
ওয়াগনারের অভিব্যক্তিবাদী সংগীত নিয়ে আলাপ
২০০৫ সালের কথা, টোকিও শহরের বুঙ্কিয়-কুতে বাস করি। সেখানে আমার এক সুহৃদ হোশি সান, মিউজিকে পড়াশোনা করতে এসেছে হিরোশিমা থেকে। টোকিও ইউনিভার্সিটির ছাত্র হলেও, তার গুরুর কাছেই মূলত তালিম নিয়ে থাকে সুজুমির [একপ্রকার ছোট ড্রাম] ওপর। আমরা দোতলা একটি অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। ওপরে কোজি নামে আরেকজন থাকে, সে সামিসেন বাজায়। আর নিচতলায় আমার একলা সংসার। মাঝেমধ্যে হোশি আর আমি ঘুরতে বের হই। একদিন এক জাপানিজ রামেন রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলাম মধ্যাহ্নভোজ্যের উদ্দেশে। সে হঠাৎ প্রশ্ন করে বসল, ‘তোমাদের দেশের মানুষ এত রঙিন পোশাক পরে কেন?’
আমি তাকে উত্তর না দিয়ে ফিরতি প্রশ্ন করলাম, ‘এত রং থাকতে তোমরা শুধু শাদাকালো পরো কেন?’
উত্তরে সে বলল, ‘এতে পূর্ণতা রয়েছে, শুভ্রতা রয়েছে, তা ছাড়া…।’
—ব্যস, বলে আমি তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, এই যে বললে এতে পূর্ণতা রয়েছে, এখানে আমাদের মানুষদের রাঙা পোশাক পরবার উত্তর রয়ে গেছে। অর্থাৎ এদের জীবন রঙিন নয় বলে তারা রঙিন পোশাক পরে বিবর্ণতা ঢাকে। একথা শুনে সে একটু বিব্রত হলো।
আমি বললাম, ‘তুমি কী ধরনের মিউজিক পছন্দ করো? ফোক না মডার্ন?
সে এককথায় উত্তর দিল, ক্লাসিক্যাল।
—তার মানে, ক্লাসিক্যাল পিরিয়ড বলতে চাইছ?
—সে বলল, একজাক্টলি তা নয়, রোমান্টিক-মডার্ন টাইমের কম্পোজারদের মিউজিকই আমার প্রিয়।
—ও আচ্ছা। তাহলে ওয়াগনারকে চেনা আছে নিশ্চয়?
—হ্যাঁ, তাঁর মিউজিক্যাল ড্রামা আমার ভালো লাগে।
—আমি বললাম, কেন ভালো লাগে? তাঁর মিউজিকে তো অনেক রং, অনেক ভেরিয়েশন। এই রুচি কি তোমার পোশাকের সাথে মেলে?
—হোসি সান একটু হাসি দিয়ে বলল, তাঁর মিউজিকে প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে আসার একটা চেষ্টা আছে, প্রতিটি চরিত্রকে যেন আলাদাভাবে ধরতে চায়। একটি সুরের ভেতর আরও অনেক সুর এসে খেলা করে। একটি মঞ্চের সামনে আমরা যে অনেক চরিত্রকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি, তারা যে প্রত্যেকে আলাদা, অথবা আমরা একটা বিষয় নিয়ে কথা বলছি, কিন্তু ভাবছি বা প্রশ্ন করছি আলাদা। ওয়াগনার এই রকম প্রত্যেক চরিত্রকে আলাদা করে চিনিয়ে দেয় একসাথে।
—আমি বললাম, এটাই হয়তো রোমান্টিক যুগের প্রবণতা, যেখানে প্রত্যেক ব্যক্তি স্বাধীন হতে চায়। যদিও সে সমাজের নানা বাধা-বিপত্তির মধ্যে কোনো রকম টিকে আছে। সে ওই বাধা অতিক্রম করতে চায়, তাঁর ভেতরের দ্রোহ আর চেপে রাখতে চায় না। তোমরা যখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অতিক্রম করছ, তখন তোমার শহরের কী অবস্থা হয়েছিল, তা তো তোমার বাবা-মায়ের কাছে শুনেছ। সেখান থেকে তোমাদের বেরিয়ে আসতে চেষ্টা তো ছিল নাকি?
—ঠিকই ধরেছ। সে সময় ছিল আমাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন। তারা সেসব কথা বলতে গেলে গুমরে কেঁদে ওঠে এখনো।
—আমি তোমাদের ওখানে [হিরোশিমা] যেতে চাই একবার হলেও। তবে কয়েক দিন আগে বুঙ্কিয়-কু-এর সিটি সেন্টারে একটি একজিবিশন দেখলাম। কিছু পেইন্টিংসে সে সময়ের মুমূর্ষু দৃশ্য উঠে এসেছে, তা দেখে আমার ভেতরটাও বিষণ্ণ হলো। এটাকে আমরা এক্সপ্রেশনিজম বলতে পারি কি না?
—তা বলতে পারো।
—তাহলে তোমরা এখন কি বিবর্ণতা কাটিয়ে তুলতে পেরেছ?
—হয়তোবা পেরেছি, হয়তোবা না।
—কখনোই পারবে না। হয়তো তোমরা প্রযুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞান দিয়ে জীবনকে অনেক সহজ বানিয়ে তুলেছ। তোমরা তোমাদের আনন্দ করার ইচ্ছাকে হাতের মুঠোয় এনেছ। তা দিয়েই কি প্রমাণ করে যে, তোমাদের ভেতরে এখন আর কোনো দ্রোহ নেই? বিষাদ নেই? তোমরা সারা দিন যে কঠিন শ্রম দিয়ে যাচ্ছ, এর জন্য তুমি কতটুকু সুখ ঘরে তুলে আনতে পেরেছ? এমনকি সাদা পোশাক পরেও তুমি কতটুকু জীবনকে অনুভব করতে পারছ? আমি মনে করি, ওয়াগনার সেই প্রশ্নকেই মঞ্চে তুলে আনতে চেয়েছে।
—তা ঠিক, তবে তুমি জীবন সম্পর্কে একটু জটিল করেই ভাবছ না কি? শোনো, জীবনে টানাপোড়েন তো থাকবেই, কোন জাতির জীবনে এসব ঘটনা নেই? কিন্তু তা কীভাবে মোকাবিলা করবে, তার ওপর নির্ভর করছে তোমার বোধ। ওয়াগনারের মিউজিকে সেই বিপ্লবেরই ইঙ্গিত রয়েছে ‘পূর্ণতার শিল্প’ এই ভাবনার মধ্য দিয়ে। যে শিল্পে কবিসত্তা, দৃশ্যায়ন, সংগীত, নাটক—সবকিছুরই গুরুত্ব থাকবে প্রায় সমানভাবে। যাকে Gesamtkunstwerk বা total work of art বলাটাই ঠিক হবে। আমাদের পরিশ্রমী মানুষেরা বিজ্ঞান ও ইন্ডাস্ট্রিকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে।
—তোমাদের বাবা-মায়ের সামনেও একই প্রশ্ন করো? যারা তাঁদের জীবনের আনন্দ বিসর্জন দিয়ে তোমাদের এই জীবনকে শুভ্রতায় ভরে তুলেছে?
—কেন, তোমাদের বাবা-মা কি-ও তা করেনি?
—করতে চেয়েছে নিশ্চয়, কিন্তু হয়তো পেরে ওঠেনি।
—কেন?
—পেরে ওঠেনি কারণ দারিদ্র্য ও আধিপত্যবাদ আমাদের তা হতে দেয়নি। ওয়াগনারের অসহায়ত্ত্ব সেখানে এসে দাঁড়িয়ে থাকে। তাঁর সংগীত সেকথাই বলে কখনো চিৎকার, কখন ঘৃণা, কখনো শোক, কখনো দ্বিধা। ফলে অনেক রং এসে ধরা দেয়। আমাদের জীবন ঠিক সে রকম। বৈচিত্র্যময়। সেখানে ঝড় হয়, বৃষ্টি হয়, আবার রোদ ওঠে। এখানেই আমাদের সাথে তোমাদের এ সময়ের পার্থক্য।
ওয়াগনারের মিউজিকে সেই বিপ্লবেরই ইঙ্গিত রয়েছে ‘পূর্ণতার শিল্প’ এই ভাবনার মধ্য দিয়ে। যে শিল্পে কবিসত্তা, দৃশ্যায়ন, সংগীত, নাটক—সবকিছুরই গুরুত্ব থাকবে প্রায় সমানভাবে। যাকে Gesamtkunstwerk বা total work of art বলাটাই ঠিক হবে। আমাদের পরিশ্রমী মানুষেরা বিজ্ঞান ও ইন্ডাস্ট্রিকে সেই পর্যায়ে নিয়ে গেছে
—হাই [বাহ্], দারুণ বলেছ। কিন্তু ওয়াগনারের সুরে তুমি যেমন বোধের বিচিত্রতা দেখছ, আমি সেখানে সমন্বয় দেখতে পাচ্ছি। বিচিত্রতা না থাকলে সমন্বয় দেখবে কীভাবে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের পূর্ণতা পেতে হবে। আমাদের বিজ্ঞানীরা মানুষের যেখানে সমস্যা, যেখানে দুর্গম, যেখানে একাকিত্ব, যেখানে ক্লান্তি-অবসাদ, সেখানেই তারা ঝাঁপিয়ে পড়েছে মানবিক প্রশ্নে। তুমি ওয়াগনারের শিল্পভাবনাতে সেই মানবতাই খুঁজে পাবে।
—এ ব্যাপারে আমি বলতে চাই, জীবনকে ভালো না বাসলে মানবতা কাজ করে না, এটা নিশ্চয়ই মানো? তুমি তোমাকে অনেক ভালোবাসো, একথা কি বিশ্বাস করো?
—তা করি!
—না, এই ভালবাসার মধ্যে স্বার্থও থাকতে পারে। তুমি তোমার গার্লফ্রেন্ডকেও ভালোবাসো। কিন্তু সে যদি তোমাকে আঘাত দেয় তখন তুমি ভেঙে পড়ো। কিন্তু ওর এই আচরণের জন্য তুমিই দায়ী হতে পারো, এই দিকটি কি ভেবে দেখেছ? যদি না ভাবতে পারো, তাহলে তোমার নিজেকেই কতটুকু ভালোবাসো?
—উত্তর জানা নেই। তবে তুমি কীই-বা করতে পারো, যদি সে তোমার থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়? তোমার হয়তো কিছুই করার থাকবে না।
—আমার মনে হয় তুমি আরও মানবিক হতে পারতে, কখনো কখনো হয়তো সেখান থেকে সরে পড়তে। যা তোমার অজান্তে ঘটে গেছে, বুঝতে পারোনি। এক্সপ্রেশনিজম সেই জায়গাটি রিপেয়ার করতে চায়। ওয়াগনারের সুরে সেই মানবতা প্রতিষ্ঠিত হতে চেয়েছে, বলেই বিষাদ কিংবা হতাশার মধ্যে তাঁর সুর শেষ পর্যন্ত আটকে থাকতে চায় না। ফিরে আসতে চায় পুনরায় জীবনের কাছে। রোমান্টিক পিরিয়ডের সুরকারদের এই প্রবণতাই তো তাঁদের সুরকে বর্ণিল করেছে।
—কিন্তু তাঁর মিউজিককে অনেক সমালোচক অতিরঞ্জিত বলতে চায়, এমনকি অতীন্দ্রিয় বা কাল্পনিক ভাবনায় আচ্ছাদিত। যা বাস্তববাদীরা সমর্থন করে না। করবেই বা কেন? আমাদের বাস্তবতায় যা নেই, অথবা যে তোমাকে আঘাত করতে চায়, যে তোমাকে ভালোবাসে না, তাঁর জন্য তোমাকে এত শোকাভিভূত হতে হবে কেন? জীবনকে একটি আবেগের ভেতরেই আটকে রাখতে হবে কেন, সে তো আরও অন্যকে ভালোবাসতে পারে। আরও কত ফুল ফুটে আছে, সেসবের গন্ধ নিতে পারে।
—পারে, কিন্তু সেখানে মানবতা থাকে কি? এই তুমি যাকে ভালোবাসো, সেই তুমি আবার অন্যকে ভালোবাসছ? তাহলে তুমি আসলে কি ভালোবাসছ? এখানে তোমার মূল্যবোধ কোথায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে? আমাদের দেশের মানুষেরা সে জীবনের মূল্যবোধকে ধরতে চায়। ফলে মানুষকে সবার আগে গুরুত্ব দিতে চায়। যেখানে কান্না আছে, মেঘের মতো বিষাদ আছে, ঝড়ের মতো তুফান আছে, তারপরও সে গান গায়। কারণ, সে জানতে চায় তার জীবনকে। জীবনের উত্থান আছে, পতন আছে, সুখ আছে, দুঃখ আছে, তা সত্ত্বেও জীবনকে রঙিন করে তোলার ভেতরেই রয়েছে জীবনের সার্থকতা। জীবনের মানে এখানে শুধু সুখের জন্য ধাবিত হওয়া মুখ্য নয়। জীবনের মানে তার ব্যক্তি আদর্শের ভেতর দিয়ে একটি বোধের স্তরে পৌঁছোনো। ওয়াগনারের সুরে সেই বোধের নিনাদও খানিকটা ধরা পড়ে।
—ভালো, এটা একটা দার্শনিক দিক হতে পারে।
—দার্শনিক দিক হলেও তা শুধু দার্শনিকদের ভাবনার মধ্যে আটকে থাকেনি, তাকে শিল্পশৈলী দিয়ে পরশ করতে জানতে হবে। ওয়াগনার তাঁর সংগীতে সেই দিকটি দেখিয়েছেন, ‘Complex textures’, ‘Rich Harmonies’ and ‘Orchestration’, and the ‘Elaborate use of leitmotifs’–এই সব দিক দার্শনিকতাকে শিল্পভাষায় রূপান্তর করে। শিল্পভাষার এই প্রবণতাগুলো হয়তো সরাসরি তোমার আমার সংগীতে কাজে আসবে না। কিন্তু সেই অভিজ্ঞতাকেও এড়িয়ে যাবে না।
—এই দার্শনিকতাই মূলত আধুনিকতা। অর্থাৎ আমাদের বর্তমান প্রযুক্তি কিংবা ইন্ডাস্ট্রিয়ালাইজেশনের যুগে হারমনি কিংবা অর্কেস্ট্রার ব্যবহার পালতে যাচ্ছে। সিনেমার চরিত্রগুলোতে লেইটমোটিফ ঢুকে পড়ছে। অর্থাৎ কিনা ওয়াগনারের মতো সুবিস্তৃত মিউজিক আমরা করছি না ঠিকই, কিন্তু তাঁর শিল্পসূত্রকে এড়িয়ে যেতে পারছি না। যাই হোক রামেন তো একটি চায়নিজ খাবার, এটা তোমরা বেশ পছন্দ করো দেখছি।
—হ্যাঁ, এটা অতীতে ইন্ডিয়ান খাবারই ছিল। যাকে তোমরা নুডলস বলো। খাদ্য তো একপ্রকার শিল্পই নাকি। যার স্বাদ প্রত্যেকের আলাদা। এক জাতি আরেক জাতির খাবারের স্বাদ সহজেই নিতে পারে না। তবে যারা পারে, তারা অনেক এগিয়ে থাকে। আধুনিকতা এখানেও লুকিয়ে আছে।
আমরা এবার রামেন-এ মনোযোগ দিলাম।
দারুন আলোচনা উপভোগ করলাম।
হাফিজা হাকিম রুমা
আগস্ট ০৭, ২০২২ ১৯:১৪