‘প্রথম’ বাঙালি মুসলমান আধুনিক গল্পকার

 

গোলাম কাসেম ড্যাডির জন্ম ৫ নভেম্বর ১৮৯৪ সালে, অবিভক্ত ভারতের জলপাইগুড়িতে। জন্মের অল্প সময় পরে তাঁর মা গত হন। নবজাতকের নাম রাখা হয় গোলাম কাসেম আল্লারাখা। পৈত্রিক বাড়ি ফরিদপুরের মাদারীপুর। বাবা খানসাহেব গোলাম রাব্বানী ছিলেন কলকাতা আইজির পুলিশ সুপারিনটেনড্যান্ট। বাবা চেয়েছিলেন, ছেলে তাঁর চেয়ে বড় কিছু হবে। কিন্তু ছেলে পাঠ্যপুস্তক বাদ দিয়ে ছবি তোলা, লেখালেখি, সার্কাস, থিয়েটার, ম্যাজিক, ঘোড়দৌড় আর বায়োস্কোপের নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। তাই আইএ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর ছেলেকে সাবরেজিস্ট্রার পদে চাকরির ব্যবস্থা করেন। ১৯৪৯ সালে ডিস্ট্রিক রেজিস্ট্রার হিসেবে অবসর নেন ড্যাডি। আর পরলোক গমন করেন ১৯৯৮ সালে ৯ জানুয়ারি। 

দেশ ভাগের পর তিনি পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। ১০৪ বছরের কিংবদন্তীর এক বর্ণাঢ্য জীবন যাপন করেছেন তিনি। ১৯১৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে আইএ ক্লাসের ছাত্র থাকাকালে কলকাতা ইউনিভার্সিটি ইনফ্যানট্রি কোরের সদস্য হিসেবে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন ড্যাডি। বিহারের মধুপুরে প্রশিক্ষণ ক্যাম্পে অবসরে গল্প লেখার সূচনা। ১৯১৮ সালে তাঁর প্রথম গল্প সুন্দরী প্রকাশিত হয় বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য পত্রিকায় [প্রথম বর্ষ তৃতীয় সংখ্যা, কার্তিক ১৩২৫]। ২৬ বছর বয়সী কোনো মুসলমান লেখকের এমন গল্প সে সময়ে অভাবিতপূর্ব।

বাংলা সাহিত্যে সওগাত যুগ গ্রন্থে মোহাম্মদ নাসিরউদ্দীন লিখেছেন, সওগাত প্রকাশের সময় কোনো মুসলমান লেখকের গল্প পাওয়া যায়নি। প্রথম ও দ্বিতীয় সংখ্যায় ছাপা হয় ব্রজমোহন দাস, জলধর সেন, পাঁচুলাল ঘোষ ও নবকৃষ্ণ ঘোষের গল্প। তৃতীয় সংখ্যায় দুজন গল্প লেখক পাওয়া গেল। একজন গোলাম কাসেম, আরেকজন একরামদ্দীন। দীর্ঘদিন এই দুজন গল্প লেখক ছাড়া কোনো ভালো গল্প লেখকের সন্ধান পাওয়া যায়নি। নাসিরউদ্দীন আরো লিখেছেন, সে সময়ের পাঠকসমাজ গোলাম কাসেমের গল্প পড়ার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকতেন। সওগাত ছাড়াও ড্যাডির গল্প মাসিক মাহে নও, দিলরুবা, বঙ্গনূর, দৈনিক ইত্তেফাক, বিপিএস নিউজ লেটার ও মাসিক ফটোগ্রাফি পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। সর্বশেষ গল্প ছবির পুরস্কার ছাপা হয় মাসিক ফটোগ্রাফির ১৯৯৬ সালের ডিসেম্বর সংখ্যায়; তাঁর বয়স তখন ১০২। ড্যাডি গল্পকার হিসেবে ১৯৭৮ সালে নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক লাভ করেন। নিচে পত্রস্থ গোলাম কাসেম ড্যাডির এক টুকরো স্মৃতি অগ্রন্থিত গল্পটি ধ্রুপদি নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা।

গবেষক সাহাদাত পারভেজের নোট

গোলাম কাসেম ড্যাডির প্রতিকৃতি © শিল্পী শিশির ভট্টাচার্য

 

এক টুকরো স্মৃতি

 

এক

ক্রিং ক্রিং ক্রিং।

সাইকেলের বেলের একটু পরেই উঠানে সাইকেল ফেলে দেবার একটা শব্দ হলো, তারপরই পাগলা হাওয়ার মতো একটা বারো বছরের ছেলে আমার ঘরে এসে প্রবেশ করল।

ছেলেটার গড়ন পাতলা ছিপছিপে, তার বর্ণ গৌর, সমস্ত দেহে একটা অদমনীয় চাঞ্চল্যের স্পন্দন। কিন্তু সবচেয়ে তার আকর্ষণীয় জিনিস হলো তার চোখ দুটি। বড় বড় ভাসা ভাসা চোখ যেন মোটরের দুটি হেডলাইট।

তাকে দেখে খুব উৎফুল্ল হয়ে বললামআরে রশিদ যে! এসো এসো। তারপর খবর কী?

সমস্ত ঘরের মধ্যে অকারণে কয়েকবার চঞ্চলভাবে ঘুরে তারপর হঠাৎ থেমে গিয়ে বললেচলুন চাচা। মাছ ধরতে যাই। আমি একটা পুকুর দেখে এসেছি। এতে অনেক মাছ আছে। টোপ ফেলতে না ফেলতে টপাটপ মাছ খাবে, আর পটাপট তা তুলব।

প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বের কথা। আমি তখন বাঁকুড়া জেলার কোনো পার্বত্য অঞ্চলে চাকরি করি। রশিদের আব্বাও সেখানে তখন পুলিশের চাকরি করেন। আমাদের এই দুই পরিবারের মধ্যে রশিদের মারফতেই দেখতে দেখতে ঘনিষ্ঠতা জন্মে গেল। রশিদের আব্বা আমায় ভাই বলতেন, কাজেই আমি হলাম রশিদের চাচা।

ওর আবদার কোনোদিন অগ্রাহ্য করতে পারিনি, আজো পারলাম না। বাইক নিয়ে ওর সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সেদিনটা অবশ্য ছিল রবিবার, অর্থাৎ ছুটির দিন।

ওর মাছ ধরার সাজসরঞ্জামও অদ্ভুত। একটা বাঁশের কঞ্চি, হাত চারেক লম্বা। তাতে একটা বেয়াড়া রকমের মোটা সুতা বাঁধা। বড়শি বলতে একটা বাঁকানো লোহা। সেটা যেকোনো মাছকে গেঁথে ওপরে তুলে আনবে তা মোটেই মনে হয় না।

নির্দিষ্ট ঠিকানায় পৌঁছে আমরা পাশাপাশি ছিপ ফেললাম। রশিদ কিন্তু ছিপ নিয়ে এক জায়গায় স্থির হয়ে বসতে পারল না, সে ছিপ হাতে সমস্ত পুকুরটি প্রদক্ষিণ করতে লাগল, এখানে-সেখানে খামখেয়ালিভাবে ছিপ ফেলে।

বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরি করবার পর ছিপখানি আমার পাশে বিরক্তভাবে ছুঁড়ে দিয়ে বললআচ্ছা চাচা বলুন তো, লোকে কী করে এত ধৈর্য ধরে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফাতনার দিক একদৃষ্টে চেয়ে থাকে?

ইতিমধ্যেই আমি দুটি মাছ তুলেছিলাম। সেদিকে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে ধৈর্য সম্বন্ধে তাকে একটা ছোটখাটো লেকচার দিলাম।

সে যে আমার কথা শুনছিল তা মনে হলো না। কেননা হঠাৎ তার মুখ থেকে বেরিয়ে এলো একটি মাত্র শব্দ চমৎকার আর এই শব্দে আকৃষ্ট হয়ে তার দিকে চেয়ে দেখলাম, পুকুরের পানির দিকে তার নজর নেই। সে বিভোলের মতো চেয়ে আছে আকাশের দিকে, যেখানে হালকা মেঘের স্তরগুলো বাতাসের দোলায় নানা ভঙ্গিতে রূপ বদলাতে বদলাতে কোনো অসীমের দিক ছুটে চলেছে।

আর এক দিন ও আমার সাথে শিকারে গেল। কয়েকটি পাখি মারবার পর একঝাঁক হরিয়াল পাওয়া গেল। গুলি করতে দুটো পড়ল। একটা তখনো জীবিত। সেটাকে হাতে করে তুলে দরদ ভরা চোখে তার দিক চেয়ে বললচাচা কী সুন্দর দেখতে তাই না? দেখুন, ওর চোখ দুটো। কত করুণ, কত ব্যথায় ভরা। না চাচা, হরিয়াল শিকার আর করবেন না।

বনে-জঙ্গলে শিকারের উত্তেজনার মধ্যেও তাকে মাঝে মাঝে বেশ আনমনা হতে দেখতাম। আমি যখন শিকার সন্ধানে ছোটাছুটি করে গলদঘর্ম হচ্ছি, ও হয়তো কোনো জংলি ফুলের সমারোহের মধ্যে বিচিত্র প্রজাপতির নৃত্যভঙ্গিমা লক্ষ করছে। না হয় পাহাড়ি ঝরনার উচ্ছ¡সিত গতিভঙ্গিমার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

কিন্তু সবচেয়ে ওকে মুগ্ধ করত সাঁওতালি নাচ। বাঁশির সুরে ও মাদলের তালে মেয়েরা যখন হাত ধরাধরি করে তাদের সুঠাম দেহশ্রীতে একই ছন্দে দোলা দিত, তখন সে মন্ত্রমুগ্ধের মতো সেদিকে চেয়ে থাকত। একদিন ওর আব্বা আমায় বললেনদেখুন ভাই, আপনি রশিদকে একেবারে মাটি করে দিলেন। ও সবসময়ই আপনার এখানে আসে, আপনার মতো ফটো তোলা, গল্প লেখা ওর খুব ভালো লাগে। লেখাপড়ায় ওর মোটেও মন নেই। পড়া ছেড়ে বসে বসে কবিতা লেখে। আমাদের কথা ও মোটেই শোনে না। আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন না, ওকে শুধরোবার জন্য।

কথাটা শুনে অবাক হয়ে গেলাম। দুঃখও হলো। আজাম সাহেব ছেলেকে যে কত ভালোবাসেন তা সেই দিন জেনেছিলাম, যে দিন আমার বাসায় গান শুনতে শুনতে হঠাৎ তিনি খবর পেলেন রশিদকে সাপে কামড়েছে। খবর পাওয়া মাত্র তিনি পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে আমার ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে পড়েছিলেন।

ওর বাবার কথা ওকে বললাম। ও একটু হেসে বললেহ্যাঁ, আব্বা আমায় অতি সুবোধ ছেলে হতে বলেন। সবসময় লেখাপড়া করতে বলেন। ওর আশা, আমি ভালো করে লেখাপড়া শিখে এখানকার সব ডিগ্রিগুলো শেষ করে বিলেত যাই। তারপর সেখান থেকে ফিরে এসে একটা ভালো ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে বসি। কিন্তু সত্যি বলতে কি চাচা, আমি এসব হতে মোটেই পছন্দ করি না। আমি চাই একজন শিল্পী হতে, খুব বড় শিল্পী হতে, তাই আমার ছবি আঁকা, ফটো তোলা, কবিতা লেখা, ছোট ছোট গল্প লেখাসব খুব ভালো লাগে। আর আপনার এসব দিকে ঝোঁক আছে বলেই তো আপনাকে এত ভালো লাগে ও আপনার কাছে আসি।

বুলবুল চৌধুরীর নৃত্য পরিবেশনা। ছবি © গোলাম কাসেম ড্যাডি । সাহাদাত পারভেজের সৌজন্যে প্রাপ্ত


দুই

এরপর অনেক বছর কেটে গেছে। আমি তখন ছুটি নিয়ে নিজের বাড়িতে আছি। এমন সময় একদিন হঠাৎ অপ্রত্যাশিতভাবে সে আমার ওখানে গিয়ে হাজির। এখন সে আর পাতলা ছিপছিপে রশিদ নয়। সে সুশ্রী বলিষ্ঠ যুবক। সারা দেহে তার স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্য টলমল করছে।

বহুদিন পর দেখা হতে খুশিতে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। বললামআরে রশিদ যে, ইস, এত বড় হয়েছ তুমি?

রশিদ হেসে বললেআপনি কি চাচা মনে করেন আমি চিরকাল সেই বিশ ইঞ্চি সাইকেল চড়া ছোট্ট রশিদই থাকব? আপনিও তো কত বদলে গেছেন বয়সের গুণে। হ্যাঁ, একটা কথা, আমি কিন্তু আর রশিদ আহমেদ চৌধুরী নই; আমি বুলবুল চৌধুরী।

আমি বেশ অবাক হয়ে বললামবুলবুল চৌধুরী? তা বাপ-মার দেয়া নামটা বদলালে কেন? ওদের ওপর রাগ করে না কি?

বুলবুল বললেনা চাচা। এটা হয়েছে আর্টের খাতিরে। আমি যে রাস্তা বেছে নিয়েছি তার জন্য এ নামই উপযুক্ত।

আমি মৃদু হেসে বললামবটে, তা বুলবুল, তোমার এখন কী করা হয়?

বুলবুল বললেএই তো, এবার বিএ ফাইনাল দিচ্ছি। কিন্তু লেখাপড়ায় তো মন বসে না। আব্বা পড়ার জন্য যে টাকা পাঠান তা নাচের ব্যাপারেই খরচ হয়ে যায়। সত্যি আমি তার কাছে খুবই লজ্জিত। আমার ভীষণ দুঃখ আমি তার উপযুক্ত হতে পারলাম না।

আমি আশ্চর্য হয়ে বললামনাচ? সে আবার কী?

চায়ের পেয়ালায় একটা চুমুক দিয়ে ও বললেআমি নৃত্যশিল্পকে বরণ করে নিয়েছি। আমি এখন নাচ শিখি, আবার সঙ্গে সঙ্গে অপরকে নাচ শেখাই।

আমি একটু উদ্বেগকণ্ঠেই বললাম, তাই তো, এ তো ভয়ংকর ব্যাপার! কিন্তু তুমি যে পথ বেছে নিয়েছ এতে যে সমাজচ্যুত হয়ে যাবে। মুসলমান হয়ে, ভদ্রলোকের ছেলে হয়ে নাচবে? বিশেষ করে মেয়েদের নিয়ে? এটা কি আমাদের কনজারভেটিভ সমাজ বরদাস্ত করবে?

বুলবুল একমুখ হেসে বললেতা আমায় জানা আছে চাচা। কিন্তু উপায় নেই। যারা নীতিবিদ ও রক্ষণশীল তাদের বাদ দিয়েই আমায় বেঁচে থাকতে হবে।

আমি একটু চিন্তা করে বললাম, বেশ রিস্কি তাতে সন্দেহ নেই। আচ্ছা, এত রকম পেশা থাকতে তুমি এটাই বেছে নিলে কেন?

বুলবুল চা শেষ করে পেয়ালাটা টিপয়ে নামিয়ে দিয়ে বললে

নৃত্যশিল্পে আমাদের কেউ নেই বলে এটা বেছে নিলাম।

সেদিন ওর কয়েকখানা ছবি তুললাম। ছবি তোলা শেষ হয়ে গেলে ও বললে চলুন চাচা, আপনাকে রবিন রায়ের সাথে আলাপ করিয়ে দিই। রবিন রায়ের নাম শুনেছেন তো? খুব উঁচুদরের অ্যামেচার ফটোগ্রাফার।

সন্তোষের কুমার রবিন রায়ের পরিচয় আমি পেয়েছি কোডাক ম্যাগাজিনের মাধ্যমে এই ফটোম্যাগাজিনে মাঝে মাঝে রবিন রায়ের ছবি বের হতো। অদ্ভুত ছবি সেগুলো।

বুলবুলের কথায় খুব লোভ হলো কুমারের সাথে আলাপ করবার জন্য। তবে কিছুটা ভয়ও ছিল। কেননা রবিন রায় মস্ত লোক আর আমি তার তুলনায় অতি সামান্য। তিনি একজন প্রতিভাশালী, অ্যামেচার আর আমি মাত্র একজন মামুলি শিক্ষার্থী।

বুলবুল আমায় কুমার রবিন রায়ের কলকাতার বাড়িতে নিয়ে গেল।

দেখলাম রবিন রায় বুলবুলকে বিশেষভাবে ভালোবাসেন।

কুমার আমাদের চা খাওয়ালেন তারপর তার কতকগুলো ছবি দেখালেন। তখন আমি তরুণ অ্যামেচার। তার ছবিগুলো অপূর্ব লেগেছিল। তিনি গালার তৈরি কতকগুলো ছবি দেখিয়েছিলেন, সেগুলোও অদ্ভুত।

তিনি যুদ্ধের কতকগুলো ছবি দেখালেন। দুটো বম্বারে যুদ্ধ হচ্ছে। বম্বারে আগুন লেগে আকাশ থেকে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে।

ছবিগুলো অবাক হয়ে দেখে বললাম, আপনি যুদ্ধের মাঝখানে গিয়ে এত বিপদের মধ্যে এই ছবিগুলো তুলেছেন।

কুমার একটু হেসে আমায় তার স্টেজে নিয়ে গেলেন। সেখানে নকল অ্যারোপ্লেন ও অন্যান্য যুদ্ধসামগ্রী দেখিয়ে বললেন, ছবিগুলো সব স্টেজেই নেয়া হয়েছে।

নকল জিনিস সাজিয়ে নিয়ে এমন রিয়েলিস্টিক ছবি তৈয়ার করা যেতে পারে তা আমার ধারণার অতীত! আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই বেরিয়ে এলো মারভেলাস!

রবিন রায়ের প্রাসাদ থেকে বেরিয়ে আসতে বুলবুল বললেকেমন দেখলেন কুমারকে?

আমি বললামচমৎকার

বুলবুল বললেএসব লোকের সাথে একটু আলাপ-সালাপ থাকলে অনেক সময় অনেক উপকার হয়। রবিন রায় আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন, আরো করবেন এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। দেখুন চাচা, অনেক সাহস করে, নিজের আত্মীয়স্বজনকে দুঃখ দিয়ে এই কাজে নেমেছি। রবিন রায়ের মতো কয়েকজনের কাছে উৎসাহ পেয়েছি আর সকলেই নিরুৎসাহ করেছে। আপনি নিজে শিল্পী, আমি আশা করি আমার এই শিল্প সাধনার জন্য আমায় দোয়া করবেন। আপনাদের দোয়ায় ও আমার নিজের চেষ্টায় আমার আশা আছে উদয় শংকরের মতোই আমি একজন বিখ্যাত নৃত্যশিল্পী হবো। হয়তো তার চেয়েও বিখ্যাত হতে পারি। কী বলেন চাচা, হবো না?

সেদিন সত্যিই অন্তর থেকে তাকে দোয়া করেছিলাম। তবে ওর আব্বার সেই দরদি আপনভোলা মুখের কথা মনে হতেই মনটা বেশ দমে যেত। তাই ওকে বললামকিন্তু তোমার আব্বা?

বুলবুল হঠাৎ যেন চমকে উঠল। তারপর বললেও আব্বা। হ্যাঁ, আমি তার উপযুক্ত পুত্র হবো। দেশ-বিদেশ থেকে এমন যশ উপার্জন করব যাতে আব্বা ও আর সকলেই আমার জন্য গর্ববোধ করবেন।

ওর কিছুকাল পরে কলকাতার একটা বিখ্যাত স্টেজে বুলবুলের নাচ দেখবার সুযোগ ঘটেছিল। সেই দিনই বুঝেছিলাম এই তরুণ নৃত্যশিল্পী সমস্ত দুনিয়ার যশের মুকুট মাথায় পরবে।

আবার কতগুলো বছর কেটে গেল।

পাকিস্তানের জন্ম হলো। চাকরি শেষে ঢাকায় চলে এলাম।

এখানে ১৯৫০ সালে বুলবুলের সাথে আবার দেখা। সে হঠাৎ আমার তেজগাঁওয়ের বাসায় এসে উপস্থিত হলো।

শুনলাম সে সিলেট ও চট্টগ্রামে নাচ দেখিয়ে এসেছে। ইরানের শা তার নাচ দেখে খুব প্রশংসা করেছেন।

বালক রশিদ বুলবুলে পরিণত হয়ে নৃত্যশিল্পে যে উচ্চ হতে উচ্চতর শিখরে আরোহণ করে চলেছে, তা আমার জানা ছিল। তবু সেদিন তার নিজ মুখে তার কৃতিত্বের পরিচয় পেয়ে বুকটা গর্ব ও আনন্দে ভরে উঠেছিল।

এরপর ওর সাথে আবার আমার দেখা ১৯৫৩ সালে। দেখা হতে ও আমায় নেমন্তন করলতার ও আফরোজার নাচ দেখতে গুলিস্তান হলে। শুনেছিলাম আফরোজা মেয়েটিকে সে-ই হাতেনাতে নাচ শিখিয়ে, তারপর তাকে বিয়ে করে।

আমার খবর পেয়ে সে আমাকে নাচের স্টেজে সমাদর করে নিয়ে গেল। তারপর ওদের দুজনের নাচ দেখলাম। অপূর্ব ওদের নাচ। ভারি খুশি হলাম দেখে। স্টেজের ওপর ওদের নাচের কয়েকখানা ছবিও নিলাম।

নাচ শেষে ড্রপ সিন ফেলে দেয়া হলো। স্টেজের ওপর বসে পড়ে সে দুই পেয়ালা চায়ের অর্ডার দিল।

চা খেতে খেতে মুখটা হঠাৎ একটু বিকৃত করে পেটে হাত দিয়ে বলেচাচা, ব্যথাটা আবার হলো দেখছি।

আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞাসা করলামকিসের ব্যথা?

সে উত্তর দিলওই একটা ব্যথা মাঝে মাঝে হয়।

আমি উদ্বিগ্ন হয়ে বললামএই ব্যথা নিয়ে তুমি নাচ করো? ট্রিটমেন্ট করাচ্ছ কিছু? একটা শুষ্ক হাসি হেসে ও বললেকী করি চাচা, না নাচলে তো চলে না। হ্যাঁ, ট্রিটমেন্ট হচ্ছে বই কি। তবে শিগগিরই ফরেইন যাচ্ছি। ওখানে ভালো ট্রিটমেন্ট হবে।

ওর কথায় বিশেষ আস্থা হলো না। যে সারা জীবন নিজের খেয়াল খুশির ওপর চলেছে, কোনো বিষয়ে কোনো সাবধানতার প্রয়োজন মনে করেনি, সে যে নিজের শরীর সম্বন্ধে যতœবান হবে, তা মনে হলো না। বুলবুল ঢাকায় থাকত বেচারাম দেউড়িতে। তখন তাদের নাচের প্রোগ্রাম চলছিল গুলিস্তানে। ওর কথামতো সেখানে গিয়ে ওর সাথে আবার দেখা করলাম। ওর বাচ্চাদের কয়েক খানা ছবিও তুললাম। ওর মুখে শুনলাম শিগগিরই ও বিদেশে যাবার আয়োজন করছে। অবশ্য সেখানে আফরোজা ও দলের অন্য কয়েকজনও যাবে তার সঙ্গে।

ওদের দোয়া জানিয়ে সেদিন ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে এলাম। এই শেষ দেখা। আর আমাদের দেখা হয়নি। কেননা কিছু কাল পরই সে এ জগৎ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল।

আমার দুর্ভাগ্য শেষ সময় তার সাথে দেখা করতে পারিনি, কেননা তখন সে কলকাতার হাসপাতালে।

সব চলে যায়, শুধু স্মৃতি থেকে যায়। তাই এখনো দেখি রশিদ ছিপ ফেলে দিয়ে তার ভাসা ভাসা চোখ তুলে সাদা মেঘের টুকরার দিকে মুগ্ধ দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।

[প্রচ্ছদে ব্যবহৃত রাজীব দত্তের ই-পোস্টারটি আলোকচিত্রী নাসির আলী মামুনের তোলা ছবি অবলম্বনে। কপিরাইট © ফটোজিয়াম

সম্পাদকের নোট

তর্ক বাংলায় প্রকাশিত গোলাম কাসেম ড্যাডির এক টুকরো স্মৃতি অগ্রন্থিত গল্পটি ধ্রুপদি নৃত্যশিল্পী বুলবুল চৌধুরীকে নিয়ে লেখা। এটি প্রকাশিত হয় সওগাত,  ১৩৮২ বাংলা [১৯৭৬ সাল], ৫৭ম বর্ষ, ৭ম সংখ্যায়। ড্যাডির গল্প পড়লে বোঝা যায়, কেমন ছিল বাঙালি মুসলমান সমাজের সাংস্কৃতিক বিকাশের পথ। তাঁর গল্প পশ্চাৎপদ সমাজ আর ঔপনিবেশিক রাজনীতির বিপরীতে বাঙালি মুসলমান সমাজের আধুনিক হয়ে ওঠার চলমান সংস্কৃতির অপূর্ব স্মৃতি কাহিনী। তিনটে কারণে আমরা গল্পটি প্রকাশ করেছি। প্রথমত, বাঙালি মুসলমান সমাজের বিকাশকে আমলে নেওয়া। দ্বিতীয়ত, ড্যাডি তাঁর সময়, সমাজ আর সংস্কৃতিকে কিভাবে বিচার করছেন, সেটা দেখা। তৃতীয়ত, বাঙালি মুসলমান সমাজের চাপা পড়া ইতিহাসকে নতুন করে নজরে আনা। হয়তো এবারসমাজের আধুনিক গল্প সমালোচকরা গোলাম কাসেম ড্যাডিকে নতুন করে চেনবার ফুরসত পাবেন। উল্লেখ করবার বিষয়অসংখ্য গল্প লিখলেও হালনাগাদ ড্যাডির কোনো বই প্রকাশ পায়নি।  আমাদের গল্পটি প্রকাশের সুযোগ করে দেওয়ায় গবেষক ও আলোকচিত্রী সাহাদাত পারভেজকে কৃতজ্ঞতা জানাই।