ক্ষয়শীল ধারাপাত
অঝোরে বৃষ্টি ঝরছে। হঠাৎ গ্রীষ্মের দাবদাহের উষ্মা ঠেলে এমন বৃষ্টিধারা মনকে উদাস করার কথা। অথচ পড়ে গেছি অস্বস্তিতে। কাউকে কথা দিয়ে কথা রাখাটা আমার মজ্জাগত। তাই অস্বস্তি ভাবটা আরও বেড়ে যাচ্ছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখি। ঘন মেঘে আকাশটা ছেয়ে আছে। চারদিকে আলোছায়ার অন্ধকার। ধরাতল ভিজে গেছে কখনো ঝিরিঝিরি, কখনো বড় বড় ফোঁটার বৃষ্টিতে। কিন্তু বের হওয়ার কথা মাথায় ঘুরপাক খেয়ে যাচ্ছে। মিরপুর থেকে উত্তরায় যাবো। কথা যখন দিয়েছি তখন আমাকে যেতেই হবে। প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য রুমে ফিরে এলাম। বৃষ্টির ছাঁট কিছুটা কমছে দেখে স্বস্তি পেলাম। এদিকে আবার ঢাকার জ্যামের কথাও ভাবতে হচ্ছে। পৌঁছানোর সময়ের দুই ঘণ্টা আগে বের হওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিছুই করার নেই ভেবে জরিনা আপাকে এসএমএস পাঠিয়ে আমার দেরি হওয়ার কথা জানিয়ে দিলাম।
জ্যামে আটকা পড়ে আছি। কালশীতে এসে সিএনজিচালিত অটোরিকশাটা জ্যামে আটকে গেল। ঢাকার এটি নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। আশপাশে, সামনে-পেছনে যত দূর চোখ যায় শুধু গাড়ি আর গাড়ি। যেন গাড়ির সমুদ্র। এ ভয়ে আজকাল বাসা থেকে বের হই না। মিরপুর থেকে উত্তরায় যেতে বড়জোর সময় লাগে আধঘণ্টা। অথচ পথে আজকাল জ্যামের এই মরণ কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। জরিনা আপাকে কথা দিয়েছি। আজ তার সঙ্গে দেখা করতেই হবে। অনেক দিন ধরে বলছেন তার বাসায় যেতে। দুপুরে লাঞ্চের নিমন্ত্রণ। টালবাহানা করে না-যাওয়ার অজুহাত দেখিয়ে অনেকবার তার অনুরোধ ফিরিয়ে দিয়েছি। নিমন্ত্রণ রক্ষা করার জন্য কারও বাসায় যাওয়াটা আমার কাছে খুবই অস্বস্তিকর মনে হয়। কেন এমন হয়, নিজেও জানি না। তার চেয়ে বরং কোনো কফিশপে, লাইব্রেরি চত্বরে কিংবা কোনো খোলা জায়গায় দেখা হওয়াটা আমার জন্য খুবই স্বস্তিদায়ক। মাঝেমাঝে অনুরোধের ঢেঁকি যে গিলতে হয়। তাই অগত্যা যেতে হচ্ছে।
জ্যামে আটকা পড়ে মাথাটা ভনভন করছে। কপালের দুপাশে রগগুলো লাফাচ্ছে। অস্বস্তি লাগছে ঠিকই। কিন্তু পরমুহূর্তে অটোরিকশাচালকের দিকে চোখ পড়তেই মনটা বিমর্ষ হয়ে গেল। প্রতিদিনের উপার্জিত আয় থেকে তার নিশ্চয়ই সংসার চলে, আর অটোরিকশার মালিক যদি থাকে, তাহলে তাকে দিনের শেষে মজুরি বুঝিয়ে দিতে হয়! কীভাবে যে কী করে বেঁচে আছে এই মানুষগুলো, ঠিক বুঝে উঠতে পারি না। এভাবে যদি ঘণ্টার পর ঘণ্টা পথের জ্যামে পড়ে থাকে, তাহলে কেমন করে তারা চলে! এসব নিয়ে ভাবতে ভাবতে দেখি চালকের চেহারাটা কাঠফাটা রোদের মতো চৌচির হয়ে আছে। তার ভেতরে যে আগুনের লেলিহান জ্বলছে, তা চোখ ঠিকরে বের হচ্ছে। কিছুক্ষণ পর পর দীর্ঘনিশ্বাস নিচ্ছে। এই মানুষগুলো যে কী অসহায়!
বৃষ্টি আর ঝরছে না। তবে বৃষ্টির পানি পথে জমে আছে। তার জন্য জ্যামটা এত দীর্ঘ হয়েছে। কেমন একটা ভ্যাপসা গরম। স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ভাবলাম কথা বলি। কথা বললে হয়তো এই মুহূর্তে মাথার যন্ত্রণাটা ভুলে থাকা যাবে। চালকও কিছুটা স্বাভাবিকতায় ফিরে আসবে। সরাসরি তাকে কোনো কথা না বলে দৃষ্টিটা বাইরে রেখে বললাম, দেশটা কীভাবে অচল হয়ে আসছে! ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়ে থাকলে মানুষের জীবন চলে কেমন করে?
চালক ভাই গোস্যা কণ্ঠে বললেন, আমরা মানুষ নাকি! কোনোরকমে বেঁচে আছি। এর চেয়ে মরণ আরও ভালো।
শুদ্ধ বাংলায় কথা বলছেন শুনে জিজ্ঞেস করলাম, সিএনজি না চালিয়ে অন্য কিছু কি করা সম্ভব ছিল না!
রেগে আরও উত্তপ্ত হয়ে চালক ভাইটি বললেন, আমাদের চাচা মামার জোর নেই যে চাকরি পাব। আর পুঁজিও নাই যে কিছু করে খাব। তাই এভাবে মরার মতো বাঁচি।
আমি ভাবলাম, আর কথা না-বলাই ভালো। কারণ, এর কোনো জবাব আমার কাছে নেই। সক্ষমতাও নেই যে এদের জন্য কিছু করতে পারি। বিষয়টার জন্য তো দেশের রাজনৈতিক সমাধান দরকার, সেখানে আমার মতো চুনোপুঁটির কী করার আছে! এভাবেই অনেক কিছুতে আজকাল চুপচাপ থাকি। নীরবে কষ্টগুলো বুকে চেপে রাখি।
আমাদের অটোরিকশার পাশেই ছিল একটা প্রাইভেট কার। ছোট্ট একটা বাচ্চা মায়ের কোলে বসে জানলার কাচে কচি হাত দুটো দিয়ে ঘষছে। আমার চোখে চোখ পড়তেই ফিক করে হেসে দিল। আমিও স্মিতহাস্যে হাত তুলে সাড়া দিলাম। বাচ্চাটা খুশিতে দ্রুত হাত নাড়তে শুরু করল। ভুলে গেলাম সকল যন্ত্রণা। পৃথিবীটা এখনো সুন্দর হয় ছোট ছোট শিশুর হাসি-কলরবে। পর মুহূর্তেই ভাবি, এই পৃথিবী কি তাদের জন্য আমরা বাসযোগ্য করে রেখে যেতে পারছি! যাহোক, ঘণ্টা তিনেক পর পৌঁছালাম উত্তরায়।
এক তুখোড় নারীবাদীর সঙ্গে আমার হৃদ্যতা গড়ে ওঠে। তার সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়, দেখা হয়। বেশির ভাগ সময় আমরা কফিশপে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করি। নারীবাদ নিয়ে তার জ্ঞানের ভাণ্ডার অগাধ। কথা শুরু হলে বিভিন্ন আঙ্গিকে যুক্তিতর্ক দিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করেন, তুলে ধরেন বাস্তবতার বিভিন্ন করাল দিক। আমিও খুব মন দিয়ে শুনি। আবার কখনো কখনো তার যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করি। নারীবাদ নিয়ে তার পাণ্ডিত্য শুধু কথার ফুলঝুরিতেই নয়, এই বিষয়ে লেখালেখিতেও সিদ্ধহস্ত। মূলত এই লেখার মধ্য দিয়েই তার সঙ্গে আমার পরিচয়। ভদ্র, মার্জিত, শালীন এই কেতাদুরস্ত নারীর চলনে-বলনে এবং পোশাকে নান্দনিকতার ছাপ প্রশংসনীয়। তা ছাড়া নিজেকে সে নারীবাদী পরিচয় দিতেও বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
এই নারী বিভিন্ন সভা সমিতি সেমিনার নিয়ে খুব ব্যস্ত থাকেন। নারীবাদ নিয়ে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দেন। একে-ওকে ফুটফরমাশ দেন এটা করো ওটা করো বলে। নারীবাদ বিষয় নিয়ে বিভিন্ন দেশের কনফারেন্সেও যান। আপাতদৃষ্টে তার সমস্ত গতিবিধি লক্ষ করলে বোঝা যায় উনি দেশ, সমাজ এবং মানুষের জন্য অনেক কিছু করে যাচ্ছেন। বিশেষ করে নারীদের ব্যাপারে কথায় কথায় তার সচেতনতার ছাপ বেশ লক্ষ করা যায়। এমনকি তার সামগ্রিকতা নিয়ে ভাবলে একধরনের ভক্তি শ্রদ্ধা এসেও ভর করে।
এই নারীবাদী একজন বয়োজ্যেষ্ঠ নারী। যার নাম জরিনা আহমেদ। তার প্রতি আমার সম্মান প্রদর্শনটাও ছিল খুব স্বাভাবিক। আজ তার বাসায় বিশেষভাবে নিমন্ত্রিত অতিথি আমি। খুব আয়োজন করে হাতে ফুলের তোড়া নিয়ে মধ্যদুপুরে উত্তরায় তার বাসার দিকে হাঁটতে থাকি। বাসা থেকে একটু দূরে অটোরিকশা থেকে নেমে যাই। বৃষ্টি আর ঝরছে না। সূর্যটা একটু একটু উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে। চারদিকে ভেজা-ভেজা পরিবেশ। এরই মাঝে ধীর পায়ে হেঁটে যাচ্ছি। বিলাসবহুল এলাকায় বাসা। গেটে দারোয়ানের কাছে পরিচয় দিয়ে উঠে যাই দোতলায়। কলবেল টিপতেই স্বয়ং জরিনা আপা এসে দরজা খুলে দাঁড়ান। ইতস্তত পায়ে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করি। আপা উচ্ছ্বসিত হয়ে আমার হাত ধরে নিয়ে সোফাতে বসালেন। নিজেও পাশে বসলেন। বললেন, আমি কিন্তু সচরাচর কাউকে নিমন্ত্রণ করি না। কিন্তু তুমি আমার কাছে স্পেশাল একজন। এটা বুঝো তো!
মনে মনে ভিরমি খাই। কেউ আমাকে স্পেশাল বললে অস্বস্তিতে ভুগি। কারণ, আমি খুবই সাধারণ একজন। কথাবার্তা চলাফেরাও করি সাধারণের সঙ্গে। তবে জ্ঞানী মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে। অনেক কিছু জানার মধ্য দিয়ে নিজেকে ঝালিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করি। এই যা!
এরই মধ্যে ঘরের কাজে সাহায্যকারী নারী দুই গ্লাস ফলের জুস নিয়ে এলো। গ্লাসটা হাতে নিয়ে ঘরের চারদিকে চোখ বোলাই। ভেতরে ভেতরে বেশ শিহরিত হলাম। হলাম চমকিত। আমি কি বাংলাদেশে নাকি সুইজারল্যান্ডের কোনো বাড়িতে বসে আছি! চোখধাঁধানো ইন্টেরিয়র ডেকোরেশন। শিল্পিত ছোঁয়ার চমকপ্রদ আবেশ। মিষ্টি শীতল পরিবেশ। আমি মনে মনে প্রমাদ গুনি।
হাতের গ্লাসটা পাশের টেবিলে রেখে বলি, খুব সুন্দর করে সাজিয়েছেন। মনে হচ্ছে স্বপ্নের মধ্যে বসে আছি।
কথাটা শুনে আপা বেশ বিগলিত হলেন। বললেন, এ আর এমন কি!
আমিও মনে মনে শ্লেষের ঢেউ তুলে বলি, সত্যি, এ আর এমন কি! তারপরেই নড়েচড়ে একটু সিরিয়াস মুডে জিজ্ঞেস করি, আপা, নারীবাদ নিয়ে আপনার যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, কর্মকাণ্ড এবং লেখালেখি—এসবের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে কি কিছু করছেন?
আপা বেশ রিলাক্স মুডে বললেন, আরে না! ওসব আমার কাজ না। আমার কাজ হচ্ছে লেখালেখি করে যাওয়া। আর কোথাও ডাকলে, গিয়ে দুটো কথা বলি, এই যা।
আমি দ্বিগুণ আগ্রহ নিয়ে বলি, কিন্তু সাধারণ নারীদের পাশে আপনার মতো এমন কারিশমাটিক লেখক এবং বলিয়ে খুব দরকার, যদি সত্যি সমাজে পরিবর্তন আনতে চান। আপনার ভেতর সেই সম্মোহন শক্তিটা প্রবল। বাংলাদেশের নারীদের যে অবস্থা! আপনাদের মতো নারীরা যদি সাধারণ নারীদের পাশে না আসেন, তাহলে পরিবর্তন তো সেভাবে আসবে না!
কণ্ঠে অবহেলার সুর নিয়ে বললেন, ওসব আমার কাজ না। আর তুমি আমাকে নিয়ে খুব পজিটিভলি ভাবো। এটা আমার কাজের একটা বড় শক্তি। তবে বাস্তবতাটা ভিন্ন। যাহোক, এসব বাদ দাও। চলো, তোমাকে আমার বাড়িটা ঘুরে দেখাই।
আমি আপার পিছু নিলাম। এঘর-ওঘর ঘুরে ঘুরে দেখছি। চমৎকার চমৎকার পেইন্টিংয়ে সাজানো প্রায় প্রতিটি দেয়াল। বলতে গেলে সবই তেলচিত্র। দেখতে দেখতে দৃষ্টি যেন আটকে থাকে সেখানে। বিমূর্ত রহস্যের এক অচেনা আলো-আঁধারীর ছায়া পুরো বাড়িটায়। চোখ ঝলসানো দামি দামি শোপিসে ভরে আছে বাড়িময়। এসব কোন কোন দেশ থেকে সংগ্রহ করেছেন, তার বিস্তারিত কথা আপা বলে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা ফোন আসাতে উনি ভেতরের রুমে চলে গেলেন।
আমি হাঁটতে হাঁটতে চলে আসি বাড়ির এক পাশের ব্যালকনিতে। যেখানে ঝুলে আছে মাধবীলতার ঝালর। মন্ত্রমুগ্ধের মতো চেয়ে থাকতেই বাঁ পাশে চোখ পড়ল। সাথে সাথে কেঁপে উঠি। ব্যালকনি ঘেঁষে কোনায় একটা ঘর, সেই ঘরে এক বয়স্ক মহিলা জবুথবু বসে আছেন। আটপৌরে শাড়ি পরা। কৌতূহলবশত সেই ঘরের দিকে পা বাড়াতেই সাহায্যকারী নারীটি দৌড়ে এসে আমাকে হাত ইশারায় ওখান থেকে চলে যেতে বলল। আমি হকচকিয়ে গেলাম। সাহায্যকারী নারীটির দিকে থমকানো দৃষ্টিতে তাকিয়ে ওর পিছু পিছু ব্যালকনি থেকে বের হয়ে এলাম। কিন্তু মনটা উসখুস করছে। কে এই বয়স্ক নারী? কেন এভাবে অথর্ব হয়ে পড়ে আছেন!
একটু কাছে গিয়ে সাহায্যকারী নারীটিকে জিজ্ঞেস করি, কে উনি?
—আপার শাশুড়ি।
আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, উনার কাছে আমাকে যেতে না করলে কেন?
—আপা জানলে ক্ষেইপা যাইবো।
—অহ!
—গ্রামের মানুষ তো জানে না শহরে কীভাবে থাকতে হয়। এইটা-সেইটা ধইরা নষ্ট করে, তাই আপায় হেরে ওই ঘরে পইড়া থাকতে কইছে।
মাথাটা চক্কর দিল। চোখের দৃষ্টিতে চারপাশে সবকিছু ঘোলাটে হয়ে আসছে। কেমন একটা অস্বস্তিবোধ জেঁকে বসল। ভালো লাগছে না কোনো কিছু। এখান থেকে পালাতে হবে। এক পা, দু পা করে বের হওয়ার দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছি। ডাইনিং টেবিলে দুপুরে খাবারের রাজকীয় আয়োজন। সবকিছু মাথার ওপর চক্রাকারে ঘুরছে। শ্বাসরুদ্ধকর এক পরিবেশ। নীরবে দরজা খুলে বের হয়ে আসি।
রাস্তায় পা রেখেই বুকভরে নিশ্বাস নিলাম। কিন্তু সাদা শাড়ি পরা জবুথবু বসে থাকা নারীটির চোখের করুণ চাহনি আমাকে বারবার চাবুকের আঘাত করে যাচ্ছে। আমি ক্ষতবিক্ষত হচ্ছি, মুষড়ে পড়ছি। আহা, নারীবাদী...!
লক্ষ করলাম, আমি অঝোরে ঘামছি। এলোমেলো পায়ে হাঁটছি। সময়ের কী নিদারুণ পরিণতি! পাশ দিয়ে একটি কুকুর করুণ সুর তুলে হেঁটে গেল।
খুব সুন্দর,চমৎকা,অনবদ্য লিখেছেন । ধন্যবাদ।
বাবুল সিদ্দিক
জুন ০২, ২০২২ ০৫:২১