ঝরনা আপা জাম্বুরাগাছ হওয়ার আগে

 

একদিন ঝরনা আপা কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কলেজে কোন পথে যায় রে?
সে হাসল। বলল, ব্রিজ পার হয়ে পাঁঠার পিঠে চড়ে চলে যাবি। পাঁঠা জানে কীভাবে কলেজে যেতে হয়।

 


ঘটনাটি ঘটেছে অনেক বছর আগে। আমি তখন ছোট। প্রাইমারিতে পড়ি। তখন ছিল ঘোর বর্ষা। এমন বর্ষা আগে দেখিনি। ঘরের পাশে কচুগাছ, পাতায় পানি জমে। পানি বেশি হলে গড়িয়ে পড়ে যায়। কয়েকটা ব্যাঙ কী ডাকছে! আমিও ডাকছিলাম, বৃষ্টির সাথে কথা বলছিলাম।
বৃষ্টি পৃথিবীকে ডুবিয়ে দিচ্ছিল। এই পৃথিবী বিশাল মহাসাগরে পরিণত হবে। মাটির ওপর কিছু থাকবে না; যা থাকার সব থাকবে পানির নিচে।
বৃষ্টি হলে আমি পাগল হয়ে যাই। কেবল ভিজি। ভিজতে আমার এত ভালো লাগে, তা কাউকে বলে বোঝাতে পারব না। মা, বাবা, আপা সবাই বকা দেয়। আমি হাসি। তাদের বকাকে পাত্তা দিই না।
পাত্তা না দিয়ে জ্বর বাঁধালাম। এ কি যে সে জ্বর! একেবারে ১০৬ ডিগ্রি। যমে-মানুষে টানাটানির মতো অবস্থা। বাবা থানা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে গেলেন। কিন্তু ডাক্তাররা কোনোমতেই জ্বর ফেলতে পারছেন না।
শুক্রবার শহর থেকে মেডিসিনের এক ডাক্তার আসেন। ওই দিন তাকে হাসপাতালে ডাকা হলো। তিনি এলেন। এসে কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর কপালে হাত দিলেন। হাত সরিয়ে বললেন, দ্রুত বরফ আনেন।
বরফ আনা হলো। তিনি বললেন, সব কাপড় খুলে ফেলেন।
আমার লজ্জা লাগলেও, জ্বরের ঘোরে আপত্তি জানালেও কেউ পাত্তা দিল না। খুলে ফেলা হলো সব কাপড়।
বরফ ঘষতে থাকো। নার্সদের আদেশ দিলেন ডাক্তার।
বরফ ঘষা শুরু হলো। মাথার ওপর ফ্যান চলছে। আরেকটা বড় টেবিল ফ্যান আনা হলো। চালু হলো দ্রুত।
কিছুক্ষণ পর আশ্চর্য হয়ে দেখলাম, জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে।

 


আমাদের ঘরের পেছনে গড়, মানে ডোবা। গড়ের পাশে পেয়ারা আর জাম্বুরাগাছ। গলায় ওড়না বেঁধে জাম্বুরাগাছের সাথে ঝুলছে ঝরনা আপা। আমাকে দেখে জিব দিয়ে ভেঙচি কাটছিল।
নিচের দিকে তাকিয়ে দেখলাম, তার ডান পা গড়ের পাশে কাদামাটিতে ডুবে আছে। আরে! আপা তো জাম্বুরাগাছ হয়ে গেছে। কিন্তু গাছে কোনো পাতা নেই।
এ রকম গাছে কি পাতা ফোটে? এই প্রশ্ন আমি কাউকে করতে পারি না। পাতার জন্য তার সেকি আকুলিবিকুলি! তা দেখেছিলাম কেবল আমি।

 


সেই স্পর্শটা আমার লাগবে। যে স্পর্শে আমি পাগল হয়ে যেতে পারি। পাগল হয়ে পাগলে যা করে তা করতে পারি।
তোমরা হয়তো বিশ্বাস করবে না, কিন্তু আমি করি। তোমরা হয়তো জানবে না, কিন্তু আমি জানি। আপার মৃত্যুর জন্য দায়ী কে? কিন্তু এ কথা আমি কাউকে বলব না। আমি তা জমা রাখতে চাই এই জাম্বুরাগাছের কাছে, তার ফুলের কাছে। যদি ফুল ঝরে যায়! না, কারও কাছে রাখব না। আমি এই কথা বাতাসে ছড়িয়ে দেব। সেখান থেকে ফুলের কাছে গেলে যাবে। ভুলের কাছে যাতে না যায় তা দেখব আমি।

 


কিন্তু কী হয়েছিল? আপা কেন জাম্বুরাগাছ হয়ে গিয়েছিল? সেই কথা বলতে লজ্জা করছে। সেদিন হয়তো জ্বর ছিল ১০৫ ডিগ্রি। হয়তো আমার একটুখানি ঘুম এসেছিল, আবার জ্বরের ঘোরে ভেঙেও যাচ্ছিল। ঘোরের মাঝে দেখলাম, আপা আমার ওটা ধরে টানাটানি করছে। আমি ব্যথা পাচ্ছিলাম। সারা শরীর ব্যথায় জর্জর ছিল।
আমাকে জোরে জড়িয়ে ধরল। আমি হাঁসফাঁস করছিলাম। কেঁদেই দিলাম। বললাম, ছেড়ে দাও। ভয়ে বা জ্বরে কাঁপছিল সারা শরীর। তারও একই অবস্থা।
আমার কান্নায় হঠাৎ তার হুঁশ ফিরে আসে। বজ্রপাতে স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মানুষের মতো কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থাকে আমার দিকে। তারপর দৌড়ে বেরিয়ে যায়।
আমি গুটিসুটি মেরে শুয়ে থাকি।

 


ঝরনা আপা? ও ঝরনা আপা? তোমার হাসিটা দেখতে আমার খুব ইচ্ছে করছে। আমার মনের মধ্যে গুনগুন করছে চিঁ-কুতকুত, চিঁ-কুতকুত...
তোমার কথা মনে পড়লেই কে যেন কানের কাছে গুনগুন করে, কুতকুত, কুতকুত...। কুতকুত খেলায় তুমি তো খুব দক্ষ ছিলে। তোমার সাথে কেউ পারত না।
তোমরা তো জানো না, আপা জাম্বুরাগাছ হয়ে যাওয়ার পর আমি আর বৃষ্টি পছন্দ করি না, বর্ষা পছন্দ করি না। যেদিন বৃষ্টি পড়ে সেদিন আমি বেরোই না। ঘরেই বন্দি থাকি। কখনো বৃষ্টির ফোঁটা পড়লে মনে হয়, আপা কষ্ট পাচ্ছে। আর কেউ হাজার হাজার পিন দিয়ে আমাকে গুঁতা দিচ্ছে। আমি রক্তাক্ত হয়ে যাই।
রক্তাক্ত আমি জাম্বুরা খাই না। কাউকে জাম্বুরা খেতে দেখলে মনে হয় তারা ঝরনা আপাকে চিবিয়ে খাচ্ছে।

 


ঝরনা আপা যেভাবে ধরেছিল, একদিন আমি সেভাবে ধরি। নাড়াচাড়া করতে করতে অদ্ভুত সুখ বের হলো। ওটা পড়ল আমার পায়ে। আমার পা যেন পচা কাদায় ঢুকে গেল। ধীরে ধীরে পাল্টে যাচ্ছে শরীরের রেখা। ঝরনা আপার মতো আমার ভেতর একটা গাছ উঠছে। কিন্তু গাছটাতে ঠিক প্রাণ ফুটে উঠছে না। পাতার জন্য, ডালপালার জন্য আমার মন কেমন করছে।
কেন যেন খুব কান্না পাচ্ছিল। জাম্বুরাগাছের নিচে বসে একা একা কাঁদি। কিন্তু আমার কান্নায় কেউ সাড়া দেয় না। কাঁদতে কাঁদতে আমি প্রাচীন শিকড়ের অশ্বত্থগাছটার দিকে এগিয়ে যাই। সেটি আছে ঘাটায়। বিশাল গাছটির নিচে আমাকে বসতে হবে। আমার নিজেকে জিজ্ঞেস করতে হবে কিছু কথা। হয়তো শিকড়ে হাত রেখে আমি ঘুমিয়েও যেতে পারি।
ঘুমের মধ্যে আমার কি ঝরনা আপার জাম্বুরাগাছ হওয়ার আগের আপার কথা মনে পড়বে? সেই যে, এক সকালে খালের পাড় ধরে হেঁটে আমাকে নিয়ে মতিউর রহমান শাহ’র ওরসের মেলায় নিয়ে গিয়েছিল। কিনে দিয়েছিল সবুজ রঙের একটি টিয়ে। টকটকে রং। টিয়েটা কি এখনো আমার কাছে আছে!
হ্যাঁ, আছে। ওটা না থাকলে আমি বাঁচতাম না। সত্যি বলছি।