ইংরেজি সাহিত্যে গণমানুষের ভাষা প্রয়োগের সূচনা
ইংল্যান্ডের মধ্যযুগের কবি এবং কথাশিল্পী জেফ্রি চসার [১৩৪৩—১৪০০]-এর প্রখ্যাত গল্পসংকলন ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ যুগান্তকারী সাহিত্যকর্ম হিসেবে এখনও, রচিত হবার এই প্রায় ছ’শ বছর পরেও, সমাদৃত হচ্ছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো এই যে, এই গল্পসংকলন তখনকার ইংল্যান্ডে প্রচলিত ফরাসিভাষা অথবা লাতিনভাষায় লিখিত হয়নি—লিখিত হয়েছিল খোদ লন্ডন এলাকার গণমানুষের স্থানিক ভাষাতেই। ইংল্যান্ডের তৎকালীন রাজনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সেই সময়টায় আনুষ্ঠানিকভাবে চার্চে বা দপ্তরের শোষণবৃত্তে লাতিন এবং ফরাসিভাষা—এই দুটি ঔপনিবেশিক ভাষাতেই কথা বলা বা কাজ করবার চল ছিল। এমনকি তখন গদ্য যা লেখালেখি হয়েছে তা হয়েছে এই দুটি পরাক্রমশালী বিদেশি ভাষাতেই। তাই আমাদের মনে প্রশ্ন জাগে, প্রচলিত লাতিন বা ফরাসিভাষা ব্যবহার না-করে চসার কেন লন্ডন এলাকার গণমানুষের স্থানিক ভাষাতে সাহিত্য রচনা করতে নেমেছিলেন? বর্তমান প্রবন্ধে আমরা এই প্রশ্নটিরই মীমাংসা করবার চেষ্টা করব।
আমরা জানি, ‘ইংলিশ সাহিত্যের জনক’ জেফ্রি চসারের কাজের ওপরে ফরাসি সাহিত্যের বিষয়, ফর্ম এবং শব্দের ব্যবহার গভীর প্রভাব ফেলেছিল। গবেষকেরা বলছেন, ১৩৭২ সাল পর্যন্ত, অর্থাৎ চসারের ইতালি-ভ্রমণের আগ পর্যন্ত, তাঁর সাহিত্যকর্মে ফরাসি সাহিত্যের সুস্পষ্ট প্রভাব লক্ষণীয়। গবেষকদের ধারণা, বিখ্যাত ফরাসি রূপকাশ্রয়ী প্রেমগাথা ‘লে রোমান ডি লা রোজ’ [১২৩০]-এর লিখনশৈলী তাঁকে আকৃষ্ট করে থাকবে। আমরা দেখি, ১৩৬৯ সালে ‘দ্যা বুক অফ ডাচেস’ নামে মিডিল ইংলিশে চসার যে-শোকগাথা লিখেছিলেন তা-ও লেখা হয়েছিল তখনকার ফরাসি কবিতার কাঠামো অনুসরণ করেই। এটাই ছিল চোখে পড়ার মতো তাঁর প্রথম কাজ। এছাড়া এ-ও বলতে হয়, নরমানদের শাসনকালে ইংল্যান্ডে সরাসরিভাবে ফরাসিভাষায় লিখিত বিভিন্ন রোমান্স, নীতিকথা, ব্যাঙ্গ, ধর্মীয় গল্প ইত্যাদির পাশাপাশি ফরাসি বীরত্বগাথার গানও এসে দোলা দেয়। যেমন, ‘লা চেনসোঁ ডে রোনাল্ড’ [১০৪০—১১৫]। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরে মধ্যযুগের ফ্রান্সে নিজেদের এসব বীরত্বগাথা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল যা ছিল তাদের জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশেরই পরিচায়ক। এসব ফরাসি বীরত্বগাথার গানের ফর্মের প্রভাব চসারের কাজের ওপরে পড়েছিল বলে ধারণা করা হয়। এজন্যই বোধ করি, ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর বিভিন্ন গল্পে আমরা ইংলিশ নাইটদের বীরত্ব, উত্থান-পতন ইত্যাদি বিষয়ের ছড়াছড়ি দেখতে পাই। আমরা আরও দেখি, ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর পরতে পরতে ছড়িয়ে আছে ফরাসি সব বিশেষণের ব্যবহার। তবে চসারের ওপরে ফরাসি সাহিত্যের বিষয়, ফর্ম এবং শব্দের প্রভাবের বাইরে আমরা ভিন্ন একটি চিত্র দেখি। গবেষকেরা বলছেন, ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এ স্থানীয় ভাষারীতি ব্যবহারের প্রবণতাটি ইতালির ত্রুবাদোর বা গণমানুষের কবিদের সাহিত্যকর্মের ভাষা-প্রবণতার প্রভাবজাত হতে পারে। আমরা স্মরণ করতে পারব, সাহিত্যকর্মে গণমানুষের অনানুষ্ঠানিক মুখের ভাষা প্রয়োগের এই রেওয়াজ পয়লাতে তৈরি করেছিলেন মূলত অক্সিতানিয়া [ইতালির উত্তর-পশ্চিম এলাকার অক্সিতান উপত্যকার অংশ, মোনাকো, দক্ষিণ ফ্রান্স এবং স্পেইনের ভাল ডি’আরান এলাকা]-র গীতিকবিরা, বার শতকের দিকে, রোমান সাম্রারাজ্যের পতনের পরে। তারপর ইতালির গীতিকবিদের মাধ্যমে ইতালির বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়েছিল সেই ঐতিহ্য; বিকশিত হয়েছিল ইতালির তিন সাহিত্যগুরু—দান্তে আলিঘেইরি [১২৬৫—১৩২১], ফ্যানচেস্কো পেতরারকা [১৩০৪—১৩৭৪] এবং জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও [১৩১৩—১৩৭৫]-এর হাতে।
গবেষকরা আমাদেরকে জানাচ্ছেন, জেফ্রি চসারের ওপরে ভার্জিল [খ্রিস্টপূর্ব ৭০—১৯ সাল] এবং ওভিদ [খ্রিস্টপূর্ব ৮৪—খ্রিস্টপরবর্তী আনুমানিক ১৭ সাল]—এই দুই প্রাচীন রোমান কবির প্রভাব পড়েছিল। এছাড়া এটাও বিচিত্র কিছু নয় যে, ইতালির সমসাময়িক সাহিত্যের বিকাশও চসারকে আকৃষ্ট করে থাকতে পারে। আমরা এ-ও জানি, ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ লেখাখা হয়েছিল ১৩৮৭—১৪০০ সময়কালে। তবে কি একই সময়ে দান্তে আলিঘেইরি, ফ্যানচেস্কো পেতরারকা এবং জিওভান্নি বোক্কাচ্চিওর হাতে বিকশিত গণমানুষের মুখের ভাষায় রচিত সাহিত্য প্রভাব ফেলেছিল তাঁদের সমসাময়িক লেখক চসারের ওপরে? এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, রোমানদের লাতিনভাষার সাথে ঐতিহাসিকভাবে রোমের উপনিবেশ—ইংল্যান্ডের মানুষের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের কারণেই দান্তে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিওর সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা ছিল জেফ্রি চসারের। কাজেই হয়ত ইতালির ত্রুবাদোর বা গণমানুষের কবিদের সাহিত্যকর্মের ধারা পরোক্ষভাবে হলেও প্রভাবিত করেছিল জিওফ্রি চসারকে। ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এ ব্যবহৃত ভাষার ওপরে এভাবেই আমরা ইতালির সাহিত্যে অনুসৃত গণমানুষের ভাষার প্রভাব দেখতে পাই।
লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জেফ্রি চসারের। এই লন্ডনের টেমস নদীর উত্তরপারে পড়েছে ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকা এবং দক্ষিণপারে পড়েছে কেন্ট। নিজের এলাকার সর্বসাধারণের মুখের ভাষা অর্থাৎ ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার ভাষাভাষীদের অনানুষ্ঠানিক ভাষাতেই চসার ১৩৮৭—১৪০০ সময়কালে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ—‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’।
চসারের এই গল্পসংকলন প্রকাশিত হবার পরে ইংল্যান্ডে নিজেদের ভাষায় সাহিত্য রচনার প্রবণতা জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ঝরে পড়তে থাকে রাজনৈতিক কারণে ফরাসি ভাষা অথবা লাতিন ভাষায় সাহিত্য রচনার দীর্ঘ ধারা। অ্যাংলো-নরমান যুগ [১০৬৬—১৩৫০]-এর ইংল্যান্ডে নরমান উপনিবেশ এবং রোমান চার্চের আধিপত্যের বলয়ের ভেতরে থাকার পরেও সঙ্গত কারণেই জেফ্রি চসারের মাথায় ইংল্যান্ডের গণমানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনার চিন্তাটি এসেছিল। ইংল্যান্ডের তখনকার সাহিত্যে লাতিন এবং নরমানদের ফরাসিভাষায় সাহিত্য রচনার বাধ্যবাধকতা বা প্রবণতার প্রেক্ষিতে ব্যাপারটা ঠিক প্রথাগত নয় বলেই আমাদের কাছে মনে হয়।
মধ্যযুগের ইংল্যান্ডের ইতিহাসের দিকে তাকালে আমরা তিনটি রাজনৈতিক পালাবদল দেখতে পাই; আনুমানিক ৪৩ সাল থেকে ৪১০ সাল পর্যন্ত ইংল্যান্ড ছিল রোমান সাম্রারাজ্যের অধীনে; রোমানরা চার শতকে ইংল্যান্ড ত্যাগ করার পরে ইংল্যান্ডে আক্রমণ করে বসে জার্মানির উত্তর-পশ্চিম অংশের বিভিন্ন গোত্র যাদের হতে গড়ে ওঠে অ্যাংলো-সেক্সন সাম্রাজ্য, যে-সাম্রারাজ্যের অধীনে ইংল্যান্ডকে থাকতে হয়েছিল ১০৬৬ সাল অবধি। ১০৬৬ সালে অ্যাংলো-সেক্সনদেরকে হটিয়ে ইংল্যান্ড দখল করেছিল ফ্রান্সের উত্তর-পশ্চিমের বিভিন্ন গোত্র। তারা অ্যাংলো-নরমান সাম্রাজ্য তৈরি করেছে এবং ১৩৫০ সাল পর্যন্ত তারা শাসন করেছে ইংল্যান্ডের মানুষজনকে। অর্থাৎ এখানে যেটা বলার তা হলো, আনুমানিক ৪৩ সাল থেকে শুরু করে ১৩৫০ সাল অবধি ইংল্যান্ডবাসীকে থাকতে হয়েছে সাম্রাজ্যবাদীদের প্রত্যক্ষ অধীনেই। এই সুদীর্ঘ প্রায় ১৩০০ বছর ধরে ঔপনিবেশিক ভাষাই ভর করেছিল ইংল্যান্ডবাসীর ওপরে; অ্যাংলো-সেক্সনদের তৈরি করা ইংরাজি [ওল্ড ইংলিশ], লাতিন এবং নরমান-ফরাসি। এমন একটা দম আটকে থাকা পরিস্থিতিতে ইংল্যান্ডের সাহিত্যিকেরা আর নিজেদের প্রাণের ভাষাতে সাহিত্য প্রকাশ করার সুযোগই পায়নি। তবে এত শত অবদমনের পরেও নিজেদের ভাষাতে সাহিত্যকর্ম তৈরির বাসনা যে তাদের ছিল তা জেফ্রি চসারের মনন অনুসরণ করলেই বোঝা যায়। তা না-হলে তিনি লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার ভাষাভাষীদের মুখের ভাষা ব্যবহার করে সাহিত্য রচনা করার পরিকল্পনা করতে যাবেন কেন?
লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকায় জন্ম এবং বেড়ে ওঠা জেফ্রি চসারের। এই লন্ডনের টেমস নদীর উত্তরপারে পড়েছে ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকা এবং দক্ষিণপারে পড়েছে কেন্ট। নিজের এলাকার সর্বসাধারণের মুখের ভাষা অর্থাৎ ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার ভাষাভাষীদের অনানুষ্ঠানিক ভাষাতেই চসার ১৩৮৭—১৪০০ সময়কালে লিখলেন তাঁর বিখ্যাত গল্পসংগ্রহ—‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’। এখানে স্মরণ করা যেতে পারে, লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার এই স্থানীয় ভাষা নরমান-শাসনের আগেই গড়ে উঠেছিল। এই ভাষার চেহারা অ্যাংলো-সেক্সনদের ওল্ড ইংলিশের খুবই কাছাকাছি। টেমসের উত্তরপারের সাধারণ মানুষেরা আনুমানিক ১১৫০ থেকে ১৫০০ সাল পর্যন্ত তাদের বাসায়, পথে বা বাজারে পরস্পরের সাথে ভাব বিনিময়ের জন্য এই অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় ভাষাই ব্যবহার করেছে। অবশ্য তখন রোমান স্যাম্রাজ্যের পতন ঘটে গেলেও ক্যাথলিক চার্চের করায়ত্তে থাকা ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার মানুষজনকেও আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে হয়েছে লাতিনে এবং শাসক নরমানদের তরবারির মুখে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে তাদেরকে ব্যবহার করতে হয়েছে ফরাসিভাষা। নরমান-শাসনের সময়ে ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকায় মানুষের মুখেমুখে গড়ে ওঠা এই লৌকিক ভাষাতেই সীমিত আকারে হলেও সাহিত্যচর্চা করা হয়েছে। তবে তার প্রকাশ ছিল ফরাসি স্ক্রিপ্টে। ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর মাধ্যমে ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার অনানুষ্ঠানিক স্থানীয় ভাষা সর্বপ্রথম সাহিত্যে প্রযুক্ত করেন জেফ্রি চসার। আমরা জানি, ইংল্যান্ডে নরমান-শাসন শেষ হয়ে যাবার পরে লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার অনানুষ্ঠানিক এই ভাষাই সারা ইংল্যান্ডে ‘মিডিল ইংলিশ ভাষা’ হিসেবে আনুষ্ঠানিক রূপ লাভ করে। জেফ্রি চসারের গল্পসংগ্রহ—‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর প্রেরণায় পনের শতকের পরে ইংল্যান্ডের মানুষজন ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার এই ‘মিডিল ইংলিশ ভাষা’-তেই সাহিত্যচর্চা করেছে।
এবার আমরা ইংল্যান্ডের জিওফ্রি চসারের গল্পসংগ্রহ—‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এ ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার সর্বসাধারণ মানুষের মুখের ভাষার ব্যবহারের সাথে ইতালির গণমানুষের কবিদের গীতিকবিতা এবং অ্যাখ্যানগীতিকা রচনায় নিজেদের লৌকিক ভাষা ব্যবহারের প্রবণতার একটি মিল খুঁজে পাব। একথা আমরা সকলেই জানি, রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরেও ইংল্যান্ডে রোমান চার্চ দীর্ঘ দিন যাবৎ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ধরে রেখেছিল এবং সে কারণে আনুমানিক বার শতকে ইতালিতে বিকশিত হওয়া গণমানুষের সাহিত্যও সহজেই চার্চের মাধ্যমে বিস্তৃত হয়েছিল সমগ্র ইংল্যান্ডে। এভাবে সাহিত্যিক সমসাময়িকতা সম্পর্কে জিওফ্রি চসার ওয়াকিবহাল ছিলেন বলে ধারণা করে নেয়াই যায়। এ-বাদে আমরা দেখতে পাই, কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের কারণে একদা চসারকে ইতালি এবং ফ্রান্সসহ বিভিন্ন দেশে ঘনঘন যাতায়াত করতে হয়েছে, থাকতেও হয়েছে দীর্ঘ দিন ধরে। গবেষকরা বলছেন ইতালিতে এমনসব ভ্রমণের ফাঁকে, পেতরারকা এবং বোক্কাচ্চিও-র সাথে চসারের ব্যক্তিগতভাবে দেখা হয়েছে; সাহিত্য নিয়ে আলাপ-সালাপও হয়েছে তখন। জানা যায়, ১৩৭৩ সালে ইতালির পাদোয়া শহরে পেতরারকার সাথে সামনাসামনি আলাপ হয়েছিল চসারের। তার আগে ১৩৫০ সালে তোস্কানার গণমানুষের মুখের ভাষায় মধ্য-ইতালির বিখ্যাত একটি লোকগাথা ‘গ্রিসেলদা’-র পুনর্লিখন করেছিলেন বোক্কাচ্চিও এবং পরে পেতরারকা তা মধ্য-ইতালির ভাষা থেকে লাতিনে অনুবাদ করেছিলেন। এমন কোনও একটা আলাপচারিতায় বোক্কাচ্চিও-র লেখা ‘গ্রিসেলদা’-র সংস্করণ নিয়ে চসারের সাথে আলাপ করেছিলেন পেতরারকা। এর পরে আমরা দেখতে পাই, পেতরারকা অনূদিত বোক্কাচ্চিও-র ‘গ্রিসেলদা’-র লাতিন সংস্করণটি চসার মিডিল ইংলিশ ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন। গবেষকেরা বলছেন, ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘দ্যা ক্লার্কস্ টেইল’ অংশে সেই অনুবাদ সরাসরি ব্যবহার করেছেন চসার। গবেষকরা আরও বলছেন, চসারের কাজের ওপরে দান্তের কাজের প্রভাবও সুস্পষ্টই বলতে হবে; যদিও দান্তের সাথে তাঁর ব্যক্তিগতভাবে দেখা হয়নি বলেই জানা যায়। ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘সেকেন্ড নানস্ টেইল’ চ্যাপ্টারে চসার তোস্কানা এবং সিচিলিয়ার লৌকিক ভাষায় লেখা দান্তের মহাকাব্য ‘কোমেডিয়া’ থেকে নেয়া কাব্যাংশ নিজের মতো করে সংযোজন করেছেন।
ইতালির তিন সাহিত্যগুরুর ভেতরে জেফ্রি চসারকে সবচাইতে বেশি প্রভাবিত করেছেন জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও। গবেষকেরা বলছেন, তোস্কানার গণমানুষের মুখের ভাষায় লেখা বোক্কাচ্চিও-র গীতিকাব্য ‘ইল ফিলোস্ত্রাতো’ [১৩৩৫ অথবা ১৩৪০] পড়ে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন চসার এবং লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার লৌকিক মিডিল ইংলিশে তিনি লিখেছিলেন ‘ত্রোইলুস এন্ড ক্রেসিদা’ [১৩৮০] নামের গীতিকাব্য। চসারের ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ [১৩৮৭—১৪০০]-এর ২৪টি গল্পে আমরা এভাবে তোস্কানার স্থানীয় ভাষায় বোক্কাচ্চিও যেসব কাজ করেছিলেন তারই বেশি প্রভাব দেখতে পাই। তখনকার ফ্লোরেন্সের জনপ্রিয় এবং প্রভাবশালী নারীদেরকে নিয়ে লেখা বোক্কাচ্চিও-র ‘দে মুলেইরিবাস ক্লারিস’ [১৩৬১—৬২]-এর অনুকরণে চসার ইস্ট-মিডল্যান্ডের লৌকিক ভাষায় লিখেছিলেন তাঁর ডাইডাক্টিক গদ্য ‘দ্যা লেজেন্ড অফ গুড উইম্যন’। এই ‘দ্যা লেজেন্ড অফ গুড উইম্যন’ লেখা হয়েছিল ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ এবং ‘ত্রোইলুস এন্ড ক্রেসিদা’-র কিছু পরে।
জেফ্রি চসার যখন ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন নিজস্ব এলাকার মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহারের বেলায় ইংল্যান্ডে একটি সুবিধেজনক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা জানি, চৌদ্দ শতক থেকে ষোল শতক অবধি বহমান ইতালির রেনেসাঁ সারা ইউরোপে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিকাশ ঘটিয়েছিল...
গবেষণায় দেখা যাচ্ছে, ফ্লোরেন্সের গণমানুষের মুখেমুখে গড়ে ওঠা স্থানিক ভাষায় লেখা বোক্কাচ্চিও-র নোভেল্লা ‘ডেকামেরন’ [১৩৪৮—৫৩]-এর প্রভাবও ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ জুড়ে। লাতিনভাষায় ‘দেস কাসিবাস ভিরোরাম ইলাস্ত্রিয়াম’ [১৩৫৫—৭৪]-এ ফ্লোরেন্স এলাকার বিখ্যাত ব্যক্তিদের পতনের গল্প লিখেছিলেন বোক্কাচ্চিও। মিডিল ইংলিশ ভাষায় লেখা চসারের ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘দ্যা মঙ্কস্ টেইল’-এ বোক্কাচ্চিও-র সেই গল্পের বিভিন্ন মঙ্কের চরিত্রের মিল পেয়েছেন গবেষকরা। এছাড়া ফ্লোরেন্সের লৌকিক ভাষায় ‘তেসেইদা’ নামে বোক্কাচ্চিও একটি দীর্ঘ মহাকাব্য লিখেছিলেন ১৩৪০-৪১ সময়কালে। চসার এই মহাকাব্যটিকে সংক্ষিপ্ত করে মিডিল ইংলিশ ভাষায় জুড়ে দিয়েছেন তাঁর ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘দ্যা নাইটস্ টেইল’ চ্যাপ্টারে। চসারের ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘দ্যা শিপম্যানস্ টেইল’-এ বোক্কাচ্চিও-র নোভেল্লা ‘ডেকামেরন’-এর এবং ‘দ্যা ফ্রাঙ্কলিন টেইল’-এ বোক্কাচ্চিওরই উপন্যাস ‘ইল ফিলোকিলো’-র ছায়াও দেখতে পেয়েছেন গবেষকেরা। এভাবেই বোক্কাচ্চিও-র রূপকধর্মী ডাইডাক্টিক—‘কমেডিয়া দেল্লে নিনফে ফিওরেন্তাইন’ [১৩৪১—৪২]-এর প্রভাব আমরা দেখি ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এর ‘দ্যা মার্চেন্টস্ টেইল’ চ্যাপ্টারে।
এতক্ষণের আলোচনা থেকে আমরা বলতে পারি, রেনেসাঁ-পূর্ব ইতালির সাহিত্যের মধ্যযুগের তিনজন প্রথিতযশা কবি ও কথাশিল্পী—দান্তে আলিঘেইরি, ফ্রানচেস্কো পেতরারকা এবং জিওভান্নি বোক্কাচ্চিও গণমানুষের মুখের ভাষায় যে-সাহিত্যকর্ম রচনা করেছিলেন তা সুস্পষ্টভাবে প্রভাবিত করেছিল ইংরাজি সাহিত্যের গুরু জেফ্রি চসারকে। এদের কাজই ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’-এ লন্ডন ও তার সন্নিহিত এলাকার লৌকিক ভাষার প্রয়োগের ক্ষেত্রে চসারের প্রেরণার উৎস বলে গবেষকদের বৃত্তে বিবেচিত হয়েছে।
জেফ্রি চসার যখন ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ লেখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তখন নিজস্ব এলাকার মানুষের মুখের ভাষা ব্যবহারের বেলায় ইংল্যান্ডে একটি সুবিধেজনক রাজনৈতিক পরিবেশ তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমরা জানি, চৌদ্দ শতক থেকে ষোল শতক অবধি বহমান ইতালির রেনেসাঁ সারা ইউরোপে ব্যক্তি-স্বাধীনতার বিকাশ ঘটিয়েছিল। কাজেই বিভিন্ন ঔপনিবেশিক অবদমন থেকে মুক্ত হয়ে উঠছিল ইউরোপের মানুষজন। এছাড়া, তখন ক্যাথলিক চার্চের করায়ত্ত হ্রাসেও দারুণ ভূমিকা রেখেছিল ইতালির রেনেসাঁ। তাই ঔপনিবেশিক লাতিনভাষাতে যে সাহিত্য রচনা করতেই হবে এমন কোনও বাধ্যবাধকতা আর ইংল্যান্ডে রইল না। সাম্রাজ্যবাদী লাতিনভাষার রাজনৈতিক অবদমন কমে এল বলেই হয়ত জেফ্রি চসার নিঃসঙ্কোচে নিজেদের প্রাণের ভাষায় সাহিত্যের প্রকাশ ঘটাতে সচেষ্ট হয়েছিলেন। এছাড়া বলতে হবে, ১৩৮৭-১৪০০ সময়কালে চসার যখন ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ লিখলেন ততদিনে ইংল্যান্ডে অ্যাংলো-নরমান শাসন দুর্বল হতে হতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে; দখলদার নরমানরা নানাভাবে আত্মীকৃত হয়ে গেছে অ্যাংলো-সেক্সনদের হাতে গড়া ইংলিশ সমাজে। বিচিত্র নয় যে, এমন একটা রাজনৈতিক শিথিলতাও চসারকে নরমানদের চাপিয়ে দেয়া ফরাসিভাষা ফেলে নিজেদের মাটির সৌগন্ধ যে-লৌকিক ভাষায় লেগে ছিল সেই ভাষাতে সাহিত্য রচনা করতে প্রলুব্ধ করেছিল।
সম্ভবত এভাবেই ঔপনিবেশিক ফরাসি ও লাতিন ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে চসার তাঁর নিজের লন্ডনের ইস্ট-মিডল্যান্ড এলাকার মানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে উদ্বুদ্ধ হয়েছিলেন। চসারের এই যুগযন্ত্রণাকে রোমান ও নরমান-ফরাসিদের উপনিবেশবাদের অবদমনের বিরুদ্ধে সুস্পষ্ট একটি বিদ্রোহ বলেই মনে হয়। রোমান সাম্রাজ্যের পতনের পরপর, বার শতকের দিক থেকে, ঠিক এভাবেই রোমান উপনিবেশবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজেদের এলাকার গণমানুষের মুখের ভাষায় সাহিত্য রচনা করতে নেমেছিলেন পয়লাতে অক্সিতানিয়া এবং তার অনুবৃত্তিক্রমে উত্তর ও মধ্য-ইতালির গীতিকবিরা। জেফ্রি চসার যে-সময়টাতে ‘দ্যা ক্যানটারবারি টেইলস্’ লিখেছিলেন তারও দুশো বছর আগের কথা সেটা।
ধন্যবাদ, ইংরেজিসাহিত্যের বিষয়ে প্রাথমিকধারনা শুরু হল।আরো লেখার প্রত্যাশায় রইলাম ।
বিপ্লব
মে ০১, ২০২১ ১৯:১০