বর্কিম্ময়ের ছবি

 

চন্দন, তুমি আমার কাছের মানুষদের একজন, বলল বর্কিম্ময়।
চন্দন হেসে বলল,
এখন নিশ্চয়ই কিছু একটা চাইবে আমার কাছে।
বর্কিম্ময় বলতে চেয়েছিল, তোমাকে আমার ছবিগুলো দিয়ে যাচ্ছি। ওগুলোর ভার আমি আর বহন করতে পারছি না। কিন্তু চন্দনের কথা শুনে মনে হলো, না বলাই ভালো।
বলো বলো। সরি, বাধা দিলাম।
আমার ইনহেলারটা দেখেছ?
এই কথা বলার জন্যে নাটকীয় শুরুটা করোনি নিশ্চয়ই’—‘চন্দন, তুমি আমার কাছের মানুষদের একজন!
এবার একটা বড় ছুটি নেব চন্দন।
চন্দন দেখল বর্কিম্ময় আগের কথায় ফিরবে না। কোথায় যাবে, খাগড়াছড়ি?
খাগড়াছড়ি বর্কিম্ময়দের বাড়ি। বাড়ি থেকে রিসাং ঝর্নার দূরত্ব পাহাড়ি হাঁটাপথে মাত্র ত্রিশ মিনিট। ভোর, ভরদুপুর আর রাতদুপুরে ঝর্নার শব্দ কানে আসে।
হয়তো।
বর্কিম্ময় যখন ঢাকায় ক্লান্ত হয়ে যায়, খাগড়াছড়ির ফিরে যায়। ওখানে ঘরের জানালা খুলে দিলে ঘরে ঢুকে পড়ে মেঘ।
ছবিগুলোর কী করবে, চন্দন বলল। ওগুলো তো তুমি রাখবে না বলছ।
পুড়িয়ে ফেলব।
পারবে? জীবন্ত কিছুর গায়ে আগুন ধরিয়ে দেবে এমন মানুষ তুমি না।
বর্কিম্ময়ের সন্দেহের চোখে তাকাল। ওগুলো জীবন্ত তুমি বিশ্বাস করো?
চন্দন হেসে ফেলল। বিশ্বাস সে করে না। বর্কিম্ময়ের শুভ্র বেশভূষাও তার কাছে দেখানোপনা মনে হয়।
বর্কিম্ময় বলল,
তুমি যাও চন্দন। আমার অনেক গোছগাছ বাকি।
চন্দন নিঃশব্দে দরজা ভিড়িয়ে চলে গেল।
বাইরে দুপুর। এমন দুপুরে মাথা ঝিমঝিম করে। গুছিয়ে চিন্তা করা যায় না। কেমন ঘুম পেতে থাকে। বর্কিম্ময়েরও তাই হয়েছে বোধ হয়। নয়তো এভাবে রোদের ভেতর চন্দনকে বের হয়ে যেতে বলে?
বর্কিম্ময় যে যথেষ্ট আভাস দিয়েছে তাকে, চন্দন কি তা বুঝতে পেরেছে? যেমন লোভী, আভাস যদি না-ও বোঝে, ছবি সে হাত করবেই। বর্কিম্ময় যখন থাকবে না তখন সে দরজা ভেঙে ঢুকবে। অবশ্য যত লোভই করুক
অঞ্জনকে চন্দন রাখতে পারবে না।
অঞ্জনের আঁচ সহ্য করবে, এমন সাধক চন্দন নয়। তাতে করে যা হবে বিশেষ সুবিধা করতে না পারায় ছবিটা বহুকাল হয়তো বদ্ধ পড়ে থাকবে। শেষে চন্দন গছিয়ে দেবে আর কোথাও। অন্য কারও কাছে।
তা দিক।
কোথায় ও? ওই তো। সার সার ক্যানভাসের ভেতর থেকে বর্কিম্ময়ের দিকে তাকিয়ে আছে
অঞ্জন। ঠিক তাকিয়ে নেই। যেন তার কাঁধের ওপর দিয়ে কিছু দেখছে।
এ ছবিতে বর্কিম্ময়ের গাঢ় কামনা আর আরাধনা মিশে গেছে। প্রতিরাতে তন্দ্রায় একটু আচ্ছন্ন হয়ে এলেই, ষোলো-বিশ ক্যানভাসে আঁকা তেলরঙের এ ছবি বর্কিম্ময়কে তার জগতে নিয়ে যেতে চায়

অঞ্জন তাকে তীব্রভাবে চায়। যে তীব্রতায় অঞ্জনকেও একদিন চেয়েছিল বর্কিম্ময়।
চাওয়া কত তীব্র হলে আঁকা ছবি জ্যান্ত হয়ে ওঠে, তা জানেন শুধু ঈশ্বর


নিঝুম পুরান ঢাকার এই বেসরকারি হাসপাতালে রেসিডেন্ট ডাক্তার হিসেবে যোগ দিয়েছে প্রায় তিন মাস হতে চলল।
গত দুটি বছর কোভিড মহামারি খুব ভালোভাবে সামলেছে এ হাসপাতাল। বাইরে বেশ সুনাম শোনা যায়। কিছুদিন আগে নতুন রং করা হলো। বাইরের দেয়ালগুলো সাদা, জানালার কাচগুলো নীল।
হাসপাতালে পা রাখার আগে নিঝুম কিছুটা সময় বাইরে কাটায়। আঁচল ভাঁজ করে টং দোকানের বেঞ্চে বসে। চা খেতে খেতে বাহির থেকে দেখে। বেশ লাগে।
হাসপাতালের ভেতরের দেয়ালের রংও সাদা। তবে ধবধবে সাদা নয়, একটু ফিরোজা করেছে। চোখে আরাম দেয়। দেয়ালের জন্য প্রায় দুশো পেইন্টিং কিনেছে ওরা। যুক্তরাষ্ট্রের অরিগনের কোনো এক হাসপাতালের আদলে লাগানো হয়েছে আর্ট গ্যালারির মতো। সেই সব ছবিও যে এত মন টানে।
সব ছবি দেখার সুযোগ নিঝুমের এখনো হয়নি। শুধু তৃতীয় তলায় হেমাটোলজির দেয়ালের ছবিগুলোই দেখা হয়েছে। কাজের শুরুতে দাঁড়ানোর সুযোগ হয় না। কাজের শেষে দাঁড়ায়।
করিডর তো নানান দিকে চলে গেছে। সব দিকে এখনো যাওয়ার অবসর হয়নি। হয় না। হাসপাতালে এই তো হয়।
কোভিডের সময়টা নিঝুম নবাবগঞ্জে ছিল। একটা বেসরকারি সংস্থার সঙ্গে। ওরা ওঁরাও সাঁওতাল এসব সমতলের আদিবাসীদের নিয়ে কাজ করে। সেখানে মহামারির আঁচড় তত পড়েনি যতটা ঢাকায় পড়েছিল। আর এ নিয়ে কিছু অহেতুক আড়কথা নিঝুম এরই মাঝে শুনে ফেলেছে।

থাকতেন কোভিডের সময়, দেখতাম কী করেন।
সর্বশেষ এক পুরুষ সহকর্মী বললেন, এই সব কোনো কাজে আসে? এর চেয়ে এই টাকা স্টাফদের দেওয়া হতো বুঝতাম। কথাটা এসেছিল দেয়ালের ছবিগুলো ঘিরে।
নিঝুম এখন নিজেকেই দোষ দেয়। আবেগের বশে বলেছিল, আপনারা কেউ তাকান না কেন ভাই ছবিগুলোর দিকে? ওর চোখ ঝলমল করছিল আনন্দে। ভদ্রলোক হেসে বললেন, থাকতেন কোভিডের সময়, সোজা হয়ে যেতেন।
করিডর ধরে যেতে যেতে এই সব কথা মনে পড়ছে।
আর আছেন এক পলাশমিতা। তিনি শুরু থেকেই ওকে দাগি হিসেবে চিহ্নিত করে রেখেছেন। ঠিক কীভাবে কখন নিঝুম ওনার বিরক্তি উৎপাদন করল কে জানে। গতকালের ক্ষত তো এখনো কাঁচা। নিঝুম হয়তো একটু বেশিই গুরুত্ব দিচ্ছে।
ছবি শুরু হয়ে গেছে। বড় ক্যানভাসের ওপর তেলরঙের কাজ।
হাসপাতালের করিডরটার আলো ছবিগুলোকে ভালো বুঝতে দেয় না। আরেকটু উজ্জ্বল হয়ে যদি ছবির ওপর পড়ত! এদিকটায় বাইরের আলোও আসে না। বাতি নিভলেই অন্ধকার।
যাক, শেষমেশ এটা তো হাসপাতালই। আর্ট গ্যালারি নয়।
করিডর নির্জন হয়ে উঠেছে। দূরে শেষ প্রান্তে ডক্টরস লিফটের দরজা বন্ধ। হাতঘড়িতে বেলা তিনটা কুড়ি। পেটে খিদে। তবু ছবিগুলো তাকে মুহূর্তে আপন করে নিল।
প্রতিটা ছবিতে একটা চাপা সবুজ আর সোনালির আশ্চর্য মিশেল। চোখকে স্বপ্নালু করে তোলে। তুলিতে আঁকা মায়াকাড়া সব মুখ আর সবুজ অন্ধকার গাছপালা।
দেখতে দেখতে হঠাৎ একটা ছবির সামনে এসে নিঝুম থেমে গেল। এ ছবি আগে দেখেনি কেন?
ছবিতে নিঝুমের বয়েসী এক তরুণ তার মুখোমুখি। তবে চোখ তার চোখের দিকে নয়। যেন নিঝুমের কাঁধের ওপর দিয়ে অন্য কিছু দেখছে।
ছবিটা এত জীবন্ত যে নিঝুম অজান্তে এপ্রন আর শাড়ি ঠিক করে নিল। পায়ে পায়ে এগোল ছবির দিকে।
এ কী দেখছে। এ ছবির যেন সত্যিই প্রাণ আছে! ছেলেটার ঠোঁটে স্মিত হাসি, যেন জানত নিঝুম আসবে। কপালে গালে চাপা সোনালি আলো বুঝি ভোরের আলো। পেছনে অস্পষ্ট সবুজ। ওখানে বুঝি কোনো রাতের স্বপ্ন এখনো আটকে আছে।
পেছনের এই সবুজ অন্ধকার কি ছেলেটার বাড়ি? বাড়ি থেকে বেরিয়ে নিঝুমকে সে দেখতে এসেছে, কিন্তু দেখছে না। চোখ সেই দুষ্টুমি। যেন বলছে
জানতাম, না এসে পারবে না। মিছেই দেরি করলে কেন?
হাসপাতালে এমন ছবি দরকার। কোনো মৃত্যুযাত্রীর সন্তান, ভালোবাসার মানুষ যদি এ ছবি দেখতে পায়, আশা ফিরে পাবে।
করিডরে কেউ নেই। কতক্ষণ কেটে গেছে কে জানে। নিঝুম ছবিটা খুঁটিয়ে দেখে গেল। পরক্ষণেই মনে হচ্ছে, সময় বুঝি পলকে শেষ। বুকের ভেতর হাহাকার।
নিঝুম নিজেও চিত্রশিল্পী হতে চেয়েছিল। তার স্বপ্ন ধ্যান রক্তের গুণ পর্যন্ত ছিল তার অনুকূলে। সেখানেই তো মায়ের যত ভয়। না হয় এমন ছবি তো তারই আঁকার কথা।
বুকের ভেতর আরও একটা শূন্যতার ভাব। এর সঙ্গে নিঝুমের মানুষিসত্তার যোগ বেশি। ছেলেটা এত সুন্দর কেন? মনে হচ্ছে তাকে আড়াল থেকে দেখে। বুকে একটা প্রিয় শূন্যতা আকার পেয়ে ধীরে ধীরে গলার কাছে উঠে আসছে। একটা মিষ্টি কষ্ট দিচ্ছে।
হঠাৎ লিফটের ঘণ্টি বেজে উঠল।
পলাশমিতা। কাছে এসে বললেন,
কী খবর নিঝুম?
সঙ্গে তার বন্ধু ফয়েজ। নিঝুম বলল, এই তো ম্যাডাম। তারপর ফয়েজের দিকে তাকিয়ে স্যার বলে মৃদু মাথা নোয়াল। ওনারা বোধ হয় ক্যানটিন হয়ে এলেন।
তিনশ সাতের পেশেন্ট ক্রিটিক্যাল হয়ে ওঠায় এগারোটা থেকে তিনটাকখন চারটি ঘণ্টা বেরিয়ে গেছে। লাঞ্চ মিস করেছে নিঝুম।
পলাশমিতার চোখ মুখ কঠিন। হঠাৎ তাচ্ছিল্যে হেসে বলল, একটা প্রশ্ন করি মেয়ে, কিছু মনে করো না। তুমি এমডি পাস করেছ কীভাবে আমি অবাক হচ্ছি।
জি ম্যাডাম?
বেসিকেই তোমার এত ফাঁক। আমি কল্পনাও করিনি। উনিশ নম্বরে এক গাদা ডায়াগনসিস অ্যালাও করেছ। একটা সিক্সটি আপ মানুষের শরীর বোঝো না?
উনিশ নম্বর?
ফয়েজ বন্ধু পলাশমিতার হাত ধরে ফেলল, পলাশ!
আরে ছাড়ো। ওর ভালোর জন্যই বলছিলাম। ঠিক আছে, পরে কথা হবে।
পলাশমিতা সবুজ কার্পেট মাড়িয়ে চলে যেতে থাকলেন। অ্যাপ্রন আর স্টেথো হাতে গোটানো ফয়েজ একটু পিছিয়ে পড়েছেন। চোখের ভাষায় নিঝুমকে যেন বললেন, কিছু মনে কোরো না।
উনিশ নম্বর বলতে ছয় নম্বর বেডের উনিশ নম্বর বিছানা। কেমোথেরাপির জটিলতা নিয়ে আসা সেই বৃদ্ধ। বাড়তি কি ডায়াগনসিস দিয়েছে তার মনে পড়ল না।
আবার উল্টো দিকে ফিরে নিঝুম ওয়ার্ডে চলল। মোড়ে এক জায়গায় কার্পেট ভাঁজ হয়ে আছে, হোঁচট খেয়ে পড়তে যাচ্ছিল। জিভ শুকিয়ে গেছে। জানামতে কোনো ভুল বা বাড়তি ডায়াগনসিস দেয়নি ও। নিশ্চিত হতে শারমিন মিসকে দেখিয়েও নিয়েছে।
শারমিন মিস এখানে লিজেন্ড হেমাটোলজিস্ট। এবং এ হাসপাতালের একমাত্র মানুষ
এ ছবিগুলোর বাইরে নিঝুমের যাকে ভালো লেগেছে। এবং এ ছবিগুলো নিয়ে তাঁর অভিমতও অন্য কারও সাথে মেলে না।
কী যে ভালো লাগে, বলেন শারমিন মিস। ছবিগুলো আরেক জগতে নিয়ে যায়। মনে হয় একটু যেন ছুটি পেলাম।
ছবির কথায় মনে পড়ল সে ছবির কথা। কী নাম ওর? কেই-বা এঁকেছেন এমন ছবি। ফেরার পথে সব দেখে যেতে হবে


গোটা ব্যাপারটাই কেমন জোর করে মেলানো, বলল তেজস। এমনও হয় নাকি! রক্ষা করো ঈশ্বর!
চারুকলার বকুলতলার নিচটা ছোট ছোট ফুলে ছাওয়া। তার পাশের ইটের রাস্তায় হাঁটছে নিঝুম আর তেজস। প্রায় সাত বছর পর দুজনের দ্বিতীয়বারের মতো দেখা। তেজসই প্রথম চিনেছে।
যৌবনের সাত বছরে চেহারা তেমন বদলায় না। কিন্তু কত অজস্র মুখের সঙ্গেই তো দেখা হয়। এক মুখ আরেক মুখকে সরিয়ে দেয়, কখনো দুটো আলাদা মুখের স্মৃতি একাকার হয়ে যায়। তবে যদি অনুভূতি দোল পায়, চেনা যায় বহু বছর পরও।

আপনার মুখটা আমি কোনো দিন ভুলতাম না। কেন জানেন? বলল তেজস। মিষ্টি চেহারাটা নয়, কপালের কাটা দাগটাও নয়।
অনেকেই কাটা দাগটার জন্যে চেনেন, নিঝুম কপাল স্পর্শ করল।
আমার সেটা হয়নি। আপনি চলে যাওয়ার সময় আপনার চোখে একটা কষ্ট দেখেছিলাম। সেই কষ্টটা আমার মনে আছে। তাই আপনাকেও মনে আছে।
নিঝুম যখন সলিমুল্লাহ মেডিকেলে সেকেন্ড ইয়ারে পড়ে, তখন একদিন কী মনে করে চারুকলার ভেতরে ঢুকে পড়েছিল। যেহেতু তার স্বপ্ন ছিল চিত্রশিল্পী হবে, বেশ কবার চারুকলায় এসে ঘুরে গেছে। তা বেশ আগের কথা। স্বপ্নাচ্ছন্নের মতো লাগত। মেডিকেলে ভর্তির পর আর আসেনি। হঠাৎ সেদিন কী মনে করে ঢুকে পড়েছিল। একটু এগিয়ে দেখে লম্বা এলোমেলো চুলের একটা ছেলে সেখানে একটা বয়স্ক কাঁঠালগাছের নিচে জনা বিশেষ ছেলেমেয়েকে আঁকতে শেখাচ্ছে। তেজস।
শিক্ষার্থীদের বয়েস দেখেই বোঝা যাচ্ছিল, চারুকলার ভর্তি কোচিং করছে ওরা। নিঝুম কাছাকাছি একটা কাঠবাদামগাছের ছায়ায় দাঁড়াল। এলোমেলো চুলের ছেলেটা হঠাৎ কণ্ঠ উঁচিয়ে বলল,
আপনি পথিকৃতের স্টুডেন্ট?
নিঝুম একটু অবাক হয়ে গেল। পথিকৃৎ কী?
বুঝেছি, বলল ছেলেটা। চাইলে আপনি বসতে পারেন এখানে কোথাও। যেখানে সুবিধা। তারপর আবার ছেলেমেয়েদের দিকে মন দিল। পার্সপেক্টিভ নিয়ে বলছিল তেজস।
নিঝুম পরে জেনেছে পথিকৃৎ সেই কোচিং প্রতিষ্ঠানের নাম।
তেজস কিন্তু বাইরের লোককে মোটেও বসতে দিতে উৎসুক না। কিন্তু নিঝুমের ভেতর সে একটা বিশেষ ব্যাপার দেখেছিল। নিঝুম প্রগলভের মতো এসে ছবিতে উঁকি দিচ্ছিল না। গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে ছেলেমেয়েগুলোর দিকে স্রেফ তাকিয়ে ছিল।
তেজসের মনে হয়েছিল মেয়েটা কিছু দেখছে না, তবু সব দেখছে। বুঝি আরও বহুদূর চলে গেছে। এ দৃষ্টি চেনে তেজস।
তার কথায় নিঝুম প্রথমে না করলেও পরে মৃদু হেসে পায়ে পায়ে কাছে এসেছিল। তারপর শেষ সারির এক কোণে একটা মেয়ের পাশে বসে পড়েছিল। ছবি দেখছিল কি দেখছিল না। হাসছিল কি হাসছিল না।
নিঝুম চলে যাওয়ার সময় তেজস তাকে বলল,
আপনি চারুকলায় ভর্তি হতে চান?
নিঝুম কোনো উত্তর না দিয়ে তাকিয়ে ছিল। পরে ঘুরে চলে এসেছে। কাজটা খুবই অভদ্রের মতো হয়েছিল কিন্তু নিরুপায়। কারণ, ওই এক প্রশ্ন তার সব উত্তরের পথ বন্ধ করে দেয়।
এবং তেজস সে কথা মনে রেখেছে। হাসতে হাসতে বলল,
এবার কিন্তু আপনাকে উত্তর দিয়ে যেতে হবে। সেই যে প্রশ্ন করেছিলাম।
নিঝুম বলল, প্রথমে সরি, উত্তর না দিয়ে চলে এসেছিলাম। আসলে, সব কথা এক হলে কোনো কথাই ব্যক্ত হয় না। জানি না আপনাকে বোঝাতে পারব কি না। তবু বলি। আমি আমার মায়ের কথার বাইরে যাইনি কখনো। আমার বাবা ছবি আঁকতেন। মায়ের খুব ভয় ধরে যায় ছবি আঁকা নিয়ে। মা ছিলেন মেডিকেল ড্রপআউট। চাইতেন আমি ডাক্তারি পড়ব। তাঁর কিছু বাঁধা ছকের পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আমি অনড়। কারণ, আমি তো তারই মেয়ে। নিরুপায় হয়ে একদিন তিনি নিজেকে আঘাত করতে থাকেন। কাচের গ্লাস ভেঙে ভাঙা কাচের টুকরো দিয়ে আঘাত করতে থাকলেন বুকে। বিপিডির একটা ওর্স্ট কেস হয়ে পড়েছিলেন। কপালের কাটা দাগটা স্পর্শ করল নিঝুম। আমার এ দাগটা তখনই হয়। তাকে বাধা দিতে গিয়ে। আচ্ছা, আপনি শিক্ষক হয়েছেন দেখে খুবই ভালো লাগল তেজস। প্রসঙ্গ বদলাতে চাইছে নিঝুম। আপনি কি শিল্পীই হতে চেয়েছিলেন?
একদম, বুদ্ধিমান তেজসও তাকে সাহায্য করে গেল। আমি খুব ছোটবেলা থেকেই জানতাম যে চারুকলাই আমার ঠিকানা।
এ জন্যেই আমার মনে হচ্ছিল বোধ হয়, এখানে এলেই আপনাকে পাওয়া যাবে, হাসতে হাসতে নিঝুম বলল। অথচ যেকোনো কিছুই হতে পারত, তাই না? আপনি তো প্যারিসেও চলে যেতে পারতেন।
তেজস বলল, সে জন্যেই বলছি। সব যেন কেমন বেশি রকম সাজানো। ফেসবুকে যুক্ত হয়ে নিই, আসুন। নয়তো আবার হারিয়ে ফেলব।
ফেসবুকে পরস্পরকে খুঁজে বার করল ওরা।
আমি যদি ভুল না করে থাকি, তেজস বলল, আপনি আমাকে কিছু একটা বলতে এসেছেন নিঝুম।
একদম বেপরোয়া হয়ে।
চলুন, চা খাওয়া যাক। এরপর হাঁটতে হাঁটতে শুনি। হাবিব নামে একটা ছেলে বসে টিএসসির উল্টো দিকে, গুড়ের চা বানায়। আপত্তি আছে?
আপত্তি না। বলতে পারেন আসক্তি আছে। গুড়ের চা আমারও খুব পছন্দ। আমাদের হাসপাতালের উল্টো দিকেও একটা আছে। আমি না খেয়ে ভেতরে ঢুকিনি একদিনও।
টিএসসির পূর্ব দিকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের যে তোরণ, তার পাশে হাবিবের দোকান। ওয়ানটাইম কাপে চা নিয়ে নিয়ে ওরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে চলে এলো।
হাঁটতে হাঁটতে নিঝুম বলল তেজসকে, সব যা কিছু ঘটে চলেছে


পলাশমিতার অদ্ভুত দুর্ব্যবহারের দিন বাসায় ফিরে প্রতিদিনের মতো সঙ্গে সঙ্গে স্নানে যেতে পারল না নিঝুম। সারাক্ষণ মনটা কাঁদছিল আর পুড়ছিল। মনে মনে সবার সঙ্গে তর্ক করছিল। যেসব তর্ক কোনো দিন ব্যক্ত হবে না।
অবশেষে নিজের ওপর জোর খাটিয়ে স্নানে যখন গেল, তখন সন্ধ্যা পার। রাত চলে এসেছে। সুতরাং স্নানের পর এক কাপ চা নিয়ে বারান্দায় এসে বসতে অনেক দেরি হয়ে গেল।
বাড়িতে ওর সাথে থাকে আরও তিনটি প্রাণী। সদ্য চোখ ফোটা দুটো বাচ্চাসহ পোষা বিড়ালি
ক্যামেলিয়া
সেদিন চায়ের আসরে ক্যামেলিয়া এলো না। কারণ, রুটিনমাফিক চলার তার অভ্যাস। নিঝুম যখন থম ধরে নিজের ঘরে বসে আছে ছানাদের নিয়ে ক্যামেলিয়া তখনই বারান্দাপর্ব সেরে এসেছে।
দূরের শহুরে আলো দেখতে দেখতে চা শেষ করে সেদিন নিঝুমের খেতে দেরি হয়ে গেল। এবং রাতে ঘুম এলো না। সেই এক পলাশমিতা ছেড়ে মন কোথায় চলে গেছে। দূর কৈশোরে, প্রথম যৌবনে। কত বন্ধুর কথায় মুখ ম্লান করে ফিরে এসেছে। প্রেমেও পড়েছিল। পালিয়ে বেঁচেছে।
কত বন্ধু নিজেকে আড়াল করে নিয়েছে। জীবন-নদী সাঁতরে ওপারে চলে গেছেন বাবা। তারপর মা। বাবার শরীর থেকে জল শুকিয়ে গেছে। মায়ের শাড়ি থেকে এখনো টপটপ ঝরছে জল।
এই সব কথা মনে পড়ছে।
এ ধরনের রাতে না চাইলেও ঘুমের জন্যে শেষমেশ তাকে একটা রিভোট্রিল খেতে হয়। এবারও তাই হলো

যখন ঘুম ভাঙল, মাথা আশ্চর্য হালকা। রোদ এসে পড়ছে চোখের ওপর। বিছানা কোথায়। তার পিঠের নিচে ঠাণ্ডা কালো মাটি। নিঝুম উঠে বসল। দূরে ভোর হচ্ছে। সূর্যের দিকে ফিরে কে যেন দাঁড়িয়ে আছে।
পাখির শব্দ পাচ্ছিল। এত পাখির ডাক! একসঙ্গে আর কখনো শোনেনি নিঝুম। পেছনে তাকিয়ে অবাক হয়ে গেল। একটা সবুজ অন্ধকার বনের কিনার। বন এলো কোথা থেকে? নরম মাটি থেকে মাথা তুলে আছে গাছের শ্বাসমূল।
বাতাসে থিনারের মৃদু রাসায়নিক ঘ্রাণ। এত মৃদু যে প্রায় পাওয়াই যায় না। জলের শব্দ আসছে। সেই শব্দেই বোধ হয়, হঠাৎ তৃষ্ণা টের পেল নিঝুম। জিভ শুকিয়ে আছে, কিন্তু জল পানের তাড়া নেই। জলের যখন জলতেষ্টা পায় তখন তার যেমন লাগে, নিঝুমের বুঝি তেমন লাগছে।
কিন্তু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটা কে?
লোকটা পেছন ফিরে তাকাল। হাত নাড়ল তাকে দেখে। চিৎকার করে বলল,
উঠেছ বর্কিম্ময়?
সেই মুহূর্তে দ্বিতীয়বারের মতো ঘুম ভেঙে চোখ মেলে তাকাল নিঝুম। দিব্বি নিজের বিছানায়। ছাদে পাখা ঘুরছে। ঘরময় পাখার চাপা শব্দ চরকি পাক খাচ্ছে। মশারির বাইরে আঁধার ভেতরে আঁধার।
বিছানা থেকে নেমে পানি খেল নিঝুম। ঘড়িতে দেখল রাত চারটার কাছাকাছি বাজে। বোধ হয় দুঘণ্টা হয়েছিল ঘুম।
বাকি রাত আর ঘুম এলো না।
পরের রাতেও একই ঘটনা। তবে সে রাতে দৃশ্যটা আরও একটু দূর গড়াল

ছেলেটা হেঁটে আসছে নিঝুমের দিকে। বর্কিম্ময়, তুমি এসেছ!
কোমল পুরুষ কণ্ঠ। গান করে ছেলেটা? নিঝুমের শরীরে একটা সুতির নীল শাড়ি। বুকের ওপর আঁচল তুলে দিল। ছেলেটা আবার ডেকে উঠল, বর্কিম্ময়!
নিঝুম বলল, কে আপনি?
সেকি! আমি অঞ্জন।
ছেলেটার চোখে একটা বিষাদের ছায়া। এই মুখ কোথায় দেখেছে? বাতাসে থিনারের রাসায়নিক গন্ধ।
মানুষটাকে হঠাৎ চিনতে পারল নিঝুম।
কিন্তু ততক্ষণে নিজ বিছানায় দ্বিতীয়বার ঘুম থেকে জেগে উঠেছে

এটা স্বপ্ন নয়। নিঝুম তার শারীরবিদ্যা দিয়ে হয়তো প্রমাণ করতে পারবে না। কিন্তু অনুভব দিয়ে জানে।
পরদিন হাসপাতালে গিয়ে দেয়ালের ছবিটার সামনে দাঁড়াল। প্রথম দিন যে মুখ দেখে বুকে হাহাকার জেগেছিল, আজ তা দেখে কেমন গায়ে কাঁটা দিল। একটা অপ্রিয় আতঙ্ক। কোনো সন্দেহ নেই। এই ছেলেটাই।
নিঝুমেরও কি মায়ের মতো হচ্ছে?
চোখে চাপা ভয় নিয়ে সে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকল। কাঁধের ওপর দিয়ে দূরে সূর্যোদয়ের দিকে তাকিয়ে আছে অঞ্জন।

সেকি, আমি অঞ্জন! কানে বাজছে কথাটা। বলার পর তার চোখে যে কষ্টের ছায়াটা পড়েছিল, এখানে তা নেই। বাহ্, পেছনে সেই সবুজ বন। গভীরে অন্ধকার। ওই বনের কিনারেই তো ঠাণ্ডা মাটির ওপর পিঠ পেতে নিঝুম শুয়ে থাকে।
ছবির সমস্ত কোণ খুঁজেও এবারও ছবি বা শিল্পী কারও নাম পাওয়া গেল না। কেউ যেন এঁকে স্বেচ্ছায় দান করে দিয়েছে।
নিঝুম কি ডাক্তার দেখাবে? সাইকিয়াট্রির প্রিয় শিক্ষক আছেন একজন, মেখলা সরকার। নিঝুম কি যাবে তাঁর কাছে? নাকি আজ রাতে দুটো রিভোট্রিল খেয়ে দেখবে কী হয়।
তাই করল। তবু ঘুম হলো ছাড়া ছাড়া। সারা রাত মনে হলো কেউ খুব চেষ্টা করছে তাকে ছবির সেই জগতে জাগিয়ে তুলতে। পারছে না।
খিটখিটে মন নিয়ে বিছানা ছাড়ল নিঝুম। এবং হাসপাতালে ভয়ঙ্কর এক ঘটনা ঘটাল। হাসপাতালে ডাক্তারদের লিফটে পলাশমিতার সঙ্গে দেখা। মহিলা তাকে দেখলেই রূঢ় স্বরে কিছু না কিছু বলেন। আজও কিছু একটা বললেন গতকালের কোনো ব্যাপার নিয়ে। নিঝুম ঠিকমতো শোনেওনি কিন্তু ঝটিতে ঘুরে তাকাল। পলাশমিতার চোখের ওপর চোখ রেখে বলল,
চোখ তুলে ফেলব খবরদার!
লিফট থেকে যখন বের হয়েছে, কারও মুখে টুঁ শব্দ নেই। খবর পেয়েছে পলাশমিতা তার রুমে বসে কাঁদছে আর কারা যেন সান্ত্বনা দিচ্ছে। তাকে কেউ কিছু বলেনি। শুধু শারমিন মিস তাকে দেখে তাকিয়ে ছিলেন। কী যেন বলবেন ভেবেও বলেননি।
বাসায় ফিরে ক্যামেলিয়ার ওপর খেপল নিঝুম। অল্প সময়ের ব্যবধানে দ্বিতীয়বার খেতে চাইলে ধমকে উঠল তাকে। ধমক শুনে বাচ্চা দুটো দ্রুত শোকেসের আড়ালে লুকিয়ে গেল। আর সেই দৃশ্য দেখে গোটা দিনের জন্য নিঝুমের মন কেঁদে উঠল। কী করছে ও? এমন মানুষ তো ও হতে চায়নি?
খাবার দিল ক্যামেলিয়াকে। ক্যামেলিয়া যেন অবিকল মানুষের মতো মনে উষ্মা নিয়ে তাকে ক্ষমা করেছে।
কয়েকবার ফোন হাতে নিয়ে রেখে দিল। ক্ষমা চেয়ে পলাশমিতাকে কল দিলে এখন তার অন্য অর্থ করা হবে। দরকার নেই।
হ্যাঁ, স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, তার একটা অংশ চাইছে সেই জগতে জেগে উঠতে। ছেলেটির আকর্ষণ প্রবল। দৈহিক নয়, আত্মিক আকর্ষণ। যৌন আকর্ষণ নয়। স্বয়ং যৌনতা পৃথিবীর সঙ্গে যে আকর্ষণে যুক্ত এ যেন সেই আকর্ষণ।
পরদিন নিঝুম গেল না হাসপাতালে। ছাদে অনেকটা সময় কাটাল। কত দিন ছাদে আসে না। পাটি পেতে আকাশের দিতে তাকিয়ে মেঘের আসা যাওয়া দেখল। সন্ধ্যা নামতেই উঠে আসতে হলো। মশার কামড়ে থাকা মুশকিল।
সেই রাতে অনেক আগ্রহ নিয়ে শুতে গেল রিভোট্রিল ছাড়া। কিন্তু সেই জগৎ তাকে ডাকল না। সকালে ঘুম ভাঙল বিছানার ওপর, যেমন ভাঙত। এমন কেন হলো?
পরদিনও একই ব্যাপার। নিঝুমের বুক হু হু করে উঠল। স্বপ্নে জাগবে না আর?
সেই পাতলা রাসায়নিকের গন্ধটা দিনভর স্মরণ করে চলল। সমস্ত মনপ্রাণ এক করে পেতে চাইল। পেল না।
পরদিন শুক্রবার। হাসপাতাল বন্ধ। দিনটা যথাসম্ভব আনন্দে কাটাল নিঝুম। হালকা বইপত্র পড়ল। বিড়ালদের নিয়ে ছাদে গেল। গল্প করল প্রতিবেশীদের সঙ্গে। গান শুনে কাটাল অনেকটা সময়।
মোবাইল টেলিফোনে সেই ছবিটার একটা ফটোগ্রাফ তুলেছিল নিঝুম। অ্যালবামে গিয়ে সেই ছবিটা বের করে দেখল কিছুক্ষণ।
অপেক্ষার অবসান ঘটল সেই রাতে

বনের কিনার। পরনে সুতির নীল শাড়ি। অঞ্জন এগিয়ে আসছে তার দিকে। পেছনে ক্রমশ জেগে উঠছে সূর্য। অঞ্জনের দেহরেখাকে আলো করে রেখেছে। বাতাসে সেই থিনারের গন্ধ, মৃদু। গন্ধটা এখন আর কটু লাগছে না।
অঞ্জন কাছে এলে আজ নিঝুম হাত বাড়িয়ে দিল। নিঝুমের হাতটা মুঠোয় নিল ছেলেটা। উজ্জ্বল হেসে বলল,
বর্কিম্ময়?
অঞ্জন দুঃখ পেয়ো না। আমি বর্কিম্ময় নই।
অঞ্জনকে বিভ্রান্ত দেখাল। বর্কিম্ময় নও? কোথায় বর্কিম্ময়?
তা তো বলতে পারি না। তুমি তাকে কীভাবে চেনো?
অঞ্জন হাসল। শিশুর মতো নিরঞ্জন হাসি। বোধ হয় এর উত্তর ওর নিজেরও জানা নেই। বলল, তুমি কে?
আমি নিঝুম।
নিঝুম, উচ্চারণ করল অঞ্জন। কী সুন্দর নাম।
তোমার নামটাও ভীষণ সুন্দর অঞ্জন। কে রেখেছে এই নাম?
অঞ্জন বিভ্রান্ত স্বরে বলল, বোধ হয় বর্কিম্ময়।
বর্কিম্ময় তোমার মা?
আবারও সেই হাসি। বলতে পারব না। হতে পারে। আবার—’
আবার?
বর্কিম্ময়ের প্রসঙ্গে মানুষটার কোথাও কষ্ট হচ্ছে। নিঝুমের মনে হলো তাকে এ নিয়ে প্রশ্ন করে আর্ত না করাই ভালো হবে।
অঞ্জন, আমার ভীষণ তৃষ্ণা পেয়েছে। আমাকে পানি খাওয়াতে পারো?
পানি? অঞ্জন ঘুরে পূর্ব দিকে তাকাল। সেখানে দক্ষিণ থেকে উত্তরে বয়ে যাচ্ছে পানি। অঞ্জন সেদিকে হাঁটতে শুরু করল। কোনো ধারণা নেই কীভাবে নিঝুমকে পানি দেবে। তবু যাচ্ছে। হয়তো ওখানে পৌঁছে আবার বিভ্রান্ত হয়ে পড়বে।
অঞ্জনের প্রতি একবুক মমতা নিয়ে নিঝুম বিছানায় জেগে উঠল। মশারির বাইরে যথারীতি রাত।
আর ঘুমোল না। চোখেমুখে পানি ছিটিয়ে রান্নাঘরে গিয়ে আটার টিন বের করল। অনেক দিন দোকান থেকে কিনে আনা পাউরুটির ওপর চলছে। আজ রুটি হোক। পরোটাও হতে পারে। পরোটার টুকরো পছন্দ করে ক্যামেলিয়া


হাঁটতে হাঁটতে ওরা সোহরাওয়ার্দীর বিরাট পামগাছগুলোর কাছে চলে এসেছে। পেছনে সূর্যের আলো চমকাচ্ছে অগভীর পানির ওপর। তার ওপারে মার্চের ঐতিহাসিক মঞ্চ
নিঝুমের কথা শেষ হয়েছে। তেজস গাছে হেলান দিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। বর্কিম্ময়। নামটা শুনিনি কখনো। তবে একটা ভরসার কথা কি জানেন? যে ছবি দেখলাম আপনার মোবাইলে। অত্যন্ত দক্ষ হাতের সুচারু ছবি। এই সুচারুতা এক দিনে আসে না। এবং এই চারুতা চেপে রাখা যায় না। মানে কি বুঝলেন? আমার বিশ্বাস, এ যুগের আমি না চিনলেও কেউ না কেউ এ ছবি ঠিক চিনবে। আমার শিক্ষকদেরই কেউ চিনবেন আশা করি। চেনা উচিত। আর বর্কিম্ময়। আমারও সন্দেহ ছবিটা ওনারই আঁকা। একটা ব্যাপার কি জানেন। জনসংখ্যার রেসপেক্টে আর্টিস্ট কমিউনিটিটা বরাবরই খুব ছোট। সুতরাং বর্কিম্ময় যদি কোনো বাস্তব চরিত্র হয়ে থাকেন, এ ছবির শিল্পী হয়ে থাকেন, তাঁকে পাওয়া যাবেই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস। ঈশ্বর সহায়।
নিঝুম হেসে সায় জানাল।
তেজস বলল,
ভালো কথা, ছবিটা আমাকে মেসেঞ্জারে পাঠাবেন একটু কষ্ট করে? ওহ, না, ম্যাসেঞ্জার না। জিমেইলে পাঠাবেন প্লিজ। কারণ, কোয়ালিটি ভালো থাকা চাই।
খানিক বাদে ওরা আরও খানিক পূর্ব দিকে হেঁটে পোলো গ্রাউন্ডের কাছে এলো। এখান থেকে সুপ্রিম কোর্টের ভবনটা প্রাসাদের মতো দেখায়। তেজস বলল, ঈশ্বর, মাথা থেকে তাড়াতেই পারছি না। বর্কিম্ময়-অঞ্জন অঞ্জন-বর্কিম্ময়। কী শুনলাম!
একটু পরপর ঈশ্বরনাম উঠতে থাকল। নিঝুম হাসছে।
তেজস বলল,
আচ্ছা, আপনি তো চিকিৎসক মানুষ। সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে না গিয়ে আপনি আমাকে খুঁজে বের করলেন কেন নিঝুম?
আমি জানি না। হয়তো স্বার্থ। কারণ, সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে তো ছবির খোঁজ নেই। যেটা শিল্পীর কাছে আছে। আমার তো এ ছবির পরিচয়টা দরকার।
ভালো বলেছেন।
আরেকটা ব্যাপার, তা হলো, আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এটা সাইকিয়াট্রির ইস্যু নয়। কিন্তু তাঁদের কাউকে আমি সেটা বিশ্বাস করাতে পারব না। যেটা একজন শিল্পীকে পারব। অবশ্য সব শিল্পীকে পারব না।
আমি যদি সেই দলের কেউ হতাম?
কষ্ট পেতাম, নিঝুম হাসল। এমন কষ্ট কত পেলাম!

রাতে ফেসবুকে চিত্রশিল্পীদের দুটো গ্রুপে তেজস ছবিটা আপলোড করল। জানতে চাইল এই ছবির শিল্পী কে কেউ জানে কি না। পাশাপাশি, বর্কিম্ময় নামে কাউকে শিল্পীরা চেনেন কি না।
দুই ঘণ্টা পর তার সরাসরি শিক্ষক চন্দন হাসানের ফোন এলো। চন্দন বললেন, তেজস, পোস্টটা মোছো, ঈশ্বরের দোহাই!
কেন স্যার?
আমি তোমার শিক্ষক। আমি তোমাকে বলছি মোছো। তাই।
স্যার, তেজসের কণ্ঠ শীতল। ঈশ্বরের দোহাই এ ছবি আর বর্কিম্ময়ের ব্যাপারে তথ্য আমার খুব বেশি দরকার। জীবন মরণের প্রশ্ন।
চন্দন বললেন, জীবন মরণের প্রশ্ন না হলেই বরং অবাক হতাম। তেজস। কথা শোনো পোস্টটা মোছো। তারপর আমার বাসায় এসো তুমি কাল সন্ধ্যায়। সব বলছি।
স্যার, কাল সন্ধ্যা না। আমি এখনই আসতে চাই।
পারবে? বেশ, চলে এসো। তার আগে কাজটা করো। তুমি জানো আমি কী বোঝাচ্ছি।

সেই রাতের কথা।
ঘটনা আরও খানিক এগিয়েছে আজ। অঞ্জন নদীর দিকে রওনা হয়েছে। পেছন পেছন চলেছে নিঝুম।
নদীর কাছে পৌঁছে অঞ্জন আঁজলা পেতে পানি নিল। ঠোঁট ছুঁইয়ে বলল,
ওমা, এত লবণপানি!
এ সম্ভাবনার কথা নিঝুমের মনেই আসেনি। গাছের গোড়ায় গোড়ায় যে শ্বাসমূল দেখেছে, তখনই বোঝা উচিত ছিল।
তাহলে মিষ্টি পানি কোথায় থাকতে পারে? বলল নিঝুম। বনের ভেতরটা ক্রমশ পাহাড়ি হয়ে উঠেছে। ওখানে একটা কোনো উৎস থাকা অসম্ভব না।
অঞ্জন বলল,
সেটা আমি ঠিক বের করে ফেলব। নিঝুম দেখো! সূর্যটা কিভাবে উঠে যাচ্ছে!
ওঠা আর নামার মুহূর্তটায় আঁচ করা যায় পৃথিবী যে কতখানি দ্রুতবেগে ঘুরছে। নিঝুম অনেক দিন সূর্যের এ দৃশ্য দেখেনি।
ঠিক আছে নিঝুম, আমি ভেতরে যাচ্ছি বনের। তুমি এখানে অপেক্ষা করো।
মাথা খারাপ তোমার! আমিও আসব সঙ্গে।
আচ্ছা, এসো।

দুজন বনের ভেতর গেল। শ্বাসমূল এড়িয়ে হাঁটাচলা কষ্টকর। কিছুক্ষণের ভেতরই ওরা বন্য প্রাণীর পায়ে চলা পথ আবিষ্কার করে ফেলল। নিঝুম বলল, এই পথটা বোধ হয় পানির দিকে যেতে পারে। চলো যাই।
চড়াই-উতরাই শুরু হয়েছে। বনের পাখিরা যেন তাদের সঙ্গে সঙ্গে উড়ছে। আর পশুরা দূরত্ব রেখে সরে সরে যাচ্ছে। একটু পর ঝরনার শব্দ শোনা গেল।
অবশেষে পাহাড়ের একটা বাঁক পার হতেই ঝরনার শব্দ সবল হয়ে উঠল। সেই শব্দ অনুমান করে এগিয়ে ওরা পেয়ে গেল অদ্ভুত এক ঝরনা।
দুধের ধারার মতো সাদা জল শব্দে আছড়ে পড়ছে। জলের ওপর নয়। পাথরের ওপর। বিরাট সেই পাথর একটা হেলানো বেদির মতো হয়ে আছে। বেদিতে পানি গড়িয়ে গড়িয়ে জমছে দূরের সরোবরে। চারপাশে ঘন সবুজ।
নিঝুম এ ঝরনা চেনে। এ যেন অবিকল রিসাং!
ঝরনার ধরার সামনে কিছুদূর যাওয়া যায়। অঞ্জন সাবধানে পা ফেলে এগোল। পানির ভারী ধারা ঝরছে। অঞ্জন আঁজলায় নিয়ে ঠোঁটে ছুঁইয়ে বলল,
স্বাদ খারাপ না। তবে একটু তিতকুটে! খেতে পারবে?
হুঁ।
আঁজলা থেকে আঁজলায় পানি জমা হলো। নিঝুম চুমুক দিয়ে খেল সবটা। এরপর নিজেই নিল আঁজলা ভরে। একবার, দুবার।
তৃতীয়বার পানি নিয়ে বলল,
হাত পাতো অঞ্জন।
অঞ্জন পানি খেতে খেতে বলল, এত তৃষ্ণা পেয়েছে, বুঝতেই পারিনি কী আশ্চর্য!
নিঝুম অঞ্জনের হাত ধরে সাবধানী পায়ে এসে দাঁড়াল ঝরনার নিচে। কী ঠাণ্ডা পানি!
মানুষের জলের তৃষ্ণা শুধু পানে না। জল দেখায় জল শোনায় ও জলস্নানে। সেই তৃষ্ণা যখন সঙ্গতৃষ্ণার সাথে মেটে, তা যেন জীবনের নতুন সূচনার ইঙ্গিত।
এত উচ্ছ্বাস লুকিয়ে ছিল নিঝুমের ভেতর! জানা ছিল না। চোখ লাল হয়ে উঠেছে তবু ঝরনার নিচ থেকে তাকে বের করা যাচ্ছে না।
অঞ্জন হাসছে। সে যে এমন হাসতে পারে, সেটা আগেই বোঝা গিয়েছিল


নিঝুম আশকার ফিরদৌস আপনার কী হন।
নিঝুম আশকার ফিরদৌস আমার বন্ধু।
এখানে নিরাপত্তা ইস্যু জড়িত বুঝতেই পারছেন। ওনার ঠিকানা ওনার একান্ত ব্যক্তিগত এটা তো স্বীকার করবেন।
কিন্তু একটা কথা বলুন, তেজস মরিয়া হয়ে উঠল। আমার ধারণা, তিনি বেশ কদিন আসেন না হাসপাতালে। ঠিক?
আমি চেক করে দেখছি।
মেয়েটা একটু সময় নিল। হ্যাঁ, এক দুই তিন... শেষ সাত দিনের এন্ট্রি নেই।
ইউ সি? মেয়েটা কুপোকাত হয়েছে মনে হলো। তেজস বলল, তিনি আপনাদের মূল্যবান রেসিডেন্ট ডক্টর। এটা আপনাদেরও দায়িত্বের মধ্যে পড়ে দেখো যে তার কোনো বিপদ হলো কি না।
আপনি দাঁড়ান। আমি কথা বলছি। আপনার নামটা আবার একটু বলবেন, প্লিজ?
তেজস হালদার।
নিঝুমের ফ্ল্যাটের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে তেজস। তেজসকে বিশেষ বিবেচনায় ঠিকানা দেওয়া হয়েছে। দীর্ঘ সময় নিয়মবহির্ভূতভাবে অনুপস্থিত থাকায় নিঝুমের নামে হাসপাতাল থেকে কারণ দর্শাও চিঠি ইস্যু হচ্ছে।
ওর মেসেঞ্জারে সাড়া নেই আজ তৃতীয় দিন। ফোন নম্বরে ফোনও আর ঢুকছে না। কোথায় বন্ধ হয়ে আছে কে জানে। তেজস বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ঘামতে থাকল। দারোয়ান বলেছে পরশু নিঝুমকে শেষ দেখেছে ফিরে আসতে। তারপর আর বের হতে দেখেনি।
ঘরের দরজার নিচ দিয়ে আলো আসছে। এতক্ষণ বেল চাপলে বেলে আগুন ধরে যেতে পারে। তেজস দরজায় চাপড় দিতে থাকল।
নিঝুম, নিঝুম, খোলো! বর্কিম্ময়ের খবর জেনেছি নিঝুম! সাড়া নেই। নিঝুম, অবাক হয়ে যাবে, দরজা খোলো!
সাড়া না পেয়ে নিচে গিয়ে দারোয়ানকে ডেকে আনল তেজস। এ ছাড়া আর কোনো উপায় নেই।
দারোয়ান ছুতার ডেকে এনেছে। দরজা ভাঙা হচ্ছে। থরথর করে কাঁপতে থাকা দরজা একসময় এলিয়ে পড়ল।
নিঝুমের ঘরে। বিছানায় লেপ্টে আছে হাজারও রং। যেন কেউ রঙিন ছবি এঁকেছিল। হঠাৎ জলের ঝাপটায় তা একাকার হয়ে বিছানাময় ছড়িয়ে গেছে।
তেজস ঘরময় খুঁজে বেড়াল তাকে।
নিঝুম, নিঝুম! রান্নাঘরে হুটোপুটির শব্দ পেয়ে উঁকি দিয়ে দেখল একটা ধূসর বিড়ালি তার দুই সন্তানকে (একটা ধূসর, একটা সাদা) আড়াল করে দরজার দিকে মুখ করে আছে। তেজস এগোতেই শ্বদন্ত দেখিয়ে দিল।  
তুমি ক্যামেলিয়া! নিঝুম কোথায়?
ক্যামেলিয়া কোনো কারণে হিংস্র হয়ে আছে। তেজস পিছিয়ে এলো। এঘর-ওঘর বারান্দা কোথাও নিঝুম নেই।
আবার বিছানার কাছে এসে দাঁড়াল তেজস। রং লেপ্টে আছে বিছানাময়। কিছু মেঝেতে ছিটকে পড়েছে। কোথা থেকে এলো এত রং? নিঝুম তো ছবি আঁকে না। নাকি গোপনে আঁকত!
গোটা ঘর খুঁজে কোথাও কোনো ব্যবহৃত রঙের কৌটা পাওয়া গেল না। ক্যানভাস তুলি কিচ্ছু নেই। একটা স্কেচবুক পাওয়া গেল। পত্রিকা দেখে কিছু স্কেচ করা পোর্ট্রেট। কিছু হাড়গোড়ের ছবি। দুটা ডায়রি।
দারোয়ান ছাদ ঘুরে এসেছে। কোথাও নিঝুম নেই।
দুদিনের সিসিটিভি ফুটেজ দেখা হলো। নিঝুম দুদিন আগে ফেরার পর আর কোথাও বের হয়নি। যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে


বর্কিম্ময়ের সামনে ডালিভরা সফেদা।
পাকা সফেদার ঘ্রাণে ম-ম করছে চৈতালী দুপুর। রোদের আঁচ আর বাতাসের বেগ পাল্লা দিয়ে চলেছে। ঘরের ভেতরে থেকেও তাদের দ্বৈরথ টের পাওয়া যায়।
বর্কিম্ময়ের খোলা জানালার বাইরে বহমং পাহাড়। চূড়ায় লেগে ভেঙে ছড়িয়ে যাচ্ছে ফুটফুটে সাদা মেঘ।
বর্কিম্ময় তার সদ্য শেষ করা ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। রিসাং ঝর্নায় স্নান করছে দুটি ছেলেমেয়ে। তার চোখে ছেলেমেয়ে হলেও আসলে ওরা পরিপূর্ণ নরনারী