শহীদ কাদরীর বিলাতি বোহিমিয়ান জীবন

 

১৯৭৯ সালের সেপ্টেম্বর মাস। হিথরো বিমানবন্দর। ব্রিটিশ এয়ারওয়েজের বিশাল পেট চিরে হেলেদুলে বের হলেন কবি শহীদ কাদরী। নেমেই কাস্টমসের ঝামেলা কাটিয়ে বিমানবন্দরটাকে একঝলক চোখ বুলিয়ে শহীদ কাদরী যাত্রী লাউঞ্জে অপেক্ষা করতে লাগলেন। উড়োজাহাজে যাত্রাকালীন অতিরিক্ত পরিমাণে স্কচ পানের ফসল যে এমন হবে, কবি সেদিন তা বুঝতে পারেননি। এয়ারপোর্টের খোলামেলা চত্বরে একটু শীতের আভাস পাওয়া গেলেও কাদরী তাঁর টাইয়ের গিঁটটা কায়দা করে খুলে ফেলেন। তারপর অস্ফুট স্বরে নিজেই নিজেকে শুধালেন, বায়রনের দেশে স্বাগত হে কাদরী!

শুরু হলো বাংলা কবিতার এক তুখোড় কবির লন্ডনে প্রবাস জীবন। লেখক, কবি, সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী আগে থেকেই লন্ডনে টয়েনবি হলে শহীদ কাদরীর থাকার সব রকম ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এখানে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী সম্পর্কে দুটি কথা বলা প্রাসঙ্গিক মনে করি। সেই সময়ে ইস্ট লন্ডনে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী ছিলেন বাঙালিদের দুর্দিনের বন্ধু। বাঙালির জন্য তাঁর উদার একটি মন এবং সেই সাথে সাহায্য করার মতো দুটো হাত সব সময় মুখিয়ে ছিল। তিনি তখন বাংলার ডাক নামের একটি পত্রিকার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। জার্মানি থেকে এক বাঙালি ভদ্রলোকের টাকায় পত্রিকাটি লন্ডন থেকে প্রকাশিত হতো। কবি শহীদ কাদরী তখন পুরোপুরিই বেকার। লেখক ও সাংবাদিক বদিউজ্জামান খসরু তখন লন্ডনে। ‘Myths and Facts Bangladesh Liberation War: How India, US, China and the U.S.S.R shaped the Outcome’ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসের ওপর উল্লেখযোগ্য গবেষণা গ্রন্থের কারেণে আমেরিকার পাঠক মহলে তিনি বি.জে. খসরু নামেই পরিচিত। তখনকার লন্ডনপ্রবাসী খসরু ভাইয়ের কাছ থেকেই লন্ডনে কবি শহীদ কাদরীর সঙ্গে তাঁর প্রাথমিক পরিচয়ের গল্পটা শুনি।

শহীদ কাদরীর সঙ্গে আমার দেখা হয় ১৯৮০ সালে। আমার সঙ্গে ছিলেন হাবিবুল বাসার। ঢাকা থেকে প্রকাশিত মর্নিং পোস্ট নামের একটা ইংরেজি পত্রিকা প্রকাশিত হতো। আমি সে পত্রিকায় তিন বছর রিপোর্টিংয়ের কাজ করেছি। ১৯৮০ সালের ৫ ডিসেম্বর হিথরো বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে ভিকটোরিয়া স্টেশনে যাই এবং সেখানে একজন বাঙালির কাছে শহীদ কাদরীর নাম শুনি। আমরা ইস্ট অলগেট স্টেশনে নামি। সেখানে প্ল্যাটফর্মে দেখি কবি শহীদ কাদরী আমাদের জন্য দাঁড়িয়ে আছেন। চকোলেট কালারের জুতা, গায়ে বাদামি রঙের কোট, মাথায় টুপি, গায়ে বাদামি রঙের ওভারকোট। ঝাঁকড়া চুল আর কালো ফ্রেমের চশমা। দেখতে তাঁর বড় ভাইয়ের মতোই। শহীদ ভাই আমাদের ব্রিকলেনে নিয়ে গেলেন এবং সেখানে একটি রেস্তোরাঁয় ভুনা গরুর মাংস দিয়ে ভাত খাওয়ালেন। শহীদ ভাই ভুনা গরুর মাংস খেতে পছন্দ করতেন। সেখান থেকে আমরা আমাদের হোটেলে চলে যাই আর শহীদ ভাই তাঁর টয়েনবি হলে ফিরে যান।

কবি লন্ডনে থাকাকালীন অনেক বাঙালির সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়েছিল। একবার সেখানে কবির সাথে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার [বর্তমানের বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী] সাথেও দেখা হয়। কবিকে সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘আপনি এত বড় কবি, অথচ দেশে ফিরে যাচ্ছেন না, কেন?উত্তরে শহীদ কাদরী বলেছিলেন, ‘যে দেশে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষকে মেরে ফেলে, সে দেশে যাওয়ার কোনো ইচ্ছা আমার নেই।’ এই ঘটনা শহীদ কাদরী প্রায়ই আড্ডায় তাঁর বন্ধুদের বলতেন।

শহীদ কাদরী তখন গোটা পূর্ব লন্ডন শহর ঘুরে বেড়ান। মনমানসিকতায় তিনি পুরোই বোহিমিয়ান। আজ এখানে তো কাল ওখানে। বিশেষ করে ব্রিক লেনের টাওয়ার হেমলেটের কিছু বইয়ের দোকানে তাঁকে প্রায়ই দেখা যায়। যে বইগুলো তিনি বাংলাদেশে গোগ্রাসে পড়তেন, সেই গ্রন্থের জনকদের জীবন্তভাবেই যেন কবি অনুভব করতেন। টাওয়ার হেমলেটের একটি বইয়ের দোকানে শহীদ কাদরী হয়ে গেলেন নিয়মিত খদ্দের। বেশি বই তিনি অবশ্য কিনে পড়তে পারতেন না। কারণ, তাঁর আয় ছিল খুব সামান্য। সপ্তাহে তিনি তখন মাত্র ৩০ পাউন্ড রোজগার করতেন। বই কেনার টাকা কোথায়? তারপরও মাঝে মাঝে খাবারের টাকা বাঁচিয়ে কিনতেন শেলি, বায়রন অথবা অস্কার ওয়াইল্ডের কবিতা। কবিতার পেপার ব্যাগ তাঁর বিশাল ওভারকোটের পকেটে সযত্নে ভরে নিয়ে বাড়ি ফিরতেন। এভাবেই চলতে থাকে দিনের পর দিন, মাসের পর মাস।

শহীদ কাদরী পূর্ব লন্ডনে টয়েনবি হলে যেখানে ছিলেন, সেখানে আরও দুজন বাঙালি বাস করতেন। তাঁদের একজন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম [পরবর্তীকালে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং মন্ত্রী], আরেকজন ডাক্তার জাহিদ হোসেন। ডাক্তার জাহিদ হোসেন একসময় বাংলাদেশে একটি মেডিকেল কলেজের ভিপি ছিলেন এবং নিজেও ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলেন। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জাহিদ হোসেন লন্ডনে পাড়ি জমান এবং সেখানেই থেকে যান। শহীদ কাদরী তখন লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘সাপ্তাহিক জাগরণ’ নামের একটি পত্রিকার সাথে জড়িত হন। পত্রিকাটির মালিক ছিলেন ডাক্তার তালুকদার। জানা যায়, সপ্তাহে মাত্র এক দিন কবি শহীদ কাদরী সেই পত্রিকায় কাজ করতেন এবং সেখান থেকে ১৫ পাউন্ড বেতন পেতেন। পত্রিকার পাশাপাশি তিনি বিবিসির বাংলা বিভাগেও কাজ শুরু করেছিলেন। সেখান থেকেও তিনি সপ্তাহে ১৫ পাউন্ড করে পেতেন। পনেরো এবং পনেরো মোট ত্রিশ পাউন্ড ছিল শহীদ কাদরীর সপ্তাহের রোজগার।

কিন্তু কিছুদিন পরই বিপদ একটা চলে এল। শহীদ কাদরী বিবিসির কাজটি হঠাৎ করেই ছেড়ে দিলেন। লন্ডনে সেই কঠিন সময়ে যখন পকেটে গড়ের মাঠ, তখন চাকরি ছেড়ে দেওয়া সত্যি বোকামি ছাড়া আর কিছুই না। কিন্তু শহীদ কাদরীর স্বভাবটাই এমন। তিনি কখনোই টাকাপয়সা অর্থকড়ি নিয়ে ভাবতেন না। হয়তো একজন যথার্থ বোহিমিয়ান কবি এমনটাই হয়ে থাকেন। তাঁদের কাছে অর্থ কখনোই গুরুত্বপূর্ণ কোনো বিষয় হয়ে ওঠে না। শহীদ কাদরী বিবিসির চাকরিটা ছেড়ে দিলেন খুব সামান্য কারণে। সেটা ছিল ১৯৮১ সাল। বদিউজ্জামান খসরুর স্মৃতি থেকে:

বিবিসিতে শহীদ কাদরীকে দেখতে পেয়ে সম্ভবত নুরুল ইসলাম নামের একজন বিবিসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে উঠলেন, ‘কবি সাহেব, কেমন আছেন?এই কথা বলায় শহীদ কাদরী রেগে গেলেন। তিনি বললেন, আমার কি নাম নেই?ব্যস! এই কথা সে কথার পর তার সাথে ঝগড়া বেধে গেল। তিনি বিবিসির চাকরিটা ছেড়ে দিলেন। কিন্তু চাকরি ছেড়ে দিয়েই তিনি মহা আর্থিক সংকটে পড়েন। তখন আমাদের সবার পকেট ছিল ফাঁকা। খুব কষ্ট করে জীবন চালাতে হতো। শহীদ ভাই সপ্তাহে সাপ্তাহিক জাগরণ থেকে যে ১৫ পাউন্ড পেতেন, তাই দিয়ে তাঁর পুরো সপ্তাহ কাটিয়ে দিতেন। তিনি এই টাকা দিয়ে প্রথমেই রুটি, সিগারেট এবং কফি কিনে ফেলতেন।’

শহীদ কাদরীর বন্ধুরা তাঁর এই চাকরি ছাড়া নিয়ে উষ্মা প্রকাশ করলেও কাদরীর এতে কোনো গা নেই। তিনি আগের মতোই আড্ডা দেন, জীবনের কঠিন সময়কে আগলে রেখে নিজের মতো করে সময় কাটান। এই কঠিন আর্থিক সময়েও তিনি স্বভাবগতভাবে বন্ধুদের সাথে নিয়মিত বাসায় আড্ডা দিতেন। কবিবন্ধু ফারুক আলমগীরের একটি স্মৃতিকথায় তেমন একটি গল্প খুঁজে পাওয়া যায়।

‘কবি শহীদ কাদরী উনিশশো আটাত্তরে প্রবাসে চলে গেলেন এবং আশ্চর্যজনকভাবে উনিশশো একাশি সালের ডিসেম্বরের প্রচণ্ড শৈত্যের সময়ে তাঁর সাক্ষাৎ পেলাম লন্ডনে। আমি তখন টেলিভিশনের একটি উচ্চতর বিশেষ প্রশিক্ষণের ফেলোশিপ শেষে হল্যান্ড থেকে ফিরছি এবং আর দশজন বাঙালির মতো উপমহাদেশের শাসকদের দেশ লন্ডন না দেখে ফিরতে পারি? তা ছাড়া লন্ডনে বিবিসি ও ভিজ-নিউজ-এ দাপ্তরিকভাবে গমন ও পরিদর্শন আমার ফেলোশিপের অংশ ছিল। টার্ন পাইক লেনের এক আত্মীয়ের বাসা থেকে বিবিসি টেলিভিশন ও ভিজ-নিউজ [পরে ভিজ-নিউজ ও ইউপি আই টিএন একত্র হয়ে এখনকার এপিটি এন নিউজ] দপ্তরে কর্মসম্পাদনের পর বুশ-হাউসে গেলাম বিবিসি বেতারে; উদ্দেশ্য, শহীদ ভাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা। বিবিসি বাংলা সার্ভিসের তখনকার প্রধান সিরাজুর রহমান আমাকে সাদরে গ্রহণ করে দুঃসংবাদ দিলেন যে শহীদ কাদরী এখন বিবিসিতে নেই। তবে তিনি আমাকে তাঁর টেলিফোন নম্বর দিলেন। শুধু তা-ই নয়, বিবিসির বাংলার অন্যতম জনপ্রিয় রিপোর্টার প্রডিউসার শ্যামল লোধকে বললেন আমার সাক্ষাৎকার গ্রহণের। শ্যামল লোধ পরদিন সময় দিলেন মধ্যাহ্নে। আমার ছোটবেলার বন্ধু লেখক কাদের মাহমুদ এবং সাংবাদিক ও এককালীন সহকর্মী গোলাম কাদের সবুজসহ কাউকে লন্ডনে না পেয়ে অসহায় বোধ করছিলাম। যাক, শহীদ ভাইয়ের টেলিফোন পাওয়া গেল। তাঁকে ওই দিন সন্ধ্যায় আস্তানায় ফিরে টেলিফোন করতে দরাজ ও ভরাট গলায় বলে উঠলেন, ‘শালা, তুম কব্ আয়া লন্ডনসে? ঠিকানা দে, আমি যাব।’ পরদিন সকাল দশটার মধ্যে দেখি আমাকে অবাক করে দিয়ে বিশাল দেহ হেলেদুলে কাঁপিয়ে আমার অবস্থান টার্ন পাইক লেনের বাড়িতে উপস্থিত। এসেই বললেন, ‘চল্ বেরোই।’ [সূত্র: বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ‘কবি শহীদ কাদরী: আড্ডার উজ্জ্বল পুরুষ ও কবিতার মুহূর্ত’, ফারুক আলমগীর, ঢাকা]

পূর্ব লন্ডনে শহীদ কাদরীর চলতে থাকে নীরব এক কবিজীবন। বাঙালি আড্ডা, ঘুম, পত্রিকার অফিসে খণ্ডকালীন কাজ। মধ্যদুপুরে ঘুম থেকে উঠে তিনি চলে যেতেন পূর্ব লন্ডনের ছোট শহর টাওয়ার হেমলেটে। সেখান থেকে তিনি কখনো বই কিনতেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতেন। মাঝে মাঝে ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। আর রাত হলেই শুরু হতো বন্ধুদের সাথে ধুম আড্ডা। ইতিমধ্যে লন্ডনের অনেকেই জানতেন, বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় কবি এই শহরে বাস করেন

এ রকমটাই ছিলেন কবি শহীদ কাদরী। পকেট গড়ের মাঠ হলেও তাঁর বুকটা ছিল বিশাল। বাংলাদেশ থেকে কেউ এলে দেশের খবর জানার জন্য তিনি উদ্‌গ্রীব হয়ে বসে থাকতেন। বন্ধুদের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

‘শহীদ ভাইয়ের মতো সংবেদনশীল ও মানবিক মানুষ খুব কমই দেখেছি। তাঁর নিজের ক্ষমতা অনুযায়ী অন্যের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়তে তিনি ছিলেন ওস্তাদ। একদিন আমি তাঁর বাসায় গেলাম। আমাকে দেখেই বললেন, ‘খসরু, কিছু খেয়েছ? আমি মাথা না সূচকভাবে নাড়তেই তিনি তাড়াতাড়ি আমার জন্য এক টুকরো রুটি আর এক বাটি দুধ এনে আমার সামনে রাখলেন।’ বললেন কবি শহীদ কাদরীর বন্ধু বদিউজ্জামান খসরু।

সেই সময় পূর্ব লন্ডনে জাতিগত বৈষম্য এবং বিদ্বেষ চরম আকার ধারণ করেছিল। নির্জন রাস্তায় একা একা লন্ডনে হাঁটা বেশ ভয়ের ছিল। আর সে কারণে সন্ধ্যা হয়ে গেলেই কেউ আর বাড়ির বাইরে পা রাখতেন না। তখন নজর থাকত শহীদ কাদরী টয়েনবি হলের মোহনীয় আড্ডায়। সেখানে শহীদ কাদরী রাতের পর রাত গোটা বাড়ি কাঁপিয়ে আড্ডা দিতেন। লন্ডনে সারা দিন ঝিরঝিরে বৃষ্টি পড়ত আর বিকেলের আগেই অন্ধকার হয়ে যেত। ঠিক সেই সময় শহীদ কাদরী হেলেদুলে আড্ডার প্রস্তুতি নিতেন। ইস্ট লন্ডনের সেই আড্ডায় ছিলেন সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, ‘সাপ্তাহিক দেশ’ পত্রিকার সম্পাদক আকবর আমিন বাবুল, এন মেরি এবং ক্রিস্টোফার পেট, বদিউজ্জামান খসরু, চলচ্চিত্র নির্মাতা কবির আনোয়ারসহ অনেকেই। শহীদ কাদরী ছিলেন সেই আড্ডার মধ্যমণি। বদিউজ্জামান খসরু স্মৃতি হাতড়ে বলেন,

‘এমন কোনো বিষয় নাই যে শহীদ ভাই সে বিষয়ে গভীর জ্ঞান রাখতেন না। তখন বেশ বুঝতে পারছিলাম যে এন মেরির প্রতি শহীদ ভাইয়ের একটা বিশেষ দুর্বলতা আছে।’

১৯৮১ সালের শেষের দিকে বিশিষ্ট চলচ্চিত্র নির্মাতা কবির আনোয়ার লন্ডনে আসেন এবং যথারীতি সব বাঙালির আশ্রয় আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরীর দ্বারস্থ হন। পূর্ব লন্ডনের বার্নহার্ট ব্যারোন হাউসের একটি অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ে তাঁর থাকার জায়গা হয়। সেই বাড়িটিতে তত দিনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, বদিউজ্জামান খসরু এবং ব্যারিস্টার নূর থাকতেন। কবির আনোয়ার বাংলাদেশ থেকে এসেছেন এই খবর শুনে একদিন হঠাৎ শহীদ কাদরী তাঁর কাপড়চোপড় সঙ্গে নিয়ে সেই বাড়িটায় উঠলেন। কবির আনোয়ার ভাইকে সেই স্মৃতি মন্থনের অনুরোধ করতেই তিনি স্মৃতির ঝাঁপিটি খুলে দিলেন।

‘কবির! তুমি এইখানে?এই বলে শহীদ কাদরী তাঁর সব পোঁটলাপুঁটলি নিয়া হাজির। এসেই বলে, সে এখানেই থাকবে। প্রথমে সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম একটু নিমরাজি হলেও পরে আমরা সবাই তাঁকে সাদরে গ্রহণ করে নিলাম। আর আমিও প্রাণ ফিরে পেলাম। শুরু হয় আমাদের নতুন এক জীবন। বেলা এগারোটা-বারোটার দিকে ঘুম থেকে উঠেই আড্ডা, আবার সেই আড্ডা শেষ হতো ভোররাতের দিকে। চলচ্চিত্র নির্মাতা রুহুল আমিন আমাদের সেই আড্ডায় প্রায় সময়ই যোগ দিতেন।’

এখানে ব্যারিস্টার নূরের কথা উল্লেখ করা প্রাসঙ্গিক হবে বলে মনে করি। বিভিন্ন আড্ডায় সুযোগ পেলেই শহীদ কাদরী এবং কবির আনোয়ার তাঁরা দুজনই ব্যারিস্টার নূরের বিশাল হৃদয়ের কথা তুলে ধরতেন। তিনি ছিলেন অসাধারণ এক উদার মানসিকতার লোক। মানুষকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করা ছিল তাঁর স্বভাব। নিজে না খেয়ে, না পরে তিনি বাঙালির উপকার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠতেন। শহীদ কাদরী একদিন কবির আনোয়ারকে বললেন,

‘একবার শিকড়ের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গেলে আর কিছুই থাকে না কবির!’

 ১৯৮২ সালে শহীদ কাদরীর সাথে তাঁর আরেক বন্ধু কথাসাহিত্যিক ও গল্পকার জ্যোতিপ্রকাশ দত্তের সাথে কাকতালীয়ভাবে লন্ডনে দেখা। পুরোনো বন্ধুকে দেখে শহীদ কাদরী আনন্দিত হয়ে উঠলেন। জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত সেই স্মৃতিমন্থনটি করছেন,

‘১৯৮২’র মে মাসে সপ্তাহ দুয়েকের জন্য আমি ও পূরবী ইউরোপে বেড়াতে যাই নিউইয়র্ক থেকে। বেলজিয়াম, ফ্রান্স ও সুইজারল্যান্ড। যাওয়া-আসার পথে লন্ডনে দু-চার দিন করে থাকা। পূরবীকে শহীদ দেখেছিল ঢাকাতেই। সাতষট্টিতে আমার বিবাহোত্তর অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিল সে। লন্ডনে পৌঁছে কবি দেবব্রত চৌধুরীর মুখে শহীদ কাদরীর লন্ডনে বাসের কথা শুনি এবং দেবুদাকে নিয়ে শহীদের সঙ্গে দেখা করতে যাই সুরমা পত্রিকা অফিসে। শহীদ সেখানে সপ্তাহের কিছু সময় ব্যয় করত পত্রিকা সম্পাদনায় সাহায্যকারী হিসেবে। ওই দিন দেখা হওয়ার পরে স্থির হয় আমরা ইউরোপ ভ্রমণ থেকে ফিরলে শহীদের সঙ্গে কিছু সময় কাটানো যাবে।’ [সূত্র: দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন, সেপ্টেম্বর ২, ২০১৬, শহীদ, সে তো নেই, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, ঢাকা]

এভাবেই পূর্ব লন্ডনে শহীদ কাদরীর চলতে থাকে নীরব এক কবিজীবন। বাঙালি আড্ডা, ঘুম, পত্রিকার অফিসে খণ্ডকালীন কাজ। মধ্যদুপুরে ঘুম থেকে উঠে তিনি চলে যেতেন পূর্ব লন্ডনের ছোট শহর টাওয়ার হেমলেটে। সেখান থেকে তিনি কখনো বই কিনতেন, লাইব্রেরিতে গিয়ে পড়াশোনা করতেন। মাঝে মাঝে ভিক্টোরিয়া পার্কে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা সময় কাটাতেন। আর রাত হলেই শুরু হতো বন্ধুদের সাথে ধুম আড্ডা। ইতিমধ্যে লন্ডনের অনেকেই জানতেন, বাংলাদেশের এক জনপ্রিয় কবি এই শহরে বাস করেন। কাদের মাহমুদ লেখক এবং সাংবাদিক। ১৯৭৩ সালে তিনি পূর্ব লন্ডনে এসেছিলেন বিবিসির একটি কাজ নিয়ে এবং তখন থেকেই তিনি লন্ডনপ্রবাসী। তিনি জানতেন, কবি শহীদ কাদরী লন্ডনে আছেন এবং তাঁর খুব কাছাকাছিই থাকেন। তাঁর খুব ইচ্ছে হয় যদি কবিকে একবার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করে আনা যায়! কিন্তু সমস্যা হলো শহীদ কাদরীকে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তিনি কখন কোথায় আড্ডা দিয়ে বেড়ান আল্লামালুম! শহীদ কাদরীর স্বভাবটাই এমন। শহীদ কাদরী নিজেই বলেছেন সে কথা।

‘না, শহীদ সে তো নেই; গোধূলিতে থাকে

কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায়নি, পাবে না।’

শহীদ কাদরীর ভাষায়, ‘ধাউ ধাউ করে ঘুরে বেড়াতাম’। চালচলনে তিনি ছিলেন কেতাদুরস্ত আর স্বভাবেও তিনি তা ধরে রাখতেন। এমনিতে চুপচাপ থাকতেন, তবে যদি কারও সাথে কথা বলে ভালো লাগত, তাহলে তাহলে আর কথা নেই। দিন নেই রাত নেই, তখন তার সাথেই চলত আড্ডা। শেষ পর্যন্ত কাদের মাহমুদ কবির দেখা পেলেন। তাঁর একটি স্মৃতিচারণা তুলে ধরছি।

‘কী করে কখন আবার একদিন শহীদ কাদরীর সাথে দেখা হয়ে যায়, জনমত দফতরে কি? না, ঠিক কোথায় তা আজ আর মনে করতে পারছি না। নাই-বা পারলাম। ক্ষতি নেই। কারণ, তিনি একদিন খার্তুম রোডে আমার বাড়িতে এলেন। ঝর্না এমন পরিবারের মেয়ে, যেখানে অতিথি আপ্যায়ন একটি নৈমিত্তিক ব্যাপার হতো। তদুপরি শহীদ কাদরী তো শহীদ কাদরীই; বাংলার ছেলে হিসেবে বিশালদেহী, নাদুনসুদুস; শুদ্ধ-কথক, একটু ক্যাকেশিয়ান মূর্ছনা, আবার ঢাকাইয়া বোলও বের হয়; এর উপর এমন আত্মসচেতন কবি, যিনি পকেটে স্বরচিত কবিতা নিয়ে ঘোরেন না। তিনি আসবার পরে বোঝা গেলো, তাঁর সর্বাবয়বে একটা কষ্টের অবলা জলছাপ; তবে তিনি আরামপ্রিয় ও আদরপ্রিয়। আজকাল কেন, অনেক বছর ধরেই বাংলাদেশ থেকে কচুর লতি, পাটশাক ইত্যাকার যাবতীয় সবজি আর কাঁচকি মাছ থেকে রুই মাছসহ হরেক কিসিমের দেশি মাছ লন্ডনে আমদানি হয়; তখন তা অতটা ছিল না। তবু বাজার থেকে আমি যা আনতে পেরেছিলাম, তা দিয়ে ঝর্না দেশি উপায়ে উপাদেয় রান্না করেছিল। আমাদের পাশে বসিয়েই শহীদ কাদরীকে আমরা সানন্দে খাইয়েছিলাম। তারপর কিছুটা আড্ডাও হয়েছিল। কবিতা পড়েছিলাম কি? মনে পড়ে না। তবে লন্ডনে আমাদের ছোট পরিসরের ছোট সংসারটি যৎকিঞ্চিৎ বাংলাদেশ হয়ে জ্বলজ্বলে চিকতাই ছেড়েছিল।’

এভাবেই সপ্তাহে ১৫ পাউন্ড সম্বল করে শহীদ কাদরীর লন্ডন জীবনে গা ভাসিয়ে দিলেন। লেখক, কবি এবং সাংবাদিক আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী সেই সময়ে ‘ক্যাশ এন্ড ক্যারি’ নামের একটি গ্রোসারির দোকানে কিছু সময়ের জন্য চাকরি করতেন। ‘ক্যাশ এন্ড ক্যারি’র মাধ্যমে আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী অনেক বাঙালিকে বিভিন্ন সময়ে নীরবে সাহায্য সহযোগিতা করতেন। কবির আনোয়ারের স্মৃতি থেকে একটি ঘটনা তুলে দেওয়ার লোভ সামলানো যাচ্ছে না

 ‘পকেটে টাকা নাই, এদিকে পেটে কিছু দিতে হবে, কী করি? তখন ‘ক্যাশ এন্ড ক্যারি’তে যাওয়ার সাথে সাথেই গাফ্‌ফার ভাই পকেটে হাত দিয়ে কিছু দিয়ে দিলেন। বুঝতে পারলাম তিনি আমার চোখ দেখেই হয়তো সব বুঝতে পেরেছিলেন। শুধু আমি না। সেই সময়ে গাফ্‌ফার ভাই ছিলেন আমাদের সবার অভিভাবক।’

প্রবাস জীবনটাই এমন। তবে তাঁরা কেউ বিত্তবান ছিলেন না অথবা বলা যায় বিত্তের পেছনে তাঁরা ঘোরাঘুরিও করতেন না। কারণ, তাঁদের অস্থিমজ্জায় ছিল কবিতা, শিল্প, সিনেমা, সৃষ্টির উল্লাস। প্রচুর আর্থিক সমস্যায় তাঁরা ভুগেছেন, কিন্তু এই নিয়ে তাঁদের কোনো আফসোস ছিল না। শহীদ কাদরীও অন্য সবার মতো তাঁর লন্ডনজীবন প্রচুর আর্থিক কষ্টে সময় পার করেছিলেন। কাদের মাহমুদের স্মৃতি থেকে,

‘যে কথা দিয়ে শুরু করেছিলাম, খাঁটি কবিকে ছোঁয়া যায় না। শহীদ কাদরীকে লন্ডনে যে কিছুটা সময় আমি কাছে পেয়েছিলাম, সেটা তাঁর কবিত্বকে ছোঁয়া তো বহু দূরের কথা, তাঁকে চেনাই ছিল দুরূহ। যত দূর মনে পড়ে, কেবল তাঁর বহিরঙ্গে একটা দুর্ভেদ্য বোহিমিয়ান লেবাস দেখতে পেরেছিলাম। আর সেই লেবাসে অঢেল কষ্টের চিত্রাবলি আঁকা।’

কবির লন্ডন জীবন ধীরে ধীরে কঠিন আর দুর্গম হয়ে উঠল। কবি সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি আবার বাংলাদেশে চলে যাবেন। ১৯৮২ সালে তিনি ঢাকায় গেলেন এবং সেখানে তাঁর দৈনিক সংবাদে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দেওয়ার কথাবার্তা চলতে থাকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি আবার পূর্ব লন্ডন ফিরে আসেন।

পূর্ব লন্ডনে টাওয়ার হেমলেটের বইয়ের দোকানে ঢুঁ দেওয়া তখন কবির অন্যতম কাজ। চকোলেট রঙের জুতা আর বাদামি রঙের ওভারকোট ছিল কবির প্রিয় পোশাক। মাথায় কায়দা করে টুপি পরতেন। একদিন ঠিক পূর্ব লন্ডনেই ঘটল ঘটনাটা। যে ঘটনায় কবির আমূল জীবন পাল্টে দেয়। এমনকি কবিকে তাঁর পরিকল্পনা অনুযায়ী বাংলাদেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারেও বিরত রাখে। কবির সঙ্গে ডেনা নামের এক আমেরিকান মহিলার পরিচয় ঘটে। তখন শহীদ কাদরী বিবিসির সাথে যুক্ত। হঠাৎ করেই একদিন ডেনার সাথে টাওয়ার হেমলেটের একটি বইয়ের দোকানে দেখা হয়। ডেনা নিজেও কবিতা ভালোবাসেন। তবে কাদরীর মতো তিনি লেখক না। আলাপ-পরিচয়ে জানা গেল ডেনা আমেরিকার বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম এ করেছেন। ডেনা আমেরিকান নাগরিক এবং ইহুদি ধর্মাবলম্বী। কবির সাথে ডেনার জমে গেল আড্ডা। তারা কখনো টাওয়ার হেমলেট, কখনো ভিক্টোরিয়া পার্কের ব্রিকলেনসহ বিভিন্ন জায়গায় সময় কাটাতেন। আলোচনা চলত কবিতা নিয়ে। একদিন প্রস্তাব আসে ডেনার কাছ থেকেই। বিয়ে করে আমেরিকায় চলে গেলে কেমন হয়? শহীদ কাদরীর ‘হোমলেস মাইন্ড’ ডেনার এই প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তাঁরা লন্ডনে বিয়ে করলেন এবং চলে এলেন আমেরিকার বোস্টন শহরে। সেটা ছিল ১৯৮৩ সাল। সমাপ্ত হয় কবি শহীদ কাদরীর বিলাতি বোহিমিয়ান জীবনের এক অধ্যায়, পাশাপাশি শুরু হয় আমেরিকার বোস্টন শহরে কবির আরেক ছন্নছাড়া জীবনের গল্প।