মমতাজউদদীন আহমদের পরিচয়

 

জীবনী কি কেবলই ব্যক্তিমানুষের ঘরসংসার, টানাপোড়েন, আত্মস্তুতি নয় বরং এসবের সঙ্গে যোগ হয় সমাজ, রাজনীতি, পরিবেশ পরিস্থিতি, মনোবিশ্লেষণ, দর্শন। সব একসঙ্গে মিলেই একটি জীবনগাথা বা আমরা যাকে বায়োগ্রাফি বা জীবনী বলি, তা-ই হয়ে ওঠে। আর সেই জীবনীগ্রন্থ মানুষকে সাহস জোগায়, অনুপ্রেরণা দেয়, স্বপ্ন দেখায়। একেকটি জীবনীগ্রন্থ রীতিমতো একেকটি বাস্তব ইতিহাসের সাক্ষী। তা ছাড়া কোনো একজনকে মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার আদর্শ-লক্ষ্য নির্ধারণ, স্বপ্ন দেখা, সাহসী হয়ে ওঠা, হতাশা কাটিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করা ও শক্তিময় হয়ে ওঠার রসদ জোগায় একজন মহান-মহৎ পূর্বপুরুষের জীবনী। তাই তো?

তেমনই একটি মমতাজউদদীন আহমদের আত্মজীবনী এই তো আমি শত ঘাত-প্রতিঘাত, সফলতা, ব্যর্থতা বয়ে বহু পথ, বাঁক পেরিয়ে আসা বর্ণিল মানুষের আত্মবয়ান। এই বয়ানে দেশভাগ আছে, আছে তার যন্ত্রণা, সমাজ বদলে যাওয়া, বদলে দেওয়ার দুর্বার আকাঙ্ক্ষা, স্বার্থের বিষবাষ্প, মৌলবাদ, চাটুকার তোষামোদি মানুষের কথাও। এই সব জীবনকথা নিয়ে বইটিতে সহজ সুন্দর ছন্দে কুলকুল করে বয়ে চলা টাঙন নদীর মতো জীবন মেলে ধরেছেন মমতাজউদদীন।

মমতাজউদদীন আহমদ কত তাঁর পরিচয়অধ্যাপক, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তবে বাংলাভাষী মানুষের কাছে তাঁর প্রথম ও শেষ পরিচয় নাট্যকার হিসেবেই। নাট্যকার পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরতে তাঁর নিজের আগ্রহেরও কোনো শেষ ছিল না। মমতাজউদদীন বিশ্বাস করতেন, বাংলা নাটকের বৃহত্তম ক্ষেত্র বাংলার লোকজীবন ও লোককাহিনির মধ্যে নিহিত। নাটকের মধ্যে তিনি দেখতে ও দেখাতে চেয়েছেন বাংলার জীবন ও জনপদকে, বাংলার লোকায়ত লোকসকলকে উচ্চারণ করেছেন, দৃঢ়কণ্ঠে, এই কথা: বাংলাদেশের নাট্যচর্চায় অভিনব কোনো বিশেষ কিছু চাইনি আমি। তবে বাংলাদেশের নাটকে বাংলাদেশকে চেয়েছে আমার মন। আমি হৃদয় খুলে বসে আছি, দীর্ঘ ষাট বছর এমন নাটক দেখব আমি, যেখানে আমার প্রকৃতি, অরণ্য, পশু, মানুষ এবং আমার প্রেম কথা বলে। এমন ক্রন্দন দেখব, যেখানে আমার মায়ের ব্যাকুল দুটি আঁখি সজল হয়ে থাকে। এই বিশ্বাস ও আকাঙ্ক্ষায় স্থির থেকে মমতাজউদদীন আহমদ লিখে গেছেন একের পর এক নাটক। তাঁর নাটকে আমরা লক্ষ করি, মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা আলোড়ন-বিলোড়ন, মূল্যবোধের সংকট, রাজনৈতিক স্বেচ্ছাচার, স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতি এবং উত্তরণের আহ্বান। শিল্পী মমতাজউদদীন আহমদের স্বাতন্ত্র্য এখানে যে নিখিল নিরাশার প্রান্তরে বাস করেও তিনি মানুষকে শোনান আশার সংলাপ, তাঁর সৃষ্টিসম্ভার হয়ে ওঠে অনিঃশেষ শান্তিকামী আলোর অপরূপ উৎসব। এমন একজন মানুষের জীবনকথা কেমন বৈচিত্র্যময় হতে পারে, তা তাকে না জানলে জানা অসম্ভব। তাই দুই খন্ডের এই তো আমি মমতাজউদদীন আহমদ এর আত্মজীবনী বইটি পড়লে জানা যাবে অন্তরালের মানুষটিকে। প্রথম উৎসর্গপত্র থেকে শুরু করে প্রস্তুতিকথা পর্যন্ত পড়লে একটা কথা স্পষ্ট হয়, বাবা-মায়ের দেওয়া জীবন ও স্কুলজীবনে দেখা দেশভাগ এবং তার পরের জীবন প্রথম খন্ডে শেষ হয়েছে মুক্তিযুদ্ধ শেষ করে বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের মধ্য দিয়ে। শেষ পাতায় চোখ রাখি- শ্যামল বাংলার সন্তান আমি। আমার জীবন কথার পরতে পরতে অনেক ভাবনা আর দুঃখ-সুখের কথাই আমার জীবনকথা। এবার সেই কথা বলব- এই আমি আর এক আমি তাই নিয়ে নতুন এক এই তো আমি হব। সুখ হোক বাংলার, সুখী হোক বাঙালি। তমিজউদ্দীন মিঞা নামটি আকিকার পরে ইয়াকুব আলি পণ্ডিতের প্রতিক্রিয়ায় কী করে মমতাজউদ্দীন মিঞা হলো, সে কথা পড়তে পড়তেই পাঠক জেনে যায় মঞ্জুর ডাকনামটি কতটা ব্যথা জাগাত বা প্রিয় বালিকা যখন চুপি চুপি একা পেলে ডাকত মনজু বলে, তা কতটা শিহরিত করত। ফুফার বদৌলত নামে আবার পরিবর্তন এলো, মমতাজউদ্দীন মিঞা হয়ে গেলেন মমতাজউদ্দীন আহমেদ। যদিও কবে থেকে বা কী কারণে মমতাজউদদীন আহমদ হলেন, তা মনে করতে পারেন না; তবে কবি জসীমউদ্‌দীন নামের বানান আগ্রহী করেছিল তাঁকে বলে অনুমান করেন। জন্মতারিখ নিয়েও তিনি লিখেছেন, আমরা যারা ১৮ জানুয়ারি ১৯৩৫ কে তাঁর জন্মতারিখ হিসেবে জানি। তিনি বলছেন, এটি ভুল। ১৯৫১ সালে দেশভাগের পরে মালদা জিলা স্কুল ও মুসলমান ছাত্রাবাস থেকে বিতাড়িত মমতাজউদদীন ১৯৫১ মার্চ মাসে ম্যাট্রিক ফাইনাল পরীক্ষার ফরম পূরণে ভোলাহাট স্কুলের প্রধান শিক্ষক যোগেশবাবুর জন্য যে জন্মতারিখ ও সাল আমরা পাই, আদতে তা হবে ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৩৩।

প্রথম খণ্ড শেষ করে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথমেই আমার কথায় মমতাজউদদীন লিখছেন- ধারাবাহিকভাবে যদি কথা শুনতে চান, তবে আমার কথা পড়ে খুব সুখ পাবেন না। কেননা, আমি ইতিহাস লিখতে বসিনি, কেবল কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি।

নিজের পরিবার ও বাবার কথা বলতে গিয়ে লেখক এখানে নির্মোহভাবেই কথা বলেছেন। সমালোচনা করেছেন বাবার আচরণ, বৈশিষ্ট্য, ভুলভ্রান্তিগুলো নিয়ে। সাধারণত একজন ব্যক্তি তাঁর পরিবার তথা বাবা-মায়ের সম্পর্কে বলতে গেলে তাদের ভালো দিকটাই বলেন। সাবধানে এড়িয়ে যান মন্দ দিকগুলো। চেতনায় কাজ করে, বাবা-মা যা-ই করুন না কেন, তাঁদের ভুল ধরতে নেই। বাবার সম্পর্কে বলতে গিয়ে তিনিও ভেবেছেন বড় রূঢ় হয়ে গেল কি! তারপরও দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন, বাবার ভীরুতা তাঁকে স্বস্তি দেয়নি। বাবাকে শীর্ষ স্থানে বসিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষা পোষণ করেননি। বাবার মধ্যে নির্লজ্জ নৈতিকতাহীনতা, তোষামুদে ভাব দেখেছেন। যা নিয়ে বলায় তিনি অকপট। আবার সততা, হিসেবি, কর্মঠ, নিষ্ঠার কথাও জানিয়েছেন।

টাঙন নদী বয়ে যাওয়া ছবির মতো সুন্দর মালদহ জেলার হবিবপুর থানার আইহো গ্রামে জন্ম নেওয়া মমতাজউদদীনের এই আত্মজীবনীতে আমরা যেমন তাঁর জীবন পাই, তেমনি জানা-অজানা অনেক ইতিহাস নতুন করে জানতে পারি। জানতে পারি দেশভাগ-পরবর্তী সময়ের কথা। তাঁর পারিবারিক গল্প যেমন আছে, আছে তাঁর ভাইবোনদের কথা। দশ ভাইবোনের মধ্যে তিনিই একমাত্র উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করেছেন। শিক্ষা গ্রহণের জন্য তাঁকে ছাত্রাবস্থায় কাটাতে হয়েছে মামা, ফুফু, খালা, কাকার বাসায়। সেই পরাণুগ্রাহী জীবন সব সময় সন্তোষজনক ছিল না। কিন্তু অধিক সচেতনতার কারণে, বিকল্প কোনো উপায় ছিল না বলে নীরবে সয়েছেন অনেক না পাওয়া। এমন সব ক্ষুদ্রতা ও সংকীর্ণতার মধ্যে পড়েছেন যে মাঝে মাঝে তিনি বিদ্রোহীও হয়ে উঠতেন কিন্তু অপরাপর বিবেচনায় শামুকের মতো নিজেকে গুটিয়েও নিতেন। সেই সব দিনের বঞ্চনা, অত্যাচার, অপমান তাচ্ছিল্যের কথা কোনো দিন জানতে দেননি কাউকে। সেই সব দিনে এক দুর্বৃত্ত জুয়াড়ির বংশধর হিসেবে হীনম্মন্যতাও কি জাগত মনে। নিজের কথা বলতে গিয়ে আত্মীয়-পরিজনের খারাপ যেমন বলেছেন, তেমনি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁদের স্নেহ-মমতার কথাও জানান দিয়েছেন উদার হয়ে। বাবা-মায়ের ভালোবাসা-স্নেহহীনতা, বঞ্চনার কথা লোকসমক্ষে বলা সহজ নয় মোটেও! সেই কাজটিই যখন কেউ করেন, তখন বুঝে নিতে হবে জখমটা কতখানি। কতটা ভার বয়ে বেড়িয়েছেন অত্যন্ত সংবেদনশীল এই মানুষ। প্রিয়জনদের বঞ্চনা, অনাদর, অবহেলা প্রায়শই মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করে। মমতাজউদদীন আহমদের ক্ষেত্রে তা বরং শাপে বর হয়েছে। মনের অবাধ সৌন্দর্যই তাকে বিপথগামী না করে আজকের বরেণ্য মমতাজউদদীনে পরিণত করেছে।

রাজশাহী যাবার পরে সেখানকার কলেজ জীবন পড়তে পড়তে পাঠক অমুসলিমদের সম্পর্কে সহানুভূতিহীন সাম্প্রদায়িক ভাবনার এক বিদ্বেষী কিশোরকে বদলে যেতে দেখবে অসাম্প্রদায়িক চেতনার উদারতায়। ছাত্ররাজনীতির সদস্য হলেও সাহিত্য ও ভাষার শিক্ষক বলে তাঁর কর্মজগতের সঙ্গে রাজনীতির সংযোগ ছিল না। মমতাজউদদীনের চোখে সমসাময়িক সময় ও রাজনৈতিক ঘটনাক্রম পড়তে পড়তে পাঠকের বিরক্ত লাগবে না কিন্তু অজানা অনেক ইতিহাস বা ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায় সেসব ঘটনা বা গভীরের কথাগুলো সেভাবে কোনো ইতিহাসের পাতায় লিপিবদ্ধ হয়নি। নাটকে অভিনয় নিয়ে রাজনৈতিক কথাবার্তার মাঝেই তিনি তারাপদের বন্ধুর ভূমিকায় অভিনয় করে পাওয়া খ্যাতির সঙ্গে জানান চাকরের ভূমিকায় অভিনয় করায় বাবার দুঃখ পাবার কথা। প্রথম খন্ডেই মমতাজউদদীনের বিয়ের গল্প পাবে পাঠক। ২৬ অক্টোবর, ১৯৬৩ সালে বিয়ে করলেন মমতাজউদদীন, যদিও প্রথমে বিয়ের দিন ঠিক হয়েছিল ২৭ অক্টোবর কিন্তু ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান সামরিক শাসনের বলে ক্ষমতা দখল করেছিলেন বলে ওই দিন বিয়ে করেননি মমতাজউদদীন। শুধু জীবনের অন্যতম সেরা দিনের সাথে আইয়ুব খানকে মেলাবেন না বলে।

প্রথম খণ্ড শেষ করে দ্বিতীয় খণ্ডের প্রথমেই আমার কথায় মমতাজউদদীন লিখছেন- ধারাবাহিকভাবে যদি কথা শুনতে চান, তবে আমার কথা পড়ে খুব সুখ পাবেন না। কেননা, আমি ইতিহাস লিখতে বসিনি, কেবল কয়েকটি কথা বলতে চেয়েছি। প্রথম খণ্ড শেষ করে পাঠকের মনে হতেই পারে ধারাবাহিকভাবে সত্যিই কথা নেই। সময় ধরে লেখাটি সত্যিই এগোয়নি। লেখক ইতিহাস লিখতে বসেননি বললেও লেখকের অজান্তেই অনেক ইতিহাস উঠে এসেছে, যা সময়কে ধরতে এবং ঘটনাক্রমের সাথে লেখকের সম্পৃক্ততা বা সময়কালকে নিজের পরিস্থিতি দিয়ে বোঝাতে বা নিজের পরিস্থিতি এবং সেই সময় মিলেমিশে ইতিহাসই হয়ে উঠেছে অনেকখানি। কেননা সমাজ বহতা জীবনের প্রতিচ্ছবি। সেখানে নানা ঘাত-প্রতিঘাত, নানা উত্থান-পতন। রাজনৈতিক-সামাজিক-অর্থনৈতিক-ধর্মীয় নানা তরঙ্গ-বিক্ষোভে সে জীবন সর্বদাই অস্থির। মমতাজউদদীনের জীবন দেশ-কাল-বিচ্ছিন্ন কোনো জীবন নয়, বরং নানা ঘটনার তরঙ্গে আন্দোলিত সে জীবন। তাই তাঁর লেখায় সমাজ-সভ্যতা, রাজনীতি-ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ নানা দিকের নানা তথ্য উঠে এসেছে, যা ইতিহাসের অন্যতম উপাদান বা ঐতিহাসিক দলিলও। দ্বিতীয় খণ্ডের শুরুতেই পাঠক এমন একটি বিষয়ের মুখোমুখি হবে, যা এখন পর্যন্ত সত্য। রাজধানীর বাইরে থেকে শিল্পসাহিত্য হয় না। মমতাজউদদীনের লেখাতেও সেই সত্যতার দেখা মিলবে। বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ষোলো বছর কাটানোর পরও তাঁর মনে হয়েছে, সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার কথা বলছি। দিনরাত পরিশ্রম করছি, সব সুযোগের ব্যবহার করছি, কিন্তু আমার এত সব শ্রম প্রচেষ্টা তার পরিচয় ব্যাপ্ত হচ্ছে না সারা দেশে। বাংলাদেশের মতো ছোট দেশে সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতি সাধন রাজধানীর বাইরে অন্য কোনো শহরে বা অঞ্চলে পূর্ণতা নিয়ে বিকশিত হবে না, মূল জায়গায় না গেলে। চাটগাঁ যদিও বড় শহর। বাণিজ্যনগরী হিসেবে চাটগাঁর নিজস্ব ধারা আছে। এখানে সাহিত্যচর্চা ও সংস্কৃতির সাধন তেমনভাবে ক্ষেত্র রচনা করতে পারবে না। চাটগাঁ ক্রমেই আমার কাছে বদ্ধ জলাভূমি মনে হতে লাগল। আমি রাজধানীমুখী হবার জন্য উন্মুখ হলাম। দ্বিতীয় খণ্ডের পাতায় পাতায় দেখা মিলবে ঢাকার নাট্যাঙ্গন, নানা গুণীজনের ও তাদের নানা রকম কর্মকাণ্ডের। এখানেও বঙ্গবন্ধুর পরবর্তী সময়ের স্বদেশ তার শাসকদের কথা আর ইতিহাস চোখে পড়বে এবং নাটক নিয়ে নানা ভ্রমণের কথা শোনাবেন মমতাজউদদীন। স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশের নাট্য আন্দোলনে তিনি পথিকৃৎ। বাংলাদেশের নাটকের কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবে এই নাট্যকারের জীবন ও সৃষ্টি উঠে আসবে। তাঁর মতো নাট্যকারেরাই জাগরণ সৃষ্টি করেছেন এ দেশের নাট্যাঙ্গনে। এক অঙ্কের নাটক রচনায় তিনি ছিলেন পথিকৃৎ। পূর্ব পাকিস্তানের নাট্য আন্দোলন থেকে শুরু যার সূচনা, তারপর একাধারে ভাষা আন্দোলন, ৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান মুক্তিযুদ্ধ, গ্রুপ থিয়েটার আন্দোলন, স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনসমস্ত আন্দোলনে যিনি ছিলেন প্রথম সারির মানুষ। যিনি বাংলাদেশে নাটককে এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে দিয়েছেন। নাটক থেকে গণতান্ত্রিক সব আন্দোলনে যিনি ছিলেন অনবদ্য অংশ। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে জড়িত ছিলেন না। কিন্তু বাংলার মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলার অসাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির প্রতি তাঁর বিশ্বাস ছিল অনেক গভীরে। মৌলবাদী ও মৌলবাদের ভেক ধরা ধান্দাবাজদের কাছে তাঁর উপস্থিতি সহনীয় ছিল না, এটা তিনি জানতেন। তিনি জানতেন নব্য আলখাল্লাধারীদের জটিল-কুটিল ধান্দাবাজি। এই সব জটিল-কুটিল রংবদলের জাদুকরদের তিনি ঘৃণা করতেন। তাঁর ভেতরে বাস চর্যাপদ, মঙ্গলগীতি, বৈষ্ণবগীতি, রবীন্দ্রনাথ, মধুসূদন। তিনি এসব ছাড়া বাংলার সুষমা ভাবতেই পারেন না। হৃদয়ে তাঁর মসজিদ, মন্দির, হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ- খ্রিস্টান সকলের সম্মিলিত সহাবস্থান। এক আমির মধ্যে অনেক মিশ্রণ অনেক যোগ-বিয়োগ। বাংলা বাঙালি, প্রকৃতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সাহিত্যসবই তাঁর আপন। অত্যন্ত প্রিয়।

মমতাজউদদীনের জীবন দেশ-কাল-বিচ্ছিন্ন কোনো জীবন নয়, বরং নানা ঘটনার তরঙ্গে আন্দোলিত সে জীবন। তাই তাঁর লেখায় সমাজ-সভ্যতা, রাজনীতি-ধর্মবিশ্বাস, আচার-আচরণ নানা দিকের নানা তথ্য উঠে এসেছে, যা ইতিহাসের অন্যতম উপাদান বা ঐতিহাসিক দলিলও

বিশ্বব্যাপী বাংলা ও বাংলাদেশের নাটককে সর্বমহলে যিনি তুলে ধরেছেন জীবনব্যাপী একাগ্র চিত্তে। মমতাজউদদীন আহমদ বাঙালির সংগ্রামী ঐতিহ্যকে পৌনঃপুনিকভাবে তাঁর নাটকে ব্যবহার করেছেন শিল্প উপাদান হিসেবে। এ প্রেক্ষাপটে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য তাঁর সাতঘাটের কানাকড়ি। এ নাটকে শিল্পরূপ পেয়েছে বাঙালির সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ চেতনা। শোষকের বিরুদ্ধে সমুত্থিত বাঙালির রুখে দাঁড়ানোর এক বিশ্বস্ত নাট্যদলিল এই নাটক। মমতাজউদদীনের নাট্যভুবনের বিশাল এলাকাজুড়ে আছে নির্মল ও পরিশীলিত কৌতুক ও হাস্যলাস্য। প্রসঙ্গত স্মরণ করা যায়, তাঁর হাস্যলাস্য ভাষ্য, হৃদয়ঘটিত ব্যাপার-স্যাপার, প্রেমবিবাহ সুটকেস, দশটি রগড় নাটিকা ইত্যাদি রচনার কথা। কেবল মৌলিক নাটক নয়, রূপান্তরিত নাটকের ক্ষেত্রেও তিনি রেখেছেন স্বকীয় প্রতিভার স্বাক্ষর। জমীদার দর্পণ, নীল দর্পণ, দুই বোন প্রভৃতি নাটক এ প্রসঙ্গে স্মরণযোগ্য। আবার মমতাজউদদীন আহমদের নাটকে আঙ্গিক নিরীক্ষার স্বকীয়তার পরিচয় পাওয়া যায় রাজা অনুস্বারের পালা নাট্যে। এই রচনায় মৈয়মনসিংহ গীতিকার রূপকল্প ব্যবহার করে নাট্য আঙ্গিক নির্মাণে অভিনবত্ব ও আধুনিকতার পরিচয় দিয়েছেন তিনি। কলকাতায় জমীদার দর্পণ নাটক মঞ্চায়ন নিয়ে মমতাজউদদীন এখানে লিখেছেন, আমাদের জমীদার দর্পণ দেখে কলকাতার আধুনিক দর্শক অভিজ্ঞ দর্শক বেশ তৃপ্ত হয়েছেন। একই দর্শক পরের দিন সপরিবার এসেছেন, এমনও দেখেছি। আকাশবাণী কলকাতার নাট্য-প্রযোজক জগন্নাথ বসু আমাকে বলেছিলেন, আপনাদের নাটক সম্পর্কে আমার কাছে বিরূপ তুচ্ছতার সংবাদ ছিল, কিন্তু দেখে বুঝলাম, আপনারা সত্যিই ভালো এবং স্মরণীয় কাজ করছেন। উচ্চকন্ঠে বলেছিলেন, কলকাতার তথাকথিত নাট্যকর্মীদের বলতে চাই এ নাটকটি আপনারা দেখেন, একাধিকবার দেখেন। দেখে শিখুন বাংলার কৃষকের জীবনযাপন কতখানি সংগ্রাম আর ত্যাগের দ্বারা সিদ্ধ। ১৯৯৯ সালে হজযাত্রা করেন মমতাজউদদীন। হজযাত্রা পালনে অপ্রস্তুত এই মানুষটির লেখায় দেখা মিলবে অন্য রকম এক হজযাত্রার বিবরণ, যা আদতে পাঠক সচরাচর পড়তে পারে না কোনো লেখায়। কী লিখেছেন তার কোট দিতে হবেমমতাজউদদীন আহমদ ছিলেন অসম্ভব ক্ষুরধার প্রাবন্ধিক, গবেষক। নিজের সমগ্র শিক্ষকতা জীবন, শিল্পকলা একাডেমিতে গবেষণা ও প্রকাশনা বিভাগের পরিচালক, জাতিসংঘের বাংলাদেশের স্থায়ী মিশনে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী ও পরবর্তীকালে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি প্রণয়নে বিশেষজ্ঞ থাকাকালীন এক দিনের জন্যও তাঁর নিজস্ব গবেষণা থেমে থাকেনি। ছিলেন যেমন বহুমাত্রিক লেখক, ঠিক তেমনি নাট্য রচনা, নাট্য নির্দেশনার বাইরে নিজ দায়িত্বেই লিখেছেন বাংলাদেশের নাটকের ইতিবৃত্ত ও বাংলাদেশের থিয়েটারের ইতিবৃত্ত নামে দুটি অমূল্য গবেষণা। তাঁর গদ্য রচনার সৃষ্টিও ছিল বিস্তৃত। চার্লি চ্যাপলিন-ভাঁড় নয় ভবঘুরে নয়, আমার ভিতরে আমি, জগতের যত মহাকাব্য, লাল সালু ও সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ, মহানামা কাব্যের গদ্যরূপ, সাহসী অথচ সাহস্য, নেকাবি এবং অন্যগণ, জন্তুর ভিতর মানুষ' এর মতো বিশাল গদ্যভাণ্ডার ছিল অসামান্য। ভাষা আন্দোলন নিয়ে তিনি লিখেছিলেন 'একুশ আমার বাংলা আমার', লিখেছিলেন শিশুসাহিত্য ও কিশোর রচনা, সরস রচনা। তিনি একাধারে ছিলেন ঔপন্যাসিক। সজল তোমার ঠিকানা, এক যে জোড়া, এক যে মধুমতির মতো উপন্যাসের জন্ম তাঁর হাতে। অনুবাদক হিসেবে মমতাজউদদীন আহমদের কথা না বললেই নয়। বিশেষ করে ফেরদৌসির রচিত শাহনামা তিনি অনুবাদ করেছিলেন। তার সৃষ্টির বিস্তৃতি যে কতখানি ছিল, তা অবর্ণনীয়। সমস্ত কিছুর বাইরে কেবল এক অতুলনীয় নাট্যকারের পরিচয়ই সবার আগে আসে। বাংলা ও বাংলাদেশের নাটকে তিনি যে জোয়ার আর সৃষ্টির মহিমায় মেতে উঠেছিলেন, তা বাংলা নাটককে এগিয়ে দিয়ে ছিল কয়েক যুগ। বাংলা নাটকের এই কিংবদন্তি স্রষ্টার হাত ধরে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের নাটক প্রাণ ফিরে পেয়েছিল। গণমানুষের ভাষ্য, নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের কথা, প্রান্তিক মানুষের জীবনাচার, লোককথা, স্বাধীনতা, মুক্তি, স্বপ্ন, স্বপ্নভঙ্গ, আশা, হতাশাসমস্তই উঠে এসেছিল তাঁর নাটকে। জন্ম নিয়েছিল বাংলা নাটকের এক নতুন ধারা। পূর্ব বঙ্গের বাংলা নাট্য আন্দোলন থেকে সমস্ত গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগের সৈনিক। তাই তো তাঁর সৃষ্টি, তাঁর কর্ম, তাঁর চিন্তা আর ভাবনার প্রসারতা যুগ যুগ টিকে থাকবে এই বাংলার বুকে। বাংলা নাটক যত দিন থাকবে, এই বাংলা ভাষা থাকবে যত দিন, এই বাংলাদেশ যতকাল রবে, তত দিন মমতাজউদদীন আহমদ থাকবেন চিরস্মরণীয় হয়ে। তাঁর আত্মজীবনী পড়া শেষ করে মনে হবে আরও কিছু হয়তো বলতে চেয়েও বললেন না তিনি। অনেকটা সেই ছোটগল্পের মতো শেষ হয়েও যেন শেষ হলো না। তাই হয়তো তিনি নিজেই লিখেছেন, আমার স্মৃতিচারণ শেষ হলো। তাই কি! আমার সব কথা, যাবতীয় কর্মকাণ্ড বলতে পারলাম কি পারলাম না, তা আমি নিশ্চিত নই। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র, সরব নীরব বহু কথা হাজার কথা আমার বলা হলো না। না বলা বা বলতে না পারা অনেক কথার পরেও যখন এই দুই খণ্ডের আত্মজীবনীকে নিয়ে ভাববেন, আপনি একজন নিপাট ভালো মানুষের সাথে একজন স্বার্থহীন দেশপ্রেমিকের দেখাও পাবেন। নিজের আত্মসম্মানবোধ, আদর্শ বজায় রাখতে কখনো কোনো অন্যায়ের সঙ্গে আপোস করেননি। আজীবন একজন শিক্ষক হিসেবেই থাকতে চেয়েছেন, থেকেছেন। এতে ছিল তাঁর অপরিসীম আনন্দ ও তৃপ্তি। উচ্চাকাঙ্ক্ষা তাঁর কখনোই ছিল না। তাই তো তাঁর পক্ষেই সম্ভব হয়েছিল লিখে দেওয়া, আমি কখনোই কলেজের অধ্যক্ষ বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালক চেয়ারম্যান হওয়ার অভিলাষ পোষণ করব না।

এবং এটাও পাঠক নিশ্চিত হবে, তাঁর বহু পরিচয় অধ্যাপক, নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা, চিত্রনাট্যকার, মুক্তিযোদ্ধা সর্বোপরি একজন সংবেদনশীল মানুষ। তবে বাংলাভাষী মানুষের কাছে তাঁর প্রথম ও শেষ পরিচয় নাট্যকার হিসেবেই। নাট্যকার পরিচয়ে নিজেকে মেলে ধরতে তাঁর আগ্রহেরও কোনো শেষ ছিল না। গোটা জীবনের যে যাত্রার কথা এই বই দুটোতে তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন, তাতে এটা স্পষ্ট হয় যাপনের ঘটনাক্রম ও দেখা নানা রঙের জীবনকে তিনি কখনো না কখনো নাটকে রূপ দিয়েছেন বা বলা যায় তাঁর দেখা সময়কাল তাঁকে তৈরি করছে নাট্যকার হিসেবে আর উনি তাঁর আগ্রহকে যাপন করেছেন কর্মে ও জীবনে। আর তাই দেখি নাটকের মাধ্যমে নিজেকে মেলে দিতে চেয়েছেন তিনি, নাটকের মাধ্যমে চেয়েছেন মানুষকে জাগাতে, নাটককে অস্ত্র বানিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছেন মুক্তিযুদ্ধে, স্বৈরাচার আন্দোলন বা দেশের যেকোনো সংকটে। বাংলা নাটক তথা শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্যের ভুবনে এক আলোকিত মানুষ মমতাজউদদীন আহমদ। তাঁর নাটক দর্শক-পাঠককে উদ্বুদ্ধ করে শুভ চেতনায়, তাঁর নাটক সমাজের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধ হয়ে উঠতে অনুপ্রাণিত করে, আমাদের শোনায় আশা ও আশ্বাসের বাণী। তাঁর আত্মজীবনী পাঠ করলে মানুষ সাহসী হবে স্বপ্ন দেখায়। একা পথ চলায়।

একজন মমতাজউদদীনের যাপিত জীবনের পুরোটা দেখে নেওয়া যাবে এক মলাটে। বই দুটিতে প্রচুর বানান ভুল রয়েছে। সম্ভবত প্রকাশকের বই করার তাড়ায় বানান সংশোধনের সুযোগ হয়নি। লেখকও স্বীকারোক্তি করেছেন, তিনি তাড়া খাওয়া মানুষের মতো দ্রুতগতিতে লিখে শেষ করেছেন বই দুটি।

জীবনীগ্রন্থ দুটি রীতিমতো দীর্ঘ সময়ের অকপট সাক্ষী। তাই মানুষ হয়ে বেড়ে ওঠার আদর্শ-লক্ষ্য নির্ধারণ, স্বপ্ন দেখা, সাহসী হয়ে ওঠা, হতাশা কাটিয়ে মনোবল বৃদ্ধি করা ও শক্তিময় হয়ে ওঠার রসদ জোগাতে এই জীবনী বই দুটো অনন্য হয়ে উঠতে পারে যে কারও জীবনে।