চিত্রশিল্পী মনিরের সদরে-অন্দরে
বিমূর্ত শিল্পী, এভাবেই চিনি আমরা শিল্পী মনিরুল ইসলামকে। যদিও তাতেও আবদ্ধ থাকেন না তিনি। কিংবা এ রকমও বলা যায়, তাঁর বিমূর্ত শিল্পে যে প্রকৃতির অবশেষ থাকে, সেটি অকস্মাৎ সবকিছু ছাপিয়ে ওঠে, কিন্তু মুহূর্তেই উধাও হয়ে যায়। এইভাবে কোন ফাঁকে যে তাঁর শিল্পে প্রকৃতি এসে আশ্রয়-বিশ্রাম নেয়, আকৃতি, ফর্ম, রং ও লাইনের সঙ্গে গভীর এক সুসঙ্গতি নিয়ে বসবাস করে, তা কেবল অনুভবই করা যায়; এর দৃশ্যমানতার সঙ্গে নিবিড়ভাবে মিশে থাকে অনুভব।
আবার ক্যানভাসে, কাগজে মনিরের রঙের প্রলেপ, টেক্সচার আর টেকনিকও আমাদের চিন্তার খোরাক জোগায়। এ তিনের সমন্বয়ে মনিরুল ইসলাম শিল্পী হিসেবে নিজের স্বতন্ত্রতা সৃষ্টি করেন; নিজেকে কি স্বদেশের, কি বিদেশের শিল্পীদের থেকে আলাদা করেন। তাঁর এই স্বতন্ত্রতার আদল আরও গভীরতা পায় স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে; কেননা তাঁর প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে এ-ও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, বাংলার গ্রাফিকস পেইন্টিং আর ছাপচিত্রে নাগরিকতা ও নগরবোধের নির্মাতা তিনি। সুলতানের শিল্পকর্মে বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর যেমন ‘দেশজ আধুনিকতা’ দেখেন, মনিরুলের কাজেও সেই আধুনিকতা ফুটে ওঠে, তিনি তাকে পুষ্ট করেন মূলত কাগজের ক্যানভাসে কখনো পেইন্টিংয়ে, কখনোবা ছাপচিত্রে। কাগজের ওপর তেলচিত্র চর্চার যে ধারা, নির্দ্বিধায় বলা চলে, মনিরুল তাকে পুষ্ট করেছেন, লালন করেছেন এবং গভীর আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে তা উপস্থাপন করেছেন আমাদের সামনে। এমনও দেখা গেছে, এচিং কিংবা অ্যাকোয়াটিন্ট মাধ্যমে কাজ করে, ড্রাই পয়েন্ট, সফটগ্রাউন্ড, রিলিফ, জোলোটিনসহ আরও অনেক মাধ্যমে চোখকে আটকে দেওয়ার মতো ছাপ নিয়েছেন তিনি; কিন্তু অনায়াসে সেই ছাপের মায়া ত্যাগ করে রংকে ওভারল্যাপ করেছেন তার ওপরে, ঢেলে দিয়েছেন তেল, পাথরকুচি কিংবা চালের গুঁড়া। নতুন এক সময়ের শিল্প-আলোচকের আবির্ভাব ছাড়া মনিরের এই উপকরণ ব্যবহারের সত্যিকারের ব্যবচ্ছেদ ও তার সুদূরপ্রসারী প্রভাবসম্পর্কিত আলোচনা বলা চলে অসম্ভব।
মনিরুল ইসলামের শিল্পকর্ম © ছবি: ছবিঘরের সৌজন্যে
অনেক শিল্পীর মধ্যেই নিজের কাজকে একটা তাত্ত্বিক, আদর্শিক বা ভাবাদর্শগত দিক থেকে ব্যাখ্যা করার অবচেতন প্রবণতা থাকে। কিন্তু মনিরুলের মধ্যে তেমন কোনো প্রয়াস নেই—তিনি বরং ভালোবাসেন কাজের মাধ্যম নিয়ে কথা বলতে, টেকনিক নিয়ে কিছু বলতে—এবং তা এমনকি সাধারণ দর্শকের সঙ্গেও। নিজের চিত্রশিল্পের মাধ্যম ও টেকনিক নিয়ে এমন খোলামেলাভাবে কথা বলতে বোধ করি অন্য কোনো শিল্পীই পছন্দ করেন না। তাঁরা ভালোবাসেন রহস্যময় হাসি দিয়ে নিজের শিল্পকর্মের বুনন, প্রলেপ, স্তরীকরণ, রঙের মিশেলকৌশল লুকিয়ে রাখতে। কিন্তু মনির সেই ঘরানার নন, তিনি বরং মেতে ওঠেন সেই রহস্যের দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞাসুকে ঘরের মধ্যে আমন্ত্রণ জানাতে। এ কারণে মনিরের সঙ্গে গ্যালারিতে তাঁর কাজের সামনে দাঁড়ালে কীভাবে একটি ছবি জন্ম নিল, জন্ম নিয়ে এই পর্যায়ে এসে দাঁড়াল, তার কারিগরি বৃত্তান্ত শুনতে শুনতে একসময় বরং ছবির কারিগরি আদলটি রক্তমাংসের অবয়ব নিয়ে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, ছবিটি খুব সহজেই অনুভবের প্রান্তরে এসে দাঁড়ায়।
মনিরুল ইসলাম © ছবি: ঢাকা অপেরা
কখনো কাগজ, কখনো প্লেট-অ্যাসিড, কখনো জলরং, কখনো বা অ্যাক্রিলিকের আঁকিবুঁকিতে নগর মননের ধারাপাত আঁকতে, দেশজ আধুনিকতাসমেত উঠে দাঁড়াতে দীর্ঘ পথ হাঁটতে হয়েছে মনিরুলকে। কিন্তু আমাদের সৌভাগ্য, তিনি কখনো থেমে পড়েননি। হয়তো কখনো থমকে দাঁড়িয়েছেন, গতিও মন্থর হয়েছে, কিন্তু অচলায়তনকে ভাঙতে ভাঙতে তিনি ঠিকই এগিয়ে গেছেন তাঁর গন্তব্যের দিকে। এক পরতের ওপর পড়েছে আরেক পরত, তাকে ঢেকে ফেলেছে নতুন পরত; নতুন নতুন স্তর যেন প্রকৃতিকে সংবদ্ধ করেও হারিয়ে গেছে, নতুন এক ছবির ইঙ্গিত দিয়ে থমকে পড়েছে। স্তরীভূত রঙের অবচেতন জগৎ আলাদা ক্যানভাসে বসতি স্থাপন করেও তাঁর প্রতিটি ছবিকে করে তুলেছে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। বোধ হয় এ কারণেই তিনি প্রসঙ্গক্রমে মাঝেমধ্যেই বলে থাকেন, পেইন্টিং কোনো দিন শেষ হয় না এবং পারফেকশন বলতে কোনো কিছু নেই। ক্যানভাসে তিনি যে রঙের পরত দেন, প্রায়ই দেখা যায়, ফের তা ঘষে ঘষে তুলে ফেলতে এবং আগের টেক্সচারের ওপর নতুন করে রং বসাতে, পূর্বের টেক্সচারকে আত্মস্থ করে নতুন টেক্সচার দৃশ্যমান করে তুলতে। ফলে আমাদের জন্য নতুন এক চিন্তার পরিসর তৈরি হয়, কেননা আমরা অনুভব করি—পুরোনোকে বিলীন করে নতুন কিছু নির্মাণের পরও তিনি যেন নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত অতীতের সঙ্গে, মনে হয় সেই খান থেকে বেরিয়ে আসতে তিনি মোটেও রাজি নন, এমনকি এ-ও দেখা যায়, বেরিয়ে আসার যাবতীয় পথ ফুটিয়ে তোলার পরও তিনি সচেতনভাবে যুক্ত থাকেন নিজের অতীতের সঙ্গে। নিজের ছবিকে তিনি যেন নিজেই অসমাপ্ত করে তোলেন ভবিষ্যতের দিকে ধাবমান পরিভ্রমণের স্রোতকে রুদ্ধ করে।
মনিরুল ইসলামের শিল্পকর্ম © ছবি: ছবিঘরের সৌজন্যে
সেই হিসেবে, তাঁর যে স্বতন্ত্রতা, তাঁর যে মৌলিকত্ব, তাকেও নিশ্চয়ই প্রশ্নবিদ্ধ করা যায়; কিন্তু এটিও সত্য যে, এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে প্রতিনিয়ত আমরা যত মূল্যায়ন করে চলেছি, তা আসলে আপেক্ষিকভাবেই করে থাকি এবং শিল্পসাহিত্যে যখন স্বতন্ত্রতা ও মৌলিকত্বের কথা বলা হয়, সেই আপেক্ষিকতার অস্তিত্ব মেনে নিয়েই বলা হয়। আমরা মনিরের মধ্যে স্বতন্ত্রতা খুঁজে পাই, কেননা মনিরুলের আবির্ভাবের আগে বাংলাদেশের ছাপচিত্র ছিল গভীর গ্রামীণ মায়াজাগানো, গতিময় হয়েও নিরেট বাস্তবে আকীর্ণ; ছিল প্রকাশনাশিল্প সম্পৃক্ত। কিন্তু তার অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে ছাপচিত্রের নির্মুক্তি ঘটে। কেননা নতুন যে সময়, নতুন যে মনন বাঙালির হৃদয়ে জাগছে, মনির তাকে ধারণ করেন, তিনি বাংলার ছাপচিত্রে নগরমনন জাগিয়ে তোলেন। এই কাজটি এ দেশে বলতে গেলে তিনি একাই করেছেন। তিনি নগরবোধকে জাগিয়ে তুলেছেন আর সেটি সহজ হয়েছে তাঁর বিমূর্ত শিল্পচর্চার প্রেক্ষাপটের কারণে, দীর্ঘদিন ধরে গ্রাফিকস পেইন্টিং ও প্রিন্টমেকিংয়ে ধারাবাহিকভাবে যুক্ত থাকার কারণে।
শিল্পের ধারণা ও ইতিহাস নিয়ে মনিরুলের স্বর তাঁর সমসাময়িক এদেশীয় শিল্পীদের চেয়ে একটু অনুচ্চই বলতে হবে; কিন্তু যা তিনি বলেন, তা অনুচ্চ হলেও সুদৃঢ়, তা দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতাসঞ্জাত আর চিন্তাজাগানিয়াও। যেমন, গড়পড়তা বিরাজিত ধারণা এক পাশে সরিয়ে রেখে তিনি জানান, বিমূর্ত শিল্প আমাদের এখানে ঠিক ইউরোপের প্রভাবে ঘটেনি। তিনি বলেন, আমাদের শিল্পীদের ইউরোপযাত্রার আগেও তা ছিল, ‘আগে কেউ কেউ রিপ্রোডাকশন থেকে ভয়ে ভয়ে বিমূর্ত ছবি আঁকতেন।’ কিন্তু হামিদুর রাহমান, আমিনুল ইসলামদের বিদেশের অভিজ্ঞতা যে কাজটি করল, তা হলো প্রত্যাখ্যান ও সমালোচনার ভয় একদম ভাঙিয়ে দিল। এইভাবে সংক্ষেপে, কিন্তু বেশ দৃঢ়ভাবে তিনি যে দু-চারটে কথা বলেন, তা থেকেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে তাঁর প্রস্তুতি ও ভিত্তি।
মনিরুল ইসলাম © ছবি: ঢাকা অপেরা
চাঁদপুরের মানুষ, কিন্তু জন্ম আবার জামালপুরে; অতএব পৈতৃকসূত্রেই হোক আর জন্মসূত্রেই হোক, মেঘনা-যমুনা তীরের মানুষ মনির। আর এই নদী যেন তাঁর ব্যক্তিত্ব নির্মাণেও ভূমিকা রেখেছে। মেঘনা বা যমুনার মতোই প্রবহমান, ভাঙনপ্রবণ, খরস্রোতা সৃষ্টিপ্রবণ তিনি; চরের মতো জেগে ওঠেন, স্বপ্নাচ্ছন্ন একমাত্র সম্বল ঘর ও উর্বরা ভূমির মতো অতলে তলিয়ে যান। ১৯৬৬ সালে ফাইনাল পরীক্ষার পর ফল বেরোনোর আগেই শিক্ষক হয়ে গিয়েছিলেন আর্ট কলেজের। চাকরি অবশ্য শুরু করেছিলেন পাকিস্তান টেলিভিশনে, কিন্তু বড় টেনেছিল শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের পরামর্শ—হোক বেতন কম, কাজ করতে পারবেন স্বাধীনভাবে। সেই স্বাধীন শিল্পসাধনা কতটুকু এগোচ্ছিল বলা মুশকিল; তবে আমরা দেখি, এক স্বৈরশাসনের দেশ থেকে মনির ১৯৬৯ সালে বৃত্তি নিয়ে যাত্রা করেছিলেন আরও এক স্বৈরশাসনের দেশে। যাকে বলে উত্তপ্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুল্লিতে—স্বৈরশাসক আইয়ুব-ইয়াহিয়ার সামরিক শাসনকে ছেড়ে ফ্রাঙ্কোর সামরিক শাসনে। বছরখানেকের জন্য গিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ফিরে আসা হয়নি। নয় মাসের স্কলারশিপের মেয়াদ বেড়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান দূতাবাস থেকে স্পেনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ করে সেই স্কলারশিপ বন্ধের ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
মনিরুল ইসলামের শিল্পকর্ম © ছবি: ছবিঘরের সৌজন্যে
মনিরুল গিয়েছিলেন মিরর পেইন্টিং বা ফ্রেসকো শিখতে। যাকে বলা চলে আদিম এক মাধ্যম—যার উপকরণ মূলত মরা চুন এবং বালু। কিন্তু খুব দ্রুতই তিনি জড়িয়ে যান আরেক মাধ্যম এচিংয়ের সঙ্গে। এই এচিংয়ের সুলুকসন্ধানে তিনি এতই নিবেদিত ছিলেন যে, দেশ থেকে বহুদূরের স্পেনে ‘মনির স্কুলিং’ হয়ে উঠেছে এচিং চর্চার নতুন একটি ধারা। শিল্পচর্চা করতে গিয়ে বারবার মাধ্যম পাল্টেছেন তিনি। কিন্তু তারপরও গ্রাফিকসের প্রতি সূক্ষ্ম ও অদৃশ্য নিবিড় এক বুনো আকর্ষণ বোধ করি রয়েই গেছে। স্পেনে দীর্ঘদিন গ্রাফিকস চর্চার পর ১৯৯৭ সালের দিকে দেশে ফিরে আবারও পেইন্টিং নিয়ে মেতে উঠেছিলেন তিনি। বিভিন্ন মাধ্যমে, বিভিন্ন অভিজ্ঞতায় আর বিভিন্ন উপকরণে কাজ করার এই প্রাণশক্তি আমাদের মনে করিয়ে দেয় পাবলো পিকাসোকে। বললে অত্যুক্তি হবে না, স্পেনে থাকার কারণেই হোক কিংবা সমসাময়িক শিল্পচর্চার একজন প্রাণপুরুষ হিসেবেই হোক, মনিরুলের মধ্যে পিকাসোর প্রভাব অন্তত তাত্ত্বিক দিক থেকে খুবই প্রবল। মনিরুল এ ব্যাপারে খুবই সচেতন যে, একই ইমেজ যেন দ্বিতীয়বার ফিরে না আসে। তাঁর বিশ্বাস, মানুষ প্রতিনিয়ত নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হচ্ছে; অতএব অভিজ্ঞতাই যেখানে প্রতিনিয়ত পাল্টে যাচ্ছে, সেখানে একই ইমেজ কেন পুনরায় ফিরে আসবে? পিকাসোকে যেমন দেখা যায় একই সময়ে বিভিন্ন রকমের ছবি আঁকতে, তেমনি মনিরুল একের পর এক পরিভ্রমণ করেন নতুন নতুন ইমেজে। একই সময়ে দুটি মাধ্যমে কাজ করতে তিনি পছন্দ করেন না বটে, কিন্তু বহুমাত্রিক উপকরণের উপস্থিতি তাঁর ইমেজকে নতুন মাত্রা দিতে ভূমিকা রাখে।
মনিরুলের কাজে পরিভ্রমণের আনন্দ একেবারে আলাদা—কারণ, তা কেবল অনুভূতি ও আবেগের মেঘাচ্ছন্নতাই তৈরি করে না, পাশাপাশি উপকরণ এবং মাধ্যম নিয়েও চিন্তার গভীর খোরাক জোগায়। তিনি যখন বলেন, শিল্প কখনো প্রকৃতির বাইরে যেতে পারে না, প্রকৃতিই আমাদের প্রেরণা, তখন কথাটিকে খুব প্রাণের ও সাদামাটা কথা বলে মনে হয়; কিন্তু একটু গভীরভাবে তার ক্যানভাসের দিকে তাকালেই বোঝা যায়, প্রকৃতির প্রবেশ ঘটিয়ে তিনি আসলে নগরবোধকে সজীব করে তোলেন, শহরকে শহরেরই আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেন।
স্পেনের এক প্রদর্শনীতে মনিরুল ইসলামের দুটি শিল্পকর্ম
মনিরুল ইসলামের প্রদর্শনী আমার প্রথম দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। এমনকি দেশের বাইরে ২০১১ সালে স্পেনের মাদ্রিদে একটি গ্রুপ প্রদর্শনীতেও আমি তাঁর শিল্পকর্ম দেখেছিলাম। পেছনের দিকে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি, দীর্ঘ প্রায় ২৫ বছর ধরে আমি তাঁর ছবি দেখছি। ওপরে যে কথাগুলো বললাম, তা এই সামান্য দেখা বা তাঁর সঙ্গে বিভিন্ন সময় হওয়া এলোমেলো বিচ্ছিন্ন কথাবার্তার (প্রসঙ্গত বলে রাখা ভালো, তিনি আমাকে চেনেন না) অভিজ্ঞতা থেকে বলা। এই অভিজ্ঞতার, এই পর্যবেক্ষণের অর্থময়তা আদৌ আছে কি না, তা নিয়েও প্রশ্ন তোলা যায়। সবচেয়ে বড় কথা, সেই প্রশ্ন তোলার জায়গাটি মনিরুল নিজেই তৈরি করে দিয়েছেন। তিনি যখন শিশুর মতো বলেন, ‘যখন কোনো ক্রিটিক বা বোদ্ধা বা দর্শক বলেন, কী আঁকলেন কিছু বুঝলাম না, তখন আমিও উত্তর দেই, আমিও বুঝি নাই। তারা অবাক হয়, কিন্তু আমি আসলেই একচুলও বুঝি না। কারণ, ছবি আঁকায় বোঝার কিচ্ছু নাই। ইউ লাইক অর ডোন্ট লাইক।’
বিষয়টি এমনই—‘আমারই চেতনার রঙে পান্না হল সবুজ, চুনী হয়ে উঠল রাঙা’... আর তাই মনিরের কাজ আমি পছন্দ করি, এটাই বোধ করি শেষ কথা। একটা বিষয়ে তিনি পরিষ্কার এবং সেটিকে তাঁর শিল্পচিন্তার একটি গূঢ় দার্শনিক দিকও মনে হয়—শিল্পীকে নিজের ব্যক্তিত্ব তৈরি করে নিতে হবে, ছবিতে যেন তার পারসোনালিটির প্রকাশ ঘটে, এই ব্যক্তিত্বই ছবি আঁকার আলাদা শৈলী তৈরি করে, কেননা তখন রং বা রেখার ব্যবহার শিল্পীর রক্তের সঙ্গে মিশে যায়, আলাদা আলাদা ইমেজ নির্মাণের পরও তার সিগনেচার একই রকম হয়ে ওঠে। মনিরুলও এভাবেই নির্মিত হয়েছেন, নির্মিত হয়ে চলেছেন।