গণমননের কবি সাবদার সিদ্দিকী
তরতাজা সকালে দেখা হলো তাঁর সঙ্গে, নিউমার্কেটের বলাকা গেটে। বললেন, মাহবুব, চলেন, চা খাই। আমি মাথা দুলিয়ে সায় দিলে তিনি ভেতরে ঢুকতে পা বাড়ালেন। যাব মনিকো রেস্তোরাঁয়। ভেতরের সার্কেলে ঠিক পুব দিকে ওই রেস্তোরাঁ [ছিল, আজ নেই, উঠে গেছে]। গতকাল সন্ধ্যায় তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয়েছে আমার। আমি সদ্যই মুক্তিযুদ্ধ থেকে ফিরে এসেছি কলেজের হোস্টেলে। ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলের ৩০১ নম্বর রুমে থাকি, আরও একজন থাকে এ রুমে। যিনি আমার রুমমেট, সে সম্পর্কে আমার ভাগনে, খালাতো বোনের বড় ছেলে রফিক। রুমগুলো ডবল সিটেড।
সেই সময় ও বয়সে, সাতসকালেই ঢাকার জীবন শুরু হতো। আমি হোস্টেল থেকে বেরিয়ে বাইরের চিটাগাং হোটেল/বা রেস্তোরাঁয় নাশতা সেরে নিউমার্কেটে চক্কর দেব ভেবে বলাকা গেটে গেছি। সেখানেই দেখা হলো সাবদার সিদ্দিকীর সঙ্গে। শাদা প্যান্ট আর ট্রাউজার পরা।
আমি খুব সমীহ করে কথা বলি তাঁর সঙ্গে। তিনি একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার [স্বদেশ] সম্পাদক এবং বয়সে আমার চেয়ে এক ছটাকখানি বড়। তরতর করে চলোচ্ছলো স্বরে কথা বলেন বাংলা-ইংরেজিতে। ওই স্বরে ঢাকার কোনো তরুণ কথা বলে না, বলতে দেখিনি বা শুনিনি। যাকে বলে স্মার্ট গাই, সাবদার তাই। তিনি সেভাবেই কথা বলেন। কণ্ঠে সামান্য ক্যালকেশিয়ান টান। গতকালই তা টের পেয়েছি। নাম তাঁর গোলাম সাবদার সিদ্দিকী [১৯৫০-১৯৯৪]।
এখন মনে হয়, ওই নাম বড্ড বেমানান ছিল তাঁর জীবন ও চেতনার সঙ্গে। পরে তিনি নাম থেকে গোলাম ছেঁটে ফেলে কেবল সাবদার সিদ্দিকী নাম লিখতেন।
কী লিখতেন তিনি? কবিতা। গদ্যও।
২
বাউণ্ডুলে স্বভাব বলতে যা বোঝায়, সাবদারকে ঠিক সে রকমই মনে হয়েছে আমার। বাহাত্তর সালের কোনো একদিন তিনি আমাকে যেতে বলেছিলেন তাঁর বাসায়। তিনি তখন উঠেছিলেন এলিফ্যান্ট রোডের একটি ফ্ল্যাটবাড়ির সেপারেটেড সিঙ্গেল রুমে। সকাল ৯টায় গিয়ে দেখি তিনি তখনো বিছানায়। তাঁর মাথায় দীঘল ঘন কাঁধ ছোপানো চুল, শাদা বালিশে তিনি মোচড় খেয়ে উঠে বসলেন এবং বললেন, বসেন। আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
সাবদার সিদ্দিকীর কবিতাসংগ্রহ পড়ে আমরা তাঁকে জানতে ও চিনতে চাই আজ, আসলেই তিনি কেমন কবি ছিলেন এবং কী লিখেছেন। তাঁর সাংস্কৃতিক ও কাব্যিক দ্রোহের পেছনে অবশ্য ছিল মানুষের প্রতি প্রেম ও সচেতন দায়বদ্ধতা, কিন্তু এক উড়োজীবনের সুতো ধরে তিনি জীবনে শিল্প ও শিল্পের জীবনের মধু কেমন করে পান করতে চেয়েছেন, সেটা পরখ করা যাক
বোধ হয় এই প্রথম শুনলাম, হাত-মুখ ধুয়ে আসাটাকে ফ্রেশ হয়ে আসা বলে। বুঝলাম, তাঁর সাংস্কৃতিক অ্যান্টেনা আমাদের তুলনায় অনেকটাই ওপরে। তিনি আমাদের চেয়ে কেবল বয়সেই নন, চেতনায়ও বাংলাদেশে প্রাগাধুনিক। তিনি ধরেই নিয়েছিলেন যে তাঁর কবিতাযাত্রীরা বাংলাদেশের ষাটের কবিরা। কিন্তু আসলে তিনি সত্তরের প্রজন্মের মানুষ। এ কারণে আমার বা আবিদ-শিহাব-এর চেয়ে মিশতে থাকেন আবুল হাসান, নূরুল হুদা, অসীম সাহা বা নির্মলেন্দু গুণের সঙ্গে। আমরা তখনো তামাকে আসক্ত নই, কেবল আবিদ আজাদ, অকালপক্ব তামাকসেবক হিসেবে আমাদের সঙ্গী, একটা সেতুর মতো সাবদার জুটে গেলেন আমাদের সঙ্গে। তিনি এ-কূলে ও-কূলে—দুকূলেই তাঁর জীবন ও শিল্প যাপন করে যাচ্ছিলেন। এর মধ্যে সদ্য স্বাধীনতার মতোই ছড়িয়ে পড়ছিল গাঁজার ব্যবহার। কেন, কারা, কীভাবে গাঁজা আমাদের তরুণসমাজের নেশার সামগ্রী হয়ে উঠল, তা আমরা বুঝতেও পারলাম না। সেই সঙ্গে আরও কয়েক বছর পরে এল নেশার ট্যাবলেট ম্যানড্রেক্স ও সিডাকসিন আর কাশির সিরাপ ফেনসিডিল। ফেনসিডিল চকোলেটের মতো ঘন রসে ভরপুর ছিল, যাতে শিশু-কিশোরেরা তা চেটে খেতে পারে এবং কাশির উপশম হয়। পরে সেই নামটি ঠিক রেখে তরল ফেনসিডিল আসে বাজারে। সেই ফেনসিডিল নেশার বস্তু। ওই নেশার পণ্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের বেশি মাত্রায় আসক্ত করেছিল। আর গাঁজা ছড়িয়ে পড়ে সর্বত্র। নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষ, যারা আয়-রোজগারে তেমন কোনো সুবিধা করতে পারছিল না। সেই আসক্তির রাজনৈতিক কারণ যা-ই থাক, একটি নতুন জাতিসত্তার স্বপ্ন ও কল্পনাকে ভিন্ন খাতে ও হতাশায় নিমজ্জনের জন্যই যে তার বিস্তার ঘটানো হয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কেবল ঢাকা শহরে নয়, জেলা শহরগুলোতেও মদের দোকানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। লিকারশপ নামের সেই সব দোকান থেকে যেকোনো তরুণ বিনা বাধায় সেসব নেশার পণ্য কিনতে পারত। নির্মলদা [নির্মলেন্দু গুণ] আসক্ত হয়ে পড়েছিলেন গাঁজায় আর আবুল হাসান মদাসক্ত হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর হার্ট এক্সপান্ড হয়ে গেছিল। কম-বেশি অধিকাংশই তখন নেশায় জড়িয়ে পড়ে। সেই দলে সাবদারও ছিলেন। মাত্র বছর কয়েকের মধ্যেই সাবদার এতটাই আসক্ত হয়ে পড়েন যে তাঁকে সামাল দেওয়া যায়নি। হলে সিট পাইনি বলে তখনো আমি ঢাকা কলেজের সাউথ হোস্টেলেই থাকি, একতলার একটি সিঙ্গেল রুমে। সাবদার প্রায়ই আসতেন মাতাল হয়ে। কোনো তোয়াক্কা না করে আমার সিটে শুয়ে পড়তেন। মাতাল অবস্থায় দূরের বাথরুমে যেতে নিষেধ করেছিলাম আমি, যদি হিসি পায়, তাহলে জানালা ব্যবহার করত। পশ্চিমের দিকটা ২০/২৫ ফিট খালি। তারপর বাউন্ডারি ওয়াল। তারপর বিডিআরের চাঁদমারির বিশাল মাঠ। ওই দিনগুলোতে, যখনই তিনি আসতেন, সব দিন নয়, মাঝেমধ্যেই আসতেন, আমি জ্বালাতনই মনে করতাম। হোস্টেলের ছাত্ররা জানতে পারলে আমাকে তিরস্কার করবে, এই ভয়ে আমি তাঁকে নিষেধ করেছিলাম আসতে। তারপর, আমি ওই সিঙ্গেল সিট ছেড়ে উঠে এলাম বন্ধু হাসান হাফিজের রুমে। সে তখনো রেগুলার ছাত্র। সেখানে প্রায়ই আসতে শুরু করলেন কবি আবুল হাসান। হাসান ভাই আমার অগ্রজ মাহবুব সাদিকের বন্ধু, তাই আমি তাঁকে খুব পছন্দ করতাম। তিনিও। আর হাসান হাফিজের সঙ্গে তাঁর সখ্য গড়ে উঠেছিল লেখকসত্তা হিসেবে। আবুল হাসান প্রায়শই হাসান হাফিজের শার্ট পরে বেরিয়ে যেতেন। কেননা, হাসান ভাইয়ের শার্ট ময়লা হয়ে যাওয়ায়, তিনি যেহেতু গৃহচ্যুত ছিলেন বন্ধুর [মাহফুজুর রহমান/অবজারভার এর সাংবাদিক ছিলেন] সঙ্গে রাগ করে চলে এসে, সঙ্গে কাপড়চোপড় আনতে পারেননি বা আনেননি।
এ কথাগুলো বলার পেছনে রয়েছে সেই সময়কার বাউণ্ডুলে সময়ের ছবি বোঝানো। এই তালিকায় আমি আরও অনেক কবির নামই বলতে পারি, যাঁরা ওই সময়ের হাতে বন্দী ছিলেন। পরে, প্রকৃতিই যেন তাঁদের ফিরিয়ে দেয় তার সন্তানদের স্বাভাবিক জীবনের ধারায়। কিন্তু সাবদার ফিরে আসতে পারেননি। তিনি সেই বৈরী নেশার সাম্রাজ্যেই বন্দী ছিলেন।
একদিনের ঘটনা বলি। আমার সঙ্গে তাঁর আর দেখাই হয় না। আমার কর্মজীবনের কারণেই আমি বিচ্ছিন্ন হয়ে যাই। কিংবা সাবদারও আমাকে খুঁজে পান না। আজিজ মার্কেটে একদিন দেখি চটের প্যান্ট আর শার্ট পরে সাবদার হাজির। আমাকে বললেন, পাঁচটা টাকা দেন তো মাহবুব।
আমি দশ টাকা বের করে দিয়ে বললাম, একি অবস্থা আপনার সাবদার ভাই?
তিনি হাত এমনভাবে ঝাড়লেন যে বাতাস তাড়াচ্ছেন।
বাদ দেন।
বলে হন হন করে হাঁটতে লাগলেন বাইরের দিকে।
তাঁর সঙ্গে সেই আমার শেষ দেখা।
মুনীর মোরশেদের দোকান ও প্রকাশনা সংস্থা `ঘাস ফুল নদী’তে নিশ্চয় সাবদারের যাতায়াত ছিল, নিয়মিতই। আমার বন্ধু মাহবুব কামরান আর মুনীরের ক্রিয়েটিভিটি নিয়ে কোনো তর্ক ছিল না আমার। ওরা যে সাবদারের ওই চেতনার প্রতি অনুরক্ত ছিল, সাবদার সিদ্দিকীর ‘কবিতাসমগ্র’ প্রকাশ থেকেই তা অনুমান করতে পারি। আমার পরবর্তী প্রজন্মের কবি পুলক হাসানও সাবদারের অনুরক্ত আজও। মূলত পুলকের উৎসাহে ও প্ররোচনায়, মুনীর মোরশেদ ও কামরান অকালপ্রয়াত সাবদার সিদ্দিকীর কবিতাসংগ্রহ প্রকাশ করেছে তারা, এ-তথ্য জানিয়েছেন কবি ও গদ্য শিল্পী আবদুল মান্নান সৈয়দ, এ বইয়ের ভূমিকায়। এই বইয়ের প্রচ্ছদ দেখে কামরানের শিল্পচেতনার স্পর্শ আবারও পেলাম আমি। কামরান অকালে ঝরে পড়েছেন প্রকৃতির বিছানায়, এই বেদনার ভার বয়ে বেড়াই আমরা, কামরানের বন্ধুরা, যাদের যাতায়াত ছিল নারায়ণগঞ্জে, বোস কেবিন, আলম কেবিনে,—অকালপ্রয়াত গল্পকার কবি ওয়াহিদ রেজার ডেন্টাল কেবিনে এবং কখনো প্রেসক্লাবে, শীতলক্ষার কোনো ভাসমান নৌকায় বা আরও কিছু জায়গায়।
৩
আমি জানতাম ঘাস ফুল নদী নামে একটি সংগঠন ছিল মুন্সিগঞ্জে, সেটার সঙ্গে মুনীর মোরশেদ, মাহবুব কামরানসহ আরও অনেকেই জড়িত ছিলেন। সেই নামটিই কি না জানি না, মুনীর যখন আজিজ মার্কেটে পুস্তক প্রকাশনী ও বিক্রির দোকান দেয়, তখন ওই নামটিই ব্যবহার করে। মুনীরের রাজনৈতিক দর্শনের সঙ্গে যায় এমন বহু পৃথিবীখ্যাত কবি লেখকের বই ও পোস্টার সে সংগ্রহ করে বিক্রির আয়োজন করে। আমি আজিজ মার্কেটে গিয়ে দেখি মুনীরের দোকানের দরোজায় চে গুয়ে ভারার একটি প্রমাণ সাইজ পোস্টার ঝুলছে। ভেতরে পৃথিবীর বিপ্লবীদের বই, পোস্টার, লিফলেট ইত্যাদি। আমার প্রিয় নেতা মওলানা ভাসানীর আর ছিল সিরাজ সিকদারের পোস্টার।
কামরান ও মুনীর অনুভব করেছিল যে সাবদারের ভেতরে যে আগুন আছে, তা বিপ্লবীর। কিন্তু সাবদার প্রথাগত কোনো বিপ্লবীর অনুসারী ছিলেন বলে মনে হয়নি আমার। তাঁর সৃজনশীল মনে ছিল স্বপ্ন আর কল্পনার রঙধনু, যেখানে মানুষের জন্য অপরিমিত প্রেম ছিল, উসকে দেবার মতো কাগুজে জ্ঞানও ছিল, ছিল রাজনীতিসচেতনতা মানুষের কল্যাণবোধের প্রেক্ষিত ও প্রেরণা, তাঁর কবিতা সে কথাই আমাদের জানিয়েছে।
সাবদার সিদ্দিকীর কবিতাসংগ্রহ পড়ে আমরা তাঁকে জানতে ও চিনতে চাই আজ, আসলেই তিনি কেমন কবি ছিলেন এবং কী লিখেছেন। তাঁর সাংস্কৃতিক ও কাব্যিক দ্রোহের পেছনে অবশ্য ছিল মানুষের প্রতি প্রেম ও সচেতন দায়বদ্ধতা, কিন্তু এক উড়োজীবনের সুতো ধরে তিনি জীবনে শিল্প ও শিল্পের জীবনের মধু কেমন করে পান করতে চেয়েছেন, সেটা পরখ করা যাক।
১৯৯৭ সালের বইমেলায় বেরোনো সাবদার সিদ্দিকীর কবিতাসংগ্রহ আমার হাতে এসেছিল, সেবারই। আমি কিনেছিলাম, কিংবা মুনীর আমাকে দিয়েছিল, আজ আর মনে নেই। এই পুস্তকে আমি স্বাক্ষর করে রাখিনি। ফলে বুঝতে পারছি না—কীভাবে এই চটিসদৃশ কাব্যসংগ্রহ আমার দখলে এলো এবং আমি সাবদারের কবিতারও সমঝদার ভাবি নিজেকে অথবা ভাবতে ভালোবাসি, তাহলে কেন এতকাল তাঁকে নিয়ে লিখিনি? দুর্জ্ঞেয় এই প্রশ্নের কোনো জবাব আমার কাছে নেই।
৪
আসলে কবিতা পড়া আর কবিতা বোঝার মধ্যে অনেকটাই তফাত আছে এবং কবিতার অন্তর চেনা খুবই দুরূহ। সবাই এটা পারে না। এ কাজে তারাই পারদর্শী, যারা কল্পনাকে আকাশের মতো উদার ও স্বপ্নিল করার ক্ষমতা রাখেন, অর্থাৎ স্বপ্নবাজ ও চিন্তক যাঁরা, দেশ সমাজ ও মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি সম্পর্কে সম্যক অবহিত, তাঁরাই কেবল কবিতা বুঝতে ও উপলব্ধি করতে পারেন। আমি নিজের কবিতা চিনি ও বুঝি, কেননা আমি সেগুলো বুঝেই লিখেছি। কিন্তু অন্যের কবিতা কতটা চিনি বা বুঝি, সেটা বলা কঠিন। প্রত্যেক কবির ব্যক্তিগত বিষয় ও ভাবনার জগৎ আছে, যা ভিন্ন ভিন্ন ও তার উপমা, চিত্রকল্পের জগৎও ভিন্নতর পরিপ্রেক্ষিতের। এসব বুঝেছি যখন কাজ করতে গিয়েছিলাম কবিতায় লোকজ উপাদানের ব্যবহার নিয়ে, সেই আড়াই যুগ/তিন যুগ আগে, তখন টের পেয়েছিলাম, কেন প্রকৃত কবিরা তাঁর সংস্কৃতির ওপর এতটা নির্ভরশীল এবং কেন বৈপ্লবিক কাজ করার জন্য হলেও সাংস্কৃতিক চেতনার নিশানটি ওড়াতে হয়।
সাবদার সিদ্দিকীর দুটি কবিতার কথা বলি আগে।
একটির নাম স্বাধীনতা, মিছিলের ট্রাক, অন্যটি হাতুড়ি।
নাম পড়েই মনে হবে দুটি কবিতাই রাজনৈতিক এবং রাষ্ট্রের চরিত্রচিত্রণে যথেষ্ট। কিন্তু দুটি কবিতার সাংস্কৃতিক কাজ দুই রকম।
স্বাধীনতা, তুমি কি নিরপেক্ষ
বন্দুক কিংবা কলমের মতো?
লাল সালুতে জ্বলজ্বল তুমি কি
রবিকরোজ্জ্বল বর্ণমালা?
আমার কলমে জমে থাকা তুমি কি
সুনীল সেই বিষ?
রক্তে আমার দ্রিমিক দ্রিমিক
দ্রাক দ্রাক
তুমি কি হৈ চৈ, মিছিলের ট্রাক।
[স্বাধীনতা, মিছিলের ট্রাক]
এ কবিতায় সাবদার স্বাধীনতাকে জিজ্ঞেস করছে কথাগুলো। আসলে তিনি বুঝতে চাইছিলেন স্বাধীনতার রাজনৈতিক মানে কোনটা? সে কি বন্দুকের? নাকি কলমের? নাকি তা হৈ চৈ-এর, মিছিলের ট্রাকের নাকি আমাদের ভূ-রাজনৈতিক স্বাধীনতা কেবল পতাকার জন্য? আবার সাবদার এটা জানতে চেয়েছেন যে স্বাধীনতা তাঁর লেখার কলমের জমে থাকা সুনীল বিষ কি না। কেন তাঁর স্বাধীনতা মানে বিষ মনে হলো? কেন এসব বিষয়ে এমন সব প্রশ্ন জাগল? কেন তিনি সেই প্রশ্নই উত্থাপন করলেন জনসমুদ্রে? নিশ্চয়, স্বাধীনতা নিয়ে জনমনে নানা রকম প্রশ্ন জাগছিল সেসব দিনেই, যা প্রকৃত জন-আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে উঠেছিল। স্বাধীনতার স্বপ্নস্বাধ নিয়ে উপস্থিত হলেও তা জনগণ ভোগ-উপভোগ করতে পারেনি। যারা স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে, যারা রক্ত দিয়েছে জনযুদ্ধে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হিংস্র-রক্তাক্ত আক্রমণে প্রাণ দিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, তাদের জন্য ক্ষমতাসীন দল কর্তব্যপরায়ণ ছিলেন না বললেও চলে। এ কারণে দেশজুড়ে অসন্তোষ আর বিক্ষুব্ধ জনতার মিছিল চলছিল। মানুষ নানা বিষয়ে সরকারের সমালোচনা করেছে সেদিনগুলোতে। আর সরকার অসহনীয় আচরণ করেছে প্রতিবাদী মানুষের সঙ্গে। ফলে জনগণ এটা বুঝে গেছিল যে তাদের কথা বলার অধিকার, মতপ্রকাশের অধিকার, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ আন্দোলন করার অধিকার সংবাদপত্রের সত্য প্রকাশের অধিকার হরণ হয়ে গেছে। মানুষের অধিকার হরণের এই পরিস্থিতিই কি সাবদারের কবিতার বিষয়? আর সেই কথাই প্রতীকী উচ্চারণে উঠে এসেছে তাঁর কবিতায়।
শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অমর কবিতা, অবিনাশী গান/ কাজী নজরুলের বাবরী দোলানো…ইত্যাদি কবিতাটির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ও রাজনৈতিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল ১৯৭১ সাল, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কাল। আর সাবদার সিদ্দিকীর এই কবিতার সময় স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল বা ১৯৭০-এর দশকের প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব।
প্রথম পর্বটি ছিল বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বাধীন স্বাধীনতার প্রথম সরকার। ১৯৭৫ সালের অর্ধেক পর্যন্ত ছিল সেই শাসন, যা পরিবর্তিত হয়েছিল বাকশাল নামক একদলীয় শাসনে। দ্বিতীয় পর্বটি ছিল সামরিক শাসনাধীনে। সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতা লাভ করেন। এবং তিনি একদলীয় শাসন উল্টে দিয়ে একধরনের বহুদলীয় গণতান্ত্রিক শাসন চালু করেন। তবে, তাঁর শাসনব্যবস্থায় মিলিটারি প্রভাব অনেকটাই বেড়ে যায়। এবং ১৯৭১ সালের পাকিস্তানি দখলদার সামরিক শাসকদের এদেশীয় দালালদের পুনর্বাসিত করেন। ওই সব অবৈধ ও স্বাধীনতাবিরোধী মানুষকে সরকারে নেওয়ায় জিয়ার মুক্তিযোদ্ধার ইমেজ ক্ষুণ্ন হয় এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক চেতনাকে জনগণ মনে করে দেশে বন্দুকের শাসনই চলছে। সাবদারের কবিতায় সে কারণেই স্বাধীনতাকে বন্দুকের শাসনও বলা হয়েছে। এই পঙ্ক্তিগুলো যে সে সময় ও রাজনীতিকে নির্মাণ করেছে, তা আমাদের উপলব্ধি করতে হবে।
শামসুর রাহমানের ‘স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অমর কবিতা, অবিনাশী গান/ কাজী নজরুলের বাবরী দোলানো…ইত্যাদি কবিতাটির সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবেশ-প্রতিবেশ ও রাজনৈতিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ছিল ১৯৭১ সাল, স্বাধীনতাযুদ্ধের সময়কাল। আর সাবদার সিদ্দিকীর এই কবিতার সময় স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল বা ১৯৭০-এর দশকের প্রথম পর্ব ও দ্বিতীয় পর্ব
স্বাধীনতা তুমি কি ‘নিরপেক্ষ’ বলার পরের পঙ্ক্তি বন্দুক কিংবা আমাদের কলমের মতো?’ লিখেছেন।
বন্দুক আর কলম সামাজিক জীবনে দুই মেরুর উপকরণ। সামরিক বাহিনীর শক্তি তার বন্দুকে নিহিত আর আমাদের মানে কবিদের যারা স্বাধীন চেতনা-শাসিত, তাদের শক্তি নিহিত কাগজে-কলমে। বন্দুকের ক্ষমতা সীমায়িত, কিন্তু কলমের ক্ষমতা অসীম। কলমের শক্তি রোধ করার মতো সাহস ও শক্তি কারও নেই। ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল চায় কলমের সাহস ও শক্তিকে নানাভাবে অবরোধ করে রাখতে। সাবদার সেই পরিপ্রেক্ষিত থেকেই, আমার মনে হয়েছে ব্যবহার করেছেন বন্দুক ও কলম শব্দ দুটি। আর স্বাধীনতাকে বলছেন সে কি নিরপেক্ষ? স্বাধীনতা কখনো নিরপেক্ষ নয়। সে জনগণের সাহস ও শক্তির নিশান, সে জনগণের পক্ষের, তাদের আকাঙ্ক্ষিত এক রাজনৈতিক-সামাজিক উদ্ভাসন। একটি জাতির সামগ্রিক সত্তার জাগরূক রূপ, ভূমিবেষ্টিত সীমানার রূপ। আর স্বাধীনতার রূপ হচ্ছে সেই জনগণের আকাঙ্ক্ষিত চাওয়া/পাওয়ার বিষয়-আশয়গুলো, যা রাজনৈতিক অবকাঠামোর ভেতরে গণতান্ত্রিক শাসনপদ্ধতির মধ্যে পাওয়া যায়। আর সেই পুঁজিবাদী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ভেতরেই আছে স্বাধীনতার প্রকৃত সৌন্দর্য ও রূপ। আমার বিশ্বাস, সাবদার সেই অন্তর্নিহিত সত্যই নির্মাণ করেছেন এই পঙ্ক্তিতে। নিজের কলমে জমে থাকা সুনীল বিষ হিসেবে স্বাধীনতাকে চিত্রিত করার পেছনেও আছে তার অভীপ্সার একটি মূল লক্ষ্য। এবং তিনি যেহেতু পাবলো নেরুদার প্রতি অনুরক্ত ছিলেন, তাই বলা চলে তিনি বিপ্লবী চেতনাও ধারণ করতেন। তার রক্তে দ্রিমিক দ্রিমিক/দ্রাক, দ্রাক শব্দই বলে দেয় সাবদার বিপ্লবের ওই চেতনার মতোই নাচছেন হৈ চৈ-এর প্রতিবাদী মিছিলে, প্রতিরোধের ট্রাক যেন তিনি নিজেই।
ঠিক পরের কবিতা `হাতুড়ি’।
একটি হাতুড়ি পড়ে ছিল নিঃসঙ্গ রাজপথে
একজন শ্রমিক বললেন:
আমিই পেয়েছি কুড়িয়ে, দেখুন এটা লোহার, এটাই আমার।
একজন বিচারক বললেন
দেখুন এটা কাঠের এটাই আমার।
আমি এখন হাতুড়ির শ্রেণিচরিত্র বিশ্লেষণ করতে চাই
কেন না আমি কবি।
[হাতুড়ি]
সাবদার সিদ্দিকী এ কবিতায় তিনটি শ্রেণির চরিত্র নির্মাণ করেছেন। হাতুড়িকেন্দ্রিক এই শ্রেণিচিহ্ন দান করতে গিয়ে তিনি ভাষাগত বিষয় মনে রাখেননি। হাতুড়ি ব্যবহারকারী শ্রমিকের মুখের ভাষা, লোকাল ডায়লেক্টের, ক্যালকেশিয়ান হবে না। ঢাকাকেন্দ্রিক শ্রমজীবী মানুষের যে ডায়লেক্ট, তখনো রপ্ত করতে পারেননি সাবদার। কিংবা তিনি কলকাতার বাংলাকেই বাংলা ভাষার কলোক্যাল স্ট্যান্ডার্ড বিবেচনা করেছেন। কিন্তু আমরা তো জানি কলকাতার বাংলা ভাষা আমাদের ভাষার স্ট্যান্ডার্ড সংস্করণ নয়। আমাদের ভাষার শব্দসংঘ ও তার উচ্চারণ অনেক ট্রেসপূর্ণ। আমাদের দেশের শিক্ষিত/শীলিত মানুষও দেখুন, বলেন না। তাঁরা বলেন, দেখেন এই হাতুড়িটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছি, এটা আমার। আর হাতুড়ির দ্বারা কর্মজীবী যারা, তাদের মুখের ভাষা বা নিত্যদিনে ব্যবহৃত ভাষা দেখুন মার্কা নয়। এখানে কবি তাঁর নিজের মননজাত চিন্তা আর ভাষার পরিপ্রেক্ষিত থেকে ওই শব্দ ব্যবহার করেছেন।
শ্রমিক যে হাতুড়ি পেয়েছে, সেটা লোহার তৈরি, বিচারক যে হাতুড়ির কথা বলেছেন, সেটা কাঠের। এ দুজনের সামাজিক শ্রেণি নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। কিন্তু যিনি কবি, তাঁর শ্রেণিচরিত্র কী? তিনি শ্রমিকের ও বিচারকের শ্রেণির মধ্যবর্তী, মধ্যবিত্তের মানুষ’, যিনি বা যাঁরা মুখ্যত সুযোগসন্ধানী ও সুবিধাভোগী। এরাই সমাজের শ্রেণিচরিত্রের বিশ্লেষক। অপরচুনিস্টদের হাতে পড়েই মূলত রাজনৈতিক সমাজের মানুষের প্রকৃত চরিত্র বিশ্লেষণে প্রকাশ পায়নি বা পায় না। কারণ, এরা ধনী বা উঁচুতলার মানুষদের ভালো মানুষ হিসেবে চিত্রিত করে নানা কায়দা-কৌশলে। আবার দরিদ্র মানুষের অসহায়ত্ব যতটা বর্ণময় করে বর্ণনা করে, তেমনভাবে তাদের ওপর ধনীদের শোষণের সাঁড়াশি কারবারের চিত্র আঁকেন না। ধনীরা দেশের, সমাজের উন্নয়নের বরকন্দাজ, জব মার্কেটের উদগাতা, অর্থনীতির চালিকাশক্তি ইত্যাদি অর্ধসত্য ও অর্ধবানোয়াট কথায় সাজিয়ে সমাজ শোষণের প্রকৃত সত্য ঢেকে দেয়। কবি হচ্ছে এদেরই নব্য সংস্করণমাত্র। উচ্চাকাঙ্ক্ষী, লোভী, আত্মপ্রবঞ্চক ও শিরদাঁড়াহীন মানুষ, অধিকাংশই। সাবদার তাদেরই সহোদর বা তাদেরই জাতভাই, কিন্তু একটু ভিন্নজাতের হওয়ায়, সমাজ ও সংসারকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখাবার উদগ্র আগ্রহে ব্যাকুল এক মানবসন্তান, ছিলেন। হাতুড়ির শব্দগুলো তাই কোনো চমক সৃষ্টি করে না। বরং বিচারকের হাতে যদি লোহার হাতুড়ি দেওয়া যায়, তাহলে দুটি প্রতীকী অর্থ আমরা পেয়ে যেতাম। এক. বিচারকের বিচার কঠিন ও কঠোর ন্যায়বিচার, যা লোহার মতো শক্তিশালী ধাতুসদৃশ। উল্টো দিকে শ্রমিকের হাতে কাঠের হাতুড়ি দিলে তাকে ন্যায়বান শ্রমজীবী ও অন্যায়কারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী শ্রমশক্তি হিসেবে পরিচিত করা যেত। এটা আমার চিন্তাজাত। এই দুটি কবিতার ভেতর দিয়ে সাবদার সিদ্দিকীর রাজনৈতিক চরিত্রের দৃঢ়তা ও অস্বচ্ছতার পরিচয় মেলে। তিনি যে কবিতার ভেতরের বিষয়গুলো তেমনভাবে তার ভাবনাস্রোতের মধ্যে তীব্র করে তুলতে পারেননি, কেবল কথার খই সৃজন করে চমক দিতে চেয়েছেন, সেটা আরও কিছু কবিতায়ও আছে। তার এই নেগেটিভ দিক নিয়ে আমি তেমন কিছু বলব না। কেননা, কবিকে পজিটিভলি তুলে ধরতেই আমরা অভ্যস্ত এবং সেটাই শ্রেয়।
একটি অসম্ভব চিত্রকল্পময় কবিতা ‘বাংলাদেশ সময়’। উদ্ধৃত করা যাক—
ম্যাচবাক্সহীন শহরের ক্রুদ্ধ যুবক
দড়ির আগুনে জ্বেলে নেয় সর্বশেষ সিগ্রেট তার।
দোতলা বাস থেকে ছাই ঝাড়ে
ছুঁড়ে মারে দগ্ধ সিগ্রেট
বিদগ্ধ শহরের বুকে।
এ কটি লাইনে চিত্র আছে, যৎকিঞ্চিৎ কল্পনাও আছে যা ইশারার মতো মনের ভেতরে জেগে ওঠে। তারপরও আমরা কল্পনায় শহর নামক একটি চির-চঞ্চল বসতি এলাকার বৈচিত্র্যময় ছবি কল্পনায়/অভিজ্ঞতায় পাই, যাকে বিদগ্ধ বললে খুব বেশি ভুল হবে না, কিংবা গোটা নাগরিক জীবন প্রতিবেশই এক ভুলের আকর। ঠিক এরই বিপরীতে আছে একটি অনন্য চিত্রকল্পময় বর্ণনা।
গ্রামের সরল কৃষাণ তখন শস্যের
সবুজ জায়নামাজে নত
অবনত শস্যের সবুজে মিশে
গেরিলার মতো।
তিনি যে একজন মুক্তিযোদ্ধা, তাই যেন এই দৃশ্য রচনায় প্রাণময় হয়ে উঠেছে। ধানের নুয়ে পড়া সবুজে মিশে একজন গেরিলা যেভাবে ক্যামোফ্লাজ করত, আজকের কৃষাণ সেই ঢঙে শস্যের সঙ্গে মিশেছে যেন তিনি বা তাঁরা সবুজ জমিনের জায়নামাজে ইবাদতরত। একজন কৃষকের উৎপাদনকর্ম ও তাঁর সূচি যে ইবাদতের মতো ধ্যানমগ্ন, ইবাদতের মতোই প্রেমময় কাজ, সাবদার সেই অনন্য, প্রাকৃতিক ও গণজীবনের প্রত্যাশিত কাজটি করেছেন। এ কবিতার দুটি স্তরে, বিপরীত চিত্র এঁকে সাবদার সিদ্দিকী দুটি শ্রেণি-সমাজের দুই রকমের কর্মপ্রবাহ রচনা করেছেন। শহর কর্মময় আবার অকর্মহীনতারও, দিব্যি সচল ও গতিময় আর গ্রামীণজীবন, উৎপাদকের কর্মপ্রবাহে সচল ও সজীব, যেন তারা নিত্যকার ইবাদতে রত। গণমানুষের ওই কর্মময় নিঃশব্দ জীবনের ছবি রচনা করে সাবদার সিদ্দিকী গণমননের কথাই বলেছেন, যা শাসকশ্রেণি ও তাদের সুবিধাভোগী মধ্যবিত্ত বিস্মৃতপ্রায়।
‘কয়েকটি শব্দ, কয়েকটি বাক্য’ শিরোনামের কবিতায় তিনি লিখেছেন—‘একজন পুলিশ একটি রাষ্ট্র’।
এই বাক্যটি তখনই সত্য বলে মনে হয়, যখন রাষ্ট্রব্যবস্থা তার রাজনৈতিক চরিত্র হারিয়ে ফেলে এবং শাসনকর্মে আইন প্রয়োগকারী ও শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা পুলিশের হাতে ক্ষমতার দণ্ডটি চলে যায়। তখন পুলিশই হয়ে ওঠে দন্ডমুণ্ডের অধিকারী। সংবিধান, সংসদ, সংসদ সদস্য, আইনপ্রণেতাদের কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়ে। আইন-আদালত, সংবিধান ইত্যাদি রাষ্ট্রের মৌলিক ভিতগুলো অদৃশ্য হয়ে যায়। তখন গণমানুষ নির্মমভাবে পুলিশের হাতে শাসিত/নির্যাতিত হতে থাকে। সাবদার সিদ্দিকী এই পঙ্ক্তিতে সেই অগণতান্ত্রিক শাসনের নির্মম ছবিই এঁকেছেন এই বাক্যে। বাদবাকি বাক্যগুলোতে কিছু শ্লেষ ও নির্মম সত্য উচ্চারিত হয়েছে ঠিক, তবে কবিতার যে মৌলিক ধর্ম, তার রেশ খুব কমই আছে। দশ নম্বরটি—‘একজন গেরিলা ও সন্ন্যাসীর/ মধ্যে মৌলিক পার্থক্য নেই/ যেহেতু উভয়েই/ মূলত ভ্রাম্যমাণ। এই চার পঙ্ক্তির একটি বাক্যে সাবদার সিদ্দিকী কল্পজাত সত্য নির্মাণ করেছেন। সন্ন্যাসী ভ্রাম্যমাণ কি না, তা বোঝার উপায় নেই। তার জন্য গবেষণা দরকার। তবে রাজনৈতিক কর্মী গেরিলার প্রশিক্ষণই বলে দেয় তাকে তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সামরিক কৌশলের জন্য নানা জায়গা বদল করতে হয়/হবে। সন্ন্যাসী মূলত ধ্যানমগ্নচরিত্র। সেই চরিত্র ভ্রাম্যমাণ নয়। তবে আমরা যদি বনজীবনের গভীরতর উন্মাদনার কথা ভাবি, তাহলে সন্ন্যাসীকে বনচারী/ভ্রাম্যমাণ ভাবতেই পারি। সব সময় ও সম্পর্কেরই যে সত্য ও স্বাভাবিক কিছু উচ্চারণ করতে হবে, কবিতায় তার কোনো ফর্মুলা নেই। কবিতা হচ্ছে, আমার ধারণা প্রকৃতির মতো স্বাধীনচেতনার। তবে সেখানে তার সামাজিক জীবনের প্রতি দায়ই সব থেকে বেশি।
শ্লেষের ব্যবহার সাবদারের কবিতায় অনেক। সমাজ সংসারের, রাষ্ট্রযন্ত্র ও শাসকের বিরুদ্ধে শ্লেষ ও শ্লেষাত্মক বাক্য তার চেতনার প্রধানতম উপকরণ। প্রায় প্রতিটি কবিতায় তিনি শ্লেষ ব্যবহার করেছেন বলেই আমার মনে হয়েছে।
কিছু পঙ্ক্তি তুলে আনা যাক—
১
কেবল বত্রিশটা দাঁত
নড়েচড়ে কথা বলে স্বাধীনতা স্বাধীনতা চায়
খায় দায় চিবায় ঘুমায়। কেবল বত্রিশটা দাঁত।
…………………………….
কেবল বত্রিশটা দাঁত
কয়েক সেন্টিমিটার হাহহা
হাস্যে লাস্যে ভেসে যায় হাহা যায়।
[দন্তপংক্তিবিজ্ঞান]
২
প্রাসাদের রাজ কারুকাজ মুগ্ধ জন্মান্ধ
ক্রীতদাস আমি কি
রাজার ঝলমল নীল মখমল
মুকুট শরীর জরীর জন্মান্ধ ভালবাসি
গজ দন্ত শ্বেত রাজহাসি।
[স্থাপত্য শিল্প]
৩
জাতিসংঘের বদলে
একটি কমপিউটার যথেষ্ট।
৪
মাও সে তুঙ একটি মাংস
উপগ্রহ।
[কয়েকটি শব্দ, কয়েকটা বাক্য]
৫
হাওড়া ব্রীজ যেন লোহার ব্রেসিয়ার তোমার
কলকাতা, যন্ত্রের সমান বয়সী তুমি
কলকাতা, তোমার ইতিহাস
বাইবেলের পেছনে গাদাবন্দুক
বাংলা গদ্যের সমান বয়সী
আমার কিশোর কলকাতা
সন্ন্যাসীর লিঙ্গের মতো নিস্পৃহ তুমি আজ।
[কলকাতা/আমি এক তরুন মহাপুরুষ]
৬
ক্ষুধার্ত লাল ডাক বাক্স এক
গিলে খায় সুনীল
কাগুজে ভালবাসা, আমাদের।
[কাগজ পাখি]
৭
যেখানেই পা রাখি
ভিন্নগ্রহে কিংবা ভিনগাঁয়ে
পায়ের নিচে টুকরো দুই জমি
হয়ে যায় আপন মাতৃভূমি।
[পা]
৮
বন্দুকনির্গত ক্রুদ্ধ ভাইরাস
যুদ্ধ আর রেডক্রসের পতাকা ওড়ায়।
[যুদ্ধ ও রেডক্রস]
৯
ট্রাফিক দীপপুঞ্জ থেকে
ক্রসকাঠহীন
একজন শ্বেতশুভ্র যীশু
একটি শহরকে শাসায় ইশারায়।
[ক্রসকাঠহীন যীশু]
১০
সমস্ত ঘুমন্ত আগ্নেয়গিরি পোড়াব
[বানো কপেতা]
এ রকম বহু বাক্য, বাক্যাংশ তুলে আনা যাবে সাবদারের কবিতা থেকে যেখানে শ্লেষ শুয়ে আছে নিঃশব্দে, প্রায় অলক্ষ্যে। যেমন—ইত্যাদির যাবতীয় গণিতের বিভিন্ন সূত্রের টানাপোড়েনে/ বিনয় বানায় ট্র্যাপিস্ট্রির কোলাজ’ কিংবা ‘তিনটি বিন্দু দিয়ে অনায়াসে বুঝিয়ে দিতে পারে অতএব’ ‘হাতে পেলাম দুই দিন/ জন্মদিন ও মৃত্যুদিন’ [মানসাংক বিজ্ঞান]
শ্লেষ কেন সৃষ্টি হয়েছে সেই তথ্য না জেনেও আমরা এর তীক্ষ্ণ তীর গেঁথে যেতে দেখি মানুষের কথায়, আচরণে, অঙ্গভঙ্গিতে, অনুভব করি সমাজ সংসারের সর্বত্রই। ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ-শ্লেষ একই সমাজের অন্তর্গত হলেও একেকটির প্রয়োগপ্রেক্ষিত ভিন্ন। ব্যঙ্গ ও বিদ্রূপ অনেকটাই সরাসরি, শ্লেষ একটু পরোক্ষে উচ্চারিত। অন্যায়-অবিচার ও প্রশাসনের ত্রুটি-বিচ্যুতিসহ মানুষের আচার-আচরণ নিয়েও শ্লেষ-ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ অব্যর্থ।
ভাষার ব্যবহারে সাবদার সিদ্দিকী একটু হলেও ভিন্ন, ঠিক প্রচলিত ধারায় তিনি শব্দ ব্যবহার করেননি। তিনি একটু ব্যাকা-টেরা গোছের কথার নির্মাতা।
ক.
একদা তুমি বলেছিলে
লাল সূর্যটাকে পিটিয়ে পিটিয়ে হাতুড়ি
কাস্তে বানাবে, লোহা পিটিয়ে সোনা
গাধা পিটিয়ে ঘোড়া।
খ
কবিতার চুল্লীতে প্রজ্জ্বলন্ত মাংসখণ্ড আমি মমি
পোড়াব পাণ্ডুলিপি ইতস্তত এই সব শব্দ
যাবতীয় নিঃশব্দে পুড়বে ধিকি ঝিকি মিকি
গলবে উত্তপ্ত মম বারুদ মোম যৌবন।
গ
টেলিগ্রাফের তার
যেন রবিশংকরের সেতার।
ঘ
নীরব দর্শক এক সচিত্র প্রদর্শনীতে
এতসব তেলকালি জলরং
প্রদর্শনীর ভাস্কর্যগণ গণতন্ত্রহীন ঘনস্থির।
ঙ
ক্লিক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির রোবট বৈজ্ঞানিক।
সাবদার সিদ্দিকীর উদ্ধৃত কবিতাগুলোতে তেমন কোনো লালিত্য নেই, যা প্রচলিত বোধে খুবই কর্ণপ্রিয় হবার নয়। কিন্তু কথাগুলো ভেতরে রয়েছে একধরনের দাহ ও দহনক্ষমতা যা আমাদের উত্ত্যক্ত করে। কী রকম উত্ত্যক্ত করে তার উদাহরণ হিসেবে ‘ক্লিক প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির রোবট বৈজ্ঞানিক’ বাক্যটিকে নিতে পারি। কেমন খাপছাড়া বাক্য। কিন্তু আমরা যদি প্রত্যেক শব্দের প্রতীকী ব্যঞ্জনার কথা ভাবি, তাহলে ওই ক্লিক হচ্ছে ধনশালীর ইচ্ছার অধীন এক ছবিয়ালের চরিত্র। আর সেই ছবিয়াল একজন রোবট বৈজ্ঞানিক, যিনি কাজ করেন রোবটের মতো, মালিকের নির্দেশে, তারই ইচ্ছের অধীনে। আবার ‘এতসব তেলকালি জলরং/প্রদর্শনীর ভাস্কর্যগণ গণতন্ত্রহীন ঘনস্থির’—এই বাক্যগুলোতে খুবই প্রতীকীভাবে গণমানুষের কথা বলা হয়েছে যারা গণতন্ত্রবঞ্চিত। যেন তারা ঘনস্থির হয়ে আছে। তারা নড়তে চড়তে পারছে না।
কিছু চিত্রকল্প তুলে এনে দেখা যাক সাবদার সিদ্দিকীর মনোভূমে কি আছে/ছিলো।
ক
আমার অপেক্ষায় থরথর শরীরে
তোমার ছড়ান রাস্তার জ্যামিতি
ট্রাফিক আইল্যান্ডে
একখণ্ড শুভ্র মেঘের মতো
ট্রাফিক অথচ পুলিশ।
………..
জাপানি কাপড়ে ঢাকা
হে আমার ঢাকা
…………
রেস্তরাঁর নিঃসঙ্গ চেয়ার
আমার অপেক্ষায় ক্লান্ত জানি
হে শহর হে অশ্বারোহী
গুপ্তঘাতকের ধারল চকচকে
চোখের চারদিকে বেড়ে ওঠা
হে শহর, আমি তো এসেছি
এই তো এই আমি।
[হে শহর হে অশ্বারোহী]
এসব কবিতাংশের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ কি দরকার পড়ে? না, পড়ে না। যেসব পঙ্ক্তি পাঠকের মনে একধরনের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে, সেটা নেগেশানের হোক বা পজিটিভ, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানুষের অকথিত কথামালা। সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই বলতে পারে না। সাদামাটা ভাষায়ও বলতে পারে না, লজ্জা পায় নানা কারণে, সেই অব্যক্ত কথাই বলেন কবিরা।
কেবল বত্রিশটা দাঁত কয়েক সেন্টিমিটার হাহহা হাস্যে লাস্যে ভেসে যায় হাহা যায়। [দন্তপংক্তিবিজ্ঞান] ২ প্রাসাদের রাজ কারুকাজ মুগ্ধ জন্মান্ধ ক্রীতদাস আমি কি রাজার ঝলমল নীল মখমল মুকুট শরীর জরীর জন্মান্ধ ভালবাসি গজ দন্ত শ্বেত রাজহাসি। [স্থাপত্য শিল্প] ৩ জাতিসংঘের বদলে একটি কমপিউটার যথেষ্ট। ৪ মাও সে তুঙ একটি মাংস উপগ্রহ। [কয়েকটি শব্দ, কয়েকটা বাক্য] সাবদার সিদ্দিকীর সঙ্গে পরিচয়ের দরজা খুলে গেলো। মাহবুব হাসানের ব্যাখ্যা বর্ণনা এক অদেখা অপরিচিত সাবদার সিদ্দিকীর সামনে দাঁড় করালেন। নিমিষের পরিচয়ের সব আবরণ উবে গেলো। এটুকু পাঠ তো অনেক কিছু। সাবদার সিদ্দিকীর যেকোন একটি লাইনই তাঁকে পড়তে আগ্রহী হওয়ার জন্য যথেষ্ট। ধন্যবাদ তর্কবাংলা।
নূর সিদ্দিকী
জুলাই ২৪, ২০২২ ১৫:৩১
সাবদার সিদ্দিকী'র উপর লেখা আলোচনাটির জন্য কবি মাহবুব হাসানকে ধন্যবাদ জানাই। প্রায়বিস্মৃত হয়ে যাচ্ছিলেন সাবদার। আমাদের বন্ধুকবি। আলোচনাটি যেমন প্রাণময়, তেমনি তীর্যক। আরও বিস্তৃত পরিসরে লেখার অনুরোধ রইলো।
হাফিজুর রহমান
জুলাই ০২, ২০২২ ১৯:৪৩
আমাদের অগ্রজ কবি সাবদার সিদ্দিকীর সাথে পরিচয় ছিল। প্রচন্ড বোহেমিয়ান। দারুণ মেধাবী কবি।কিন্ত নেশাতুর থাকতেন বলে এড়িয়ে যেতাম। আমি ৮০ তে দেশবাংলার স্টাফ রিপোর্টার। একবার রাস্তায় দেখা। বলতেই অফিসে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে গেলেন। আমি তার কাছে একবার একুশে সংকলনের জন্য কবিতা চাইলাম। তিনি বইমেলায় বসেই লিখে দিলেন। মাহবুব হাসান শুধুই লেখক নন,গবেষক। তিনি সততই নির্মোহভাবে তুলে এনেছেন সাবদার সিদ্দিকীর কবিতা ও তার যাপিত জীবন। অসাধারণ লেখা মাহবুব ভাই। ফেরদৌস সালাম
ফেরদৌস সালাম
জুলাই ০২, ২০২২ ২০:০৭
সেঔ সময়কে দারুণ ভাবে তুলে এনেছে বহিমিয়ান কবি সাফদার সিদ্দিকী। মাহুবুব হাসানের বিশ্লেষণ অসম্ভব সুন্দর।
শওকত আহসান ফারুক
জুলাই ০২, ২০২২ ২২:২৬
লেখাটা সাবদার সিদ্দিকীকে স্মরণ করালো। তাঁর কবিতার আমি মুগ্ধ পাঠক ছিলাম না। তবে স্বীকার করতে হবে মানুষ হিসেবে, জীবনাচরণে সাবদার ভাই খুব আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আড্ডায় তাঁর তির্যক ও ক্ষুরধার মন্তব্য খুব উপভোগ্য ছিল। সাবদার ভাই ছিলেন টালমাটাল এক সময়ের খাঁটি প্রতিভূ।
Elias Ahmed
জুলাই ০৩, ২০২২ ২১:১৩
It is very touching, unparalleled memories about Poet Sabder Siddiqee.A lot of thanks to Mahabub Hasan!
Ahmed Bulbul Islam
জুলাই ২০, ২০২২ ১৩:২১