পিটার ব্রুক: আপনার শূন্যস্থানে আমাদের শোকনাট্য
বার্মিংহাম শহরের সার্বক্ষণিক জীবন্ত ব্রিস্টল রোডের এক পাশের পুরোনো এক বাড়ির চিলেকোঠার জানালা খুলে ইংল্যান্ডের আকাশের দিকে তাকিয়েছিলাম। রবিবার। প্রহরের হিসাবে এক খাঁ খাঁ দুপুর। প্রায় নিস্তব্ধ তল্লাট। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা শনিবার রাতভর উল্লাস সাঙ্গ করে ঘরের ভেতরেই হয়তো গাঢ়ভাবে ঝিমুচ্ছে। এ বছর গ্রীষ্মে বিলাতের আকাশে এমন করুণ মেঘের ওড়াউড়ি আর দেখিনি। আমার চোখ ছিল মেঘমল্লারে আর দুই হাত ধরেছিল ছোট্ট ফিনফিনে দুটো বই-ইভোকিং [অ্যান্ড ফরগেটিং] শেক্সপিয়ার এবং প্লেয়িং বাই ইয়ার: রিফ্লেকশনস অন সাউন্ড অ্যান্ড মিউজিক। একটিতে লেখকের অটোগ্রাফ। লন্ডনের এক অনুষ্ঠান থেকে সরাসরি লেখকের অটোগ্রাফ নিয়ে বই দুটো আমাকে দেবেন বলে আগলে রেখে দিয়েছিলেন অগ্রজ সতীর্থ সুদীপ চক্রবর্তী। মহামারির আগের বছর। আমি পিএইচডি ডিগ্রি লাভের প্রেষণায় এই ইঙ্গদেশে এলাম। সুদীপদা তত দিনে ডক্টরাল গবেষণা প্রায় মীমাংসা করবার পথে। তাঁর লন্ডনের বাসায় বহুদিন পর দেখা হবার আলিঙ্গন অকস্মাৎ ছাড়িয়ে, নিজের সমস্ত উত্তেজনাকে চোখের বিভায় আর ঠোঁটের হাসিতে অনুবাদ করে সুদীপদা বই দুটো আমাকে দিয়েছিলেন, ‘ন্যাও ন্যাও। পাতা উল্টায়া দ্যাখো ভিত্রে কী আছে!’ দোসরা জুলাই, এই শেক্সপিয়ারিয়ান সামারে বই দুটোর শীতার্ত লেখক চলে গেলেন অনন্ত গ্রীষ্মে। বেশ কিছু বই পড়ে আর নিতান্ত একটি-দুটি বই লিখে আজ মনে পড়ছে, আমি কোনো দিন লেখকের অটোগ্রাফ নিইনি। এখন ভাঙা ভাঙা মনে পড়ছে, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ-ই হয়তো তরঙ্গভঙ্গ নাটকে বলেছিলেন, স্বাক্ষর তো আঙুলের কীর্তিমাত্র! তাই হয়তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ডাকঘর, আহমদ ছফার বাঙালী মুসলমানের মন, সেলিম আল দীনের চাকা কিংবা সৈয়দ জামিল আহমেদের ইন প্রেইজ অব নিরঞ্জন—কোনো বইয়েরই পৃষ্ঠা উল্টে কোনো দিন লেখকের নামলিপি, নিজের শীর্ণ আঙুলে এভাবে স্পর্শ করিনি। এত দিন রবীন্দ্রনাথের কথাকেই ভেবে এসেছি, কবিকে তো জীবন-চরিতে নয়, কবিতায় খুঁজতে হয়! ব্রিস্টল রোডের এই রবিবার দুপুরে, হারানো ভালোবাসা ফিরে পেয়ে ছুঁয়ে দেখার ইচ্ছার মতন তীব্রতা নিয়ে আমি পিটার ব্রুকের অটোগ্রাফ স্পর্শ করছিলাম। আর জীবন ও মরণের মাঝখানে থাকা নাজুক ব্যবধানখানির করুণ ঘ্রাণ আস্বাদ করছিলাম। ঠিক তখন ঢাকা থেকে লেখক ও সম্পাদক সাখাওয়াত টিপু হোয়াটসঅ্যাপ করলেন, ‘তর্কবাংলায় পিটার ব্রুকের ইন্টারভিউ তো আর কোনো দিন ছাপা হবে না!’ আমার এখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে প্যারিসে অবস্থানরত ব্রুকের সেক্রেটারি নিনার কাছে মেইল করে আকুতি জানিয়েছিলাম, কমপক্ষে শরীরবিহীন এই ভার্চুয়াল দুনিয়াতে হলেও যেন তাঁর সাথে খানিক কথা হয়। তাহলে এর কিছু অংশ পিএইচডি থিসিসে কাজে লাগাব আর কিছু আলাপচারিতা তর্কবাংলার জন্য পাঠিয়ে দেব। ইংল্যান্ডে আসার পর থেকেই টিপু ভাই ব্রুকের প্রতি এক সম্মোহিত আবেগ নিয়ে ইন্টারভিউটির জন্য প্রায় প্রায় সঞ্জীবনা জুগিয়েছেন। হায় মাবুদ, আমাদের এই জীবনে কিছু কাজ ফেরারি থেকে যায়!
২
ওই বই দুটোর লেখক পিটার ব্রুক বস্তুত কে ছিলেন? ব্রুক এক মহান লেখককে ভুলতে চেয়েছিলেন। ভুলে গিয়ে তিনি যা করেছিলেন, তাতে ক্রমশ ‘বাস্তবতার অন্তর্গত বিশ্ব’ আমাদের সামনে উন্মোচিত হয়েছিল। ব্রুক বলেছিলেন, ‘ইট ইজ অনলি হোয়েন উই ফরগেট শেক্সপিয়ার দ্যাট উই ক্যান বিগিন ফাইন্ড টু হিম’। তিনি শেক্সপিয়ারকে ভুলে যাওয়ার বিনির্মাণবাদী ক্রিয়ায় খুঁজে পেতে মঞ্চে শুরু করেছিলেন একের পর এক নাট্যসৃষ্টিযজ্ঞ। নাট্য পরিচালনা, চলচ্চিত্র নির্মাণ, অভিনয় কর্মশালা, বক্তৃতা আর নাট্যতত্ত্ববিষয়ক বই লিখে সৃষ্টি ও চিন্তার এক বিশাল সম্ভার রেখে, ৯৭ বছর বয়সে এই ইংরেজ শিল্পী, প্যারিসের ফরাসি আঙিনায় চিরতরে প্রস্থান করেছেন। জীবনের মঞ্চে পিটার ব্রুকের এই ভূমিকা এখন থেকে এই পৃথিবীর যৌথ স্মৃতির অংশ হয়ে গেল। তাঁর সৃজনশীলতা ও ভাবজগৎ এক বৈশ্বিক উত্তরাধিকার তৈরি করেছে। তাঁর জীবন ও কাজ হয়তো চিরকাল ধরে আমাদেরকে যুক্ত হতে, সংলাপ করতে প্ররোচনা দেবে। বাখতিনিয়ান সংলাপের তত্ত্ব ধার করে বলব, পিটার ব্রুকের কাজ এমন এক সংলাপের সূচনা করল, যা কেবল অপরের সাথে কথা বলার সম্পর্ক চিরতরে শুধু খুলেই দিল না, কথা বলা বন্ধ রাখাকেও চিরতরে অসম্ভব করে দিল।
পিটার ব্রুক ইংরেজদের উন্নাসিক জাতীয়তাবাদী পরিবেশ ছেড়ে ১৯৭০ সালে ফরাসি দেশে চলে যান। কারণ, তিনি জনপ্রিয়তাবাদী ছিলেন না। জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ দিয়ে জনমনোরঞ্জন করা তাঁর কাজ ছিল না। লোকচিত্তের তুষ্টি সাধনের বাসনা তাঁর শিল্পের স্বপ্নে এক কণাও জায়গা পায়নি। তিনি প্যারিসে গড়ে তোলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব থিয়েটার রিসার্চ’। নিরীক্ষামূলক প্রযোজনা ও গবেষণার জন্য একটি নতুন নাট্য কোম্পানি
৩
পিটার ব্রুক প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯২৫ সালে লন্ডনে জন্মেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। তারপর নাটকে জড়িয়ে গেলেন। নাটককে ঘিরে জীবন ও শিল্পের মধ্যকার সম্পর্কের এক অভাবিত ভাষা আবিষ্কারের ক্রিয়ায় ক্রমে ক্রমে মেতে উঠলেন। কুড়ি বছর বয়সে বার্মিংহাম রেপার্টরি থিয়েটারে প্রবল উদ্যমে পরিচালকের কাজের মাধ্যমে শুরু করেছিলেন নিজের নাট্যযাত্রা। স্ট্র্যাটফোর্ড-আপন-অ্যাভন শহরে অবস্থিত রয়্যাল শেক্সপিয়ার কোম্পানি [আরএসসি]-তে ১৯৬৩ সালে পরিচালনা করেন শেক্সপিয়ারের ট্র্যাজেডি কিং লিয়ার। রঙ্গমঞ্চে তখনো তাঁর গ্রাউন্ড ব্রেকিং কাজটির জন্ম হয়নি। সাত বছর পর আসে সেই অবিস্মরণীয় মুহূর্ত। ১৯৭০ সালে আরএসসিতে পরিচালনা ও মঞ্চস্থ করেন শেক্সপিয়ারের কমেডি আ মিডসামার নাইট’স ড্রিম। এই প্রযোজনার মাধ্যমে তিনি প্রথাগত শাস্ত্রবদ্ধ শেক্সপিয়ারিও নাট্যভাষা বদলে দিলেন। সৃষ্টি করলেন নতুন বাগধারা। কিন্তু কীভাবে? ক্ল্যাসিক কাজকে সংকুচিত করার প্রবণতাকে সামাজিক জীবনের নতুন বিপদ আখ্যায়িত করে পিটার ব্রুক এক ভিন্ন চ্যালেঞ্জ নিয়েছিলেন। ফলে, ‘সংকোচনবাদ’ [রিডাকশনিজম] মোকাবিলা করতে গিয়ে ধ্রুপদি সাহিত্যের ‘অজানা’ [আননোন] ‘নানাকিছু’র [থিংস] ‘রহস্য’ [মিস্ট্রি] অভিনীত করার ভাষা আবিষ্কারের কাজেই তিনি মনোনিবেশ করেছিলেন। নাটককে মঞ্চে রূপায়ণের খেলায় তিনি বিমূর্ত কোনো আইডিয়া বা কনসেপ্ট কিংবা চরিত্রের কোনো তত্ত্ব থেকে কাজ করেননি। ব্রুক নিজেই বলেছেন, একটি নাটক তাঁর কছে একটি দারুণ মোজাইকের মতন। নাটকের সংগীত, ছন্দ, চিত্রকল্পের বিস্ময়করতা, অনুপ্রাসের ধ্বনি-মাধুর্য—এই সবকিছুই তাঁর কাছে ধরা দেয় একটি সারপ্রাইজ ও আবিষ্কারের দাবি নিয়ে। কারণ এগুলো ব্যতিক্রমধর্মী মানব প্রজাতির ভেতরগত গড়নের অতি প্রয়োজনীয় একেকটি প্রকাশ। পিটার ব্রুকের কাছে শব্দকে কখনোই টেক্সটের অংশ মনে হয়নি। তিনি মনে করতেন, অভিনেতা শব্দকে জীবন্ত মানুষের জৈবিক অংশ ভাববে। আর অভিনেতা যখন চিন্তাহীনভাবে অবাধে স্বতঃস্ফূর্ততায়, ইন দ্য হিট অব দ্য মোমেন্টে, সেটা করবে, তখনি সে শিল্পে ঋদ্ধ এক রূপকার হয়ে আমাদের কাছে আসবে। ব্রুক সাহিত্যের অন্তর্গত বিশুদ্ধতাকে নাট্যশিল্পে জীবন দিয়েছিলেন। এই জীবনদানের বিশেষ ভাষা আবিষ্কারের মধ্যে দেখা যায় দৃশ্যজ উপস্থাপনায় বৌদ্ধ দর্শনের সংক্ষিপ্ততার নন্দনপ্রণালি। প্রায় শূন্যতার কাছাকাছি একটি মঞ্চভাষায় তীক্ষ্ণ সংবেদনশীলতায় আবেগিক উপায়ে তিনি দর্শকদের স্নায়বিক তন্ত্রীতে উদ্দীপনা প্রবাহিত করেছেন।
৪
পিটার ব্রুক শেক্সপিয়ার ছাড়াও সফোক্লেস, টিএস এলিয়ট, টেনেসি উইলিয়ামস, আর্থার মিলার, জঁ জেনে, স্যামুয়েল বেকেট, আন্তন চেখভ, দস্তয়েভস্কি, টেড হিউজ—এমন অনেক ধ্রুপদি, আধুনিক ও সমকালীন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকদের কাজকে নাট্যে সৃজন করেছেন। স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করতে তিনি কখনো ক্লান্ত হননি। আমরা অবশ্যই ভুলে যাইনি ফারসি সুফি কবি ফরিদ উদ্দীন আত্তারের কাব্য দ্য কনফারেন্স অব দ্য বার্ডস অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে নির্মিত নাট্য প্রযোজনা। আবার, ১৯৮৫ সালেই ব্রুক নির্মাণ করেন নয় ঘণ্টার বিস্ময়কর প্রযোজনা মহাভারত। পিটার ব্রুকের এই কাজগুলোর মধ্যে একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক সত্তার উপলব্ধি ফুটে ওঠে। তবে, ভারতীয় অধ্যাপক রুস্তম ভারুচা ব্রুকের মহাভারত প্রযোজনার ইন্টারকালচারাল প্রকল্পকে, এডওয়ার্ড সাঈদ কথিত প্রাচ্যবাদিতার কারণে সমালোচনাও করেছেন। ভারুচার যুক্তি হলো, পশ্চিমা দুনিয়ায় এ ধরনের ইন্টারকালচারাল প্রকল্প, পাশ্চাত্যের জ্ঞানতাত্ত্বিক ক্ষমতাচর্চার ইতিহাসকেই প্রসারিত করে, পোক্ত করে, বৈধতা দান করে। ক্ষমতাবান সংস্কৃতির বলয়ে থেকে অপরায়িত প্রান্তিক সংস্কৃতি থেকে ঋণ করার নৈতিকতা পিটার ব্রুকের রয়েছে কি না—এই রাজনৈতিক প্রশ্ন তুলেছেন অধ্যাপক ভারুচা। কারণ, পশ্চিমা আন্তসাংস্কৃতিক বিভিন্ন পন্থা এশিয়ান বা ইউরেশিয়ান পারফরম্যান্সের তত্ত্ব ও চর্চার নামে, রহস্যায়ন ও সৌন্দর্যায়নের মাধ্যমে, বস্তুত সংস্কৃতির ভিন্নতা, স্থানিকতা ও রাজনীতিকে উপেক্ষা করে। তথাপি, মহাভারত প্রযোজনায় সাদা কালো বাদামি অভিনেতাদের কাস্টিংয়ের মাধ্যমে, ইউরোপীয় বর্ণবাদী ক্ষমতাতন্ত্রের বিপরীতে, এই বিশ্বের বৈচিত্র্য ও বহুত্বের এক জীবন্ত মেটাফর নিয়েও কি পিটার ব্রুক দাঁড়াননি? এভাবেও তো ভাবা যায়! একটি নির্দিষ্ট জনপদের সাংস্কৃতিক পুঁজি থেকে ঋণ নেওয়ার অর্থ আমরা লালন ফকির ও জিল দল্যুজের নৈতিক-রাজনৈতিক দর্শন থেকেও নির্মাণ করতে পারি। কারণ, অপরের কাছ থেকে ধার করার অর্থ হলো নিজের সীমাবদ্ধতাকে উচ্চারণ করা। নিজের প্রবৃদ্ধি ও বিকাশের জন্য অপরের প্রয়োজনীয়তাকে সশরীরে চর্চা করা। অপরকে ঘৃণা করার অর্থ তো নিজেকে গ্রহণ করারও ব্যর্থতা। আমাদের নিজস্বতা তো অন্যদের নিজস্বতা দিয়েই সৃজিত হয়। আমরা তো এভাবেই হয়ে উঠি। এই জীবন ও পৃথিবীর বৈচিত্র্যকে একীভূত করে ভাবতে পারাও তো মানুষের কাজ। তাই, পিটার ব্রুক থেকে আমাদের শিক্ষা হলো, পিটার ব্রুকের সৃষ্টিকর্ম ও রুস্তম ভারুচার নৈতিক সমালোচনা—দুটোকেই পাশাপশি রেখে আমরা বাঁচতে পারি।
৫
পিটার ব্রুক ইংরেজদের উন্নাসিক জাতীয়তাবাদী পরিবেশ ছেড়ে ১৯৭০ সালে ফরাসি দেশে চলে যান। কারণ, তিনি জনপ্রিয়তাবাদী ছিলেন না। জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ দিয়ে জনমনোরঞ্জন করা তাঁর কাজ ছিল না। লোকচিত্তের তুষ্টি সাধনের বাসনা তাঁর শিল্পের স্বপ্নে এক কণাও জায়গা পায়নি। তিনি প্যারিসে গড়ে তোলেন ‘ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার অব থিয়েটার রিসার্চ’। নিরীক্ষামূলক প্রযোজনা ও গবেষণার জন্য একটি নতুন নাট্য কোম্পানি। পোলিশ নাট্যপরিচালক ও অভিনয়-গুরু ইয়ার্জি গ্রোটভস্কির ‘থিয়েটার ল্যাবরেটরিয়াম’ থেকে তিনি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, পিটার ব্রুক ছিলেন একজন কৃতজ্ঞ শিল্পী। তাঁর পূর্বসূরি সকল মাস্টার পরিচালকদের কর্ম ও ভাবনা ঘনিষ্ঠভাবে তিনি পাঠ করেছেন। তিনি পর্যালোচনা করেছেন। তিনি তাঁদের কাজ ও ভাবনা থেকে সার গ্রহণ করে নিজের কাজে ও ভাবনায় প্রতিফলিত করেছেন। এখানে শমিত মিত্তের থেকে আলোকিত হয়ে বলতে পারি, কনস্তানতিন স্তানিস্লাভস্কির অভিজ্ঞতাবাদী কার্যকারণভিত্তিক অভিনয়কাঠামো থেকে দুটো বিষয় ব্রুক আত্মস্থ করেছেন। প্রথমত, ‘অভিনেতার মনে নির্মিত মুখের’ খোঁজ কীভাবে করা যায়। দ্বিতীয়ত, ‘অভিনেতার মুখে নির্মিত মনের’ খোঁজ কীভাবে করা যায়। ব্রুক নিবিড়ভাবে অনুধাবন করেছিলেন স্তানিস্লাভস্কির নাট্যে কী করে অভিনেতা চরিত্রের “সত্য সত্তা” “হয়ে ওঠে” [টু বি]। ব্রুক অভিনেতাকে ‘ডিটাচড উইথাউট ডিটাচমেন্ট’-এর ক্রিয়ায় সম্পূর্ণভাবে যুক্ত হতে কাজ করেছেন। সম্ভবত এখানেই আরেক মাস্টার বার্টল্ট ব্রেশটের সাথে ব্রুক ঐক্য অনুভব করেছেন। তবে, ব্রেশট মার্কসবাদী কাব্যতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে স্তানিস্লাভস্কির অভিনয়-পদ্ধতির সমালোচনা করেছেন। কারণ, স্তানিস্লাভস্কি অভিনয়-পদ্ধতির মধ্যে রয়েছে পলিটিক্যাল ইনারশিয়া বা রাজনৈতিক নিষ্ক্রিয়তা। এই পদ্ধতির অভিনয়-ভাষা পুঁজিতান্ত্রিক দমনমূলক ব্যবস্থা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তুলতে অক্ষম। স্তানিস্লাভস্কি সিস্টেমের অভিনেতা সামাজিক বাস্তবতাকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ কায়দায় প্রতিরূপায়িত করে। জগৎ যেমন আছে তেমনটাকেই তুলে ধরে। কিন্তু ব্রেশট বুর্জোয়া অত্যাচারী ব্যবস্থা থেকে মুক্তির জন্য দর্শকের রাজনৈতিক ক্রিয়াসন্ধানী এক অভিনয় তত্ত্ব প্রস্তাব করেন। ব্রেশটের রাজনৈতিক অভিনয় পদ্ধতির অভিনেতা ‘টু বি অ্যান্ড নট টু বি’ [একই সঙ্গে চরিত্র হওয়া এবং চরিত্র না হয়ে চরিত্রকে স্রেফ ডেমনস্ট্রেট করার] ধারণাকে প্রয়োগ করে। এই রাজনৈতিক অভিনয়-ভাষা প্রয়োগের মাধ্যমে অভিনেতা ‘টেক্সট’ [মঞ্চস্থ নাটক] এবং ‘মেটাটেক্সট’ [থিয়েটারের বাইরে বাস্তবের সমাজ ও রাষ্ট্র]-এর বৈপ্লবিক পরিবর্তনমুখী সম্পর্ক নিয়ে দর্শককে সক্রিয় করে। তবে, মিত্তের থেকে ধার করে আরও বলতে পারি, আধুনিক কালে পিটার ব্রুক একমাত্র পরিচালক, যিনি অভিনেতাদের সক্ষম করে তুলেছেন একই সঙ্গে চরিত্র হতে এবং না হতে। আর এটা একান্তই ব্রেশট থেকে আলাদা। কারণ, ব্রুকের অভিনেতা চরিত্র না হতে গিয়ে ব্রেশটের অভিনেতার মতন সামাজিক দ্বন্দ্ব নিয়ে স্রেফ মতামত তুলে ধরে না। ব্রুকের অভিনেতা চরিত্র না হতে গিয়ে বরং নিজেদের অন্তর্গত দ্বন্দ্ব ভণ্ডামি ও অসত্যকে সাহসের সাথে রূপায়ণ করে। অন্যদিকে, গ্রটভস্কির অভিনেতা সভ্যতার স্কিৎজোফ্রেনিয়া ও রুগ্ণ দশা থেকে মুক্তির জন্য সামাজিক মুখোশ পরিত্যাগ করে। এই ধর্মতাত্ত্বিক অভিনেতা আত্মনিবেদনের পবিত্র শারীরিক ক্রিয়ায় সত্তার গুঢ়তম আকর খোঁজ করে। গ্রটভস্কির ট্র্যানসেনডেন্টাল বা তুরীয়ধর্মা অভিনয় থেকে ব্রুক একটি বিশেষ মাত্রা তাঁর নাট্য নির্মাণে আত্মস্থ করেছেন। ব্রুক বুঝতে চেয়েছেন, অভিনেতা কীভাবে সামাজিক বিশ্ব ও অন্তর্জগৎ একীভূত করার মাধ্যমে চরিত্রের নিগূঢ় সত্তা তৈরি। অন্যদিকে, অন্তোনিও আর্তুদের ‘থিয়েটার অব ক্রুয়েলটি’ থেকে ব্রুক তাঁর অভিনেতাদের জন্য ছেঁকে নিয়েছিলেন জীবন্ত সত্তার জ্বলন্ত প্রাণময়তার ধারণা। জীবনের ভেতরে থাকা সংক্রামক জীবন। পিটার ব্রুক তাঁর নাট্যে, চরিত্রের সৃজনে, অভিনয়ের ভাষায় এক শৈলীহীন শৈলী তৈরি করেছিলেন। বাস্তবতাকে ব্যাখ্যা নয় বরং বাস্তবতা স্বয়ং কী, তা তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি নাটকের ফর্মে আদতে জীবনকেই সৃজন করেছেন। অতীতের শিল্প ও পূর্বসূরিদের নাট্যভাবনার সারাৎসার গ্রহণ করার কারণে পিটার ব্রুকের কাজে স্তানিস্লাভস্কি, ব্রেখট, গ্রটভস্কি ও আর্তুদ—সকলেই আছেন। আবার সকলেই থাকার কারণে ব্রুকের কাজে বস্তুত কেউই নেই। আধুনিক নাট্যশিল্পের ভুবনে পিটার ব্রুক সম্ভত শেষ এক ‘সিনক্রেটিক সেল্ফ’, নানা সত্তার সংশ্লেষে পরিণত এক শিল্পসত্তা। এই সংশ্লেষে আমরা দেখি শরীর, স্থান, সময় ও গল্পের রসায়নে এক বিস্ময়কর স্বপ্ন রচিত হয়েছে। এই স্বপ্নের কাঠামো সমগ্র বিশ্বের স্পন্দনকে আত্মা বানিয়ে নিজের ভেতরে ধরে রেখেছে।
পিটার ব্রুক শেক্সপিয়ার ছাড়াও সফোক্লেস, টিএস এলিয়ট, টেনেসি উইলিয়ামস, আর্থার মিলার, জঁ জেনে, স্যামুয়েল বেকেট, আন্তন চেখভ, দস্তয়েভস্কি, টেড হিউজ—এমন অনেক ধ্রুপদি, আধুনিক ও সমকালীন কবি, নাট্যকার, ঔপন্যাসিকদের কাজকে নাট্যে সৃজন করেছেন। স্থান ও কালের সীমা অতিক্রম করতে তিনি কখনো ক্লান্ত হননি। আমরা অবশ্যই ভুলে যাইনি ফারসি সুফি কবি ফরিদ উদ্দীন আত্তারের কাব্য দ্য কনফারেন্স অব দ্য বার্ডস অবলম্বনে ১৯৭৭ সালে নির্মিত নাট্য প্রযোজনা। আবার, ১৯৮৫ সালেই ব্রুক নির্মাণ করেন নয় ঘণ্টার বিস্ময়কর প্রযোজনা মহাভারত। পিটার ব্রুকের এই কাজগুলোর মধ্যে একটি সর্বজনীন সাংস্কৃতিক সত্তার উপলব্ধি ফুটে ওঠে
৬
পিটার ব্রুকের নাট্যচিন্তার সারগ্রাহী নমুনাস্বরূপ ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত হয় একটি ছোট্ট বই—দ্য এম্পটি স্পেস। ব্রুকের সব কটি বই ছোট ছোট। ব্রুকের বইগুলো পড়লে বিশ্বাস করতে ইচ্ছা হয় মেগা বিবলিয়ন মেগা কাকোন—বড় বই মানে বড় জঞ্জাল। প্রাঞ্জল, ছোট ছোট বাক্যে, নন-একাডেমিক কায়দায় ক্ষুরধার চিন্তার স্বচ্ছ প্রকাশ ঘটিয়েছেন এই চৌকস লেখক। এই বইয়ের প্রথম লাইনে ব্রুক লিখেছেন, আই টেক এনি এম্পটি স্পেস অ্যান্ড কল ইট বেয়ার স্টেজ। তারপর তিনি বলেছেন, একজন মানুষ এই শূন্য স্থানের মধ্য দিয়ে হেঁটে যায় এবং অন্য একজন তাকে দেখতে থাকে। তাহলে এটাই যথেষ্ট একটি থিয়েটার হতে। ব্রুকের এই পুনঃসংজ্ঞায়ন সাহিত্য থেকে নাট্যশিল্পের এক বৈপ্লবিক প্রস্থানের সূচনা করে। এমনকি থিয়েটারের জন্য গল্পের মাধ্যমে সৃজিত কল্পভুবনের প্রয়োজনীয়তা আর থাকে না বলে সামনে চলে আসে পারফরম্যান্স ধারণাটিও। একজন জীবন্ত মানুষ, তার জীবন্ত ক্রিয়া আর একজন জীবন্ত মানুষের সেটি দেখা। এই নাট্যিক প্রক্রিয়া আমাদের প্রপঞ্চময় এই দুনিয়া ও জীবনকে বুঝতে, খাপ খাওয়াতে, রূপান্তর করতে, এমনকি পুনর্নির্মাণ করতে এক নতুন ভাষা জোগায়। এই বইয়ে পিটার ব্রুক চার ধরনের থিয়েটারকে তত্ত্বায়িত করেছেন—ডেডলি থিয়েটার, হোলি থিয়েটার, রাফ থিয়েটার এবং ইমেডিয়েট থিয়েটার। ডেডলি থিয়েটার বাণিজ্যসর্বস্ব, ভালো মতন বিনোদন দিতেও অক্ষম এক মৃত নাট্য। হোলি থিয়েটার অদৃশ্যকে দৃশ্যমান করে তোলে। এই ধারণার মাধ্যমে ব্রুক প্রস্তাব করেন, মঞ্চ হলো এমন এক স্থান যেখানে অদেখা জীবন রূপায়িত হয়ে আমাদের চিন্তার জগৎ নাড়িয়ে দেয়। রাফ থিয়েটার হলো জনপ্রিয় বিচিত্র রূপ-রীতির নাট্য, যা জনতার মর্মমূল ধারণ করে। পিটার ব্রুক নিজে যে ধরনটি অনুসন্ধান করেছেন জীবনভর, তা হলো ইমেডিয়েট থিয়েটার। একটি নাট্যঘটনার মাধ্যমে জীবনের জন্য চিরকালের সত্য আবিষ্কার করতে জীবনের সাথে জীবনের যে কনফ্রনটেশন বা মোকাবিলা ঘটে, তা-ই হলো ইমেডিয়েট থিয়েটার। এই থিয়েটারের তিনটি উপাদান: পুনরাবৃত্তি [রিপিটেশন], প্রতিরূপায়ণ [রেপ্রিজেন্টেশন] ও সহযোগিতা [অ্যাসিসট্যান্স]। দর্শকের চোখের, বাসনার, আনন্দের সহযোগিতায় অভিনেতার মহড়ার পুনরাবৃত্তি পরিণত হয় জীবনের প্রতিরূপে। ইমেডিয়েট থিয়েটার প্রতিরূপায়ণের মাধ্যমে চিরকালের সত্য ধরতে সচেষ্ট হয়। কিন্তু ব্রুক বলেন, থিয়েটারে সত্য স্থির থাকে না, সব সময় পাল্টাতে থাকে। পেঙ্গুইন থেকে প্রকাশিত দ্য এম্পটি স্পেস বইয়ের শেষ পৃষ্ঠাটি বন্ধ করবার আগে একবার পড়তে পারি। ব্রুক এখানে একটি বই থেকে বরং থিয়েটারকে বেশি মূল্য দিয়েছেন। কারণ, বই হলো চিন্তার অনুশীলন মাত্র। সময়ের ফোঁড়ে সেই চিন্তা বইয়ের পৃষ্ঠায় বরফের মতন জমে থাকে। আর ব্রুক মনে করেন, থিয়েটার হলো এমন একটি শিল্পমাধ্যম, যেখানে আবার নতুন করে শুরু করা সম্ভব। অথচ আমাদের বাস্তব জীবনে তা কখনোই সম্ভব নয়। আমরা আমাদের ফেলে আসা জীবনের কোনো কিছুতেই কখনোই আবার দ্বিতীয়বারের মতন ফিরতে পারি না। নতুন পাতারা কখনোই আর গজাবার আগের পর্বে ফেরে না। ঘড়ির কাঁটা কখনো পেছনে ঘোরে না। আমরা কখনোই সেকেন্ড চান্স পাব না। এভাবে বলার পর ব্রুক বলেন, কিন্তু থিয়েটার সব সময় নতুন করে শুরু হয়। দৈনন্দিন জীবনে “যদি” একটি কাল্পনিকতা, থিয়েটারে “যদি” একটি নিরীক্ষা। দৈনন্দিন জীবনে “যদি” একটি ছল, কিন্তু থিয়েটারে “যদি” একটি সত্য। পিটার ব্রুক অবশেষে বলেন, আমরা যখন এই সত্য বিশ্বাস করতে পারি, তখন থিয়েটার আর জীবন এক হয়ে ওঠে।
৭
জীবন আর নাট্যের এই অবিভাজ্যতা—পিটার ব্রুক সারা জীবন খুঁজেছেন। কারণ, ব্রহ্ম তো বিশ্বসংসারের সর্বব্যাপী এক অনাদি বিন্যাস। তাহলে যা আত্ম, তা তো অবশেষে ব্রহ্ম। অভিনয়ে আত্মসত্তা সৃজনের কাজ তো বিশ্বসত্তা নির্মাণেরই প্রচেষ্টা। মিস্টার পিটার ব্রুক অথবা মসিয়েঁ পিটার ব্রুক আপনি শান্তিতে থাকুন। আপনাকে গুডবাই বলব না। বলব অ রভোয়াঁ—আবার দেখা হবে। আমাদের যে কেউ যখনি কোনো শূন্যস্থান দিয়ে হেঁটে যাব, তখনি আপনার সাথে দেখা হবে। আপনিও হয়তো চিদানন্দে আমাদের দেখবেন!
RIP my dear comrade Peter Stephen Paul Brook CH CBE. Thank you Shahman Moishan Sir, for your very informative article. As an actor I got so many reminders including “Empty Space”, “In the heat of the moment”
Tarek Chowdhury
জুলাই ০৬, ২০২২ ১৮:৪৭