শ্রীকৃষ্ণকীর্তন: নতুন সাহিত্যিক ভাষার জন্ম
বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগ [১২০০-১৮০০]-এর পয়লা দিকে রচিত সাহিত্যের অন্যতম নিদর্শন হিসেবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন বিবেচিত হয়ে আসছে। পদ্মপুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ, হরিবিংশ, ভাগবত ও ব্রহ্মবর্তপূরাণে বর্ণিত শ্রীকৃষ্ণের জন্মকাহিনী এবং বাল্যলীলার উপরে নির্ভর করে গড়ে ওঠা পৌরাণিক কাহিনীর সাথে এই আখ্যানকাব্যে কবি মিলিয়েছেন বাংলার লোকজ ভাণ্ডারের শ্রীরাধার গল্প। কাব্যটিতে গীতসংলাপের বৈশিষ্ট্য থাকাতে মনে হয়, সম্ভবত এটি পালাগান হিসেবেই রচিত হয়েছিল। প্রামাণিক দলিল-দস্তাবেজের অভাবে এই আখ্যানগীতিকাটির রচনাকাল সঠিকভাবে নির্ণয় করে উঠতে পারাটা এখন পর্যন্তও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় মনে করেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পুঁথির লিপিকাল হবে ১৪৫০ থেকে ১৫০০ সালের মধ্যে। সুকুমার সেনও এমনটিই ধারণা করেছেন। ভক্তিবাদের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গীর দিক থেকে অন্তত এটুকু বলা যায়, এই আখ্যানগীতিকাটি বৈষ্ণবকাব্য থেকে পৃথক এবং তাই সহজেই অনুমান করে নেয়া যায়, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাব-পূর্ববর্তী সময়ে অর্থাৎ ১৪৮৬ সালের আগেই কোনও এক সময়ে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করা হয়েছিল। আমরা জানি, শ্রীচৈতন্যদেবের আবির্ভাবের পরে বাংলাকাব্যে বৈষ্ণব মতবাদের প্রচারসর্বস্বতাই প্রধান হয়ে ওঠে। কৃষ্ণলীলার উপরে ভিত্তি করে রচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ আমরা কিন্তু বৈষ্ণব মতবাদের কোনও ছায়া দেখি না। আহমদ শরীফ এমনটাই বলছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ যুক্তি দিয়েছেন, হয়তোবা পনেরো শতকের প্রথমার্ধের কোনও সময়েই রচিত হয়েছিল এই আখ্যানগীতিকাটি। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পুঁথির লিপিকাল নিয়ে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, এই আখ্যানগীতিকাটির সাহিত্যিক ভাষার চেহারার বিষয়ে বলা যেতে পারে যে অপভ্রংশ ও অবহট্ট সাহিত্যের ধারায় এটিতেও চর্যাপদাবলীর মতোই প্রাচীন কোনও বাংলাভাষা ব্যবহার করা হয়েছে। বর্তমান প্রবন্ধে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ প্রযুক্ত প্রাচীন বাংলাভাষার স্বরূপ সম্পর্কে আলোচনা করব। বিতর্কে না-ঢুকে, আলোচনার সুবিধার্থে, আমরা ধরে নিচ্ছি যে বড়ু চণ্ডীদাসই এই আখ্যানভাগের আদি ও মূল কবি।
শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন, বাংলাভাষার প্রাচীনত্বের দিক থেকে চর্যাপদাবলীর পরেই বড়ু চণ্ডীদাস বিরচিত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। আমরা স্মরণ করতে পারব, মধ্যভারতীয় আর্যভাষার বিবর্তনের অন্তপর্যায়ে অর্থাৎ আনুমানিক ৮ম থেকে ১২শ শতকে লৌকিক প্রাকৃত ভাষা থেকে অপভ্রংশের জন্ম হয়। বিবর্তনের ধাপে অসমীয়া, উড়িয়া এবং বাংলা নামের পৃথক পৃথক স্বতন্ত্র আধুনিক ভাষা জন্ম নেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে ভারতবর্ষের উত্তরাপথের পশ্চিম থেকে পূর্বপ্রান্তে প্রবহমান ছিল সর্বভারতীয় ভাষার অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্টভাষার ধারা। অবহট্টভাষা মূলতই অপভ্রংশের লৌকিক রূপ। প্রতীয়মান হয় যে নব্যভারতীয় আর্যভাষার প্রথম পর্ব পর্যন্ত নানা ধাপেই অবহট্টবাহিত ভাষার বিবর্তন ঘটেছিল। আনুমানিক ১২শ থেকে ১৪শ শতকের মধ্যে নব্যভারতীয় আর্যভাষার পূর্বীশাখার অন্তর্গত বঙ্গীয় উপশাখার উপভাষাগুলোর তিন লীলাভূমি—আসাম, উড়িষ্যা ও গৌড়ীয় বাংলাতেও এই মিলিত অবহট্ট বা ভগ্ন-অপভ্রংশে সাহিত্য রচিত হয়েছে বলে আমরা জানি। একই অবহট্ট-প্রবাহের অংশ ছিল বলে বঙ্গীয় উপশাখার অহমীয়া, উড়িয়া এবং গৌড়ীয় উপভাষার অবহট্ট বা লৌকিক রূপের ভেতরে তখন তেমন বড় কোনও ফারাক ছিল না। পরবর্তীকালে এই অবহট্টের ধারা থেকেই ক্রমান্বয়ে পৃথক হতে হতে অসমীয়া, উড়িয়া এবং বাংলা নামের পৃথক পৃথক তিনটি স্বতন্ত্র আধুনিক ভাষার জন্ম হয়। স্মরণ করা যেতে পারে, বঙ্গীয় উপশাখার তিনটি স্বতন্ত্র আধুনিক লৌকিক ভাষা—অসমীয়া, উড়িয়া এবং গৌড়ীয় বাংলা—স্থানিক কারণে নিজস্ব অবয়ব নিয়ে পৃথক হতে শুরু করেছিল ১৩শ শতকের দিক থেকে। এ সময়টিতে বঙ্গীয় উপশাখার মিলিত অবহট্টপ্রবাহ থেকে স্ববৈশিষ্ট্য নিয়ে প্রথমে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে উড়িয়া ভাষা। এরপরে, ১৬শ শতকের দিক থেকে, অসমীয়া ভাষা এবং গৌড়ীয় বাংলাভাষার মিলিত আধুনিক ধারা থেকে ছিটকে পড়ে গিয়ে অসমীয়া ভাষা পৃথক সত্তায় বিকশিত হয়। এই সময়টিতে স্থিত হতে শুরু করে বঙ্গীয় উপশাখার তিনটি আধুনিক ভাষা। বাংলাভাষা স্থিত হবার ঠিক আগমুহূর্তে ভারতবর্ষের উত্তরাপথের পূর্বপ্রান্তে প্রবহমান অবহট্টবাহিত লৌকিক ভাষাতেই রচিত হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-পদাবলী।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সাহিত্যিক ভাষার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো, এই আখ্যানকাব্যে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের অন্যতম নিদর্শন—চর্যাপদাবলীর প্রতিতুলনায় বেশি মাত্রায় সংস্কৃতভাষার আবহ বিদ্যমান রয়েছে। চর্যাপদাবলীতে আমরা তৎসম শব্দ বা বাগধারা বা সংস্কৃতকাব্যের অনুকৃতির তেমন একটা উদাহরণ দেখি না। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র গবেষণা থেকে দেখা যায়, মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ খণ্ডিতপদসহ ৪১৮টি পদের ভেতরে বড়ু চণ্ডীদাস সরাসরিভাবে ১২৩টি সংস্কৃতশ্লোকের সংযোজন ঘটিয়েছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ধারণা করেছেন, সংস্কৃতশ্লোকগুলো সম্ভবত এই কবির নিজের হাতেই রচিত হয়েছিল। এবাদে আখ্যানকাব্যটিতে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এর ৫টি বিখ্যাত সংস্কৃতপদের বাংলা-অনুবাদও সন্নিবেশিত হয়েছে।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, নব্যভারতীয় আর্যভাষার প্রথম পর্যায়ে ভারতবর্ষের উত্তরাপথের পূর্বদিকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের শিষ্টজনেরা সংস্কৃতভাষায় সাহিত্য রচনা করলেও সমাজের নিরক্ষর ও অন্ত্যজ জনসাধারণ [নিঃসন্দেহে যারা জনসংখ্যার সিংগভাগ-অংশই ছিলেন] তাদের মৌখিকভাবের বিনিময় এবং সাহিত্যকর্ম প্রকাশের জন্য মূলত লোকজ অবহট্টকেই বেছে নিয়েছিলেন। অপভ্রংশ-সাহিত্যের ধারাবাহিকতায় বাংলাসাহিত্যের আদিযুগ [৬৫০ থেকে ১২০০ সাল]-এর অন্তিমকালে অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্টভাষার বহুল ব্যবহার সমাদৃত হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে আমরা চন্দোমঞ্জরী, দোহাকোষ, প্রকৃতপৈঙ্গল ইত্যাদিতে অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্ট ভাষার প্রয়োগ দেখতে পাই। শুভঙ্করীর আর্যা ও ডাকের বচনে আমরা অবহট্টবাহিত প্রচীন ভাষার কিছু কিছু নিদর্শণ প্রত্যক্ষ করি। এমনকি বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগ [১২০০ থেকে ১৮০০ সাল]-এর শুরুর দিকেও আমরা এতদ্অঞ্চলের সাহিত্যে অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্টভাষা সমাদৃত হতে দেখেছি। অবহট্টভাষাই ছিল তখনকার মূল সাহিত্যিক ভাষা। এই অবহট্টের ধারায় গৌড় নামের বিশাল একটি ভৌগোলিক এলাকার মানুষজনের মুখে মুখে নানা ধাপের লৌকিক ভাষার জন্ম হয়েছে। লৌকিক ভাষা ক্রমাগত ঘর্ষণে ঘর্ষণে তা চলে এসেছে আজকের স্থিতপর্যায়ের বাংলাভাষার কাছাকাছি। নব্যভারতীয় আর্যভাষার গঠনপর্যায়ে এসব পরিবর্তন ঘটেছে আনুমানিক ১২শ থেকে ১৪শ শতক অবধি। আসাম এবং উড়িষ্যার মানুষজনও তখন একইভাবে পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময় করেছে তাদের যার যার আধুনিক ভাষার ঠিক অব্যবহিত পূর্বের লৌকিক অংশের মাধ্যমেই। নব্যভারতীয় আর্যভাষার পূর্বীশাখার বঙ্গীয় উপশাখার মিলিত অবহট্টভাষায় বড়ু চণ্ডীদাস আনুমানিক ১৫শ শতকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন নামের আখ্যানগীতিকা রচনা করেছিলেন।
অক্ষরবৃত্তে অন্ত্যানুপ্রাসের কায়দায় লেখা হয়েছিল শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, সম্ভবত চর্যাপদাবলীরই অনুসরণে। এই আখ্যানগীতিকার পদগুলোতে ভাষার ব্যবহার লক্ষ করবার জন্য এখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর বংশীখণ্ড থেকে একটি উদাহরণ টানতে পারি। গানটি গীত হয়ে থাকে কেদার রাগে। কৃষ্ণের বাঁশির সুরে রাধার মন আকুল হলে রাধা বৃদ্ধা বড়ায়িকে বলছেন—
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি কালিনী নই কুলে।
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি এ গোঠ-গোকুলে॥
আকুল শরীর মোর বেআকুল মন।
বাঁশীর শবদেঁ মো আউলাইলোঁ রান্ধন॥
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি সে না কোন জনা।
দাসী হআঁ তার পাএ নিশিবোঁ আপনা॥
কে না বাঁশি বাএ বড়ায়ি চিত্তের হরিষে।
তার পাএ বড়ায়ি মোঁ কৈলোঁ কোন দোষে॥
আঝর ঝরএ মোর নয়নের পাণী।
বাঁশীর শবদেঁ বড়ায়ি হারায়িলোঁ পরাণী॥
আকুল করিতেঁ কিবা আহ্মার মন।
বাজাএ সুসর বাঁশী নান্দের নন্দন॥
পাখি নহোঁ তার ঠাঁই উড়ী পড়ি জাওঁ।
মেদনী বিদার দেউ পসিআঁ লুকাওঁ॥
বন পোড়ে আগ বড়ায়ি জগজনে জাণী।
মোর মন পোড়ে যেহ্ন কুম্ভারের পণী॥
আন্তর সুখাএ মোর কাহ্ন আভিলাসে।
বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে॥
উপরের উদ্ধৃতি থেকে বোঝা যায়, আখ্যানকাব্যটির চরণগুলোতে মিশে আছে মূলত ভগ্ন-অপভ্রংশ বা অবহট্টবাহিত প্রাচীন লৌকিক সব শব্দ। পদটিতে বিভিন্ন ধরনের ধ্বনিবিপর্যয়ের সাক্ষ্যই তার প্রমাণ। ধ্বনিবিপর্যয়ের ক’টি উদাহরণ এভাবে দেয়া যেতে পারে: বাএ<বাজায়, হআঁ<হয়ে, মোঁ<আমি, কৈলো<করলাম, নহোঁ<নই, দেউ<দাও, আগ<আগুন, বেআকুল<ব্যাকুল, জাওঁ<যাই ইত্যাদি। যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির প্রয়োগও এখানে বিরল নয়, যেমন, আহ্মা, যেহ্ন এবং কাহ্ন। এই অবহট্টভাষার ধারা থেকেই একদা স্থানিক অবয়ব ধারণ করে পৃথক হয়ে পড়েছিল বঙ্গীয় উপশাখার গৌড়ীয় বাংলা, অসমীয়া এবং উড়িয়াভাষা। এ কারণেই আজকের আধুনিক বাংলাভাষার মৌখিক ও লিখিত রূপের বৈশিষ্ট্যের সাথে আমরা এই পদটির সাহিত্যিক ভাষার কিছু মিলও পেয়ে যাচ্ছি। এই ভাষাই পরে পরিশ্রুত হয়েছে, স্থিত হয়েছে এবং রূপ নিয়েছে আধুনিক বাংলার সাহিত্যিক ভাষায়। বাংলাভাষা গঠনের মধ্যপর্যায়ের অপভ্রংশনির্ভর যে ভাষাতে বাংলাসাহিত্যের আদিযুগের অন্যতম নির্দশন চর্যাপদাবলী লিখিত হয়েছিল তার সাথে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সাহিত্যিক ভাষার ব্যপক অমিল নেই বটে। তবে বলতেই হবে, বাংলাভাষার ইতিহাসের যুগবিভাজনের আলোকে চর্যাপদাবলীর সাধুভাষার প্রতিতুলনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সাহিত্যিক ভাষা নবিনতর অর্থাৎ তা আজকের স্থিত বাংলাভাষার আরও কাছাকাছি।
উপরে উদ্ধৃত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদটির পাঠান্তর আমরা এভাবে করার চেষ্টা করতে পারি: বড়ায়ি! কে সে বাঁশি বাজায় কালিন্দি নদীকূলে? কে সে বাঁশি বাজায়, বড়ায়ি, এই গোষ্ঠ গোকূলে? আমার শরীর আকুল, মন ব্যকুল। বাঁশির শব্দে এলোমেলো হয়ে গেল আমার রান্নার কাজ। কে সে বাঁশি বাজায়? সে কোন জন? দাসী হয়ে তার পা’য়ে আমি সঁপে দেব নিজেকে। বড়ায়ি! চিত্তের হরষে কে সে বাঁশি বাজায়? বড়ায়ি! তার পা’য়ে আমি কী দোষ করেছি? আমার নয়নের জল অঝরে ঝরছে। বড়ায়ি! বাঁশির শব্দে হারিয়ে গেল প্রাণ। আমার মন আকুল করতেই কি সুস্বরে বাঁশি বাজায় নন্দের নন্দন? পাখি নই যে তার ঠাঁইতে উড়ে যাই! মেদিনী বিদীর্ণ করে দাও, সেথায় প্রবেশ করে লুকাই। আগুনে বন পোড়ে, জগতজন তা জানে। আমার মন পোড়ে কুমোরের চুলোর মতো। কৃষ্ণ-অভিলাষে আমার অন্তর শুকিয়ে যাচ্ছে। শিরে বাসলীদেবীর বন্দনা করে চণ্ডীদাস [এই গান] গাইলেন।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ বাংলা অবহট্ট বা বাংলাভাষার লৌকিক রূপের প্রভাবের চেহারাটি তবে কেমন ছিল? শুরুতেই বলে রাখা প্রয়োজন, প্রাকৃতভাষা, অপভ্রংশ এবং অবহট্টের ব্যাকরণের ভিত্তি মোটামুটিভাবে কাছাকাছি। এই প্রাচীন ব্যাকরণই অনুসৃত হয়েছে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোর বিশেষ্যপদ, সর্বনাম, ক্রিয়াপদ ইত্যাদির গঠনে। এখানে বলতেই হবে, চর্যাপদাবলীতে অনুসৃত শব্দগঠনের সাপেক্ষে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর শব্দগঠনের ধরন খুব দূরের নয়। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্-র গবেষণা থেকে ধার করে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর বাক্যগঠনে অনুসৃত ব্যাকরণের গুরুত্বপূর্ণ সূত্রগুলোর উল্লেখ এভাবে করা যেতে পারে: [১] উত্তম পুরুষের একবচন ও বহুবচনের প্রয়োগ ভিন্ন রকমের হবে-যেমন, একবচনে মোএঁ, মোঞঁ, মোঞেঁ ও মোঞ-র ব্যবহার বহুবচনে দাঁড়াবে গিয়ে আহ্মে বা আহ্মি-তে; একবচনে চলোঁ, চলিলোঁ, চলিবোঁ, চলিতোঁ ইত্যাদির ব্যবহার বহুবচনে এসে হবে চলি [চলিএ], চলিল, চলিত ইত্যাদি; [২] অতীতকালে মধ্যম পুরুষে ‘আহা’ এবং উত্তম পুরুষে ‘আহোঁ’-ধ্বনির যোগ ঘটবে, যেমন, তোহ্মে চলিলাহা, আহ্মে চলিলাহোঁ ইত্যাদি; [৩] কর্তা প্রথম পুরুষে স্ত্রীলিঙ্গ হলে অকর্মক ক্রিয়ার অতীতকালে স্ত্রী-প্রত্যয় যুক্ত হবে, যেমন, চলিলী, গেলী, বসিলী ইত্যাদি; [৪] করণ কারকে তে-বিভক্তি যোগ হবে, যেমন, গরুতে, ডালেতে ইত্যাদি; [৫] কর্ম কারকে ‘ক’ আর অধীকরণ কারকে ‘ত’-বিভক্তি যুক্ত হবে, যেমন, হামাক, দেশত ইত্যাদি; [৬] সম্বন্ধপদের বহুবচনে ‘দের’, ‘দিগের’ ইত্যাদি বিভক্তি যুক্ত হবে না; [৭] করণ কারকে ‘তে’-বিভক্তির প্রয়োগ থাকবে না ইত্যাদি। এভাবে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর বাক্যবন্ধে সাজানো পদগুলোতে অবহট্টের ব্যাকরণের আরও বৈশিষ্ট্য সবিস্তারে বর্ণনা করা যেতে পারে। তবে আলোচ্য প্রবন্ধে সে অবকাশ নেই। উপসংহারে আমরা মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র গবেষণার ফলাফল স্মরণ করতে চাই: এই আখ্যানগীতিকায় ব্যবহৃত লৌকিকভাষার এই প্রাচীন ব্যাকরণ পরে বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের আর কোনও কাব্যে অনুসৃত হয়নি।
বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের পয়লা দিকে যে ভাষায় সাহিত্য রচিত হয়েছে তার ওপরে বাংলা-অবহট্ট বা বাংলাভাষার লৌকিক রূপের প্রভাব রয়ে যাওয়াটা স্বাভাবিক। গাথাসপ্তদশী, পদ্মপুরাণ ইত্যাদি প্রাকৃতভাষায় রচিত কাব্যের ধারায় তখন কাব্য রচিত না-হলেও অপভ্রংশ বা অবহট্ট ভাষায় তখন চন্দোমঞ্জরী এবং প্রাকৃতপৈঙ্গলের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাব্য লিখিত হচ্ছিল। হয়তবা এ কারণেরই আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোর গঠনে প্রচুর লৌকিক গৌড়ীয় বা বাংলা শব্দ দেখতে পাই। ভারতীয় ভাষাপ্রবাহের পূর্বীশাখার বিবর্তনের কালে প্রাকৃত থেকে উদ্ভূত অপভ্রংশে যেহেতু অহমীয়া, উড়িয়া এবং গৌড়ীয় উপভাষার সমান অধিকার ছিল কাজেই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ ব্যবহৃত ভাষায় আমরা লৌকিক বাংলাভাষা ছাড়াও প্রাচীন অহমীয়া ও উড়িয়াভাষার উপাদানও লক্ষ করি। শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী প্রমুখ গবেষকেরা এমনটাই উপসংহার টেনেছেন। শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় আরও বলছেন, বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষা যেমন অসমীয়া ও উড়িয়া লৌকিক ভাষার কাছাকাছি, অন্যদিকে তা গৌড়ীয় লৌকিক বাংলাভাষার ‘সর্বাধিক লক্ষণযুক্ত’। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ের এই পর্যবেক্ষণ একবারেই উড়িয়ে দেয়া যায় না কেননা আনুমানিক ১৫শ শতকে যখন শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচিত হচ্ছে তখনও অসমীয়া ও গৌড়ীয় বাংলাভাষার ধারার সাথে মিলেমিশে রয়ে গেছে উড়িয়াভাষার বৈশিষ্ট্য। তাই শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ আমরা উড়িয়াভাষায় প্রচলিত স্বরান্ত-পদ্ধতি, কর্তার লিঙ্গানুসারে ক্রিয়াপদের লৈঙ্গীকিকরণ [বাসলী শিরে বন্দী গাইল চণ্ডীদাসে, মথুরা চলিলী রাধা ইত্যাদি], বিবিধ ধ্বনিবিপর্যয়, যুক্ত ব্যঞ্জনধ্বনির প্রয়োগ ইত্যাদি লক্ষণ দেখতে পাই। এখানে আমরা স্মরণ করতে পারব, বাংলাসাহিত্যের আদি নিদর্শন— চর্যাপদাবলী-তেও এভাবে বঙ্গীয় উপশাখার তিনটি উপভাষাই অর্থাৎ অহমীয়া, উড়িয়া এবং গৌড়ীয় বাংলার অস্তিত্ব জড়িয়েপেঁচিয়েই ছিল। অবশ্য এটিও আমাদেরকে মানতে হবে, গৌড়ীয় শাখার অপভ্রংশেরই কাছাকাছি ছিল চর্যাপদাবলীর সাহিত্যিক ভাষা। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সুকুমার সেন, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখের গবেষণা থেকে আমরা আগেই এই প্রবণতার কথা জেনেছি। আমরা এ-ও দেখতে পাচ্ছি, ভাষাগত পুরাতাত্ত্বিক দিক থেকে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর ভাষার এই চেহারাটি আসলে আধুনিক পর্যায়ের বাংলাভাষার স্থিত রূপ থেকে খুব বেশি দূরের নয়। এই অর্থে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ ব্যবহৃত প্রাচীন বাংলাভাষা আজকের আধুনিক বাংলাভাষারও নিকটাত্মীয়।
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পুঁথির লিপিকাল নিয়ে যতই মতবিরোধ থাকুক না কেন, এই আখ্যানগীতিকাটির সাহিত্যিক ভাষার চেহারার বিষয়ে বলা যেতে পারে যে অপভ্রংশ ও অবহট্ট সাহিত্যের ধারায় এটিতেও চর্যাপদাবলীর মতোই প্রাচীন কোনও বাংলাভাষা ব্যবহার করা হয়েছে
শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সাহিত্যিক ভাষার বৈশিষ্ট্যের অন্যতম দিক হলো, এই আখ্যানকাব্যে বাংলা সাহিত্যের আদিযুগের অন্যতম নিদর্শন—চর্যাপদাবলীর প্রতিতুলনায় বেশি মাত্রায় সংস্কৃতভাষার আবহ বিদ্যমান রয়েছে। চর্যাপদাবলীতে আমরা তৎসম শব্দ বা বাগধারা বা সংস্কৃতকাব্যের অনুকৃতির তেমন একটা উদাহরণ দেখি না। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র গবেষণা থেকে দেখা যায়, মোট ১৩ খণ্ডে বিভক্ত শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ খণ্ডিতপদসহ ৪১৮টি পদের ভেতরে বড়ু চণ্ডীদাস সরাসরিভাবে ১২৩টি সংস্কৃতশ্লোকের সংযোজন ঘটিয়েছেন। মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ ধারণা করেছেন, সংস্কৃতশ্লোকগুলো সম্ভবত এই কবির নিজের হাতেই রচিত হয়েছিল। এবাদে আখ্যানকাব্যটিতে কবি জয়দেবের ‘গীতগোবিন্দ’-এর ৫টি বিখ্যাত সংস্কৃতপদের বাংলা-অনুবাদও সন্নিবেশিত হয়েছে। স্মরণ করা যেতে পারে, অবহট্ট ভাষায় রচিত কৃষ্ণলীলা বিষয়ক লৌকিক কবিতা থেকে অনুপ্রাণিত হয়েই জয়দেব ‘গীতগোবিন্দ’ লিখেছিলেন। যা হোক, জয়দেবের ধ্বনিসমৃদ্ধ সংস্কৃতভাষার কাঠামোর অনুকরণ প্রবণতা বাংলা সাহিত্যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন থেকেই সূচিত হয়। তাই শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন, চর্যাপদ-এর প্রতিতুলনায় এই আখ্যানগীতিকার ভাষা ‘অধিকতর সংস্কৃতানুযায়ী’। তখন প্রাকৃত ও অপভ্রংশের প্রভাব অতিক্রম করে বাংলাসাহিত্য ফের ‘সংস্কৃতের আদর্শে’ ঢুকে পড়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেছেন। পরবর্তীকালে আমরা দেখব, সংস্কৃতভাষা বহুলভাবে ব্যবহারের এই রেওয়াজ চালু রয়েছে শ্রীকৃষ্ণবিজয়, কৃষ্ণমঙ্গল, গোবিন্দমঙ্গল, কৃষ্ণকর্ণামৃত, গোবিন্দবিলাস ইত্যাদি চরিতকাব্য রচনার বেলাতে।
এ পর্যন্ত আমরা শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর সাহিত্যিক ভাষার বৈশিষ্ট্য নিয়ে যে আলোচনা করেছি তা থেকে দেখা যাচ্ছে, আলোচ্য কাব্যে বাংলা, উড়িয়া ও অসমীয়া ভাষার প্রাচীন উপাদানসহ সংস্কৃতভাষার উপাদান ব্যবহৃত হয়েছে। এবাদে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোতে অল্প কিছু আফ্রো-এশীয় ভাষা-পরিবারের সেমিটিক শাখার আরবি এবং প্রত্ন-ইরানীয় উপবিভাগের ফার্সিভাষার শব্দের উপস্থিতিও লক্ষ করা যায় [যেমন, কামান, নারাজ, মজুর, বন্দী ইত্যাদি]। দীনেশচন্দ্র সেন, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, সুকুমার সেন, আহমদ শরীফ, শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, নিত্যানন্দ বিনোদ গোস্বামী প্রমুখ গবেষকদের কাজে আমরা তার উল্লেখ দেখি। এই কাব্যে এমন কিছু বিদেশি শব্দের আচমকা উপস্থিতির পেছনে বাংলায় মুসলিম ঔপনিবেশিকদের শাসনের প্রভাব রয়েছে বলেই ধারণা করা হয়। ইতিহাস বলছে, ১২০৪ সালে তুর্কিদের হাতে সেনবংশের রাজা লক্ষ্মণ সেন পরাজিত হলে বাংলায় মুসলিম শাসনের সূত্রপাত ঘটে। তুর্কিরা তাদের নিজেদের সাথে করে নিয়ে এসেছিল তাদের নিজস্ব ভূমিতে ব্যবহৃত আরবি-ফার্সি-তুর্কি শব্দ। আহমদ শরীফ যুক্তি দিচ্ছেন, বাংলায় মুসলিম শাসনের শুরুর ঠিক পরপরের সময়টায় রচিত এই সাহিত্যকর্মে নিতান্তই ব্যবহারিক কারণেই এমন দলছুট কিছু আরবি-ফার্সি শব্দ ঢুকে পড়াটা বিচিত্র কোনও ব্যাপার নয়। এ কারণেই আমরা অনুমান করতে পারি, অন্ততপক্ষে ১৩শ শতকের পরপর দিয়ে রচিত হয়েছিল এই আখ্যানগীতিকা। তবে বলতেই হবে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ এসব নানা বিদেশি শব্দের মাত্রাতিরিক্ত কোনও সংযোজন ঘটেনি। এ বিষয়ে আমরা পরে লক্ষ করব, বাংলায় মুসলিম ঔপনিবেশিকদের শাসন পাকাপোক্ত হলে তুর্কিশাসনামল থেকে শুরু করে মুঘল-শাসনামল পর্যন্ত রচিত বিভিন্ন কাব্যে, যেমন, কৃষ্ণরামের রায়মঙ্গল, ভারতচন্দ্র রায়গুণাকরের অন্নদামঙ্গল ও সত্যনারায়ণের পাঁচালি, ফকির গরীবুল্লাহ্ ও সৈয়দ হামজা-র পুঁথি ইত্যাদিতে আরবি, ফার্সি, তুর্কি, হিন্দি ও উর্দু ভাষার মিশ্রপদ্ধতিতে কাব্য রচনার উদাহরণ রয়েছে। তবে বলতেই হবে, কবি জয়দেবের সংস্কৃতকাব্য ‘গীতগোবিন্দ’-এর প্রভাবে কাব্য রচনা করলেও বড়ু চণ্ডীদাস তার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোতে বঙ্গীয় উপশাখার অবহট্ট বা লৌকিক রূপের ক্রিয়াপদ, সর্বনামপদ, নানা লৌকিক শব্দ ও বাগধারার সাথে সংস্কৃতভাষার উপযুক্ত মেলবন্ধন ঘটিয়েছিলেন। এ কারণেই এই আখ্যানকাব্যের ভাষায় তৎসমশব্দের সামান্য কিছু সমাবেশ আমাদের চোখে বিসদৃশ ঠেকে না।
গৌড়ীয় উপভাষার অর্বাচীন অপভ্রংশ বা অবহট্ট বা লৌকিক রূপেই যে শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনা করা হয়েছিল তা আমরা উপরের আলোচনা থেকে দেখেছি। এবার প্রশ্ন আসবে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর পদগুলোতে ভৌগোলিকভাবে গৌড় নামের বিস্তৃত এলাকার কোন অংশের ভাষা ব্যবহার করা হয়েছিল? মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ এবং শ্রীকুমার বন্দোপাধ্যায় উল্লেখ করেছেন, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ পশ্চিম রাঢ়ের আঞ্চলিক ভাষার উপস্থিতিই প্রবল বলে মনে হয়। এখানে আমরা দু’টি প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। প্রথমত, বিবর্তনের প্রক্রিয়াতে বাংলাভাষার গঠনের পর্যায়ে গৌড়-সন্নিহিত বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে জন্ম নেয়া মানুষের মুখের ভাষার ভেতরে তেমন একটি পার্থক্য ছিল না, যেমন, বড় কোনও ফারাক ছিল না রাঢ়ী ও বরেন্দ্রীর উপভাষার ভেতরে। দ্বিতীয়ত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর বটতলার সংস্করণগুলোর কল্যাণে পুঁথিগুলোতে কোনও একটি আঞ্চলিক ভাষার বৈশিষ্ট্য বেশি পরিমাণে অনুপ্রবেশ করে থাকতে পারে। প্রথম প্রসঙ্গটি উঠল এ কারণে যে বাংলার প্রচীন অবহট্টের ধারায় আঞ্চলিক বিভিন্নতা থাকবার সম্ভাবনা খুবই কম। শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায়ও এ বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন কেননা তিনি মনে করেন, প্রচীন অবহট্টে আঞ্চলিক বৈশিষ্ট্য রক্ষিত থাকবার কথা নয়। আমরা জানি, অবহট্ট বা ভগ্ন-অপভ্রংশ ভারতবর্ষের নির্দিষ্ট কোনও প্রাদেশিক ভাষা ছিল না; বাক্যগঠন ও শব্দের ব্যবহারের দিক থেকে প্রদেশগুলোতে তা সামান্য কিছু বিভিন্নতা পরিগ্রহ করেছিল মাত্র। আমরা এ-ও দেখি, অবহট্ট-পর্যায় অতিক্রান্ত হবার পরেই বাংলাভাষা স্থিত হয়েছে এবং সেখানে দেখা দিয়েছে আঞ্চলিক বিভিন্নতা। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ যদি রাঢ়ী উপভাষার অস্তিত্ব মিলে যায় তবে এই আখ্যানকাব্যের রচনাকাল আরও খানিকটা এগিয়ে আসবে বলে আমরা মনে করি। তবে যুগবিবেচনায় এমন উপসংহার টানা সঙ্গত হবে না। বরং এটি বলাই শ্রেয়, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ যে প্রাচীন বাংলা সাধুভাষা ব্যবহার করা হয়েছে তার চেহারা বর্তমানের স্থিতপর্যায়ের বাংলাভাষার রাঢ়-অঞ্চলের মানুষের স্থানিক মুখের ভাষারই নিকটবর্তী।
সৌকর্য ও ভাষার ব্যবহারের দিক থেকে বাংলাসাহিত্যের আদিপর্বে রচিত চর্যাপদাবলী এবং মধ্যযুগের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন— এই দুই সাহিত্যিক নিদর্শনের মাঝে আর বড় কোনও সাহিত্যিক নিদর্শনের খবর অদ্যাবধি মেলেনি। এ প্রসঙ্গে আমরা এখানে কৃত্তিবাস ওঝার শ্রীরামপাঁচালির কথা উল্লেখ করতে চাই। আনুমানিক ১৫শ শতকে, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন রচনার কাছাকাছি সময়ে, প্রায়োস্থিত পর্যায়ের গৌড়ীয় বাংলাভাষার কথ্য বা লৌকিক রূপে শ্রীরামপাঁচালি রচিত হয়েছিল—তখনকার সময়ের বহুল প্রচলিত অবহট্ট ভাষাতে নয়। শ্রীরামপাঁচালির সহজ, সরল ভাষা প্রমাণ করে, ১৫শ শতকের দিকে গৌড়ীয় বাংলামুলুকে স্পষ্ট দু’টি সাহিত্যিক ভাষার ধারা বিদ্যমান ছিল—একটি খোদ অবহট্ট-সাহিত্যের ভাষার ধারা এবং অপরটি স্থিতপ্রায় বাংলাভাষার ধারা। পাঁচালির মতো সহজ-সরল ও জনপ্রিয় লৌকিক ভাষাতেই বাংলাসাহিত্যের মধ্যযুগের পয়লা দিকটায় মানুষের মুখে মুখে ছড়া, লোকগীতি, গীতিকা ইত্যাদি রচিত হয়েছিল এবং তা ছড়িয়ে পড়েছিল বাংলামুলুকের মানুষের মুখে মুখে। যুগবিবেচনায় শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এর অবহট্টবাহিত সাহিত্যিক ভাষার প্রতিতুলনায় প্রায়োস্থিত বাংলাভাষার আদলে তৈরি করা শ্রীরামপাঁচালির সাহিত্যিক ভাষাকে আধুনিক না-বলে আর কোনও উপায় থাকে না। তো আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, প্রায়োস্থিত স্তরের বাংলাভাষাকে আশ্রয় না-করে বড়ু চণ্ডীদাস তার শ্রীকৃষ্ণকীর্তন-এ কেন অবহট্টের মতো প্রাচীন একটি সাহিত্যিক ভাষা ব্যবহার করেছিলেন? সম্ভবত, অবহট্টভাষার গাম্ভীর্য এবং ধ্বনিমাধুর্যই বড়ু চণ্ডীদাসকে টেনেছিল।
গ্রন্থপঞ্জি
- আলম, মাহবুবুল [২০০৯]: শ্রীকৃষ্ণকীর্তন [বংশী ও বিরহ খণ্ড], খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ২০০৯।
- আলম, মাহবুবুল [২০১৬]: বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস, খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি, ঢাকা, জুলাই ২০১৬।
- গোস্বামী, নিত্যানন্দ বিনোদ [১৩৫৯]: বাংলা সাহিত্যে কৃষ্ণকথার ক্রমবিকাশ, ফাল্গুন ১৩৫৯।
- চট্টোপাধ্যায়, সুনীতিকুমার [১৩৪৫]: জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য, মিত্র এন্ড ঘোষ, কলিকাতা, বৈশাখ ১৩৪৫।
- বন্দ্যোপাধ্যায়, শ্রীকুমার [১৯৬৭]: বাংলা সাহিত্যের বিকাশের ধারা, প্রথম খণ্ড, ওরিয়েন্ট বুক কোম্পানি, কলিকাতা, জুলাই ১৯৬৭।
- মুখোপাধ্যায়, সুখময় [১৯৬০]: মধ্যযুগের বাংলাসাহিত্যের তথ্য ও কালক্রম, জি. ভরদ্বাজ অ্যান্ড কোং, কলিকাতা, ১৯৬০।
- শরীফ, আহমদ [২০১৬]: বাঙালী ও বাঙলা সাহিত্য, নিউ এজ পাবলিকেশন্স, ঢাকা, জুন ২০১৬।
- শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ [২০১৯]: বাংলা সাহিত্যের কথা, প্রথম খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, জুলাই ২০১৯।
- শহীদুল্লাহ্, মুহম্মদ [২০১৪]: বাংলা সাহিত্যের কথা, দ্বিতীয় খণ্ড, মাওলা ব্রাদার্স, সেপ্টেম্বর ২০১৪।
- সেন, দীনেশচন্দ্র [১৮৯৬]: বঙ্গভাষা ও সাহিত্য, প্রথম ভাগ, ভারতবর্ষ প্রিন্টিং ওয়ার্কস, কলিকাতা, ১৮৯৬।
- সেন, সুকুমার [১৯৪০]: বাঙ্গালা সাহিত্যের ইতিহাস, মডার্ন বুক এজেন্সী, কলিকাতা, ১৯৪০।
- সেন, সুকুমার [১৯৫৭খ]: ভাষার ইতিবৃত্ত, সাহিত্যসভা, বর্ধমান, ১৯৫৭
- সেন, সুকুমার [১৩৬৮]: ভারতীয় সাহিত্যের ইতিহাস, গ্রন্থপ্রকাশ, কলিকাতা, ভাদ্র ১৩৬৮।