ঝিলের পাড়ে পলিটিক্যাল নাইট

 

রাত সাড়ে ১২ টায় সোনারগাঁও হোটেলের পেছনের হাতিরঝিলের পাড় ধরে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। ঝিলপাড় নির্জন, শুধু দুইটা কুকুর পাশাপাশি বিপরীত দিক থেকে হেঁটে আসছিল। একটার গলায় ঝুলছিল গিটার; আমি তাকে চিনতে পারলাম। বছর পাঁচেক আগে আমি যখন যেভাবে নাই হয়ে গেলাম নামে একটা উপন্যাস লিখছিলাম, তখন এক বিকেলে এই ঝিলের পাড়েই তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। সে একটা নারকেল গাছের গোড়ায় বসে ঝিলের দিকে চেয়ে গিটার বাজিয়ে গান গাইছিল: আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।

আমি তাকে বলেছিলাম, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আপনার জন্য এই গান গাওয়া বিপজ্জনক। ওরা ভাবতে পারে, আপনি জাতীয় সংগীত নিয়ে মশকরা করছেন। ওরা কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসের অবমাননাকারীদের শাস্তি দেওয়ার জন্য আইনের খসড়া তৈরি করে ফেলেছে।

কুকুরটা সঙ্গে সঙ্গে সেই গান থামিয়ে শুরু করেছিল বিএনপির দলীয় সংগীত গাওয়া: প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ...

আজ সেই কুকুরটাই আমাকে থামিয়ে বলল, জামিল সাহেব না? জীবিত আছেন?

আমি বললাম, মারা গেলে খুশি হতেন?

কুকুরটা বলল, ডাজ্নট ম্যাটার, কত বড় বড় মানুষ মরে সাফ হয়ে যাইতেছে...!

আমি বললাম, তা অবশ্য ঠিক। তা আপনাদের কি করোনা হয় না?

আপাতত না। সে তার পাশের কুকুরটাকে দেখিয়ে আমাকে বলল, আমার বন্ধু, সাবাচকিন। রাশিয়ান।

আমি বললাম, নাম শুনেই বুঝতে পেরেছি। তারপর সেই কুকুরটার মুখের দিকে চেয়ে বললাম, গসপাদিন সাবাচকিন, বাংলাদেশে কবে এলেন?

সাবাচকিন বলল, অপ্রয়োজনীয় প্রশ্ন। আমরা আলাপ করছিলাম সিরিয়াস পলিতিকাল ইস্যু নিয়ে।

আমি বললাম, কী রকম?

সাবাচকিন বলল, যেমন ধরেন, জীবনের মানে কী, বেঁচে থাকার সার্থকতা কিসে।

আমি বললাম, ক্লিশে। আপনাদের কি খেয়েদেয়ে কাজ নাই?

আমি আপনার ইন্তেলেকতুয়াল শালোনেস দেখে বিস্মিত না হয়ে পারছি না, সাবাচিকন বলল।

আমি হকচকিয়ে গেলাম। কখনও ভাবতেও পারিনি কেউ কাউকে মুখের উপর এমন অপমানজনক কথা বলতে পারে।

একটা দমকা বাতাস এসে ঝিলপাড়ের গাছগুলোর শাখাপ্রশাখা আন্দোলিত করে চলে গেল।

আমি বললাম, জীবনের মানে খোঁজা কীভাবে পলিটিক্যাল ইস্যু হতে পারে?

এভরিথিং ইজ পলিতিকাল, সবজান্তার ঢঙে বলল সাবাচকিন, পলিতিকস ছাড়া গাছের পাতাও নড়ে না।

আমার হাসি পেল। বললাম, এক্ষুনি যে বাতাসটা গাছপালায় ঝাপটা দিয়ে চলে গেল, আপনি সেটা থেকে কী পলিটিক্যাল বার্তা পেলেন?

আমার প্রশ্নটার উত্তর এড়িয়ে গিয়ে সাবাচিকন বলল, প্রাণিজগৎ পলিতিকাল। এতা বোঝানোর জন্য যদি এখন আমাকে লেকচার শুরু করতে হয়, তাহলে সেতা হবে বড়ই পরিতাপের বিষয়।

আচ্ছা বুঝলাম প্রাণিজগৎ পলিটিক্যাল। সো হোয়াট? আমি বললাম।

সাবাচকিন বলল, আপনি একজন পলিতিকালি আনহাপি সিতিজেন। নাকি এতাও তের পান না?

টের পেয়ে লাভটা কী? আমি বললাম। হঠাৎ লক্ষ করলাম, সাবাচকিনের পাশের কুকুরটা নিঃশব্দে কিন্তু ভয়ানকভাবে হাসছে; তার দুই ছেদনদন্ত এমনভাবে বের হয়ে আছে, যেন এক্ষুনি কামড়ে দেবে।

কিন্তু ভেবে দেখলাম, আমার তরফ এখন পর্যন্ত এমন কিছু ঘটেনি যে কারণে আমাকে কামড়ে দেওয়া ওদের পক্ষে জায়েজ বলে গণ্য হতে পারে। সুতরাং আমার ভয় পাওয়ার কিছু নাই। আমি পরিবেশটার ভার হালকা করার উদ্দেশ্যে কুকুরটাকে তার নাম জিজ্ঞাসা করলাম। সে বলল তার নাম গফুর। আমি চমকে উঠলাম, কারণ আমার এক বাল্যবন্ধুর নাম আবদুল গফুর। গত রাতে আমি তাকে নিয়ে একটা গল্প লিখতে শুরু করেছি; গল্পের নাম আবদুল গফুরের বিস্ফোরক যৌবন; প্রায় ২০ বছর আগের প্রেক্ষাপটে তার প্রেমে পড়ার কাহিনি।

আপনার গফুর নামকরণের শানে নযুলটা কি জানতে পারি? আমি কুকুরটাকে বললাম।

কাকায়া রাজনিৎসা? চোস্ত রুশ ভাষায় বলে উঠল সে, কী এসে যায় তাতে?

আপনিও রাশিয়ান নাকি? আমি বললাম।

সে পাল্টা প্রশ্ন করল, গফুর কি রাশিয়ান নাম হতে পারে?

মাঝখান থেকে সাবাচকিন বলে উঠল, গাফুরোভ বিলক্ষণ রুশ নাম। ককেশাসে গেলে অনেক গাফুরোভের সাক্ষাৎ পাবেন। তারা আপনাকে রেদ ওয়াইন খেতে দেবে, ভেড়ার মাংস খেতে দেবে। তারা ভীষণ অতিথিপরায়ণ, যারপরনাই বন্ধুবৎসল; কোনো গাফুরোভ যদি আপনাকে একবার বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করে, তাহলে সে আপনার জন্য জীবন দিতেও কসুর করবে না। কিন্তু আপনি যদি একবার উলতাপালতা কিছু করেন, যেমন গাফুরোভের তরুণী ভগ্নির দিকে এমনভাবে তাকান যা গাফুরোভের ভালো লাগবে না, তাহলে সে তরবারির এক কোপে আপনার মুন্দুতা ঘাড় থেকে নামিয়ে দেবে।

আমি মনে মনে বললাম, বেটা এসব কথা আমাকে শোনাচ্ছে কেন? মতলব কী?

পলিটিকস, এভরিথিং ইজ পলিটিক্যাল! গফুর নামের কুকুরটা বলল।

সাবচকিন বলল, বাংলাদেশে এখন সবচেয়ে বেশি পলিতিকালি কনশাস গ্রুপ হচ্ছে বুরোক্রাসি। শুধু কনশাস নয়, হাইপার-কনশাস। এই দেশের পলিতিকস এখন পলিতিশিয়ানদের নিয়ন্ত্রণে নেই; চলে গেছে আমলাদের কবজায়। প্রাইম মিনিস্তার্স অফিস ইজ বিয়িং কনত্রোল্দ বাই দা বুরোক্রাৎস। কারণ, আমলারাই পলিতিশিয়ানদের ক্ষমতায় থেকে যাওয়া নিশ্চিত করেছে, জনগণ নয়। জনগণের ভোতের কোনো প্রয়োজনই হয়নি। বুরোক্রাসিই দে ফাক্তো সরকার। অল পাওয়ার তু দা সেক্রেতারিয়েত। পাঁচজন সেক্রেতারি যদি একজোত হয়ে প্রাইম মিনিস্তারের সামনে গিয়ে বলে, হাতির ঝিলের পারে বসবাসকারী সাংবাদিক জামিল আহমেদকে আমরা রাষত্রের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছি; আজ আমরা তাকে পুলিশ রিমান্দে নিয়ে এক দজন সেদ্ধ দিম খাইয়ে প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ গান গাওয়াব, তাহলে প্রাইম মিনিস্তার বলবে আপনারা যা ভালো বোঝেন তাই করেন, আমি আপনাদের পাশে আছি।

আসলে কে কার পাশে আছে, তা কি আপনি জানেন, মিস্টার জামিল আহমেদ? বলল গফুর নামের কুকুরটা।

জানি না, আমি বললাম, জানার কোনো ইচ্ছাও নাই!

হাতিরঝিলের আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে হাসতে লাগল দুই কুকুর। অট্টহাসি থামলে গফুর গিটার বাজাতে শুরু করল। গিটারে সেই সুর:

প্রথম বাংলাদেশ আমার শেষ বাংলাদেশ, জীবন বাংলাদেশ আমার মরণ বাংলাদেশ।

বাংলাদেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ! প্রতিধ্বনি তুলে গেয়ে চলল হাতিরঝিলের বাতাস।

থামেন! আমি খুব জোরে চিৎকার দিয়ে উঠলাম, কী হচ্ছে এই সব?

গফুরের গিটার থেমে গেল। সাবাচকিন তার থ্রি-কোয়ার্টার প্যান্টের পকেট থেকে একটা চুরুট বের করে ধরাল। জ্বলন্ত দেশলাইয়ের কাঠির আলোয় আমি দেখতে পেলাম, তার মুখে সেই সবজান্তার হাসি।

ঠিক তখনই সামনের দিক থেকে এগিয়ে এল দুইটা দশাসই ইঁদুর; একেকটার উচ্চতা কমপক্ষে চার ফুট; উভয়ের মুখে শজারুর গায়ের কাঁটার মতো লম্বা গোঁফ, পরনে অজস্র পকেটওয়ালা কালো রঙের ভেস্ট; ভীষণ চড়া বেল্ট বাঁধা কোমরে পিস্তল, কাঁধে অটোমেটিক রাইফেল। মাথায় চে গুয়েভারার টুপি।

আমার চোখের পলক পড়তে না পড়তেই গায়েব হয়ে গেল গফুর ও সাবাচকিন। দুই ইঁদুর আমার সামনে এসে দাঁড়াল। একজন বলল, হেরা গেল কই?

আমি অবাক হওয়ার ভান করে বললাম, কারা?

রাষ্ট্রদ্রোহী দুই কুত্তার বাচ্চা, খানকির পোলারা গেল কই? ফোঁস ফোঁস করতে করতে বলল অন্য ইঁদুরটা।

আমি বললাম, সে রকম কাউকে দেখি নাই।

ওই মিয়া, মিছা কথা কন ক্যা? ধমক দিয়ে বলল প্রথম ইঁদুরটা।

আমি একটু রেগে ওঠার ভঙ্গি করে বললাম, যাকেতাকে ধমকাবেন না! যেখানেসেখানে আপনাদের দেশদ্রোহীরাষ্ট্রদ্রোহী খোঁজার দরকার হলে আপনারা নিজেরাই খুঁজে...।

আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই দুই ইঁদুর নিজ নিজ কোমর থেকে পিস্তল বের করে আনল। একজন দাঁত কিটমিট করে বলল, যাকেতাকে মানে? অন্যজন বলল, লকডাউনের মধ্যে এত রাত্রে ঘুইরা বেড়াইতেছেন কিসের জন্য?

ঘুরে বেড়াইতেছি না, অফিস শেষ করে বাসায় যাচ্ছি।

এত রাত্রে কিসের অফিস?

মিডিয়া।

মিডিয়া? কোন মিডিয়া? একসঙ্গে বলে উঠল দুই ইঁদুর।

প্রথম আলো।

কার্ড কই?

আমি পকেট থেকে আমার আইডি কার্ড বের করলাম। এক ইঁদুর সেটা হাতে নিয়ে স্ট্রিটল্যাম্পের আলোয় মেলে ধরল। অন্য ইঁদুরটাও সেটার দিকে ঝুঁকে দেখতে লাগল। মুহূর্তের মধ্যে দুজনেরই অগ্নিমূর্তি: ওই মিয়া, ফাইজলামি করার জাগা পাও নাই?

মানে? কিসের ফাজলামি?

হালার পুত, এইখানে প্রথম আলো কই?

আমার আইডি কার্ডের মাঝখানে আমার ছবি, ছবির মাথার উপরে মোটা ইংরেজি হরফে লেখা মিডিয়াস্টার লিমিটেড; নিচে ঠিকানা। কোথাও প্রথম আলো লেখা নাই।

মিয়া, ভোদাই পাইছ আমগো? কোথাকার কোন মিডিয়াস্টারের কার্ড লয়া ঘোরো, আর কও প্রথম আলো?

আমি জেদি সুরে বললাম, মিডিয়াস্টারই প্রথম আলো।

কেমনে? ওই বেডা, মিডিয়াস্টার কেমনে প্রথম আলো হয়?

এমনেই হয়! আমি গোঁয়ার্তুমি শুরু করলাম, মিডিয়াস্টার প্রথম আলোর মালিক প্রতিষ্ঠান, এইটা যদি আপনাদের জানা না থাকে তাহলে সেটা আপনাদের মূর্খতা...।

 কীইই? দাঁত কিড়মিড় করে উঠল এক ইঁদুরের; সে তার রাইফেলের বাঁট দিয়ে আমার ডান পায়ের হাঁটুতে প্রচণ্ড জোরে বাড়ি মেরে বলল: আমরা মূর্খ! সঙ্গে সঙ্গে অন্য ইঁদুরটা দেখাইতাছি তোরে মূর্খ কারে কয় বলতে বলতে তার রাইফেলের নল দিয়ে গুঁতো মারল আমার পেটে। তার পর দুইজনে মিলে শুরু করে দিল এলোপাথাড়ি পিটুনি আর অকথ্য গালাগাল। পিটুনির চোটে আমার মুখ থেকে মা-রে বাপ-রে আর্তচিৎকার বেরুতে শুরু করলে মধ্যরাতের নীরব নির্জন ঝিলপাড়ে করুণ প্রতিধ্বনি হতে লাগল। এবং একপর্যায়ে আমি ধরাশায়ী হয়ে দেখতে পেলাম ঝিলের পানির গভীর থেকে পাড়ের ঢাল বেয়ে উঠে আসছে ঝাঁকে ঝাঁকে ইঁদুর; ছোট ছোট, স্বাভাবিক আকৃতির ইঁদুর; আমাকে পেটাতে ব্যস্ত সশস্ত্র উর্দিধারী দুই ইঁদুরের মতো দশাসই আকার তাদের নয়; কিন্তু সবাই মিলে তারা এক বিশাল প্রাণিসমষ্টি; সবাই পেছনের দুই পায়ের উপর দাঁড়িয়ে উদগ্রীব-উৎকর্ণ হয়ে দেখছে আমাকে ও আমার দুই নিপীড়ক ইঁদুরকে।

এই সময় দেখা গেল নির্জন ফুটপাত ধরে বাংলামোটরের দিক থেকে দুই পায়ে হেঁটে আসছে একটা বানর। তার ডান হাতে একটা অ্যালুমিনিয়ামের চোঙা; চোঙায় মুখ লাগিয়ে প্রথমে একটা ফুঁ দিল সে। সেই শব্দে আমার প্রহারকারীদের হাতপা থেমে গেল।

তারপর হাতিরঝিলের বাতাসে চোঙানিঃসৃত বানরকণ্ঠ বেজে উঠল: ষড়যন্ত্রমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকার অভিযোগে হাতিরঝিল থানার পুলিশ দৈনিক প্রথম আলোর অনুসন্ধানী প্রতিবেদক জামিল আহমেদকে সহিসালামতে নিরাপত্তা হেফাজতে লইয়া যাইতেছে...