হাসপাতাল ও তুলনাত্মক মডার্ন আর্ট বিশ্লেষণ
তো এই হাসপাতালটা, যেটা একটা বড় লেকের পাশে। হাসপাতালটা দেয়াল তুলে এমনভাবে বানানো হয়েছে, ভিতরে ঢুকলে জগৎ থেকে আলাদা হয়ে যায় সবকিছু। এই হাসপাতালের একটা বিশেষত্ব আছে। এখানে সাধারণত মৃত্যুপথযাত্রী রোগীরাই আসে। তো দেখা যায় এরা এই মৃত্যুর সময়টায় আত্মীয়স্বজন আর অতীতের বিভিন্ন ঘটনা এমনকি বিভিন্ন স্বপ্ন যেগুলা তারা আর কখনো পূরণ করতে পারবে না—এই সব বিষয় নিয়ে ভাবতে থাকে, মৃত্যুযন্ত্রণার চাইতে যেন এগুলোই তাদের জন্য বেশি কষ্টকর হয়ে ওঠে। হাসপাতাল এক অদ্ভুত পদ্ধতির মাধ্যমে এদের স্মৃতি আলাদা করে ফেলে। ফলে তারা মৃত্যুর সময়ে এসব ভেবে কষ্ট পাওয়া থেকে বেঁচে যায়। এমনকি এ-ও শুনেছি, তারা যে মানুষ, এটাও অনেকে ভুলে যায়। তবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, এই পদ্ধতিটা নতুন হওয়ায় কিছু সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু এটা নিয়ে গবেষণা চলছে। শিগগির এটাকে স্ট্যাবিলাইজ করে ফেলা হবে। তখন বেশ কিছু স্মৃতি, যেমন আত্মপরিচয়—এগুলো আলাদা করা ছাড়াই স্মৃতি পৃথকীকরণ সম্ভব হবে।
আজকে রাতটা আমরা দুজন এ হাসপাতালে কাটাব। এখানে ওর মানে আমার বন্ধু আতিফের এক আত্মীয় ভর্তি হয়েছে। যদিও এখানে মৃত্যুপথযাত্রীরাই এসে থাকে। কিন্তু কিছু রোগী আছে, যারা মৃত্যুকে কিছুদিনের জন্য এড়িয়ে এ পৃথিবীর আলো-বাতাস ভোগ করার সৌভাগ্য অর্জন করে। আমরা যা বুঝতে পারছি ওর চাচাও এ যাত্রায় বেঁচে ফিরতে পারবে। স্মৃতি আলাদা করার বিষয়টা কিছুটা ভয়াবহ মনে হলেও এটা টেম্পরারি ব্যাপার। রোগী সুস্থ হলে একটা এলিভেটরের মধ্য দিয়ে তাকে যেতে হয় আর এভাবে পুরোনো সব স্মৃতি সে ফিরে পায়। শুনেছি মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো কিছু স্মৃতি হারিয়ে যায়। কিন্তু ব্যাপারটা খুব বড় কোনো ঝামেলা না।
তো আমরা যখন ঢুকি তখন বাজে আটটার মতো। আমাদেরকে থাকতে হবে পুরো একটা রাত। সময় কাটানোর মতোন তেমন কিছুই এখানে নাই। যেমন হুট করেই আমার মাথায় ব্যাপারটা এলো। একটা ছোট পাঠাগারের ব্যবস্থা এরা করতে পারত। এখানে বিশাল বিস্তৃত লাউঞ্জে বসে বসে হাতে একটা বই নিয়ে নাড়াচাড়া করতে পারাটা আসলেও বেশ আয়েশি ব্যাপার হতো বলে মনে হচ্ছে। এখন সময় কাটানোর একমাত্র মাধ্যম হাতের এই পুরোনো ফোনটা। এটার চার্জ আবার খুব দ্রুতই ফুরিয়ে যায় আর আমি যেহেতু চার্জার আনিনি, তাই চার্জ দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না।
কিছু বন্ধুবান্ধব আছে, যারা সারা দিন বিপ্লব বিপ্লব করে গলা ফাটিয়ে ফেলে আর দিবাস্বপ্নে বিভোর থাকে। আমিও একই কাতারের লোক। এই সময়টায় এদের কেউ থাকলে আমরা পরবর্তী বিপ্লবের সম্ভাব্য একটা রোডম্যাপ এঁকে ফেলতাম। এটা যদিও অর্থহীন ফালতু একটা আলোচনা ছাড়া কিছুই হতো না, যার শেষটায় কিছু দীর্ঘশ্বাস আর হতাশা ছাড়া আর কিছুই থাকে না। তারপরেও ব্যাপারটা হলো, আড্ডা জমে ওঠে আর কিছু সময়ের জন্য পারিপার্শ্বিকতা ভুলে গিয়ে স্বপ্ন বোনায় বিভোর হই আর সময়টাও খুব দ্রুতই কেটে যায়।
কিন্তু আমার মনে হয় না এখানে এলে আমরা এমন কোনো আড্ডা জমাতে পারতাম। এখানে সবকিছুই কেমন আলাদা হয়ে যায়। এমনকি ঘনিষ্ঠ বন্ধন বলে যে একটা ব্যাপার আছে, সেটাও কেমন আলগা হয়ে যায়। এই যে, ছোটকালের বন্ধু আতিফ যার আজকে জন্মদিন; সে ব্যস্ত আছে ভার্চুয়ালে, একেকজনের উইশের জবাব দিতে সে ভীষণ ব্যস্ত। একটা বিষয় খেয়াল করলাম, এই আতিফ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই দিনগুলোয়, যেটা কিনা আমি এত দিন বুঝতেই পারিনি। এমনকি মেক্সিকোর জুয়ারেযও তাকে স্প্যানিশে উইশ করেছে। যাহোক চুপচাপ বসে বসে আশপাশ দেখছি আমি।
প্রায় এক ঘন্টা পার হয়ে গেছে। আমরা উঠে হাসপাতালের বাইরে ক্যাফেটেরিয়ায় এলাম। এখানে প্রতিটা জিনিসের দাম দুই থেকে তিন গুণ করে। তারপরেও আতিফ দুটা চা নিল। আমরা ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায় এসে বসলাম। এখান থেকে লেকের পচা সবুজ পানি যেটা রাত হওয়ার ফলে বুঝতে না পারলেও পরদিন ভোরের আলোয় ঠিকই বুঝতে পারব—লেকের সেই পানি দেখা যাচ্ছে। বারান্দাটা মূলত ধূমপানের জায়গা বলতে পারেন। এখানটায় কোনাকাঞ্চিতে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সিগারেট-ফিল্টার পড়ে আছে। আমাদের উদ্দেশ্যও খানিকটা এমনই।
চা খেতে খেতে সিগারেট ধরানোর চেষ্টা করছি। কিন্তু কোনোভাবেই সম্ভব হলো না। ডাক্তার-নার্সের ভিড় ছাড়াও এক মুরব্বি বারান্দার এক কোণে বসে আছে। মুরব্বির সম্মানার্থেই আমরা আর সিগারেট জ্বালালাম না। চা-টা খেয়ে বাইরে এলাম। কার পার্কিংয়ের সামনে যে ছোট্ট বাগানটা আছে এখানটায় এসে বসলাম। এখানে সস্তা বিড়ির ঘ্রাণে বাতাস ভারী হয়ে আছে। এখানে মূলত গার্ড আর ড্রাইভাররা বিড়ি খায়। পরিবেশটা বেশ গরম, একদমই বাতাস নেই আর ভ্যাপসা গরমে ঘামে ভিজে যাচ্ছে শরীর। তাই আমরা আবারও হাসপাতালে সেন্ট্রাল এসির নিচে ফিরে এলাম।
এখানে যদিও রোগীর আত্মীয়স্বজন ভিড় করে না তেমন। আর বেশির ভাগই থাকে বয়স্ক আঙ্কেল আন্টি। কিন্তু এর মাঝেও কিছু তরুণীর দেখা পাওয়া যায়। হাসপাতাল খরচ অসম্ভব রকমের বেশি হওয়ায় এখানে বিত্তবানেরাই শুধু আসতে পারে। তাই এসব তরুণী যেমন অসম্ভব রকমের সুন্দরী, তেমনি পোশাক আশাকেও বেশ আকর্ষণীয় হয়ে থাকে। দুঃখ-কষ্ট আর দুশ্চিন্তার মাঝেও তাই মাঝে মাঝে হাসপাতালের লবিটা দর্শনযোগ্য হয়ে ওঠে এবং সবকিছু ফিকে করে দিয়ে সুখস্বপ্নের মতো বিলাসী কারবারযোগ্য হয়ে থাকে। এখন লবিতে বসে তেমনই একটা দর্শন দিচ্ছি।
সাম্প্রতিক সময়ে তাইকা ওয়াইতিতি একটা সিনেমা করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ওপর। এই সিনেমাটায় একটা মেয়ে অভিনয় করে। থমাসিন ম্যাকাঞ্জির সহজাত চাল-চলন আর মিষ্টি হাসি যে কারোই ভালো লাগার কথা। যারা এই সিনেমাটা দেখেছে, খুব সহজেই থমাসিনকে ভুলতে পারবে না। আমি লবিতে বসে মেয়েটাকে যখন প্রথম দেখলাম, মনে হলো, তোমাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি! মেয়েটা পাঠকাঠির মতোন সরু আর বেশ লম্বা। লম্বায় সে আমাকে ছাড়িয়ে যাবে এটা নিশ্চিত। আর কেমন রক্তশূন্য ফ্যাকাসে গাল তার। ফোনে অনবরত কথা বলে যাচ্ছে এবং কথার তালে তালে হাত নাড়ছে। ব্যাপারটা তাকে সব চোখের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করেছে, এটা খুব সহজেই বুঝতে পারছি। যদিও কোনো মেয়ের দিকে এভাবে তাকানোটা ঠিক না, আর এতে সে বিরক্তও হতে পারে। তারপরেও আমি তার থেকে দৃষ্টি ফেরাতে পারছি না।
আতিফও তাকে লক্ষ করেছে। আতিফকে বললাম, মেয়েটা দারুণ সুন্দরী। আতিফ বলল, আমি ওকে গতকালই দেখেছি। ওই যে বলেছিলাম বাইক এক্সিডেন্ট করেছে। বললাম, কোনটা, ওই দুই পাটির অনেকগুলা দাঁত ভেঙে গেছে যার এবং কাঁধের হাড় গুঁড়ো হয়ে গেছে, তার কথা বলছ? বলল, হ্যাঁ, ওই ছেলের বোন হবে মেয়েটা সম্ভবত। গতকাল যখন দেখলাম তখনই মনে হয়েছে, একে কোথাও দেখেছি। মনে হয় এলাকায় বা অন্য কোথাও। কিন্তু দেখেছি যে এটা শিউর। বললাম, তাহলে চলো কথা বলে দেখি।
আমরা তার সাথে কথা বলার জন্য দারুণ আগ্রহী হয়ে উঠেছি এবং মনে মনে সাহস সঞ্চার করছি এমন সময়ে কতগুলো বয়স্ক নারী—যাদের মধ্যে আমাদের থমাসিনের মা খালাসহ আরও অনেকেই থাকতে পারে, এসে তার চারপাশ ঘিরে ফেলল আর আমাদের আশার গুড়ে বালি ঢেলে দিল। এখন শুধু চেয়ে চেয়ে দেখা ছাড়া আর কিছু করার নেই।
আতিফের সাথে ঘুরে বেড়াচ্ছি এখন। ওর জন্মদিন আজ সেটা তো আগেই বলেছি। জন্মদিনে অসংখ্য মানুষ তাকে উইশ করেছে। সে সেই উইশগুলোর প্রতি-উত্তরে একটা ভিডিও বার্তা তৈরি করার স্পট খুঁজছিল। রাত দশটার বেশি বেজে গেছে। আমরা একটু বাইরে এলাম। বাগানের ভেতরে ছোট্ট একটা ছাউনিতে বসে রইলাম কিছুক্ষণ। দামি দামি গাড়ির আসা-যাওয়া দেখলাম। এখন বেশ বাতাস বইছে। গত কয়েক দিনের প্রচণ্ড গরমের পর বৃষ্টির আগাম বার্তা নিয়ে এসেছে এই বাতাস আর থেকে থেকে হওয়া বিদ্যুৎ চমকানি। আমরা প্রায় আধঘণ্টা ধরে বসে আছি। ইতিমধ্যে দুইটা সিগারেট পুড়িয়েছি। আতিফ বলল, চল হাসপাতালের বাইরে গলিটায় যাই।
আমরা গলিটা ধরে হাঁটলাম কিছুক্ষণ। হাসপাতালের প্রধান ফটকের পাশেই চা সিগারেট নিয়ে এক গাছের নিচে বসে ছোট এক ছেলে। মানুষের ভিড় সেখানে। আমরা আফসোস করছিলাম, ত্রিশ টাকা দিয়ে চা না খেয়ে এখানে এসে পাঁচ টাকা দিয়েই চা খাওয়া যেত। যাহোক, এখন চা খাওয়ার ইচ্ছা হলো না। তাই আবার ফিরে এলাম হাসপাতালে।
২
এবার এসে থমাসিনকে আর পেলাম না। সে নিশ্চয় চলে গিয়েছে এর মধ্যে। তার পরিবর্তে আরেক মেয়ের দেখা পেলাম। যে কিনা একটা ট্রাউজার আর টি-শার্ট পরে আছে। এটা নাইট ড্রেসও বলা যেতে পারে। যা বুঝলাম, মেয়েটা পোশাকের ব্যাপারে এতটা সচেতন নয়। চোখে একটা চশমা এবং মাস্কের আড়ালে তার চেহারা ঢাকা পড়েছে। তার শরীরের গঠনও খুবই সরল। আতিফের ভাষায় মেয়েটা তালপাতার মতোন ঠ্যানঠ্যানে। যাহোক সে তার বাবার সাথে বসে আছে লবিতে।
আমরা ভিডিও বার্তা বানানোর জন্য একটা ভালো স্পট নির্ধারণ করেছি। মাদার এন্ড চাইল্ড কেয়ার নামে যে বিভাগটা, সেটার সামনে দীর্ঘ করিডরটাই আপাতত আমাদের পছন্দ হয়েছে, যেটার দেয়ালজুড়ে রয়েছে অদ্ভুত সব দৃশ্য। তারপরেও আরও ভালো কোনো স্থান পাওয়া যায় কি না, সে জন্য আমরা পুরো হাসপাতাল ঘুরে দেখব এখন।
আমরা দ্বিতীয় তলায় গেলাম। এ তলাটা বেশ সুন্দর। তবে লোকজন বেশি আর গার্ড রয়েছে কয়েকজন। এখান থেকে নিচের লবিটা খুব সুন্দর দেখায়। একটা কথা বলা হয়নি, হাসপাতালে ছবি তোলা, ভিডিও করা সম্পূর্ণ নিষেধ। এর মধ্যেও আমাদেরকে ভিডিও করতে হবে, যেটা বেশ কঠিন একটা কাজ। এ জন্য আমাদেরকে বেশ সতর্কতার সাথে স্থান নির্বাচন করতে হবে। এরপর আমরা অন্যান্য তলা ঘুরে দেখলাম। এসব ফ্লোরে অবশ্য সুবিধাজনক স্থান পেলাম না। তাই আবারও নিচে নেমে এলাম।
দ্বিতীয় তলায় এসে লিফট ছেড়ে দিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামলাম। সিঁড়িতে একটা ছবি ঝুলছে। ছবিটায় ঠিক কী বোঝাতে চাইছে আর্টিস্ট, আমরা বুঝতে পারলাম না। ছবিটার ওপর যত্রতত্র আবার ছোট ছোট পাথর আটকে দেওয়া হয়েছে। এই পাথরগুলোই-বা কী অর্থ বহন করে! আতিফ কিছুক্ষণ নখ দিয়ে খোঁচালো পাথরগুলো ওঠানোর জন্য। তারপর দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে ও বলল, এইটা একটা দেয়াল, দেয়াল বেয়ে পানি পড়তেছে। আমি বললাম, তাইলে পাথর দেওয়ার মানে কী? ও বলল, আরে এইটা দেয়াল না এইটা আসলে ঝরনা হবে। পাহাড় বেয়ে পানি পড়তেছে তো তাই সেইটা বুঝাতে পাথরগুলা দিছে। যদিও ব্যাখ্যাগুলার সাথে ছবিটাকে ঠিক মিলাতে পারছিলাম না। একটা পর্যায়ে আমার মনে হতে লাগল, এটা নিশ্চয়ই একটা জলপ্রপাত। পরে বললাম, ধুর বালছাল কী আঁকে কিছুই ঠিক নাই।
এরপর আমরা নিচতলায় নেমে এলাম। বাবার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে তখন মেয়েটা। আমরা ইমার্জেন্সির সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। এখানে গার্ড আলাউদ্দিন ডিউটিতে আছে। বেশ আলাপি লোক বলে এর মধ্যেই কিছুটা খাতির হয়ে গেছে লোকটার সাথে। আলাউদ্দিন আমাদেরকে বলল, ইমার্জেন্সিতে আজ চাপ অনেক বেশি। আতিফ খুব আগ্রহের সাথে জানতে চাইল, কেউ মরছে না কি? বলল, না আজকে কেউ মরেনি এখনো। বেড একটাও খালি নাই বুঝলেন! এই আলাউদ্দিন যে কিনা রোগীর চেহারা দেখেই তার রোগ বলে দিতে পারে। আতিফের চাচা, যাকে প্রথমে অন্য এক হসপিটালে নেওয়া হলে ভুল ট্রিটমেন্ট করা হয়। পরে তাকে যখন এখানে নিয়ে আসা হয়। গেটে আলাউদ্দিন ডিউটিতে ছিল তখন, সে নাকি দেখেই বলে দিয়েছিল, আরে মিয়া উনি তো হার্ট অ্যাটাক করছে। আমি ঘটনাটা শোনার পর থেকেই আলাউদ্দিনকে আলাদা সম্মানের দৃষ্টিতে দেখে আসছি।
এতক্ষণে আমার ফোনের চার্জ একদমই শেষ হয়ে গেছে। এখন চুপচাপ বসে থাকা আর মানুষের কাজকর্ম দেখা ছাড়া কিছু করার নেই। আতিফ এর মধ্যেই একবার চেষ্টা করেছে ভিডিওটা বানাতে। কিন্তু এখনো হাসপাতালে বেশ লোক আর বাচ্চাদের চিল্লাচিল্লি, যার ফলে ভিডিওটা ভালো হচ্ছে না, বিশেষ করে ভয়েস ক্লিয়ার আসছে না। এ জন্য তাকে আরও অপেক্ষা করতে হবে। যখন একটা-দুইটা বাজবে, হাসপাতাল সম্পূর্ণ নীরব হয়ে যাবে তখনই কেবল একটা সুন্দর ভিডিও বার্তা বানানো সম্ভব।
এখন কিছু করার না থাকায় আমি আর আতিফ আইসিইউর সামনে এলাম। এখানে একদল নারী-পুরুষ ভিড় করেছে। যাদের মধ্যে কেউ কেউ কাঁদছে আর বয়স্কদের চেহারায় দারুণ দুশ্চিন্তার ছাপ। যদিও তরুণ কিছু ছেলেমেয়েকে দেখলাম যারা কিছুটা নিশ্চিন্ত এবং পরস্পরে গল্পগুজবে ব্যস্ত। একটু পর আইসিইউ থেকে এক মুরব্বি বেরিয়ে এলো কাঁদতে কাঁদতে। এসে মাথা নাড়তে লাগল, আর আশা নাই আর আশা নাই। তাকে জড়িয়ে ধরে কেউ কেউ সান্ত্বনা দিচ্ছে। আমরা অনুমান করলাম, রোগী আজ রাতের মধ্যেই মারা যাবে। যাহোক, আইসিইউর সামনে সব সময়ই এমন কিছু না কিছু দৃশ্য আপনার চোখে পড়বেই। পরিবেশটা বেশ ভারী হয়ে গেছে। আমরা তাই আবার নিচে নেমে এলাম।
নিচে নেমে আসতেই সেই হালকা-পাতলা মেয়েটাকে দেখতে পেলাম। ঘোরাঘুরি করছে এদিক-সেদিক আর সেই সাথে তার হাত আর কাঁধ দুলছে বেকায়দাভাবে। অদ্ভুত এক ব্যাপার। যা মনে হচ্ছে, এই মেয়ে কিছুটা উদাস প্রকৃতির।
আমরা টয়লেটে গেলাম। এই জায়গাটা এখনো ঘুরে দেখা বাকি রয়ে গেছে। যদিও চাইলেও আমরা ফিমেল টয়লেট পরিদর্শন করতে পারব না। তাই মেইল টয়লেটের কারুকার্য দেখেই ক্ষান্ত হতে হবে। এখানে তিনটা টয়লেট, ইউরিন প্যানসহ দুইটা বেসিন আছে, যেগুলার কল খুবই উন্নত। সুইস মেকানিজম কলগুলো একবার টিপলে একটু পানি পড়েই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। কবজিতে জোর কম হওয়ায় আমার বেশ শক্তি খরচ হচ্ছে। বিষয়টা তাই অনেকটা নলকূপের হাতল ধরে নিচের দিকে টেনে নামানোর মতোই কষ্টকর মনে হচ্ছে। যা বুঝলাম দামি জিনিস আর কম দামি জিনিসের ব্যবস্থাগত পার্থক্য খুব একটা বেশি না।
রাত এখন বারোটার কাছাকাছি। আমরা হাসপাতাল এরিয়া থেকে বের হয়ে এসেছি। গলির মাথায় ফুটপাতে বসে চা বিক্রি করছে এক পিচ্চি। পিচ্চি অত্যন্ত ব্যস্ত। এর মধ্যে এক টুকরো রুটি কীভাবে পাঁচ টাকা না হয়ে দশ টাকা হলো, এই ব্যাপারটা বুঝাতে হচ্ছে এক বয়স্ক লোককে। আর এরই ভিতরে আরেকজনকে দশটা বেনসন দিতে গিয়ে হলিউড দেওয়ায় বকা খেয়ে আমাদেরকে চায়ের দুটি কাপ এগিয়ে দিল। যদিও চায়ের দোকানিরা বেশ আলাপি হয়। কিন্তু এই পিচ্চি একদম ক্যাড়ম্যাড় করে সবার কথার জবাব দিচ্ছে। এটা অনেকে বেশ মজার সাথেই উপভোগ করছে। অল্প আগেই ঘন বর্ষায় রাস্তাঘাট ভিজে গেছে। এখনো পাতায় পাতায় জড়িয়ে আকাশ থেকে মৃদু বর্ষণ জারি আছে। চায়ের কাপেও দু-এক ফোঁটা পড়ছে। সিগারেটটা হাতের তালুর মাঝে খুবই কসরত করে ধরে রাখতে হচ্ছে। ভিজে গেলে স্বাদটাই নষ্ট হয়ে যাবে।
যাহোক আমরা আবারও ফিরে এসেছি হাসপাতালে। কিছুটা গুমোট পরিবেশের ফলে ঘেমে গেছি একেবারে। আর বর্ষার ফোঁটায় মাথা গেছে ভিজে। এসির নিচে এসে তাই কেমন ম্যাড়ম্যাড়ে লাগছিল নিজেরে। আমরা আবারও ফিরে এসেছি মাদার অ্যান্ড চাইল্ড কেয়ারের সামনের সেই করিডরটায়। গতবারের ভিডিও ধারণের সময় এক পিচ্চি চিল্লিয়ে ওঠে যা ভিডিওটাকে ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে ফেলে। আমরা বিভিন্নভাবে কিছু শট নিলাম। আতিফ বসে বসে সেগুলো এডিট করে তার বার্তা বানাচ্ছে।
আমরা বসে আছি লিফটের সামনে। লিফটের ভিতর প্রচণ্ড হুটোপুটি, মনে হচ্ছে, কেউ যেন কুস্তি লড়ছে। লিফট খোলার পর দেখলাম দুই আয়া হাসতে হাসতে বের হচ্ছে। তারা চলে যেতেই সেই অদ্ভুত সরু মেয়েটা এলো। সাথে তার বাবা এবং যদ্দুর মনে হচ্ছে মা এবং চাচা বা মামাও আছে। তারা ব্লাড ব্যাংকের আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে। বিষয়টা আমরা এখনো বুঝে উঠতে পারিনি। এই মেয়ে, তার হাসপাতালে আসার কী প্রয়োজন ছিল! যাহোক, সে এসেছে এবং আমরা তাকে দেখছি।
৩
আমরা এখন বসে আছি ক্যাফেটেরিয়ার বারান্দায়। চারটার মতো বেজে গেছে। এতক্ষণ বাগানের ভেতরে বসে বসে দুজনে একের পর এক সিগারেট টেনেছি। ঘুম আর রাতের ক্লান্তি দূর করতে আমাদেরকে এই সিগারেটগুলো ভালো সাহায্য করেছে। যদিও আতিফ ফোনের স্ক্রিনে চোখ সেটে দিয়ে সময় পার করে দিচ্ছিল। কিন্তু অন্যদিকে আমি, যার ফোন অনেক আগেই বন্ধ হয়ে গেছে চার্জ শেষ হয়ে, চুপচাপ সিগারেট টেনে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। তথাপিও এখানে যে বিড়ালটাকে আমরা দেখতে পাচ্ছি, সে বেশ অহংকারী এবং কারোর ডাকেই সে সাড়া দিতে চায় না।
আমরা এর মধ্যে আরেকবার ভিতরে যাই। লিফটে উঠে আইসিইউ থেকে নামার পথে একদল নারী-পুরুষকে কাঁদতে দেখলাম। তারা লাশটা নিয়ে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাচ্ছে, যেখানে লাশ ধোয়ার ব্যবস্থা রয়েছে। আমি আতিফ থেকে শুনেছি, এখানে লাশ ধোয়ার ব্যবস্থাটা অত্যন্ত নির্মম। দুটো লম্বা পাথরের পাটাতন। একটার ওপর লাশ রেখে অন্যটা দিয়ে এমন জোরে চাপ দেওয়া হয়, যে ভেতরের রক্ত-টক্ত যা আছে সব বের হয়ে যায়। এভাবে লাশ ধোয়ার কায়দাটা তারা কোত্থেকে আবিষ্কার করেছে, সেটা এক রহস্য আর কেনই-বা এভাবে লাশ ধুতে হবে, সেটাও রহস্য।
ব্যাপারটা মনে হচ্ছিল জাহান্নামের শাস্তির মতো। পাথরের চাপে লাশটা কেমন কিমার মতো হয়ে গেল এবং তারা অল্প পানি ছিটিয়ে সেটাকে প্যাকেট করে ফেলল। এই অসহ্য নিষ্ঠুরতা দেখে শিউরে উঠলাম। আতিফও দারুণ অস্বস্তি বোধ করতে লাগল। আমরা কোনোরকমে ফিরে এলাম সেখান থেকে। ব্যাপারটা আমাদের মন মানস আচ্ছন্ন করে রেখেছে। তাই ব্যস্ত হয়ে বাইরে এলাম এবং সিগারেট ধরিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করতে লাগলাম।
হাসপাতালে মৃত্যুহীন কোনো রাত বা দিন যেন যায়-ই না। আতিফ বলছিল আমাকে, আজরাইল আইসিইউতে কেমনে ছোটাছুটি করে! এই বেডে মরছে তো দুই মিনিট পরে পাশের বেডেরটাও মরে গেল। ভাই রে ভাই, আমি ভয়ে নিচে চলে আসছিলাম আর ওপরে যাইনি সারা রাত। বিষয়টা হলো ওর চাচা আইসিইউতে ভর্তি এখন পর্যন্ত। যদিও অবস্থার উন্নতি আশানুরূপ।
আমরা যখন সিগারেট খেয়ে ক্যাফেটেরিয়া যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করলাম, ঠিক তখনই কাচে মোড়ানো আইসিইউর ভেতরে নার্সদের ছোটাছুটি আর একটা বেডের পাশে অনবরত লাল আলো জ্বলতে নিভতে দেখলাম। আইসিইউতে কখন কী হয়ে যায় আগে থেকে কিছু বলা যায় না। আমরা প্রচণ্ড উদ্বেগসহ সিঁড়ি দিয়ে ছুটতে ছুটতেই তিনতলায় উঠলাম। যে গার্ড আইসিইউর সামনে বসে ছিল সে কোনোভাবেই কিছু বলতে চাইল না। অথচ নার্সদের ছোটাছুটি দেখে আমরা কিছু একটা যে ঘটেছে সেটা আঁচ করতে পারছিলাম। যদিও কেউ কিছু বলতে চাচ্ছে না। যাহোক, পরে আমরা জানতে পারি, এটা ঘটেছে অন্য এক বেডে।
আমরা এবার নেমে এসে এই ক্যাফেটেরিয়ায় ঢুকে বসে আছি। দুইটা স্যান্ডউইচ, দুই টুকরা পাতলা রুটির মাঝে হালকা মাংসের পুর যার দাম একশ দশ টাকা। খুবই কষ্টকর হতো যদি এটা আমার নিজের টাকায় খেতে হতো। কিন্তু আমার ভাগ্য আতিফ আমার বন্ধু সারা রাতের সমস্ত কিছুর খরচ বহন করছে। আমরা এই স্যান্ডউইচ খেয়ে দুইটা চা নিয়ে এসে বারান্দায় বসেছি। ফজরের আজানের আওয়াজ ভেসে আসছে দূর থেকে। একটা দুইটা পাখির আওয়াজসহ শহরের এই প্রাণকেন্দ্রে মোরগের ডাকও শুনতে পেলাম আমরা। ভোর হওয়ার যে বিশাল আর ধীর প্রক্রিয়া, সেটাই বসে বসে উপভোগ করছি।
আমি তিনটা চেয়ার এক করে শুয়ে পড়েছি। একটা ঘাসফড়িং টেবিলের ওপর লাফালাফি করছে আর আতিফ চায়ের কাপ দিয়ে সেটাকে আটকাতে চাইছে। শুয়ে লেকের পানি দেখছি। আবছায়ায় লেকের পানির সবুজ রং দেখতে পাচ্ছি। একটা নারীকণ্ঠ আমার বিশ্রামের এই আয়োজনে বিঘ্ন ঘটাল। তড়িঘড়ি উঠে বসলাম। দেখি সেই পলকা গড়ন মেয়েটা, যে কিনা এখন আতিফের পাশেই বসে আছে। চায়ে চুমুক দিচ্ছে সে অল্প অল্প করে, আর আমাদেরকে ব্যাখ্যা করছে কেন আরও তিনটি টেবিল থাকতে সে আমাদের সাথে এসে বসল।
কিছু মনে করবেন না। রাতটা অনেক স্ট্রেসের ভেতর দিয়ে গেছে। একটু কথা বলতে ইচ্ছে করছিল আসলে। বললাম, এটা খুবই ভালো একটা ব্যাপার, আমরাও আসলে কথা বলতে চাই। তবে যদি কিছু মনে না করেন, তাহলে একটা সিগারেট ধরাতে চাই। সে মাথা নেড়ে সায় দিলে আমি একটা সিগারেট ধরাই এবং তাকে দেয়ালে ঝুলতে থাকা আর্টগুলোর জটিলতা বোঝাতে চেষ্টা করি।
এই আর্ট যেটা কিছু রঙের সমন্বয়, কোনো অর্থ বহন করে না, আমি বললাম। সে প্রবল মাথা নেড়ে বলল, না এইটা হলো মডার্ন আর্ট, এগুলা বুঝতে হলে গুড স্টাডি দরকার। আমি বললাম, তো আপনি বুঝায়ে দেন জিনিসটা কী বোঝাচ্ছে। সে ব্যাখ্যা করতে লাগল, এটা একটা দরজার মতো। এখানে আর্টিস্ট বিভিন্ন কালার য়ুজ করেছে। এই কালারগুলার সবগুলাই দেখেন অনেক ডিপ। এইটা দিয়ে আসলে মনের কমপ্লেক্সিটি বোঝাচ্ছে। মূলত দরজাটা হলো মাইন্ড বুঝার একটা প্রাথমিক ধারণা।
আমি বিষয়গুলা মনোযোগ দিয়ে শুনছি এবং তার অঙ্গভঙ্গি দেখছি মুগ্ধ হয়ে। আতিফ অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ফোন টিপে যাচ্ছে আর সিগারেট ফুঁকছে। যদিও আমি মনোযোগ দিয়ে সব শুনছি। কিন্তু এসবই আজগুবি মনে হচ্ছে। তাই তার জ্ঞানের পরীক্ষা নেওয়ার জন্য বললাম, এটা না হয় বুঝলাম। কিন্তু সিঁড়িতে ঝোলানো ওই আর্টটা সম্পর্কে কী বলবেন? সে বলল, কোন আর্ট! চলেন দেখি গিয়ে। আতিফসহ আমরা ক্যাফেটেরিয়া ছেড়ে বের হলাম। আতিফ এসে লবিতে চেয়ারে বসে পড়ল। আমি আর সে গেলাম সিঁড়িতে সেই অদ্ভুত ছবিটা দেখতে। সে প্রথমবার দেখে বলল, এইটা একটা দেয়াল যেটা দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে। তারপর কিছুক্ষণ ঠোটে চিমটি কেটে ভ্রু কুচকে বলল, না এইটা আসলে ঝরনা হবে এবং এই পাথরগুলা পাহাড়ের মেটাফোর। আমি মৃদু হেসে বললাম, ব্যাখ্যাটা সেই। তারপর তার থেকে বিদায় নিয়ে চলে এলাম লবিতে। আতিফ তখন ইমার্জেন্সির সামনে ফোন চার্জে দিয়ে আলাউদ্দিনের সাথে গল্প করছে।
আমি বসে আছি আর আমার পেছনে একজন নাক ডাকছে আর নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। একজন নারী গার্ড কোত্থেকে এলো আর আমার দিকে তাকিয়ে একটু হাসল এবং বেশ উচ্চস্বরে আস্তাগফিরুল্লাহ পড়ল। তারপর বলল, এহ কেমনে ঘুমাইতেছে! আঙুল দিয়ে আমাকে ইশারায় বলল, ওরে একটা ঠুয়া দেন। আমি মৃদু হেসে শুধু মাথা দোলালাম। সে চলে গেল। আমি আবারও চুপচাপ বসে রইলাম।
আতিফ আর আমি এখন রিসেপশন কাউন্টারগুলোর আশপাশে ঘোরাঘুরি করছি। হাসপাতালে অত্যধিক খরচ আর ক্যাফেটেরিয়ায় খাবারের দাম বেশি হওয়ায় আমরা এর প্রতিবাদস্বরূপ কিছু জিনিস চুরি করার পরিকল্পনা হাতে নিয়েছি। গার্ড আর অন্য লোকেরাও এই সময়টায় ঝিমাচ্ছে। রিসেপশনে এক কোণে একজন বসে বসে ফোনে খেলা দেখছে। আমরা আশপাশের সিসি ক্যামেরাগুলোর দৃষ্টিশক্তি মেপে নিয়ে কিছু জিনিসকে টার্গেট করেছি। এর মধ্যে দুইটা পাঞ্চ মেশিন, একটা স্টেপলার, দুইটা ক্যালকুলেটর। আতিফ একটু বেশিই সতর্ক। এদিক সেদিক দেখলাম আমরা কয়েকবার ঘুরে টুরে। চট করে কাউন্টারের পিছনে গিয়ে জিনিসগুলো নিয়ে এলো আতিফ। এর মধ্যে আমি একটা সিল সরিয়ে ফেলেছি কাউন্টারের ওপর থেকে।
এরপর আমরা জিনিসগুলো ব্যাগে ভরে দ্রুত টয়লেটে চলে এলাম। এখানে এসে জিনিসগুলো ব্যাগে কাপড়ের আড়ালে লুকিয়ে ফেলল আতিফ আর আমি সিলটা দিয়ে হাসপাতালের দেয়ালে দেয়ালে আমাদের স্মৃতিচিহ্ন এঁকে গেলাম।
এরপর উত্তেজনা প্রশমিত হলে আমরা লবিতে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। এর মধ্যে গার্ডদের শিফট পরিবর্তন হলো। গার্ড আর ক্লান্ত নার্সরা চলে গেল আর নতুন গার্ড আর নার্সরা হাসপাতালে তাদের কাজ বুঝে নিল। তাদের চিল্লাচিল্লিতেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। দেখলাম দুই পুলিশকে এক বিশালদেহী ভদ্রলোক বলছে, আরে, যত খরচ লাগে, সব আমি দিমু ভাই। আরে দোষ তো আমার না। হেয় আসতেছিল আমিও যাইতেছিলাম। এখন যা হওয়ার তা তো হইয়া গেছে। পুলিশরা মাথা নাড়ছিল ঘন ঘন আর জি স্যার জি স্যার বলছিল। এদিকে আমাদেরও বের হওয়ার সময় হয়ে আসছে।
আতিফকে ডেকে ওঠালাম। ওর চাচি চলে এসেছে। দিনের বেলাটা তিনিই থাকবেন এখানে। আমরা এবার হাসপাতাল থেকে বেরোলাম। ইমার্জেন্সির সামনে দিয়ে ছোট্ট গেটটা পার হবো। দেখলাম পুলিশের ভ্যান দাঁড়িয়ে আছে, ভ্যানের পেছনে একটা ভাঙা হেলমেট আর অনেক রক্ত জমাট বেঁধে আছে আর তার ওপর মাছি ওড়াউড়ি করছে। যা বুঝলাম ভয়ানক অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে। আমরা বাইকচালকের বাঁচা-মরার সম্ভাবনা নিয়ে আলাপ করছি রিকশায় বসে নো স্মোকিং নোটিশ ঝোলানো অভিজাত এলাকা দিয়ে যেতে যেতে। আমরা একটা করে সিগারেট ধরালাম। মনে হচ্ছে একটা রাত ভিন্ন এক জগতে কাটিয়ে চিরচেনা শহরে ফিরে এসেছি। নির্ঘুম রাত কাটানোর ফলে শরীরজুড়ে ক্লান্তি আর চোখও বেশ জ্বলছে। রিকশা চলছে নো স্মোকিং এরিয়ায়।