আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘কান্না’
আধুনিক বাংলা কথাসাহিত্যের বিস্ময় প্রতিভা আখতারুজ্জামান ইলিয়াস। মাত্র পাঁচটি গল্পগ্রন্থে তাঁর লেখা মোট গল্পের সংখ্যা সাকুল্যে বাইশ। তাঁর গল্পের বৈশিষ্ট্য সূত্রায়ণে বলা হয়, ‘ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির, নিজের সঙ্গে নিজের, সমাজের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার সঙ্গে ব্যক্তির দ্বন্দ্ব-সংঘাতের কথকতা নিয়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প।’১ বলা হয় যে, ‘তাঁর মধ্যে প্রথম থেকেই এই বোধ কাজ করেছে যে, অভিজ্ঞতার বিভিন্নতা স্পষ্ট করা এবং স্পষ্ট করার মধ্য দিয়ে চরিত্র তৈরি করা এবং চরিত্র তৈরি করার মধ্য দিয়ে দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলা। তাঁর এই বৈশিষ্ট্যের চূড়ান্ত বিশ্লেষণ হচ্ছে: সংঘাত। এই সংঘাত কখনো মৃদু, প্রকাশ্য সোচ্চার, অবৈরীমূলক, কখনো আবার বৈরীমূলক এবং প্রত্যক্ষ। দ্বন্দ্বের কারণে ব্যক্তি পরাস্ত, ধ্বস্ত, পঙ্গু, নিজের চরিত্র বিনাশে তৎপর, নিজের বিকাশ সন্ধানেও অক্ষম।...মুক্তি চাইলেও বাঁধনে বন্দী সে। উড়াল দিতে চাইলেও জটায়ু সে, তার ডানা ছিন্ন, আহত রক্তাক্ত।...নিষ্কৃতি নেই তার।’২ লেখকের মৃত্যু-পরবর্তী [০৪.০১.১৯৯৭] ১৯৯৭-এ প্রকাশিত ‘জাল স্বপ্ন স্বপ্নের জাল’ গ্রন্থের ‘কান্না’ গল্পের আদ্যন্ত কেন্দ্রীয় চরিত্র আফাজ আলির গল্পে বিধৃত জীবনখণ্ডও যেন এই সত্যকেই চিত্ররূপ দেয়। বরিশালের কৃষ্ণকাঠিতে তার নিবাসগ্রাম। পরিবার সেখানে বসবাস করলেও আফাজ ঢাকায় গোরস্তানে মোনাজাত করানোর কাজ করে জীবন নির্বাহ করে, সেই আয় থেকেই তার পরিবারের যাবতীয় সংস্থান। গল্পের সূচনায় আফাজ যখন নিজের বৃত্তিগত কাজের ব্যস্ততায় সংলিপ্ত, তখন তার নজরে পড়ে ‘সবুজ সোয়েটার ও সবুজ-হলুদ চেক-কাটা লুঙ্গি পরা’ কৃষ্ণকাঠির কুদ্দুস হাওলাদারের ছেলে মনুমিঞার ওপর। এই মনুমিঞা আফাজ আলির কাছে এসেছে ‘জরুরি খবর’ দিতে, কিন্তু জিয়ারতের দোয়া পড়ে মরহুমের স্বজনদের শোকাবেগকে উথলে তোলার প্রক্রিয়ার মধ্যে বিঘ্ন ঘটিয়ে মনুমিঞার সঙ্গে কথা বলার সময় কোথায় আফাজের! তাই সে দোয়া উচ্চারণ করতে করতে মনুমিঞাকে দেখতে পেয়েও কথা বলতে আগ্রহ প্রকাশ না করে মনে মনে ভাবে, ‘দেখুক, ব্যাটা ভালো করে দেখে নিক। ...সব[কবর]গুলো সে নয়ন ভরে দেখুক। ...খোদার কালাম বুঝতে না পারুক, বাংলা কথাগুলোই পড়ুক। তাতেও তার সময় কাটবে। ...একটু ঘুরে ঘুরে দেখুক না। এখানে খামাখা দাঁড়িয়ে থাকে কেন? আফাজ আলির এখনো তো ঢের দেরি।’
এই গল্পসূচনার মুহূর্ত বর্ণনার ভেতর দিয়েই ইলিয়াস আফাজ আলি চরিত্রের দ্বান্দ্বিক যাপনের শিকড়টিকে পাঠকগোচর করেন। ঢাকার কবরে জিয়ারত করানোর বৃত্তিনিযুক্ত বসবাস করলেও সেই শিকড় বরিশালের প্রত্যন্ত কৃষ্ণকাঠি পর্যন্ত চারিয়ে-ছড়িয়ে বিস্তৃত। আফাজের যাপনের আত্মদ্বন্দ্ব এবং পরিবার, প্রতিবেশী, আত্মীয়-স্বজন, বৃত্তিস্থানে অন্য সহগামী ও প্রতিস্পর্ধী এবং যাদের ওপর নির্ভর করে আফাজের টিকে থাকা, সেই ঢাকার অভিজাত বাঙালিদেরও জড়িয়ে নিয়ে এই গল্পে ইলিয়াস যেন প্রেক্ষিতকালের বাংলাদেশের যাপন-প্রবাহের স্পন্দনকে শাশ্বত আধারে ধারণ করে পাঠকের সামনে মেলে ধরেছেন।
সুর করে আয়াত উচ্চারণ করতে করতে শোকমগ্নতার আবহ সৃজন করে নিজেকেও সেই শোকের প্রায় অংশভাগী প্রতিপন্ন করে মৃত আত্মার আত্মীয়-বন্ধু-পরিজনদের ভাবালু শোকাচ্ছন্ন করে তোলার বিশেষ করণ-কৌশলে নৈপুণ্য প্রদর্শনের স্বতঃস্ফূর্ততা আফাজের বৃত্তির ‘Unique Selling Proposition’ বা ‘ইউএসপি’। পারিপার্শ্বিক একই বৃত্তিতে নিযুক্ত অন্য প্রতিযোগীদের থেকে এই বিশেষ প্রকরণ-দক্ষতায় তার আত্মগর্ব। হীন প্রাণ ধারণের সত্যকে যেন জরির আবরণে ঢেকে রাখে সে এই প্রচ্ছন্ন গর্বের মলোলালিত শ্রেষ্ঠমন্যতায়, ‘...দাপটের গোরকোন-কাম-মালি কাল্লুমিঞাকে দিয়ে হায়দর বখস পার্টি হাতাবার যত ফন্দিই করুক, আফাজ আলির দোয়াদরুদ আর মোনাজাত শোনার পর কারও সাধ্য নাই যে তাকে বাদ দেয়।’ কেমন বিশিষ্টতা অন্বিত আফাজ আলির দোয়াদরুদ আর মোনাজাত,—তার বর্ণনা গল্পের সূচনা অনুচ্ছেদেই পাঠকগোচর করা আছে; তা এই রকম: ‘আফাজ আলির কাঁদো-কাঁদো গলায় ঢেউ ভাষার দুর্বোধ্যতাকে ছাপিয়ে মরহুমের প্রতি সবার আবেগকে চড়িয়ে দেয় নিবেদনের চূড়ায়, সেখান থেকে হঠাৎ করে নামা কঠিন। আয়াতের ভাষায় কারও দখল না থাকায় সব কথাই হয়ে দাঁড়ায় মুর্দার সঙ্গে প্রত্যেকের যোগাযোগের প্রকাশ। তার সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের মিহি ও মোটা কাহিনি একাকার হয়ে সবাইকে ব্যাকুল করে তোলে এবং শোকের আগুন উত্তাপ হয়ে ফাল্গুনের এই শেষ দুপুরে তাদের শরীরে একটু ওম দেয়।’ পরবর্তী অনুচ্ছেদেও আফাজের দোয়াদরুদ ও মোনাজাতের নিবিষ্ট নিরীক্ষিত বর্ণনা: ‘আফাজ আলি মরহুমের নাম করে তাকে বেহেশত নসিব করার জন্যে আল্লার দরবারে এবার মিনতি জানায় বাংলায়। তার মিনতির আর শেষ নাই। মরহুমের বাবা-মা এবং আরও আগেকার পূর্বপুরুষদের সঙ্গে মরহুম সুখে শান্তিতে বেহেশতবাসী হোক, আল্লা তাদের গুনাখাতা মাফ করে দিক। আল্লার দয়ার সীমা নাই, গুনাগার মানুষের ওপর রহম বর্ষণ করেন বলেই তিনি রহমানুর রহিম। মোনাজাত শুনতে শুনতে কারও কারও চোখে পানি আসে, মোনাজাতের জন্যে এক হাত নিয়োজিত রেখে অন্য হাতে চোখ মুছতে গেলে নোনা পানি নামে দুই চোখ ঝেঁপে। বেদনা ও মিনতিতে গলা কাঁপিয়ে আফাজ আলি বলেন, ‘হায়াৎ হোসেন খান সাহেবকে তুমি উঠিয়ে নিয়েছ, তোমার বান্দাকে তুমি ফিরিয়ে নিলে, আমাদের কোনো নালিশ নেই। আল্লা, তুমি তাঁর বিবি ও আওলাদদের এই শোক সহ্য করার তৌফিক দাও, হে আল্লা রাব্বুল আলামিন।’ মরহুমের ছেলেরা হাপুস নয়নে কাঁদতে শুরু করলে...।’
‘লেখকের দায়’ শীর্ষক ‘প্রফুল্লকুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার’ প্রাপ্তি উপলক্ষে পঠিত বক্তব্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘দেশের অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এ জন্য শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি, তখনো পাকে প্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিই মধ্যবিত্তকে এবং শক্ত সমর্থ জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশূন্য করে তৈরি করি।’
ঢাকার অভিজাত সমাজের মানুষদের সমাহিত করার কবরস্থানে মোনাজাত করানোর দোয়াদরুদ উচ্চারক আফাজ আলির তুচ্ছ বৃত্তি-ধারক জীবনে আলো ফেলে ইলিয়াস তার যাপনের খুঁটিনাটি, ব্যস্ততা, উদ্বেগ ইত্যাদির অনুপুঙ্খ বর্ণনার মাধ্যমে বাংলাদেশের নগরজীবন যাপনধারাকেই অর্থবহ চিত্ররূপ দান করেছেন। গল্পের বাচনে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশের অসমবিকাশ অর্থনীতির করুণ সত্যের অনুস্পন্দন,—কবরে জ্বালানোর জন্য যে ‘দামি’ আগরবাতি ব্যবহৃত হয়, তা-ও ‘ইন্ডিয়ান’! মোনাজাত করতে আসা মানুষরাও যেন কবরের ভিতরের মৃত শবদেহাবশেষ-এর মতোই; তাদের ‘ফারাক’ খুব বেশি নয়! শোকাভিভূত ও কান্নায় ভেঙে পড়া শোক উদ্যাপনের জন্য কবরে আসা অভিজাত মানুষদেরও পকেটমারের ভয়ে তটস্থ থাকতে হয়; ‘এক হাতে নিজের পাঞ্জাবি বা প্যান্টের পকেট ছুঁয়ে দেখে। দিনকাল খারাপ, যেখানে সেখানে পকেটমার, প্রাণভয়ে কাঁদার পথও ভদ্রলোকদের বন্ধ হয়ে আসছে।’
গল্পের বেদনাঘন অন্তিম বার্তাবহ চূড়ান্ত প্রহারের ঘটনাটি নিরীহভাবে পাঠকজ্ঞাপিত হয় এই মর্মে যে, মরহুম হায়াৎ হোসেন খানের মোনাজাতের মিনতি-বাক্য উচ্চারণে আফাজ আলি ভুল করে নিজের ছেলে মোহাম্মদ হাবিবুল্লার নাম উচ্চারণ করে ফেলে। বর্ণনা-বাচনে বলা হয়, ‘নাম ভুল করলেও আলিমুল গায়েব আল্লা ঠিকই সংশোধন করে নেবেন—এই আস্থা থাকা সত্ত্বেও আফাজ আলি বিব্রত হয়, মুর্দার নাম বলতে নিজের ছেলের নাম বলে ফেলায় তার মনটা খারাপ হয়ে যায়। তবে কয়েক মুহূর্তেই সামলে নিয়ে মোনাজাত অব্যাহত রাখে।’ গোরস্তানের বরাত নেওয়া খদ্দেরের মৃত আত্মীয়ের মোনাজাতের ব্যবস্থাপনা, এক মোনাজাত চলতে চলতেই তা অকস্মাৎ দ্রুত শেষ করে অন্যটার জন্য ব্যতিব্যস্ত বিদায় নেওয়া, প্রতিস্পর্ধী কাল্লুমিঞা ও হায়দর বখসের নতুন খদ্দের ধরার ব্যাপারে নিয়ত উদ্বেগ তাড়না, নিজের অনুসারী গোরকোন-মালি শরিফ মৃধার শৈথিল্য ও বিষ্মরণের জন্য অগ্রিম নিয়েও কথামতো কাজ করে না রাখার জন্য তিক্ত-তীক্ষ্ণ-ভর্ৎসনা ও তিরস্কারবিদ্ধ হওয়া ইত্যাদি নৈমিত্তিক বৃত্তি-ঝঞ্ঝাটের ব্যস্ততার মধ্যেও আফাজ আলির মনোচিন্তার সর্বসত্তায় আচ্ছন্ন করে থাকে ছেলে হাবিবুল্লার জীবন প্রতিষ্ঠা বিষয়ে নিয়ত উদ্বেগ। মাদ্রাসা থেকে দাখিল পাস করার পর হাবিবুল্লা কলেজে ভর্তি হওয়ার জেদ ধরলে আফাজ আলির শ্বশুর আশরাফুদ্দিন বাধা দিলে প্রকাশ্যে শ্বশুরের অপক্ষপাত করে কথা বলতে না পারলেও আফাজের ‘গোপন সায় কিন্তু ছেলের ইচ্ছায়’। সেই ছেলে একবার ফেল করে সেন্টার বদলে বোর্ড অফিসে পয়সা খরচ করে পাস করে সেকেন্ড ডিভিশনে। মাসখানেক আগে গ্রামের আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের কাছ থেকে পাঁচ হাজার টাকা ‘হাওলাত’ [ধার] করে বরিশালে ঘুষ দিয়ে এসেছে এক প্রফেসর-কাম অফিসারকে। অনুক্ষণ উপার্জন চিন্তা আর ছেলের চাকরি অথবা তার জন্য প্রদেয় ঘুষের অর্থ জোগাড় করার দুশ্চিন্তা নিয়ে ঢাকার কবরে ঘুরে বেড়ানো আফাজ আলির প্রাণধারণ বস্তুত জীবিত অবস্থায় কবরবাস!
মনুমিঞাকে বরিশাল থেকে ঢাকার কবরস্থানে উপনীত হওয়া দেখে আফাজ আলির পক্ষে তাই খুব স্বাভাবিক ভাবনা এটাই হয় যে, বুঝি সে এসেছে ঘুষের টাকার দ্বিতীয় কিস্তি আদায় করতে। ‘চাচা, হাবিবুল্লার খবর তো ভালো না’—মনুমিঞার এই বাক্য প্রথমে না শুনে টাকা দেওয়া সম্পর্কে নিজের যাবতীয় মনঃক্ষোভ উজাড় করে দেয় আফাজ আলি। তার দীর্ঘ বাক্যমালার ক্ষুব্ধ সংলাপে কিছুক্ষণ আগে স্ব-সংসাধিত [Self Performed] ‘মুর্দার জন্যে রোনাজারি’র আবেশবিস্তারী ভাবঘোর মুছে যায়। আফাজ আলি শমিত হলে সেই সুযোগ পুনরায় মনুমিঞা জানাতে চায় আফাজপুত্র হাবিবের জীবন সংকটের কথা। সে কথাও যথাযথ মাত্রায় উচ্চারণ করে বোঝানোর মতো সংলাপ পরিসর সৃষ্টি করতে দেয় না, নিয়ত ক্ষুব্ধচিত্ত ও উদ্বেগ-ব্যাধি বহন করে বাঁচা আফাজ আলি। শেষে এগিয়ে আসা শরিফ মৃধার মধ্যস্থতায় আফাজ জ্ঞাপিত হয় তার ছেলে মোহাম্মদ হাবিবুল্লার জীবনসংকটের বার্তা।
শবেবরাতের দিনটি আফাজ আলির বৃত্তির সর্বোচ্চ উপার্জনের দিন। সেই কাঙ্ক্ষিত লগ্নের ছ’দিন আগে হাবিবুল্লার জীবনসংকটের খবর, আফাজ আলিকে উভয়সংকট পতিত করে। বাৎসরিক, নৈমিত্তিক ও বরাত পাওয়া খদ্দেরদের চাহিদা, প্রতিশ্রুত অর্থও কর্ম এবং ছেলেকে দেখতে এই ছ’দিন পরের সব উপার্জন জলাঞ্জলি দিয়ে কৃষ্ণকাঠি ফেরার উদ্বেগে দীর্ণ হতে থাকে আফাজ আলি। ‘ভোরে বরিশাল ঘাটে নেমে প্রথম বাসে বাকেরগঞ্জে পৌঁছেই ইসহাক রিকশাওয়ালার মুখে’ খবর পাওয়া যায় যে ‘হাবিবুল্লার দাফন হয়ে গেছে কাল বিকালে’।
শবেবরাতের দিনটি আফাজ আলির বৃত্তির সর্বোচ্চ উপার্জনের দিন। সেই কাঙ্ক্ষিত লগ্নের ছ’দিন আগে হাবিবুল্লার জীবনসংকটের খবর, আফাজ আলিকে উভয়সংকট পতিত করে। বাৎসরিক, নৈমিত্তিক ও বরাত পাওয়া খদ্দেরদের চাহিদা, প্রতিশ্রুত অর্থও কর্ম এবং ছেলেকে দেখতে এই ছ’দিন পরের সব উপার্জন জলাঞ্জলি দিয়ে কৃষ্ণকাঠি ফেরার উদ্বেগে দীর্ণ হতে থাকে আফাজ আলি। ‘ভোরে বরিশাল ঘাটে নেমে প্রথম বাসে বাকেরগঞ্জে পৌঁছেই ইসহাক রিকশাওয়ালার মুখে’ খবর পাওয়া যায় যে ‘হাবিবুল্লার দাফন হয়ে গেছে কাল বিকালে’।
জীবিত অবস্থায় কবরবাসের নারকীয় প্রাণধারণের বাস্তবতা উদ্ঘাটনে লেখক আফাজ আলির বরিশালের কৃষ্ণকাঠি গ্রাম পৌঁছানোর পরের বর্ণনাতেও পাঠককে যেন নরকদর্শন ঘটান। যে গ্রাম-বাস্তবতার সংবাদখণ্ড দিয়ে ঘটনা, দিন ও মুহূর্ত বর্ণিত হয় হাবিবুল্লার মৃত্যুর; তাতে উঠে আসে বিংশ শতাব্দীর ন’য়ের দশকের ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’-এর আর্থসামাজিক জীবনধারার আকাঁড়া সত্য:
ক. ‘বাকেরগঞ্জ হাসপাতালে ডাক্তারদের কেউই সপ্তাহে দুই দিনের বেশি হাসপাতালে থাকে না।’
খ. ‘এই গোরস্তানের কী ছিরি, এখনে এই দোয়া পড়ে আল্লার কালাম নাপাক করে ফেলা হয় না? এ কি গোরস্তান, না ভাগাড়? এসব কি মুর্দাকে ইজ্জতের সঙ্গে দাফন করা, নাকি লাশ দড়ি বেঁধে টেনে এনে পুঁতে রাখা হয়েছে? খালের ধারে বেতবন থেকে মানুষের ও বাঁশঝাড় থেকে পর্দানশিন মেয়েমানুষের গুয়ের গন্ধ, রাত্রে শেয়ালের খোঁড়া কবরগুলোর ভেতর থেকে উঁকি দেওয়া বয়স, লিঙ্গ ও পেশানির্বিশেষে মুর্দাদের খুচরাখাচরা ঠ্যাং, রান বা হাঁটুর গন্ধ এবং গিজগিজ করা গাছপালাগুলোর ভেষজ গন্ধ মিশে ফাল্গুনের ফুরফুরে হাওয়ায় অবিরাম ঘুরপাক খায়।’
গ. ‘...মনুমিঞা জানায়, “২০০০ সাল নাগাদ সবার জন্য শিক্ষা কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে নারীশিক্ষা বিস্তার” অফিসার জাহাঙ্গীর কাজী স্যার তো [ঘুষের] টাকাটা পেয়েই বিভিন্ন জায়গায় ভাগবাঁটোয়ারা করে দিয়েছে, ...।’
ঘ. ‘বাকেরগঞ্জে আলিয়া মাদ্রাসার বিল্ডিং করার টাকা এসেছে মেলা, বিলাত না অ্যামেরিকার কোন নাসারা প্রতিষ্ঠান টাকা ঢালছে আমাদের দীনি এলেমের জন্যে, তারা বুঝতে পাচ্ছে, ইসলাম ছাড়া আর গতি নাই।’
শবেবরাত দু’দিন বাকি থাকতেই আফাজ আলি ফিরে আসে নিজের কর্মস্থল ঢাকার সেই রইস মানুষদের গোরস্তানে।
শবেবরাতে কোনো মুর্দার মেয়ের পরম আকাঙ্ক্ষিত ‘বাপের কবর থেকে বাপের লাশের বাসি রক্তে লাল ও শুকনা মজ্জায় পুরুষ্ট’ গোলাপ, কারও সন্তুষ্টির জন্য বা কবরে ‘সবুজ ঘাসের গালিচা’য় বন্দোবস্তের অর্থপ্রদায়ী উদ্বেগ-ব্যস্ততার বৃত্তে ঢুকে পড়ে সদ্য পুত্র বিয়োগ হওয়া আফাজ আলি। মিথ্যা লোকভোলানো এই রকম সব ব্যবস্থাপনা আর জিয়ারতের খদ্দের ধরে নিজেদের মধ্যে কাজের ভাগ-বাঁটোয়ারা করে বখরা পাবার ফড়েগিরির সূচনা হয় আবার। হাবিবুল্লার দাস্ত হওয়া থেকে অসুস্থতার বাড়াবাড়ি শুনে কৃষ্ণকাঠি রওনা হওয়ার দিন ব্যস্ততার মধ্যেও যে জোয়ান ছেলে মরে যাওয়ায় তার রহিস বাবা কবরের জায়গা ঠিক করতে এসেছিল, তাদের যথাযথ পাকড়াও করে শরিফ মিঞা হায়দর বখসকে দিয়ে দাফনের দোয়া পড়ালেও আট-দশটা গাড়িতে চড়ে আসা পনেরো-কুড়িজন মানুষকে ‘জিয়ারত’ পড়াতে বলে আফাজ আলিকেই। এই মুহূর্তে যেন আফাজ আলিরও জোয়ান ছেলের জন্য অবরুদ্ধ শোকের উচ্চারণের ভূমি রসায়ন বিক্রিয়া হঠাৎ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়; তাই সে এই পার্টির অনুমতি পাওয়ার আগেই জিয়ারতের দোয়া পড়তে শুরু করে এবং অবধারিতভাবে তার আবেগাতিরেকের বাঁধভাঙা স্রোত শরিফ মিঞাকে উদ্বিগ্ন করলেও [‘মোনাজাত করতে করতে আবার ভুলভাল কিছু বলে ফেললে সব পণ্ড হবে’] আফাজের শোক মনে করায় রবীন্দ্র-উপলব্ধির সেই দর্শন-সার যা বলে:
তাহারে অন্তরে রাখি
জীবন কণ্টক-পথে যেতে হবে নীরবে একাকী
সুখে দুঃখে ধৈর্য ধরি, বিরলে মুছিয়া অশ্রু আঁখি,
প্রতিদিবসের কর্মে প্রতিদিন নিরলস থাকি
সুখী করি সর্বজনে।
‘লেখকের দায়’ শীর্ষক ‘প্রফুল্লকুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার’ প্রাপ্তি উপলক্ষে পঠিত বক্তব্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘দেশের অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এ জন্য শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি, তখনো পাকে প্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিই মধ্যবিত্তকে এবং শক্ত সমর্থ জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশূন্য করে তৈরি করি।’
পুত্র হাবিবুল্লাহর মৃত্যুর জন্য শোক আফাজের নারকীয় কীটসদৃশ প্রাণধারণের একান্ত ব্যক্তিগত শোক। তাকে বাঁচতে হবে এই ভারবাহী ক্লান্তি নিয়ে কৃত্রিম কান্নার বেসাতি করেই আজীবন। কৃষ্ণকাঠির খালের ধারের গোরস্তানে সে ছেলের জন্য জিয়ারতের দোয়া পড়েছে, কষ্ট হয়নি; কারণ সে প্রক্রিয়া যান্ত্রিক—‘মুখস্থ’ উচ্চারণ পড়া মাত্র। সেখানে কঠিন মনে হয় ‘আল্লার দরবারে মোনাজাত করা’ এবং ‘ছেলের রুহের মাগফেরাতের জন্যে আর্জি’ করা। তাই তাৎক্ষণিক কৃষ্ণকাঠিতে সেই কর্মপ্রয়াসে সে অসফল হয়েছিল, ‘নদীপথ হয়ে খালের ওপর দিয়ে আসা সমুদ্রের নোনা বাতাসে আফাজ আলির চোখে পাতলা মেঘ জমতে না জমতে আবদুল কুদ্দুস হাওলাদারের [৫ হাজার টাকা ধার যার কাছে] নিশ্বাস মেশানো স্থানীয় হাওয়া সব শুষে ফেলে এবং সেই সঙ্গে গলার আর্দ্রতাও শুকিয়ে গেলে দুই হাত তুলেও লোকটা কিছুই চাইতে পারে না।’ সেই স্থগিত চাওয়া সন্নিবদ্ধ যুক্তবেণীর গ্রন্থিবন্ধনের মতো বিজড়িত হয়ে অর্গলমুক্তি পেল এবার:
ছেলেটা ঘুমাক, মশামাছিতে সে যেন এতটুকু উসখুস না করে। তার কাফনে কি মাটির দাগ লেগেছে? গোসল করানোর সময় তার শরীর থেকে দাস্তের সমস্ত চিহ্ন ভালো করে মুছে ফেলা হয়েছে তো? মাটির ভেতরে শুয়ে থাকা তার শরীরের সমস্ত নাপাক জিনিস সাফ করতে আফাজ আলি দোয়া পড়ে একটু ঝুঁকে।
যে খানদানি পরিবারের ছেলে শাহতাব কবিরের লাখ-লাখ টাকা খরচ করে লন্ডনে চিকিৎসা করিয়েও বাঁচাতে পারেনি তার পরিবার। তার ভাইবোনেরা থাকে আমেরিকা, জার্মানি ও জাপানে। যার বাপ কোনো ফরেন কোম্পানির খুব বড় অফিসার; সেই মরহুমের জিয়ারত করতে করতেই আফাজ আলির আপন মরহুম পুত্র মোহাম্মদ হাবিবুল্লার জন্য অবরুদ্ধ পিতৃশোক উদগীর্ণ লাভার মতো সবকিছু মিশিয়ে অগ্নিশুদ্ধ ধারায় উগরে দিতে থাকে, ‘‘আল্লা, এত বড় উপযুক্ত পোলাডারে তুমি বাপের বুক হইতে কাড়িয়া লইলা? অর মায়ের বুকডা তুমি খালি করিয়া দিলা? ...আল্লা, তার নাদান বাপটার কথা একবার তুমি ভাবিয়া দেখলা না? ...আল্লা, আল্লা রাব্বুল আলামিন, শাহতাব কবিররে তুমি বেহেস্ত নসিব করো আল্লা। কিন্তু পাক পরওয়ারদিগার, তার বাপটারে কি তোমার নজরে পড়লো না? বাপটা কি তামাম জীবন খালি গোরস্তানে গোরস্তানেই থাকবো? ...আল্লা, তার নাদান বাপটা কি খালি গোর জিয়ারত করার জন্যেই দুনিয়ায় বাঁচিয়া থাকবো। আল্লা!’
যে আফাজ আলি বরিশালের কৃষ্ণকাঠি গ্রাম থেকে ঢাকার রহিস লোকদের গোরস্তানে দাফন, গোর আর জিয়ারতের মোনাজাতের আনুষঙ্গিক কর্মনির্বাহে নিজে কেঁদে মরহুমের স্বজনদের শরীরের কান্নাগ্রন্থির অর্গল মুক্তি ঘটানোর কর্ম করে, তার সেই কান্না নেহাতই অনুভূতি উদ্দীপনের কৃত্রিম কান্না। কিন্তু আপন জ্যেষ্ঠ পুত্র মোহাম্মদ হাবিবুল্লার অকস্মাৎ মৃত্যু এবং তাকে দেখতে গিয়ে কবরে অসমাপ্ত মোনাজাত যেন ঢাকায় পুনরায় ফিরে এসে কাজে যোগ দিয়ে ধনীসন্তান শাহতাব কবীরের জিয়ারতের দোয়া পড়তে পড়তে তার বৃত্তিপালনের কৃত্রিম শোক উদ্বেজক কান্না আর নিজের পুত্রমৃত্যুতে বুক খালি হওয়া ব্যক্তিশোকের কান্না একাকার হয়ে যায়।
‘কান্না’ গল্পের আফাজ আলি চরিত্র সম্পর্কেও এই বক্তব্য সত্য। যে রাষ্ট্রিক জীবনপ্রবাহে সাধারণ তুচ্ছ মানুষ প্রায় অবমানবের মতো প্রাণ ধারণের বাধ্যতায় অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দী, সেখানে গল্পের চরিত্ররা বিশাল বপু যোদ্ধার তেজ নিয়ে বিরাজ করবে কীভাবে। তীক্ষ্ণ বস্তুবাদ আর শ্রেণিচেতনার সূক্ষ্মবোধ তাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দিয়ে গড়িয়েছে স্বাভাবিক মানুষ; যারা বাঙালি। সহিষ্ণু, স্বপ্নদর্শী, ভীরু, সৎ কিন্তু প্রাণধারণের জন্য ন্যূনতম অসততাকে অবলম্বনে পরান্মুখ নয়। আফাজ আলিও তেমন।
সমালোচক আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্প-ব্যাখ্যা ও সূত্রায়ণে লিখেছেন, ‘তাঁর গল্পে...চরিত্রেরা সমাজের প্রচলিত কাঠামোর মধ্য থেকেই তাদের জীবনের প্রবাহন সম্পন্ন করে গেছে।’৩ ‘কান্না’ গল্পের আফাজ আলি চরিত্র সম্পর্কেও এই বক্তব্য সত্য। যে রাষ্ট্রিক জীবনপ্রবাহে সাধারণ তুচ্ছ মানুষ প্রায় অবমানবের মতো প্রাণ ধারণের বাধ্যতায় অদৃশ্য শৃঙ্খলে বন্দী, সেখানে গল্পের চরিত্ররা বিশাল বপু যোদ্ধার তেজ নিয়ে বিরাজ করবে কীভাবে। তীক্ষ্ণ বস্তুবাদ আর শ্রেণিচেতনার সূক্ষ্মবোধ তাই আখতারুজ্জামান ইলিয়াসকে দিয়ে গড়িয়েছে স্বাভাবিক মানুষ; যারা বাঙালি। সহিষ্ণু, স্বপ্নদর্শী, ভীরু, সৎ কিন্তু প্রাণধারণের জন্য ন্যূনতম অসততাকে অবলম্বনে পরান্মুখ নয়। আফাজ আলিও তেমন। ‘বৌ-ছেলেমেয়ের ভরণপোষণের জন্য তাকে পড়ে থাকতে হয় ঢাকার গোরস্তানে; তাই ৫০৬৮ নম্বর কবরে শবেবরাতের দিন যাতে একটা লাল গোলাপ পাওয়া যায়, তার ব্যবস্থাপনাও বরাত নেয় সে। কেননা, ‘ঐ ১টি গোলাপের দাম এমনকি ২০০ টাকা পর্যন্ত উঠতে পারে, এর ১৫০ টাকাই তার,...।’ সে স্বপ্নদর্শী, সর্বস্ব দিয়ে, ধার করেও ঘুষের টাকা দিয়েছিল, ছেলে হাবিবুল্লা যেন একটা চাকরি পায়—এই মনোবাসনায়। স্বপ্ন সফল হলে ছেলের রোজগারে মাসে মাসে ঋণশোধ হবে—এইটুকু মাত্র ছিল তার ‘জীবিত অবস্থায় কবরবাস’ এর মুমূর্ষু জীবনধারণ থেকে পরিত্রাণ পাবার দুর্মর বাসনা-লালিত স্বপ্ন। গড়পড়তা বাঙালির মতো সে সংস্কারের নির্বোধ ভাবভাবনার জালে বন্দীও। ভাবে, ‘আল্লার এলেম শিখতে শিখতে ছেড়ে দিয়েছিল বলে হাবিবুল্লার ওপর আল্লা কি নারাজ হয়েছে?’ সেই ছেলের মৃত্যুর পর জীবনের ভার বা দায় বহনে সে অক্লান্ত। হতমান সেই জীবন মানে ‘গোর জিয়ারত করার জন্যেই’ বেঁচে থাকা!
‘লেখকের দায়’ শীর্ষক ‘প্রফুল্লকুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার’ প্রাপ্তি উপলক্ষে পঠিত বক্তব্যে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘দেশের অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের স্বপ্ন ও স্বপ্নভঙ্গ, এবং আবার স্বপ্ন দেখার অসীম শক্তি আমাদের চোখে পড়ে না। এ জন্য শ্রমজীবী, নিম্নবিত্ত মানুষকে নিয়ে যখন লিখি, তখনো পাকে প্রকারে তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিই মধ্যবিত্তকে এবং শক্ত সমর্থ জীবন্ত মানুষগুলোকে পানসে ও রক্তশূন্য করে তৈরি করি।’৪ তাঁর জীবৎকাল তথা মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বকালের বাংলাদেশ সম্পর্কে এই বক্তৃতাতেই ইলিয়াস বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশে এখন চলছে শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে মধ্যবিত্তের বিচ্ছেদ প্রক্রিয়া।’৫ ‘কান্না’ গল্পে তিনি যেন এক দায়বদ্ধ শিল্পীর কর্তব্যনিষ্ঠা নিয়ে ঢাকার অভিজাত গোরস্থান থেকে বরিশালের প্রত্যন্ত কৃষ্ণকাঠি গ্রাম যাতায়াত করে ‘আমেরিকা, জার্মানি, জাপানে’ যাপন-হৃদয় বাঁধা দিয়ে ঢাকায় পা রাখা ‘বড়ো-বড়ো রইস মানুষ’ যথা মন্ত্রী, সেক্রেটারি, মেজর জেনারেল, সিনেমার হিরো, বড়-বড় মার্কেট ও ‘ফরেনারদের অফিসে কাজ করা সায়েব’দের সঙ্গে আফাজ আলি, শরিফ মৃধা, হায়দর বখস, কাল্লুমিঞা, মনুমিঞা প্রভৃতির মতো শহর ও গ্রামে উঞ্ছবৃত্তি করা গবিব ও নিম্নবিত্ত এবং ঘুষখোর অধ্যাপক জাহাঙ্গীর কাজী, আফাজ আলির চশমখোর শ্বশুর আশরাফুদ্দিন, গ্রামের পয়সাওয়ালা ‘পরহেজগার’ [ধার্মিক] কুদ্দুস হাওলাদারদের সমান্তরাল স্থিতিতে স্থাপন করে বাংলাদেশের রাষ্ট্রিক জীবনধারার মুক্তি [১৯৭১] পরবর্তী পঁচিশ বছরের সমাজ যাপনের ‘বাইনারি বৈপরীত্য’কে ধারণ করেছেন অনায়াস নৈপুণ্যে। গল্পটি গ্রন্থাকারে প্রকাশের আগে ইলিয়াস ‘আনন্দ পুরস্কার’ বক্তৃতায় বলেছিলেন, ‘...সমগ্র জাতির সাংস্কৃতিক ভিত্তি অনুসন্ধান করা একটি কঠিন কাজ কিন্তু কঠিনেরে ভালোবাসিলাম—এটুকু জেদ না থাকলে কারও শিল্পচর্চায় হাত দেওয়ার দরকার কী?’ তিনি এই কঠিন কাজ সাহিত্যে করে গেছেন সহজাত দক্ষতায়।
উল্লেখপঞ্জি
১. সুশান্ত মজুমদার, ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ছোটগল্প: নতুন স্বর, সুর ও আস্বাদ, পাক্ষিক ‘শৈলী’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা ১৯৯৭, পৃ. ৩১।
২. তত্রৈব, পৃ. ৩১
৩. সুধীর ঘোষ, ‘অল্প লেখার গল্পলেখক’, ‘মহাযান’ সাহিত্যপত্র, অক্টোবর ২০০৫, পৃ.৬৯ [৬৭-৭০]।
৪. ‘লেখকের দায়’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা, ২৮.৪.১৯৯৬, পৃ.৪
৫. তত্রৈব, পৃ.৪
৬. সুধীর ঘোষ, তত্রৈব, পৃ. ৬৮
৭. লেখকের দায়, তত্রৈব, পৃ. ৪
নোট: সুশান্ত মজুমদারের বক্তব্যের ভাবনির্যাস গ্রহণ করা হয়েছে মাসুদুল হকের লেখা প্রবন্ধ ‘আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের পাঁচ গল্প: নির্মোহ বাস্তবতার চালচিত্র’র প্রথম পৃষ্ঠা থেকে। ‘তৃণমূল’ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস সংখ্যা জানুয়ারি ১৯৯৮ পৃ. ২৪৬ [২৪৬-২৫৫]
► প্রচ্ছদে ব্যবহৃত ছবি ছবি তুলেছেন নাসির আলী মামুন © ফটোজিয়াম