দম্পতি
এক
ভালোবাসা এতটাই তীব্র তাদের, অনিক ভাবছিল—যদি ঈশ্বর থাকেন তবে তার কাছে কেবল একটা বরই চাইবে সে। মৃত্যু পর্যন্ত যেন লুনার সঙ্গে থাকতে পারে। আর তাদের যেন অনন্ত যৌবনা করে রাখে। একদিনের জন্যও হারাতে চায় না সঙ্গম শিহরণ। লুনা জানে, অনিক তাকে অনিকের চেয়েও বেশি ভালোবাসে। তাদের যৌথ জীবন সিনেমার মত। দ্বন্দ্বসংঘাতঈর্ষাঝগড়া এসব এন্টিক বস্তুতে পরিণত হয়ে ড্রয়িং রুমের একুরিয়ামে ভাসে আর মাঝে মাঝে গোল্ডফিশের খাদ্য হয়। অনিকও মাঝে মাঝে ভাবে এই অবিশ্বাস্য অতি যুগল যাপন কী করে চলছে তাদের! লুনার কাছেও অতি ঐশ্বরিক মনে হয় না এই জীবন। এটাইতো চেয়েছিল তারা। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখি দম্পতি হয়ে থাকবে। মূলত জীবনবোধ মননঅধ্যয়নের সঙ্গে অর্থনৈতিক প্রবাহটি বহু আগে থেকেই পরিকল্পিত।
থিসিসএন্টিথিসিনথিসিস আর বিশেষজ্ঞ দ্বারা বহুবার পরীক্ষিত একটা নিরবিচ্ছিন্ন প্রবাহ ধরে রেখেছে তাদের দেড় দশকের যৌথ জীবন। একটাই অভাব। এই অভাবের জন্য অবশ্য এক মুহূর্তও তাদের ভেতর কোনো প্রশ্ন নেই। ক্ষোভ নেই। আসলে এই বিষয়টায় তারা দুজনেই নির্বিকার। কারণ তারাও চায়নি নতুন কোনো প্রাণ। এ এক আশ্চর্য চাওয়া। প্রথমে অনিক বলেছিল, সঙ্গে সঙ্গেই লুনা সশব্দে হেসে বলেছিল, আমার মনের কথাটা কিভাবে জানলে?
ধরিত্রীতে নতুন প্রাণ আনার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কোনো সংশয় নেই—বিষয়টা এমত নয়। এই যে বিচিত্রবঙ্গে কদর্য যাপন—প্রত্যহ মানবের চূড়ান্ত অবনমন... অর্ধশতকেও সভ্যতার ধারে কাছে নেই। চকচকে জীবন ব্যস্ততায় অনুকরণ প্রিয়তা শাখামৃগকেও হার মানায়—এই যে মানুষের অপমান—মৌল মানুষ থেকে দূরে হাস্যকর কতক মিথ্যা দম্ভের নানারূপ কৃৎকৌশল আর প্রত্যহ জঘন্যতর প্রতারাণার জীবন।
এই যে অপানুসঙ্গের মহোৎসব কথিত শিক্ষার নির্লজ্জতার চরম অভিলাষপ্রিয়তা...অসংখ্য কু দ্বারা শাসিত জনমের প্রায়শ্চিত্ত সেটা কেনো এক নতুন প্রাণ করতে যাবে? তাকে কেন এইসব অমানুষদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামতে হবে। তার জন্য কী রেখে যাচ্ছে তারা যারা নবপ্রাণ সৃষ্টি করছে দূষিত নর্দমার এই বিচিত্রবঙ্গে। ফলে তারা নিজেরা নিজেদেরকে নিয়ে যেভাবেই বাঁচুক নতুন মানব সৃষ্ট প্রকল্পে নতুন প্রাণকে কষ্ট দিতে নারাজ। এরপর আর এই বিষয়ে তাদের কোনো কথা হয়নি। মানুষের কল্পিত স্বর্গের জীবন যাপন করছে এই ধরিত্রীতে তারা। তাদের অনেকগুলো যাপন কৌশলের একটি দুজন দুজনকে ছাড়া গোটা দুনিয়া নিয়ে নির্বিকার। অন্যসব বিষয়ে স্টয়িকবাদের মত প্রবল উদাসীন। অথচ দুজন দুজনকে প্রচণ্ড ভালোবাসে। টেক কেয়ার করে।
দুই
মধ্যাহ্ন আহারের পর লুনা শুয়েছিল শয়নকক্ষে এলোমেলো চুল ছড়িয়ে আয়েসে। অনিক বারান্দায় বসে সিগারেট টানছিল। দুপুরের রাস্তা সুনশাান। বারান্দার নিচেই ঝকঝকে রাস্তা। রাস্তাটিা নির্জন দুপুরের মত। দুপুরটা প্রথম বৈশাখের। করোনাকাল। অনিক বোঝে এই অতিমারিটা আসলে পুঁজি রাজনীতির নয়া কৌশল। পৃথিবীর সব মধ্যবিত্ত মানুষের জন্য জন্য একটা ভয় দেখানোর খেলা। আহা মূঢ় মানুষ বোঝে না তার সর্বস্ব কেড়ে নেয়ার, তাকে থামিয়ে দেয়ার, তাকে কোনোভাবেই উচ্চতর কাতারে যেতে না দেয়ার রাজনীতি এই করোনা। কারণ হঠাৎ বিশ্বজুড়ে বিত্ত তৈরির পদ্ধতি অতি সহজতর হয়ে গেছে। ফলে বিত্তবানের সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ভরে যাচ্ছে সুইস ব্যাংকের ভল্ট। বিচিত্রবঙ্গের ফড়ে ব্যবসায়ী উঠে যাচ্ছে বিল গেটসদের কাতারে। সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের জায়গায় যেহেতু এই ধনবান হওয়া বিচার্য নয় সেহেতু একই প্লেনের যাত্রী রূপে সালমানকে আর আম্বানির সহ্য হচ্ছে না। সহ্য হচ্ছে না জ্যাক মায়কে ট্রাম্পের। ফলে ব্যবধান দ্রুত বাড়াতে শেষ কিছু চেষ্টা করতেই হয়। এইরকম মরণ কামড়ের ইতিহাস পুঁজিবাদের আছে। ফলে তাকে প্রযুক্তির কারণে চোখ বুঝে বিশ্বাস করার কিছু নাই। এই রকম একটা বোধ থেকে করোনা সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে অনিকের অনান্থা। কোনো কিছু প্রশ্ন ছাড়া যেতে দিবে না সে। লুনাও একমত। হতে পারে ভাইরাস। এটি মানবসৃষ্টও হতে পারে। কিন্তু এটা একটা বড় চালবাজি চালাকি হয়েছে মানুষের সঙ্গে। আর এই চালাকিটা পুঁজিবাদেরই খেলা। নচেৎ টিকতে পারছে না। কনজুমার সোসাইটি ভেঙে পড়ছে নতুন নতুন সব অনুসঙ্গে। এই ভাঙ্গার হাত থেকে রক্ষা পেতে দুনিয়াজুড়ে এক যোগে মানুষকে দমিয়ে দেয়া হলো। বড় সুযোগটা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী একই চরিত্রের সরকারসব দেশ চালাচ্ছে বলে এটি খুব সহজ হলো।
তিন
সিগারেট শেষ হয়ে এলো। সিগারেটে সুখটান দিয়ে পরিত্যক্ত ফিল্টার ঝুল বারান্দা দিয়ে টোকা মেরে ফেলে দিতে দিতে এক টুকরো আগুনসমেত ফিল্টারটি রাস্তায় পড়ছে তো পড়ছেই। তৃতীয়তলা পার হওয়ার সময় হঠাৎ অনিক দেখে তার সিগারেটটি লুনার দেহে রূপান্তরিত হয়ে নীল শাড়ি ভেসে ভেসে নিচে নেমে যাচ্ছে। কী এক বিভ্রমের দৃশ্য যেনো অনেকটা তারকোভস্কির ধীর গতির ফ্রেম ওয়ার্ক। লুনা দ্রুতই পড়ে গেল রাস্তায়। দৃশ্যহীনতার বড় ম্যাজিক্যাল দৃশ্য যেনোবা। অনিক দেখে লুনার মাথাটি রাস্তায় কঠিন আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মগজঘিলু বেরিয়ে ছিটকে গেলো চারিধার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দুপুরের এসফল্টপ্লান্টের কালো রাস্তা! ♦
গল্পে প্রবন্ধের গন্ধ বেশি পেয়েছি। তবে চিন্তাটা সমসাময়িক সময়ের প্রক্ষেপণ।
শাখাওয়াত বকুল
এপ্রিল ১৮, ২০২১ ১২:২২
অনেকদিন পর রোকন-এর গল্প পড়লাম। রোকন-এর "দম্পতি" গল্পটি শাদা-মাটাভাবে শুরু হলেও, গল্পটি পড়ে শেষ করা না পর্যন্ত বোঝা যাবে না এর রূঢ় বাস্তবতার দিকটি। গল্পের শেষে এসে রোকন আমাদের এমন এক দৃশ্য-কল্পের মুখোমুখি দাঁড় করান, তাতে রক্ত হিম হয়ে আসে: "সিগারেট শেষ হয়ে এলো। সিগারেটে সুখটান দিয়ে পরিত্যক্ত ফিল্টার ঝুল বারান্দা দিয়ে টোকা মেরে ফেলে দিতে দিতে এক টুকরো আগুনসমেত ফিল্টারটি রাস্তায় পড়ছে তো পড়ছেই। তৃতীয়তলা পার হওয়ার সময় হঠাৎ অনিক দেখে তার সিগারেটটি লুনার দেহে রূপান্তরিত হয়ে নীল শাড়ি ভেসে ভেসে নিচে নেমে যাচ্ছে। কী এক বিভ্রমের দৃশ্য যেনো অনেকটা তারকোভস্কির ধীর গতির ফ্রেম ওয়ার্ক। লুনা দ্রুতই পড়ে গেল রাস্তায়। দৃশ্যহীনতার বড় ম্যাজিক্যাল দৃশ্য যেনোবা। অনিক দেখে লুনার মাথাটি রাস্তায় কঠিন আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে মগজঘিলু বেরিয়ে ছিটকে গেলো চারিধার। রক্তে ভেসে যাচ্ছে দুপুরের এসফল্টপ্লান্টের কালো রাস্তা!" আশাকরি রোকন ভবিষ্যতে আমাদের আরো গল্প উপহার দেবেন।
Ahmed Nakib
মে ০৭, ২০২১ ১৭:০৭
অনেকদিন পর রোকন ভাইয়ের গল্প পড়ে ভালো লাগলো।
তিতাস অধিকারী ।
এপ্রিল ১৬, ২০২১ ২১:৪৫