গদ্যের সৌন্দর্য বা কাঠুরিয়ার কাজ
গদ্যের সৌন্দর্য নিয়ে কোনো কাজ কি আমি পড়েছি? মনে পড়ছে না। আমরা কি এ নিয়ে ভেবেছি? এ প্রশ্ন আমরা করতেই পারি, আসলে গদ্যের সৌন্দর্য নিয়ে আমাদের চেতনায় সত্যই কোনো ভাবনা আছে কি না। বিষয়টি অবশ্য ভাবনার। আমরা কবিতার সৌন্দর্য খুঁজতে যতটা তৎপর, তার নানা কৃতি নিয়ে গর্বিত এবং উৎসাহিত, গদ্যের কারুকাজ নিয়ে তেমনটা নই। গদ্যের রূপ নিয়ে আমাদের ভাবনা যে চলমান জীবনের মতোই প্রবহমানতার স্রোতের অংশ, সেটা আমাদের নতুন করে চিনতে হবে। কারণ, আমাদের চেতনাকে ওই চিন্তার ফোকরে ঢুকিয়ে নতুন করে নতুনভাবে ভাবতে হবে।
ভারতীয় বা ইউরোপীয় সৌন্দর্যবাদীরা যে চোখেই দেখেন না কেন, তাঁদের চিন্তায় যে কবিতাই ছিল প্রথম, তা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। গদ্য তাঁদের সামনে আসে অনেক পরে, যখন আসে তখনো তার সৌন্দর্য নিয়ে তাঁরা ভাবেননি। এটাকে আমি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করি। কারণ, গদ্য তখনো শোভাবর্ধনকারী লেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি, বা একে নতুন প্রেরণার উৎস ভাবেননি কেউ। যাঁরা শিল্পসাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষক, তাঁরা গদ্যের সৌন্দর্য খুঁজে দেখার প্রেরণা পাননি। কিন্তু এখন সেই কাল যেমন গত হয়েছে, তেমনি সেই উৎসের মানুষেরাও গত হয়েছেন। এখনকার সৌন্দর্যবাদীরা একই সঙ্গে দৈশিক ও বৈশ্বিক শিল্পসাহিত্যের বাজারে নিত্যই ঢুঁ মারেন। সেটা বই সংগ্রহ করে যেমন, তেমনি অনলাইনেও তাঁরা তৎপর। নিজেদের ভালো লাগা গদ্যের বিষয় নিয়ে তাঁরা কাজ করেন। চিহ্নিত করেন সেই গদ্যের প্রবহমানতা এবং সৌন্দর্যের উপকরণ-উপাদান।
কী কী উপকরণ-উপাদান গদ্যের সৌন্দর্য বাড়ায়, তা-ও তাঁরা চিহ্নিত করেন। কিন্তু আমরা তার তেমন কিছু জানি না। আমি বর্তমান জটিল/জঙ্গম পৃথিবীর কিছুই জানি না, তবে আঁচ করতে পারি। কেন আঁচ করতে পারি?
২
পারি, কারণ এই পৃথিবীরই বাসিন্দা আমি। কিংবা পারি না, কারণ তার জটিলতার বহু স্রোতাক্রান্ত গতিপথ সম্পর্কের তলদেশ অজানা রহস্যে বোনা। সেই তল পাওয়া কঠিন, দুরূহ। আবার এর গভীরতর বোধ আমরা অন্তরে সহজে আয়ত্ত করতে পারি অনুভব/উপলব্ধির স্বাভাবিক চেতনার দ্বারা। এর ভেতর মহলে কী কী আছে, তা জানি না। জানার জন্য সময় সুযোগ আর অভিনিবেশ দরকার। সেই সময় আমাদের নেই। অভিনিবেশের প্রধানতম অন্তরায় জঙ্গম পৃথিবীতে খাদ্যান্বেষণের জন্য মানুষের ইঁদুরদৌড়। সেই দৌড়ে আমাদের নাভিশ্বাস ওঠে প্রতিদিন। তারপর বিশ্রাম, ঘুম, তারপর আবার খাদ্যের সন্ধানে ইঁদুরদৌড়। এর ভেতর থেকে বেরিয়ে মনের খোরাক জোগাড় করা অনেকটাই কষ্টসাধ্য। কখনো কখনো তা দুঃসাধ্যও। তারপরও মানুষ থেমে থাকে না। কারণ, তার মধ্যে নিহিত আছে অন্বেষণের অসীম স্পৃহা। সেই স্পৃহাই তাকে নিয়ে চলে অজানা গন্তব্যের পথে, যা অজানা, অচেনা, দুর্গম।
ভারতীয় বা ইউরোপীয় সৌন্দর্যবাদীরা যে চোখেই দেখেন না কেন, তাঁদের চিন্তায় যে কবিতাই ছিল প্রথম, তা নিশ্চিত করেই বলা যেতে পারে। গদ্য তাঁদের সামনে আসে অনেক পরে, যখন আসে তখনো তার সৌন্দর্য নিয়ে তাঁরা ভাবেননি। এটাকে আমি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া বলে মনে করি। কারণ, গদ্য তখনো শোভাবর্ধনকারী লেখা হিসেবে চিহ্নিত হয়নি, বা একে নতুন প্রেরণার উৎস ভাবেননি কেউ। যাঁরা শিল্পসাহিত্যের বিচার-বিশ্লেষক, তাঁরা গদ্যের সৌন্দর্য খুঁজে দেখার প্রেরণা পাননি। কিন্তু এখন সেই কাল যেমন গত হয়েছে, তেমনি সেই উৎসের মানুষেরাও গত হয়েছেন। এখনকার সৌন্দর্যবাদীরা একই সঙ্গে দৈশিক ও বৈশ্বিক শিল্পসাহিত্যের বাজারে নিত্যই ঢুঁ মারেন
সেই অচেনাকে চেনার পথ বাতলে দেন সৌন্দর্য বিশারদগণ। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে সৌন্দর্য নামের এই অদৃশ্যমান একটি উপাদানের রূপ কী হতে পারে, সেটাই তো অন্বেষণের মূল লক্ষ্য। আমরা খুঁজে বেড়াই নিজেকেই। উল্টেপাল্টে দেখি তার বহিরাবরণ, অন্তরও চেখে দেখার জন্য তার কিছু সৃষ্টি নমুনা পড়ি বা দেখি। দেখে যদি আনন্দ জাগে মনে, পড়ে যদি আনন্দ জাগে কিংবা ধরা যাক, জাগল বেদনা, জারিত হলো দুঃখের রস, তখন আমরা ধরে নিই ওই সৃষ্টি মানুষকে জাগাতে পারে। তার সত্তাকে নাড়া দিতে পারে, তার চেতনায় ঘা দিতে পারে, তাকে জাগিয়ে তুলতে পারে ভিন্ন এক পরিপ্রেক্ষিতের ভূমিতে।
ফুলের আকার আছে, তার গন্ধ সু হতে পারে, আবার উৎকটও হতে পারে। কিন্তু গন্ধের বা সুবাসের কোনো আকারসর্বস্বতা নেই। নেই বলে যে তা একেবারেই অস্তিত্বহীন, তা তো নয়। গন্ধটা সুগন্ধি হোক বা না হোক, তার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু যার কোনো গন্ধ নেই, তাকে কী করে আনন্দময় ভাবব আমরা?
অস্তিত্ব আছে, ব্যাসও মাপা যেতে পারে যদি কোনো আধারে ঢোকানো হয়, ওজনও মাপা যায়, কিন্তু গন্ধ ও বর্ণ নেই। সেই প্রায় অস্তিত্বহীন অস্তিত্বের উপাদান হচ্ছে বাতাস। অপরিমেয় বাতাস আমাদের শ্বাসের উপাদান, আমাদের অস্তিত্ব রক্ষার অক্সিজেন, তার শোভা আমরা দেখি না। মনেও করি না যে তার আলাদা অস্তিত্ব আছে। বাতাস না থাকলে যে আমরা মৃত বস্তু হয়েই থাকতাম, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। এই অবারিত বাতাসের উৎস কোথায়? কোনো বিজ্ঞানী কি গবেষণা করে বের করতে পেরেছেন? ধরা যাক, ওই আকাশের কথা, যাকে দেখি আমরা খালি চোখে, অনুভব করি তার সুনীল সুগোল রূপ, কিন্তু তাকে স্পর্শ করতে পারি না। পারি না, কারণ সে তো শূন্য কেবল। ওই শূন্যতার কোনো শুরু-শেষ নেই। ওই অনিঃশেষ আকাশের খুঁটি খোঁজা জরুরি। কীভাবে সে এমন ঢঙে দাঁড়িয়ে আছে? কী করে দাঁড়িয়ে আছে? বিস্ময়কর এই ভাবনাগুলোই আমাকে সৌন্দর্য আহরণে উৎসাহ জুগিয়ে চলেছে। সেই উৎসাহের সাহসে ভর করে আমি রূপোশ্বৈর্যের সন্ধানে বেরিয়েছি।
৩
না, আমি আকাশের বর্ণনায় যাব না। কেন না, তা হবে বাহুল্য। যাঁরা আকাশের বর্ণনা করেছেন, তাঁদের কবিতায় বা গদ্যে, গল্পে, উপন্যাসে এবং প্রবন্ধ-নিবন্ধে—সেখানেই আমরা পেয়ে যেতে পারি তাঁদের উপলব্ধির লেখ্য রূপ। শুধু বিস্ময়কর আকাশই নয়, আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের বাতাসই নয়, এই জগৎ সংসারের যাবতীয় উপাদান-উপকরণ নিয়েই আমরা কথা বলতে পারি, বলা উচিত।
এই ঔচিত্যবোধ ভাষার গদ্য সেক্টরে কেমন, তা-ও পরখ করা যেতে পারে। ঔচিত্যের সঙ্গে সামাজিক যুক্তির এক অদৃশ্য-প্রায় বন্ধন আছে। সংস্কৃতি তার শিক্ষক, রূপকার। সংস্কৃতি আমাদের শেখায় তার পারিপার্শ্বিক সমাজ-সংসার আর চিন্তাশীলতার বৌদ্ধিক প্যাটার্ন। সমাজের বাসিন্দারা সেই যুক্তিই মেনে নেয়, কেননা, সেখানে তার/তাদের উপকার/কল্যাণ নিহিত থাকতে দেখে, তাদের চেতনায় তা গ্রাহ্য। কবিতার চেয়ে গদ্যে যুক্তি অনেক কার্যকর বলেই মানি। বিশেষ করে প্রবন্ধের গদ্যে যুক্তি অনিবার্য। কবিতা যুক্তি মানে না। সে যুক্তির বন্ধনমুক্ত হয়ে দেখতে চায় সেই নিরালোকে কিসের বাহানা খেলা করে। কিংবা সেখানে অধিবাস্তব/পরাবাস্তব পৃথিবীটা কেমন-বা কেমন হতে পারে। সেখানে যেতে তার মন আর মানসচক্ষুই যথেষ্ট।
গল্প-উপন্যাসের গদ্যে যুক্তি অবশ্যই অনিবার্য, তবে চরিত্রের মানস বর্ণনায় তার রূপ কবিতার মতোই কোমল হতে পারে, জটিলও হতে পারে, রহস্যে ভরপুরও হতে পারে তার বর্ণনা। যাকে বলা যেতে পারে, কোমলে-কঠিনের দ্বৈরথের ভালোবাসা। কবিতার কোমলতার পেছনে কি এই সব থাকে, যা বলেছেন বুদ্ধদেব বসু তাঁর এক প্রবন্ধে?
‘কবিতা লেখা ব্যাপারটা আসলে জড়ের সঙ্গে চৈতন্যের সংগ্রাম, ভাবনার সঙ্গে ভাষার, ও ভাষার সঙ্গে ছন্দ, মিল, ধ্বনিমাধুর্যের এক বিরামহীন মল্লযুদ্ধ।’ [ প্রবন্ধ সংকলন/ বুদ্ধদেব বসু, ১৯৬৬, পৃ. ১০২, দে’জ, কলকাতা]
বুদ্ধদেবের কথায় কবিতার বিষয়ে জানা গেল। কিন্তু গদ্য সম্পর্কে তিনি কি বলেছেন? বিশেষ করে রবীন্দ্রনাথের গদ্যশিল্প বিষয়ে?
‘গদ্যশিল্পে সচেতন পরীক্ষার লিপিকাতেই আরম্ভ। তার মানে, রবীন্দ্রনাথের গদ্য কবিতার ভেতরেই নিহিত ছিলো? বুদ্ধদেব লিখেছেন—‘যা কোনোরকমই পদ্য নয়, গদ্য-পদ্যের মাঝামাঝি জায়গায় অবস্থিতভাবে পড়েও নেই, যা নির্ভুল গদ্য এবং নির্ভুলভাবে ছন্দস্পন্দিত, এই ধরনের রচনা পর্যায় তাঁর অন্তরজীবনের প্রধান অবদান। [প্র.সং, বু.ব,পৃ.৩৭]
সে-তো বোঝা গেলো, এ হচ্ছে কবিতার গদ্য বিষয়ে বুদ্ধদেবের ভাষ্য। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধ গদ্যের বিষয়ে বুদ্ধদেবের কী অভিমত?
‘সবুজপত্রে’র আগে পর্যন্ত প্রবন্ধে বা কথাসাহিত্যে তাঁর কবিসত্তা সম্পূর্ণ নিষ্কৃতি পায়নি।…এখানে বলে রাখা দরকার যে, তার সাহিত্য ও রসতত্ত্বের আলোচনায় আমরা প্রথম থেকেই একটি ভিন্ন সুর লক্ষ করি এখানে তাঁর কবিসত্তার কাজ বেশি, উপমা আরো প্রচুর, মীমাংসা আরো অনিশ্চিত, এবং উপস্থাপনা—সরকারি আদর্শে দেখলে সবচেয়ে কম তৃপ্তিকর।…কেকাধ্বনি প্রবন্ধ তো রীতিমতো নন্দনতত্ত্বের অনুশীলন।…পঞ্চভূতে ভিন্ন ভিন্ন চরিত্রের সাহায্যে ভিন্ন ভিন্ন দৃষ্টিকোণ উপস্থিত করেছিলেন, তেমনি এখানেও যেন নিজের সঙ্গে তর্ক করতে করতে তার যাত্রা, একটু এগিয়ে, আর-একটু পিছিয়ে, মাঝ মাঝে হোঁচট খেয়ে, কখনো কোনো আকস্মিক ও উজ্জ্বল ভাবনার পশ্চাদ্ধাবন করে, কখনো বা দূর কল্পনার উৎসাহে আলোচ্য বিষয় বিস্মৃত হয়ে—এমনভাবে লেখেন যেন সমস্ত ব্যাপারটা তাঁর আত্মপরীক্ষা ও স্বগতোক্তি। ( পৃ. ৩৩)
মন্তব্য লিখেছেন বুদ্ধদেব, কিন্তু প্রমাণ হিসেবে উদ্ধৃতি দেননি রবীন্দ্রনাথের রচনা থেকে। আমি গদ্যের নমুনা দিতে চাই, যা নিয়ে আলোচনা করেছেন বুদ্ধদেব।
আধ বুড়ো হিন্দুস্থানী—
রোগা লম্বা মানুষ,
পাঁকা গোঁফ, দাড়ি-কামানো মুখ
শুকিয়ে আসা ফলের মতো।
ছিটের মেরজাই গাঁয়ে, মালকোচা ধুতি,
বাঁ কাঁধে ছাতি, ডান হাতে খাটো লাঠি,
পায়ে নাগরা, চলেছে শহরের দিকে
ভাদ্র মাসের সকালবেলা,…
পথিকটাকে দেখা গেল
আমার বিশ্বের শেষ রেখাতে
যেখানে বাস্তুহারা ছায়াছবির চলাচল।
ওকে শুধু জানলুম, একজন লোক।
ওর নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, বেদনা নেই,
কিছুতেই নেই কোনো দরকার।…
সেও আমায় গেছে দেখে
তার জগতের পোড়ো জমির শেষ সীমানায়
যেখানকার নীলকুয়াশার মাঝে
কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো,
যেখানে আমি, একজন লোক।
[একজন লোক]
এ-টুকু নিরেট বর্ণনা। মনে হয় সামনে দাঁড় করিয়ে বর্ণনাটি লিখেছেন তিনি। তখন সেই লিপিকা ও পুনশ্চর সময়ে, তিনি গদ্যস্টাইলে কবিতা রচনার জন্য মনস্থির করেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন, কথ্য ভাষায় পরিপার্শ্বের বর্ণনা দিলেই তা আধুনিক গদ্য কবিতা হবে। হয়নি যে তা বলি কেমন করে? আজকের অনেক কবিই তো এ-রকম বর্ণনাকেই কবিতা বলছেন। আসলে কবিতার প্রাণটি কোথায়, তার হদিশ কি আমরা আসলে জানি? উদ্ধৃত পঙ্ক্তিগুলোর শেষ পাঁচ পঙ্ক্তিকে আমি বলতে চাই সেই অন্বেষণ, যা কবির মনে বাসা বেঁধে থাকে।
সেটা কি আইস্যুলেশন? নাকি এটা সেই সত্তার শিকড় যাকে বলে মানবাত্মার নির্মূলকরণ? সে তো এলিনিয়েশন? ব্যক্তি থেকে ব্যক্তির বিচ্ছিন্ন বোধসত্তা? যা আধুনিক যান্ত্রিক সমাজসত্তার প্রধান রূপ। পাশের বাড়ির/বাসার বসতিকেও আমরা চিনি না, চিনলেও তাকে জানি না/জানি না মানে তার অন্তরের খবর জানি না। এর জন্য নির্মূলকরণ ধ্যান ও বিচ্ছিন্ন থাকার চেষ্টাকে যান্ত্রিকতার খোলস চাপানো হয়েছে।
আমার এ-রচনার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে গদ্য, যাকে আমরা বলি গদ্য—উপন্যাসের গদ্য, গল্পের গদ্য যেখানে প্রতিটি বাক্যে লুকিয়ে আছে/থাকে নিরেট বর্ণনার ভেতরে তুলনা, সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্যের মিল-অমিলের শ্লেষ আর হীরের কুচির মতো উপমা, চিত্র ও চিত্রকল্পের শোভা। আছে/থাকে রূপকের ইশারা, থাকে অ্যালিগরির ঝংকার। গদ্যের গহনসত্তার খোঁজ করতে গিয়ে কি আমরা এ-সব কবিতার উপাদান নিয়ে ভাবি? না, ভাবি না। আমি নিজেও এ-নিয়ে ভাবিনি।
বর্ণনাও কবিত্ব গুণে পাঠককে মুগ্ধ করতে পারে, সে আমরা দেখেছি সৃষ্টিশীল কবিতার বর্ণনায়, গদ্যের প্রকরণের প্রণোদনায়, গদ্যশিল্পীর রচনায়। বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, মীর মশাররফ হোসেন, জগদীশ গুপ্ত, সতীনাথ ভাদুড়ী, বুদ্ধদেব বসু, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়, বিমল কর, সমরেশ বসু, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ, শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়, আবুল বাশার, আল মাহমুদ, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, কায়েস আহমেদ, মাহমুদুল হক, সৈয়দ শামসুল হক, হাসনাত আবদুল হাই, হোসেনউদ্দিন হোসেন, আলাউদ্দিন আল আজাদ, শাহেদ আলী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত, আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী, আবুবকর সিদ্দিক, মহাশ্বেতা দেবী, ঋত্বিক কুমার ঘটক, আমজাদ হোসেন, আবু কায়সার, মাহবুব সাদিক, ফজলুল কাশেম, হুমায়ূন আহমেদ, সাইয়িদ আতীকুল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম, কমলকুমার মজুমদার, মতি নন্দী, সুব্রত বড়ুয়া, খায়রুল আলম সবুজ, হাসান আজিজুল হক, রাহাত খান, শওকত ওসমান, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, মঈনুল আহসান সাবের, বিপ্রদাস বড়ুয়া, ইমদাদুল হক মিলন, বনফুল, বুলবুল চৌধুরী, শাহাদুজ্জামান, সুচরিত চৌধুরী, মুর্শিদ এ.এম, রাবেয়া খাতুন, রিজিয়া রহমান, আবসার আমেদ, আবুল ফজল, ইউসুফ শরীফ, সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, আরেফিন বাদল, গৌরকিশোর ঘোষ, জাকির তালুকদার, মশিউল আলম, আহমদ বশীর এবং এ-কালের আধুনিক গদ্যশিল্পীদের রচনায় সেই সব অনন্য রূপায়ণ আমরা দেখতে পাব। যেসব সৃষ্টিশীল গদ্যকারের নাম লিখেছি, এর বাইরেও রয়ে গেলেন অনেকে, যাঁরা অবশ্যই উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন এবং তাঁদের রচনায়ও আছে সেই সব উপাদান, যা আমার অন্বেষণের লক্ষ্য। এঁদের কারও কারও রচনা থেকে প্রয়োজনমতো উদ্ধৃতি দেবার চেষ্টা করব, যাতে আমার বক্তব্যের সঙ্গে তা সঙ্গতি সাধন করে।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে দিয়ে শুরু করা যেত, কিংবা তাঁর পরবর্তী গল্পকারদের দিয়েও, কিন্তু সে জন্য আমাকে অনেক জায়গা নিতে হবে। তবে এটাও ঠিক যে বঙ্কিম ও রবীন্দ্রনাথের গদ্যের নমুনা উপস্থাপন করলে পরবর্তীকালের লেখকদের রচনার ভেতরে উপাদানগত ও চেতনাগত পার্থক্য চেনা সহজ হবে।
রবীন্দ্রনাথের এই কবিতাটুকু গদ্যে সাজালে কি তার কাব্যরূপ নষ্ট হয়ে তাঁর গদ্যের মহিমা নিয়ে দাঁড়াবে? জানি না, তবে চেষ্টা করে দেখা যাক, সেই গদ্যরূপটি কেমন দেখায় আর তার অর্থদ্যুতি অটুট থাকে কি না।
আধবুড়ো হিন্দুস্থানী—/ রোগা লম্বা মানুষ,/পাঁকা গোঁফ, দাড়ি-কামানো মুখ/শুকিয়ে আসা ফলের মতো। /ছিটের মেরজাই গাঁয়ে, মালকোচা ধুতি,/ বাঁ কাঁধে ছাতি, ডান হাতে খাটো লাঠি,/ পায়ে নাগরা, চলেছে শহরের দিকে/ভাদ্র মাসের সকালবেলা, …/পথিকটাকে দেখা গেল/আমার বিশ্বের শেষ রেখাতে/যেখানে বাস্তুহারা ছায়াছবির চলাচল। /ওকে শুধু জানলুম, একজন লোক।/ওর নাম নেই, সংজ্ঞা নেই, বেদনা নেই,/কিছুতেই নেই কোনো দরকার। …/সেও আমায় গেছে দেখে/তার জগতের পোড়ো জমির শেষ সীমানায়/যেখানকার নীলকুয়াশার মাঝে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো,/যেখানে আমি, একজন লোক।
[একজন লোক]
‘নীলকুয়াশার মাঝে কারো সঙ্গে সম্বন্ধ নেই কারো’—এ-টুকু ছাড়া উদ্ধৃত অংশে আর কোনো অস্পষ্টতা যেমন নেই, তেমনি রহস্যময়তাও নেই কবিতার। তার মানে কোনো কবিতার উপাদান-উপকরণ ও অলংকারও নেই। তাই একে কবিতা না বলে গদ্য বলাই শ্রেয়। কবিতায় যে সত্য তা অস্পষ্টভাবে লুকানো থাকে নানা অ্যালিগোরির সঙ্গে। সেই রকম কোনো রূপক এখানে নেই। কেবল সে একজন লোক, আমি একজন লোক এই মানবিক সত্য ছাড়া সামাজিক-রাজনৈতিকভাবে কিংবা সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্যে কোনো মিল-মহব্বত নেই তাদের মধ্যে। অনেকটাই কথা বলার ঢঙে তিনি এই কবিতার বর্ণনা দিয়েছেন বলে মনে হয়, কথ্য বাংলায় এর পদচারণা। না, এটাকে কবিতাই বলব, তবে উপমা, চিত্রকল্প ছাড়া। চিত্র আছে তাতে, কিন্তু কল্পনার সেই অমোঘ দ্যুতি—বিদ্যুচ্চমক নেই। নেই বিস্ময়। যদি কোনো কবিতার পঙ্ক্তি গদ্যাকারে সাজালে তার কাব্যিক রহস্য অটুট থাকে, যেমন জীবনানন্দ দাশের অনেক কবিতায় তার দেখা মেলে, তাহলে বুঝতে হবে ভাষার গহনে লুকিয়ে আছে কবিতার ঘোরতম রহস্য, যা অধ্যাত্মবাদীদের অন্বেষণের অংশ। শব্দমালা ব্যবহারের কৌশলই বলে দেয় সেখানে কবিতার উপাদান আছে কি না।
গদ্যে ফিরি। রবীন্দ্রনাথই উঠে এলেন প্রথমে।
পাওনা এবং অ-পাওনার টাকা নিয়ে নন্দনকিশোর কোনোদিন বাবুগিরি করেননি। থাকতেন শিকদারপাড়ার গলির দেড়তলা বাড়িতে। কারখানা-ঘরের দাগ দেওয়া কাপড় বদলাবার ওঁর সময় ছিলো না। কেউ ঠাট্টা করলে বলতেন, ‘মজুর মহারাজের তকমা-পরা আমার এই সাজ।
কিন্তু বৈজ্ঞানিক সংগ্রহ ও পরীক্ষার জন্যে বিশেষ করে তিনি বাড়ি বানিয়েছিলেন খুব মস্ত। এমন মশগুল ছিলেন নিজের শখ দিয়ে যে কানে উঠত না লোকের বলাবলি করছে—এত বড় ইমারতটা যে আকাশ ফুঁড়ে উঠল আলাদিনের প্রদীপটা ছিল কোথায়?
এক রকমের সখ মানুষকে পেয়ে বসে সেটা মাতলামির মতো। হুশ করে না লোকে সন্দেহ করছে। লোকটা ছিল সৃষ্টিছাড়া, ওঁর ছিল বিজ্ঞানের পাগলামি। ক্যাটালগের তালিকা ওল্টাতে ওল্টাতে ওঁর সমস্ত মন প্রাণ চৌকির দুই ছাতা আঁকড়ে ধরে উঠত ঝোঁকে ঝোঁকে…। চাকরি ছাড়তে হল। সাহেবের আনুকূল্যে রেল কোম্পানির পুরোনো লোহালক্কড় সস্তা দামে কিনে নিয়ে কারখানা ফেঁদে বসলেন। তখন য়ুরোপের প্রথম যুদ্ধে বাজার সরগরম। লোকটা অসামান্য কৌশলী, সেই বাজারে নতুন নতুন খালে নালায় তাঁর মুনাফার টাকায় বান ডেকে এল।’
[ল্যাবরেটরি/শতবর্ষের গল্প/মাহবুব হাসান নির্বাচিত, ২০০২, অয়ন প্রকাশন, ঢাকা, পৃষ্ঠা-৩৫০-৩৫১]
কবি বলেই কি তাঁর গল্পের বর্ণনা কাব্যিক উপমাযুক্ত? নাকি এ-কালের গাল্পিকরাও বাক্য সাজান উপমা, উৎপ্রেক্ষা সহযোগে। সেটা দেখাতে আরেকটি উদ্ধৃতি দেওয়া যেতে পারে।
কাছাকাছি কোথাও রাইফেলের গুলির আওয়াজ ফেটে পড়লো। অন্ধকারের ওপর পুরো একটা সর পড়েছিল, এখন তা তিরতির করে কেঁপে উঠলো, হয়তো কোনো কারণে ভয় পেয়েছে ছাউনির সৈনিক, শরীরকে চাঙ্গা করে নেবার জন্যে নিছক একটা ফায়ার। আজকাল তো সৈন্যরা এ-রকম খামোখা ফায়ার হরদমই করে থাকে। অন্যরা ছাউনির রাজাকাররাও হতে পারে। হয়তো তারাই এখন পাহারায়। অনেকের মতো মনোয়ারও জানে কারণে-অকারণে কিভাবে এদের হাত নিসপিস করে, এরা সব সময় হয়ে আছে ক্ষয়-গোখরো, একবারে দুম করে হাতে কল্কে পেয়েছে, গায়ে মাছি বসলেও ক্ষেপে ওঠে, জোরে বাতাস ছুটলেও এদের ইচ্ছে হয় হল্ট বলে তা থামিয়ে দিতে। মনোয়ার দেখেছে, উড়ন্ত ঝিঁঝিঁ পোকার দিকে তাক করে ফটাফট গুলি ছুঁড়ে নিজেদের রসিকতায় এরা নিজেরাই হো হো করে হাসে—মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান, হেউ।’
[কালো মাফলার/মাহমুদুল হক> শতবর্ষের গল্প, পৃষ্ঠা ৩১৯]
এ-দুজনের গল্পের ভাষাগত পার্থক্য সহজেই বোঝা যায়। রবীন্দ্রনাথ বহুচরিত্রের অধিকারী, আর মাহমুদুল হক একান্তই কথাশিল্পী। তাঁর সাহিত্য ভাবনা ও চর্চার এলাকা কেবলই কথাসাহিত্যের গদ্য। রবীন্দ্রনাথের মতো বহুমুখী প্রতিভাবান নন মাহমুদুল হক। তাঁর গদ্যে নিরেট কথাই থাকবার কথা। কিন্তু লক্ষ্য করলে দেখব রবীন্দ্রনাথ যে পরিমাণ কাব্য-সঞ্চারী শব্দ ব্যবহার করেছেন, তার চেয়ে বেশি ব্যবহার করেছেন মাহমুদুল হক। মনন ও মানসগত প্যাটার্নে শিল্পীচেতনায় এমন কিছু আরোপ করে, যা তাঁর সৃষ্টির প্রেক্ষাপটকে নান্দনিক ইমেজ নির্মাণ করেন। মাহমুদুল হকের গল্পের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিপ্রেক্ষিত পটভূমি মুক্তিযুদ্ধাক্রান্ত ঢাকা শহর। মধ্যরাতে পাকিস্তানি মিলিটারি ও তাদের এ-দেশীয় দোসর রাজাকারদের অপতৎপরতার চিত্র নির্মাণ করেছেন মাহমুদুল হক। কালো মাফলারের উদ্ধৃত বর্ণনাটুকুও যদি বিচার করতে যাই, তাহলেও উঠে আসবে রাজাকারদের রাজনৈতিক চরিত্র। তারা মনে-প্রাণে পাকিস্তানি সেনাদের সহচর এবং রাজনৈতিক শক্তির শাখা। তাদের কোনো সামরিক ট্রেনিং নেই, কিন্তু হাতে পেয়ে গেছে থ্রি-নট-থ্রি রাইফেল। যা মূলত সামরিক ক্ষমতার অংশ এবং একে সাহসেরও প্রতীক বলা যায়।
একবারে দুম করে হাতে কল্কে (কল্কে মানে রাইফেল) পেয়েছে, গায়ে মাছি বসলেও ক্ষেপে ওঠে, জোরে বাতাস ছুটলেও এদের ইচ্ছে হয় হল্ট বলে তা থামিয়ে দিতে। মনোয়ার দেখেছে, উড়ন্ত ঝিঁঝিঁ পোকার দিকে তাক করে ফটাফট গুলি ছুঁড়ে নিজেদের রসিকতায় এরা নিজেরাই হো হো করে হাসে—মুক্তিবাহিনীর গোয়েন্দা বিমান, হেউ।
এই বর্ণনার সঙ্গে বাংলদেশের লোকসমাজের একটি প্রায় অশ্লীল রসিকতার মিল পাওয়া যায়। ‘নতুন বাল গজালে তা আয়না দিয়ে দেখে’—এই লোক-রূপকটির শ্লেষ ফুটে উঠেছে। ‘একবারে দুম করে হাতে কল্কি পেয়েছে’ বলেই তারা গায়ে মাছি বসলেও খেপে যায়। জোরে বাতাস ছুটলেও এদের ইচ্ছে হয় হল্ট বলে তা থামিয়ে দিতে। অপরিণামদর্শীর হাতে অস্ত্রের মতো মারাত্মক কিছু গেলে যা হয়, হতে পারে, সেটা মাহমুদুল হক, ঠিকমতোই ধরতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর সামান্য হলেও ভাষাগত সংকট আছে। তিনি পশ্চিম বাংলায় জন্মেছিলেন বলে তাঁর চিন্তাগত ক্ষেত্রে তাঁর লোকাল ডায়লেক্ট কাজ করেছে। পূর্ব বাংলার লোকাল ডায়লেক্টে তিনি অভ্যস্ত ছিলেন না। অভ্যস্ত হলে তিনি কল্কে শব্দের জায়গায় ব্যবহার করতেন রাইফেল/বা অস্ত্র। সামরিক বাহিনীর ওই অস্ত্র সামাজিক মানুষের সাহস এতোটাই বাড়িয়ে দেয় যে, তাদের হিতাহিত জ্ঞান লুপ্ত হয়ে যায়। তাই ঝিঁঝিঁ পোকা বা নিরাকার বাতাস সে বা তারা থামিয়ে দিতে চায় অস্ত্রের জোরে। পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সদস্যরাও অস্ত্রের জোরেই আমাদের রাজনৈতিক চিন্তা ও স্বাধীনতার দাবিকে থামাতে চেয়েছিল, যা ছিল অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত। মানুষের, ব্যক্তিগত চিন্তা ও বিশ্বাসকে অস্ত্রের জোরে থামানো যায় না। ওই দুটি বিষয় আকারহীন, কিন্তু খুবই শক্তিশালী। বলতে গেলে চিন্তা ও বিশ্বাসকে বাগে আনবার কোনো ইজম, কলাকৌশল বা অস্ত্র আজও মানুষ আবিষ্কার করতে পারেনি।
ঝিঁঝিঁ পোকা সাধারণত নাগরিক জীবনে বাস করে না। কারণ, ঝোপঝাড় শহরে নেই বললেই চলে। কিন্তু ১৯৭১ সালের ঢাকার পাড়া-মহল্লাগুলো ছিল গ্রামীণ পরিবেশাক্রান্ত। ফলে মধ্যরাতে ঝিঁঝিঁ পোকাদের বাসস্থান ঝোপঝাড়সুলভ ছিল। এতে করে মাহমুদুল হকের বর্ণনায় যে পরিবেশ-পরিস্থিতির বিবরণ এসেছে, তা যথার্থই বলে যায়। একই সমাজের বাসিন্দার দুই বা অধিক মানুষের বর্ণনাভঙ্গি ও শব্দচয়ন ভিন্ন হতে বাধ্য। কারণ, তাঁদের মানস প্যাটার্ন। ব্যক্তির অভিব্যক্তিই তা প্রমাণ দেয়।
আরেকটি উদ্ধৃতি—কবির গদ্য।
একটা মিহিন শিসধ্বনি বাঁশঝাড়ের কিনারা ঘেঁষে নতুন তরতাজা বেড়ার ফাঁকে বার বার এসে বিঁধছে। আজ আষাঢ়ী পূর্ণিমা—সন্ধ্যের সময়েই নিশ্চয় সোনার থালার মতো পূর্ণচাঁদ উঠেছিলো, কিছুই দেখা যায়নি, বিকেল থেকে ধোঁয়াটে মেঘের আবরণে সারা আকাশ ছেয়ে আছে। এই রাত দুপুর শেষে তার আভা…ঈশ্বর পালাচ্ছে। হাতিয়ার-ফাতিয়ার যন্ত্রের বাক্স, কাপড়ের গাঁটরি, চিড়াগুড়ের পাতিল যেখানে যা আছে, থাক...ঝাপের ওধারে বুড়িমা যশোধা এবং এধারে রেবতী, যার কোলের কাছে তিন বছরের ছোট্ট কন্যা শিউলি...ওরা ঘুমাচ্ছে, ঘুমাক ওরা। পালাচ্ছে ঈশ্বর।
(ঈশ্বরের পলায়ন/আলাউদ্দিন আল আজাদ/শতবর্ষের গল্প/মাহবুব হাসান সম্পাদিত/২০০২, ঢাকা)
আরেক কবি আল মাহমুদের গদ্য—
প্রথমে কালো পাখিটাকে আমি দেখিনি। আমার লক্ষ্য ছিল একটা শাদা বগার ওপর। বগাটা ছিল বিশাল আর ধবধবে শাদা। নিশ্চিন্ত মনে ঘাড় বাঁকা করে স্বচ্ছ পানির ভেতরে সে তার ধারালো চঞ্চু উঁচু করে ঠোকর মারার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিল।…আমার কথা শুনে আদিনা মুখে কাপড় চাপা দিয়ে এমনভাবে হেসে উঠেছিল যে, হাসির কাঁপুনিতে তার পিঠটা নুয়ে পড়েছিল।…আমি আমার একনলা বন্দুকটা সোজাসুজি সামনের দিকে তাক করলাম। আশ্চর্য, পাখিটা কী ভেবে যেন তার ভয়ের ভাবটা মুছে ফেলে আবার পানির দিকে মুখ নামিয়েছে। গুলি করলাম। পাখিটা তাসের ঘরের মত পানির ওপর শাদা দুটি বড় পাখা খুলে বিছিয়ে দিল। একটুও নড়ছে না।…আমি বন্দুকটাকে নামিয়ে নিলাম। না, কোনো দয়ামায়া, স্মৃতি বা কবিত্বের তাড়নায় নয়, আমি ভুল করে পাখিটার পেছন দিক থেকে লক্ষ্য স্থির করেছি অথচ পাখি শিকারিরা কোনোদিন পেছন দিকে থেকে গুলি করে না। আগে আমিও কোনোদিন করেছি বলে মনে পড়ে না। কেন পড়ে না? সম্ভবত শিকারের মুখোমুখি না হলে বারুদবর্ষণকারীরা কোনো আনন্দ পায় না। বীর্যবর্ষণকারীদেরও যেমন রমণলিপ্তা নারীর মুখমণ্ডল, বাহুমূল, স্তনযুগের প্রত্যক্ষতা অবলোকন ও পেষণের প্রয়োজন অবধারিত হয়ে ওঠে, কারণ, এসব উপাচারের স্বতঃস্ফূর্তি রক্তকে মথিত করলে পুরুষের শরীর একটা নিক্ষেপনীতিতে ঋজু হতে হতে এক অন্তরালবর্তী পুলকময় সত্তাকে নির্গলনে বাধ্য করে। যদিও বেগবান বারি জরায়ুকে বিদ্ধ করবে কি করবে না’ এ-নিয়ে বর্ষণকারীদের কোনো মাথাব্যথা থাকে না। বারুদবর্ষণকারী শিকারির নীতিও তেমনি।
[পানকৌড়ির রক্ত/আল মাহমুদ/ শতবর্ষের গল্প/ঐ]
পর পর দুজন কবির লেখা গল্প থেকে উদ্ধৃতি দিয়েছি এ-কারণে যে প্রধানত কবি হলে তাঁদের গল্পের ভাষা কেমন হয়, তা দেখানো বা বোঝানোর জন্য। আলাউদ্দিন আল আজাদ ও আল মাহমুদ দুজনেই প্রধানত কবি। দুজনেরই গল্প উপন্যাসে সমান ঝোঁক ও খ্যাতি আছে। এ-দুজনের সামাজিক জীবনের গ্রামীণ পটভূমি প্রায় একই এলাকার। আলাউদ্দিন আল আজাদ কিশোরগঞ্জ, ভৈরব এলাকার, আল মাহমুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ। লোকজীবনাচারের বিষয়-আশয় এ-দুজনের কৈশোর-যৌবনকালে একই সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত প্রেরণাজাত। তাঁরা মানুষের বসবাসের এলাকাকে, গ্রামের প্যাটার্নকে খুব নিবিড়ভাবে চেনেন। সেটা কিন্তু দুজনের বর্ণনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দুজনের গল্পেই। তাহলে পার্থক্য কোথায়? দুজন কবি হওয়ার পরও, কবিদের যে উপমা ব্যবহারের ঝোঁক থাকে, তা পাওয়া গেলে পার্থক্য বোঝা সহজ হয়। আবার দুজনের পরিবেশ বর্ণনায়ও কবির চেতনার স্পর্শ আছে ভাষার শব্দমালায়।
কিন্তু গদ্যের ভেতরে যে রহস্য লুকানো থাকে, সেই রহস্যের কুঠুরি কোথায়, তা খুঁজে দেখা দরকার। সেই রহস্যের অন্যতম উপাদান পাঠককে চুম্বকায়িত করে। গদ্যকার এমন সব শব্দ প্রয়োগ করেন, তার পরিবেশ ও প্রতিবেশের বর্ণনায়, চরিত্রের আবেগ-অনুভূতি চিত্রায়ণে এমন বাগভঙ্গি নির্মাণ করেন যে পাঠক তার বিদ্যাজাত বুদ্ধি ও স্বাভাবিক মানবিক ও মানসিক প্রজ্ঞায় তা বুঝতে পারেন এবং আনন্দ বা বেদনাজাত হন। কবিরা যেমন উৎপ্রেক্ষা ও তুলনা ব্যবহার করেন, সেটা কবি স্বভাবের কারণেই বেশি হয়ে থাকে, তেমনি উপমাও আমরা লক্ষ করি। এ-গুলো কবিতার উপাদান হলেও গদ্যের শোভা- সৌন্দর্য নির্মাণেও অনেক ভূমিকা রাখে।
আল মাহমুদ বারুদবর্ষণকারী আর বীর্যবর্ষণকারীর মধ্যে যে সাজুয্য-সামঞ্জস্য নির্মাণ করেছেন, তা আমাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অভিজ্ঞতায় তেমন একটা সাধারণভাবে দেখা যায় না। একজন শিকার করতে অব্যর্থ লক্ষ্যভেদী, অন্যজন সঙ্গিনীর আনন্দকে ঘনীভূত করে তোলার জন্য ব্যস্ত। তার লক্ষ্য অব্যর্থ হলো কি হলো না, তা নিয়ে সে ভাবিত নয়। একজন আনন্দরসে সিক্ত অন্যজন করুণ রসের ভেতর দিয়ে আনন্দ অর্জনে বন্দুক তাক করেন। জীবনে এই দুটিই আছে। একজন নির্মমভাবে পাখি শিকার করে, অন্যজন নারীর শরীর দলিত-মথিত করে রক্তে বান ডেকে এনে বীর্যপাতের ভেতরে মুক্তানন্দ লাভ করেন। কবির লেখা গল্পে তাই রহস্যের সুতোর মাথাটা থাকে এমন এক জায়গায়, যা খুঁজে নিতে হয় পাঠককে, খুবই সতর্কভাবে। কারণ, কবি গদ্যের ভেতরে যেসব শব্দ ব্যবহার করেন, তা অনেক সময়েই প্রতীকী ভাষ্য হিসেবেও করেন। এ-জন্যে পাঠককে খুব মনোযোগ দিয়ে পড়তে হয় কবির লেখা গল্প বা উপন্যাস।
মাহমুদুল হক কবি নন, গদ্যশিল্পী, তাঁর ভাষায় দেখা যাক কী রহস্য লুকিয়ে আছে।
কাছাকাছি কোথাও রাইফেলের গুলির আওয়াজ ফেটে পড়লো। অন্ধকারের ওপর পুরো একটা সর পড়েছিল, এখন তা তিরতির করে কেঁপে উঠলো, হয়তো কোনো কারণে ভয় পেয়েছে ছাউনির সৈন্যরা, শরীরকে চাঙ্গা করে নেবার জন্যে নিছক একটা ফায়ার।
গদ্যকার মাহমুদুল হকের বর্ণনা পড়ুন। রাইফেলের গুলির আওয়াজ যখন ফেটে পড়ে লেখা হয়, তখন সেই প্রতিবেশের সময় ও কালের প্রবাহ মনে রাখা জরুরি। যুদ্ধাক্রান্ত ঢাকার বাসিন্দাদের ভয় মেশানো জীবনে রাইফেলের গুলি ফেটেই পড়ে। অন্ধকারের ওপর পুরো একটা সর পড়েছিল—দৃশ্যটি কল্পনা করুন। সেই সর গুলির আওয়াজে তিরতির করে কেঁপে ওঠে। কবি নন তিনি, তবে পরিবেশের বর্ণনায় প্রতিবেশের ইমেজ ধারণ করতে গিয়ে তাঁকেও এমন সব শব্দ তুলে আনতে হয়, যা সেই পরিবেশকে বাঙ্ময় করে তোলে। এ-গল্পে মাহমুদুল হক সেই সুষমাই নির্মাণ করেছেন।
আধুনিক নগর ও তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ডায়লেক্ট আজ কথ্যরূপের মধ্যেও প্রমিত সার্কেল/ঘের সৃষ্টি করেছে। এই প্রমিত বাংলায় যারা কথা বলেন না, আমরা ধরে নিই তারা মহানগরের জন্য উপযুক্ত (কালচারড) হয়ে ওঠেনি। তারা লোক বাংলার সংস্কৃতিতে রয়ে গেছে। এবং তারা একটি মিশ্রভাষিক ডায়লেক্ট সৃষ্টিতে কাজ করছে। ঠিক একইভাবে ওই ঢাকাইয়া ডায়লেক্ট না জানা, না বলতে পারা এ-যুগের আধুনিক নাগরিকেরাও যে মোগলীয় ঐতিহ্যে স্নাত পুরাতন ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে, তাদের কালচারাল বিহেভিয়ারের পাঙ্ক্তেয়-জন হয়ে ওঠেনি, সেটাও বুঝতে হবে আমাদের। খুবই ছোটো তাদের ডায়লেক্ট এলাকা, তবে তা বিশিষ্ট, মানতেই হবে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এবং কালচারাল নৃবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন
কবি-গদ্যকার এবং শুধুই গল্পকারের রচনার মধ্যে তুলনা করিনি, করব না। তবে তুলে ধরব কার মনের জোর কোথায়, ভাষার জোর কোথায়, গল্প নির্মাণের কলাকৌশল কোথায়? এই কথাগুলো বলার আগে একবার মনে পড়ল নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘টোপ’ গল্পটির কথা। বহুকাল আগে পড়া সেই গল্পটি শতবর্ষের গল্প সংকলন ঘেঁটে দেখতে গিয়ে চোখে পড়ল নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘রস’ গল্পটি, বিমল মিত্রের ‘আমীর ও উর্বশী’, প্রফুল্ল রায়ের ‘চর’, মুর্শিদ এ.এম-এর ‘ফাউ ও ফেরেশতা’, সৈয়দ মনজুরুল ইসলামের ‘ফেরিঘাটের রান্নাবান্না’, সুবোধ ঘোষের ‘ফসিল’, কায়েস আহমদের ‘মহাকালের খাঁড়া’, ওয়াসি আহমদের ‘পারুল’, শওকত ওসমানের ‘রাতা’, সমরেশ বসুর ‘আদাব’, শাহেদ আলীর ‘জিবরাইলের ডানা’, আবুল বাশারের ‘ফাউ’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘এক বর্ষার গল্প’, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের ‘তারাবিবির মরদপোলা’, বিমল করের ‘আত্মজা’, সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর ‘স্তন’, কমলকুমার মজুমদারের ‘ফৌজ-ই-বন্দুক’ চোখে পড়ল।
না, কাউকেই বাদ রেখে ওই সব গল্পকারের ভাষার কেরামতি দেখানো ঠিক হবে না। কেন তাঁরা শিল্পী, ভাষার শিল্পী, গদ্য নির্মাণে মানুষের চেতনার পরশ নির্মাতা, তা বুঝতে হলে তাঁদের নির্মাণকলা পরখ করা জরুরি। গদ্য নির্মাতা হিসেবে কাউকেই কারও চেয়ে কমজোরি ভাবা ও বলা অনুচিত হবে। তাঁরা প্রত্যেকেই নিজ নিজ ভাষা-চেতনায় উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমি যখন এই সংকলনের জন্য গল্প বাছাই করছিলাম, প্রায় দুই বছর ধরে, তখন আমাকে একেকজনের অনেক গল্প পড়তে হয়েছে, তাঁদের সেরা গল্পটা বেছে নেবার জন্য। জানি না, যেগুলো বেছে নিয়েছিলাম, সে গল্পগুলো কালের বিচারে তাদের সেরা গল্প কি না! তবে তাঁদের রিপ্রেজেন্ট করে এই গল্পগুলো, এটা আমি বলতে চাই।
ওদিকে ঘন কালো বনান্তের ওপরে ভাঙা চাঁদ দেখা দিল। তার খানিকটা ম্লান আলো এসে পড়ল চারশো ফুট নিচের নদীর জলে, তার ছড়ানো-মণিখণ্ডের মতো নুঁড়িগুলোর ওপর। আবছাভাবে যেন দেখতে পাচ্ছি কপিকলের দড়ির সঙ্গে বাঁধা সাদা পুঁটলিটা অল্প অল্প নড়ছে বালির ওপরে। এক হাতে রাজাবাহাদুর রাইফেলটা বাগিয়ে ধরে আর একহাতে মাঝে মাঝে আলো ফেলছেন নিচের পুঁটলিটায়। চকিত আলোয় যেটুকু মনে হচ্ছে— পুঁটলিটা যেন জীবন্ত, অথচ কি জিনিস তা বুঝতে পারছি না। এ-নাকি মাছের টোপ। কিন্তু কী এ মাছ—এ কিসের টোপ?
আবার সেই স্তব্ধতার প্রতীক্ষা। মুহূর্ত কাটছে, মিনিট কাটছে, ঘণ্টা করছে। রাজাবাহাদুরের টর্চের আলো বারে বারে পিছলে পড়ছে নিচের দিকে। দিগন্তপ্রসার হিংস্র অরণ্য ভাঙা ভাঙা জ্যোৎস্নায় দেখাচ্ছে তরঙ্গিত একটা সমুদ্রের মতো। নিচের নদীটা ঝকঝক করছে যেন একখানা খাপখোলা তলোয়ার।…ক্রমশ যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম, ক্রমশ যেন ঘুম এল আমার। তারপরই হঠাৎ কানের কাছে বিকট শব্দে রাইফেল সাড়া দিয়ে উঠল— চারশো ফুট নিচ থেকে ওপরের দিকে উৎক্ষিপ্ত হয়ে উঠল প্রচণ্ড বাঘের গর্জন। চেয়ারটা সুদ্ধ আমি কেঁপে উঠলাম।
টর্চের আলোটা সোজা পড়ছে নুড়ি ছড়ানো বালির ডাঙাটার ওপরে। পরিষ্কার দেখতে পেলাম ডোরা কাটা অতিকায় একটা বিশাল জানোয়ার সাদা পুঁটলিটার ওপরে একখানা থাবা চাপিয়ে দিয়ে পড়ে আছে, সাপের মতো ল্যাজ আছড়াচ্ছে অন্তিম আক্ষেপে। ওপর থেকে ইন্দ্রের বজ্রের মতো অব্যর্থ গুলি গিয়ে লেগেছে তার মাথায়। এত ওপর থেকে এমন দুর্নিবার মৃত্যু নামবে আশঙ্কা করতে পারেনি। রাজাবাহাদুর সোৎসাহে বললেন—ফতে!
…আমি রাজাবাহাদুরকে সোৎসাহে সোল্লাসে অভিনন্দিত করতে যাব, এমন সময়...এমন সময়...পরিষ্কার শুনতে পেলাম শিশুর গোঙানি। ক্ষীণ অথচ নির্ভুল।…আমি পাগলের মতো চিৎকার করে উঠলাম—রাজাবাহাদুর কিসের টোপ আপনার? কী দিয়ে আপনি মাছ ধরলেন?
চুপ—একটা কালো রাইফেলের নল আমার বুকে ঠেকালেন রাজাবাহাদুর।
কীপারের একটা বেওয়ারিশ ছেলে জঙ্গলে হারিয়ে গিয়ে থাকে, তা অস্বাভাবিক নয়, তাতে কারো ক্ষতি নেই।
…আট মাস পরে, এই চমৎকার চটিজোড়া উপহার এসেছে। আট মাস আগেকার সে রাত্রি এখন স্বপ্ন হয়ে যাওয়াই ভালো, কিন্তু এই চটিজোড়া অতিমনোরম বাস্তব পায়ে দিয়ে একবার হেঁটে দেখলাম, যেমন নরম, তেমনি আরাম। [টোপ/নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়/শতবর্ষের গল্প/ঐ]
নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় পাঁচ লাইনেই গল্পটা বলে দিতে পারতেন। তা তিনি করেননি। নাটকীয়ভাবে শুরু হয়েছে গল্প আবার শেষটাও নাটকীয়ভাবে সেরেছেন। মাঝখানে গল্পকার সেই আবহ নির্মাণ করেছেন, যাতে গোটা বিষয়টায় পাঠক ডুবে থাকে। এই গল্পের প্রতিটি পঙ্ক্তি বাস্তবকে ছুঁয়ে-ছেনে আমাদের দৈনন্দিন জীবনের রেখায় দাগ ফেলে গেছে। অভিজ্ঞতায় নেই কিন্তু এই গল্প আমাদের একটি অচেনা-অজানা জীবনের, কাহিনির ভেতরের রক্ত-মাংসের স্বাদ দিয়ে আমাদের নিয়ে এসেছে। আমরা কিছুতেই এই গল্পকে গল্প বলতে চাই না, পারি না। মনে হয় আমিই যেন রাজাবাহাদুরের সঙ্গে ছিলাম বাঘশিকারের ওই পরিবেশ-প্রতিবেশে। আমি যতটুকু বুঝতে পারছি, এলাকাটি তরাইয়ের। শালবন আর ঘন জঙ্গলের ভেতরে এমন বন্য পরিবেশ আর কোথাও নেই।
আর সব থেকে বিস্ময়কর হলো নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের তির্যক শ্লেষ। একই মানুষের কত রূপ। গল্পকার শিশুর টোপ দিয়ে বাঘশিকারকে কেবল অমানবিক হিসেবেই চিত্রিত করেননি, একধরনের ঘৃণাও উসকে দিয়েছেন রাজাবাহাদুরের ওপর, পাঠকের মনে, আবার সেই গল্পকারই রাজাবাহাদুরের দেয়া বাঘের চামড়ায় তৈরি চটিজোড়া পরে পরম আরাম পাচ্ছেন। এই দ্বিমাত্রিক চরিত্রের অধিকারী মানুষ, যেকোনো সাধারণ ও মানবিক মানুষ, যারা সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির সঙ্গে জড়িয়ে আছে—নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় সেই বহুমাত্রিক মানুষের স্বরূপই নির্মাণ করেছেন এই গল্পে।
কোর্টে যেদিন হাজির করা হয় রেহানাকে, সেদিন ছাত্রদের মিছিল সভা এবং ভিড়ে সমস্ত কোর্ট ভবন ও আশেপাশে জনাকীর্ণ ছিল। মুহুর্মুহু শ্লোগান উঠছিল। একটা অশান্ত ঢেউ যেন বারবার এগিয়ে এসে আছড়ে পড়ছে প্রচণ্ড আক্রোশে এই রকম মনে হয়েছিল তার। নামকরা উকিল বহু যুক্তিতেও তার জামিন নিতে পারেননি। তার স্বামী আসলাম, শহরের বিশিষ্ট শিল্পপতি, হাতে চাপ দিয়ে বলেছিল ডোন্ট বি নার্ভাস। আমি ওপরের কোর্টে যাবো আরো পাস করা উকিল আনবো। তোমার জামিন হবেই। বেকসুর খালাসও হবে তুমি। ডোন্ট বি আপসেট। তারপর মুখের কাছে মুখ এনে ঘৃণার সঙ্গে বলেছে, একটা রিকসাঅলা মরেছে, একটা ছাত্র অজ্ঞান হয়ে হাসপাতালে। সো হোয়াট? এই ওভার পপুলেটেড দেশে দুটো মানুষ গেলে কি আসে যায়? ওরা সমাজের জন্য কি দিয়েছে? ওদের চেয়ে তোমার জীবনের দাম অনেক বেশি। এই সামান্য কারণে তোমার শাস্তি হতে পারে না। এ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, হচ্ছে, হবে। রাস্তাঘাটে এতে মানুষ গিজ গিজ করলে এ্যাক্সিডেন্ট ছাড়া কি হবে? আসলাম রাগে প্রায় ফেটে পড়ে। রেহানার শরীর তখন ভয়ে শক্ত কাঠ। পুলিশ সামনে পিছনে দাঁড়িয়ে থেকে তাকে যখন ঘর থেকে বেরুতে বলে, তখন কান্নায় ভেঙে পড়লো সে। আসলাম সান্ত্বনা দিয়ে বললো, প্লিজ রেহানা, কন্ট্রোল ইউর সেল্ফ। বি টাফ। কিচ্ছু হবে না তোমার।
[সহবাস/হাসনাত আবদুল হাই/শতবর্ষের গল্প/ঐ]
হাসনাত আবদুল হাই নিরেট গদ্যকার? আমি যতটা জানি, তিনি কবিতাও লেখেন বা লিখতেন এবং এখনো সেই চর্চা আছে তাঁর। সহবাসের যে অংশটুকু উদ্ধৃত করেছি তা একটি কোর্টের দৃশ্য। কোর্ট হলেও গোটা পরিবেশের বর্ণনা নয়, দুটি চরিত্রের মধ্যে সম্পর্ক ও যে-কারণে তারা সেখানে নীত, সেটা পরিচ্ছন্ন বর্ণনায় উঠে এসেছে। এবং ওইটুকু বর্ণনায়ই চরিত্র দুটোর রাজনৈতিক ও সামাজিক স্ট্যাটাস স্পষ্ট হয়েছে। এবং তাদের মন-মানসিকতা, গরিব মানুষ সম্পর্কে শিল্পপতি ধনবানের ক্রুদ্ধ কিন্তু চাপা রাগ-এর ভেতরে শ্রেণিবিভক্ত সমাজের রূপটি আমরা দেখতে পাচ্ছি। গল্পের শুরু ও শেষ না পড়লেও এই টুকুই বলে দিচ্ছে আমাদের বাস্তব জীবনের হিংস্রতা, স্বার্থের রূপ। শিল্পপতি আসলামের রাগের কী কারণ থাকতে পারে? সে আসামির স্বামী এই সমাজের একজন হোমরা-চোমরা। তার ভাবখানা যেন তিনি বা তারা অর্থের জোরে বিচার কিনে নেবেন। কিংবা ন্যায়কে অন্যায় আর অপরাধীকে নিরপরাধ হিসেবে প্রমাণ করবেন। আবার একই সঙ্গে আইনের কাছে, বিচারপতির কাছে তিনি/তারা ইকুয়াল। গরিব ও ধনীর মধ্যে আইন বিভাজন টানে না। কিন্তু ধনবানের পক্ষে আইনের রক্ষক ও আইনের প্রয়োগকারীদের ব্যক্তিগত লোভ আমরা সব সময়ই দেখতে পাই। প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে হাসনাত আবদুল হাই এই গল্পে সেটাই কি তুলে আনেননি? গল্প যে শুধুই কাহিনি নয়, একটি প্রবহমান কাহিনির সরল বর্ণনা নয়, সেটা বোঝার মতো পাঠকের সংখ্যা নগণ্যই বলতে হবে দেশে ও সমাজে। শিক্ষিত/উচ্চ শিক্ষিত হলেও অধিকাংশেই প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যের পাঠক নন, এমনকি সারা জীবনে একখানা গল্প পাঠ করেছেন, এমনও লাখ লাখ প্রজ্ঞাবানের দেখা মিলবে এই সমাজে-সংসারে। কবিতা কদাচিৎ পড়ে থাকতে পারেন তারা, কিন্তু তার স্বাদ নেওয়া তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয়ে ওঠে না। এ রকমই আমাদের সাহিত্যের পাঠকশ্রেণির অভিজ্ঞান।
আমি বিমল করের আত্মজার কথা উল্লেখ করতে চাই। বাস্তব ও মনোবাস্তবের মিশেলে নির্মিত ওই গল্পটি আমাকে বেদনায় নীল করে ফেলেছিল। সন্দেহ কতটা অমানুষিক ও অমানবিক দোষ হতে পারে মানুষের সামাজিক জীবনে, তার নির্মম চিত্রই নির্মাণ করেছেন বিমল কর। কানকথা শোনা ও কানকথা বিশ্বাস করাও যে সুপারস্টিশন/কুসংস্কার, ব্যক্তি মানুষের মনের ভেতরকার কদর্যতা/অজ্ঞানতা/বা মূর্খতার ভেতর দিয়ে তা সমাজকে, ব্যক্তির মানবিক চেতনাকে কণ্টকিত করে ফেলতে পারে, সেই মনস্তত্ত্ব আমাদের বুঝতে হবে। জানতে হবে মানবিকতার উল্টো পিঠে বাস করে অমানবিক, নিষ্ঠুর চেতনা। আত্মজায় সেই পরিসরই আমরা দেখতে পাই।
হিমাংশু স্বামী, যূথিকা স্ত্রী। ওরা বছর পাঁচেকের ছোট-বড়। দেখলে মনে হবে ব্যবধান পাঁচের নয়, আট কিংবা দশের। মেয়ে পাশে থাকলে এ-হিসেবটাও গোলমাল হওয়া বিচিত্র নয়।…আচমকা মাটি থেকে পা উঠে যেতেই পুতুল ভয়ে হিমাংশুকে জড়িয়ে ধরে—তার হাত হিমাংশুর মাথার চুলে ঘাড়ে টলে পড়ে। ক্রিমসন রঙের ল্যুজ ফ্রকের আড়ালে হিমাংশুর নাক, চোখ, মুখ সব ঢাকা পড়ে গেছে শুধু অট্টহাসির অনেকখানি শব্দ ঘরের বাতাসে।…এমনভাবে বলল, জিনিসটা মোটেই ভালো নয়, যূথি। এ সব আশকারা তুই দিবিনে। এ একধরনের কমপ্লেক্স!
যূথিকা শেষ কথাটা বুঝল না। শিপ্রাদির চোখের দিকে তাকাল।
মানে?
মানে—? ও, সে তুই বুঝবি না!
শিপ্রা যূথিকার অজ্ঞতাকে উপেক্ষা জানিয়ে অনুকম্পার হাসি টেনে আনল ঠোঁটে, আসলে যূথি এই...এই...ধরনের রুচি—কি বলে যেন একে—হ্যাঁ এই ধরনের রুচি খুব খারাপ, নোংরা।
যূথিকা কয়েক মুহূর্ত ফ্যাকাশে, অর্থহীন চোখে তাকিয়ে থাকে শিপ্রাদির মুখের দিকে।
…বিকৃত মুখভঙ্গি করে ব্রাকেটের ওপর থেকে ক্ষুরটা তুলে নেয়। রক্তের স্বাদ আছে, কিন্তু গন্ধ আছে না কি? নেই? কিন্তু ভ্যাপসা পচা ঘার মতন গন্ধ আসছে কোথা থেকে। পঙ্কিল রক্তের, কলুষ নিঃশ্বাসেরও হতে পারে। হতে পারে ওই পশুটার।
মণিবন্ধের একটি শিরায় ক্ষুরটা জোর করে চেপে ধরল হিমাংশু তারপর ছোট্ট একটা টান। ছত্রিশ বছরের অমিত তাপে তপ্ত একটি যৌবনের উষ্ণ শোণিত ফিনকি দিয়ে ছুটে এল। আহঃ কি টনটনে আরাম! কি শান্তি! যেন হু হু করে জ্বর ছেড়ে যাচ্ছে।
[আত্মজা/ বিমল কর/শতবর্ষের গল্প/ঐ]
বাস্তব আর মনোবাস্তবের মধ্যে ইন্টারেকটিভ চেতনা কাজ করে, তাকে লালন-পালন আর সমৃদ্ধ করে তোলে ধীরে-সুস্থে সমাজকাঠামোর সাংস্কৃতিক প্রবাহ। আমরা বাস্তব—যাকে সাধারণভাবে সামাজিক পরিবেশ-প্রতিবেশের উপকরণ-উপাদানে গঠিত জীবনবাস্তব বলি, সেখানই বসবাস করি। আর মনোবাস্তব হচ্ছে ব্যক্তির নিজস্ব কল্পনাজাত বাস্তব, যা সমাজ-সংসারের উপাত্ত থেকেই জাত, সিদ্ধান্ত বা নির্লিপ্ত থাকা, প্রতিক্রিয়াহীন থাকার পেছনেও ক্রিয়াশীল মানুষের ওই চেতনাধারা। বাস্তব আর পরাবাস্তবের মিলনেও সৃষ্টি হয় নতুন ও ভিন্নতর বাস্তব, যা ব্যক্তির নিজস্ব। গল্প-উপন্যাসে লেখকগণ সে সবই ব্যবহার করেন। এ-কারণেই কোনো গল্পই অন্য গল্পকারের সঙ্গে মেলে না, ভিন্ন কাহিনির রূপায়ণ হয়। সে-কারণেই এক গল্পকারের বর্ণনার সঙ্গে অন্যজনের ভিন্নতা আমরা লক্ষ করি। যেটা যেমন চৈতন্য চিত্রণে, তেমনি ভাষিক ভিন্ন প্যাটার্নেও। উদ্ধৃত গল্পকারগণ ও তাদের গল্পের ভাষা ব্যবহার ও চরিত্রের ভিন্নতা তার প্রমাণ দিচ্ছে এবং দেবে।
এই নির্জলা বৃষ্টিধারার সঙ্গে পাশের ঘরের তারাবিবির বিলাপ, কিছুক্ষণের জন্য রমজান আলীর ধমক ও তারাবিবির গোঙানি একাকার হয়ে রূপ লাভ করতো একটি অখণ্ড বস্তুতে এবং তার ধাক্কায় গোলজারের শরীরের নিচেকার খাট, তার চারপাশের দেওয়াল, শরীরের ওপরকার মশারি ও ছাদ কোথাও সরে গিয়ে গোলজারকে একেবারে নিরাশ্রয় করে দিতো। গোলজারের রক্ত ও মেদ শুকিয়ে তার শরীরটা পড়ে থাকতো একটা ছায়ার মতো। তার ছায়া-শরীরের চারপাশে কোনো বস্তু নেই, কেবল ছায়া। ওপরে মশারি, মশারির ওপর ছাদের ছায়া, পাশে দেওয়াল ও শূন্যতার ছায়া, রাত্রিকাল ও অন্ধকারের ছায়া।…আবার কোনো কোনো রাত্রে তারাবিবির বিছুটি পাতার মতো খসখসে কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙে গেছে, অনেকক্ষণ জেগে থেকে সে বুঝতে পারে, তারাবিবি রমজান আলীকে জাগাবার চেষ্টা করছে...অ-গোলজারের বাপ! এক্কেরে লাশটা হইয়া রইছো না? আরে বুইরা মরদ, খাটিয়ার লাশটাভি লড়েচড়ে, তোমার লড়ন নাই। বিছানা জুইড়া ভ্যাটকাইয়া রইছো অ গোলজারের বাপ!
…হাতপাখাটা নিয়ে বউকে পেটাতে শুরু করবে—খানকি মাগী, তর মরদানি দেখনের খাউজানি উঠছে না? র! তরে মরদ দ্যাখাই। তর হাউস মিটাইয়া দেই, আয়।
…তারাবিবি রমজান আলীর দ্বিতীয় স্ত্রী, আগে কি ধরনের শালী হতো। আগের পক্ষের মেয়েরা তারাবিবিকে এখনো খালা বলে ডাকে।...অমামু, তাদের তিনজনই গোলজারের বড়ো, দুজনের জন্ম তারাবিবির বিয়ের আগে, মামুজান, নানায় হালায়, এই বিয়া যহন করছে তখনই তো ষাইট বছইরা বুইড়া। পঁচিশ বছরের ছেমড়িটারে লইয়া বুইড়ার বহুত মুসিবত না মামু? বহুৎ মেহনত হয়, না? এই বিয়াটা না করলে রমজানের এই রাত্রিবেলার ভোগান্তিটা হতো না। অনেক রাত্রে তারাবিবি যখন তার মাঝখান দিয়ে চেরা গলায় একাই কোরাস স্বরে চিৎকার করতো, আরে বুইড়া মরাটা! এক্কেরে কব্বরের মইদ্যে ঢুকছে। আরে, খাড়াও, জানাজাডা পইড়া লই, জানাজা না লইয়া কব্বরে যাইবা, আজাব অইবো না! গোলজারের কলজেটা তখন ছিটকে পড়তো চারদিকে, বাপে হালায় বুইড়া হইয়া বিয়াটা না করলে তো জিন্দেগীতে দুনিয়ার মইদ্যে পয়দাই হইতাম না।
এই উদ্ধৃতি পুরোনো ঢাকার খিস্তিখেউর-অধ্যুষিত ডায়লেক্ট তারাবিবির চরিত্রটিকেই কেবল নয়, গোটা এলাকার সামাজিক জীবনই বাঙ্ময় হয়ে উঠেছে। কথা বলার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ডায়লেক্ট পুরান ঢাকার নগরজীবনের একটি নতুন অভিজ্ঞতা না বলে, আদি ঢাকাইয়া বা উর্দু-ফারসি-বাংলার সংমিশ্রণে যে ডায়লেক্ট আমরা পেয়েছি, তার সামাজিক ও রাজনৈতিক রূপও আমাদের জানতে/বুঝতে হবে। কারণ ওই এলাকার সামাজিকতা ও তার সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য ওই নগরজীবনকেই বিশিষ্ট করেনি, নতুন পরিবেশের দুয়ারও উন্মোচন করেছে। আধুনিক নগর ও তার সামাজিক ও রাজনৈতিক ডায়লেক্ট আজ কথ্যরূপের মধ্যেও প্রমিত সার্কেল/ঘের সৃষ্টি করেছে। এই প্রমিত বাংলায় যারা কথা বলেন না, আমরা ধরে নিই তারা মহানগরের জন্য উপযুক্ত (কালচারড) হয়ে ওঠেনি। তারা লোক বাংলার সংস্কৃতিতে রয়ে গেছে। এবং তারা একটি মিশ্রভাষিক ডায়লেক্ট সৃষ্টিতে কাজ করছে। ঠিক একইভাবে ওই ঢাকাইয়া ডায়লেক্ট না জানা, না বলতে পারা এ-যুগের আধুনিক নাগরিকেরাও যে মোগলীয় ঐতিহ্যে স্নাত পুরাতন ঢাকার বাসিন্দাদের কাছে, তাদের কালচারাল বিহেভিয়ারের পাঙ্ক্তেয়-জন হয়ে ওঠেনি, সেটাও বুঝতে হবে আমাদের। খুবই ছোটো তাদের ডায়লেক্ট এলাকা, তবে তা বিশিষ্ট, মানতেই হবে। ভাষাবিজ্ঞানীরা এবং কালচারাল নৃবিজ্ঞানীরা এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিতে পারবেন। আমরা আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের গল্পের ভেতর দিয়ে জানতে ও বুঝতে পারি, মানুষ কতটা সন্দেহপ্রবণ হলে, মায়ের পক্ষেও ছেলে সম্পর্কে/বিরুদ্ধে বানিয়ে কিছু বলা জলবৎ তরলং হতে পারে। তারা বিবি তারই একটি নমুনা বা নিদর্শন। তারাবিবি ছেলে গোলজার সম্পর্কে যে বদনাম বর্ণনা করে, তা সে বিশ্বাস করে কি করে না, তারও চেয়ে বড় সত্য হচ্ছে এটা তার নিত্যদিনের অভ্যাস। এই অভ্যাস মানবজীবনের মতোই সহজ সরল ও আনন্দ বিনোদনেরও অংশ তার। কারণ তাদের আনন্দ বিনোদনের জন্য এর বাইরে তেমন কিছু নেই বলতে গেলে। তারা বিবির মরদ পোলা গোলজার, তার মায়ের এই অভ্যাসের কথা জানে। তাই সে তেমন কিছু মনে করে না। নগরজীবনের বাইরে থেকে আসা গোলজারের স্ত্রী তা জানে না/জানত না বলেই সে গ্রামীণ মহিলাদের মতো একটুতেই কান্নাকাটি করে। ওই পর্যন্তই। সেই সন্দেহ তাকে সেপারেট জীবনের ইঙ্গিত দেয় বটে, কিন্তু তা আত্মধ্বংসী করে ফেলে না।
সন্দেহ করার কারণে, নোংরা চিন্তার অপরাধবোধে হিমাংশুকে জড়িয়েছে যূথিকা, সামান্য ইঙ্গিতেই হিমাংশু আত্মধ্বংসী পথ বেছে নিয়েছে। দুটো গল্পই সন্দেহ করার পরিপ্রেক্ষিতের হলেও, হিমাংশুর আত্মমর্যাদাবোধ তাকে আত্মহত্যায় টেনে নিয়ে গেছে। কিন্তু গোলজারকে সেই রকম প্রকাশ্য সন্দেহ প্রকাশের পরও সে তার মাকে দোষারোপ না করে কেবল জিজ্ঞাসা করেছে। পারিবারিক জটিলতায় পড়েছে গোলজার, মায়ের এই সন্দেহপ্রবণতার মিথ্যাকথনের সূত্রে, তাতে মানবজীবনেরই আরেকটি পথ সৃষ্টি হয়। কিন্তু নগরের বাসিন্দা, দুই মেরুতে বসবাসকারী দুটি মানুষের ভেতরকার বিষয় উন্মোচিত হয়েছে দুইভাবে, দুটি গল্পে। আলো/অন্ধকার মানবজীবনেরই এমন এক আচ্ছন্ন এলাকা, যার তল পাওয়া কঠিন। এই এলাকা নিয়ে কাজ করাই মূলত লেখকদের রাজনৈতিক চেতনার যাত্রাপথ। যারা অন্তরের তাপ অনুভব করেন, তারা সেই পথেই যান, আমরা দেখেছি।
৪
এই অংশে দেখাতে চাই গল্পকারের কাব্যচেতনা বা তাদের অনুভবমালার বর্ণনায় সাদৃশ্যমূলক শব্দের ব্যবহার। আমরা জানি বা মানি ‘মতো’ শব্দটি কবিরা ব্যবহার করেন অধিক মাত্রায়। মনে হয় মতো ছাড়া কবিতা যেন লেখাই সম্ভব নয়। কারণ, কবিতায় মতো হচ্ছে সাদৃশ্যমূলক চিত্রের একটি অমোঘ ব্যবহার। কিন্তু সেই মতোই যখন গল্পের গদ্যে ব্যবহৃত হয়, তখন আমরা তাকে কী বলব? রবীন্দ্রনাথের গদ্য থেকে দেখা যাক মতোর ব্যবহার।
আমরা পাড়াগাঁয়ের ছেলে কলিকাতার ইঁচরে পাকা ছেলের মতো সকল জিনিসকেই পরিহাস করিতে শিখি নাই।
[একরাত্রি/রবীন্দ্রনাথ/শতবর্ষের গল্প, দ্বিতীয় খণ্ড পৃ. ৩৬৭/ঐ]
মনটা সহসা একটা বৃহত বোঝার মতো হইয়া বুকের শিরা ধরিয়া ঝুলিতে লাগিল। [একরাত্রি, পৃ. ৩৬৯]
তোমার মতো লোক সুরবালার স্বামীটি হইয়া বুড়া বয়স পর্যন্ত বেশ সুখে থাকিতে পারিতে। [একরাত্রি, পৃ. ৩৬৯]
সকালে বারান্দায় বসে চা খাচ্ছিলেন, বিশ বছরের মেয়েটি ঘাগরা দুলিয়ে অসংকোচে তাঁর কাছে এসে উপস্থিত—জ্বলজ্বলে তার চোখ...ঠোঁটে একটা হাসি আছে, যেন শান-দেওয়া ছুরির মতো।
খুকুর মতো বসে বসে দুধ খাচ্ছিস ঢক ঢক। [ল্যাবরেটরি/পৃ. ৩৫১ ও ৩৬১]
বৃষ্টিতে ধোয়া আকাশের মতো হাসি। [সড়ক/ ঋত্বিক কুমার ঘটক/ পৃ. ৯৯]
সে রাস্তার ওপারে তার গন্তব্যে যাবার পথটার দিকে তাকাল। একটা অন্ধকার সুড়ঙ্গের মতো দেখাচ্ছে। [অন্ধকার থেকে অন্ধকার/মতি নন্দী/পৃ. ২৮৭/ঐ] ।
পরে অভিশাপের মতো করে বলেছিলো, ভালোবাসা বিনে বাইচ্যা থাকার কুনো স্বাদ নাই আয়াত ভাই্।
আসলে বেঁচে থাকার জন্য সব মানুষকেই জাল নিয়ে ঘুরতে হয় সুযোগ মতো খ্যাপ মারতে না পারলে বাঁচার উৎসাহ অনেক থিতিয়ে আসে। [খোল করতাল/ সেলিনা হোসেন/ পৃ. ৪৮৬ /ঐ]
সুশান্ত ভাবলো, তার মতো সাহসী পুরুষকেও রাতের ভ্রম আক্রমণ করছে। [সুন্দর লাশ/ নাসরিন জাহান/পৃ. ১৯৬/ ঐ]
পরে নেশার মতো পেয়ে বসেছিলো চিন্তাটা। [মোমের ইলিশ/রাবেয়া খাতুন/পৃ. ৩৮৩/ঐ]
তার লজ্জাও অবশ্য আজকের আবছা সন্ধ্যার মতো অস্পষ্ট। [ইলিশ পুরান/ মাহবুব সাদিক/ পৃ. ৩১২/ ঐ]
…আবার কোনো কোনো রাত্রে তারাবিবির বিছুটি পাতার মতো খসখসে কণ্ঠস্বরে তার ঘুম ভেঙে গেছে, অনেকক্ষণ জেগে থেকে সে বুঝতে পারে, তারাবিবি রমজান আলীকে জাগাবার চেষ্টা করছে। [তারাবিবির মরদপোলা/ আখতারুজ্জামান ইলিয়াস]
যে কটি উদ্ধৃতি দিয়েছি ‘মতো’ নিয়ে, তাতে করে ওই শব্দের সাদৃশ্য নানা বৈচিত্র্যে উপস্থিত হয়েছে। কবি বা গল্পকার, যিনিই লিখুন না কেন, ভাষায় ওই সাদৃশ্যবাচক শব্দটি না থাকলে লেখকের পক্ষে পাঠককে চেনানো কঠিন হতো কি বলতে চাইছেন লেখক। তুলনা দেবার লক্ষ্যই হচ্ছে বর্ণিত বিষয়কে আরও স্বচ্ছ করে তোলা। আবার এমন কিছু বাক্য এখানে উদ্ধৃত হয়েছে, যার কোনো বস্তুরূপ নেই, আকার নেই, কিন্তু পাঠক ঠিকই চেনেন।
এর পরের অংশে গদ্যের অন্যান্য উপাদান নিয়ে কথা বলতে চাই।