টি. এস. এলিয়টের নতুনধারার ভাষাভাবনা

 

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া ব্রিটিশ কবি টি. এস. এলিয়ট [১৮৮৮-১৯৬৫]-এর দ্য লাভ সং অফ জে. আলফ্রেড প্রুফর্ক বা স্রিফ প্রুফর্ক আধুনিক সাহিত্যে একটি অসামান্য কীর্তি হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। মুক্তছন্দের এই কবিতার নতুনধারার কাঠামো, নৈর্ব্যক্তিক প্রকাশ এবং লৌকিক ভাষার ব্যবহারের কারণেই প্রকাশিত হওয়ার প্রায় একশ বছর পরেও কবিতাটির আবেদন সামান্যতমও কমেনি। প্রায় একশ বছর ধরে পাঠকেরা যেসব উচ্চমার্গের কবিতা পাঠ করেছেন, আলাপ-আলোচনা করেছেন; গবেষকেরা যেসব কবিতা নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ লিখেছেন, সেসব কবিতার একটি তালিকা তৈরি করলে তার পয়লা দিকেই এই কবিতার অবস্থান থাকবে। ইতিহাস বলছে, হার্ভার্ড কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর টি. এস. এলিয়ট যখন ১৯১০ সালে সেখানকার দর্শন বিভাগে গবেষণা-সহকারী পদে কাজ করছিলেন, তখন কবিতাটি রচনা করেছিলেন তিনি। কাছাকাছি সময়ে হার্ভার্ড অ্যাডভোকেট-এ কবিতাটির কিয়দংশ ছাপা হয়। পরে শিকাগোর পোয়েট্রি: ম্যাগাজিন অব ভার্স-এ ১৯১৫ সালে ছাপা হয় পুরো কবিতা। এর আগের বছরেই তিনি তাঁর দর্শনবিষয়ক গবেষণা [নলেজ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স ইন দ্য ফিলোসফি অব এফ এইচ ব্রাডলি, যে গবেষণাটি ডিফেন্ড করার জন্য এলিয়ট আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে যাননি; অক্সফোর্ড থেকে লন্ডনে গিয়ে খুঁটি গেড়েছিলেন] চালিয়ে যাবার জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেট্রোন কলেজের সাথে যুক্ত হয়েছেন। উল্লেখ্য, ১৯১৭ সালে লন্ডন থেকে প্রকাশিত তাঁর প্রথম বই প্রুফর্ক অ্যান্ড আদার অবজার্ভেশন-এ এই কবিতা স্থান পায়। তখন থেকেই কবিতাটি ঈর্ষণীয় সাফল্যের মুখ দেখতে শুরু করে। পাঠক এবং সমালোচকদের বৃত্তে ঐকমত্য গড়ে ওঠেএলিয়ট তাঁর প্রুফর্ক কবিতার মধ্য দিয়ে আধুনিক কবিতার যুগের সূচনা করলেন। এতক্ষণ যেসব তথ্য হাজির করা হলো, তা আমাদের অজানা কিছু নয়। এই প্রবন্ধে যেটা বলার সেটা হলো, প্রুফর্ক নামের আপাদমস্তক একজন শহুরে নায়কের যুগযন্ত্রণা, তার বিভ্রান্তি এবং তার নিশ্চলতা কবিতায় তুলে ধরার জন্য এলিয়ট নতুনধারার কাব্যরীতি খুঁজে নিয়েছিলেন। তার পাশাপাশি যুগোপযোগী একটা ভাষাও তৈরি করে নিয়েছিলেন তিনি। সে ভাষা উত্তর আমেরিকার গণমানুষের মুখের ভাষার প্রতিচ্ছবি বৈ আর কিছু নয়।

স্বাভাবিকভাবেই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগবে: এলিয়ট কেন তাঁর কবিতা প্রুফর্ক-এ উত্তর আমেরিকার লৌকিক ভাষা প্রয়োগ করতে গেলেন? অতীতের দার্শনিক এবং সাহিত্যিকদের ভাষাবিষয়ক চিন্তাভাবনা এবং প্রয়োগ কি তাকে উজ্জীবিত করেছিল? কোন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে এলিয়টের মনে এসেছিল যে আধুনিক সময়ের একজন নায়কের প্রবণতাগুলো পাঠকের সামনে উপস্থাপন করতে হলে যুগের সঙ্গে তাল মেলানো একটা কাব্যভাষা তৈরি করে নেওয়াটাই শ্রেয়?

লিরিক্যাল ব্যালাডস্-এর মুখবন্ধে প্রথমবারের মতো রোমান্টিক যুগ [আনুমানিক ১৮০০-১৮৫০]-এর কবিতার দর্শন নিয়ে আলোচনা করেছিলেন উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ। সেটা ১৮০২ সালের কথা। রোমান্টিক যুগের কবিদের এই কাব্যদর্শন বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত ইংল্যান্ডে প্রভাব বিস্তার করেছিল, এমনকি ইংরেজি ভাষাভাষী উত্তর আমেরিকাতেও। নয়া কাব্যতত্ত্ব এবং কাব্যরীতি সম্পর্কে আলোচনা করার সময় ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ বলেছিলেন, তদগত অবস্থার একজন কবির ভেতরে প্রকৃতির বিভিন্ন বস্তু এবং মানুষ আপনাতেই সুগভীর ভাবনার সঞ্চার করতে পারে, যা কিনা সেই কবির ভেতরে উদ্দীপনার জন্ম দেয় এবং তিনি তখন তার সেই আবেগকে কবিতার ভাষায় অনুবাদ করেন। এখানে কবি একজন মহামানব ছাড়া আর কিছুই ননতিনি একজন গভীর চিন্তক, তিনি ভীষণ একজন বুঝমান মানুষ, যিনিই কেবল জানেন, মনুষ্যসমাজের জন্য কোন আবেগটিকে কবিতায় অনুবাদ করতে হবে। রোমান্টিক যুগের কাব্যদর্শনের বিষদ আলোচনায় না গিয়ে এটুকু বলা যায় যে তাঁর ট্র্যাডিশন অ্যান্ড ইনডিভিজুয়াল ট্যালেন্ট [১৯১৯] শীর্ষক প্রবন্ধে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কাব্যতত্ত্বের এই ধারণার বিরোধিতা করেছিলেন এলিয়ট। এর মাঝের একশ বছর মতো সময়কালে রোমান্টিক যুগের কাব্যদর্শন এবং কাব্যকলার বড় কোনো সমালোচনা করেনি কেউ। এলিয়ট যুক্তি দিয়েছিলেন, আসলে একজন কবিকে নিজের ভেতরের আবেগ দ্বারা তাড়িত না হয়ে বরং তাঁকে নৈর্ব্যক্তিকই হতে হয়। অর্থাৎ কাব্যসৃষ্টি কোনো আত্মগত প্রক্রিয়া নয়। একজন কবি তাঁর পূর্ববর্তী কবি ও লেখকদের কাজ লক্ষ করবেন, তিনি নির্ভর করবেন নিজের জাগতিক অভিজ্ঞতার ওপরেআবেগের ওপরে নয় এবং তারপর তিনি একজন অনুঘটক হিসেবে তাঁর অনুভূতি প্রকাশ করবেন নিজের কবিতায়। কিন্তু কোন ধরনের ভাষায় একজন কবি পাঠকের কাছে তাঁর নিজের আবেগ বলুন বা তাঁর জাগতিক অভিজ্ঞতাই বলুন, কবিতা আকারে প্রকাশ করবেন বা নৈর্ব্যক্তিকভাবে একজন অনুঘটক হিসেবে তা উপস্থাপন করবেন?

ঊনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইংল্যান্ডের রোমান্টিক কবি উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ, সামুয়েল টেইলর কোলরিজ প্রমুখ রোমান্টিক কবি ধ্রুপদি সাহিত্যের বিপরীতে দাঁড়িয়ে কবিতায় গ্রামীণ জীবনঘনিষ্ঠ সহজ, সরল একটা ভাষা তৈরি করেছিলেন। লিরিক্যাল ব্যালাডস্-এর মুখবন্ধ [১৮০২]-তে কাব্য রচনার জন্য প্রয়োজনীয় ভাষা নিয়ে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ বলেছিলেন, একজন কবিকে তাঁর আত্মগত অনুভূতি প্রকাশের জন্য লাগসই একটা ভাষা খুঁজে নিতে হয়। সাহিত্যের ভাষাবিষয়ক তাঁর প্রস্তাবনাটা এমন ছিল: প্রকৃতির কোলে বেড়ে ওঠা গ্রামীণ মানুষজন যে নিরাভরণ ভাষাতে নিজেদের ভেতরে ভাবের আদান-প্রদান করে থাকে, সেই সহজ, সরল ভাষাতেই আসলে কবিতা লেখাটা শ্রেয়। তিনি যুক্তি দিচ্ছেন, গ্রামের মানুষজনের মুখের ভাষা [শহুরেদের মৌখিক ভাষার মতোই] তৈরি হয় তাদের পৌনঃপুনিক অভিজ্ঞতা এবং অনুভূতির ভেতর দিয়ে। স্বভাবে তা অনেক বেশি দার্শনিক এবং তা সুদীর্ঘকাল ধরে ভাববিনিময়ের জন্য ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রামের মানুষজনের এমন সহজ, সরল ভাষাতে উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ লিখেছিলেন তাঁর বিখ্যাত কবিতা—‘টিনটার্ন অ্যাবে [১৭৯৮] এবং দ্য ইডিয়ট বয় [১৭৯৮]; সামুয়েল টেইলর কোলরিজ লিখেছিলেন—‘দ্য রাইম অব দ্য অ্যানশান্ট মেরিনার [১৭৯৮] এবং কুবলা খান [১৮১৬]; উইলিয়াম ব্লেক লিখেছিলেন জেরুসালেম [১৮০৪], দ্য লিটিল ব্লাক বয় এবং দ্য ল্যাম্ব [১৭৮৯] ইত্যাদি। এখানে বলতেই হয় যে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ বা কোলরিজ বা ব্লেকএঁরা কেউ নিশ্চয় ভাবেননি যে উনিশ শতকের মাঝামাঝি গিয়ে তাঁদের ইংল্যান্ড গ্রামীণ অর্থনীতির বৈশিষ্ট্য হারিয়ে ফেলতে শুরু করবে এবং সেখানে ব্যাপকভাবে শুরু হয়ে যাবে নগরায়ণ। নগরের মানুষ কি আর গ্রামের মানুষদের সহজ, সরল লৌকিক ভাষায় লিখা কবিতা আর পড়বে? এসব প্রশ্নই নিশ্চয় ভাবিত করেছিল এলিয়টকে। আমরা মনে করি, উত্তর আমেরিকার অর্থনীতি বাদেও ইংল্যান্ডের অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের প্রকৃতিও ঠিকঠাকভাবে বুঝেছিলেন এলিয়ট। নিশ্চয় এ কারণেই তিনি সাহিত্য রচনার জন্য ইংরেজি ভাষাভাষী শহুরে মানুষের রুচির অনুরূপ সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাষার সন্ধান করেছিলেন; তিনি আস্থা রেখেছিলেন উনিশ শতকের মাঝামাঝি থেকে বিশ শতকের পয়লা দিকের নাগরিক মানুষের লৌকিক ভাষার ওপরে। ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ এবং এলিয়টের ভাষাভাবনার মিলটা হলো এই যে তাঁরা দুজনেই কাব্যরীতিতে লৌকিক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন; আর অমিলটা হয়ে গেল লৌকিক ভাষার চেহারার ওপরেওয়ার্ডস্ওয়ার্থের কাব্যভাষা যেখানে সহজ, সরল, নিরাভরণ; সেখানে এলিয়টের কাব্যভাষা শহুরে লৌকিক ভাষার অনুগামীচটকদার, অপেক্ষাকৃত জটিল, রহস্যময়।

কাব্যে গণমানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি একটা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কিত এলিয়টের চিন্তাভাবনার ওপরে ইতালির কবি দান্তে আলিঘেইরি [১২৬৫-১৩২১] এবং ইংল্যান্ডের দার্শনিক ফ্রান্সিস হার্বার্ট ব্রাডলি [১৮৪৬-১৯২৪]-র সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। আইডিয়ালিস্ট স্কুলের সদস্য ব্রাডলি তাঁর বন্ধুদের মতোই মনে করতেন, মানুষের ভাবনা আসলে বিমূর্ত প্রপঞ্চ, যা কিনা নির্ভর করে বর্তমানের ভাষার কাঠামোর ওপরে এবং তিনি এ-ও ভেবেছেন, মানুষের অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত হয় তার সমস্ত চিন্তাভাবনা। তাই তার বর্তমানের চিন্তাচেতনাই তার কাছে মূর্ত হয় নিজের বাস্তবতা হিসেবে আর ভাষার মাধ্যমেই তার আজকের চিন্তাচেতনা প্রকাশিত হয়, পাল্টেও যায়। আইডিয়ালিস্ট স্কুলের সদস্য ব্রাডলি শব্দের সাথে যেসব দ্ব্যর্থকতা থাকতে পারে, সেগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য একটি ফ্রেমওয়ার্ক দাঁড় করিয়েছিলেন, যেটা পরে ভাষার দর্শন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছিল। বার্ট্রান্ড রাসেলের ভাষাবিষয়ক প্রাথমিক চিন্তার ওপরে ব্রাডলির কাজের প্রভাব পড়েছিল বলে জানা যায়। পরে অবশ্য তাঁদের মত ও পথ আলাদা হয়ে গিয়েছিল। এতগুলো কথা বলার কারণ এই যে হার্ভার্ড কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে এলিয়ট যখন ১৯১০ সালে সেখানকার দর্শন বিভাগে গবেষণা-সহকারী পদে নিয়োজিত ছিলেন, তখন তিনি নলেজ অ্যান্ড এক্সপেরিয়েন্স ইন দ্য ফিলোসফি এফ. এইচ. ব্রাডলি শীর্ষক গবেষণায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। আইডিয়ালিস্ট ব্রাডলির ভাষাবিষয়ক ধারণার সঙ্গে সুর মিলিয়ে এলিয়ট ভাবছিলেন যে মানুষের অভিজ্ঞতা আসলে নির্ভর করে মানুষের উদ্ভাবিত ভাষাকাঠামো এবং শব্দের ওপরেই। তাই কোনো শব্দ শুনলে বা তার লিখিত রূপ চোখে পড়লে আমাদের মনে ভেসে ওঠে শব্দের সাথে সম্পর্কিত আমাদের নিজস্ব অভিজ্ঞতা। শব্দসঞ্জাত মানুষের এসব অভিজ্ঞতার পেছনে লুকিয়ে আছে চারটি উপাদানমানুষের অনুভব, তার নিজস্ব মতামত, মনোযোগ এবং সময়। এই যুক্তিতে তিনি বলছেন, উদ্ভাবিত ভাষা ও শব্দ বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে গতিময় বলে সময়ের সঙ্গে তা পরিবর্তিত হয়ে যায়। এলিয়টের সাথে সুর মিলিয়ে এই প্রসঙ্গে আমরা বলতে চাই, ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ কাব্যে যে সহজ, সরল ভাষা ব্যবহারের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন, সময়ের সাথে তা স্থির কিছু নয়সময়ই নির্ধারণ করে দেবে মানুষের ভাব প্রকাশের ভাষা ও শব্দের চেহারা। প্রুফর্ক-এ গতিময় ও জটিল ভাষার ব্যবহার তাই ভুঁইফোড় কোনো ঘটনা নয়। একই যুক্তিতে আমরা বলতে পারি, ভবিষ্যতে এলিয়টের প্রুফর্ক-এর গতিময় ভাষাও আবেদন হারিয়ে ফেলতে পারে এবং তখন উত্তরাধুনিক যুগের ব্যক্তির মনকে উপস্থাপন করার জন্য নতুনতর ভাষা উদ্ভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়।

কাব্যে গণমানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি একটা ভাষার ব্যবহার সম্পর্কিত এলিয়টের চিন্তাভাবনার ওপরে ইতালির কবি দান্তে আলিঘেইরি [১২৬৫-১৩২১] এবং ইংল্যান্ডের দার্শনিক ফ্রান্সিস হার্বার্ট ব্রাডলি [১৮৪৬-১৯২৪]-র সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষ করা যায়। আইডিয়ালিস্ট স্কুলের সদস্য ব্রাডলি তাঁর বন্ধুদের মতোই মনে করতেন, মানুষের ভাবনা আসলে বিমূর্ত প্রপঞ্চ, যা কিনা নির্ভর করে বর্তমানের ভাষার কাঠামোর ওপরে এবং তিনি এ-ও ভেবেছেন, মানুষের অভিজ্ঞতা থেকেই উৎসারিত হয় তার সমস্ত চিন্তাভাবনা।

সাহিত্যে ভাষার ব্যবহার সম্পর্কিত এলিয়টের চিন্তাভাবনার ওপরে কোমেডিয়া মহাকাব্যের কবি ইতালির দান্তে অ্যালিগেরি প্রভাব বিস্তার করেছিলেন বলে আমরা মনে করি। একথা স্মরণ করা যেতে পারে যে আনুষ্ঠানিক সাহিত্যে গণমানুষের মুখের ভাষার গুরুত্ব এবং তার প্রয়োগের ওপরে দান্তে অন দ্য ভালগার টাং [ডি ভালগারি এলোকোয়েন্তা] [১৩০২-০৫] শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁর ভাষাভাবনা প্রকাশ করেছিলেন। সাহিত্যে সর্বজনগ্রাহ্য একটি ভাষা ব্যবহারের পক্ষে দান্তে কেবল যুক্তি দিয়েই ক্ষান্ত হননি, তিনি তাঁর মহাকাব্য কোমেডিয়া-তে সে কাজটি করেও দেখিয়ে গেছেন। কোমেডিয়া লেখা হয়েছিল তাঁর নিজের এলাকা তোস্কানার গণমানুষের মুখের ভাষায়। তখনকার রেওয়াজ অনুযায়ী তিনি খোদ লাতিনে কবিতা লিখেননি। দান্তের প্রতিভায় মুগ্ধ এলিয়ট তাঁর প্রবন্ধ দান্তে [১৯২৯]-তে বলেছেন, সাহিত্যে দান্তে যে কমন ল্যাংগুয়েজ বা সর্বসাধারণের ভাষা-র ধারণা প্রযুক্ত করেছেন এবং চর্চাও করেছেন তার সৌন্দর্য তুলনাহীন। কেননা তা ড্রাইডেন বা পোপের ভাষার চেয়েও মাটির কাছাকাছি একটি ভাষা। এমন একটি প্রাণবন্ত, সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার সামনে রোমান্টিক যুগের ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ বা কোলরিজ বা ব্লেকের মতো কবিদের তৈরি করে নেওয়া সহজ-সরল গ্রামীণ ভাষা তাঁর কাছে পানসে বলেই মনে হয়েছিল। তিনি মন্তব্য করেছিলেন, ইলিংশ রোমান্টিক যুগের কবি আলফ্রেড টেনিসন [১৮০৯-৯২] এ কারণেই একজন প্রতিনিধিত্বমূলক ইলিংশ কবি হয়ে উঠতে পারেননি।

এলিয়টের সামনে সাহিত্যে লৌকিক ভাষা প্রয়োগের ব্যাপারে আরও কিছু উদাহরণ ছিল বলে ধারণা করা যায়মার্টিন লুথারের করা নিউ টেস্টামেন্ট-এর অনুবাদ [১৫২২] এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কথাশিল্পী মার্ক টোয়েনের সাড়া জাগানো উপন্যাস দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন [১৮৮৪]। হিব্রু এবং প্রাচীন গ্রিক ভাষা থেকে জার্মানদের লৌকিক ভাষায় বাইবেলের অনুবাদ করেছিলেন মার্টিন লুথার। আমরা স্মরণ করতে পারব, মার্টিন লুথারের আগে বাইবেলের যতগুলো অনুবাদ হয়েছিল, সবই করা হয়েছিল ক্যাথলিক চার্চ প্রবর্তিত দাপ্তরিক লাতিন ভাষায়। এদিকে মার্ক টোয়েন তাঁর উপন্যাস দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন রচনা করেছিলেন উত্তর আমেরিকায় অভিবাসিত ইউরোপীয় মানুষদের লৌকিক ইংলিশ ভাষায়। জানা যায়, শৈশবে এলিয়টের পছন্দের বইগুলোর অন্যতম ছিল এই বই। একথা অবশ্য স্মরণ করতেই হবে যে দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব হাকলবেরি ফিন-এ বর্ণবাদদুষ্ট বিস্তর আঞ্চলিক এবং স্ল্যাং ব্যবহার করা হয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা প্রয়োগ করে দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফর্ক লেখার বেলাতে এই মারাত্মক ভুল করেননি এলিয়ট।  

এ প্রসঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুজন পুরোধা কবির নাম উল্লেখ করতে চাই আমরাওয়াল্ট হুইটম্যান [১৮১৯-১৮৯২] এবং এমিলি ডিকেনসন [১৮৩০-১৮৮৬]। এঁরা দুজনেই বয়সে এলিয়টের চেয়ে বড়। এলিয়টের আগেই এই দুজন মার্কিন কবি তাঁদের কবিতাতে কখনো কখনো লৌকিক ভাষা এবং স্ল্যাং ব্যবহার করেছেন। তাঁদের ব্যবহৃত সেসব শব্দ তখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কোনো অভিধানে ঠাঁইও পায়নি। অ্যাংলো-সেক্সনদের ইংলিশ শব্দ এবং লাতিন অথবা ফরাসি উৎস থেকে ধার করা বিভিন্ন শব্দ তাঁদের ব্যবহৃত লৌকিক শব্দ থেকে অনেক দূরেরই বলতে হবে। সাহিত্যে এমন অপ্রচলিত ভাষা ব্যবহারের সৌন্দর্য সম্পর্কে ওয়াল্ট হুইটম্যানের অন্তত দুটো সাড়া জাগানো প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল—‘স্ল্যাং ইন আমেরিকা [১৮৮৫] এবং অ্যান আমেরিকান প্রিমিয়ার [১৯০৪]। এমিলি ডিকেনসন সম্ভবত তাঁর নয়া ভাষাভাবনা নিয়ে এমন কোনো প্রবন্ধ লিখেননি। এলিয়টের আগের জমানার এ দুজন কবি এলিয়টকে কবিতাতে সর্বজনগ্রাহ্য ভাষার অবতারণা করতে প্রলুব্ধ করেছিল কি না, তা অবশ্য পরিষ্কার নয়। এলিয়ট তাঁর নিজের কাজের ওপরে তাঁর দেশের পুরোধা কবি হুইটম্যানের ফ্রি মিটার এবং লৌকিক ভাষার প্রভাব সম্পর্কে কিছুই উল্লেখ করেননি। সাহিত্যের ট্র্যাডিশন বা পরম্পরা খুঁজতে গিয়ে তিনি বরং ইউরোপীয় সাহিত্যিকদের নিয়ে আলোচনাতেই সময় ব্যয় করেছেন। তবে বলতেই হবে যে এলিয়ট বা এজরা পাউন্ডের আগেই ওয়াল্ট হুইটম্যানই প্রথম ইংজেজি সাহিত্যে মুক্ত ছন্দ ব্যবহার করে দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলেন এবং তা সাফল্যও পেয়েছিল [এমিলি ডিকেনসন বরাবরই তাঁর কবিতায় আঁটোসাঁটো কাঠামো ব্যবহার করেছেন]। হুইটম্যানের এই প্রচেষ্টা এলিয়টকে উদ্দীপিত করেছিল কি না, সে সম্পর্কেও তেমন কিছু জানা যায় না। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, এলিয়ট স্বয়ং তাঁর একটি প্রবন্ধে [হুইটম্যান অ্যান্ড টেনিসন, ১৯২৬] আরবান আমেরিকার জাতীয়তাবাদ ও বস্তুবাদী অভিযাত্রা নিয়ে হুইটম্যানের গর্ব প্রকাশের ব্যাপারটা নিয়ে তীব্র সমালোচনাই করেছিলেন। এলিয়ট যুক্তি দিয়েছিলেন, আরবান আমেরিকার জাতীয়তাবাদ ও বস্তুবাদী অভিযাত্রা নিয়ে আসলে গর্বের কিছু নেই, যে গর্ব ছড়িয়ে আছে হুইটম্যনের সং অব মাইসেল্ফ কবিতায়, কেননা এই অগ্রযাত্রা আদতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষের জীবনকে সঙিনই করে তুলেছে, জটিল বানিয়ে দিয়েছে। উত্তর আমেরিকার ইতিহাসের দিকে তাকালে এলিয়টের এই প্রত্যক্ষণকে খারিজ করে দেওয়া যায় না। তবে এটা মানতেই হবে, বস্তুবাদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই জটিল বাস্তবতাই এলিয়টকে প্রলুব্ধ করেছিল সম্পূর্ণ নতুন একটা ভাষায় প্রুফর্ক রচনা করতে।

টি. এস. এলিয়ট © ছবি: উইকিপিডিয়া

আমরা এতক্ষণ লৌকিক ভাষায় সাহিত্য রচনা নিয়ে এলিয়টের ভাবনা এবং তাঁর ওপরে পূর্ববর্তী লেখকদের প্রভাব আদৌ পড়েছিল কি না, তা নিয়ে আলোচনা করেছি। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা ইতিহাস ও সমাজের গতিময়তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রুফর্ক নামের চরিত্রটিকে একটু বোঝার চেষ্টা করব। আমাদেরকে মানতেই হবে যে চরিত্র চিত্রণের প্রয়োজনে নিজস্ব প্রকরণ ও ভাষা তৈরি করে নেওয়াটাই সমীচীন। এ কারণেই নিশ্চয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্গঠনের সময়কাল [আনুমানিক ১৮৬৫ থেকে ১৯১৪ পর্যন্ত]-এর একজন খেটে খাওয়া মানুষের মন আঁকতে গিয়ে সেখানকার সাধারণ মানুষের মুখের ভাষার কাছাকাছি একটি ভাষা খুঁজে নিয়েছিলেন এলিয়ট। প্রুফর্ক নামের সেই মানুষটিকে খেটে খাওয়া মানুষ বলে ধরে নেওয়ার পেছনে কারণ একটাই: দ্য লাভ সং অব জে.. আলফ্রেড প্রুফর্ক-এ নায়ক সস্তা হোটেল, ধুলোমলিন এবং পচা ঝিনুকের দুর্গন্ধে ভরা যে রাস্তার বর্ণনা দিয়েছেন, সে রাস্তা দিয়ে অন্তত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এলিটরা হাঁটবেন না!

১৮৬৫ থেকে ১৯১৪ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাস্তবতাটা এমন ছিল: ১৮৬৫-তে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গৃহযুদ্ধ শেষ হয়ে গেছে। ১৮৭৭ থেকে শুরু হয়েছে সেখানকার শিল্পবিপ্লব। আয়রন, স্টিল ও কয়লা উৎপাদনের ক্ষেত্রে ব্রিটেনকে ছাড়িয়ে গেছে দেশটি। তখন মুক্তবাজার অর্থনীতি ছুটছে লাগামছাড়া ঘোড়ার মতো, বড় বড় করপোরেশন গ্রাস করে নিচ্ছে ছোট যত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। কাজেই জীবিকার্জনের স্বার্থে বিশেষত, ইস্ট কোস্টে, গ্রাম থেকে শহরে ছুটে আসছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাজার হাজার মানুষ। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের কারণে মোটাদাগে প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ জট পাকিয়েছে নিউ ইয়র্ক, শিকাগো, ফিলাডেলফিয়া, সেইন্ট লুইস [যেখানে জন্ম আর বেড়ে ওঠা টি. এস. এলিয়টের], বোস্টন [যে শহরের হার্ভার্ড কলেজ ও হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন এবং দীর্ঘদিন থেকেছেন এলিয়ট], বাল্টিমোর ইত্যাদি বড় বড় শহরে। এদিকে শিল্পবিপ্লবের অবদান হিসেবে বড়জোর দশটি অগ্রগামী শিল্পের কলকারখানাগুলোতে শ্রমিকের জায়গা দখল করে নিচ্ছে মেশিন। এভাবে শ্রমের বাজারে বাড়ছে উদ্বৃত্ত শ্রমিকের সংখ্যা। জনসংখ্যার বিস্ফোরণের পাশাপাশি তখন ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে মানুষের অভিবাসন তো চলমান ছিলই, যা শ্রমের বাজারে কাজে ঢোকা বা কাজ বজায় রাখার প্রতিযোগিতাকে আরও রক্তক্ষয়ী করে তুলেছিল। তবে সত্য এই যে অর্থনীতির কাঠামোগত পরিবর্তনের কারণে তখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় আয় কিন্তু লক্ষণীয়ভাবে ঊর্ধ্বগতি পেয়ে গিয়েছিল। তা হলে কী হবে? শহরে অভিবাসিত এসব শ্রমিকের মজুরি তো আর বাড়ছিল না! তো শ্রমিকদের পকেটে খরচ করার মতো পর্যাপ্ত অর্থ আসবে কোথা থেকে? সে সময়টায় দেশটির শ্রমিকেরা কারখানায় বা করপোরেশনে কাজ-বাজ করে-টরে গড়ে দৈনিক আয় করতে পারছিল মাত্র ১.৫০ ডলার। জাতীয় আয় ট্রিলিয়ন ডলারের ঘর ছুঁলেও তাই বৃদ্ধি পেয়ে যাচ্ছিল আয়বৈষম্য আর দারিদ্র্য। একটি হিসাব বলছে, ১৮৯৭ সালে দিকে, তখনকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের চার হাজার বড় পরিবার [যারা সংখ্যায় দেশটির জনসংখ্যার শতকরা প্রায় ১ ভাগের নিচেই ছিল]-এর সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল বাকি ১.১৬ কোটি পরিবারের সম্পদের প্রায় সমান। এভাবে তখন দেশটির প্রায় ৪৫ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে পড়ে যায়, বিশেষত বড় বড় নগরে। ১৮৬৫ থেকে ১৯১৪ সময়কালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতির এই চিত্রের সারাংশ টানা যায় এভাবে: দেশটির জাতীয় আয় বাড়ছে বটে, কিন্তু একই সাথে বাড়ছে মানুষের আয়বৈষম্য এবং দারিদ্র্য। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তথাকথিত সমৃদ্ধির এই যুগেরই মানুষ স্বয়ং এলিয়ট। প্রুফর্ক-এর ধসে পড়া নায়কও সেই অস্থির সময়েরই প্রতিনিধি।

ফলত, এই সময়টায় উন্মূল হয়ে পড়েছিল জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় বড় নগরের অসংখ্য মানুষ। কাজেই তখনকার সমাজে যে বিভিন্ন অস্থিরতা আর নৈরাজ্য বেড়ে যাবে, তা বলাই বাহুল্য। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করি ১৮৭৩ সালে লেখা মার্ক টোয়েন এবং চার্লস ডাডলি ওয়ারর্নারের যৌথ উপন্যাস দ্য গিল্ডেড এইজ-এর কথা। উপন্যাসটিতে তাঁরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের তৎকালীন অন্তঃসারশূন্যতা এবং সামগ্রিক দুর্নীতির ছবি তুলে ধরেছিলেন এভাবেওপরে চকচক করছে সবকিছু আর নিচে ছড়িয়ে আছে গাঢ় কালিমা। এই উপন্যাসের সূত্রে তখন দেশটির গৃহযুদ্ধ-পরবর্তী সময় থেকে বিংশ শতাব্দীর গোড়া পর্যন্ত মর্মান্তিক সময়টিকে এখনো দ্য গিল্ডেড এইজ বলে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। অনুমান করেই নেওয়া যেতে পারে, মার্ক টোয়েন এবং চার্লস ডাডলি ওয়ারর্নারের এই সাড়া জাগানো উপন্যাস এলিয়টের নজর এড়ায়নি মোটেই।

১৯৪২-এ, প্রুফর্কের মতোন ভেঙে পড়া, একাকী, সমাজ থেকে বিযুক্ত একজন শহুরে চরিত্রকে নিয়ে আলবেয়ার কামু তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য আউটসাইডার লিখেছিলেন। এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: প্রুফর্কের মতোন সময়োপযোগী একটি চরিত্র ফেলে কেন ইংলিশ রোমান্টিক যুগের শেষ দিকের কবিরা সহজতা, সরলতায় ভরা গ্রামীণ পটভূমির মানুষদেরকে নিয়ে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থীয় কায়দায় কবিতা রচনা করার ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন? তাদের সামনেই কি ১৮৫১ সালের দিক থেকে ইংল্যান্ডে নগরায়ণের হার বেড়ে যায়নি? এখানে এসে ইংলিশ রোমান্টিক যুগের শেষের দিকের কবিদেরকে আমাদের কাছে অন্ধ বলেই মনে হতে পারে।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অস্থির সময়ের কোনো বড় নগরের বাসিন্দা আমাদের হতভাগ্য নায়ক প্রুফর্ক। কাজেই তার নিজের সময়ের প্রতিভূ এই নায়ককে নিজের অভিজ্ঞতা থেকে তৈরি করে নিতে এলিয়টকে খুব একটা কসরত করতে হয়নি। প্রুফর্ক নামের এমন একজন শহুরে নায়কের সাথে এলিয়ট আমাদেরকে সস্তা হোটেল এবং নোংরা রেস্তোরাঁয় বসিয়েছেন যেখানে আমরা চোরবাটপার, ভণ্ড আর গণিকাদের দেখা পেয়ে যাচ্ছি। প্রুফর্কের সাথে আমাদেরকে কবি হাঁটতে নিয়ে গেছেন শহরের কদর্য কোনো গলিঘুপচিতে। সেখানে আদুরে কোনো বেড়ালের মতো করে হলুদ কুয়াশা আর ধোঁয়া আমাদেরকে জোর ধাক্কা মারছে। অস্থিরতায় ভেঙে পড়া, ক্লান্ত, বিভ্রান্ত, হতাশ, নপুংসক আর ভীত একজন অতি সাধারণ আমেরিকান নায়কের সাথে এভাবে আমরা পরিচিত হই। আমরা দেখি, কোনো দেয়ালে লটকিয়ে দেওয়া পতঙ্গের মতো সময়ের সাথে বেকায়দাভাবে আটকে আছে প্রুফর্কসে বেরোতে পারছে না, জাড্যতার কারণে তার ভালবাসার কথাও প্রকাশ করতে পারছে না কারও কাছে। প্রুফর্কের জন্য তাই বেদনা জাগে আমাদের মনে এবং দেশনির্বিশেষে আমরা, উন্নয়নের রাজনীতির বলি হওয়া সাধারণ মানুষেরা, তার সাথে একাত্মতা বোধ করি। আরও পরে, ১৯৪২-এ, প্রুফর্কের মতোন ভেঙে পড়া, একাকী, সমাজ থেকে বিযুক্ত একজন শহুরে চরিত্রকে নিয়ে আলবেয়ার কামু তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস দ্য আউটসাইডার লিখেছিলেন। এখানে আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে: প্রুফর্কের মতোন সময়োপযোগী একটি চরিত্র ফেলে কেন ইংলিশ রোমান্টিক যুগের শেষ দিকের কবিরা সহজতা, সরলতায় ভরা গ্রামীণ পটভূমির মানুষদেরকে নিয়ে ওয়ার্ডস্ওয়ার্থীয় কায়দায় কবিতা রচনা করার ঐতিহ্য বজায় রেখেছিলেন? তাদের সামনেই কি ১৮৫১ সালের দিক থেকে ইংল্যান্ডে নগরায়ণের হার বেড়ে যায়নি? এখানে এসে ইংলিশ রোমান্টিক যুগের শেষের দিকের কবিদেরকে আমাদের কাছে অন্ধ বলেই মনে হতে পারে।

আমরা এতক্ষণ দেখলাম, এলিয়ট তাঁর কবিতা দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফর্ক-এ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমসাময়িক জটিল রাজনৈতিক বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সময়ের একজন সঠিক প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পেরেছিলেন। এই নায়কের মনোজগতের স্বরূপ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ব্যবহার করেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় কোনো শহরের সাধারণ মানুষের মুখের ভাষা, যেটা কিনা সময়ের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতেই গড়ে নিয়েছিলেন তিনি। এ কথা স্মরণ করা যেতে পারে, আটলান্টিক উপকূল থেকে প্যাসিফিক উপকূল পর্যন্ত সুবিশাল উত্তর আমেরিকা তখন অভিবাসীদের সবচেয়ে বড় আকারের একটা মেল্টিং পট-এ পরিণত হয়েছে। সেখানে, ১৬০০ সালের দিক থেকে, আমেরিকার আদিবাসীদের সাথে গিয়ে মিশেছে ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়েলস, জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, ফ্রান্স, সুইডেন ইত্যাদি দেশ থেকে অভিবাসিত মানুষজন। তাদের সাথে যোগ হয়েছে আফ্রিকা থেকে জোরজবরদস্তি করে যেসব দাস নিয়ে আসা হয়েছিলতারাও, আরও যোগ হয়েছে ইউরোপ থেকে চলে আসা কিছু উন্মূল ইহুদি। উত্তর আমেরিকায় এরা সকলেই সাথে করে নিয়ে এসেছিল নিজেদের ভাষার নতুন নতুন সব শব্দ আর ভাষার কাঠামো। এই জটিল রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতিতে তবে কেমন চেহারা হতে পারে উত্তর আমেরিকার মহামানবের মুখের ভাষার? সে ভাষা কি ১৬০৭ সাল থেকে ১৭৮৩ অবধি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে চলমান ব্রিটিশ উপনিবেশের শাসকদের বেঁধে দেওয়া তথাকথিত আধুনিক ইংলিশ ভাষাতেই স্থির হয়ে থাকবে? নাকি অজস্র অভিবাসীর সেই দেশে মানুষের মুখের ভাষা বিবর্তিত হতে হতে দাঁড়াবে গিয়ে নতুন একটা লৌকিক চেহারায়? এই দ্বিতীয় সম্ভাবনাটিই উত্তর আমেরিকার মানুষের মুখে মুখে নতুন একটি গতিময় ইংলিশ ভাষার জন্ম দিয়ে ফেলেছিল, যাকে আমরা আমেরিকান ইংলিশ হিসেবে চিনেছি। এমন একটা নমনীয়, বৈচিত্র্যময়, গতিময় ভাষাই নিজের কাব্যে ব্যবহার করেছিলেন এলিয়ট। সে ভাষা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নির্দিষ্ট কোনো অঞ্চলের ভাষা ছিল না, ছিলবড় কোনো শহরের একটি স্থানিক ভাষা।

প্রুফর্কের জটিল মনোজগৎ আমাদের সামনে তুলে ধরতে উত্তর আমেরিকার বিবর্তিত সর্বজনীন ইংলিশ ভাষাকেই বেছে নিয়েছিলেন এলিয়ট এবং কাজটা তিনি করেছিলেন যুগের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিত থেকেই। চাইলেই তিনি কবিতাটি রচনা করতে পারতেন প্রচলিত আধুনিক ইংলিশ ভাষায়। কিন্তু তিনি উল্টো পথে হেঁটেছিলেন তখন। উত্তর আমেরিকার ইতিহাসের বাস্তবতাই তাঁকে সাহিত্যে নতুন ভাষা নির্মাণ করে নিতে খুঁচিয়েছিল যে ভাষার চেহারাটি জটিল—‘লিরিক্যাল ব্যালাডস্-এর মুখবন্ধে উইলিয়াম ওয়ার্ডস্ওয়ার্থ প্রস্তাবিত সহজ, সরল গ্রামীণ কোনো ভাষা নয় সেটা। তাই আমরা দেখতে পাই, দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফর্ক-এর মুক্তছন্দের পরিধিতে ঢুকে পড়ছে নতুন নতুন সব শব্দ, শব্দগুচ্ছ, বাগধারা ইত্যাদি; শব্দ আর বাক্য তৈরি করছে নতুন সব ইমেজের কুহক, কবিতাটির কাঠামোটি ভঙ্গুর হয়ে পড়ছে থেকে থেকেইসেখানে ভিড় জমাচ্ছে খণ্ডিত বাক্য; বাক্যগঠনের বেলাতে প্রায়শই দরকারি শব্দ ফেলে দেওয়া হচ্ছে; বাক্যে পরোক্ষভাবে ঢুকে পড়ছে দান্তের কোমেডিয়া-র নরকের আবহ, গসপেল অব জনের পুনরুত্থিত ল্যাজারাস এবং শেকসপিয়ারের রাজকুমার হ্যামলেটে বর্ণিত অকিঞ্চিৎকর কোনো মানুষের গল্প; বিভিন্ন বাস্তবতা উপস্থাপন করা হচ্ছে সমান্তরালভাবেএক ভাবনা থেকে চট করে পাঠককে টেনে, ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হচ্ছে আরেক ভাবনার ভেতরে। এভাবে দ্য লাভ সং অব জে. আলফ্রেড প্রুফর্ক-এর অপ্রচল কাঠামো কবিতাটিকে জটিল ও ধোঁয়াটে বানিয়ে দিচ্ছে শেষ পর্যন্ত। কবিতাটির এই দুর্বোধ্য কাঠামো তখনকার কোনো প্রচল কাঠামোকেই নির্দেশ করে না। এভাবে রোমান্টিক কবিদের কাব্যতত্ত্ব এবং ভাষাভাবনা থেকে যোজন যোজন দূরে সরে গিয়েছিলেন এলিয়ট। সেই পথে তাঁর সাথে অনেক দূর অবধি হেঁটেছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আরেকজন পুরোধা কবিএজরা পাউন্ড।