
ছবির শুরুটাই হলো জীবনযুদ্ধ থেকে
মুর্তজা বশীর [Murtaja Baseer]
বাংলাদেশের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী, মুদ্রাতত্ত্ব বিশারদ ও লেখক মুর্তজা বশীর। জন্ম ১৭ আগস্ট ১৯৩২ সালে, ঢাকায়। ১৯৪৯ সালে ছাত্রাবস্থায় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন তিনি। তার আগে ১৯৪৮ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে বগুড়া শহরে সমাবেশ ও মিছিলের আয়োজন করেছিলেন। ১৯৫০ সালে তাঁকে মিথ্যা মামলায় গ্রেফতার করা হয়। ৫ মাস কারা ভোগের পর মুক্তি পান তিনি। পরবর্তীকালে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন। তাঁর আঁকা ড্রয়িং সেই আন্দোলনকে নতুন মাত্রা দিয়েছিল। ১৯৪৯ সালে ঢাকা চারুকলা কলেজে ভর্তি হন তিনি। শিক্ষা শেষে ১৯৫৫ সালে তিনি শিক্ষকতা শুরু করেন নবাবপুর স্কুলে। ১৯৫৬ সালে উচ্চশিক্ষার জন্য ইতালি যান। আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্ট-এ চিত্রকলা নিয়ে দুবছর পড়াশোনা করেন। ফ্লোরেন্স ছাড়ার আগে মুর্তজা বশীরের প্রথম একক প্রদর্শনী হয় ‘লা পার্মানেন্ট’ গ্যালারিতে। প্রদর্শনীটি চলে ১৯৫৮ সালের ২৯ মার্চ থেকে ১১ এপ্রিল নাগাদ।
দেশে ফিরে ১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে শিক্ষকতা গুরু করেনি তিনি। ১৯৯৮ সালে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। আধুনিক চিত্রশিল্পী মুর্তজা বশীর শিল্পকলার নানা পদ্ধতি ও নানা মাধ্যমে কাজ করেছেন বিস্তর। দেশে-বিদেশে তাঁর অসংখ্য একক ও যৌথ প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ শিল্পীজীবনে তিনি লাভ করেছেন অসংখ্য সম্মাননা ও পুরস্কার। তাঁর উল্লেখযোগ্য পুরস্কার ফ্রান্সের জাতীয় পুরস্কার [Prix National 1973], বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার [১৯৭৫], একুশে পদক [১৯৮০], সুলতান পদক [২০০৩], হামিদুর রাহমান পুরস্কার [২০১৫] ও স্বাধীনতা পুরস্কার [২০১৯]। বাংলাদেশের দ্বিতীয় প্রজন্মের আধুনিক এই শিল্পী ২০২০ সালের ১৫ আগস্ট করোনা আক্রান্ত হয়ে পরলোক গত হন। তর্ক বাংলায় তাঁর অপ্রকাশিত এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন শিল্পী ও লেখক মোস্তফা জামান।
—সম্পাদকীয় নোট
মুর্তজা বশীর © আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ
মোস্তফা জামান: আমরা আধুনিকতার যে সুনির্দিষ্ট ধারণার মধ্য দিয়ে শিল্পকর্ম ও শিল্পীদের দেখি এবং ব্যাখ্যা করি, তাতে সামগ্রিক চিত্র ফুটিয়ে তোলা যায় না। আধুনিকতার এমন খাটোতর ধারণা নিয়ে কিছু বলুন।
মুর্তজা বশীর: আমার কাছে যেটা মনে হয় যে, শিল্পকলার শুরুটা হয়েছিল মানুষের একটা জাদুবিশ্বাসের ওপর ভিত্তি করে। সেটা ছিল প্রাগৈতিহাসিক শুরু। প্রাগৈতিহাসিক মানুষ বড় বড় বন্য প্রাণীকে দেখছে, সে বন্য প্রাণীর তেজ বশ করার জন্য। সে গুহার গায়ে পাথরে সেই জন্তুটির কল্পিত ছবি আঁকত। এই ধরনের করে সে ভাবছে, এতে করে সেটাকে জাদু করা হলো, এবং এতে করে তাকে বশ করা যাবে। ছবির কিন্তু শুরুটাই হলো জীবনযুদ্ধ থেকে। সারভাইভাল, তার বেঁচে থাকার তাগিদ থেকেই কিন্তু ছবি আঁকার সূত্রপাত। আলাদা কিছু না। তারপরে আমরা দেখছি, ক্রমান্বয়ে যখন গোড়ার দিকের রেনেসাঁস থেকে রেনেসাঁস কিংবা বাইজেনটাইন বা তার আগ পর্যন্ত যে বাইজেনটাইন শিল্পগুলো, সেখানে দেখছি ছবিগুলোর ভিত্তি হয়ে উঠছে ধর্মকে কেন্দ্র করে।
মোস্তফা: কিন্তু গুহাচিত্রও তো একধরনের রিচুয়ালিস্টিক শিল্প, ম্যাজিক ধর্ম...
মুর্তজা: ওইটা কিন্তু বাঁচার তাগিদ থেকে! কিন্তু রেনেসাঁস শিল্পী কিংবা গোড়ার রেনেসাঁস বা বাইজেনটাইন এখানে কিন্তু বাঁচার তাগিদ ছিল না। এখানে ছিল, সম্পূর্ণভাবে ধর্মীয় নির্দেশে আদ্দিষ্ট হয়ে সে ছবি এঁকেছে, সেখানে সে শিল্পীর কিন্তু স্বাধীনতা ছিল না। শিল্পী এঁকেছে যেটা চার্চ থেকে নির্দেশিত হয়েছে, কিংবা পুরোহিত তাকে যা বলেছে, কিংবা যিনি স্পন্সর, সে ডিউক আর যে-ই হোক, রাজা মহারাজা বা যে-ই হোক, তাকে খুশি করার জন্য সে ছবি করেছে। এখানে তার ব্যক্তিস্বাধীনতা ছিল না। ব্যক্তিস্বাধীনতা যদি থাকত, ব্যক্তিস্বাধীনতা থেকে যে ছবি আঁকা হয়েছে, সেটা কিন্তু আবার গ্রহণযোগ্য হয়নি। যেমন, মিকেলেঞ্জেলো যখন স্লেভগুলো করল, সেগুলো কিন্তু তখন যাদের জন্য করেছিল, তারা কিন্তু তাতে আর আগ্রহ প্রকাশ করেনি। সেগুলো আনফিনিশড ছিল। সেগুলো সম্পূর্ণ করা হয়নি। কারণ হলো, ওই ধরনের কাজে পৃষ্ঠপোষকের অভাব ছিল। সাধারণ মানুষের জীবন কি সাধারণ মানুষের চিন্তাধারা, কিন্তু রেনেসাঁসেও আসছে না। তারপরে আমরা দেখি, রেনেসাঁর পরবর্তীকালে এই রোমান্টিক পিরিয়ডের ঠিক রিয়েলেস্টিকের আগে, ওই যে করোর ল্যান্ডস্কেপগুলো সেখানে দেখা যাচ্ছে, তারা ধর্মকে বাদ দিয়ে তাদের বাস্তবতাকে নিয়ে কাজ করতেছে। কিন্তু সর্বপ্রথম মানুষের জীবন নিয়ে ছবি আঁকেন রিয়েলিস্ট পেইন্টাররা। যেমন Courbet…সেটা কিন্তু তারা একেবারে ওই চার্চের বিধিনিষেধ থেকে বেরিয়ে তারা সম্পূর্ণভাবে জাম্প করল।
...যে বিরাট জাম্পটা হলো সেটা হলো আমেরিকাতে। আমেরিকাতে যে অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম শুরু হলো, তার কারণটা কী? আমেরিকার যে সমাজ, সে সমাজটা কী? সমাজটা হলো যে, মানুষ একা। নিঃসঙ্গ। সবকিছুর নিয়ন্তা যন্ত্র। স্লট মেশিনের মতো, দাম দিলেই কোকাকোলার মতো এসে যাচ্ছে, কিংবা দুধ এসে যাচ্ছে, তারপর পারিবারিক জীবন, পারিবারিক জীবন ভেঙে যাচ্ছে—মা অন্যত্র চলে গেছে, বাবাও তাই। এই যে একটা অস্থিরতা, এই অস্থিরতার ভিতর থেকে একধরনের ক্ষোভ, একধরনের রাগ—সেই রাগটাকেই বহিঃপ্রকাশ করল তারা ক্যানভাসে। রং দিয়ে ছিটিয়ে দিল। আঁচড় কাটল। ভ্যান গঘ যেমন করেছে। কেন ভ্যান গঘ মোটা মোটা ওই রকম কাজ করছে? অন্যেরা কেন করেনি? তার কারণ হলো যে ভ্যান গঘের একটা রাগ, সে যুদ্ধ করছে তার রংতুলি নিয়ে ক্যানভাসের সাথে। সে কিন্তু যুদ্ধ করছে ওখানে এবং তার যে ক্ষোভ, সেটা থেকে একেবারে ইচ্ছামতো তুলি চালিয়েছে। অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমের মতো এবং সেই সময় আমেরিকান সাহিত্যে বিট জেনারেশন রাইটার জ্যাক কেরোয়াকের ‘অন দ্য রোড’ একটা বিরাট প্রভাব রাখে। ঠিক একই সময় আবার বিলেতে যে গৎবাঁধা জীবন, সেই জীবনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হিসেবে এলো কিছু সাহিত্য। জন অসবোর্ন, লিন রিড বাঙ্কস, অ্যালেন সিলিটো, জন ব্রেইন এবং এরা এলো। এই সম্পর্কে সর্বপ্রথম বই লিখল কলিন উইলসন। ‘দি আউটসাইডার’ এবং ‘নেসেসারি ডাউট’ বলে বই লিখল সে। আর নাটক লিখল জন বার্জার। ফলে এই গ্রুপটা..., মনে হলো যে অ্যাংরি ইয়াং ম্যান। এদের একটা সামাজিক ইয়ে ছিল কি, এরা কিন্তু এসছিল প্রত্যেকেই শ্রমিকশ্রেণির ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে। তো দেখা যাচ্ছে যে, আর্টে এখন কাজ হচ্ছে, এখন কিন্তু কোনো মুভমেন্ট হচ্ছে না। আগে যেমন ইমপ্রেশনিজম, এক্সপ্রেশনিজম, দাদাইজম, অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজম, এখন কিন্তু হচ্ছে না। কারণ...
মোস্তফা: কিন্তু ষাটের দশকে আপনাদের যে, মানে অ্যাবস্ট্রাক্ট ইমপ্রেশনিজমের প্রভাব আপনাদের ওপর পড়ল, আপনারা যেভাবে অ্যাবস্ট্রাক্ট এক্সপ্রেশনিজমকে নতুনভাবে এখানে পরিচয় করালেন আরকি—আপনাদের নিজেদের ভাষায়, এখানে কি ওই রকম পরিস্থিতি ছিল যে আপনার বৈপ্লবিক কোনো...
মুর্তজা: এখন হলো কি, মানুষ, এখন কিন্তু দেখবে পৃথিবীতে কোনো একটি মুভমেন্ট বলতে, আর্ট মুভমেন্ট বলতে যেটা বোঝায়, যে একই রকম চিন্তাধারা নিয়ে এখন কিন্তু সেটা নাই। এখন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। নিজের আকাঙ্ক্ষা, নিজের অনুভূতি, নিজের অভিজ্ঞতাকে হয়তো সে প্রতিফলিত করছে। পরে হয়তো দেখা যাচ্ছে যে, এই বিচ্ছিন্নতা একই ধরনের। এই বিচ্ছিন্নতা নিয়ে তারা হয়তো একটা গ্রুপিং করার চেষ্টা করছে। এরা কিন্তু কোনো ফিলোসফিকে নিয়ে নয়, দেখা যাচ্ছে তাদের মিল নেই। আপাতদৃষ্টে চিন্তাধারায় মিল হলেও, এরা কিন্তু কোনো ফিলোসফিকে নিয়ে একত্রে বসে এটা করেনি। বর্তমান যুগে হলো কি, আমার কাছে যেটা মনে হয়, এখন দুটি ধারা। একটি হলো আর্ট ইজ আ ইউনিভার্সাল লেঙ্গুয়েজ বা আন্তর্জাতিকতাবাদ। আরেকটি হলো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ। এই দুটো ধারায় এখন পুরো বিশ্বের আর্ট। আমার কাছে তা-ই মনে হয়েছে। পুরো বিশ্বের আর্ট কিন্তু এই দুধারায়ই এখন চলছে।
মোস্তফা: এটা তো স্যার আধুনিক যুগের শব্দ! কিন্তু অনেকে বলে কনটেম্পরারি বাতচিতে আন্তর্জাতিকতা বলে কিছু নাই। কিন্তু যেটা প্রবর্তিত আছে...আমি জানি না, এটা হয়তো আন্তর্জাতিকতাবাদেরই একটা সম্প্রসারণ, ট্রান্সনেশনাল আরকি। যে নেশনগুলো আছে, এদের মধ্যে যোগাযোগও আছে। যেটা আদিতেও আসলে ছিল।
মুর্তজা: না, আদিতে ওইভাবে ছিল না। এখন তো হলো, ইন্টারনেট প্রযুক্তিগত কারণে এসব হয়েছে।
মোস্তফা: ইন্টারনেটের যুগে এমনভাবে সমস্ত কিছু ফ্লো করছে, যে ফ্লো কেউ আর থামিয়ে রাখতে পারবে না।
মুর্তজা: এক সেকেন্ডে পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে, এক মিনিটেই সব জেনে যাচ্ছে। ফলে সেই দিক থেকে আমরা একটা গ্লোবালাইজেশনের যুগে আছি। বিশেষ করে, আমাদের দেশে এই গ্লোবালাইজেশন, ইন্টারনেট ইত্যাদি প্রযুক্তির ফলে পৃথিবীর কোথায় কোন অঞ্চলে কী ধরনের কাজ হচ্ছে, তার সাথে একটা যোগসূত্র ঘটে যাচ্ছে। এবং তারা বিশ্বাস করে যে, আর্ট হলো আন্তর্জাতিক ভাষা। অতএব তারা আন্তর্জাতিকতার দিকে ঝুঁকেছে। তার ফলে দেশীয় ঐতিহ্য, দেশীয় মূল্যবোধ এইগুলোকে তারা অবহেলা করছে। যেমন ধরো, আমাদের দেশে, এখনো বাংলাদেশে যে বিমূর্ত চিত্রকলা হচ্ছে, আমি এটার সাথে তাল মিলাতে পারছি না। যে, কী করে বাংলাদেশে সম্পূর্ণভাবে বিমূর্ত চিত্রকলাগুলো হয়। তবে এখনো কিন্তু একজন শিল্পী, দুয়েকজন ছাড়া, একজন শিল্পী টোটালি এখনো বিচ্ছিন্ন না। সে পরিবারের সাথে বাস করে। সেখানে তারা বাবা আছে। মা আছে। ভাই আছে। বোন আছে। তাদের নিয়েই কিন্তু সে বসবাস করে আসছে।
মোস্তফা: সেই সামাজিক অবস্থা আর নেই, আপনি বলছেন?
মুর্তজা: হ্যাঁ, আমেরিকায় যে অবস্থা ছিল, সে পরিবেশে এখন আর তারা জীবন যাপন করছে না। অর্থাৎ আমেরিকান একজন শিল্পীর কাছে যেভাবে বাস্তবতা ছিল, যেভাবে একটা বিচ্ছেদি পরিবার...সেটা কিন্তু এখানে হয়নি। কিন্তু কিছু কিছু শিল্পী, যেমন ধরো কিবরিয়া, কিবরিয়া কেন এই ধরনের কাজ করছে? আমার বিশ্লেষণ হলো যে, কিবরিযার বাড়ি কোথায়, পশ্চিমবঙ্গে, বীরভূমে। সে এখানে এসেছে। তার এখানে কোনো আত্মীয়স্বজন নাই। অতএব, হি ইজ আ রোলার। সম্পূর্ণভাবে একা। তার কোনো বন্ধুবান্ধব নাই। তার কোনো আত্মীয়স্বজন নাই। যার জন্য তার কাজে কিন্তু এটার প্রকাশ দেখি, সে গ্রেভিয়ার্ডের ছবি আঁকছে। প্রথম দিকে, গ্রেভিয়ার। কোনো শিল্পী আজ পর্যন্ত গ্রেভিয়ার্ডের ছবি, কেন তারপর তার যে বিমূর্ত কাজগুলো, এই কাজগুলো আমি যেভাবে বিচার করে দেখেছি, যে তার জীবনটা হলো ক্ষত-বিক্ষত। বিচ্ছিন্ন জীবন। এলিয়েনেটেড সে। সে এই জগৎটাকে একটি সুন্দর কাঠামোর মধ্যে ভরতে চেয়েছে। এই জন্য কোয়েরি শৈশব কিছু এসেছে। এবং টেক্সচার, টেক্সচারটা কী? তার ক্ষত, তার হৃদয়ের, শারীরিক ও মানসিক যে যন্ত্রণা, তার নিঃসঙ্গতা, সেটাকে সে সুন্দর রং দিয়ে একটি প্রলেপ দিয়ে ঢেকে দিতে চেয়েছে। এটাই তো তার ছবির বিষয়বস্তু। তার মনোবিশ্লেষণ যদি আমি করি, এটাই হতে পারে তার কারণ। যেমন দেবদাস চক্রবর্তীর কাজ। দেবদাস চক্রবর্তীর কাজে আমি যেটা খুঁজে পাই, যে ভ্যান গঘের মতো তার একধরনের আত্মবিধ্বংসী প্রবণতা—কারণটা কি? সে ছিলো কলকাতায়, এই দেশে এসেছে। তার মধ্যে হলো, যেহেতু এখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ ধর্মবিশ্বাসী দলের সে নয়, তাকে কেউ দেখতে পারে না। ফলে তার মধ্যে একধরনের ক্ষোভ, একধরনের রাগ কাজ করেছে! এবং আমি দেবদাসের বাসায় যেতাম মাঝেসাজে, আমি তাকে দেখেছি সে কীভাবে কাজ করে। ঠিক ভ্যান গঘ যেভাবে উইদ ফুল অব অ্যাঙ্গার। ভ্যান গঘের ওপর আমি ডকুমেন্টারি দেখেছি, ঠিক সেইভাবে কাজ করে। ঠিক তারও কিন্তু কাজের ধরনটা ওইভাবেই ছিল। সেখানে সে লড়াই করছে ক্যানভাসের সাথে। তো, এখন বাংলাদেশে বিমূর্ত চিত্রকলা হওয়ার মতো এইটার কারণটা কী? এখানেও দুটি কারণ, যেটা আমার কাছে মনে হয়েছে। একটি হলো আন্তর্জাতিকতাবাদ...
মোস্তফা: মানে যে ট্রেন্ডটা একটা গ্লোবাল হেজিমনির জন্ম দিয়েছে...
মুর্তজা: কিন্তু মজাটা হলো ফ্রান্সে কোনটা হচ্ছে, লন্ডনে কোনটা হচ্ছে! এই যে খাঁটি বিমূর্ততা কোথায়, আর ফ্রান্সটা কোথায়! যদ্দুর জানি, আমি সবটা বলতে পারব না, যে ট্রেন্ডটা আমেরিকাতে যেভাবে হয়েছে, অন্য কোথাও সেভাবে হয়নি। ইতালিতে হয়নি। ফ্রান্সে হয়নি। লন্ডনের মতো জায়গায় হয়নি। জার্মানিতে হয়নি। ওইভাবে হয়নি।
মোস্তফা: আলাদা ভাষা ছিল। জার্মানদের আলাদা বিমূর্ত চিত্রকলার ভাষা ছিল।
মুর্তজা: ডাচরা করেছে অনেকটা এক্সপ্রেশনিজমের মতো—কেরল অ্যাপেল। এক্সপ্রেশনটা ওইভাবেই।
মোস্তফা: কিন্তু ওইটা অন্য ধরনের ফিগারেশন...নিউ ফিগারেশন সম্ভবত বলে।
মুর্তজা: বোধ হয়। আমি ঠিক এই টার্মগুলো বলতে পারব না। তো, এখন...
আমাদের এখানে প্রথমেই একটা জিনিস মনে করতে হবে আন্তর্জাতিকতা আছে। আমি প্যান্টশার্ট পরছি, এটা তো আমার দেশের না। আমার দেশের লোক তো লুঙ্গি পরে। ওগুলো আন্তর্জাতিক। কিন্তু আমার দেশ, দেশের মাটি, সেটা কিন্তু ভিন্ন। প্রকৃতি মানুষকে প্রভাবান্বিত করে। আমার কথাটা হলো কি জানো, যে আন্তর্জাতীয়তাবাদ বলে যদি আমি এটা করি, তো আমার প্রশ্ন হলো, কেন তারা অ্যাবস্ট্রাক্ট, ইমপ্রেশনিজমের মতো কাজ করে না।
মুর্তজা বশীর © আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ
মোস্তফা: মানে আমার এখানে একটা প্রশ্ন অন্য। স্যার, যদি ব্যক্তির নতুনত্ব, তার সৃষ্টিশীলতা এবং ব্যক্তির স্বাতন্ত্র্যকে বোঝানোর জন্য ছবি হয়ে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রবণতা ফলো করার প্রয়োজনটা কী? কিংবা আন্তর্জাতিক প্রবণতা যদি আমি গ্রহণও করে নিই, ওটাকে আমি ব্যক্তিগত মাত্রাই তো দিচ্ছি শেষ পর্যন্ত। আমি আসলে জানতে চেয়েছিলাম, ওটা কীভাবে দেখেন, এই যে আন্তর্জাতিক প্রবণতা, যেটা এখন আবার পোস্টমডার্নিজমের নামে যে ইনস্টলেশন বা অন্য নানা ধরনের কাজ সবাই করতে চাচ্ছে। আপনি যেখানে বলছেন বিমূর্ত শিল্পের কথা, এখানে সে রকম কোনো পরিস্থিতি ছিল কি না? গ্রহণ-বর্জনের যে ব্যাপার চলে শিল্পের মধ্যে, একজন শিল্পী তো ব্যক্তি, সৃষ্টিশীল ব্যক্তিত্ব। তো ওই সৃষ্টিশীল ব্যক্তি যদি গ্রহণ-বর্জনে যায়, তো এই গ্রহণ-বর্জনটা এত সহজ যদি হয়ে যায়, যে একটা প্রবণতা খুব জনপ্রিয়, আমি সেটা গ্রহণ করে নিলাম, নিয়ে আমি এটা চর্চা করলাম। আমার কোন নতুনত্ব আমি দেখাব, ওটাই তো ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য। আমি আমার যে নতুনত্ব দেখালাম, আমি যে এটা প্রয়োগ করছি। তো ওইখানের যে ব্যাপারটা সেটা কীভাবে সমাধান হচ্ছে যে আমি পশ্চিমা প্রবণতাকে অনুসরণ করছি, যেটা আন্তর্জাতিকতাবাদের নামে করি আর অনুকরণের নামে করি। তো করতেছি কিন্তু, আবার বলতেছি ‘আমি ব্যক্তি’! কিন্তু আসলে এই যে সামাজিক মানুষ, তার তো একটা সামাজিক স্তর আছে। তার একটা স্থানিক ব্যাপার আছে। সেই স্থানিকতা থেকে সে রূপান্তর করে একটা নতুন ভাষা দিয়ে প্রভাবিত হতেই পারে। প্রভাবিত হওয়া, আর নকল করা, এটা নিয়া আপনার কোনো পর্যবেক্ষণ আছে কি না?
মুর্তজা: কিন্তু আমার কাছে যেটা মনে হয়েছে যে, আমাদের এখানে প্রথমেই একটা জিনিস মনে করতে হবে আন্তর্জাতিকতা আছে। আমি প্যান্টশার্ট পরছি, এটা তো আমার দেশের না। আমার দেশের লোক তো লুঙ্গি পরে। ওগুলো আন্তর্জাতিক। কিন্তু আমার দেশ, দেশের মাটি, সেটা কিন্তু ভিন্ন। প্রকৃতি মানুষকে প্রভাবান্বিত করে। আমার কথাটা হলো কি জানো, যে আন্তর্জাতিকতাবাদ বলে যদি আমি এটা করি, তো আমার প্রশ্ন হলো, কেন তারা অ্যাবস্ট্রাক্ট, ইমপ্রেশনিজমের মতো কাজ করে না।
মোস্তফা: আরও আরও অনেক মুভমেন্ট আছে, অ্যাবস্ট্রাক্টই তো শুধু না...
মুর্তজা: অ্যাবস্ট্রাক্ট-ইমপ্রেশনিজমের মতো কাজ কেন করল না। ইমপ্রেশনিজমের মতো কেন কাজ করল না। তারা মানে এগুলো রিয়ালিজমের মতো কেন কাজ করল না। কেন করল না, তা আমার কাছে বড় প্রশ্ন। এখানে আমি যেটা দেখেছি, সেটা হলো, আধুনিক হওয়ার জন্য আধুনিকতার চর্চা। যেহেতু বিমূর্ত চিত্রকলা আঁকারও তার লক্ষ্য নয়...
মোস্তফা: একসময় এটা ছিল...
মুর্তজা: এখনো তাই হচ্ছে...তুমি চিন্তা করে দেখো, যে ছেলে অ্যাবস্ট্রাক্ট করছে, তার সামাজিক পটভূমি কী? তার পারিবারিক অবস্থান কী? সে এলিয়েনেটেড না হলে সে কী করে অ্যাবস্ট্রাক্ট পেইন্টিং করে, আমাকে তুমি এটা বোঝাও। তাকে তো সম্পূর্ণভাবে আউটসাইডার হতে হবে। সে কি নিঃসঙ্গ? সে তো নিঃসঙ্গ না! তার তো ভাই আছে, তার বোনের বিয়ের চিন্তা করতে হয়, তার বাপের ওষুধের কেনার কথা ভাবতে হয়, তার মায়ের চিন্তা করতে হয়, সে কী করে নিজেকে টোটালি বিচ্ছিন্ন ভাবছে? তো, সেখানে কী করে পুরোপুরি এই বিমূর্ত চিত্রগুলো হতে পারে? আমার মাথায় এটা একেবারে ঢোকে না। এটার কারণটা হলো যে, বাংলাদেশে একটি বই, যা বাজে প্রভাব সৃষ্টি করেছিল। সেটা আমেরিকার আর্টের একটা বই, নাম ছিল ‘আমেরিকান আর্ট সিনস নাইনটিন ফোরটি ফাইভ’।
মোস্তফা: ওটা কত সালের ঘটনা? আপনাদের স্টুডেন্ট লাইফের কথা কি, স্যার?
মুর্তজা: ওই রকম সময়ে হয়তো। আমার কাছে আছে বইটা, ‘আমেরিকান আর্ট সিনস নাইনটিন ফোরটি ফাইভ’। এই বইটা দেখে আর ইন্টারনেট দেখে, আমরা একরকম ইমিটেটিংই করে যাচ্ছি। আমি আধুনিক চিত্রকলার বিরুদ্ধে না। কিন্তু আমার কথাটা হলো, তুমি নিজে যদি এলিয়েনেটেড না হও তো কী করে এই বিমূর্ত শিল্প করো! যেমন কিবরিয়ার তা হয়েছে, ওটা যুগে যুগে ওয়ান পার্সেন্ট। কিবরিয়া এলিয়েনেটেড হয়েছে। কিবরিয়ার কাজ আমি সমর্থন করি। কারণ, তার জীবন এটাই। তার জীবন ক্ষতবিক্ষত। সেটা বিচ্ছিন্ন। সে তা অর্গানাইজড করেছে ক্যানভাসে। একটা সুন্দর কাঠামোর মধ্যে তা এসেছে। সেখানে তার বেশির ভাগ ছবি তো ধূসর বর্ণ, তার কারণটা কী?
মোস্তফা: তাহলে আমরা যদি তুলনা করি যে কিবরিয়া স্যার তার উল্টাটা করছে, বিউটিফাই করছে, এস্থেটিসাইজ করছে।
মুর্তজা: সে শুধু বিউটিফাই-ই করছে না, সে একটা সুন্দর জগৎ সৃষ্টি করছে। যেটা তার নাই।
মোস্তফা: এনশেনটেড ওয়ার্ল্ড...
মুর্তজা: না। তার নিজের জগৎ, যেহেতু সে ক্ষতবিক্ষত, সেটা হলো টেক্সচার। সেটাকে সুন্দরভাবে সে উপস্থাপন করছে, একটা নির্ধারিত এলাকার মধ্যে সে আনছে। গণ্ডির মধ্যে আনছে। যেটা সে চায় তার জীবনে। এবং সেখানে সে সুন্দর একটি রং, বেশির ভাগই দেখবা তার ছবিতে গ্রে এইগুলো, আর ডার্ক কালার। তারপরে মাঝে মাঝে একটু অরেঞ্জ, এগুলোই তার জীবনের আকাঙ্ক্ষা। এটাকে আমি যেভাবে দেখি, কিবরিয়ার কাজ পারফেক্টলি অর্ডার ফর কিবরিয়া। কিন্তু অন্য যে করছে সেখানে আমি একমত না।
মোস্তফা: আমি কিবরিয়া স্যার সম্পর্কে যেটা বলছিলাম যে, কিবরিয়া স্যার অ্যাবস্ট্রাকশনকে এইভাবে দেখলেন যে একেবারে বিউটিফুল একটা পিকচার তৈরি করছেন শেষ পর্যন্ত। দেখতে খুব সুন্দর, খুব এনশেনটিং মনে হয়...কিন্তু আমরা যদি জ্যাকসন পোলক বা আমেরিকান অ্যাবস্ট্রাকশন দেখি তারা যে সামাজিক পটভূমি থেকে আসা বিচ্ছিন্ন লোক. তাদের এই বিচ্ছিন্নতার মধ্য দিয়ে কিন্তু একধরনের ইরেশনালিটির প্রকাশ পাচ্ছে। ঠিক যুক্তিসংগত না কিন্তু। একেবারে বিস্ফোরণের মতো পেইন্টিং...
মুর্তজা: প্রথমেই তো আমি বলে এসেছি যে এলিয়েনেটেড সোসাইটি...বাপ চলে গেছে, মূল কথাটা হলো ব্রোকেন ফ্যামেলি। বাবা চলে গেছে...মা চলে গেছে...
মোস্তফা: তার তো বেশির ভাগই তো ডিসপ্লেসড, যেমন মার্ক রথকো ডিসপ্লেইসড, অন্য অনেকেই তো না, আমেরিকানই তো না, আরও অনেকেই...সবাই ডিসপ্লেসড...
মুর্তজা: মজাটা হলো কি জানো, ১৯৭৮ সালে যখন আমেরিকান সরকারের স্কলারশিপ নিয়া আমি আমেরিকায় ঘুরছি, তখন কিন্তু লেখা থাকত, মার্ক রথকো, আর্সেলে গোর্কি কিংবা ডি কোনিং, আমেরিকান আর্টিস্ট। কিন্তু আমি যখন ১৯৯৯ সালে আমেরিকা গেলাম, তখন কিন্তু আমি ভিন্ন চিত্র দেখলাম, তখন রাশান-আমেরিকান দেখলাম।
মোস্তফা: আগে আমেরিকানাইজ করার যে প্রক্রিয়াটা ছিল...
মুর্তজা: গোর্কি, রাশান-আমেরিকান, ডি কোনিং ডাচ-আমেরিকান—মানে জাতিগত যে পরিচয়টা আমি দেখলাম, আমার কাছে খুব অবাক লাগল...
মোস্তফা: জাতিগত প্রশ্নে আপনি যেটা বললেন যে, নিজের লোকাল বিষয়-আশয় সামনে নিয়ে আসা, সেখানে কিন্তু একই সমস্যা। এই যে গ্লোবালাইজেশনের নামে, একধরনের জরুরি জিনিস যে এইটাই শুধু গ্লোবালাইজেশন। এই একটা ট্রেন্ডই। হয় ইনস্টলেশন, আর না হলে আর বাকিগুলো গ্লোবালাইজেশনের আওতায় পড়ে না। ঠিক যে রকম আপনাদের সিক্সটিজ এ যে একটা ট্রেন্ডই, আধুনিক হতে হলে অ্যাবস্ট্রাক্ট হতে হবে। সিক্সটিজে এ রকমই একটা ট্রেন্ড ছিল।
মুর্তজা: অ্যাবস্ট্রাক্ট মানে, এখানে তো পিওর অ্যাবস্ট্রাক্ট হয়ইনি!
মোস্তফা: মানে মোটামুটি একটা অ্যাবস্ট্রাকশনের মধ্য দিয়ে যে গ্লোবাল ট্রেন্ড, এটাও একটা একের মধ্যে চলে যাওয়ার প্রবণতা ছিল। আবার যখন দেশজ কথা বলে অনেকে, তো দেখা গেল যে দেশজ বলতেও কিন্তু একটাই, এটুকুই দেশজ, এর বাইরে আর দেশজ হয় না। দেশজ যদিও আরও অনেক অনেক কিছু আছে আরকি। যে আপনি একটা ইনোভেশন করলেন ঢাকার একটা পার্টিকুলার কনটেক্সটে সেটাও কিন্তু দেশজ হবে। কিন্তু অনেকের ধারণা দেশজ বলতে গ্রামীণ। রুরাল, এটা সম্পর্কে আপনার মত কী?
মুর্তজা: শোনো, দেশজ বললে কিন্তু আমাকে গ্রামীণটাকেই বলতে হবে। যেইটা লোকশিল্প। সেটাই আমাদের দেশজ।
মোস্তফা: কিন্তু এর বাইরেও কি নতুন রীতি হতে পারে না? যেমন শহরে বসে যেটা আমি নতুন কিছু করতে যাচ্ছি...
মুর্তজা: না, শহরে বসে তুমি যেটা করছ সেটা হলো একটি আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত মানুষের মন দিয়ে একটা জিনিস আঁকছ। আর আরেকটা হলো, বংশানুক্রমিক শিক্ষা নিয়ে, শিক্ষিত না, কিন্তু পরম্পরা, বংশপরম্পরার মধ্য দিয়ে করা হয়। আর একটা প্রথাগত শিল্প বলতে যেটা বুঝি, সেটাই করছে। সেটা কিন্তু এখন তত দ্রুত না। তবে এখন কিন্তু দেখা যায় না, আগে আমি কিন্তু দেখেছি, ছোটবেলায় রিকশার পিছনে যে চিত্র...
মোস্তফা: ওগুলো তো একেবারে নতুন কাজ...
মুর্তজা: সেটা বলছি না। সেগুলো কিন্তু খুব সমাজ সচেতন ছিল। সময় যেমন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকার সময়ের ছবি, কিংবা ১৯৬৫ সালের যুদ্ধে আমি দেখেছি যে প্লেন, সেটাই। কিন্তু এখন বেশির ভাগই দেখা যায় যে, নায়ক-নায়িকা, সিনেমাভিত্তিক, কিন্তু আগে ওটা ছিল না। আগে ছিল এই রিকশাশিল্পীরা একটা প্রতিবাদী, মানে সমাজভিত্তিক। তারা ছিল সবচেয়ে সামাজিকভাবে সচেতন শিল্পী। যেমন করে আমেরিকার পপ আর্টিস্টরা, কোকাকোলার বোতল যে একটা পেইন্টিং হতে পারে, কিংবা একটা বিলবোর্ড, কিংবা একটা কমিক বই, ওই ডট, ডট, ডট...দিয়ে যে কমিক, এইটা কিন্তু আগে কখনো কল্পনা করিনি।
আমাদের শিল্পীরা যেটা আঁকে, কামরুল ভাইও এঁকেছেন, যে সুন্দরী রমণী, কোমরে কলসি, কিন্তু আমি তা আঁকিনি। এই যে রমণী পানি টানতে টানতে রাখার জায়গাটিতে, কোমরে তার ঘা হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে শরীর। কিংবা গ্রামের একটি মেয়ে ওই নদীর পানি আনতে আনতে যে কষ্ট, এটাকে আমি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি একজন বিদেশি পর্যটকের দৃষ্টিতে কিন্তু এটা দেখিনি। ফলে আমি যেটা এঁকেছি সেটা অন্যভাবে ইন্টারপ্রেট করার চেষ্টা করেছি।
মুর্তজা বশীর © আলোকচিত্র: সাহাদাত পারভেজ
মোস্তফা: আমরা যদি ঢাকায় বসে, ঢাকার রিয়েলিটি নিয়ে কাজ করি, বা বাংলাদেশের নতুন ডেভেলপমেন্ট নিয়ে কাজ করি, তাহলে নট নেসেসারি নিজেকে গ্রামীণ হতে হবে। গ্রামীণ হবে না, কিন্তু সেটাও ঢাকারই কাজ হবে।
মুর্তজা: বাংলাদেশে তুমি যে ল্যান্ডস্কেপ দেখবে, মানুষ গৌণ, প্রকৃতিটাই প্রধান। খেত, কিংবা নৌকা, মানুষ কিন্তু খুব ছোট। কিন্তু আমার যে রাজনীতি, আসলে মানুষের সাথে সম্পর্কিত প্রকৃতি, মানুষ আছে বলেই প্রকৃতি আছে। যে প্রকৃতির সাথে মানুষের কোনো সম্পর্ক নাই, সেখানে মানুষ বড় হবে। প্রকৃতি কর্তৃত্ব করবে না। মানুষ ওটার দৃষ্টিভঙ্গিতে যতটা ধানক্ষেত আসতে পারে, ততটা ইয়ে আসতে পারে, ওইটা...। ফলে হলো কি, এই মানুষ প্রধান কাজ, এবং সাধারণ মানুষের কাজ, আমি ‘কলসি কাঁখে মেয়ে’ এঁকেছি। কিন্তু ‘কলসি কাঁখের মেয়ে’ আমাদের শিল্পীরা যেটা আঁকে, কামরুল ভাইও এঁকেছেন, যে সুন্দরী রমণী, কোমরে কলসি, কিন্তু আমি তা আঁকিনি। এই যে রমণী পানি টানতে টানতে রাখার জায়গাটিতে, কোমরে তার ঘা হয়ে গেছে। বেঁকে গেছে শরীর। কিংবা গ্রামের একটি মেয়ে ওই নদীর পানি আনতে আনতে যে কষ্ট, এটাকে আমি উপলব্ধি করার চেষ্টা করি। আমি একজন বিদেশি পর্যটকের দৃষ্টিতে কিন্তু এটা দেখিনি। ফলে আমি যেটা এঁকেছি সেটা অন্যভাবে ইন্টারপ্রেট করার চেষ্টা করেছি।
মোস্তফা: কিন্তু ‘দেয়াল’ সিরিজ ছবিগুলোকে আপনি কীভাবে বর্ণনা করবেন?
মুর্তজা: ইতালিতে যখন গেলাম, তখন আমি ছবি আঁকতে অনুপ্রাণিত হই পরিতোষ সেন দ্বারা। তখন পরিতোষ সেন প্যারিস থেকে ফিরেছে। স্টেটসম্যান পত্রিকায় তখন প্যারিস প্রত্যাগত শিল্পীদের ওপর প্রতি সপ্তাহে একটা করে আর্টিকেল বেরোত। যেমন লক্ষ্মণ পাই, এস এম সুজা, আকবর পদমসী, রাম কুমার, পরিতোষ সেন, রাজা। রাজা তো প্যারিসে থাকে। প্যারিস প্রত্যাগত ভারতীয় শিল্পী না। তো, আমি পরিতোষ সেনের কাজ দেখে অনুপ্রাণিত হলাম। আমি কলকাতায় ১৯৫৪ সালে পড়তে যাই। ১৯৫৫ সালে আমি পরিতোষ সেনের সাথে দেখা করি। তখন কিন্তু আমি অলরেডি প্যালেট নাইফে কাজ করছি। এবং প্যালেট নাইফ দিয়ে কাজ করার সময় যে লাইন, এই যে লাইন দেয়, সেই লাইন আমি প্যালেট নাইফের আগা দিয়ে দেয়ার চেষ্টা করতাম। তারপরেও লাইনগুলো খুব শার্প হতো না। ভেঙে যেত। তো পরিতোষ সেন আমাকে দেখালেন, কী করে ওই প্যালেট নাইফের সাইড থেকে নিয়ে...এই জিনিসটা আমি কিবরিয়াকে দেখালাম। আমি যখন ইতালি থেকে ফিরে আসলাম। তখন করাচিতে আমার কাজ দেখল, আর্কিটেক্ট জালালুদ্দিন বলল, তুমি দেখি কিবরিয়ার মতো ট্রিটমেন্ট করো। আমি কিবরিয়ার মতো? কেন? বলল, এই যে লাইন? খুব দুঃখ পেলাম! আমি শিখালাম কিবরিয়ারে, আর এখন কিনা সে বলছে এটা কিবরিয়ার লাইন! আমি এই তখন থেকেই প্যালেট নাইফে কাজ বন্ধ করে দিলাম। ওই যে বন্ধ করলাম আর প্যালেট নাইফে গেলাম না।
মোস্তফা: ওই সময়ে কিন্তু সবার কাজই মোটামুটি এক ধরনের ছিল, এক ধরনের লাইন দিয়ে...
মুর্তজা: তখনকার সময়ে ওই লাইন আমি পরিতোষ সেন থেকে প্রথম ঢাকায় নিয়ে আসলাম। তখন আমার ‘ওয়েটিং ফর টুমোরো’, মানে আমি তো ১৯৫৬ সালে এই কাজগুলোর প্রদর্শনী করলাম। তখন তো লোকে সবাই দেখল যে এই লাইন দিয়ে কাজ আমিই প্রথম করে দেখাচ্ছি। তো, সেটার প্রভাব পড়ে কিবরিয়ায়, কিবরিয়া থেকে...শাহতাব, সুজা এদের মধ্যে এলো। তখন তো আমি অলরেডি ইতালিতে চইলা গেছি। তো, আমার কথাটা হলো, ইতালিতে তখন আমি সাধারণ মানুষ আঁকলাম। ইতালি থেকে ফিরে এলাম। করাচিতে আমি যে ছবিগুলো আঁকলাম, সেগুলো এই সাধারণ মানুষের, তাতে আবার অনুপ্রাণিত হলাম...বিদেশে ছিলাম দু’বছর, নস্টালজিয়া, এই বাংলার রমণীকে আমি আঁকা শুরু করলাম। তারপর লাহোরে যখন গেলাম, তখন কিন্তু আমার ট্রান্সপারেসিজম...ওই তখন আমার গ্রে হলো কালার। আগে কিন্তু আমার কাজগুলো খুব প্রি-প্লানড, একটা স্কেচ করতাম, ড্রয়িং করতাম এবং অনেক সময় আমি লিখতাম, বি অথবা ব্লু, রেড, মানে আর প্লাস বি। মানে নিচে রেড, উপরে ব্লু। এভাবে প্লান করা থাকত। তো, লাহোরে যে ছবিগুলো আঁকলাম, সেগুলো কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই। ক্যানভাসে আঁকতাম, ফ্লোরে। ইজেল ছিল না। আর লিকুইড কালার, এনামেল কিংবা লেকার। তারপর কিছু অয়েল। আমি হাত দিয়ে রং লাগাতাম। আঁচড় কাটতাম। কী করছি আমি নিজেও জানি না। করতে করতে তখন হ্যাভক একরকম সাদা হতো, কাপড় দিয়ে চাপলাম, একটা টেক্সচার এসে গেল। মিল দিয়ে আঁচড় কাটলাম। তখন আমি দেখলাম আশ্চর্যজনক কিছু ঘটেছে। তখন আমি ওই ধরনের ইমেজ ডেভেলপ করি।
মোস্তফা: সেটাই পরে মোটামুটি অ্যাবস্ট্রাকশনের দিকে মোড় নেয়...
মুর্তজা: কিছুটা ওই ধরনের কাজ হয়ে গেল তখন। তারপর আমি বিয়ে করলাম, ১৯৬২ সালে। আমার জীবনটা হচ্ছে...তো একটি সুন্দর সুশৃঙ্খল জীবন, এটাতে আমি তো অভ্যস্ত না। তখনই ওই জ্যামেতিক ফর্মে কাজ করলাম। আমার তখন মনে হলো সবকিছু পরস্পর সম্পর্কিত। এই গাছ, মুরগি, পশুপাখি, মানুষ—সব একই স্থাপত্য শৈলীতে আবদ্ধ। ওই তখন সবগুলো ইন্টার লিঙ্ক...
মোস্তফা: ওই যে মোটা মোটা লাইন ধরে কাজগুলো...
মুর্তজা: ওই গাছ আছে না, গাছ, মোরগ, বাড়ি, মুখ—সব একই কাঠামোয় গড়া। মানে স্থাপত্যকলার গড়নের মধ্যে কেউ কারও থেকে বিচ্ছিন্ন না। বাড়ি, মানুষ, মুরগি—সব একতাবদ্ধ। ষাটের দশকে আমার সমকালীন বন্ধু আমিনুল এবং কিবরিয়া, তারা তখন পুরো বিমূর্ত কাজ করছে। আমার নিজেকে তখন খুব খাপছাড়া মনে হচ্ছে। আমি যেন আধুনিক না। তখন...আধুনিক মানেই হলো বিমূর্ত আঁকা। এই ধারণাটা আমাদের এখানে এখনো দেখা যাচ্ছে। আধুনিক মানেই হলো বিমূর্ততা, ফিগারেটিভ হলেও সে ফিগারেটিভ, সেমিঅ্যাবস্ট্রাক্ট হলেও সে ফিগারেটিভ পেইন্টার।
...তো, এখন কথা হলো, যখন আমি ‘ওয়াল’ করলাম, তা বাস্তব থেকে নেওয়া...আমি যা দেখে করলাম, ‘ইরাপশন’ বলো, ‘রেডিয়ান্ট’ বলো, প্রত্যেকটা সিরিজ, এমনকি উয়িং-ও, আমার কাছে অ্যাবস্ট্রাক্ট রিয়েলিজম। এদের সোর্স আছে। উয়িংয়ে আমি হয়তো কিছু বর্জন করেছি। কিন্তু কিছু অ্যাড করিনি। হয়তো অনেকগুলো ডট আছে, কিছু ডট কমিয়ে দিয়েছি। ওইটা হলো আমার এস্থেটিকস।

@ Miraj Ul Islam ধন্যবাদ মন্তব্যের জন্য। উইকিপিডিয়ার তথ্যগত ভুলের কারণে এমনটা হয়েছে। সংশোধন করা হলো।
তর্ক বাংলা
আগস্ট ০১, ২০২১ ০৪:০৬

বেশিরভাগ সাক্ষাৎকারেই ব্যক্তি আমিটাকে বারবার পোট্রেট করা হয়, সাক্ষাৎকার দানকারীই করে। মুলকথা অন্ধবিন্দুটি থেকে যায়, সাক্ষাৎকারদাতার দিকেই কিন্তু শিল্পি মুর্তজা বশীরের সাক্ষাৎকার পড়ে আমার বিশেষভাবে লক্ষ্যণীয় লেগেছে, উনার তত্থ্য দেয়ার উদারতা, পরিমিতিবোধ আর অন্যের চিত্রকর্মের ঠিকঠাক মূল্যায়ন। তিনি এবস্ট্রাকট রিয়েলিজমের সূত্রপাত ঘটিয়েছেন, একইসাথে সেটা যেন জীবনঘনিষ্ঠ হয়, তার দিকেও দৃষ্টিপাত করেছেন। তিনি শিল্পি কিবরিয়ার জীবনে যে বিচ্ছিন্নতার স্বরুপ দেখেছেন, তাকে সততার জায়গায় আত্মিক মনে করেছেন, দেবদাস চক্রবর্তীর এংরি ম্যানারিজমের কথা বলেছেন, সেটাও বিচ্ছিন্নতা থেকেই কারন এরা ভারত থেকে এসে পরিবারবিচ্ছিন্ন এলিয়েনেয়েড ছিলেন। অন্যদিকে কামরুল হাসানের রমনী চিত্রকর্মের সম্পর্কে এমন ভাবনা, আমার ভাবনাতেও তোলপাড় করে দেয় কেননা রমনী কোমরের নন্দন আর প্রকৃতির বাইরে যে প্রকৃতপক্ষে মানুষের সংগ্রামের অনুলেল্লিখিত অধ্যায় রয়েছে, তা বলেছেন। আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জানলাম। তর্ক বাংলা ও মোস্তফা সাহেবকে আন্তরিক ভালোবাসা জানাই।
শাখাওয়াত বকুল
আগস্ট ০১, ২০২১ ০৮:০৮

শিল্পী মূর্তজা বশীরের সংগে শিল্পী মোস্তফা জামান মিঠুর বাক্যালাপে শিল্পের অতীত,আধুনিকতা, সমকাল ওঠে এসেছে। ধন্যবাদ প্রিয় মোস্তফা জামান।
জাহিদ মুস্তাফা
আগস্ট ০৩, ২০২১ ১৪:২৩
সুস্বাদু, মু্র্তজার একান্ত ভাবনাগুলো বারবার ভালো লাগে। তবে শুরুতে সম্পাদনায় শিল্পীকে ‘কার্টুনিস্ট’ বিশেষণে দ্বিমত আছে। শিল্পী মুর্তজা বশীর সে ঘরানার নন। Cartoonists draw political, advertising, comic, and sports cartoons. Some cartoonists work with others who create the idea or story and write captions. Some create plots and write captions themselves. Most cartoonists have comic, critical, or dramatic talents, in addition to drawing skills. বরং শিল্পী রফিকুন্নবী সেই ঘরানার একজন পরিচিত শিল্পী। এটা আমার অভিমত, মুর্তজা ৫২ ভাষা আন্দোলনে লিনোকাটে কাজ করেছেন, অসংখ্য প্রতিকৃতি এঁকেছেন যা কোনভাবে তাঁকে কার্টুনিস্টের ‘মর্যাদা’ দেবে না। তিনি বিমূর্ত এবং abstract realism ধারার একজন পথিকৃৎ, সেটাই তাঁর বড় শিল্প পরিচয়। ধন্যবাদ।
মিরাজুল ইসলাম
আগস্ট ০১, ২০২১ ০৩:১৫