শাহেদ আলীর আত্ম-ইতিহাস ‘জীবনকথা’
শাহেদ আলীর জীবনকথা পাঠ শুরু করতে গিয়ে একটা গভীর নস্টালজিয়া প্রথমেই গভীর ধাক্কা মেরে দেবে; পাঠক এই জীবনী না পড়লে বোঝার উপায় নেই এই বিষয়। আর এই জীবনী পড়ার পর যদি এই বিষয়টা না ঘটে, পাঠকের মনোজগতে, তো বলতেই হয় যে, ওই পাঠকের হৃদয় বোধ হয় গণ্ডারের চামড়াসদৃশ কোনো বস্তু দিয়ে মোড়ানো। পাঠক রাগবেন না, দয়া করে! পাঠকের প্রতি পূর্বোক্ত নিবেদন করেই শুরু করছি। কারণ, পড়ার বিষয়টা না ঘটলে, এই বিষয়টা পাঠক মেলাতে পারবেন না, তখনই তো একটা সমস্যা তৈরি হবে, তা বলাই যায়। তাই পাঠকের কাছে জোর আবেদন, এই জীবনী যেন পাঠক পাঠ করে নেন। আবার এই জীবনী না পড়লে কেউ ধড়ফড় করে মারা যাবে, এমনও নয়।
শাহেদ আলীর জীবনকথা নামের আত্মজীবনী পাঠের বেলায় সবচেয়ে বড় যে বিষয় মনে ধাক্কা দিয়েছে, তা হলো—এই জীবনীর অন্দরে যে নস্টালজিয়া আছে, সেই নস্টালজিয়া, প্রায় সব মানুষ না হলেও একটা বড় শ্রেণির মানুষের নস্টালজিয়ার সাথে সম্পৃক্ত হতে সক্ষম। ফলে যে কেউই এই জীবনী নিজের সাথে মিলিয়ে পড়ার বিষয়টা করে উঠতে পারবেন। জীবনী পাঠের বেলায় জীবনীকারের সাথে একাত্মতার যে বিষয়, তা এই জীবনী থেকে পাঠক পেতে সক্ষম। শাহেদ আলীর বর্ণনার ভেতর দিয়ে নস্টালজিয়াই মাঝে মাঝে নানান স্মৃতিকে একত্র করে একটা বড় কালখণ্ড তৈরি করে দেয়। সেই কালখণ্ডে ভেতরে কেবল শাহেদ আলীই থাকেন না; কিংবা কেবলই থাকেন না শাহেদ আলীর পরিবার। একটা বড় সময় আর তার চারপাশের সবকিছু নিয়েই এই জীবনী পূর্ণ হয়ে ওঠে। একটা বিস্মৃত সময় যেন সিনেমার ফ্ল্যাশব্যাক রীতিতে পেছনের সবকিছু নিয়ে হাজির হয় আমাদের কাছে।
শাহেদ আলীর জীবনী শুরু হয়েছে তাঁর জন্মের ইতিহাস দিয়ে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অনেকেই তো জীবনের বিভিন্ন পর্বের একটা নির্দিষ্ট অংশ থেকে শুরু করেন জীবনী লেখা। মানে ধরা যাক, কেউ জন্মের হিসাব-নিকাশ না মিটিয়েই, কেউ কেউ তার জীবনের একটা নির্দিষ্ট সময় থেকেও জীবনী লেখা শুরু করতে পারেন। কিন্তু সেই বিষয়টা যে একেবারেই খারাপ কিছু, তা কিন্তু নয়। কারণ, কে কোন পর্যায় থেকে তাঁর জীবনী লেখা শুরু করবেন, সেটা তো একান্তই নিজস্ব ব্যাপার। কিন্তু আমাদের প্রশ্নটা একটু ভিন্ন জায়গায়। কারণটা সম্পূর্ণতা আর অসম্পূর্ণতার প্রশ্নের সাথে সম্পৃক্ত। ধরুন, কেউ তাঁর জীবনের একটা উজ্জ্বল দিক ঘিরেই জীবনী লিখে ফেললেন। এতে কী ধরনের সমস্যা হয়? এতে প্রধান যে সমস্যা, তা হলো একজন মানুষের কেবল ভালো আর গুরুত্বপূর্ণ দিকই সব নয়। একজন মানুষের খারাপ আর অগুরুত্বপূর্ণ দিকও সমানভাবে বিবেচ্য। সেই বিবেচনা না করতে পারলে একটা বড় সংকট তৈয়ার হয়। কিন্তু গুরুত্বের হিসেবে জীবনের কোনো অংশই অগুরুত্বপূর্ণ নয়। শাহেদ আলী তাঁর আত্মজীবনীটা শুরু করেছেন তাঁর শৈশব থেকেই। যে শৈশবের ভেতরে কেবলই শাহেদ আলী নেই। আছে তাঁর চারপাশ। তাঁর পরিবারের অনেকেই। আছে তাঁর মানস গঠনের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার হালহকিকত। সেই শৈশবের ভেতর দিয়ে তিনি আমাদের অন্য একটা জগতে নিয়ে যান। যে শৈশব কেবল তাঁরই জীবনের বর্ণনা নয়, এর চেয়ে আরও বেশি।
তাহলে প্রশ্ন উঠতেই পারে যে, শাহেদ আলী তাঁর জীবনীর ভেতর দিয়ে আমাদের কোথায় নিয়ে যেতে চান? আর নিলেও সেটা কি আদতে সম্ভব? হ্যাঁ, সম্ভব। ধরুন আপনি এমন একটা সময়ের ভেতর দিয়ে যাচ্ছেন, সেই সময় পূর্বের সময়ের থেকে অবশ্যই আলাদা। কিন্তু যে মানুষটা পূর্বের সময়ের ভেতরে যেতে পারছেন না, সেই মানুষের কাছে কিন্তু পূর্বের সময়ের ভেতরে ছিল, এবং নানান অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে—এমন বিষয়সমূহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সেই সময়ের যে নদীটা ছিল সেই নদীটা আজ হয়তোবা মরে গেছে। সেই নদীটাকে ঘিরে হয়তোবা গড়ে উঠেছিল একটা জনপদ। সেই নদীর ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য, ওই নির্দিষ্ট জনপদের ওপর। কারণ, নদী কেবল তো নদী নয়, নদীর আরও অনেক ভূমিকাই তো আছে। ছিল। কিন্তু নদী যখন আর নেই, তার ভূমিকাও এখন আর নেই। ফলে পঞ্চাশ বছর পূর্বে একটা নদীকে ঘিরে যে জনপদ গড়ে উঠেছিল, এবং যে জনপদকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিল একটি নদী—সেই সবই জানা সম্ভব পুরোনো ইতিহাস পাঠের ভেতর দিয়ে।
শাহেদ আলী কী কী সত্য বলেছেন, যা ইতিহাসে সচরাচর পাওয়া সম্ভব হয় না? নানান বিষয় আছে। এর ভেতরে অন্যতম হলো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক বিষয়াদি। ওই যে নদীর বিষয়ে কথা হলো সেই বিষয় একেবারে ঠিক না থাকলেও ‘পানি’ কিন্তু শাহেদ আলীর ভৌগোলিক বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। নদী সব সময় না থাকলেও হাওর অঞ্চলের একটা বিশদ বর্ণনা কিন্তু শাহেদ আলীর জীবনী পাঠের পর জানা সম্ভব হয়। তিনি এই বিষয় বেশ দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। শাহেদ আলী পানির যে আধিক্য, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবনযাপনের ধরন নিয়ে কথা বলেছেন। জানাচ্ছেন—কীভাবে নদী ও হাওর মানুষের জীবিকা আর যাতায়তকে বদলে দেয়। বদলে যায় একটা জনপদ
কিন্তু ‘সাহেবী ইতিহাস’ তো আধিপত্যমূলক। আধিপত্য মেনে নিয়ে এই ইতিহাস রচিত হয়, ক্ষমতাকে মানা হয় গুরু হিসেবে। ক্ষমতা-আধিপত্যের এই প্রভাব কিন্তু জনসাধারণের থেকে ইতিহাসকে এককভাবে দূরে রাখে। এই দূরে থাকা ও রাখার কারণে সাধারণ মানুষের জীবনযাপনের বিভিন্ন রকম পদ্ধতি একেবারেই ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে যায়। তাহলে কীভাবে এই বিষয়গুলো আমরা জানতে পারি? যেমন এই বিষয়ে একটু বলে নিতে হয়, চর্যাপদের হিসাবটা এই ক্ষেত্রে বিবেচনার ভেতরে আসতে পারে। কারণ, চর্যাপদে সাধারণ মানুষকে এবং সাধারণ মানুষের কর্মকাণ্ডকে পাওয়া যায়—এটা বহুল স্বীকৃত মতবাদ। তাহলে আমরা দেখছি যে, সাধারণ মানুষের খুঁজে পাওয়ার বিষয়টা মূলধারার ইতিহাসে না পাওয়া গেলেও, সাহিত্য কিন্তু তা ধরে রাখে। অন্যান্য মাধ্যমেও কিছু কিছু থাকে। যদিও সাহিত্যের ভেতরে এই বিষয়সমূহ একটু অন্যভাবে থাকে। কিন্তু বিষয়টা থাকে।
শাহেদ আলীর জীবনকথা পাঠের পর এই সত্যই উপলব্ধি হয়। শাহেদ আলী জানান, আমাদের, তাঁর জীবনীতে, কীভাবে একটা অঞ্চল এবং অঞ্চলের লোকজন জীবনকে যাপন করে। এবং এই জীবনযাপন পদ্ধতি শাহেদ আলী পুরোনো সময়ের ভেতরে থেকে নতুন সময়ের সাথে সংযুক্ত করে নিজের মতো বা নিজের দিকে নিয়ে আমাদেরকে জানান না। তিনি এই বিষয়টা একটা সামষ্টিক বোধের ভেতর থেকে তৈয়ার করেন এবং একটা সমষ্টিচেতনা তৈয়ার করে নেন। সেই বিষয়টা কোনো ফাঁপা ও ফাঁকা বিষয় নয়। তার একটা ভার রয়েছে। সেই ভারের ওপর নির্ভর করেই এই বিষয়টা তৈয়ার হয়। কোনো ফাঁকিবাজি যে করেননি, শাহেদ আলী এই বিষয় বলতে পারব না। জীবনীকার এমন একটু-আধটু করেনই। কারণ, নিজেকে ক্ষুদ্র/ছোট বলার শক্তি কম মানুষেরই থাকে। শাহেদ আলীর জীবনী পড়লেই এই বিষয় বুদ্ধিমান পাঠক পেয়ে যেতে বাধ্য। আবার এই যে পাঠক পেয়ে যেতে পারবেন, এই বিষয়টা বলা গেল, তা সম্ভব হলো এই কারণে যে, শাহেদ আলী সেই সমস্ত চিহ্ন-সূত্রও আমাদের কাছে রেখে গেছেন। এসব কথা বাদ দেওয়া যাক।
তো ইতিহাস তো সত্য কথা বলে না। তো শাহেদ আলী কী কী সত্য বলেছেন, যা ইতিহাসে সচরাচর পাওয়া সম্ভব হয় না? নানান বিষয় আছে। এর ভেতরে অন্যতম হলো একটা নির্দিষ্ট অঞ্চলের ভৌগোলিক বিষয়াদি। ওই যে নদীর বিষয়ে কথা হলো সেই বিষয় একেবারে ঠিক না থাকলেও ‘পানি’ কিন্তু শাহেদ আলীর ভৌগোলিক বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ হয়ে আছে। নদী সব সময় না থাকলেও হাওর অঞ্চলের একটা বিশদ বর্ণনা কিন্তু শাহেদ আলীর জীবনী পাঠের পর জানা সম্ভব হয়। তিনি এই বিষয় বেশ দারুণভাবে তুলে ধরেছেন। শাহেদ আলী পানির যে আধিক্য, তার পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের জীবনযাপনের ধরন নিয়ে কথা বলেছেন। জানাচ্ছেন—কীভাবে নদী ও হাওর মানুষের জীবিকা আর যাতায়তকে বদলে দেয়। বদলে যায় একটা জনপদ। বিষয়টা কিন্তু একটা অঞ্চলের জন্য নানাবিধ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। মনে রাখা জরুরি যে, শাহেদ আলী এই বর্ণনা কেবল জনগণের জায়গা থেকে বুঝিয়েছেন কিংবা উপস্থাপন করেছেন। তিনি নিজ এবং নিজ পরিবারের ভেতরে রেখে এই বিষয় আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
খাদ্যশস্য উৎপাদনই শাহেদ আলীর সময়কার অর্থনীতির প্রধান উৎস হিসেবে কাজ করেছে। কী কী খাদ্য কীভাবে উৎপাদিত হয়েছে, আর সেটা দিয়ে কীভাবে একটা অঞ্চলের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয়েছে, এই বিষয় বিশেষ কারণে গুরুত্বপূর্ণ। ধরা যাক—ধান, দুধ আর মাছ উৎপাদনের যে আধিক্যের বিবরণ শাহেদ আলী দিয়েছেন, সেই বিষয় হয়তোবা এখনকার বিবেচনায় বেশ লোভনীয়। এবং একই সাথে তার বণ্টন প্রক্রিয়াও বেশ রূপকথাতুল্য। কিন্তু বাস্তবে যদি তার কিছুই না থাকত, তো শাহেদ আলী কোনোভাবেই এই বর্ণনা তৈয়ার করতে পারতেন না। পারলেও বয়ানের বেলায় একটা ‘ধরা খেয়ে যাওয়ার’ মতো বিষয় তৈয়ার হয়ে যেত। কিন্তু পাঠক এই বিষয় পাঠ করার বেলায় কোনো ধান্ধায় পড়ে যাবেন না, এ কথা বেশ জোরের সাথেই বলা চলে। এর পেছনে আরও কয়েকটা বিষয় গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষী হিসেবে কাজ করেছে। প্রথমত, শীতের দিকে হাওর অঞ্চলের জলা অঞ্চল শুকিয়ে গিয়ে যে গোচারণভূমি তৈয়ার হয়, সেই গোচারণভূমি মাংস ও দুধ উৎপাদনের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আবার জল যে মাছের আস্তানা—এই বিষয় তো ধ্রুব সত্যের মতো। এই দুটো বর্ণনার বিষয় আবার সত্য হয়ে ওঠে তখনই, যখন শাহেদ আলী আমাদেরকে যাতায়তের আবহাওয়াকে দুইটা ভাগে ভাগ করেন। আরও লোভনীয়, এক টাকায় আট মণ চালের মতো বিষয়, আমাদের সামনে বারবার ভেসে আসে। যেমন ঘি উৎপাদন আর তার বেচাকেনার হিসাবটা, তা এরই সাথে সম্পৃক্ত থাকবে।
তাহলে কি কেবলই খাদ্যের সাথেই এই অঞ্চলের আর্থ-উৎপাদন কাঠামোর সাথে সম্পৃক্ত? না। তা একেবারেই নয়। খাদ্যশস্য ব্যতীত অর্থকরী নানান পেশার বিষয় কিন্তু এই জীবনীতে রয়েছে। এই বিষয় এমনই হতে পারে যে, জীবনের চলাচলের জন্যে মানুষকে অনেক কিছুই করতে হয়। করা লাগে। তা না হলে চলে না। চলবে না। এই বিষয়টা এই ক্ষেত্রে জরুরি বিষয়। সামন্ত সমাজে কাজের সুযোগ এত ছিল না। কৃষিপ্রধান পেশা হলেও এর সাথে সম্পৃক্ত আরও কিছু কাজবাজ ছাড়া এমন কিছু আর নাই। পুঁজির যেমন বহুবিধ বিকার থাকে, তেমনি তার অনেক সুবিধাও পাওয়া যায়। এই সুবিধা কিন্তু একেবারেই ফেলে দেওয়ার মতো নয়। যেমন কল-কারখানার একটা বড় নেতিবাচক দিক অবশ্যই রয়েছে। কিন্তু এই কলে আর কারখানায় অনেকেই একটু কাজবাজ করে পেটে দুটো দানাপানি দেয়। কিন্তু সামন্ত সমাজে এই বিষয় একেবারেই স্থির ব্যাপার। কোনো অতিরিক্ত সুযোগ পাওয়া বেশ কঠিন ব্যাপার। সামন্ততন্ত্র যতটুকু সুযোগ দেবে, ততটুকুই নিয়ে দিন গুজরান করতে হবে। এবং এই বিষয়টা পরিযায়ী প্রক্রিয়ায়ও এক। যেমন—দূর থেকে শাহেদ আলীর বসত-অঞ্চলে আসা কামলা, তারাও কিন্তু একই প্রক্রিয়ায় তাদের কাজ গুছিয়েছে।
প্রয়োজনীয় বিষয়ের মধ্যে, যাকে এখন মৌলিক অধিকার হিসেবে বিবেচনা করা হয়, বস্ত্রের সংস্থান ও চিকিৎসা ব্যবস্থা খুবই জরুরি বিষয়। কিন্তু এই দুটো বিষয় এই সময়ে যে উন্নত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে, শাহেদ আলীর জীবনী পাঠের পর বোঝা যায় যে, এই দুটো বিষয় তখন এখনকার মতো জুতসই অবস্থানে ছিল না। একটা মানুষ পোশাক কিনবে, আর তা হবে হাল ফ্যাশন অনুযায়ী—এই বিষয়টা ভাবনায়ও সেই সময় আসে নাই। করা তো দূরে থাক। কিন্তু বর্তমানে তা একেবারেই সস্তা বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সেই সময়, শাহেদ আলীর শৈশবকালে, মানুষ পোশাক কিনেছে কয়েক বছর পরে একটা, বড়জোর দুটো। আর চিকিৎসা ব্যবস্থার যে ভয়াবহ বর্ণনা তিনি দিয়েছেন, তাতে বোঝা যায় যে সামান্য রোগই মানুষকে পটল তুলতে বাধ্য করেছে। এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো সম্বল সেই সময়কার মানুষের ছিল না। কেবল কুইনাইন মিক্সার নিয়ে সর্বরোগের বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর মতো অসহায় অবস্থা শাহেদ আলী এই জীবনীতে তুলে ধরেছেন। এর কি কোনো রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে? যে সময় শাহেদ আলী এই বর্ণনা দিচ্ছেন, সেই সময় তো পরিস্থিতি এত খারাপ হওয়ার কথা না। কিন্তু ভৌগোলিক কারণে যে এই অঞ্চলের এই অবস্থা, তা কিন্তু নয়। রাজনৈতিকভাবে বঞ্চনা এই প্রক্রিয়াকে আরও বেশি ত্বরান্বিত করেছে। সেটা কেন্দ্র-প্রান্তের রাজনৈতিক বিবাদটা সম্পর্কে ধারণা থাকলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমি এই ক্ষুদ্র আলাপে কথা বাড়ালাম না।
শিক্ষাকে গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন-প্রপঞ্চ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। নানা রকম উদ্দেশ্য পূরণে এই বিষয়টা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে, বর্তমানে। কিন্তু শিক্ষা যে মৌলিক অধিকারের বিষয়, তা শাহেদ আলীর সময়ে বিশ্বাসযোগ্য বিষয় ছিল না। কারণ, শিক্ষার বিষয়টা বিশেষভাবে অর্থনৈতিক নানান প্রত্যয়ের সাথে সম্পৃক্ত ছিল। শাহেদ আলী কিন্তু বারবার বলার চেষ্টা করছেন যে তাঁর পরিবার একেবারেই দরিদ্র নয়। একটা অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের বিষয়ে তাঁর ওকালতি চোখে পড়ার মতো। কিন্তু পরীক্ষা দেওয়ার মতো ত্রিশ টাকা শাহেদ আলীর ছিল না। এটা একটা বড় চিহ্ন হিসেবে কাজ করেছে যে, শাহেদ আলীর সময় শিক্ষা ব্যাপারটা অর্থনৈতিক বিবেচনায় প্রকৃত কোনো অবস্থায় ছিল। আঁচ আমরা করতে পারি, যে বেশ অবস্থাসম্পন্ন ঘরের সন্তান হয়েও শাহেদ আলীর এই ভোগান্তি সহ্য করতে হয়েছে। তাহলে অন্যান্য পরিবার থেকে পড়ালেখা করে কলকাতা পর্যন্ত কিংবা ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছে লেখাপড়া করা কি এতই সহজ বিষয় ছিল? না। তা ছিল না। এত সহজে লেখাপড়ার ব্যাপারটা করা সম্ভব হতো না। শাহেদ আলীর আশপাশের পরিস্থিতি পাঠই এই বিষয় আমাদের জানান দেন। ফলে শিক্ষা ব্যাপারটা বেশ কষ্টের ভেতর দিয়েই শাহেদ আলীকে শেষ করতে হয়েছে। যদিও মেধার হিসেবে শাহেদ আলী ছিলেন অনেক এগিয়ে। স্কুলের ফলাফল সেই সত্যই আমাদেরকে জানায়।
‘ক্লাস স্ট্রাকচার’ এটাকে আমরা ‘বর্ণ প্রথাও’ বলতে পারি—এই জীবনীর একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। বিশেষ করে শাহেদ আলী যে অঞ্চলে বেড়ে উঠেছেন এবং বড় হয়েছেন সেই অঞ্চলে ধর্মান্তর আর শ্রেণির হিসাবটা আমলে নেওয়া জরুরি। কারণ, অর্থনৈতিক উৎপাদন কাঠামোর সাথে এই বিষয়টা বিশেষ হয়ে ওঠে। জেলেদের বিভাজন, ধর্মের হিসেবে, এই বিষয়ে আমাদের সজাগ করে তোলে। কিন্তু এ থেকে যেকোনো সাম্প্রদায়িক কিংবা বর্ণ-প্রথাভিত্তিক সমস্যার তৈয়ার হয়েছে, এমনটা শাহেদ আলী আমাদের জানাচ্ছেন না। বরঞ্চ একটা অসাম্প্রদায়িক মনোবৃত্তি সারা জীবনী জুড়ে ওৎ পেতে রয়েছে। আমাদের একটা মানসিক আরামের বন্দোবস্ত করেই তিনি এই আলাপ পুরা করেন।
ভূগোল মেনে রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয় এই জীবনীর উল্লেখযোগ্য বিষয়-উপাদান। রাজনৈতিক সচেতনতা যেকোনো ব্যক্তির জন্য গুরুত্বপূর্ণ। শাহেদ আলীও এই সচেতনতার বিষয়ে সজাগ ছিলেন। ছাত্রাবস্থায়ই তাঁর এই রাজনৈতিক সচেতনতার বিষয় লক্ষ করা যায়। শাহেদ আলী স্কুলে পড়ার সময়ই রাজনৈতিক চিন্তার বশবর্তী হন, এবং সেই অনুযায়ী নানান কাজকর্মে সক্রিয় থাকেন। বিশেষ করে দেশভাগের পূর্বে আদি সিলেট কেন বিভাজিত হবে, এই বিষয়ে যে রেফারেন্ডাম হয়েছিল, তার বিরুদ্ধে যে সংগ্রাম সিলেটবাসী করেছিল, তাতে শাহেদ আলীর সক্রিয় অংশগ্রহণ ছিল। আবার দেশভাগের পর পশ্চিম পাকিস্তানের একচোখা দৃষ্টিভঙ্গির কারণে যে তমদ্দুন মজলিস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তাতেও সক্রিয় ভূমিকা ছিল তাঁর।
আর এই প্রতিষ্ঠানই পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। সেই ভূমিকা এককভাবে প্রতিষ্ঠানের নামে এন্ট্রি হলেও প্রতিষ্ঠান তো মানুষই চালায়। সেই মানুষের আবার সক্রিয়তার বিবেচনায় কম-বেশি রয়েছে। শাহেদ আলী সক্রিয়তার হিসেবে একটু বেশিই সক্রিয় ছিলেন। এবং তাঁর রাজনৈতিক জীবনের সূচনাও হয়েছিল এইভাবেই। বিশেষ করে মুসলিম লীগের রাজনৈতিক অনুষঙ্গ-প্রবণতা শাহেদ আলীর ওপর বিশেষ প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। একসময় এই ধারার বাইরে গেলেও এই ঘরানার ভেতরেই তাঁর রাজনৈতিক জীবন স্থির ছিল।
শাহেদ আলী কেবল রাজনৈতিক আন্দোলনে যোগই দেন নাই। তিনি সরাসরি মাঠে নেমে রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে তিনি প্রার্থী হয়েছিলেন এবং জিতেছিলেন। এবং এই সময়কার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি বয়ান দিয়েছেন এই জীবনীতে। প্রথাগত বয়ানের বিপরীতে তাঁর বয়ান একটা নতুন অর্থ তৈয়ার করতে পারে কি না, সে বিষয়ে মত দেওয়া আমার কাজ নয়। এই জীবনী পাঠ করলে অনেক মেধাবী লোকই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন। আমরা সেই অপেক্ষায় থাকলাম।
রাজনৈতিক ঘটনাগুলো জীবনী-পাঠের মাধ্যমে উপস্থাপিত হয় আমাদের চেতনায়। হয়েছেও তাই। কিন্তু এই চিত্রের কম-বেশি কিন্তু আছে। মানে অনেকেই তো এই বিষয়টা এড়িয়ে যাওয়ার ব্যাপারেও আগ্রহ দেখান। কিন্তু শাহেদ আলী সেটা করেন নাই। তিনি একেবারে শতভাগ রাজনৈতিক ইতিহাস তুলে না ধরলেও একটা বিস্তৃত রাজনৈতিক পটভূমির খোঁজ আমরা পাব। শাহেদ আলীর জন্ম ঔপনিবেশিক বাংলায়। সেই বাংলা আবার কেন্দ্র কলকাতা থেকে বহু দূরে অবস্থিত। ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে, ঔপনিবেশিক আমলে, শাহেদ আলী অভিজ্ঞতার সংকটের কারণে ঔপনিবেশিক রাজনীতির প্রায় কিছুরই বয়ান সেভাবে তৈয়ার করতে পারেননি। কিন্তু ঔপনিবেশিক আমলের শেষ দিকে রাজনৈতিক উত্তাপের অনেক কিছুই তিনি ধারণ করেছিলেন। সেই আলাপ আগেই হয়েছে। আবার যে পাকিস্তান জাতীয়তাবাদের সমর্থনে একসময় অনেক কিছুই ছেড়েছিলেন শাহেদ আলী। তার বিপক্ষে নির্মিত, অবশ্যই দরকারি, বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূতিকাগার ভাষা আন্দোলনের পক্ষেও তাঁর সক্রিয়তা ছিল বিশেষ। এবং তৎপরবর্তী সময়ে আরও নানান রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড এই বিষয়কে আরও শক্তিমান করে তুলেছে। যদিও একটা সময়ে শাহেদ আলীকে আর রাজনীতির ময়দানে দেখা যায় নাই। কিন্তু যতটুকু দেখা গেছে তা ঔপনিবেশিক আমল থেকে শুরু করে দুটো জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে।
লেখকের কেবল লেখার দায়িত্ব পুরা করার ভেতর দিয়েই শেষ হয়ে যায় না। সমাজ ও রাষ্ট্রিক দায়িত্ব পালনও একজন লেখকের জন্য জরুরি বিষয়। শাহেদ আলী যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন-পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সময়ে কর্মজীবনে শিক্ষকতাকেই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। এবং এই পেশার সাথেই তাঁর সবচেয়ে বেশি সময় সম্পর্ক ছিল। কিন্তু ওই যে বললাম লেখালেখির একটা দায়িত্ব তো শাহেদ আলী নিয়েছিলেনই বটে। কিন্তু সেই দায়িত্বের বাইরে সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য হিতকর নানান দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এবং তা তিনি পুরা করেছিলেন দক্ষতা আর সুনামের সাথেই। আরও বেশ কিছু চমৎকার অনুষঙ্গ এই জীবনীতে আছে। পাঠককে সব বলে দিয়ে এই পুস্তক পাঠ থেকে বিরত রাখা এক ধরনের অপরাধই বটে! ফলে পাঠক এই পুস্তক পাঠের ভেতর দিয়েই এই বিষয় পুরা করতে পারবেন। বিশেষ করে গ্রামীণ জীবনের দ্বিতীয় পর্বের বয়ান আর শাহেদ আলীর লেখক হবার কাহিনিটা। এ ছাড়া আরও কয়েকটি অনুষঙ্গ।
শেষে এই কথা বলতে হয়, শাহেদ আলীর জীবনী পড়ার পর এই বিষয় বেশ স্পষ্টই হয় যে, জীবনী লেখার বেলায় তিনি বিক্ষিপ্ত চিন্তা-পদ্ধতির আশ্রয় নেননি। তবে অনেক লেখক বিক্ষিপ্ত ঘটনাবলিকে জীবনী আকারে চিত্রিত করেন। এই বিষয় ক্রনোলজিক্যাল বয়ানের বিপরীতে অবস্থান নিয়ে একটি বিক্ষিপ্ত ইতিহাসকে দাঁড় করান। বিষয়টা যে একেবারেই বাজে বিষয়, তা বলছিনে। কিন্তু এই বিষয়টা ধারাবাহিক ইতিহাস তৈরি করতে গিয়ে একধরনের সমস্যা তৈরি করে। শাহেদ আলী কিন্তু এই ক্রনোলজিকে মেনেই তাঁর জীবনী রচনা করেছেন। ফলে সাধারণ পাঠকও একটা আরাম পাবেন, এই জীবনী পাঠ করতে গিয়ে।