আহমদ ছফার ‘মুসলমান’ বিচার
আমাদের চেতনার মৌল শক্তি কোথায় নিহিত তা বোঝা ও জানা যায় সাহিত্যের নানা শাখার সৃষ্টিশীল রচনায় এবং সংস্কৃতিতে রূপায়িত লোকসংস্কৃতির নানান উপাদান-উপকরণ ও কাহিনি বুননে। সংস্কৃতি আর সাহিত্য অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। জীবন-চেতনার ডালপালাগুলো অজস্র ভাবনার পাতায় আচ্ছাদিত। তারা মুক্ত-স্বাধীন জীবনাচারে অবারিত প্রাকৃতিক শুশ্রূষায় বয়ঃপ্রাপ্ত হয়ে থাকে। তবে সেই বয়ঃপ্রাপ্তির পেছনে যে কালচারাল হেগেমনি [সাংস্কৃতিক আধিপত্য] কাজ করে তা কোনো জনগোষ্ঠীর ছেড়ে আসা জীবন-সংস্কৃতির জোড়ালো প্রবাহের মধ্যে মিশে থাকে। যেমন, হিন্দু সংস্কৃতি বলে যাকে আমরা চিহ্নিত ও চিত্রিত করি, তার পেছনে কাজ করে উপমহাদেশীয় জীবনযাপন কাঠামোর পারিবারিক, সামাজিক ও উৎপাদন ক্রিয়ার চর্চিত আচার-আচরণ। ওই আচার-আচরণ তার বিশ্বাসের মর্মমূল থেকে উঠে আসে।
যাকে আজ আমরা ভারতীয় মিথ বলি, তা আসলে হিন্দু সম্প্রদায়েরই আচরিত রিচুয়াল-ধর্ম ও কাহিনিসূত্র। সেই আচারসর্বস্ব রিচুয়ালই পরবর্তীকালে মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকেরা গঠনগতভাবে অনুসরণ করেছে। কারণ ওই মুসলিম জনগোষ্ঠী ধর্মান্তরিত হয়েছিল। বহুধাবিভক্ত বর্ণপ্রথায় ত্যক্ত-বিভক্ত ও বিরক্ত, সামাজিকভাবে নিগৃহীত, অত্যাচারিত, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু শাসনের নিচে নিপীড়িত-শোষিত-বঞ্চিত নিম্ন আয়ের এবং নিম্নবর্গের ‘উৎপাদক’ হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল। ইসলাম তাদের মানবিক ও মানসিক মুক্তির পথ দেখালে, তারা একে সামাজিক ও মানবিক মুক্তির উপায় হিসেবে বিবেচনা করে এবং ধর্মান্তরিত হয়। ধর্মান্তরিত হবার পর তাদের অতীতে যাপিত জীবনাচারের লালিত স্বপ্ন নিজেদের অভিজ্ঞতা-কল্পনার অবারিত ধারায় এনে যোগ করে। এবং তাদের মনে জাগরূক থাকে উচ্চবর্ণের হিন্দু সম্প্রদায়ের বিত্তশালীদের অমানুষিক অত্যাচার-নিপীড়ন। তাদের মনে একধরনের প্রতিশোধ-ঘৃণা সুপ্তাবস্থায় জেগে থাকে। কারণ শত শত বছরের অস্পৃশ্য জীবন-সমাজ-বাস্তবতা থেকে মুক্ত হবার পর যখন বুঝতে পারে যে, তারা সামাজিকভাবেও সবার সমান, সমান মর্যাদার অধিকারী এবং ‘মানুষ’ হিসেবে গণ্য, যা মূলত নতুন ইসলাম ধর্মের মর্মবাণী, তখন তাদের মনের কোণে জেগে ওঠে প্রতিশোধ-স্পৃহা। সেই সময়কার মুসলিম লোককবিগণ ধর্মের কাহিনি বিনির্মাণে ফেলে আসা ধর্ম-সংস্কৃতির কাঠামোর আশ্রয় নেন। কারণ, তা তার অভিজ্ঞতার অন্তর্গত। ইসলাম ধর্মের আকাশচুম্বি মানবিকতার সৌন্দর্য ব্যাখ্যা ও বিবরণে তারা ব্যবহার করেন সেই অভিজ্ঞতাজাত ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসি হিন্দু ধর্মের দেবদেবীর অলৌকিক ক্ষমতা থেকেই অর্জন করেছে। মহাভারতের কাহিনিগুলোর কথা মনে রাখলেই আমরা ফ্যান্টাসির মূল খুঁজে পাবো। যেমন: সত্যবতী-পরাশর মুনির কাহিনি কিংবা কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে কৃষ্ণের অলৌকিক ক্ষমতা প্রদর্শন, কিংবা ইন্দ্র ও রোহিনীর প্রেমের বিষয়টি, অহল্যা কাহিনি অতি-অবারিত ভরা ফ্যান্টাসি। এই ফ্যান্টাসি মূলত মানুষের অবদমিত ক্ষমতার ভেতরে বাস করে প্রত্যাশা হিসেবে। মুসলমান পুঁথিকারগণ তাদের ধর্মের বীরপুরুষ ও নারীদের নির্মাণ করেন হিন্দু ফ্যান্টাসির মতো করে। তারা নির্মাণ করেন তাদের ধর্মের নতুন বীরপুরুষদের, যারা শৌর্যে-বীর্যে কেবল অনন্যই নয়, অনন্য তাদের অবাস্তবক্রিয়া-কর্মও। কারণ ওইসব নতুন ফ্যান্টাসির মূলে যে কাহিনি বর্ণিত হয় তা বাস্তবের হলেও কর্মে ও মর্মে ধর্ম সত্যের শৌর্য দেখানোই মূল উদ্দেশ্য। আর এর অনুকরণে হিন্দুধর্মী ফ্যান্টাসি বীর প্রতিস্থাপিত হয় মুসলিম ধর্মবীরদের দিয়ে। সেটাই করেছেন পুথিকারগণ এবং অলৌকিক ক্ষমতার জোরে বিধর্মী মানুষকে মুহূর্তে মুসলমান করে ফেলার চিত্রও তারা এঁকেছেন।
শহীদে কারবালার পুথিকার তেমনটাই করেছেন। কারবালার যুদ্ধ-ময়দান থেকে হযরত হোসেনের কর্তিত মস্তক নিয়ে সীমার যাচ্ছে দামেস্কে। সেখানে এজিদ অপেক্ষা করছেন হোসেনের কাটা মাথার জন্য। দামেস্কের পথে যেতে যেতে রাত নেমে আসে। বাধ্য হয়ে সীমারকে আশ্রয় নিতে হয় এক গেরস্তের বাড়িতে।
আহমদ ছফার বর্ণনায়—
গৃহকর্তার নাম পুথিলেখকের জবানিতে আজর। হিন্দু ধর্মাবলম্বী, তার উপর আবার ব্রাহ্মণ। সেই রাতে হজরত হোসেনের ছিন্ন মস্তক এক অলৌকিক কাজ করে ফেলল। গৃহকর্তা আজর, তার ব্রাহ্মণী, সাতপুত্র এবং সাত পুত্রবধূ একসঙ্গে কাটা মস্তকের মুখে কালেমা পড়ে মুসলমান হয়ে গেল।
[আহমদ ছফা/রচনাবলী-৪, পৃষ্ঠা ৩৩৯]
প্রথমত, কারবালা থেকে দামেস্কের পথ মরুময় এবং দীর্ঘ। এই পথে জনবসতি নেই বললেই চলে। তারপর সেখানে যদি কোনো বসতি থাকেও, তাকে আর যাই হোক আজর ব্রাহ্মণ হিন্দু হিসেবে বর্ণনা করা যায় না। মধ্যযুগে, মরুভূমিতে কোনো হিন্দুর বসতি থাকাটা যেমন অলৌকিক, তেমনি কর্তিত মাথার মুখে কালেমা পড়ে সেই ব্রাহ্মণ সংসারের সবার ইসলাম ধর্ম গ্রহণও এক ফ্যান্টাসি।
পুথি লেখক কেন এই ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিলেন, সে ব্যাখ্যাও দেয়া যেতে পারে। তার প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে হিন্দু ব্রাহ্মণকে সপরিবারে মুসলমান হিসেবে রূপান্তর করা। সেই সাথে ধর্মের অলৌকিক শক্তির প্রদর্শন। ইসলামে অতি-অলৌকিকতার কোনো জায়গা নেই। কিন্তু মুসলমান পুথিকারদের কাছে অলৌকিতা তাদের সংগুপ্ত অভীপ্সার অন্তর্গত। তারা চান ব্রাহ্মণ হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধ তুলতে। এ-কারণে স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনায় না নিয়ে তারা মরুভূমিতে ব্রাহ্মণের সংসার দেখিয়েছেন এবং হযরত হোসেনের কাটা মাথা থেকে উচ্চারিত কালেমা পড়ে সেই ব্রাহ্মণ পরিবার ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছে। ইসলামের এই প্রতাপ ও তার দিগ্বিজয়ী রূপ দেখাতেই এই রকম ফ্যান্টাসির আশ্রয় নিয়েছেন পুথিকার। এবং তারা মনে করতেন তাদের সমাজের বঞ্চিত-শোষিত মুসলিমরা এ-রকমটাই প্রত্যাশা করেন। সেই জনচেতনার কাব্যক্ষুধা নিরসনে ওই পুথিকারগণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
মুসলিম পুঁথিকারগণ ধর্মের উজ্জ্বল রূপ ও সাফল্য বর্ণনায় নিয়ে আসেন তার অভিজ্ঞতার ফসল ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের জনমানসের প্রত্যাশা, তাতে মিশে থাকে ফ্যান্টাসি। দরিদ্র ও অবহেলিত ওই ধর্মান্তরিত মানব সমাজ আর্থিকভাবে বর্ণবাদী হিন্দুদের সামাজিকভাবে মুখোমুখি করতে পারেনি কখনোই। কারণ, তাদের আর্থিক সামর্থ্য তেমন ছিলো না এবং সেই রকম শক্তি অর্জনও সহসাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি।
আহমদ ছফা © শিল্পকর্ম নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
আমি আগেই বলেছি— এই ফ্যান্টাসির ব্যুৎপত্তি হিন্দু ধর্ম ও তার সাংস্কৃতিক কাহিনিগুলো। মধ্যযুগের প্রত্যেক হিন্দু-রচিত কাহিনিকাব্যে বা পুঁথিতে এই ফ্যান্টাসি পাওয়া যায়। বড়ু চণ্ডীদাসে, কৃত্তিবাসী রামায়ণে, মানিক গাঙ্গুলির ধর্মমঙ্গলে, বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে, নারায়ণ দেবের পদ্মাপুরাণে, মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর চণ্ডীমঙ্গলে, ভারতচন্দ্রের অন্নদামঙ্গলে লোকরঞ্জক ফ্যান্টাসির ব্যবহার। গোটা হিন্দু ধর্মের কাহিনিগুলোতে যে-সব ফ্যান্টাসি আছে, সেখানে যুক্তির কোনো জায়গা নেই। মহাভারতের কাহিনিগুলোতে আমরা তা দেখতে পাব অজস্র ফ্যান্টাসি। সেখানে ধর্মগুরুদের অলৌকিকতা আকাশচুম্বি হলেও কোনো জ্ঞানবান তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন না। কারণ, ধর্মের জোশ ও বিশ্বাসের এই মিলিত কালচার একইভাবে মুসলমানদের চিন্তা ও সমাজে পর্যায়ক্রমে ঢুকে পড়েছে। সেখ ফয়জুল্লাহর গোরক্ষ বিজয়, শাহ মুহম্মদ সগীরের ইউসুফ জুলেখা, বাহরাম খানের লাইলী মজনু, দৌলত কাজীর সতী ময়না ও লোর চন্দ্রানী, দোনা গাজীর সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামান, মুহম্মদ কবীরের মধুমালতী, সৈয়দ সুলতানের নবীবংশ, নওয়াজিশ খানের গুলে-বকাওলী, সৈয়দ হামজার হাতেম তা-ই, গরীবুল্লাহর ইউসুফ জোলেখা ও জঙ্গনামা, হেয়াৎ মাহমুদের জঙ্গনামা ও সর্বভেদবাণী প্রভৃতি কাব্যে রয়েছে ফ্যান্টাসির ব্যবহার। তবে পুথিকারদের রচনায় যে-বিদ্বেষমূলক কাহিনিরূপ দেখা যায় তার মূলে রয়েছে বর্ণবাদী হিন্দুদের ওপর প্রতিশোধমূলক ঘটনার উপস্থাপনা। ঠিক এ-কারণেই মরুভূমিতে হিন্দু ব্রাহ্মণের পরিবারকে পাওয়া যায়, যা অবাস্তব, যা অবারিত কল্পনার ফসল।
২
মুসলিম পুঁথিকারগণ ধর্মের উজ্জ্বল রূপ ও সাফল্য বর্ণনায় নিয়ে আসেন তার অভিজ্ঞতার ফসল ও সামাজিক পরিপ্রেক্ষিতের জনমানসের প্রত্যাশা, তাতে মিশে থাকে ফ্যান্টাসি। দরিদ্র ও অবহেলিত ওই ধর্মান্তরিত মানব সমাজ আর্থিকভাবে বর্ণবাদী হিন্দুদের সামাজিকভাবে মুখোমুখি করতে পারেনি কখনোই। কারণ, তাদের আর্থিক সামর্থ্য তেমন ছিলো না এবং সেই রকম শক্তি অর্জনও সহসাই সম্ভব হয়ে ওঠেনি। আবার অন্যদিকে মুসলিম শাসক আর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে সাংস্কৃতিকভাবে দূরত্ব ছিলো মেরুদূর। শাসকদের সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ভাষা ছিলো ভিন্ন। যাকে আজ আমরা জানি ফারসি হিসেবে, উপমহাদেশের মুসলিম বাদশাদের কথ্যবুলি ও দরবারের ভাষা ছিলো সেই ফারসি। তুর্কি ভাষিক শাসকগোষ্ঠী কখনোই চায়নি বাঙালি মুসলমানদের মৌখিক ভাষা জানতে বা শিখতে। তেমনি বাংলামুলুকের মুসলিমদের রাজভাষা ফারসি শেখানোরও কোনো জোরালো উদ্যোগ আয়োজন ছিলো না। শাসকগোষ্ঠী নিজেদের সাংস্কৃতিক জীবনাচার নিয়ে, আর্কিটেকচার নিয়ে, বাগান চর্চা নিয়ে, খাদ্যাখাদ্যের গবেষণা ও তার রোশনাই বাড়ানো নিয়ে যতোটা যত্নবান ও তৎপর ছিলেন, মুসলিম জনগোষ্ঠীকে তাদের ভাষায় পারদর্শী করে তোলার কোনো উদ্যোগই নেয়নি। বরং তারা তুর্কির বদলে ফারসিকে রাজভাষায় রূপান্তরিত করেছে, বাংলা বা হিন্দিকে কাছে টেনে নেয়নি। তার বদলে তারা ফারসি ও হিন্দির মিশেলে জন্ম দিয়েছে উর্দু নামের মুসলমানি ভাষা। এ-ভাবেই শাসক ও শাসিতের মধ্যে রচিত হয়েছে ফারাক। কোনোভাবেই ফারসিভাষী শাসক বাংলাভাষী বাঙালির ইসলামি চেতনার কোনো খোঁজ নেয়নি। আবার ওইসব গরিব মুসলমানরাও ফারসি শিখে ইসলামি সভ্যতার ও সংস্কৃতির মৌল চিন্তা ও চেতনার কোনো জ্ঞান অর্জন করতে পারেননি। ফলে নতুন ধর্মের [ইসলাম] একেশ্বরবাদী সাংস্কৃতিক অভিমুখে তাদের কল্পনাকে তারা পুনর্নির্মাণের চেষ্টা চালাতে পারেনি। সেই প্রয়াসে বরং তাদের প্রধান অবলম্বন ছিলো অতীতে যাপিত জীবনের সাংস্কৃতিক বোধ-সত্তা।
মানুষ সেই প্রাণী, যার চিন্তার মধ্যে লালিত হয় তারই ফেলে আসা দিনগুলোর অভিজ্ঞান। এই নিয়মে ধর্মান্তরিত মুসলমানরা তাদের অর্জিত অভিজ্ঞতা [হিন্দু সংস্কৃতির অভিজ্ঞতা] দিয়ে তারা নতুন [ইসলামিক] ধর্মের সাংস্কৃতিক চেতনায় মিশিয়েছেন। ফলে যুক্তির চেয়ে আবেগায়িত কল্পনা তাদের নিয়ন্ত্রণ করেছে। হিন্দু ধর্মের পুথিকারদের রচনা [মঙ্গলকাব্য ও বৈষ্ণব কাব্য] পাঠ করলে দেখা যাবে, ওই অতিরঞ্জিত কল্পনার রূপারূপ এবং বাস্তব জীবনের অন্তরঙ্গতায়ও আছে ফ্যান্টাসির কারুকাজ।
আহমদ ছফা তাঁর বাঙালি মুসলমানের মন প্রবন্ধে এ-বিষয়টিই তুলে এনেছেন। তাঁর বাঙালিরা এ-যুগের নয়, মানে আহমদ ছফার যুগের নয়। এমন কি যাকে আমরা আধুনিক বলে চিহ্নিত করেছি, সে যুগের বাঙালিও নয়। তারা বাংলার মধ্যযুগের বাঙালি পুঁথিকার। সেইসব পুথির রচয়িতাদের অবাধ কল্পনা ও তাদের রচনার নায়কের অপরিসীম ক্ষমতার অলৌকিকতার বর্ণনাই তারা দিয়েছেন। সেইসব বর্ণনায় আরব দেশের প্রাকৃতিক পরিবেশে স্থাপন করেছেন বাঙালি হিন্দুকে অবলীলায়।
আহমদ ছফার এই বিচার প্রায় যথার্থই বলে বিবেচিত হবে, তবে এ-ক্ষেত্রে কেবল বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষী বা দায়ী করা পুরোপুরিভাবে ঠিক হবে না। কারণ জনগোষ্ঠীর মুসলিম অংশ চেষ্টা করেছে শাসকদের সাথে অন্তরঙ্গ হতে, শাসকদের প্রশাসনিক অংশীদার হতে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর মননে সেই প্রেরণা জাগেনি যে, বাংলার ওই মুসলমানদের জন্য তাদের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদেরকে প্রশাসনের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন, সেই সব হিন্দুদেরই রাজ কাজে নিয়োগ করেছেন।
আহমদ ছফা © শিল্পকর্ম রাজীব শীল
৩
আহমদ ছফার বাঙালি মুসলমানের মন বিশ্লেষণে এক কথায় অসাধারণ। কীভাবে বাঙালি মুসলমান পুথিকারগণ এমন ধারার কাব্য-কাহিনি নির্মাণ করেছেন তার ব্যাখ্যাও তিনি দিয়েছেন।
পুথি সাহিত্যের মধ্যেও আমরা দেখতে পাই, বাঙালি আদিম কৃষিভিত্তিক কৌমসমাজের মনটি রাজশক্তির আনুকূল্য অনুভব করে হুংকার দিয়ে ফণা মেলে জেগে উঠেছে। কিন্তু ঐ জেগে ওঠাই সার, সে মন কোনো পরিণতির দিকে ধাবিত হতে পারেনি। প্রতিবন্ধকতা সামাজিক সংগঠনের মধ্যেই ছিল। সমাজ সংগঠন ভেঙে ফেলে নব-রূপায়ণ তারা ঘটাতে পারেননি। কারণ মুসলিম শাসকেরাও স্থানীয় জনগণের মধ্য থেকে যে নেতৃশ্রেণী সংগ্রহ করেছিলেন, তাদের মধ্যে বাঙালি মুসলমান প্রতিনিধিত্ব একেবারেই ছিল না বললেই চলে। অন্যদিকে ভাষাগত, সংস্কৃতিগত, রুচি এবং আচারগত দূরত্বের দরুন শাসকশ্রেণীর অভ্যাস, মনন রপ্ত করতে গিয়ে বার বার ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে বাঙালি মুসলমান।
[বাঙালি মুসলমানের মন: আহমদ ছফা রচনাবলী ৪, পৃষ্ঠা ৩৫৫]
আহমদ ছফার এই বিচার প্রায় যথার্থই বলে বিবেচিত হবে, তবে এ-ক্ষেত্রে কেবল বাঙালি মুসলিম সম্প্রদায়কে দোষী বা দায়ী করা পুরোপুরিভাবে ঠিক হবে না। কারণ জনগোষ্ঠীর মুসলিম অংশ চেষ্টা করেছে শাসকদের সাথে অন্তরঙ্গ হতে, শাসকদের প্রশাসনিক অংশীদার হতে, কিন্তু শাসকগোষ্ঠীর মননে সেই প্রেরণা জাগেনি যে, বাংলার ওই মুসলমানদের জন্য তাদের একটি সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ নেয়া জরুরি। তারা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে যাদেরকে প্রশাসনের জন্য উপযুক্ত বিবেচনা করেছেন, সেই সব হিন্দুদেরই রাজ কাজে নিয়োগ করেছেন। এবং তাদেরকে আরবি ও ফারসিতে উপযুক্ত করে নিয়েছেন। শাসকদের মননক্রিয়া ছিলো এ-রকম : শাসন কাজে যারা উপযুক্ত, তারা ধর্মে-মর্মে কি তা তাদের কাছে জরুরি নয়। তাদের স্বার্থ হাসিলে তারা যোগ্য হলেই আর কোনো সমস্যা নেই। তবে ভারতের পশ্চিমাংশের মানুষেরা মুসলমান শাসক মোঘল ও পাঠানদের আনুকূল্য পেয়েছেন। তার কারণ তারা অনেকটাই ফারসির সাথে পরিচিত ছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের বাঙালি মুসলমানের সাথে শাসকদের মনে কোনো রকম ধর্মীয় মানসিকতার যোগ ছিলো না বা তারা সেটা অনুভব করেননি। আরবি-ফারসি না জানার ফলেই এখানকার পুথিকারদের আশ্রয় নিতে হয়েছে কল্পনার। জনশ্রুতি ও লোকশ্রুতির গল্পগুলোকেই আরো রঙিন করে উপস্থাপন করেছেন তারা। কারণ তারা মনে করতেন মুসলিম জনগোষ্ঠী এ-সব ফ্যান্টাসির ভেতর দিয়ে ইসলামি নায়কদের শৌর্য-বীর্য অনুধাবন করতে পারবেন।
‘বাঙালি মুসলমান সমাজ স্বাধীন চিন্তাকেই সবচেয়ে ভয় করে। তার মনের আদিম সংস্কারগুলো কাটেনি’—আহমদ ছফার এই বিচার যথার্থ। বাঙালি মুসলমান তার চেতনা প্রসারের ক্ষেত্রে খুব সংকীর্ণ। ইসলাম ধর্মের নানান রকম বিচার বিশ্লেষণে তার মন সায় দেয় না। ফলে বাংলাদেশে ইসলাম অনেকটাই স্ট্যাটিক হয়ে পড়েছে। কোরআনের বিচার-বিশ্লেষণ ও এর সাংস্কৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব কত ব্যাপক হতে পারে, কত দিগন্ত উন্মোচনকারী হতে পারে, এর রূপারূপ কত ব্যাপক ও বিশাল সৌন্দয্য সৃষ্টির আকর হতে পারে—তা আমরা করে দেখাতে প্রস্তুত নই। বাঙালি মুসলমানের এই সীমাবদ্ধতাই আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় বাধা। আর আজকের বাঙালি মুসলমান তো এমন এক সাংস্কৃতিক আধিপত্যের মধ্যে নিপতিত যে, সেই ঘোর থেকে বেরিয়ে আসার পথ খুঁজে পাওয়াও দুরূহ। ইসলাম আর আকরগ্রন্থ কোরআন যে মুক্তচেতনার, নিজেকে উসকে দিয়ে নতুন চিন্তা আর ভাবনার মৌল শিখা জ্বালাবার পথ-প্রদর্শক হতে পারে, সেটাই বাঙালি মুসলমানের মনে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি। আমাদের উচিত কোরআনিক জ্ঞান নতুন করে আবিষ্কার করা। ♦
নোট: প্রতিকৃতি দুটি আহমদ ছফা: বাছাই জবাব [চন্দ্রবিন্দু প্রকাশনী] বই থেকে নেওয়া হয়েছে।
এদেশের মানুষের কাছে ইসলাম ছিল নতুন একটি ধর্ম। ইসলামের মাধ্যমে এঅঞ্চলের মানুষদের আধ্যাত্বিকতার পরিচয় ঘটে। স্বাভাবিক ভাবেই, নিজের মতো করে ধর্মিয় আবহকে চিন্তা করবে এটাই বাস্তব। মৌলবি আহমদ ছফা সরল ভাবে এবং সম্ভবত প্রথম এই তত্ত্বটি প্রকাশ করেন।
মাসুদ পারভেজ
জুলাই ১০, ২০২১ ১০:৪৮
এই কথাটি কোন হুজুরকে বললে তার সঠিকতা বোঝা যেত “ইসলাম আর আকরগ্রন্থ কোরআন যে মুক্তচেতনার, নিজেকে উসকে দিয়ে নতুন চিন্তা আর ভাবনার মৌল শিখা জ্বালাবার পথ-প্রদর্শক হতে পারে, সেটাই বাঙালি মুসলমানের মনে বিশ্বাস স্থাপন করতে পারেনি।”
শারমিন
জুলাই ২৫, ২০২১ ১৯:৩৩
বিশ্লেষণ ভালো লেগেছে। আহমদ ছফার লেখাটা আবার পড়তে উদ্বুদ্ধ হচ্ছি। বাঙালি মুসলমানদের আত্মনিরীক্ষা যে প্রয়োজন, এই লেখা পড়ে তা স্পষ্ট হয়েছে। লেখককে ধন্যবাদ।
Kazi Nasir Mamun
জুলাই ০৪, ২০২১ ০২:২৯