ধবল দুঃখের মতো আবিদ আজাদ!


আবিদ আজাদ [১৯৫২-২০০৫] আমার কবিতার সঙ্গী। আমরা একই সময়ের মানুষ, একই সমাজের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘেরাটোপের মধ্যে বসবাস আমাদের। ফলে আমরা অচিরেই কবিতার বন্ধু হিসেবে চলতে শিখলাম। সদ্য স্বাধীন দেশের নাগরিকের যেসব আনন্দ-বেদনার ঢেউ তা আমরা ভোগ করলাম। আর তা উপভোগ করলাম আমাদের কবিতার ভেতর দিয়ে। আমরা তাই লিখলাম যা দিনের আলোর মতোই স্বচ্ছ ও রাতের আঁধারের মতো নারকীয়। আমি বলতে চাই, দিনের আলোর কর্কশ আর রাতের অন্ধকারে ছাওয়া ভালোবাসা আমাদের উন্মত্তপ্রায় তারুণ্যকে গ্রাস করে নিয়েছিল। এমন একটি ঘোরের মধ্যে সেই যাপন ছিল যাকে জীবনের অরবিট থেকে আলাদা করা যায় না। আবিদ আজাদের কবিতা থেকে সেই সময়ের পঙক্তিগুলো তুলে এনে দেখা যাক, সেখানে কী কী উপাদান-উপকরণ ব্যবহৃত হয়েছে; সত্তায় তার রূপ কীভাবে ফুটে উঠেছে।
‘নির্মিত কহ্লারে যেন পাই আবক্ষ বাংলাদেশ’—এই কবিতাটির কয়েক পঙক্তি পড়ে দেখা যাক।

বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে ফুটে উঠল এক সাদা কহ্লার
আমাদের লোকগাথার হংসগুচ্ছের মতো
রবীন্দ্রনাথের মতো
ঝাঁকড়া চুলের নজরুলের মতো
পিছনে মেঘের মতো বিশাল মিছিল নিয়ে আসা মওলানা ভাসানীর মতো
একঝাঁক পায়রা-ওড়া শেখ মুজিবের হাতের মতো 
বাউল গানের আর্তনাদের মতো
জীবনানন্দের চিলের মতো
সারা গ্রাম-বাংলার বুকের ধবল দুঃখের মতো
বাংলাদেশ ব্যাংকের  সামনে ফুটে উঠল সাদা শাপলাফুল।

এই অংশ নিয়ে কথা বলা যাক। বাংলাদেশ ব্যাংকের সামনে, মতিঝিলের তিন রাস্তার মোড়ে যে শাদা শাপলা ফুলের স্ট্যাচুটি নির্মিত হয়েছে, আবিদ সেই কহ্লার নিয়ে লিখেছেন কবিতাটি। শাপলা আমাদের জাতীয় ফুল। ওই প্রতীকটি কেবল আমাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক চেতনারই সিম্বল নয়, যেন আমাদের সব গগনস্পর্শী মননেরও প্রতীক। অন্তত আবিদ আজাদ সেভাবেই দেখেছেন ওই শাপলা-স্ট্যাচুকে। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, যিনি ওই শাপলার স্ট্যাচুটির নান্দনিক রূপ দিয়েছেন, তাঁর চেতনায় কাজ করেছে কেবল দেশ ও জনগণের কথা। কিন্তু আবিদ আজাদ ওই নির্মিত কহ্লারকে কতভাবে দেখেছেন তা প্রকাশ পেয়েছে উদ্ধৃত পঙক্তিগুচ্ছে।

প্রথম পঙক্তিতেই আবিদ বলছেন ওই কহ্লারটি বাংলার লোকগাথার হংসগুচ্ছের মতো। বাংলার লোকগাথার যে নান্দনিক ও রূপসী গল্প আছে সেই ঐতিহ্যকে এক টানে গেঁথে দিয়েছেন তিনি কহ্লারের ডানায়। এতে করে গোটা বাংলাদেশ ফুটে উঠেছে তার সমগ্রতা নিয়ে। আমাদের লোকায়ত সাংস্কৃতিক ধারাস্রোত যে অনন্য এক জায়গা জুড়ে আছে তা তিনি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতেন বলেই রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, মওলানা ভাসানী ও বঙ্গবন্ধুর আগে তিনি তাঁর প্রিয় বাংলাকে স্মরণ করেছেন লোকগাথার উপাদানের উল্লেখের মধ্য দিয়ে। তারপর তিনি ওই মনীষী রবীন্দ্রনাথ, নজরুলকে স্মরণ করেছেন। লক্ষ্য করলেই বুঝবেন, রবীন্দ্রনাথের নামের আগে কোনো বিশেষণ নেই। রবীন্দ্রনাথ নামটিই যে বিশেষণ, সেটা আমরা বুঝি যখন নজরুলের নামের আগে ‘ঝাঁকড়া চুল’ ব্যবহার করেন তিনি। ‘দ্রোহী’ শব্দটি দিয়েও তিনি নজরুলকে চেনাতে পারতেন। কিন্তু অতিব্যবহারে ওই শব্দটি অনেকটাই ক্লিশে হয়ে গেছে। বরং ঝাঁকড়া চুলের মধ্যে যে শারীরিক ইমেজের একটি প্রতিরূপ মেলে, তা অনেকটাই বাস্তব বোধাক্রান্ত।

পিছনে মেঘের মতো বিশাল মিছিল নিয়ে আসা মওলানা ভাসানীকে যখন চিত্রিত করেন আবিদ, তখন আমরা এক তুখোড় বিপ্লবী রাজনীতিকের আপোষহীন চেহারা দেখতে পাই। ওই কহ্লারটি যেন মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক দিকদর্শনের মতোই বাঙ্ময় হয়ে আছে; ধারণ করেছে উন্মাতাল চেতনার বাংলাদেশের সমগ্র রূপ।

আজ যদি ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ দিই তাহলে দেখব তার ইতিহাসের অধিকাংশ প্রদেশ জুড়ে রয়েছে অপ্রাপ্তি আর সর্বত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র। সেখানে আছে মূলত শুষে নিংড়ে খাওয়ায় উন্মত্ত রাজনীতি ব্যবসায়ীদের অপচ্ছায়া। এই ইতিহাসে দেশের মানুষ নেই, তাদের পাশে আছে পার্টির মানুষ, যাদের চেহারা নেই। তারা আদলহীন দলান্ধ প্রাণবীজ...

শেখ মুজিবের হাতের মতোই একঝাঁক পায়রা-ওড়া যেন ওই কহ্লার বা শাপলাফুলটি। ওই শাপলাফুলটি বাউল গানের আর্তনাদের মতো চিরকলের বেদনায় জর্জরিত। জীবনানন্দ দাশের চিলের মতো তীক্ষ্ণ চিৎকারে ভরপুর, যে বেদনার যেন শেষ নেই। যে দুঃখ ধবল যা শাদা চোখে দেখা যায় না, সেই রকম বাংলার ধবল দুঃখ ধারণ করে আছে ওই কহ্লার। অর্থাৎ আনন্দ-বেদনায় গাঁথা ওই শাপলা ফুলটি আমাদের জাতীয় আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক পরিস্থিতির সব কিছু ধারণ করে আছে।

‘এই শাদা ফুল আমাদের রাজধানী’ বলেছেন আবিদ আজাদ। আমাদের রাজনৈতিক চেতনার রাজধানী ঢাকা মহানগরের পাশে গোটা দেশের প্রতীকও ওই শাপলা। তারপর তিনি বলছেন ওই শাপলা ফুলটি হাওড় এলাকার মানুষের প্রতিনিধি। আবিদ আজাদ কিশোরগঞ্জের মানুষ ছিলেন। তিনি তাঁর এলাকার হাওড়ের মানুষের সাথে সমন্বিত করেছেন কবিতাটিকে। তারপরই তিনি বলেছেন তাঁর একান্ত ব্যক্তিগত পরিবারের এক সদস্যের কথা; তিনি তাঁর ফুপু। ‘ওই সাদা ফুল জল থৈ থৈ ভাটির দেশের দূর পাড়াগাঁ’র আঙিনায় একজোড়া/গহীন নৌকোর মতো কালো চোখ নিয়ে ফুটে থাকা আমার ছোটো ফুপু।’
আবিদ এ-কবিতায় পরের স্তবকে বলছেন—

এই সাদা ফুল আমাদের স্বাধীনতা
এই সাদা ফুল আমাদের পার্লামেন্ট
এই সাদা ফুল আমাদের অতিথিভবন
এই সাদা ফুল আমাদের ন্যাশনাল আর্ট-গ্যালারি
এই সাদা ফুল আমাদের টুরিস্ট ব্যুরো
এই সাদা ফুল আমাদের ইস্টিশন মাস্টারের মেয়ে
এই সাদা ফুল আমাদের ভোর

আবিদের মনের মধ্যে যা কিছু ছিলো স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে, এই কবিতায় যেন তারই বর্ণনা আমরা পাই। আমাদের স্বাধীনতা, পার্লামেন্ট, অতিথিভবন, আর্ট-গ্যালারি, টুরিস্ট ব্যুরো, ইস্টিশন মাস্টারের মেয়ে এবং প্রাকৃতিক ভোর। এই ভোর শব্দটি একটি দিনের সূচনা-শব্দ। নতুন দিনের সূচনার প্রতীক সে। নতুন দিগন্তেরও সূচনাকারী হচ্ছে ভোর।  আরো বহুভাবেই ভোর শব্দটিকে বর্ণনা করা যায়।
ওই শাদা ফুলের সাথে মিশে আছে আবিদ আজাদের চিন্তার ক্ষেত্রগুলো। তিনি নানান রকম চিত্রকল্পের উপাদানে সাজিয়ে তুলেছেন ওই কহ্লারটিকে। নাইট শিফটের নার্সের মতো ওই  সাদা শাপলা ফুলটি। রাতে কর্মরত নার্সের মতো যদি হয় ওই কহ্লার, তাকে তিনি আবার সাজিয়েছেন রূপকথার কড়ির ঘুমন্ত পাহাড়ের মতো করে, ভয়ার্ত তেপান্তরের মাঠে রাজপুত্রের লক্ষ্যের মতো, রাক্ষসের বন্দিত্ব থেকে মুক্ত রাজকন্যার মতো করে। এখানে কতকগুলো সিমিলি নির্মাণ করেছেন তিনি। নার্সের শাদা অ্যাপ্রোনের মতো, কড়ির পাহাড়ের মতো, রাজপুত্রের লক্ষ্যের মতো। এই সব উপমার সাথে জড়িয়ে আছে এক একটি দীর্ঘ চলচ্চিত্রিক চিত্রকল্প, যা আমাদের টেনে নিয়ে যায় এর গভীরে। এ-বিষয়ে কবি শঙ্খ ঘোষ-এর একটি বক্তব্য তুলে দেয়া যাক, ‘ভাবতে হয় যে মানবসংঘের চেতনার আরেকটা স্তরকে ছুঁতে চায় কবিতা, যে স্তরে  তার মধ্যে লীন হয়ে আছে আবহমান রিচুয়াল। এই স্তরকে গোপনে কাঁপিয়ে দেবার জন্যই কবি নিয়ে আসেন তাঁর লোকায়ত প্রতিমাভাণ্ডার, তাঁর ছন্দসম্পদ, তাঁর মিল। প্রাত্যহিকের আবর্তের মধ্যে একটা বিন্যাস আবিষ্কার করে নেবার জন্যই কখনো কখনো  তাঁর দরকার হতে পারে এই সামঞ্জস্যের পথ।’ [ শঙ্খ ঘোষ, শব্দ আর সত্য]

আবিদ আজাদ, আমার মনে হয় তাঁর মনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা আবহমান রিচুয়ালের অংশই এ-কবিতার বিভিন্ন পঙক্তিতে তুলে এনেছেন। যাতে করে আমরা যারা তাঁর পাঠক, তাদের স্মৃতিসত্তার ভেতরের প্রতিমার সাথে মিলিয়ে দেখতে পাই।

এই সাদা ফুলের ছায়ায় ফুটে আছে আমাদের কুঁড়েঘর
যে কুঁড়েঘরের চালগুলি বহুদিন শুনেছে যুদ্ধবিমানের গর্জন
যে কুঁড়েঘরগুলি বর্ষারাতে কান পেতে শুনেছে মর্টারের শব্দ
যে কুঁড়েঘরগুলি উঠোনে দাঁড়িয়ে খড়ের গাদার পাশে শুনেছে লাজুক কিষানির আর্তনাদ
যে কুঁড়েঘরগুলি জ্যোৎস্নারাতে দেখেছে চকচকে বন্দুকের নল

এখানে কুঁড়েঘর হলো বাংলাদেশের গরিব মানুষের প্রতীক বা প্রতিমা। কুঁড়েঘর বললেই ফুটে ওঠে বাংলাদেশের গ্রামীণ সামাজিক চেহারা। একে আমরা অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক চেহারাও বলতে পারি। কেন না, এরাই আমাদের আপামর জনতার বৃহত্তম অংশ। ওই জনতা শুনে চলেছে যুদ্ধবিমানের গর্জন, মর্টারের শব্দ, কিষানির আর্তনাদ, দেখেছে চকচকে বন্দুকের নল। এই সব উপকরণের সাথে যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশের পরিচয় ও সম্পর্ক স্বাধীনতার আগে থেকেই। স্বাধীনতার পরও যে নেহাত কম নয় ওই সব উপকরণের শব্দ ও তার ব্যবহার, সেটা কি আমরা ভুলে যেতে পারি? আরো কয়েকটি পঙক্তি আছে এ-কবিতায়, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, তার ক্ষয় ও ক্ষতি এবং আমাদের ছিন্নভিন্ন জীবনের ছবি। এ-সবই এই কবিতার মূলমন্ত্র, কহ্লারে মুদ্রিত আবক্ষ বাংলাদেশের চেহারা-সুরত।

‘এই শাদা ফুল আমাদের রাজধানী’ বলেছেন আবিদ আজাদ। আমাদের রাজনৈতিক চেতনার রাজধানী ঢাকা মহানগরের পাশে গোটা দেশের প্রতীকও ওই শাপলা। তারপর তিনি বলছেন ওই শাপলা ফুলটি হাওড় এলাকার মানুষের প্রতিনিধি। আবিদ আজাদ কিশোরগঞ্জের মানুষ ছিলেন...

চিত্রকল্পময়তাই আবিদের প্রধান প্রবণতা। লক্ষ্য করলেই আমরা দেখব তাঁর কবিতায় চিত্রকল্পের সমাহার। সেই সাথে তিনি বিশেষণের পর বিশেষণ ব্যবহার করতে উৎসাহী। গত শতকের সাতের দশকের কবিতার প্রবণতা প্রধানত রাজনৈতিক হলেও তাকে প্রতীকী ব্যঞ্জনা ও মিথিক পরম্পরার পরিষেবা দিয়ে নতুনতর করে তুলেছেন অনেক কবিই। ভাষা ব্যবহারের ক্ষেত্রেও কথ্য ভঙিমাকে তারা আবাহন করেছেন। তবে প্রচলিত প্রমিত ভাষা-সজ্জার সাথে লোকবুলি বা লোক বাংলার শব্দসম্ভার ব্যবহারে তারা অনেকটাই পারঙ্গমতা দেখিয়েছেন। আবিদের কবিতা থেকে তার দু-একটা  উদাহরণ দেয়া যাক—

এই তোর অভয়ারণ্য, এই তোর
স্বাধীন চারণভূমি, এই তোর নিরাপদ স্বর্গাদপি
গরীয়সী জন্মজনমের জন্মভূমি—
এই তোর একান্ত পৃথিবী
এরই স্বত্বাধিকার আমি তুলে দিচ্ছি তোর হাতে
এরই স্বপ্নে তুই ভাল থাকবি,
 সুখে থাকবি বিষাক্ত দুধেভাতে—
[অভয়ারণ্য]

তুই-তুকারি করার ভাষা মূলত লোকজ সমাজের। কথ্য ভাষার প্রধান প্রবণতাই এটা। আবিদ এখানে সেই একান্ত ঘনিষ্ঠ শব্দটি ব্যবহার করেছেন গণমানুষের প্রতিনিধিত্ব সৃষ্টির জন্য। কবিতায় বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর থাকা একজনকে কবিতার কথক বলছেন, তোকে এই স্বাধীন দেশটি দিয়ে যাচ্ছি। কথক এটাই বলে যাচ্ছেন যে, এখানে কীভাবে সে ভালো থাকবে? ‘বিষাক্ত দুধেভাতে’ বলার পর আমরা বুঝতে পারি তার মারণযন্ত্রণার শ্লেষটা। দুধভাতে বাঁচার কথা যে কবি বলেছিলেন মধ্যযুগে, তাকে তিনি ব্যঙ্গ করছেন এভাবে যে, এখন বিষাক্ত দুধেভাতে আমরা বেঁচে থাকব এবং ভালো থাকব। এই শ্লেষবাণের কারণ কী? সে কি এদেশের আপামর জনগণের মধ্যে যারা ব্যবসা করেন, বিশেষ করে খাদ্যবস্তুর ব্যবসায় জড়িত, তারা নিত্যই এমন সব বিষ মেশায় খাদ্যদ্রব্যে, উপাচারে, ফলমূলে, যা নিত্যই ব্যবহারের তালিকায় থাকে আমাদের, সেই খাদ্য যখন বিষে দূষিত হয়, ফরমালিনে ভরে ওঠে, তখন তো আমরা ‘বিষাক্ত দুধেভাতে’ ভালো থাকবই!
উদ্ধৃত পঙক্তিগুলোর ভেতর দিয়ে আমাদের জাতীয় সামাজিক রাজনৈতিক ও শঠ-চেতনার স্বরূপ উদ্ঘাটিত হয়েছে। আমরা জাতি হিসেবে কতোটা আত্মধ্বংসপ্রবণ, তা একটি পঙক্তির মাধ্যমেই ফুটে উঠেছে, আমরা বুঝতে পারি।

স্তব্ধতার একটা আলাদা গন্ধ পাই আজ
যেমন পেঁয়াজ তেলে ডালের ফোড়ন দিলে হয় ;
[আগামী জন্মের বুকে স্তব্ধতাকে এভাবে জাগাও]

এই দুটি পঙক্তি পাঠকের মনের মধ্যে এসে ধাক্কা দেয়। স্তব্ধতার কোন ঘ্রাণ আছে? লৌকিক জীবনের ডালের ফোড়নের সাথে সেই স্তব্ধতার যিনি সিমিলি সৃষ্টি করেন, তিনি যে কল্পনার এক রাজা, সে আমরা বুঝতে পারি।

আবিদ আজাদ অনেক সময় কবিতায় তাঁর কথাগুলো বলেন অনেকটাই বর্ণনাত্মক ঢঙে, যার মধ্যে ঘটে কয়েকটি চিত্রের সমাহার। যেমন, ‘আমি জানি তার শূন্য চোখের সামনে তখন ভেসে উঠবে/এক শীতের ভোরে/শিমুল গাছের নিচে/উদ্ধার করা তার হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যাওয়া ছেলের লাশ।’[এখন যে কবিতাটি লিখব আমি ] মূল উদ্দিষ্ট হচ্ছে ছেলের লাশের কথা বলা এবং তা ভেসে উঠবে চোখের সামনে। এই বর্ণাত্মক চিত্রের সমাহার ছাপিয়ে ওঠে লাশটি। তখন পাঠকের চৈতন্যে হামলে পড়ে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের এমন বহু রক্তাক্ত ছবি। প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে রক্তাক্ত লাশের যে বৈসাদৃশ্য, তাকে সমন্বিত করে সৃষ্টি হয় আরেকটি নগ্ন-নিষ্ঠুর প্রতিচ্ছবি, যা বাংলাদেশ বহুবার দেখেছে এবং এখনো দেখে আসছে। কবির কাজই হলো তার কবিতাকে ভবিষ্যতের পাঠকের হাতে পৌঁছে দেয়া, যাতে সে ও তারা কবির সময়কালকে অনুধাবন করতে পারে। আবিদ আজাদ সেই কাজটিই করতেন তাঁর কবিতায়। যেমন করেছেন ‘এখন যে কবিতাটি লিখব আমি’ কবিতায়। কবিতাটি থেকে আরো কিছু অংশ দেখা যাক—

এখন যে কবিতাটি লিখব আমি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে দুটো লোহার ঠান্ডা হাতকড়া
তার জন্যে অপেক্ষা করছে একটি চকচকে ঘাতক ছুরি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে ভাড়া করা মাস্তানদের একটি কালো গাড়ি
তার জন্যে অপেক্ষা করছে ক্যান্টনমেন্টের একটি রক্তপায়ী বাড়ি
তার জন্য অপেক্ষা করছে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের একটি হিংস্র চেয়ার
তার জন্য অপেক্ষা করছে উচ্চাভিলাষী কয়েকজন জেনারেলের ষড়যন্ত্রের
একটি নির্মম নির্জন মধ্যরাত—

অর্থাৎ আবিদ আজাদ যে-কবিতাটি লিখতে যাচ্ছেন, সেই অলিখিত কবিতার জন্য, যা যা হতে পারে, তিনি তারই বর্ণনা লিখেছেন। আমরা অলিখিত বা অকথিত কবিতার মর্মবাণী উপলব্ধি করতে পারি। পাঠককে উদ্দীপিত করার যে টেকনিক আবিদ নিয়েছেন, তা আমাদেরই প্রত্যাশারই অন্তর্গত, কিন্তু আমরা তা বলতে পারছি না। এই অকথিত কথা যে কতটা শক্তিশালী তা সৌন্দর্য ব্যবসায়ীরা বেশ ভালো জানেন।

আজ যদি ৫০ বছর বয়সী বাংলাদেশের প্রতি মনোযোগ দিই তাহলে দেখব তার ইতিহাসের অধিকাংশ প্রদেশ জুড়ে রয়েছে অপ্রাপ্তি আর সর্বত্র ক্ষমতাকেন্দ্রিক ষড়যন্ত্র। সেখানে আছে মূলত শুষে নিংড়ে খাওয়ায় উন্মত্ত রাজনীতি ব্যবসায়ীদের অপচ্ছায়া। এই ইতিহাসে দেশের মানুষ নেই, তাদের পাশে আছে পার্টির মানুষ, যাদের চেহারা নেই। তারা আদলহীন দলান্ধ প্রাণবীজ।

আবিদ আজাদের কবিতা নিয়ে যা বলতে চাই তা বলা হলো না। কারণ আমার সীমাবদ্ধতা, ভাষার সীমাবদ্ধতা, প্রকাশের সীমাবদ্ধতা…। আমি যা বলব বলে মনে মনে ঠিক করি, লেখর সময় তা লিখতে পারি না। বাধা হয়ে ওঠে আমারই যাপিত জীবনের শব্দমালা। শব্দের অন্তর্গত অর্থদ্যোতনা আমাকে তেমনভাবে টানতে পারছে না। কারণ শব্দের অর্থ ও তার ব্যঞ্জনার্থ আমার চিন্তার সাথে সঙ্গী হতে পারছে না । তাহলে আমরা কোথায় যাব কবিতার ভাষা আর শব্দের নিজস্ব ও অন্তর্গত অর্থ পাওয়ার জন্য?