প্যাঁচানো

 

চারপাশের আলো নিয়ে আমার কখনো সন্তুষ্টি আসে না। পানি বা বাতাস না, আমার মনে হয় যে আলোর অভাবে আমি মরে যেতে পারি।
এ কথা শুনে আপনার হাসি পাচ্ছে তো? অনেকেই হাসে। বলে এমন উদ্ভট কথা নাকি কেউ শোনেনি। অথচ আমার সারাদিন কাটে আলোর কাছে যাওয়ার চেষ্টায়। সূর্যের স্বাভাবিক আলো স্পর্শ করতে না পারলে যে ক্লিষ্টতার মুখোমুখি হই তা মানুষকে বোঝাতে চাওয়া যে মূর্খামি সেটা অন্তত আমি বুঝি।   
আমার বাসার মত আমার চাকরিও নিচতলায়, প্রায়ান্ধকার একটা ঘরে, যেখানে সবসময় দুইশ ওয়াটের লাইট জ্বলে। চারদিকে আকাশচুম্বি বাড়ি, নিচতলার ঐ অফিসঘর বেচারার কোনো উপায়ই নেই সূর্যের কণামাত্র আলো নিজের ভেতরে নিয়ে আসে। কাকভোরে উঠে ছুটতে ছুটতে আসি, আর ফেরার সময় সন্ধ্যার শহরে বিদ্যুতের বাতির সমুদ্র সাঁতার দিয়ে ঘরে ফিরি। কিন্তু তবু আমার আলোর প্রতি কাতরতা ঘোচে না। ঐ যে বললাম, আলোর অভাবে...।
অফিসের নির্বাহীরা বসেন সতের তলায়। সেখানে প্রতিদিন না হলেও দুয়েকদিন পরপর আমাদেরকে নিচতলা থেকে যেতে হয়। বস ডেকে পাঠান, মিটিং থাকে। লিফট থেকে বের হলেই পরিস্কার ইউনিফর্ম পরা সৈন্যদলের মত এক পশলা সূর্যের আলো স্যালুট দেয়। আমিও মনে মনে পাল্টা সালাম ঠুকে ঢুকে যাই সেই আলোকময় জগতে। সেখানে সব উর্ধ্বতনের ব্যস্ততা, টাইয়ের নিখুঁত নট, শাড়ি-শালোয়ার-কুর্তির মসৃণ সিল্ক, আঙুলের ছাঁটা নখে টাইপ করা সম্মোহিত করে রাখার মত নোটিশপত্র, বিজ্ঞাপন। আমার ইমিডিয়েট বসের গাঢ় লিপস্টিক, তার বসের আফটার শেইভের মৃদু ধেয়ে আসা ঘ্রাণ, তারও বসের ব্রান্ডেড ব্লেজার থেকে বেরুনো জেল্লায় ঝাপসা হয়ে আসে চোখ। 
এই ফ্লোরে সবাই ডায়েট প্ল্যান, সবাই ব্যায়াম, অথবা সাঁতার, সবাই পাঁচতারা হোটেলের পুলসাইড বার রেস্তোরাঁয় কফি, বিয়ার, ওয়াইন কিংবা স্কচ অন দ্য রকস। মাপা হাসি, পরিমিত কৌতুক আর শনৈ শনৈ কী এক অপরিসীমের দিকে যাওয়া আমার ভেতরেও পাম্প দেয়া সাইকেলের টায়ারের মত শক্ত উত্তেজনা তৈরি করে। কিন্তু এখনো এই আলোময় ফ্লোরের একজন না বলে মন খারাপ নামের একটা পাউডারের স্তর সারা গায়ে লেগে থাকে। তবে হাল ছাড়িনি। একবার না পারিলে দেখ কতবার যেন? 
সেদিন বাইরে মেঘের পরে মেঘ জমে আঁধার করে এসেছে। সহকর্মীরা কোথায় ভালো খিচুড়ি দিয়ে লাঞ্চ করা যায় তার আলোচনায় মত্ত। সবার মধ্যে একটা ঢিলেঢালা ভাব। এমন নিকষ কালো দিনে আমার কারো সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে না। 
আমি মাত্র শেষকরা প্রজেক্ট প্ল্যানের প্রিন্ট আউট নিয়ে ফাইলটা গুছিয়েছি। উপরের ফ্লোরে যাবো, তখন হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। বিদ্যুৎ ফিরে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করা যায়, কিন্তু জানি যে সতেরতলায় জেনারেটর  চালু করে দেয়া হয়েছে। আর দিনের বেলা সেখানে অন্ধকার থাকার প্রশ্ন আসে না। আমার বস এই ড্রাফট প্রজেক্ট প্ল্যানের জন্য অপেক্ষা করছেন। 
বিদ্যুৎ নেই বলে লিফট চলছে না। আমি সতর্ক হয়ে ফাইলটা নিয়ে বেরিয়ে আসি। লিফট চলছে না তো কি হয়েছে? সিঁড়ি আছে। সিঁড়ি বেয়ে সতেরতলা ওঠা কোন বিষয়? অফিসের কেউ জানে না যে গোপনে আমিও ডন বৈঠক, আমিও চামচে মার্বেল রেখে দৌড় প্রতিযোগিতায় প্রথম স্থানের অধিকারী।  
ওপরে ওঠার সিঁড়ি পেছনের দিকে, দরজার ওপরে লাল অক্ষরে ছোট্ট সাইনের পাশে তীরচিহ্ন—সিঁড়ি। 
ঠেলে ঢুকতেই পেছনে ভারী দরজাটা খট করে বন্ধ হয়ে গেল। অমনি কিছুটা অন্ধকার এসে ধাক্কা দিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আর দরজাটা দেখার সাহস পেলাম না। শুধু সামনে সরু আবছা আলো দেখে প্রায় লাফ দিয়ে সিঁড়িতে উঠে গেলাম। কতগুলো ধাপ পার হলে ল্যান্ডিং, সেটা পেরিয়ে সিঁড়ির পরের ধাপে উঠলে একপাশে দেয়াল যা উঁচু ছাদের দিকে, দেয়ালের কোনে একটা ঘুলঘুলি। সিঁড়ি দিয়ে আগে কোনদিন ওপরে যাইনি, এখানে ঘুলঘুলি আছে! এখান দিয়ে আলোর আভাস আসছে! ঘুলঘুলিতে ঘষা কাঁচ। আলো সরাসরি আসে না, কাঁচের ভেতর দিয়ে প্রতিসরণের আঁকাবাঁকা ভঙ্গির কারণে আলোটাকে একটা মরা সাপের মত লাগে। 
বাইরে যদি আজকে প্রখর সূর্যালোক হতো তাহলে কি এই ঘুলঘুলি দিয়ে আসা আলো আরো প্রাণসঞ্চারী উজ্জ্বল হতো? এসব হাবিজাবি ভেবে আসলে আমি নিজেকে চাঙ্গা করি। এক ধরনের আত্মসম্মোহন। নিজেকে বলি, যে অন্ধকারের ভেতর থেকেও আলো উৎসারিত হয়। বলতে বলতে সিঁড়ি ভাঙি। না, সতেরতলা বেশি দূরে না, এই তো চারতলা পার হলাম। 
বিদ্যুৎ না থাকলে এই অফিসের অন্য সব জায়গায় জেনারেটরের মহার্ঘ্য পরিষেবা চালু হয়ে গেলেও সিঁড়িতে আলো নিভে যায়। সিঁড়ি সবচে অবহেলিত, অথচ এখান দিয়ে মানুষকে উঠতে হয়, ওপরে যেতে হয়, সেখান থেকে নামতে হয়! দুর্ঘটনায় সিঁড়ির কথা সবার আগে মনে পড়বে। অথচ সবাই লিফট খোঁজে। 
হা করে শ্বাস নিতে নিতে দশতলায় উঠলাম। সিঁড়ির অন্যপাশে খাড়া উঁচু দেয়াল, প্রতিতলায় ভেতরে ঢোকার দরজার মাঝখানে ছোট্ট বর্গাকারের কাঁচ, তার ওপরে চৌখুপী স্টিলের জাল। সেখানে থেকে ওপাশে ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখতে পাই শান্ত রিসেপশনের নীল সোফাসেটের পাশে তরতাজা অর্কিড। কোনো মানুষ দেখা যায় না। 
পা ভারী হয়ে আসছে, হাঁটুর মালাইচাকিতে খিল ধরে গেছে। চট করে হিসেব করে দেখলাম যে প্রায় সাড়ে পাঁচশ সিঁড়ি ভেঙে সতেরতলায় অবশেষে পৌঁছেছি! আহ! পৌছে যাওয়া ভীষণ তৃপ্তিময়!
এখানেও একই রকম দরজা, কাঁচ বসানো ফোকর। কিন্তু কী আশ্চর্য! সিঁড়ির দিকের এ দরজায় বাইরে থেকে এখানে হাতল নেই। দরজা খুলতে হলে কি ধরে টান দেবো?
যতটা আত্মবিশ্বাস নিয়ে উঠতে শুরু করেছিলাম, সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে তার অনেকখানি কমে গেছে। এখন বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে দমবন্ধ লাগছে। এই ফ্লোরে ঘুলঘুলি নেই, আলো কম। নিচের তলায় গিয়ে ঘুলঘুলির কাছে দাঁড়িয়ে একটু নিঃশ্বাস নিয়ে আসবো? ভুরুক করে আসা একটু আলোর ঝলকানি পেলে প্রাণশক্তি বাড়বে? 
অফিসে বসদের কাছে আরোহণ ও অবতরণ আমার কাজের মধ্যে পড়ে। চাকুরির চুক্তিপত্রে এমন লেখা আছে। আজকে এই যে হা করে শ্বাস নিতে নিতে সিঁড়ি ভেঙে উঠে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, অথচ দরজা খুলতে পারছি না—একথা বলে কোথায় অভিযোগ করা যায় ভাবছি। হিউম্যান রিসোর্সেস ডিপার্টমেন্ট, খোদ আমার বস, না কি এই ভাড়া নেয়া অফিসের মালিকপক্ষ? যারা বিল্ডিং বানাতে গিয়ে ভুল করে, কিংবা ইচ্ছে করে বাইরে থেকে দরজা খোলার বন্দোবস্ত রাখেনি! 
বন্ধ দরজায় ক্রমাগত নক করতে থাকি আমি। 
গরমে শরীরে, গলার কাছে ঘামে চিটচিট করলেও গায়ের জামা খোলার প্রশ্ন ওঠে না। অফিসের পোশাক বলে কথা, শিষ্টাচারও। যে কোনো মুহূর্তে দরজা খুলে গেলে মুশকিলে পড়বো। তারচেয়ে থাক, বড়জোর ঘামাচি হবে। শিষ্টাচারের কাছে ঘামাচির ভোগান্তি তুচ্ছ বিষয়।
চৌকোনা কাঁচের ভেতর দিয়ে ওপাশে দেখার চেষ্টা করি। এবার নির্বাহীদের কাউকে কাউকে দেখতে পাই, নীল সোফাসেটের কাছে গোল হয়ে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা বলছেন। তাদের শরীরি ভাষায় স্পষ্ট—সারাদেশ জুড়ে এ অফিসের অসংখ্য ব্রাঞ্চের মালিকানাস্বত্ব। ওদের চোখে চিন্তা ও অহংকারের ছাপ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, কিন্তু সেটা কি আমার এবং আমার মত আরো অনেক অনেককে নিয়ে? না কি ক্রেতা-ভোক্তা, যাদের ওপর দিয়ে আমাদের দৌড়ের জন্য তৈরি পিচ, তাদেরকে নিয়ে। অথবা দৌড়ের ঐ পথ কত দীর্ঘ তা নিয়ে?
ওদের ভাষা বোঝার আশা জলাঞ্জলি দিয়ে অধোস্তনদের দুয়েকজন নোটপ্যাড হাতে দাঁড়িয়ে আছে, তাদের অবনত ভঙ্গি, দোকানের ফলের মত নিরীহ ভাবলেশহীন চোখ । কিন্তু উর্ধ্বতনরা তাদের মাথার ওপর দিয়ে অন্য কোথাও তাকিয়ে কথা বলছেন। 
দরজার এপাশে আমি বিনীত দর্শক, নিজের শরীরী ভাষায় স্বয়ংক্রিয় পরিবর্তন টের পাই। হাত বিনীত হয়ে মুখে একটা গলতে থাকা আইসক্রিমের হাসি এসে যাচ্ছে। এমনটা হচ্ছে বলে নিজের ওপর বিরক্ত হই, আচ্ছা বলেন, আমার কি এমন বিগলিত হবার দরকার আছে? সিঁড়ি বেয়ে ওঠার কাজ তো আমি যোগ্যতা বলেই পেয়েছি। আলো এবং চাকরিতে উন্নতি দুইই পরস্পরের পরিপূরক আমার কাছে। কীই-না করছি এ দুটো বিষয়কে নিজের জীবনে ধরে রাখতে।
সেই সকালে কোনমতে বাথরুমের কাজ সেরে অফিসে চলে আসি—এই বাক্যটা যত সরল, আমার আসা কিন্তু ততটা না। পায়ের গোড়ালিতে আগেরদিনের দৌড়ের পাথরবাঁধা ভার লেগে থাকে। মনে মনে বলি, আরেকটা দিন। দিনের শেষে সন্ধ্যা হবে। তখন বাসায় ফিরবো, নিজের ঘর, আহ নিজের বিছানা! ঘুমাতে পারবো। আর রাত কত বিশাল! নিজস্ব রাত। রাতে শরীরের শিরা উপশিরাদের বিশ্রাম। আহ, ওদের একান্ত বিশ্রাম। সুতরাং রাতের সুখভাবনা ভেবে আমি দিনের ঘণ্টাগুলোর ভেতর নিজের অস্থিমজ্জা মিশিয়ে দিতে থাকি। 
চৌকোনা ফোকরে চোখ রেখে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছি কতক্ষণ বুঝতে পারছি না। মোবাইলটা সঙ্গে আনা হয়নি। আসলে ইচ্ছে করে রেখে এসেছি, মিটিংয়ের সময় মোবাইল বেজে উঠলে আমার ম্যাম বিরক্ত হন। গত মিটিংয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় আমার আসক্তি কম বলে পিঠ চাপড়ানো পেয়েছিলাম। আজকে তাই সাইলেন্ট মোডে টেবিলের ড্রয়ারে রেখে এসেছি যাতে বেজে উঠলে কেউ আমাকে না খোঁজে। 
কিন্তু, কতক্ষণ এভাবে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবো? কতবার নক করলাম। জোরে দুমদুম শব্দ করলাম। কিন্তু কোনো কাজ হচ্ছে না। এবার কিছুটা পিছিয়ে এসে ধমাধম লাথি দেই দরজায়। 
আরে! এখন তো ব্যপারটা খাপছাড়া এবং নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে! এবার মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ি আমি। কেউ কি শব্দ শুনছে না? এখানে কি বাইরের শব্দ ঢোকে না! 
না, বসে থাকলে চলবে না। হয় দরজা খুলতে হবে, না হয় খোলাতে হবে। 
কিন্তু উঠতে গিয়ে হতভম্ব হয়ে গেলাম! ছাদটা ঝড়ের কবলে পড়া গাছের ডালের মত নিচু হয়ে আমার মাথায় ঠেকে যাচ্ছে! এইতো একটু আগেই ধরাছোঁয়ার বাইরের মত উঁচু আর দশাসই ছিল! শরীর বাঁকিয়ে তড়াক করে উঠে রেলিং ধরে নিচের সিঁড়িতে নেমে যাওয়া ছাড়া উপায় নেই। ছাদ যেন আরেকটু নিচু হলো! আমিও আরো কয়েক ধাপ নেমে গেলাম। আরো দ্রুত। দশতলার ঘুলঘুলি অদৃশ্য হলো। আলো-অন্ধকারের মাপজোক মাথা থেকে উধাও হয়ে গিয়ে আমার বুকের কাছটায় শক্ত ইট চেপে বসেছে। অভ্যাসবসে আমি জানি, এ অবরোধ-আতঙ্ক। সরু, ছোট, অন্ধকার, চেপে আসা জায়গায় এ আতঙ্ক ভর করে আমার ভেতর। এর আগেও দুয়েকবার হয়েছে। নিরোধ হিসেবে মনকে অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে হয়। 
তখন আমি কি করি জানেন? নিজেকে আরো কঠিন কোন অবস্থায় কল্পনা করে নেই। ভাবি, আমার অবস্থা যদি এমন হতো যে কোনো দুর্ঘটনা কবলিত বিমানের ভেতরে আছি। তেলের ট্যাঙ্ক ফুটো হয়ে গেছে, বিমানে আগুন ধরে যেতে পারে। ককপিট থেকে জরুরি অবতরণের ঘোষণা দিচ্ছে ক্যাপ্টেন। কিন্তু যে কোনো মুহূর্তে অবতরণের আগেই নীলিমায় ভাসতে ভাসতে পুড়ে অঙ্গার হতে পারি সবাই। জান্তব মৃত্যুভয়ের কাছে মাথার ওপরে ছাদ নিচু হয়ে আসার আতংক তখন ফিকে হয়ে আসে। একটা সত্যি কথা বলি, আমি কিন্তু কোনোদিন বিমানে ভ্রমণ করিনি। টিভি সিনেমায় দেখা দৃশ্যের সঙ্গে কল্পনায় নিজেকে জুড়ে দেই। 
আচ্ছা, সিঁড়ির একেকটা ধাপে ক’টা করে সিঁড়ি? স্থপতি নিশ্চয়ই হিসাব করে বানায়। চারতলা থেকে তিনতলা নামতে বত্রিশটা। মাঝখানে চৌকোনা ল্যান্ডিং। সেখানে বসে পড়লাম। একটু স্থির হয়ে নেই। ধরা দেওয়ার ধন সেতো নয়, অরূপ মাধুরী—সতেরতলার দরজার উদ্দেশে বেকুবের মত এই গানের লাইন মনে আসে। বেসুরো করে গেয়ে উঠবো? নাকি কোন বাস বা ট্রেন দুর্ঘটনার কবলে নিজেকে কল্পনা করে নেবো? কিন্তু বিমানে ভ্রমণ তো দূর, আমার তো বাসে ট্রেনেও দূরপাল্লার কোনো ভ্রমণে যাওয়া হয় না। 
আপনারা নিশ্চয়ই অবাক হচ্ছেন, কিন্তু সবার কি গ্রামের বাড়ি থাকে? কারো কারো ভিটেমাটি যমুনা বা পদ্মার ভয়াল করাল গ্রাসে নদীগর্ভে বিলীন হতে পারে না?
সুতরাং ধরা যাক, আমি গ্রামের সেই প্রান্তিক চাষির সন্তান, নদীর কাছাকাছি একচালা টিনের ঘরটাই সম্বল। অন্যের জমি চাষ করি। ধানের ক্ষেতের উদাসী বাতাস দেখে আবহাওয়ার পূর্বাভাস দিতে পারি। অন্ধকারে জমির আল দিয়ে হেঁটে যেতে আমার পা ফসকায় না। আমার বন্ধু না থাকলেও শত্রু বলতে তেমন কেউ নেই। শুধু সেদিন সর্বগ্রাসী ভয়াল নদী আমার শত্রু হলো। 
নদীরপাড়ে দাঁড়িয়ে আছি, ভরযুবতীর শরীরে প্রেম ভর করার মত গড়িয়ে গড়িয়ে নদী তার পাড়ভাঙার খেলা দেখাচ্ছে, আর আমার বুকের ভেতরে আতঙ্ক জমে কঠিন পাথর হচ্ছে। ইচ্ছে করছে সে পাথর বের করে এনে নদী তীরে বাঁধ দেই। নদী এক আছাড়ে যতটুকু পাড় ভাঙে, আমি লাফ দিয়ে ততটুক পিছিয়ে আসি। ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে দেখি আমার ঘরের চালা কত দূর। নদী আর কতবার গা মুচড়িয়ে আছাড় দিয়ে পাড় ভাঙলে সেখানে পৌঁছে যাবে! 
নদীর খেলা একসময় ফুরিয়ে যায়। ভিটেমাটির সঙ্গে আমার কপাল চাপড়ানো কান্নাও সঙ্গে নিয়ে যায় নদী। সেদিন আকাশ তার উঁচু সীমানা থেকে নিচে নেমে দম আটকে ধরেছিল আমার। তবুতো আকাশ ছিল মাথার ওপরে। নদীভাঙন আমাকে এই অন্ধকার সিঁড়িতে নিচু হয়ে আসা ছাদ, আঁটসাঁট অন্ধকারের চাপ ভুলতে দিচ্ছে কই? 
বরং সাধারণ শহরবাসী মধ্যবিত্ত হিসেবে নিজেকে কল্পনা করে নেওয়া যাক। যেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো ছাত্র। বাবা মা’র যত্নে বড় হয়েছি। একদিন কোন রেস্টুরেন্টে খেতে গিয়ে জঙ্গি হামলার মুখে পড়ে গেলাম। টেবিলের নিচে লুকিয়ে আছি। আমার চারপাশে বন্দুকধারী মুখোশপরা জঙ্গি  নিষ্ঠুর কণ্ঠে হেকে যাচ্ছে। ভয়ে,আতঙ্কে কাঁপতে কাঁপতে শব্দ করে কেঁদে ফেলায় ওরা আমাকে টেনে বের করে ফেললো। নিজের নাম ধাম সব ভুলে গিয়ে তোতলাতে শুরু করেছি। জঙ্গিদের একজন বন্দুকের ধাক্কায় দেওয়ালের কাছে নিয়ে ফেললো। তারপর অসংখ্য প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর না পেয়ে ওরা ঠা ঠা গুলি করে দিলো। রেস্টুরেন্টের টেবিলে জ্বলতে থাকা আশ্চর্য মোমগুলোকে দেখতে দেখতে গুলি খেয়ে মেঝেতে লুটিয়ে পড়ে গেলাম। আমার বাঁ পাশে তখন এক তরুণীর তাজা লাশ। লম্বা চুলের কাছে পড়ে থাকা তার চশমার কাঁচে রক্ত, যেন কেউ পিচকিরি দিয়ে কালচে লাল রং ছিটিয়ে বিমূর্ত চিত্রকলা নির্মাণ করে গেছে। আমার নিঃশ্বাস পাহাড়ের মত ওজনদার করে দিয়ে রেস্টুরেন্টের বাতাস দুর্গন্ধে ঝিম মেরে আছে। মরতে মরতে নাড়িভুড়ি উলটে আসে আমার, আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।
না না, শহরবাসী মধ্যবিত্ত ভালো ছাত্র, অথচ ভীত-আতঙ্কিত হিসেবে নিজেকে ভেবে নেয়া মন সায় দিচ্ছে না।  
কিন্তু আর কোন দুঃসহ ভূমিকায় নিজেকে কল্পনা করে নিলে মাথার ওপরে নেমে যাওয়া এই ছাদ তার নিজের জায়গায় ফিরে যাবে?
বাইরে সম্ভবত কালবৈশাখি আকাশ আরো কালো করে দিয়েছে। সিঁড়ির অন্ধকারে আমার অবরোধ-আতঙ্ক যেমন দ্বিগুণ হতে থাকে, তেমনি মনে মনে নিজেকে বিযুক্ত করলে সাময়িক উপশমও মেলে, বর্তমান সহনীয় হয়। 
সত্যি তো, এই মুহূর্তে আমি মৃত্যুমুখে পতিত নই। পায়ের গোড়ালি ভারী বোধ সত্ত্বেও সকাল বেলায় সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শক্তি থাকে। এই যে সতেরতলা অব্ধি উঠে এসেছিলাম। বলা যায়, দশতলা পর্যন্ত খরগোশের গতিতে লাফিয়ে পার হয়েছি। তারপর কখন থেকে বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ঐ তো একটু আগে দরজার ফোকর দিয়ে আমার বসকে দেখেছিলাম, হিলের খট খট তুলে হেঁটে যাচ্ছে, সিল্কের শাড়ির পরিপাটি কুচি পদক্ষেপের তালে সামান্য হেলছে দুলছে। ম্যাম চোখ নাচিয়ে কথা বলছেন আরেকজনের সঙ্গে। পাশ দিয়ে কেউ একজন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল, যেন কোথাও কোন দুর্যোগ মোকাবেলা করতে যাচ্ছে। আসলে হয়তো কোন মিটিংয়ের জন্য মিনিটখানেক দেরি হচ্ছে তার।  দরজার এপাশে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম, দুম দুম কিল দিয়ে দরজায় শব্দ করলাম, শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে লাথি দিলাম। এরা কেউ শুনলো না!
দ্রুত নিচে নেমে নিজের ডেস্কে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে এবার রীতিমত শরীর ঠাণ্ডা হয়ে আসে আমার। তিনতলার সিঁড়ির নিচে প্রবল অন্ধকারের ঘূর্ণি। কোনো প্রলয়ংকরী ঝড়ের মোকাবেলা করছি এমন বোধ গ্রাস করে নেয় আমাকে। ঐ যে বললাম বাতাস পানি না, আলোর অভাবে মৃতপ্রায় লাগে আমার। কি করে নিচে নামবো! তবু সিড়ির রেলিং আঁকড়ে ধরলাম। অর্ধেক নেমে কাঁপতে কাঁপতে বসে পড়ি, মনে হয় কেউ যদি আকঁশি দিয়ে টেনে আবার আমাকে ঘুলঘুলির কাছটায় নিয়ে যেতো! আবছা আলোর কিছুটা সঙ্গে নিয়ে ফিরতাম। 
ক্লান্তিতে নুয়ে পড়ছে শরীর। তবু, যেহেতু নিচে নামাই ভবিতব্য, এবার সর্বশক্তি দিয়ে উঠে দাঁড়াই। নিচতলায় পৌঁছে গেছি, কয়েক পা এগিয়ে দরজাটা টেনে খুলবো। এবার নিশ্চয়ই দরজা খুলে যাবে। নিচতলা তো আমার নিজস্ব। সিঁড়ির শেষ ধাপে গা এলিয়ে দিয়ে বসে পড়লাম, একটু জিরিয়ে নেই। সিঁড়ির নিচটায় বেশ অনেকটা জায়গা। অনুভূমিক হয়ে থাকার কারণে প্রথমে নজরে পড়ে না। সমান্তরাল হলে কত কিছু দেখার আছে। 
কখনো খেয়াল করা দরকার পড়েনি যে এত বড় দালানের সিঁড়ির কাছে একটা খোড়লের মত আছে। অন্ধকারে চোখ সয়ে গেলে সেখান দিয়ে সরু লিকলিকে কিন্তু বেগবান আলোর রেখা ধীরে এসে হাজির হয়। আমাকে অনঢ় করে দিয়ে আলোর চলাচল আটকে জ্বলজ্বল করতে থাকে কতগুলো চোখ, কোন কোন চোখে সেঁটে বসা চশমা। তাদের একজন ফ্যাশফ্যাশে গলায় কথা বলে ওঠে, ‘ আটকা পড়লেন তাহলে?’ 
আমি এবার রীতিমত ভয় পেয়ে হকচকিয়ে উঠে বসি। কারা এরা?
অন্ধকারের উৎস থেকে আবছা আলো ধীরে ধীরে পরিষ্কার হচ্ছে। মুখগুলোর দিকে দেখতে চেষ্টা করি, সঙ্গে সঙ্গে নিজের হৃদপিণ্ডের শব্দে কানে তালা লেগে যায় আমার, কোথথেকে ধেয়ে আসা ঠাণ্ডা চাবুকের মার মেরুদণ্ড এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলে। 
আমার কথা আপনাদের বিশ্বাস হচ্ছে না, জানি। কিন্তু অবিশ্বাস্যকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার ট্রেনিং এই অফিস আমাকে দিয়েছে। এক আধ বছর না, পুরো সাড়ে তিন বছর ধরে। আর এখন যা দেখছি তা তো সব দিনের আলোর মত সত্যি। যদিও সিঁড়ির এ জায়গাটায় আলোর ঘাটতি আছে। 
তবে আলো অন্ধকারের ভেদ ঘুচে গেল যখন দেখি, সুচালো মুখের কতগুলো খুড়ুলে প্যাঁচা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের গলায় ঢিলেঢালা টাই, কারুর স্খলিত শাড়ি, দুমড়ানো ওড়না। 
চিৎকার করতে গিয়ে থেমে গেলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলে দিলো যে এখানে হৈ হট্টগোল করে কোন লাভ নেই। 
—‘আপনারা?’—পোশাকের গুণে প্যাঁচাদেরকে আপনি সম্বোধন করে ফেললাম। 
—‘আমরাও আপনার মত, দরজা খোলার অপেক্ষায়, নামা-ওঠার দৌড়ের মধ্যে আছি’। 
—‘ওহ, কিন্তু আমি তো একটু আগেই এখান দিয়ে গেলাম’—আমি তোতলাই। হতভম্ব হয়ে আবারো প্যাঁচাগুলোকে দেখি। ওরা আমার চোখে স্থির চোখ রেখে চেয়ে আছে। টিভির বিজ্ঞাপনে দেখা মাথা শান্ত রাখার সংলাপ মনে মনে আউড়ে আমি প্যাঁচাগুলোকে গোনার চেষ্টা করে হাল ছেড়ে দেই, কারণ ওদের চোখ আমার চোখ বরাবর। ওদের মাথা আমার মাথায় সমান সমান। একজনের মাথার পেছনে আরো অনেক মাথা। পায়ের পাতায় ভর দিয়েও সবাইকে আলাদা করে দেখতে পাচ্ছি না আমি। ওদের কেউ আমাকে নখর দিয়ে আঁচড় দিলে তা আমার নাকে এসে লাগবে। ওদের চোখ মুখ শান্ত না হিংস্র বোঝা যাচ্ছে না।  
—‘প্রথম প্রথম এমনই মনে হয়, যে এই তো একটু আগে গেলাম, আসলাম’—মহিলা প্যাঁচা কানের দুল ঝাঁকিয়ে বলে। ধাঁ করে তার মুখটা চিনতে পারি। এতো সায়রা আপা! আমি যখন এ অফিসে জয়েন করলাম, এই আপা আমার পাশের কিউবিকলে বসতেন। আমাকে পুরো অফিস ঘুরে দেখিয়ে সবার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। সপ্তাখানেক পর তার টেবিলের কতগুলো ফাইল আমার ডেস্কে রেখে গেলেন। তারপর থেকে তাকে আর দেখিনি। খোঁজ করলে কেউ কিছু বলতে পারেনি। মনে পড়লো সায়রা আপা প্রতিদিন কানে এমন ঝুলানো দুল পরতো, এরকমই মাথা ঝাঁকিয়ে কথা বলতো। কিন্তু এমন বুড়োটে ছিল না তো! বরং ঢলঢলে একটা ভাব ছিল। 
সায়রা আপাকে কিছু বলার আগেই পেছন দিয়ে উঁকি দিলো ইশতিয়াক ভাইয়ের হাই পাওয়ারের চশমা। পাওয়ারের কারণে তার চোখদুটো আগেই বড় দেখাতো। কারদিকে চেয়ে কথা বলছেন বোঝা যেত না। এখন অতিকায় দেখাচ্ছে। উনি আমাকে এ অফিসে ট্রেনিং দিয়েছিলেন। অনেক ধৈর্য্য নিয়ে আমাকে কাজের খুঁটিনাটি বুঝিয়ে দিতেন। ওনাকে নিয়ে কি যেন কানাঘুষা চলছিল। এই অফিসের জন্য বেশি স্লো ইশতিয়াক ভাই। সবকিছুতে বেশি ডিটেইলিং কেউ চায় না কি? এখানে রেডি-সেট-গো’ না হলে ওপরে ওঠা মুশকিল। আমি নতুন নতুন তখন অতসব কথা ভালো বুঝতে পারিনি। একদিন অফিসে এসে দেখলাম ইশতিয়াক ভাই নেই। তার অনুপস্থিতি হঠাৎ হোঁচট খেয়ে পড়ে যাওয়ার মত লেগেছিল আমার। তারপর অবশ্য উঠে দাঁড়িয়ে গায়ের ধুলো ঝেড়ে ফেলেছিলাম। 
আচ্ছা, এদের পাশে জুবুথুবু হয়ে দাঁড়িয়ে ওই প্যাঁচাটা কে! চেনা, কিন্তু নাম মনে নেই। কোন সেকশনে যেন! বিষণ্ণ চোখের লাল টিপ পরা, উনি কি আমার উল্টোদিকের কিউবিকলে বসতেন? তারও ওপাশে আরেকজন, টাকমাথা?
সিঁড়ির নিচের ফোকর গলে আসা সরু আলোর রেখা এখন বেশ স্পষ্ট। সার বেঁধে দাঁড়ানো প্যাঁচাদের দু’চারজন বাদে অন্যরা পরিচিত না, তবু সবাইকেই চেনাজানা মনে হচ্ছে। অন্ধকারের ভেতর এমন জ্বলজ্বলে অথচ নিস্পৃহ চেয়ে থাকা মনে হচ্ছে কোথাও দেখেছি। কোথায় তোমায় যেন দেখেছি! হ্যাঁ, দেখেছি। 
বিশ্বাস করেন, আমার নিচতলার বাসায় সকালে ঘুম থেকে উঠে বাথরুমের মরাটে বাল্বের আলোয়  আয়নার সামনে এই মুখগুলোকেই তো প্রতিদিন দেখি।