেন, এবং ‘লোকায়ত’ শব্দটির ঐতিহাসিক-দার্শনিক তাৎপর্যকে সামনে এনে, লোকায়ত অর্থে ‘লোককবি’ কথাটা অনুমোদন করেছেন। এ প্রবন্ধে এবং অন্য আরো অনেক লেখায়—যার কোনো কোনোটি আমরা আমাদের বর্তমান আলোচনায় ব্যবহার করব—যতীন সরকার বিশদ বাংলার বেশ কয়েকজন কবির বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন, অসাম্প্রদায়িকতা, বস্তুবাদী মনোবৃত্তি, মানবিক প্রত্যয়, ধর্মশাস্ত্রের পর্যালোচনা ইত্যাদি ঘোরতর আধুনিক বৈশিষ্ট্যে বাংলার লোকায়ত বা সনাতন ধারার সাহিত্য এতই সমৃদ্ধ যে, একে ‘আধুনিক’ বলতে আপত্তি করা কুসংস্কারই বটে। জালাল উদ্দীন খাঁকে তিনি এ ধারার, অর্থাৎ ‘বাংলার মূলধারার কবি’ হিসাবেই বিশ্লেষণ করেছেন।
তাঁর সামগ্রিক বিশ্লেষণে ‘বাংলার মূলধারার কবি’ কথাটা দাঁড়িয়েছে একটা পারিভাষিক শব্দের মতো, যার মধ্যে সুভাষণের ইশারা আছে। তিনি প্রতিষ্ঠিত ধারণাগুলোকে রদ করতে চান নাই; বরং ওগুলোর পূর্ণতা চেয়েছেন। যে উপায়ে নগণ্য সংখ্যক মানুষ বিপুল অধিকাংশের সাথে সম্পর্কহীন থেকেও সবার কর্তা হয়ে উঠল, সে প্রক্রিয়াকে বাতিল করেন নাই। অর্থাৎ, উপনিবেশায়ন প্রক্রিয়াকে বহাল তবিয়তে থাকতে দিয়েছেন। কিন্তু ওই প্রক্রিয়ার যে ফল ফলেছে, তার নিন্দা করেছেন। ওই প্রক্রিয়ার প্রধান ফল ‘আধুনিকতা’য়ও তাঁর বিশেষ কোনো আপত্তি নাই। তাঁর দৃষ্টিতে, কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দিয়ে ওই কুফলের নিরসন সম্ভব।
আমরা যতীন সরকারের এ ধরনের অবস্থানের অকথিত ভিত্তিগুলো সংক্ষেপে বুঝতে চাইব। এ সূত্রে উন্মোচন করতে চাইব তাঁর চিন্তার পদ্ধতিগত কয়েকটি দিক।
২
বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’র প্রশ্নটি যেকোনো অর্থেই উনিশ শতকের কলকাতার বাস্তবতায় বিবেচ্য। একসময় কলকাতাস্থ উনিশ শতকীয় ঘটনা ও ভাববোধির স্বরূপ বোঝানোর জন্য ‘রেনেসাঁস’ কথাটা প্রচলিত হয়েছিল। বিস্তর মত-মতান্তর ও ভিন্নমতের মধ্য দিয়ে গিয়ে এখন ওই কথাটার রূপ দাঁড়িয়েছে এরকম যে, রেনেসাঁ ওই সময় সংঘটিত হয়েছিল, তবে এর নানারকম সীমাবদ্ধতা ছিল। কাজেই একে খণ্ডিত রেনেসাঁ বলা যায়। যতীন সরকার রেনেসাঁর ধারণা কবুল করেন; তবে তার সীমাবদ্ধতার উল্লেখ থাকাটাও জরুরি মনে করেন। শুধু তাই নয়, ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁস বিষয়ে অন্যতর ভাবনা’ প্রবন্ধে তিনি সত্যি সত্যি এমন প্রস্তাব দিয়েছেন, যা সম্ভবত এর আগে শোনা যায় নাই।
তাঁর প্রস্তাবের মর্মকথা এরকম: কলকাতার নাগরিক রেনেসাঁস নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ভাবগত যে উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছিল, তার নানারকম প্রভাব মফস্বল শহরে আর গ্রামেও দেখা গেছে। প্রান্তের এসব উদ্যোগ-আয়োজনে বরং কলকাতার রেনেসাঁসের সীমাবদ্ধতাগুলোর কোনো কোনোটির অন্তত আংশিক নিরসন ঘটেছে। যেমন তিনি ঢাকার বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের কথা বলেন। এ কথা অবশ্য আরো বহুজন বলেছেন। কিন্তু এর মধ্য দিয়ে কলকাতার রেনেসাঁয় মুসলমান সমাজের অনুপস্থিতির একরকম ক্ষতিপূরণ হওয়ার প্রস্তাব তিনি তুলেছেন। কথা হিসাবে এটা খুব প্রচলিত নয়। এরপর আরো এগিয়ে তিনি গিরীশচন্দ্রের কথা বলেন। কৃষ্ণকুমার মিত্রের প্রসঙ্গ টানেন। ময়মনসিংহের এ দুই কৃতী ব্যক্তি যথাক্রমে কোরানের অনুবাদ করে এবং মুহম্মদ চরিত রচনা করে, তাঁর মতে, ‘বঙ্গীয় রেনেসাঁসের সাম্প্রদায়িক চরিত্রকে কিছুটা পরিমাণে হলেও সংশোধন করতে পেরেছেন’। আরেক ধরনের উদাহরণ তিনি চয়ন করেছেন কাঙাল হরিনাথ, অশ্বিনীকুমার দত্ত প্রমুখের কাজ থেকে। এঁরা দুজনই কলকাতার আলো চারিয়ে দিয়েছেন ঘোর মফস্বলে। কলকাতা ও লোকায়ত বাংলার সংযোগসেতু হিসাবে হরিনাথের সাথে আমাদের বিলক্ষণ পরিচয় আছে। যতীন সরকার বরং বেশ কতকটা চাঞ্চল্য তৈয়ার করেন বরিশালের মুকুন্দদাসের প্রসঙ্গ তুলে। তাঁর মতে, ‘অশ্বিনীকুমার দত্ত রেনেসাঁসের যে উৎসার ঘটিয়েছিলেন, মুকুন্দদাস তারই মধ্যে লোকায়ত চৈতন্যকে প্রবাহিত করে দিয়ে যথার্থ বেগবান করে তুলেছিলেন।’ (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, কথাপ্রকাশ, ঢাকা, পৃ. ১৩৭)
আরো অগ্রসর হয়ে তিনি লোকায়ত বাংলার প্রতিনিধি হিসাবে লালনের প্রসঙ্গ তোলেন। রামমোহনের প্রায় সমকালে জন্ম নেয়া এই ভাবুকের ভাবজগৎকে তিনি রামমোহনদের সৃষ্ট কলকাতার নাগরিক রেনেসাঁসের সমান্তরালে স্থাপন করেন, এবং প্রস্তাব করেন, ‘পল্লীর জনগণের মধ্যে রেনেসাঁস চৈতন্যকে জাগ্রত রেখেছিলেন লালন ও তাঁর শিষ্য-প্রশিষ্যবৃন্দ।’ (পৃ. ১৩৪) এভাবে তাঁর মতে, নাগরিক রেনেসাঁসের পাঁচভাগ আর লোকায়ত রেনেসাঁসের পঁচানব্বই ভাগ মিলে বাংলার রেনেসাঁস সমগ্র বাঙালির প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। অন্যদিকে আবার, কলকাতার তত্ত্বজ্ঞানীদের প্রণীত রেনেসাঁসের ইতিহাসের মধ্যে যে-সীমাবদ্ধতা প্রকট ছিল, পূর্ববঙ্গের তাত্ত্বিকদের ইতিহাসচর্চায় তার অপনয়ন ঘটেছে বলেই তাঁর ধারণা। এ বাবদ তিনি আনিসুজ্জামান ও মুনতাসীর মামুনের ইতিহাস-গবেষণাকে বিশেষভাবে মূল্যবান মনে করেন।
যতীন সরকার বঙ্গীয় রেনেসাঁসের খণ্ডিত বাস্তবতা অপনয়নের জন্য যেসব তরিকা বেছে নিয়েছেন, সেগুলো জ্ঞানতাত্ত্বিক ও পদ্ধতিগত প্রশ্নে মোটেই ঘাতসহ নয়। যে কেউ বলতে পারেন, কলকাতার তৎপরতাকে কেন্দ্র করে রেনেসাঁসের যে-ধারণা বিকশিত হয়েছে, তার আওতায় অশ্বিনীকুমার বা এমনকি গিরীশচন্দ্রকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ থাকলেও লালনকে ব্যাখ্যা করার সুযোগ আসলে নাই। তাতে সংজ্ঞা হিসাবে খোদ রেনেসাঁসের ধারণাই হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে। দরকার হবে নতুন সংজ্ঞায়ন। সে ধরনের কোনো উদ্যোগের প্রয়োজনও তিনি বোধ করেন নাই। কারণ, বঙ্গীয় রেনেসাঁস তাঁর প্রায় যে কোনো চিন্তার বনিয়াদ। ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী’ যে-ধ্যানধারণার ভিত্তিতে তিনি বাংলাদেশের জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি প্রণয়ন করতে চান, তার মূলেও আছে ওই রেনেসাঁস এবং রেনেসাঁস-উদ্ভূত চিন্তাধারা। তাঁর চিন্তার এ দিকটা অন্য সকল জায়গার মতো এ প্রবন্ধেও তিনি পষ্ট করেই বলেছেন। একদিকে এ চিন্তার বিরোধী পাকিস্তানবাদী ধ্যান-ধারণাকে তিনি ‘সংকীর্ণ, যুক্তিবিচারহীন ও একদেশদর্শী’ হিসাবে চিহ্নিত করেন; অন্যদিকে রেনেসাঁর ধারণার পর্যালোচনার নামে আমরা যেন ‘বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ’-এর খপ্পরে না পড়ি, সে বিষয়েও সাবধান করে দেন। ফলে রেনেসাঁসের ধারণাটি তাঁর কাছে কেন এত জরুরি, তা পরিষ্কার বোঝা যায়।
শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধের ভূমিকায় নিজের চিন্তাধারার পরিচয় দিতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, ‘জীবন ও জগতের সব কিছুকে দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে’ দেখাই তাঁর লক্ষ্য। বঙ্গীয় রেনেসাঁসের পর্যালোচনার ক্ষেত্রেও তিনি ‘বস্তুনিষ্ঠ বৈজ্ঞানিক দৃষ্টি’র কথা বলেছেন। তবে তাঁর কিংবা যাঁদের বরাত ব্যবহার করে তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন তাঁদের বিশ্লেষণ—বস্তু ও যুক্তিনিষ্ঠ হলেও কোনো দিক থেকেই ‘দ্বান্দ্বিক ও ঐতিহাসিক’ অর্থে ‘বৈজ্ঞানিক’ নয়। এটা বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদী স্কুলের খুব সাধারণ প্রবণতা: জাতীয়তাবাদী প্রশ্নে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদী পদ্ধতিকে মুলতবি রাখা। প্রশ্ন হলো, এই গভীর পদ্ধতিগত ঝামেলা সঙ্গী করে তিনি রেনেসাঁসের ধারণাকে উচ্চকিত করতে চান কেন? ব্যাপারটা বোঝার জন্য আমরা শিবনারায়ণ রায়ের উদাহরণ দেব। শিবনারায়ণ রায় বঙ্গীয় রেনেসাঁস ধারণার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রচারক। যতীন সরকারের প্রায় সমসাময়িক ব্যক্তি তিনি। তবে বিশুদ্ধ উদারনীতিবাদী। ফলে তাঁর পক্ষে পদ্ধতি মান্য করে রেনেসাঁর সাবুদ তৈয়ার করা কঠিন হয় নাই। আফটার অল, কলকাতার রেনেসাঁ তো একটা কলোনিয়াল-লিবারেল ঘটনা। এ রেনেসাঁ সংকীর্ণ নাকি খণ্ডিত— এ বিবাদে শিবনারায়ণের কিছুই যায় আসে না। তিনি বরং উল্টা দেখান, ইতালির রেনেসাঁও একটা বড়লোকি ব্যাপার ছিল, এর সাথে দেশের ও দশের আর্থিক উন্নতির সম্পর্ক ছিল না, এবং মুখ্যত ব্যক্তিসমূহের বিকাশই ছিল ওই রেনেসাঁর প্রধান লক্ষণ। এদিক থেকে, তাঁর বলতে কোনো অসুবিধা হয় না, বাংলার রেনেসাঁসের স্বভাব আদতে মূল ইতালীয় রেনেসাঁর মতোই।
লক্ষ করার মতো ব্যাপার, দৃষ্টিভঙ্গি ও আকুলতায় ফারাক থাকলেও পদ্ধতিগত প্রশ্নে দুজনের মিলের পরিমাণই বেশি। যতীন সরকার তাঁর লেখার শুরুতে মার্কসবাদী তাত্ত্বিকদের কথা বেশি বলেছেন। এতে বিভ্রান্ত হওয়ার কোনো কারণ নাই। নরহরি কবিরাজের উল্লেখ করলেও পদ্ধতিগতভাবে তিনি মার্কসবাদী পন্থায় কোনো সিদ্ধান্ত নেন নাই। সত্তরের দশক থেকে কলকাতায় নব্য মার্কসবাদী ঘরানার— যেমন সাবলটার্ন গোষ্ঠী— যে-বিপুল উত্থান ঘটে, আর প্রধানত উনিশ শতকের ভারত ও বাংলার পঠন-পাঠনে যে-বিপুল নতুনত্ব আসে, যতীন সরকারের লেখালেখিতে তার উল্লেখমাত্র নাই। এই বিশাল এবং প্রভাবশালী স্কুলের সাথে তুলনা করলেই বোঝা যাবে, কেন আমরা শিবনারায়ণ রায়ের সাথে তাঁর পদ্ধতিকে সাযুজ্যপূর্ণ বলেছি। আর আমরাও এ প্রশ্ন তোলার মওকা পেয়ে যাব, কেন শিবনারায়ণকে এরপর আর আগাতে হয় না, কিন্তু যতীন সরকার শুরুই করেন ওই জায়গা থেকে।
শিবনারায়ণ রায়ের কাছে বাংলার রেনেসাঁস এক ঐতিহাসিক ঘটনা। এর বুদ্ধিবৃত্তিক ও সৃষ্টিশীল অর্জন তাঁর নিত্য অস্তিত্বের অংশ। বিপুল বাদ-পড়া মানুষের কথা তিনি একেবারে ভাবেন না, তা নয়। কিন্তু তাঁর কাছে ওই সমস্যার সমাধান খুবই সোজা। লিবারেল কায়দায় চুইয়ে-পড়া ঢঙে এ আলো বাকিদের অন্দরে পৌঁছাবে। এর কোনোটাতেই যতীন সরকারের আপত্তি নাই। তবে এর সাথে বঙ্গীয় রেনেসাঁসকে সাথে নিয়ে তিনি আরো অন্তত তিন ধাপ সামনে বাড়তে চান। বিশেষত পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের জন্য। এক. তাঁর জাতীয়তাবাদী সত্তার নিরিখ ওই বঙ্গীয় রেনেসাঁস। পূর্ব বাংলা বা বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে তাই ওই রেনেসাঁসের খণ্ডিত মূর্তি পূর্ণরূপে পুনরুদ্ধার তাঁর জন্য জরুরি। দুই. আধুনিকায়ন, প্রগতিশীলতা, মানবতাবাদসহ অনেকগুলো লিবারেল বর্গ সামষ্টিকভাবে চর্চার জন্য তিনি ওই আমল ও তার অর্জনকে নিক্তি হিসাবে ব্যবহার করতে চান। ফলে তাঁর জন্য এটা শুধু অতীতের হিসাব-নিকাশ নয়, রীতিমতো তাজা বর্তমান। তিন. তিনি বঙ্গীয় রেনেসাঁসের ভাবগত প্রেরণা চান; কিন্তু আবার চান দেশের শতভাগ মানুষ যেন সে ভাবগত অঙ্গীকারের আওতায় পড়ে। প্রবল-প্রতাপ পাঁচভাগ মানুষের জোরালো রেনেসাঁসের সাথে তাই তাঁকে দুর্বল পঁচানব্বই ভাগ মানুষের রেনেসাঁসও সাব্যস্ত করতে হয়, যাতে তাঁর প্রকল্পে দেশের শতভাগ মানুষকে একীভূত করা যায়।
প্রথম দুটি অন্য কারো কারো মধ্যেও পাওয়া যাবে। কিন্তু তৃতীয় আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে যতীন সরকারীয়। প্রকল্পে দেশের সকল মানুষকে অঙ্গীভূত করার অঙ্গীকার বাংলাদেশের বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় খুব সুলভ নয়। যতীন সরকার পদ্ধতিগতভাবে না হোক, আকাঙ্ক্ষার দিক থেকে বারবার কাজটা করতে চেয়েছেন। তাঁর কাছে যেহেতু অসাম্প্রদায়িক, ধর্মনিরপেক্ষ, উদার-মানবতাবাদী, বস্তুবাদী ইত্যাদিসহ রেনেসাঁসের ভাবগত প্রেরণার দিকটাই প্রধান, তিনি খুব সহজেই বাংলার লোকায়ত সাহিত্যধারায় এর সাযুজ্য খুঁজে পান। সে সূত্র ধরে বঙ্গীয় রেনেসাঁসকে প্রসারিত করেন শতভাগ মানুষ পর্যন্ত। লোকায়ত সাহিত্যধারাকে বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’ হিসাবে ঘোষণা করা এ প্রক্রিয়ার পরবর্তী ধাপ মাত্র।
৩
‘ইকবাল আমাদের’ প্রবন্ধের এক জায়গায় প্রসঙ্গত তিনি নিজের চিন্তাভাবনার একটা চাবিধারণা প্রকাশ করেছেন। লিখেছেন: ‘ভাববাদী মাত্রই প্রতিক্রিয়াশীল, আর যে কোনো বস্তুবাদীই প্রগতিশীল— এমন ধারণা যান্ত্রিকতা দোষে দুষ্ট এক দুর্মর কুসংস্কার।’ ( শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃ. ২৪)
তাঁর কালের স্বভাব ও ভাষার অনুগামী হয়ে তিনি ‘ভাববাদ-বস্তুবাদ’ শব্দজোড়ই ব্যবহার করেন; কিন্তু এ ধরনের বিপরীত শব্দজোড়ে চিন্তা ও অবস্থানকে চূড়ান্তভাবে বুঝতে চাওয়ার বিপদ সম্পর্কেও হুঁশিয়ার থাকেন। একালে এ ধরনের চিন্তার মুসিবত বোঝার জন্য আমাদের হাতে যথেষ্ট পরিমাণে মাল-মসলা ও কলাকৌশল আছে। যতীন সরকারদের আমলে সেরকম ছিল না। তবু তিনি যে বারবার এ সংকট সম্পর্কে উপলব্ধির কথা তাঁর লেখালেখিতে প্রকাশ করেছেন, সেটা তিনি অর্জন করেছেন বস্তুত সমাজ-প্রগতি হাসিলের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করেই। সোভিয়েত ইউনিয়নের ফ্রেমে সমাজতন্ত্রকে বোঝার যে-রেওয়াজ উনিশ শ তিরিশের দশক থেকে বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর প্রধান প্রবণতা, যতীন সরকার মোটেই তার বাইরের কেউ নন। কিন্তু বাস্তবে বস্তুবাদী দর্শনের দেশ-কালের উপযোগী কার্যকর রূপ সম্পর্কে সবসময় তৎপর এবং বিচলিত ছিলেন বলেই তিনি দেশীয় বাস্তবতা সম্পর্কেও নানা নতুন চিন্তাভাবনার দিকে গেছেন। বাংলার লোকায়ত সাহিত্য বিষয়ে তাঁর বিশেষ মনোযোগ ও লেখালেখির অন্তর্নিহিত স্বর পর্যালোচনা করে বলতে পারি, চিন্তাভাবনার ওই অংশ তাঁর অন্যতম প্রধান অর্জন।
‘বাঙালির লৌকিক ঐতিহ্যে সমাজতান্ত্রিক উপাদান’ প্রবন্ধে লেখক বিস্তৃত পরিসরে খোঁজাখুঁজি করেছেন, এবং লক্ষ করেছেন, ‘লৌকিক বৌদ্ধ, লৌকিক হিন্দু আর লৌকিক ইসলাম আলাদা খোপে আবদ্ধ হয়ে থাকে না প্রায়শই, নানাভাবে জড়িত মিশ্রিত হতে হতে এরা একাকার হয়ে যায়, কৌম ঐতিহ্যসম্পন্ন বাঙালির লোকচেতনায় বিচিত্র বর্ণবিন্যাসের সংযোজন ঘটায়, বৈচিত্র্যের মধ্যে প্রতিবাদী ঐক্যের বেগবান প্রবাহ সৃষ্টি করে।’ (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃ. ৪৭) এর উদাহরণ তিনি তালাশ করেন প্রাচীন ও মধ্যযুগের কাব্যে, আর লোকায়ত সাহিত্যকর্মের বিপুল সম্ভারে। তাঁর সিদ্ধান্তের ধরনটি কেমন? এ প্রবন্ধের এক জায়গায় তিনি লিখেছেন, ‘লালন-শিষ্য দুদ্দু শাহের গানে আরো স্পষ্ট করে সমাজতান্ত্রিক চেতনার পরিচয় বিধৃত হয়েছে।’ (পৃ. ৫৫)
সমাজতান্ত্রিক চেতনার, তাঁর কাছে, কতগুলো মতাদর্শিক-আদর্শগত নিক্তি আছে। যেমন, অসাম্প্রদায়িকতা, মানবতাবাদ, পোশাকি ধর্মের প্রতি বিতৃষ্ণা এবং এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে বিরুদ্ধতা, শোষক-নিপীড়কের ব্যাপারে সচেতনতা। এর বাইরে আছে সক্রিয়তার দিক। বাস্তবে অত্যাচারী বা সামগ্রিক শোষকপক্ষের বিরুদ্ধে মাঠে নেমে পড়া ওই আদর্শগত অবস্থান থেকে একেবারেই ভিন্ন এক তৎপরতা। যতীন সরকার স্বভাবতই সে ধরনের আন্দোলন-সংগ্রামের ব্যাপারেও উৎসাহী। সত্যি বলতে কি, সমাজতন্ত্রের বাস্তব প্রয়োগের ব্যাপারে উদগ্রীব ছিলেন বলে, পুরোনো আন্দোলন-সংগ্রামই হয়েছে তাঁর খোঁজাখুঁজির অন্যতম প্রধান এলাকা। তিনি পাগলপন্থী বিদ্রোহের কথা বলেন, বাংলা অঞ্চলের অগণিত কৃষক-আন্দোলনকে নিজের অভিযানের সাথী হিসাবে দেখতে চান, এবং আন্দোলনগুলোর পেছনে বাংলা অঞ্চলের সাধারণ মানুষের লোকায়ত ধারণাসকল-যে অন্যতম মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে, তার উল্লেখ করতেও ভোলেন না। স্বভাবতই তিতুমীর-দুদু মিয়ার আন্দোলনও তাঁর নজর কাড়ে।
কিন্তু তিতুমীর-দুদু মিয়ার আন্দোলনকে ‘লৌকিক ঐতিহ্যে সমাজতান্ত্রিক উপাদান’ খোঁজার এ অভিযানে শামিল করা মোটেই সহজ কাজ নয়। প্রভাবশালী ভাষাকাঠামো এ ধরনের একীকরণের অন্তরায়। খোদ যতীন সরকার যে-ভাষাকাঠামো ব্যবহার করেন, তাও খুব আলাদা কিছু নয়। যেমন তিনি ‘বাঙালি’ অভিধাটি ব্যবহার করেন। ‘বাঙালি সংস্কৃতি’র কথাও বলেন। এছাড়া আর কী অভিধা ব্যবহার করা যেত, বা এ ধরনের ব্যবহারের আদৌ কোনো মুসিবত আছে কি না, সে আলাপে না গিয়েও বলা যাবে, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ নামে উনিশ শতকের কলকাতায় বিকশিত সামগ্রিক মহাবয়ানের মধ্যে পাগলপন্থী আন্দোলন বা অন্য কৃষক-আন্দোলনগুলোকে যত সহজে অঙ্গীভূত করা যায়, তিতুমীর-দুদু মিয়ার আন্দোলনকে তত সহজে যায় না। ‘মৌলবাদী’ বলে অন্য যে-পরিভাষা তিনি ব্যবহার করেছেন, তার বেলায়ও ওই একই রকমের সতর্কতা দরকার।
এখানে বলে রাখা ভালো, ‘বাঙালি সংস্কৃতি’ বলে হাজার বছরের বা আবহমান কিছু আছে, কিংবা ‘মৌলবাদী’ শব্দটির কোনো স্থান-কাল নিরপেক্ষ ‘চিরন্তন’ কিসিমের অর্থ আছে— এরকম বালসুলভ অনুমান না থাকাই ভালো। অন্তত কাঠামোবাদ-পরবর্তী দুনিয়ার গত ষাট বছরের চিন্তাধারায় এ ধরনের অনুমান হাস্যকর গণ্য হতে বাধ্য। পঞ্চাশ থেকে আশির দশকে বিকশিত ও সক্রিয় ঢাকাকেন্দ্রিক বুদ্ধিজীবীদের অনেকের মধ্যে, বলা উচিত বেশিরভাগের মধ্যে, প্রভাবশালী বাস্তবতার নিরিখেই ‘বাঙালি সংস্কৃতি’, ‘মৌলবাদ’ ইত্যাদি গুরুতর ভাবাদর্শিক সংজ্ঞা নির্মিত হয়েছিল। এগুলো তাঁদের চিন্তার চাবি-ধারণা হিসাবে কাজ করেছিল। যতীন সরকার মোটেই এর বাইরের কেউ নন। হওয়া জরুরিও নয়।
সে কারণেই যতীন সরকার তিতুমীর-দুদু মিঞার আন্দোলনকে বাংলার লোকায়ত ঐতিহ্য হিসাবে গ্রহণ করার আগে ব্যাখ্যা দেয়ার প্রয়োজন বোধ করেন। তিনি মনে করেন, ‘তিতুমীর দুদু মিঞার ওয়াহাবী-ফরাজী মতবাদ ধর্মীয় মৌলবাদের সৃষ্টি।’ (পৃ. ৫৬) কিন্তু মৌলবাদী এসব ধারার সাথে তো ‘লৌকিক ধর্মানুসারী কৃষক জনসাধারণের সংঘাত’ হওয়ার কথা। দেখা যাচ্ছে, সেরকম কিছু হয় নাই। উল্টো, ‘বাংলার কৃষক জনগণ বিপুল সংখ্যায় তিতুমীর-দুদু মিঞার নেতৃত্বে সংঘবদ্ধ হয়েছে’। যতীন সরকার প্রশ্ন তুলেছেন, তাহলে কি ‘এ সময় কৃষকরা লৌকিক ধর্মচেতনা পরিত্যাগ করে মৌলবাদী হয়ে উঠেছিল?’
তাঁর কাছে এ প্রশ্নের উত্তর না-বাচক। সেদিকে যাওয়ার আগে বলে নেয়া দরকার, যতীন সরকার এ প্রশ্নের পরেও-যে বিশ্লেষণে অগ্রসর হয়েছেন, তা তাঁর কালের— তাঁর বৃহত্তর বলয়ের— ঢাকাই বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশ থেকে তাঁকে আলাদা করে ফেলেছে। ঢাকার প্রভাবশালী ডিসকোর্সে এটা সাধারণত প্রশ্ন হিসাবে হাজির হয় না। হাজির হয় নিশ্চয়তা হিসাবে। তাতে বাস্তবের তথ্য-উপাত্ত যদি সমর্থিত নাও হয়, কিছু যায় আসে না। কিন্তু এটুকুতে যতীন সরকারের চলে না। কারণ, তিনি লোকায়ত বাংলার ভাব-স্বভাব বিষয়ে আন্তরিক তত্ত্বতালাশ করতে চান। চিন্তাপদ্ধতির গড়নের কারণেই তাঁকে করতে হয়। ওই যে কৃষকসমাজ ওয়াহাবি-ফরায়েজিদের সাথে একাত্ম হয়ে আন্দোলন-সংগ্রাম করেছিল, আর উৎপাদন-সম্পর্কের বাস্তবতার মধ্যে অর্গানিক জীবনযাপন করেছিল, সে তথ্য তিনি কিছুতেই এড়িয়ে যেতে পারেন না। তাঁর চিন্তাকাঠামো এড়িয়ে যেতে দেয় না। আবার ওই চিন্তাকাঠামোর আরেক দিকের প্রভাবেই তাঁর উত্তরটা বিশিষ্ট আকার লাভ করে। কী সেই উত্তর?
যতীন সরকারের সিদ্ধান্ত: কৃষকরা মৌলবাদী হয় নাই, ‘বরং মৌলবাদের নিজের মধ্যেই কৃষক সমাজের লৌকিক চেতনা সঞ্চারিত হয়ে তার ‘মৌলতা’কে অনেক পরিমাণে খর্ব করে ফেলেছিল।’ (পৃ. ৫৬) এর কার্যকারণ ও প্রমাণ হাজির করতে গিয়ে তিনি সুরজিৎ দাশগুপ্তকে উদ্ধৃত করেন। সেখানে বলা হয়েছে, আরবের আর ভারতের ওয়াহাবি আন্দোলন এক বস্তু নয়। ভারতে এ আন্দোলনের পেছনে সৈয়দ আহমদ শাহর ওস্তাদ হিসাবে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন মৌলানা শাহ ওয়ালিউল্লাহ; আর ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারায় সাম্যবাদী ভাবধারা অতি প্রবল। যতীন সরকার যোগ করছেন, বাংলার লোকায়ত ভাবধারায় যে-সাম্যবাদী চিন্তা বিদ্যমান, ওয়ালিউল্লাহর সাম্যবাদ তার নিকট-আত্মীয়। কাজেই তিতুমীর বা দুদু মিঞার আন্দোলনেও সেই সাম্যবাদী আকাঙ্ক্ষা গভীরভাবেই ছিল। তিনি আরো অগ্রসর হয়ে মনে করিয়ে দেন, ‘ঝানু ব্রিটিশ আমলা উইলিয়াম হান্টার’ ওয়াহাবিদের ‘রাজনীতিক্ষেত্রে কমিউনিস্ট ও লাল প্রজাতন্ত্রী’ বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তাহলে মৌলবাদের কী হবে? না, তিনি সে দাবিও প্রত্যাহার করেন না। তাঁর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত: ‘লৌকিক সাম্যচেতনা ছিল এ আন্দোলনের শক্তি, আর মৌলবাদী ধর্মচেতনা ছিল এর দুর্বলতা।’ (পৃ. ৫৮)
আমরা এ সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন তুলতে পারি: ওই ‘শক্তি’ ও ‘দুর্বলতা’ নির্দেশকারী উপাদান দুটি তো কিছুতেই আলাদা রূপে অটুট থাকতে পারে না। যদি দুটি উপাদান জোরালো ভূমিকায় কার্যকর থেকেই থাকে, তাহলে দুটিরই ‘মূল রূপ’ বদলে গিয়ে নতুন সুরত ও মর্ম লাভ করার কথা। কিন্তু এ প্রশ্নে এখানে আমরা কথা বাড়াব না। এ আলোচনার আরেকটি দিকও আমাদের নজর এড়ায় না। ওয়াহাবি-ফরায়েজি বিষয়ক এ স্পর্শকাতর আলোচনায় যতীন সরকারের গদ্যের স্বরে কাউকে মানিয়ে নেয়ার প্রবণতা অতি স্পষ্ট। তিনি জানেন, সাম্যবাদী ধ্যানধারণা তালাশ করেন, এমন অনেকেই ওয়াহাবি-ফরায়েজি আন্দোলনের মধ্যে সে সম্ভাবনার লেশমাত্রও দেখতে পান না, বা দেখতে চান না। তিনি-যে দেখতে পাচ্ছেন, তাতে তাঁর চিন্তার ধাতই আলাদা হয়ে উঠছে। একই সাথে যাঁদের মানানোর জন্য তিনি কথা সাজাচ্ছেন, তাঁদের ও তাঁর নিজের কমন পরিভাষা স্বভাবতই এখানে প্রাধান্য বিস্তার করেছে। আমরা অবশ্য এ আলাপও আর বাড়াব না। বরং ওয়াহাবি-ফরায়েজি আলাপকে পুঁজি করে যতীন সরকারের চিন্তাধারার দুটি দিকে নজর দেব।
প্রথমেই লক্ষ করি, এখানে ‘মৌলবাদ’ ধারণাটি চাবিশব্দ হিসাবে ব্যবহৃত হয়েছে। পঞ্চাশ থেকে আশির দশক অবধি বিকশিত বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের একটা বড় অংশের সাথে এ ব্যবহারের গভীর সাদৃশ্য আছে। নিশ্চয়ই দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এ ব্যবহার-প্রবণতার উৎস। রিচার্ড ইটন আরো বৃহত্তর পরিসরে বাংলা অঞ্চল ও ভারতের পুরোনো ইতিহাস বিশ্লেষণে এ প্রবণতা খেয়াল করেছেন। তিনি বিশ্লেষণমূলক কৌশল হিসাবে একে উপযোগী মনে করেন নাই। এ বিষয়ে তাঁর একটা সিদ্ধান্ত উল্লেখ করি:
… it becomes unproductive, or flatly wrong, to speak of one group as ‘orthodox’ and another as ‘unorthodox’, or of one religious variant as ‘fundamentalist’ and another as, for example, ‘syncretic’. As rhetorical clubs, these labels might help identify competing social classes or factions in a given historical situation. But as analytical tools, they are quite useless. (p. 2; introduction, Essays on Islam and Indian History, Richard M. Eaton, Oxford university press, 8th impression, ২০১৪ [২০০০])
কিন্তু এ উল্লেখের অর্থ এ নয়, ‘মৌলবাদ’ ধারণা ব্যবহার করে কোনো সারগর্ভ আলোচনা সম্ভব নয়। অন্যরকম দৃষ্টিভঙ্গিও খুবই সুলভ— শুধু এটা বোঝানোর জন্যই কথাটা উদ্ধৃত করলাম। এ প্রসঙ্গে গৌতম ভদ্রের আলোচনা-পদ্ধতিরও নজির দেয়া যায়। ভদ্র প্রায় একই বিষয়ের কতগুলো দিক নিয়ে পর্যালোচনা করেছেন তাঁর বিখ্যাত ইমান ও নিশান বইয়ে। মনে করিয়ে দেয়া যাক, গৌতম ভদ্রসহ সাবলটার্ন দলের অন্য সদস্যরাও বৃহত্তর অর্থে মার্কসবাদী চিন্তাপদ্ধতির ভিত্তিতেই কাজ করেছেন। তিতুমীরের আলোচনায় তিনি ‘লোকায়ত’ পূর্বতন ধারণার বিপরীতে এঁদের শরিয়তি শুদ্ধতার কড়াকড়ি নিয়ে যথেষ্ট আলোচনা করেছেন। কিন্তু ‘মৌলবাদ’ ধারণাটি ব্যবহার করেন নাই, বা এর দরকার বোধ করেন নাই। ধারণা হিসাবে একে ব্যবহার করলে আলোচনার ধরন ও সিদ্ধান্ত ভিন্ন হতে বাধ্য। যতীন সরকার তাঁর সময়ের প্রভাবশালী চিন্তার অনুকূলে ধারণাটি খরিদ করেছেন; যদিও, আমরা আগেই বলেছি, তাঁর অন্যসব প্রবণতার কারণে আলোচনার ধরন ও গৃহীত সিদ্ধান্তে ভিন্নতা এসেছে।
দ্বিতীয় যে বিষয়ে আমরা আলোকপাত করতে চাই, তাকে বলতে পারি ‘উপর থেকে নিচে’। যে ‘বিষয়’ নিয়ে আলোচনা করছি, আলোচনার পরিভাষাগুলো কিংবা দৃষ্টিভঙ্গিগুলো সে বিষয়ের মর্মকে পাত্তা দিচ্ছে, নাকি বাহির থেকে ‘আরোপিত’ হচ্ছে, তা এক গুরুতর জ্ঞানতাত্ত্বিক বিবেচনা। যতীন সরকারকে দেখব, তিনি ওয়াহাবি-ফরায়েজিদের সম্পর্কে সিদ্ধান্ত তাদের কথা ও কাজ থেকে তুলে আনছেন না, বরং তাঁর নিজের হাতে বিদ্যমান কিছু মাপ বা বাটখারা ব্যবহার করে সেগুলোর মূল্যায়ন করছেন। বস্তুত, এটাই তাঁর পদ্ধতি। এ পদ্ধতিটা কার্যকর হয় ‘সত্যে’র একরোখা নিশ্চিত ধারণা থেকে। আমি যদি ‘সত্য’ সম্পর্কে নিশ্চিত হই, তাহলে তা সার্বিকভাবেই প্রযোজ্য হবে। এবং ওই সত্যের মাপে আমি ‘বিষয়’কে দেখব বা মাপব। গত পাঁচ দশক ধরে প্রভাবশালী হয়ে ওঠা উত্তর-আধুনিক বা উত্তর-ঔপনিবেশিক ধারণাগুলো সত্যের এরকম একরোখা নিশ্চিত আন্দাজ নিয়ে কাজ করে না। তাদের সত্য সবসময় স্থান-কালের বিশেষ বাস্তবতায় রূপ-নেয়া সত্য। কাজেই সার্বিক সত্যের নিরিখে উপর থেকে নিচের দিকে কোনো ‘বিষয়ে’র দিকে তাকানোকে বলতে পারি ‘আধুনিক’ চিন্তাপদ্ধতি। লিবারেল ও মার্কসিস্ট উভয় ঘরানাতেই এ চিন্তাপদ্ধতির প্রায় একক আধিপত্য ছিল। যতীন সরকারের লেখালেখিতে আমরা চিন্তার এই বিশুদ্ধ ‘আধুনিক’ মেজাজই দেখতে পাব। বাঙালি শিক্ষিত মধ্যবিত্তের আধুনিক মেজাজ-মর্জিতে তাঁর বিরাগ খোদ আধুনিকতার কোনো মর্মভেদী সমালোচনা নয়, এ জনগোষ্ঠীর বিকারের চিহ্নায়ন মাত্র।
৪
‘কেবল মুসলমানের লাগিয়া আসেনি কো ইসলাম’ প্রবন্ধে যতীন সরকার একটি অত্যন্ত জরুরি প্রসঙ্গ তুলেছেন। ইসলামচর্চায় যে-ধরনের ঔদার্যের সুযোগ আছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানের দেশে ইসলামের যে-ধরনের চর্চা সামগ্রিক প্রগতির জন্য অতি জরুরি, তাঁর মতে, তা আমাদের দেশের চর্চায় প্রায় অনুপস্থিত। তিনি লিখেছেন:
এ ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি অসচেতনতা, নিষ্ক্রিয়তা ও দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন সেক্যুলার রাজনীতিক ও প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীরা। তাঁদের অসচেতনতা ও উদাসীনতাই ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে শক্তি যোগায়। সেক্যুলারপন্থী রাজনীতিকেরা মানুষের ধর্মভাবনার পরিচয় না নিয়ে বা তাকে পাশ কাটিয়ে রাষ্ট্রীয় বিধানে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে চান; প্রগতিকামী বুদ্ধিজীবীরা দেশের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও তার ঐতিহাসিক ভূমিকার মূল্যায়ন না করেই সমাজ-প্রগতির স্বপ্ন দেখেন। ধর্ম নিয়ে ভাবনা-চিন্তা করা বা মতামত প্রদানের দায়িত্ব তাঁরা বহন করেন না। এরই সুযোগ গ্রহণ করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির প্রবক্তারা। ... সেক্যুলার রাজনীতি এরকম পরিস্থিতিতে হালে পানি পায় না, প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা মুখ থুবড়ে পড়ে যায়। (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, পৃ. ১৬১)
যতীন সরকার এখানে কথা বলেছেন বাইনারি অপজিশন বা যুগ্ম বৈপরীত্যের ভিত্তিতে। এ ধরনের বৈপরীত্যের তাত্ত্বিক-প্রায়োগিক বিপদ সম্পর্কে তিনি সচেতন ছিলেন বলে এখানে কোনো প্রমাণ মেলে না। আবার যে-পরিভাষাগুলোর উপর তাঁর মত ও মন্তব্য দাঁড়িয়ে আছে, সেগুলোও তিনি ব্যবহার করেছেন নিশ্চিত সত্যের মেজাজে— এগুলোর সংজ্ঞায়নের কোনো দায়িত্ব না নিয়েই। যেমন, ‘সেক্যুলার রাজনীতিক’, ‘প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী’, ‘ধর্মীয় মৌলবাদ’, ‘সেক্যুলারিজম’, ‘প্রগতিকামী বুদ্ধিজীবী’, ‘সমাজ-প্রগতি’, ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতি’, ‘প্রগতিশীল ধ্যান-ধারণা’ ইত্যাদি। উল্লেখের ধরন থেকেই পরিষ্কার বোঝা যায়, এ পরিভাষাগুলোর একটা অতি প্রচলিত প্রভাবশালী অর্থ আছে, এবং তিনি সেগুলোই অনুমোদন করছেন। দুনিয়ার সর্বত্রই-যে এ কথাগুলো বিচিত্র মতিগতিতে ব্যবহৃত হয়, তার কোনো ধার না ধেরে তিনি একরোখা সত্যের মতো করে কথা বলেছেন। আগেই বলেছি, মার্কসবাদী ও লিবারেল ডিসকোর্সের ‘আধুনিক’ ঘরানায় এভাবে বলাটাই মোটামুটি প্রভাবশালী রেওয়াজ ছিল।
দ্বিতীয় আরেকটি কথাও এখানে বলে রাখা দরকার মনে করছি। যতীন সরকার কথাগুলো বলার সময়ে যাঁদেরকে দুষেছেন, তিনি কিন্তু তাঁদের বলয়ের বাইরের কেউ নন। নিজেকে তিনি সেখানেই দেখতে চান এবং পান। তিনি ‘প্রগতিশীল’ ও ‘সেক্যুলার’; আর ‘সমাজ-প্রগতি’ই তাঁর চূড়ান্ত খায়েশ। এ বিষয়ে তাঁর নিজের সংজ্ঞায়ন এবং যাঁদেরকে তিনি দুষেছেন, তাঁদের সংজ্ঞায়ন মোটেই আলাদা নয়। আলাদা হলে তিনি সেটা লেখার দেহে টুকে রাখতেন। এ গোত্রের, অর্থাৎ নিজ গোত্রের, ব্যর্থতার সমালোচনা হিসাবেই তিনি এসব মন্তব্য করেছেন। বাংলাদেশের গত অন্তত চার দশকের ইতিহাসে এ ধরনের কথা আমরা দেদার শুনেছি। প্রগতিশীলরা উদ্যোগ-আয়োজন এবং ঐক্যে খুব একটা সুবিধা করতে পারছেন না বলেই দেশে প্রতিক্রিয়াশীলতার জয়-জয়কার— এরকম উচ্চারণ আগের জমানার মতো একালেও নিত্য শোনা যায়। যতীন সরকারের এ আলাপ গড়নে তো বটেই, এমনকি মর্মের দিক থেকেও একই কাঠামোর।
কিন্তু উপরের দুই অনুচ্ছেদ যতীন সরকারের তো নয়ই, এমনকি উদ্ধৃত অংশটিরও পূর্ণাঙ্গ পরিচয় নয়। উদ্ধৃত অংশটিতে এমন কিছু দিক আছে, যা যতীন সরকারকে বিশেষভাবে চেনার জন্য জরুরি। প্রথমেই বলতে চাই, ‘রাষ্ট্রীয় বিধানে সেক্যুলারিজম প্রতিষ্ঠা করতে’ চাওয়ার কথা। ‘প্রগতি’ প্রতিষ্ঠার কথাও লেখক বলতে পারতেন। বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের বড় অংশের এক দুর্মর ব্যাধির দিকে প্রাবন্ধিক এখানে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। সম্মতি নয়, রাষ্ট্রের নিপীড়ক শক্তির উপর ভর করে সমাজে ‘সেক্যুলার’ ও ‘প্রগতিশীল’ দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠার বাসনা লালন করেন এঁরা। গত অন্তত এক দশকের বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বভাব পর্যালোচনা করলে বোঝা যাবে, আরো প্রায় দুই দশক আগে যতীন সরকার আমাদের বুদ্ধিবৃত্তিক প্রবণতার কী ভয়াবহ ক্ষত শনাক্ত করেছিলেন। তাহলে তিনি নিজে কী চান? কিভাবে সমাজে প্রগতি কায়েম হবে? ‘আধুনিক’ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তিনি মনে করেন, ‘প্রগতি’ ‘সত্যে’র মতোই একটি নিশ্চিত ও নির্দিষ্ট অবস্থা। তবে তা কায়েম করতে হবে জনসম্মতিতে। মানুষের মন-মর্জি ও অবস্থা বুঝে খোদ ‘প্রগতি’র ধারণা সাব্যস্ত করার যেসব চিন্তা গত কয়েক দশকে দুনিয়াজুড়ে বিকশিত হয়েছে, যতীন সরকার সেসব ধারণার পোষকতা করছেন না। ‘সত্য’, ‘কল্যাণ’ ও ‘প্রগতি’ তিনি উপর থেকেই নিচের দিকে প্রবাহিত করতে চান। কিন্তু তাঁর বহু সহকর্মীর মতো তিনি রাষ্ট্রশক্তির বলে বলীয়ান হয়ে নিপীড়নমূলক কায়দায় তা করা সম্ভব বলে মনে করেন না। কাজেই এ সমালোচনার মধ্য দিয়ে তিনি বহুজন থেকে নিজেকে আলাদা করে নেন।
দ্বিতীয় যে প্রসঙ্গটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসাবে এখানে শনাক্ত করতে চাই, সে কথাটা আছে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদের এ বাক্যে: ‘প্রগতিকামী বুদ্ধিজীবীরা দেশের ধর্মীয় ঐতিহ্য ও তার ঐতিহাসিক ভূমিকার মূল্যায়ন না করেই সমাজ-প্রগতির স্বপ্ন দেখেন।’ তাদের বিপরীতে গিয়ে ‘প্রগতিকামী বুদ্ধিজীবী’ হিসাবেই যতীন সরকার ধর্মের ঐতিহাসিক ও চিন্তাগত মোকাবেলা জরুরি মনে করেন। পশ্চিমা লিবারেল ডিসকোর্সে এবং মার্কসবাদী ডিসকোর্সে এ আকাঙ্ক্ষা অতি প্রাথমিক ধরনের কর্তব্য হিসাবেই স্বীকৃত। কিন্তু বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ বুদ্ধিবৃত্তিক মহলে, একেবারেই ঐতিহাসিক বাস্তবতার দায় মেটাতে গিয়েই, এ প্রাথমিক কর্তব্যটা শুধু অবহেলিত হয় নাই, রীতিমতো বিরোধিতার পর্যায়ে গেছে। যতীন সরকার ওই ভাববলয়ে দাঁড়িয়ে কোনো প্রকার রাখঢাক ছাড়াই এ কথা প্রচার করেছেন। এতে একদিকে যেমন তাঁর তত্ত্বীয় কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় মেলে, ঠিক তেমনি তত্ত্ব ছাড়িয়ে [এড়িয়ে নয়] তিনি-যে কতকটা মাঠ-ময়দানের বুদ্ধিজীবী হিসাবেও তৎপর ছিলেন, তার প্রমাণ পাওয়া যায়।
৫
বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’র প্রশ্নটি আমাদের জন্য একটা ‘ক্লাসিক’ প্রশ্ন হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে। এ অর্থে যে, আমাদের আরো কয়েক প্রজন্ম ধরে এ প্রশ্নের মোকাবেলা করতে হবে। বাঙালি তথা বাংলাভাষী জনগোষ্ঠীর ‘আধুনিকতা’র সাথে প্রশ্নটির সাক্ষাৎ যোগ। পুঁজিবাদী উৎপাদন-ব্যবস্থা ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট শিক্ষা-ব্যবস্থার সাথে এই ‘আধুনিকতা’র সরাসরি সম্পর্ক। আর ঐতিহাসিক বাস্তবতা হলো, আমরা এ পর্বে ‘উন্নীত’ হয়েছি এক নিশ্ছিদ্র ঔপনিবেশিক শাসনের স্নেহছায়ায়। উপনিবেশ আমলেই আমাদের জীবনদৃষ্টির বনিয়াদি কাঠামো ‘আধুনিকতা’র ধারণার সাথে একীভূত হয়ে গড়ে উঠেছে, আর একই আবহে গড়ে উঠেছে আমাদের সাহিত্যদৃষ্টিও। কাজেই সে সাহিত্যদৃষ্টির ভিত্তিতে লেখা সাহিত্যের ইতিহাসে যাকে মূলধারা বলা হবে, তার সাথে উপনিবেশ-পূর্ব মূলধারার-যে ছেদ থাকবে, তা বলাই বাহুল্য। এখন উৎপাদন-সম্পর্কের বাস্তবতায় আমরা যারা ভদ্রলোকের কাতারে পড়ি, তাদের জন্য ওই ‘মূলধারা’য় মোটেই অসুবিধার কিছু নাই। মুশকিল হয় তখনি, যখন সমগ্র জনগোষ্ঠীর বাস্তবতা মাথায় রেখে কোনো কর্মসূচি সাজানো হয়— সে কর্মসূচি জাতীয়তাবাদী হোক, মার্কসবাদী হোক, বা আর কিছু। আমাদের অতি প্রভাবশালী সাহিত্যের মূলধারায় আসলে জনগোষ্ঠীর বিপুল অধিকাংশের উৎপাদক বা ভোক্তা হিসাবে কোনো অংশ নাই— ভাবনায় সমগ্রের কথাটা থাকলেই কেবল এ ডাহা সত্য আমাদের খুঁচিয়ে মারবে। আমরা ওই অবস্থাকে আমাদের সামষ্টিক অস্তিত্বের তীব্র সংকট হিসাবে আবিষ্কার করব। আর এর সুরাহা করার পথ খুঁজব। যতীন সরকার আদতে সে কাজটাই করেছেন।
বাংলাদেশের সমকালীন বা কাছাকাছি সময়ের প্রভাবশালী বুদ্ধিবৃত্তিক ধারার প্রধান প্রবণতাগুলোকে এভাবে চিহ্নিত করতে পারি: বাঙালি জাতীয়তাবাদী, ধর্মনিরপেক্ষ অর্থে সেক্যুলার, ‘মৌলবাদ’-বিরোধী, পাকিস্তান আন্দোলন সম্পর্কে খুব ক্রিটিক্যাল, উনিশ শতকের ‘রেনেসাঁ’ ও ‘আধুনিকতা’য় আস্থাবান, এবং এসব অবস্থানের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ অর্থে উদারনীতিবাদী গণতন্ত্রী। যতীন সরকার মোটা দাগে এ বলয়েই পড়েন। তাঁর সাথে সমধর্মী অন্য অনেকের চিন্তাধারার এক গুরুতর ফারাক চিন্তা ও বিচারপদ্ধতির মার্কসবাদী টান। আবার মার্কসবাদী বহু বুদ্ধিজীবী থেকে যতীন সরকার নিজেকে আলাদা করে নেন বাস্তব কর্মসূচি হিসাবে মার্কসীয় রাজনীতিকে দেখার দিক থেকে। মাঠের রাজনীতির কথা খুব প্রত্যক্ষভাবে তাঁর চিন্তার অংশীদার ছিল বলেই তাঁকে বিপুল গণমানুষের গণসংস্কৃতি ও সাহিত্যের কথা ভাবতে হয়েছে। লোকায়ত সাহিত্য ও দর্শন নামে জুতসই ক্যাটাগরি বা বর্গ চয়ন করতে হয়েছে। এবং এ দৃষ্টিভঙ্গির প্রবলতার কারণে তাঁর ঘরানার বুদ্ধিজীবীদের কাছে সিদ্ধরস হিসাবে বিদ্যমান কতগুলো ধারণা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তুলতে হয়েছে। বাংলা সাহিত্যের ‘মূলধারা’ নিয়ে তাঁর সমস্যায়ন এ গোত্রেই পড়ে।
যতীন সরকার মফস্বলে বসবাস করতেন— এ বাস্তব তথ্যের সাথে নাগরিক চিন্তাসাথীদের সঙ্গে তাঁর ফারাকের কোনো সম্পর্ক কি আছে? থাক বা না থাক, নিজের চিন্তাপদ্ধতি ও বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে উত্থাপিত এ জরুরি প্রশ্নটিকে জ্ঞানতত্ত্ব ও পদ্ধতিগত ভাবনাচিন্তার আলোকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াই পরবর্তী প্রজন্মের চিন্তকদের কাজ।